৭
প্রত্যাবর্তনের পথে কেউ কোন কথা বলেননি। যে-যার চিন্তায় বিভোর ছিলেন। বিদ্যার্ণব যে উদ্দেশ্যে ব্যাসকাশীতে ছুটে গিয়েছিলেন—মহাযোগীর অলৌকিক ক্ষমতার সাহায্যে এই পার্থিব সঙ্কট থেকে উদ্ধারের পথ, তা পাননি; কিন্তু কী যেন একটা ব্যাপার ঘটেছে যা বুদ্ধি দিয়ে না বুঝলেও অনুভূতি দিয়ে বুঝতে পেরেছেন। বাবার কথাগুলো যেন ছিল দ্ব্যর্থবোধক—জীবাত্মা-পরমাত্মার সদুপদেশ—তদুপরি ঐ শঙ্খটার উল্লেখ! কী যেন এক গূঢ় সংকেত ছিল সেই আপাত-অসঙ্গত কথার। সে ব্যাসকূট ভেদ করতে পারেননি; কিন্তু স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন বিদ্যালঙ্কারের চোখে-মুখে যেন অদ্ভুত একটা দীপ্তি। শুধু দীপ্তি নয়। তৃপ্তি। কেন?
তিনজন যখন গুরুকুল চতুষ্পাঠীতে ফিরে এলেন বেলা তখন দ্বিপ্রহর। আম্রকুঞ্জে রমারঞ্জন বিদ্যার্থীদের নিয়ে অধ্যাপনরত। সে এ সময় তার গুরুদেবের মত আত্ম-সমাহিত হতে পারে না। ত্রিমূর্তিকে উদ্যানের ফটক অতিক্রম করতে দেখে সে যেন ভূত দেখল!
এতক্ষণ সে মনশ্চক্ষে দেখছিল বৃদ্ধ গুরুদেব তার সহাধ্যায়িনীর হাতখানি ধরে বাদশাহী সড়ক বেয়ে এগিয়ে চলেছেন পুবমুখো। কথা ছিল ওঁরা সড়ক ধরে যাবেন না, পারতপক্ষে বাদশাহী সড়কের সমান্তরাল, মেঠো পথে এগিয়ে যাবেন—পৌঁছাবেন সাসারাম। সেই যেখানে আছে বাদশাহ শের শাহর মারা। সেখানে থেকে রোহিতাশ্ব দুর্গ এক দিনের পথ। এই তিনটি দিন যদি সংবাদটা গোপন রাখা যায় তাহলেই কার্যসিদ্ধি। রোহিতাশ্ব দুর্গে ওঁরা আশ্রয় পেলে আর ভয় নেই। শুধু দেখতে হবে এই তিনদিনের ভিতর রাজাসাহেবের অশ্বারোহী গুপ্তচর আর কোতোয়াল যেন পলাতকদের নাগাল না পায়।
কিন্তু এ কী! যাত্রার সঙ্গে সঙ্গেই যে ওঁরা ধরা পড়ে গেছেন! না হলে মূর্তিমান আপদের মতো রামলগন কেন ওঁদের দুজনকে নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছে!
অর্গলবদ্ধ গৃহের নির্জনতায় দ্বারকেশ্বর ডাকলেন, মা! কাছে আয়। তুই কিছু বুঝতে পারলি!
রূপমঞ্জরী তার পোষা পাখিদের আহ্বার্য বিতরণ করছিল। কাছে ঘনিয়ে এসে বললে, পেরেছি, বাবা!
—আমারও তাই মনে হল। বাবার কথার মধ্যে স্পষ্টতই কিছু একটা গূঢ় ইঙ্গিত ছিল। তাই নয়?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
—আশ্চর্য! আমি তো কিছুই বুঝতে পারিনি।
—সেটাই যে স্বাভাবিক, বাবা। কাশীতে এসে আমি আমার পূর্বজীবনের কথা এ পাঁচ বছরে কাউকে যে বলিনি। আপনিও কোনদিন জানতে চাননি…..
—আজ বলবি?
—বলব। কিন্তু তার পূর্বে আমার কৌতূহলটা চরিতার্থ করুন। আপনি আমাকে মন্ত্রদীক্ষা দিতে স্বীকৃত হননি। বলেছিলেন, আপনি দীক্ষিত সন্ন্যাসী নন, এটাই বাধা। ঐ সঙ্গে আরও বলেছিলেন, মনে মনে আপনি আমার মন্ত্রগুরুকে নির্বাচন করে রেখেছেন…
—না মা! নির্বাচন করার কী অধিকার আমার? উনি নিতান্ত খেয়ালী মানুষ। ইদানীং কাউকে দীক্ষা দেননি এটুকু জানি। তবে শিশু ভোলানাথ তো! আমার মনের ইচ্ছাটা নিজে থেকেই পূর্ণ করতে চাইলেন।
—কিন্তু মাঝপথে থেমেও গেলেন। আপনি কি মনে করেন সবটাই ওঁর শিশুসুলভ চপলতা?
