কাশীধাম : 1774 - প্ৰথম পৰ্ব
সোঞাই : 1742 - দ্বিতীয় পৰ্ব
নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর : 1742 - তৃতীয় পৰ্ব
তীর্থের পথে : 1742 - চতুর্থ পর্ব
1 of 2

নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৩

দ্বিপ্রহরে নিবারণচন্দ্র তাঁর দুর্গন্ধযুক্ত নিশ্বাস নিয়ে পুনরায় ঘনিয়ে এসে বসলেন। অন্যেরা দিবানিদ্রায় মগ্ন। নিবারণ দিবাভাগে নিদ্রা দেন না—”দিবা মা শান্সি’—শাস্ত্রের বচন। উপায় নেই, ভদ্রতার খাতিরে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে সেই দুর্গন্ধযুক্ত সুখদুঃখের কথা কিছুক্ষণ শুনতে হল। সদ্‌ব্রাহ্মণ বংশের সন্তান। পিতৃদেবের সংস্কৃত টোল ছিল—গুপ্তিপাড়া গ্রামেই। নিবারণও প্রথমে পৈত্রিক বৃত্তিই গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ওঁর গ্রামস্থ শ্যালকেরা শ্যালক-পুত্রদের নাকি ‘সমোস্কৃত’ শেখাতে চায় না। সবাই ফারসী শিখবে! নবাব সরকারে চাকরি নেবে। সমোকৃতের অং-বং মন্ত্র শিখে কী লাভ? চাল-কলা-নৈবেদ্যে কারও মন ওঠে না। নিবারণচন্দ্রের দুই বিবাহ, দুই স্ত্রীর সর্বসাকুল্যে সাতটি সন্তান। একটি মাত্র কন্যাকে পার করেছেন; ‘পার’ অর্থে সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়ার আয়োজন মাত্র। সে আবাগীও ওঁর অন্নধ্বংস করছে—জামাতা বাবাজীবন বিবাহ-বিশারদ। তাকেও দোষ দেওয়া যায় না। চারকুড়ি বৌ নিয়ে তো কেউ সংসার ধর্ম করতে পারে না! বছরে দুবার আসে। পার্বণী নিয়ে যায়। ভগবান রক্ষা করেছেন—সেই ঝাঁকি—দর্শণের ফলে কোন নাতি-নাতনি এসে সংসারের ভারবৃদ্ধি করেনি।

একনাগাড়ে বক্‌বক্ শুনতে ভাল লাগছিল না। রূপেন্দ্র প্রশ্ন করেন, এখানে আপনাকে কী-জাতীয় কাজ করতে হয়? দুপুরে বিশ্রাম নিচ্ছেন বলে জানতে চাইছি।

—আমার কাজ সাঁঝের ঘোরে। দত্তজা হুজুরকে ‘সমোকৃত-খেউড়’ শোনানো।

‘সমোস্কৃত-খেউড়’ শব্দটির অর্থ অন্বয়-ব্যাখা করে বুঝিয়ে দেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তাঁকে উপস্থিত হতে হয় ঝষধ্বজের প্রমোদকক্ষে। ‘চৌরপঞ্চাশিকা’ জাতীয় আদিরসাত্মক সংস্কৃত কাব্যপাঠ করে শোনাতে হয়। ঝষধ্বজ সংস্কৃত জানেন না; কিন্তু দেবভাষার ঐসব বিশেষ কেচ্ছার দিকে আকর্ষণ। শুধু পাঠ নয়, ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে হয়। সক্ষেদে বলেন, বললে বিশ্বাস করবেন না বাঁড়ুজ্জেমশাই, পাষণ্ডটা জেনে বুঝে এই বুড়োটাকে নাকাল করে। সামনে মদের গেলাস, দুপাশে দুই যণ্ডামার্কা যৌবনবতী উপপত্নী; আর শালা ন্যাকা সেজে বলে—ঐখানটা তো ঠিক বুঝলাম না পণ্ডিতমশাই! ‘বিপরীত-রত্যাতুরা’ শব্দটার মানে কি হল? তোমরা বুয়েছ?’ আর দুই হারামজাদী সব জেনে-বুঝে নেকী সেজে বলে, ‘না পণ্ডিতমশা, আমরাও বুঝিনি! ওর মানে কী?’ বুঝুন কাণ্ড! আমার তিনকুড়ি বয়স হল—ঐ জোয়ান মাগী দুটোকে বুঝিয়ে বলতে হবে, ‘বিপরীত রত্যাতুরা’র মানে! ওরা সব জানে, সব বোঝে—এ শুধু বুড়ো মানুষকে নাকাল করা।

রূপেন্দ্র বলেন, দু-দুটো! একসঙ্গে? কেন?