—না, নিশ্চয় নয়। সময় হলেই তিনি তোকে স্বপ্নাদেশে আহ্বান জানাবেন। মন্ত্রদীক্ষা নিতে ডাকবেন।
—কিন্তু আজই কেন তা দিলেন না? কর্ণমূলে বীজমন্ত্র? তিনি তো নিজে থেকেই বলেছিলেন, “গঙ্গাস্নান করে আয়।”
—সচল বিশ্বনাথের লীলা-খেলা অচল বিশ্বনাথের মতোই দুর্বোধ্য। ওঁর সব কথা, সব আচরণ আমরা আমাদের জ্ঞানবুদ্ধি মতে বুঝতে পারি না। তোকে তো স্পষ্টই বললেন—সারস্বত সাধনাতেই আরও অগ্রসর হতে হবে। তাই বললেন না? বাপের ঘাটে পাড়ি জমাবার আগে বেটির ঘাট পার হয়ে আয়?
বিদ্যালঙ্কার কোন কথা বললেন না। তিনি গভীরভাবে কী-যেন ভাবছেন।
কী ভাবছিস রে মা?
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল বিদ্যালঙ্কারের। বললেন আপনার কাছে কিছু স্বীকারোক্তি করার আছে, বাবা। আমি সজ্ঞানে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছি।
ভ্রূকুঞ্চন হল বিদ্যার্ণবের। বললেন, পাপের স্বীকৃতি?
—পাপ? না, পাপ নয়! আমার ব্যক্তিগত স্বার্থ যখন জড়িত নয়, ব্যক্তিগত ফলাকাঙ্ক্ষা-বর্জিত কর্মে পাপ কেন হবে? তবে সজ্ঞানে ‘তথাকথিত’ মিথ্যার আশ্রয়। আমার আশঙ্কা সেই অপরাধেই বাবা আমাকে মন্ত্র দিলেন না। আপনি আমাকে বুঝিয়ে বলুন : উদ্দেশ্য যদি ‘শুভ’ হয়, তাহলে অসত্যের পথে সেই লক্ষ্যে উপনীত হওয়া অন্যায়, অপরাধ, পাপ?
দ্বারকেশ্বর প্রশান্ত হাসলেন। বললেন, প্রশ্নটাই অবৈধ মা। সত্য-শিব-সুন্দর পরস্পর সম্পৃক্ত! অসত্যের পথে ‘শিব’-এ উপনীত হওয়া যায় না, অপিচ ‘সত্য’-র পথ কখনো অশিবে সমাপ্ত হয় না। এ সংশয় তোর মনে কেন জাগল রে, বেটি?
—সেদিন ‘কুরুক্ষেত্র তালাও’-এর বিচার সভায় আমি সজ্ঞানে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছি। আমার নৈতিক অধঃপতন ঘটেছে।
‘কুরুক্ষেত্র তালাও’-এর বিচার সভায়? কই? না! আমি তো সেখানে উপস্থিত ছিলাম। একবার মাত্র কিছু অসংযম লক্ষ্য হয়েছিল আমার, কিন্তু পরমুহূর্তেই তুই নিজেকে সংযত করেছিলি। সেই যুগাবতার শ্রীরামচন্দ্রের শম্বুক প্রসঙ্গে। সে কথাই কি বলছিস?
—সে কথাই বলছি, বাবা। কিন্তু আপনি যে অর্থে গ্রহণ করছেন সে-অর্থে নয়। ঐ মুহূর্ত থেকেই আমি মিথ্যাচারী হয়েছিলাম।
—না! অসংযত মুহূর্তে তুই বলে ফেলেছিলি—‘শম্বুক উপাখ্যানে বাল্মীকি শ্রীরামচন্দ্রের পূত চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করেছেন’—কিন্তু পরমুহূর্তেই তুই নিজেকে সংশোধন করেছিলি।
—ঐ যেটাকে আপনি সংশোধন বলছেন, সেটাই আমার মিথ্যাভাষণ। উক্তিটা প্রত্যাহার করাই আমার অন্যায়, অসত্যাচরণ! আমার মূল লক্ষ্যটা ছিল শুভ-আমার মতো কোনও হতভাগিনী যদি ভবিষ্যতে স্বাবলম্বী হতে চায়, তাহলে সে যেন আমার মতো বাধার সম্মুখীন না হয়—এটাই ছিল ‘আমার একমাত্র লক্ষ্য। বলুন—সেটা কি শুভপ্রচেষ্টা নয়?
বিদ্যার্ণব নতনেত্রে কী যেন চিন্তা করছিলেন। হঠাৎ প্রতিপ্রশ্ন করেন, ও কথা থাক। তার পূর্বে আমাকে বল্–ঐ কথাটা কেন বলি? শম্বুক উপাখ্যান প্রসঙ্গে। শ্রীরামচন্দ্র যদিও ঈশ্বরের অবতার তবু তিনি নরদেহধারীরূপে যখন অবতীর্ণ তখন তাঁকে দেশকালের বিধান মেনে চলতে হবে না? শ্রীচৈতন্যদের যেভাবে যবন হরিদাসকে কোল দিয়েছিলেন সেটা ত্রেতা যুগে শ্রীরামচন্দ্রের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না।
বিদ্যালঙ্কার বলেন, দেশকালের বিধান যে নতমস্তকে সর্বত্র মেনে চলে সে কথাসাহিত্য বা কাব্যের অন্যতম চরিত্র, মহাকাব্যের নায়কের কাছে পাঠকের প্রত্যাশা তিনি দেশকালের ঊর্ধ্বে উঠবেন। তা সে যাই হোক, কিন্তু শ্রীরামচন্দ্র মহাকাব্যের নায়িকার প্রতি যে ব্যবহার করলেন তাতে তো তিনি দেশকালের বিধান মেনেও নায়কোচিত পরিচয় রাখতে পারেননি! সেটাকে কীভাবে সমর্থন করবেন?
—কিসের কথা বলছিস্ তুই?
—সীতাদেবী মহাকাব্যের সার্থক নায়িকা। তাঁর মন্ত্র “ইহ প্রেত্য চ নারীণাং পতিরেকো গতিঃ সদা।”[১]
[১. ইহজগতে বা পরলোকে সর্বদা পতিই হচ্ছে নারীর একমাত্র গতি (রা: ২/২৭/৬)।]
দশানন তার বৈভবে, পরাক্রমে, ত্রিভুবনজয়ী রাজসিক আড়ম্বরে যখন বন্দিনী সীতার হৃদয় জয় করতে চাইছে তখন পতিব্রতা অপরিসীম দার্ঢ্যে তিরস্কার করে বলছেন :
“যদন্তরং সিংহশৃগালয়োবনে…
যদন্তরং কাঞ্চনসীসলোহয়োঃ…
যদন্তরং বায়সবৈনতয়য়োঃ…”[২]
[২. অরণ্যমধ্যে সিংহ ও শৃগালের যে পার্থক্য, সুবর্ণের সঙ্গে সীসা-লৌহের যে পার্থক্য, মহাগরুড়ের সঙ্গে কাকের যে পার্থক্য তোমার সঙ্গে শ্রীরামচন্দ্রের সেটাই পার্থক্য [রা. ৩/৪7/45-47]।]
কতখানি মনোবল থাকলে, পাতিব্রত্যের অহঙ্কার কী পরিমাণ অভ্রংলেহী হলে, এ-কথা একটি বন্দিনী তার অপহারককে বলতে পারে; তা সহজেই অনুমেয়! রাবণ ত্রিভুবন জর্ করেছে, কিন্তু সীতার হৃদয় জয় করতে পারল না! সতীর দেহ স্পর্শ করতেও সাহসী হল না! এবার চিন্তা করে দেখুন, বাবা, রাবণ-নিধনের পরে সেই পাতিব্রত্যের মূর্ত প্রতীক সীতাকে প্ৰথম দর্শনে মহাকাব্যের নায়ক কী সম্ভাষণ করলেন—
“…ন ত্বদর্থং ময়া কৃতঃ।
প্রখ্যাতস্যাত্মবংশস্য ন্যঙ্গজ্ঞ পরিমার্জতা।।”[১]
[ভেব না, তোমাকে উদ্ধার করতে আমি এ যুদ্ধজয় করেছি। বাস্তবে নিজের বিখ্যাত বংশের কলঙ্কমোচনের জন্যই আমাকে এ যুদ্ধজয় করতে হয়েছে [রা. ৬/১১৫/১৫-১৬]।]
কী নিষ্ঠুর মিলন-সম্ভাষণ! কথাটা যদি সত্যই মনে হয়ে থাকে, তাহলেও দীর্ঘ বিরহের পর প্রথম সম্ভাষণেই কি তা উশ্চার্য? ‘মা ব্রুয়াৎ সত্যমপ্ৰিয়ম’ নীতি-বাক্যটাও কি জানা ছিল না শ্রীরামচন্দ্রের?
বিদ্যার্ণব ক্ষুণ্ণ হন। বলেন, প্রজানুরঞ্জন রাম যে নিরুপায় ছিলেন, মা!
—না বাবা! তা বললে মানব কেন! দীর্ঘ বিরহের পর এটা সীতা ও রামের প্রথম সাক্ষাৎ! প্রজারা তখনো কিছু বলেনি। বাল্মীকি রামায়ণের বর্ণনায়।
—কিন্তু তিনি তো অন্তর্যামী, জানতেন এ আপত্তি উঠবেই। সীতাদেবী দীর্ঘ দিন রাবণের অবরোধে বন্দিনী ছিলেন। তাঁকে পুনরায় রাজমহিষী করা চলে না। তাতে রঘুবংশের অপবাদ। বাল্মীকি-সৃষ্ট মহানায়ক তা কীভাবে মেনে নেবেন?