—ঐ যে শাস্ত্রে বলেছে—’নাল্পে সুখমস্তি’! টাকায় যার ছাতা ধরছে সে এক-কুড়ি এক সঙ্গে নিয়ে বসলেই বা ঠেকাচ্ছে কে? বললে পেত্যয় যাবেন না মশাই—দুটো মাগীকে নাকি দুই পাশবালিশ করে দু পাশে নিয়ে রাত্রে শোয়!

রূপেন্দ্র বলেন, থাক ঘোষাল মশাই। এ আলোচনা আমার ভাল লাগছে না।

–বলতে কি আমারই ভাল লাগছে বাড়জ্জেমশাই? আমারও তো দু-দুটি ধর্মপত্নী—কিন্তু দুটোকে নিয়ে এক বিছানায় কোনদিন শুইচি? বাৎস্যায়ন বলেছেন পর্যায়ক্রমে…

রূপেন্দ্র উঠে পড়েন। বলেন, আপনি বিশ্রাম করুন, আমি একটু ঘুরে আসি।

অশ্বটি প্রাঙ্গণে বাঁধা আছে। সৈনগুপ্ত। ইতিমধ্যে সেও দানাপানি পেয়েছে। প্রভুকে দেখেই হ্রেষাধ্বনি করল। রূপেন্দ্রনাথ ভেবে দেখলেন, ঐ বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের দুগন্ধযুক্ত—উভয়ার্থেই—অভিযোগ শোনার চেয়ে শহরটা এক চক্কর ঘুরে এলে মন্দ হয় না। নদীয়ায় অনেক অনেক দ্রষ্টব্য। তিনি দু চারদিন থাকবেন মাত্র। তাও বাসস্থানটা পরিবর্তন করে কোন পান্থশালায় আশ্রয় জুটিয়ে নিতে পারলে। একটি মধ্যাহ্নই বা অপব্যয় করেন কেন? বাজারের দিকে গিয়ে লাভ নেই। মধ্যদিনে দোকানপাঠ সম্ভবত সবই রুদ্ধদ্বার। কোথায় যাবেন? ঘূর্ণী গ্রামে মৃৎশিল্পীদের বাস। তাদের হাতের কাজ নাকি অপূর্ব। কিন্তু খরমধ্যাহ্নে সে সব বিপণীও সম্ভবত রুদ্ধদ্বার। মনে পড়ে গেল, এই কৃষ্ণনগরের এক ক্রোশ দক্ষিণে আছে দোগাছিয়া গ্রাম। সেখানে বৈষ্ণবশ্রেষ্ঠ নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর মাথার উষ্ণীষটি সুরক্ষিত। একটা ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য—মহা পুণ্যতীর্থও। কিন্তু ঐ সঙ্গে মনে পড়ে গেল—সাধারণ দর্শক তা বৎসরের একটি চিহ্নিত দিনেই দেখবার সৌভাগ্যলাভ করে। সে দিনটির মাত্র এক পক্ষকাল বাকি: অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লা চতুর্দশীতে দোগাছিয়ায় ‘মূলী মহোৎসবে একটি মেলা হয়। তখনই উষ্ণীষটি সর্বসাধারণকে দেখানো হয়। ফলে দোগাছিয়া যাওয়ার অর্থ হয় না।

দেবপল্লীর নৃসিংহ মন্দির দেখে এলে কেমন হয়? দেবপল্লী শহর কৃষ্ণনগর থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে মাত্র দেড় ক্রোশ দূরত্বে। মন্দিরের দ্বার খোলা থাকতে পারে। পথের নির্দেশ জেনে নিয়ে সেদিকেই রওনা দিলেন অশ্বপৃষ্ঠে।

দেবপল্লী বা দেপাড়া একটি প্রাচীন জনপদ। এ অঞ্চলের ঐ নৃসিংহদেবের মূর্তিটির অসীম মাহাত্ম্য। নদীয়া রাজার প্রদত্ত ভূসম্পত্তির আয় থেকে এই দেব-বিগ্রহের নিত্য সেবার ব্যবস্থা। জনশ্রুতি এ মূর্তি কেউ নির্মাণ করায়নি। ইনি অনাদি বা স্বয়ংপ্রকাশ। প্রতি বৎসর বৈশাখী শুক্লা চতুর্দশীতে এখানে অন্নোৎসব হয়। গোয়াড়ি কৃষ্ণনগরের সদ্যোজাত সন্তানের পিতা-মাতা সারা বছর ধরেই এই দেপাড়ায় আসেন—নৃসিংহদেবের ভোগ দেন—আর ঐ দেবতার প্রসাদী অন্নেই নবজাত শিশুর অন্নারম্ভ অনুষ্ঠান হয়।