—উত্তরে তিনটি কথা বলব, বাবা। প্রথম কথা : রাজসিংহাসনের সঙ্গে শ্রীরামচন্দ্রের অচ্ছেদ্যবন্ধন ছিল না, যেমন ছিল সীতার সঙ্গে। তিনি অযোধ্যার সিংহাসনলাভের মোহ ত্যাগ করতে পারলে ভরত তা সুশাসনে রাখতেন। দ্বিতীয় কথা : রঘুবংশের অপবাদের প্রশ্নটা গ্রাহ্য নয়, বাল্মীকি রচিত পরবর্তী শ্লোকে। রামচন্দ্র ধর্মপত্নীকে অনায়াসে বলতে পারলেন, “লক্ষ্ণণে বাথ ভরতে কুরু বুদ্ধিং যথাসুখম।”[২] রাবণের অবরোধে বন্দিনী থাকার অপরাধে যদি সীতা বর্জনীয় হন, তাহলে ভরতকে বা লক্ষ্মণকে—যে লক্ষ্মণ দ্বাদশ বৎসরকাল সীতার চরণ ভিন্ন মুখের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি—তাদের স্কন্ধে সীতাকে অধিষ্ঠিত করতে চাইছেন কেন? তৃতীয় কথা: লোকাচার—যে যুক্তি আপনিই দেখিয়েছেন। সমকালীন লোকাচার—বশিষ্ঠর নির্দেশ—বলাৎকৃতা নারী প্রায়শ্চিত্তে শুচি হন। সে-কথা জানা ছিল বলেই রামচন্দ্র সীতাকে বলেছিলেন—লক্ষ্মণকে বিবাহ করতে! তাই শুধু শম্বুক উপাখ্যান, বা বালীবধের জন্যই নয়, রামচন্দ্রকে মহাকাব্যের উপযুক্ত নায়ক বলে স্বীকার করতে পারি না।
[২. লক্ষ্মণ বা ভরত যাতে তোমার সুখ হয়, তাকেই পতি হিসাবে বরণ কর [রা-৬/১১৫/২২]।]
বিদ্যার্ণব নিরতিশয় আহত হলেন। শ্রীরামচন্দ্রকে তিনি মহাকাব্যের নায়ক রূপে চিহ্নিত করতেন না, শ্রীজয়দেবের নির্দেশে দশাবতারের অন্যতম অবতার বলেই পূজা করতেন। তবু আদরিণী কন্যার এ চপলতা ক্ষমা করে বলেন, ঠিক আছে মা, ও আলোচনা থাক বরং! বল্ ‘কুরুক্ষেত্র তালাও’-এর বিচারসভায় কোন জাতের মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলি?
—যা আমি বিশ্বাস করি না, তাই বলেছি। যা বিশ্বাস করি, তা বলিনি। কারণ বিচারকমণ্ডলী তা গ্রহণ করতেন না। আমি লক্ষ্যে উপনীত হতে পারতাম না—পরাজিত হতাম!
—কী তুই বিশ্বাস করিস? আর কী বিশ্বাস করিস না?
—আমি বিশ্বাস করি না সেই সব দেবনাগরী হরফে লেখা তথাকথিত শাস্ত্র-বাক্য, যা আমার বিবেক-নির্দেশের পরিপন্থী। আর বিশ্বাস করি সেই মহামানবের অন্তিম উপদেশ: আত্মদীপো ভব, আত্মশরণো ভব, অনন্যশরণো ভব’।[১]
[১. “নিজেকে প্রদীপশিখা করে তোলো। সেই বিবেকদীপের আলোয় নিজের পথ খুঁজে নিও। অপরের শরণ নিও না”—মৃত্যুশয্যায় শায়িত গৌতমবুদ্ধ শিষ্য আনন্দকে একথা বলেছিলেন। আনন্দ যখন প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার মহাপরিনির্বাণের পর আমরা কার কাছে যাব পথের সন্ধান জানতে?’ তখন এই তাঁর শেষ বাণী।]
দ্বারকেশ্বর বললেন, শাক্যসিংহ শ্রীকৃষ্ণের নবম অবতার। ভগবান শঙ্করাচার্য তাঁর স্থান নির্দেশ করেছেন দশাবতার-স্তোত্রে। শ্রীজয়দেবও তা করেছেন।
—কিন্তু কবি জয়দেব ওটা খুশি মনে করেননি বাবা। না হলে ‘নিন্দসি যজ্ঞবিধেঃ’ লিখেই কেন আর্তনাদ করে উঠবেনঃ ‘অহহ!’
—‘অহহ’ আর্তনাদ পরবর্তী পংক্তির শেষ শব্দটির উদ্দেশ্যে।[২]
[২. সুপরিচিত পংক্তিটি “নিন্দসি যজ্ঞবিধেরহহ শ্রুতিজাতম্/সদয়হৃদয় দর্শিত পশুঘাতম্।।”]
—সম্ভবত তা নয়, বাবা। বৌদ্ধধর্মকে নিঃশেষিত করে, ব্রাহ্মণ্যধর্মকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে আচার্য শঙ্কর গৌতম বুদ্ধকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন অন্য হেতুতে। কারণ তিনি জানতেন যে, ভারতবর্ষকে যদি আত্মদীপের আলোয় পথ চলতে দেওয়া হয় তাহলে তাঁর পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
—কী পরিকল্পনা? উত্তর-মীমাংসা সম্ভূত অদ্বৈতবেদান্ত মত?
—আজ্ঞে না। তাঁর চার মঠের চার নবীন দেবতা! তাঁর দশনামী সম্প্রদায়। তাঁর একদেশদর্শী দর্শন!
—’একদেশদর্শী দর্শন’! আদি শ্রীমৎ শঙ্করাচার্যের?
—হ্যাঁ, বাবা। তাই বলেছি আমি। আমাকে বিস্তারিত বলতে দিন। বলুন, কোথায় আমার সমীক্ষার ভ্রান্তি।
দীর্ঘ বিশ্লেষণ করলেন হটী বিদ্যালঙ্কার। এসব কথা কোনদিন বলেননি গুরুদেবকে। আজ কী জানি কী করে রুদ্ধদ্বারটি উন্মোচিত হয়ে গেল। উত্তেজনায় হয়তো খেয়াল করেননি পিতৃদেবের সঙ্গে গুরুদেবের শিক্ষায় একটা মৌল পার্থক্য আছে। যা এতদিন প্রচ্ছন্ন ছিল। প্রকাশ হলে যে কী জাতের সর্বনাশ হবে বোধ করি তা প্রণিধান করেননি।
মগ্নচৈতন্য অবস্থায় তিনি যেন স্বগতোক্তি করে চলেছেন—আত্মদীপের আলোকে ব্ৰাহ্মণ্য ধর্মের যে ক্রমাবনতি উপলব্ধি করেছেন তারই এক দীর্ঘ বিশ্লেষণ। নারীত্বের অবমানতা দেখে এককালে তাঁর পিতৃদেব, পরে তিনি নিজে, যেভাবে নিপীড়িত হয়েছেন,ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন :
উপনিষদের যুগে জ্ঞানপিপাসাই ছিল ঋষিদের একমাত্র প্রেরণা। ঐহিক বিপদ থেকে পরিত্রাণের কথা তাঁরা চিন্তা করেননি; বৈষয়িক উন্নতিবিধানে রচনা করেননি কোন মন্ত্র। তাঁদের তখন স্থিরলক্ষ্য—অন্ধকার থেকে আলোকে পদার্পণ, মৃত্যু থেকে অমৃতে উত্তরণ! বিশুদ্ধ জ্ঞানপিপাসাই একমাত্র লক্ষ্য—জানতে হবে সেই অবাঙ্মানসগোচরকে। প্রণিধান করতে হবে কোন উদ্দেশ্যে সেই ‘একবর্ণা’ ‘বহুধা’ হয়েছেন। ক্রমে উপনিষদের ঋষি উপনীত হলেন সেই সত্যে : এ শুধু অহৈতুকী আনন্দের এক উচ্ছ্বাস! ব্রহ্মের উদ্দেশ্য-কারণত্ব হল : রসের আস্বাদন! ‘রসো বৈ সঃ। রসং হ্যেবায়ং লব্ধানন্দী ভবতি[১]।’ এই আনন্দতত্ত্বকে উপলব্ধি করে উপনিষদের ঋষি অমৃতের পুত্রগণকে সম্বোধন করে বলেছেন : “তোমরা শোন! সেই আদিত্যবর্ণের ওপারের তত্ত্ব আমি জেনেছি।” বললেন : “আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে।”[২]
[১. রসেই তিনি আছেন। ‘রস’-এই তিনি আনন্দ লাভ করেন।
২. আনন্দর উৎসমুখে এই জগৎপ্রপঞ্চের উৎপত্তি।]
এই নিত্যসত্য যেদিন জ্ঞানের আলোকে উপলব্ধি করলেন সেদিন উপনিষদের ঋষি প্রকৃতি-পুরুষের ভেদাভেদকে অস্বীকার করতে পেরেছিলেন। নারী সেই অমৃতময়ী যুগে নরকের দ্বার ছিল না, ছিল পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী—পরিপূরক। ব্রহ্মবাদীর পাশাপাশি ঠাঁই পেয়েছিলেন ব্রহ্মবাদিনীর দল। যাজ্ঞবল্ক্যের পাঁজর ঘেঁষে মৈত্রেয়ী!
তারপরেই এল ষড়দর্শনের যুগ।
হারিয়ে গেল উপনিষদের সেই অমৃতময়ী মন্ত্রটি—‘আনন্দ’ই আছে, আর কিছু নাই! এল নূতন চিন্তাধারা—মনুষ্যজীবন ঐকান্তিকভাবে ‘দুঃখময়’। কর্মফলবন্ধনের সূত্রে আবদ্ধ মানুষ জন্ম-জন্মান্তর ধরে এই দুঃখময় জীবনের কারাদণ্ডে দণ্ডিত। পুরুষার্থ হল-ঐ দুঃখ থেকে উত্তরণ! কী ভাবে? ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষের সাধনমার্গে।
দ্বারকেশ্বর প্রশ্ন করেন, সেটাই কি পুরুষার্থ নয়?
হাসলেন বিদ্যালঙ্কার। বললেন, সেটাই আমার প্রথম প্রশ্ন বাবা—ঐ শব্দটা : ‘পুরুষার্থ! লিঙ্গে কিছু ভুল হল না কি? মৈত্রেয়ী, গার্গী, লীলাবতী, মদালসার লক্ষ্য কী ছিল? পুরুষার্থ না ‘প্রকৃত্যর্থ’? ঐ শেষোক্ত শব্দটার স্বীকৃতি ব্রাহ্মণ্য দর্শনে নাই! শব্দটা অজ্ঞাত! কিন্তু ‘পুরুষার্থের পরিবর্তে ষড়দর্শন কি ‘মনুষ্যর্থ’ শব্দটা ব্যবহার করতে পারত না? না, সেই ষড়দর্শনের যুগ থেকে ব্রাহ্মণ্য
ধর্ম এসে গেল পুরুষের কব্জায়! এর পর ‘পুরাণ’ আর ‘সংহিতার’ যুগ। আরও কোণঠাসা হয়ে গেল নারীজাতি। ষড়দর্শনের যুগে নারী-পুরুষের ভেদাভেদটা তত প্রকট নয়। তখন শুধু তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। সাংখ্য আর যোগদর্শন প্রকৃতি-পুরুষ তত্ত্বের উদ্গাতা। তাতে নারীকে নরকের দ্বার বলা হয়নি। ন্যায় ও বৈশেষিকের অন্য জাতের চিন্তা : কেন বলা হল ব্যক্তি-আত্মা আর জড়-জগৎ উভয়েই মৌলিক সত্তা। পূর্ব-মীমাংসা বৈদিক কর্মকাণ্ডের দিকে নিবদ্ধদৃষ্টি। উত্তর-মীমাংসা জন্ম দিল এমন এক মতবাদ যা সাধারণ নরনারীর নাগালের বাহিরে : অদ্বৈতবেদান্ত দর্শন!
কিন্তু ঠিক তার পরের ধাপে এসে উপনীত হলেন ষড়দর্শনের ভাষ্যকারের দল। উপনিষদ বলেছিলেন : সৃষ্টির মূলে আছে: ‘আনন্দ’! ষড়দর্শন বলেছিলেন, না! সৃষ্টির মূলে আছে কর্মফলবন্ধনের ‘দুঃখ’। এ সব তাত্ত্বিক কচকচি। হিন্দু ভারতের সমাজে এর কোন প্রভাব পড়েনি। কিন্তু এবার যাঁরা এসে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির হাল ধরলেন, তাঁরা তাত্ত্বিক কচকচিতেই তাদের কর্মকাণ্ড সীমিত করলেন না। দিতে শুরু করলেন সামাজিক বিধান : কর্তব্য আর অকর্তব্যের তালিকা। স্বর্গ লাভের সরল প্রকরণ আর নরকবাসের শাস্তি। যদিচ ‘নরক’ শব্দটা বা ঐ ধারণাটা বেদ-এ কুত্রাপি নাই! এল নানান ‘পুরাণ’ আর ‘সংহিতা’। এই চিন্তাধারার প্রভূত প্রভাব পড়ল সাধারণ নরনারীর উপর। শুরু হল, দ্বিসহস্রবর্ষব্যাপী ব্রাহ্মণ্যধর্মের অবক্ষয়।
স্থির হল—ধর্ম শুধুমাত্র থাকবে পুরুষের কব্জায়।
—নারীর নয়—নারী হচ্ছে: নরকের দ্বার!
আশ্চর্য! পরম আশ্চর্য! এই আকাশজোড়া মিথ্যাটাকে সমগ্র ভারতবর্ষ বিনা প্রতিবাদে মেনে নিল! এমনকি, স্বয়ং আদি শঙ্করাচার্য! তাতেই তাঁকে বলেছি একদেশদর্শী!
দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণব ইন্দ্রিয়সংযমে অভ্যস্ত। তবু তাঁর নাসারন্ধ্র স্ফুরিত হয়ে উঠল। বললেন, শব্দটা দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করলে বিদ্যালঙ্কার—কিন্তু কোন উদাহরণ দিয়ে তা প্রতিষ্ঠা করনি এখনো।
মা নয়, বিদ্যালঙ্কার! সেটা খেয়াল করেছেন কিনা বোঝা গেল না, কিন্তু প্রত্যুত্তরের সময় তাঁর সম্বোধনটাও পরিবর্তিত হয়ে গেল। বললেন, গুরুদেব! আচার্য শঙ্কর সারাজীবন শুধু পুরুষকেই নির্দেশ দিয়ে গেছেন। গৃহী পুরুষ, সন্ন্যাসী পুরুষ। হেতু?
নারী হচ্ছে নরকের দ্বার!
‘কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ’-র পরিপূরক ‘কা তব ভর্তা’র কথা বলতে তাই তিনি ভুলেছেন। ভর্তাই যে নারীর শেষ ‘মোক্ষ’! তাই তাঁর অনুশাসনে নারী হয় উপেক্ষিত, নয়. নিগৃহীত জ্যোষীমঠ-সংক্রান্ত তাঁর ‘মঠানুশাসন অনুজ্ঞা’য় লক্ষ্য করে দেখুন, গুরুদেব, তিনি ভবিষ্যৎ শঙ্করাচার্যদের—তাঁর চারধামের মঠাধীশদের বলেছেন ‘শুচিতাযুক্ত, জিতেন্দ্রিয়, বেদ-বেদাঙ্গাদি শাস্ত্র বিশারদ’ হতে হবে। বেশ কথা! কিন্তু তাঁরা এ ধরাধামে আবির্ভূত হবেন কোন অলৌকিক প্রক্রিয়ায়? তা তো বলে গেলেন না? ঐ ভবিষ্যৎ শঙ্করাচার্যের পিতৃদেবেরা যদি ‘নরকের দ্বারস্থ না হয়—যে ‘নরক’ শব্দটাই বেদ-এ অনুক্ত—তাহলে কীভাবে নিরবচ্ছিন্ন ধারায় প্রবাহিত হবে তাঁর চতুর্থামের ধর্মপ্রচারের আয়োজন? আপনি আমাকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিন গুরুদেব—কোথায় আমার ভ্রান্তি। এটা কি একদেশদর্শিতা নয়?
দ্বারকেশ্বর নিরুত্তর। মেদিনীনিবদ্ধদৃষ্টিতে চিন্তামগ্ন।
ক্ষুব্ধ কণ্ঠে হটী বিদ্যালঙ্কার বলে ওঠেন, অথচ আপনারা বলেন—আদি শঙ্করাচার্য পূর্ণ ভগবান! গৌতম বুদ্ধ নবম অবতারমাত্র! তুলনা করে দেখুন—শাক্যসিংহ পরমপুরুষ, কিন্তু প্রকৃতির ঋণ তিনি কড়ায় গণ্ডায় পরিশোধ করে দিয়ে এসেছেন রাহুলমাতার মাতৃত্বধর্মকে সার্থক করে! তাঁর সন্ন্যাসজীবনও ছিল স্ত্রী-সংসর্গবর্জিত। কিন্তু তার হেতু এ নয় যে, নারী নরকের দ্বার! তিনি জিতেন্দ্রিয়, কিন্তু ‘ন চ পশ্যেৎ মুখং স্ত্রীণাং ন তিষ্ঠৎ তৎসমীপতঃ’—নারীত্বের অবমাননাকর এই নির্দেশ তিনি মানতেন না। সন্ন্যাস জীবনে তিনি তাঁর গর্ভধারিণী জননীর সঙ্গে মুখোমুখি বসে সদ্ধর্মের ব্যাখ্যা করেছেন, প্রিয়শিষ্য ‘যশ’-এর সহধর্মিণীকে ধর্মোপদেশ দিয়েছেন। কী অপরিসীম মহিমা তাঁর! বৈশালীরাজ ও নগর শ্রেষ্ঠীদের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করে বারবনিতা আম্রপালীকে বলেছেন, “তোমার সর্বতোভদ্রে একরাত্রের জন্য আমায় আশ্রয় দেবে, মা?’ আম্রপালীর পতিতালয়ে নির্দ্বিধায় রাত্রিবাস করেছেন মহাকারুণিক। শেষ জীবনে সন্ন্যাসিনীদের পৃথক সঙ্ঘারাম প্রতিষ্ঠার অনুমতিও দিয়েছিলেন। তাই ‘থেরগাথার’ পাশাপাশি রচিত হয়েছে ‘থেরীগাথা! যার উদাহরণ, ব্যতিক্রম হিসাবেও, নেই, দ্বিসহস্রবৎসরব্যাপী এই ব্রাহ্মণ্যধর্মে! বলুন, গুরুদেব, বৌদ্ধধর্মের এই সমদর্শনের অনুরূপ কোন কিছু কি আছে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুরাণে আর সংহিতায়?
অষ্টাদশ পুরাণের ভিতর একমাত্র মার্কণ্ডেয় পুরাণে পেয়েছি মদালসার কাহিনী—মদালসা অলকের উপাখ্যান। আর কোনও ব্রহ্মবাদিনীর সন্ধান পাইনি। সর্বত্র নারীর ধর্ম : স্বামীর চরণ সেবা, সন্তানের উৎপাদন! সংহিতাগুলিতে আরও অবক্ষয়ী চিন্তাধারা—বিষ্ণু সংহিতার ভার্যানিরূপণ, স্ত্রীধর্ম, দশবিধ সংস্কার নারীর পক্ষে অবমাননাকর। গার্গী-মৈত্রেয়ীর কোন উত্তরসূরিণী পুরাণ বা সংহিতা রচনা করেননি। পুরুষেরাই শুধু লিখে গেছেন,—ভর্তানিরূপণ, পুরুষধর্ম-এর বিবরণ! পরাশর সংহিতা ‘অগম্যাগমন’-এর প্রায়শ্চিত্ত-বিধান বিস্তারিত ভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন—কামের বশবর্তী হয়ে নিষিদ্ধ সম্পর্কের নারীতে উপগত হলে কী কী প্রায়শ্চিত্ত! আশ্চর্য! পরাশর ঋষির একবারও মনে পড়ল না—সেই হতভাগিনীটার কথা! যে ঐ পুরুষের পাশববৃত্তির শিকার হয়েছে। সেই ধর্ষিতা নারী কী ভাবে সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাবে সে-কথা লিপিবদ্ধ করতে তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন! শ্রীমদ্ভগবৎগীতায় শ্রীকৃষ্ণ বললেন, শোন অর্জুন! ‘স্ত্রীষু দুষ্টায়ু’ হলে ‘বর্ণসঙ্কর’ জন্মগ্রহণ করে। শুনে অর্জুন বললেন, ‘বটেই তো! তাঁর মনে এ প্রশ্ন আদৌ জাগ্রত হল না যে, এক লক্ষ দুষ্টা স্ত্রীলোককে এক কল্পকাল ঐ জরাসন্ধের কারাগারে বন্দী করে রাখলেও তারা সম্মিলিতভাবে একটি মাত্রও ‘বর্ণসঙ্কর’কে জন্ম দিতে সক্ষমা হবে না! এ প্রশ্ন কেন জাগল না অর্জুনের মনে? কারণ তিনি ঐ একদেশদর্শী ব্রাহ্মণ্য ধর্মের চিন্তাধারায় অন্ধ। মানতে রাজি নন যে, পাপ একা নারী করতে পারে না—তার অধিকার শুধু অর্ধেক পাপের। বাকিটা পুরুষের! গুরুদেব! আমার মনে হয়েছে—এই একদেশদর্শিতার ফলেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের এই অবক্ষয়ীরূপ! হিন্দু ভারত বারে বারে পদানত হয়েছে যবনের, মুসলমানের। অথচ এসব কথা সেদিন আমি বলিনি—সেই কুরুক্ষেত্র তালাও এর বিচার সভায়। শ্রীরামচন্দ্রের শম্বুকবধ উপাখ্যান উত্থাপন করেই সংযত হয়েছিলাম! বলিনি এজন্য যে, আমার বিচারকেরা এই সত্য প্রণিধান করতে পারতেন না। তাঁরা যা বোঝেন, যা, মানেন, সেইসব পুরাণ আর সংহিতা থেকে ক্রমাগত উদ্ধৃতি শুনিয়ে গেছি। আমি অসত্যের পথে জয়লাভ করেছি।
দীর্ঘ বিশ্লেষণ করে হটী বিদ্যালঙ্কার নীরব হলেন। ক্ষুব্ধ দ্বারকেশ্বর বলে ওঠেন, তাহলে তুমি কেন তৈলঙ্গস্বামীর কাছে দীক্ষা নেবার জন্য অত উদগ্রীব হয়েছিলে? নাথপন্থী বৌদ্ধ গুরুর তো অভাব নেই?
—একই হেতুতে গুরুদেব! পুরাণ আর সংহিতা-প্রণেতার দল যেভাবে উপনিষদের মহাসত্যকে হত্যা করেছেন, ঠিক সেভাবেই গৌতম বুদ্ধের বিনয়পিটক আজ কলুষিত হয়েছে তাঁর অধস্তন শিষ্য-শিষ্যাদের দ্বারা। কী প্রভেদ আজ এই পঞ্চ-মকার আশ্রয়ী শক্তি-উপাসকদের সঙ্গে ঐ বজ্রযানী বৌদ্ধ-তান্ত্রিকের ব্যভিচারের? সর্বত্রই তো ধর্মের নামে ইন্দ্রিয়জ কামনাবাসনার তির্যক তৃপ্তির আয়োজন! বিবেকের নির্দেশে কেউ চলে না। ব্রাহ্মণ্যধর্ম যেমন অযৌক্তিকভাবে বিশ্বাস করে—বেদ অপৌরুষেয়, অভ্রান্ত…
জ্যামুক্ত ধনুকের মতো আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালেন মহামহোপাধ্যায় দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণব। আর সংযমের আড়াল রইল না। বলেন, কী? কী বললে?
হটী বিদ্যালঙ্কারও দাঁড়িয়ে পড়েছেন। যুক্তকরে মেদিনীনিবদ্ধ দৃষ্টিতে তিনি নিস্পন্দ।
উদ্গীরণোন্মুখ আগ্নেয়গিরির মতো বৃদ্ধের সারা দেহ তখন থরথর করে কাঁপছে। বলেন, এতদূর তোমার ঔদ্ধত্য! চতুর্বেদের অপৌরুষেয়তা, অভ্রান্ততা বিষয়ে তোমার অন্তরে সংশয় জেগেছে?
এবারেও প্রত্যুত্তর করলেন না। নিবাতনিষ্কম্প দীপ-শিখার মতো যুক্তকরে মুদিত নেত্রে শাস্তির জন্য প্রতীক্ষা করছেন বিদ্যালঙ্কার।
—নীরব থেক না বিদ্যালঙ্কার! প্রশ্নের জবাব দাও!
শান্ত ধীর কণ্ঠে এবার বলেন, চতুর্বেদের মূল্যায়নও তো করতে হবে আত্মদীপের আলোকে…
—ব্যস্! থাক! আর কোন কথা নয়!
দুরন্ত ক্রোধে পরমুহূর্তেই কক্ষত্যাগ করে গেলেন। নিজের একান্ত সাধনকক্ষে প্রবেশ করে ভিতর থেকে অর্গলবদ্ধ করে দিলেন দ্বার। সমস্ত দিন বার হলেন না কক্ষ থেকে। উপবাসে অতিবাহিত হল একটি বেদনাদায়ক বিচ্ছেদের দিন। না গুরু, না শিষ্যা কেউই পরস্পরের দিকে এগিয়ে এলেন না।
এতবড় আঘাত দ্বারকেশ্বর তাঁর দীর্ঘজীবনে কখনো পাননি। পথের প্রান্তে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন শেষজীবনের একটি অবলম্বন। কন্যা-স্নেহে তাকে মানুষ করে তুলছিলেন। অধীত বিদ্যা তিল-তিল করে দান করে যাচ্ছিলেন ঐ প্রিয় শিষ্যাকে। আশা ছিল—এই সাত-পুরুষের গুরুকুল চতুষ্পাঠীর মর্যাদা সে রক্ষা করবে! হল না! কিছুই হল না! রূপমঞ্জরীর পূর্ব জীবন-কথাটাও শোনা হল না! কোন কৌতূহলই নেই আর! শেষ জীবনে এ কী জড়ভরত হয়ে পড়ছিলেন তিনি! স্নেহের বন্ধনে ইষ্ট-চিন্তাও যেন ব্যাহত হচ্ছিল ইদানীং। অন্তরে পেয়েছেন সুদূরের আহ্বান! রাত্রি প্রভাতেই সব কিছু ছেড়েছুড়ে তিনি যাত্রা করবেন!
বেদের অপৌরুষেয়তা…! না! আর চিন্তা করতে পারছেন না! মা মা ব্রহ্ম নিরাকুৰ্যাং!