অনতিবিলম্বে উপনীত হলেন দেবপল্লীতে। পথের ধারে জঙ্গলাকীর্ণ উঁচু ঢিপির একাংশে নৃসিংহদেবের মন্দির। সুবৃহৎ মন্দির[১]। ঐ সুউচ্চ ঢিপি দেখে বোঝা যায়, এখানে পূর্বযুগে একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। পাশেই প্রকাণ্ড বিল। তার একাংশের নাম ‘চামটার বিল’। এই বিল থেকে মৃত্তিকা সংগ্রহ করেই কি ঐ জনপদ গড়ে উঠেছিল? ‘চামটার বিল’ নামটি হয়েছে ‘চামুণ্ডার বিল’ শব্দ থেকে। এক কালে এই বিলের পাশে চামুণ্ডা দেবীর একটি মন্দির ছিল নিশ্চয় হয়তো তারও পূর্বে ছিল এক বৌদ্ধ সঙ্ঘারাম[২]।

[১. রূপেন্দ্রনাথ দৃষ্ট মন্দির বর্তমানে অবলুপ্ত। এখন—চল্লিশ বছর আগে দেখেছি—সেই আদিম মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ—ইতস্তত বিক্ষিত কালো আর পিঙ্গল বর্ণের বালি-পাথর বা স্যান্ডস্টোন। এখনও তা দেখা যায় কিনা জানি না। পরে একটি ছোট মন্দির তৈরী করা হয়েছে বলে শুনেছি।
২. চল্লিশের দশকে এখানে একটি ব্রোঞ্জ ধাতুর ‘উগ্রতারা’র মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে।]

সৌভাগ্য রূপেন্দ্রনাথের। মন্দিরের দ্বার খোলা ছিল। পুরোহিত ওঁকে চরণামৃত দিলেন। কষ্টিপাথরের প্রকাণ্ড দেবমূর্তি। বহুস্থানেই অঙ্গহানি হয়েছে। সাধারণত অঙ্গহীন হলে দেবতার পূজা বন্ধ হয়ে যায়। নৃসিংহদেবের তা হয়নি—যেহেতু তিনি অনাদি বিগ্রহ! জনশ্রুতি নৃসিংহদেবের ভূমধ্যে একটি পরশমণি ছিল। সেটি অপহরণের উদ্দেশ্যেই ঐ অঙ্গহানি। যে তস্কর সেই পরশপাথরখানি খুলে নিয়েছিল সে তা ব্যবহার করতে পারেনি—এটাই তস্করের দুঃখ এবং সাধুর সান্ত্বনা! দেবতার ভ্রূ মধ্য থেকে বিচ্যুত হওয়ামাত্র স্পর্শমণি তার অলৌকিক গুণটি হারিয়ে ফেলে! যতদিন দেবতার ভূমধ্য ছিল ততদিন নাকি এয়োস্ত্রীর দল ঐ পাথরে হাতের নোয়া ছুঁইয়ে সোনার বালা পরে ঘরে ফিরত। দেবতার অঙ্গচ্যুত হবার পর সেই পরশমণি হয়ে গেল মামুলি পাথর! দেবমূর্তির উচ্চতা দ্বি-হস্ত পরিমাণের অধিক। পদতলে প্রহ্লাদ, অঙ্কে হিরণ্যকশিপু।

রূপেন্দ্রনাথ যখন শহরে ফিরে এলেন তখন পড়ন্ত বেলা।

নিবারণচন্দ্র অপেক্ষা করছিলেন। প্রশ্ন করেন, কোথায় গেছিলেন?

—দেবপল্লী। নৃসিংহদেবের মন্দির দেখে এলাম।

–বড় জাগ্রত দেবতা। চলুন, এবার দত্তবাড়ি যাই!

বেশ বড় প্রাসাদ। দ্বিতল। সামনে লোহার সিং-দরোজা। খিলানের উপর থাবা-তোলা এক সিংহ মূর্তি। কার্নিশে অসংখ্য গোলা পায়রা। ওঁদের দেখতে পেয়েই দত্তজার সেই সরকারবাবু—যে ওঁকে সোঞাই থেকে নিয়ে এসেছে—সে এগিয়ে এল। নিবারণচন্দ্রকে বললে, আপনি আজ আসুন পণ্ডিতমশাই। আজ সন্ধ্যায় পাঠ হবে না। আপনার ছুটি।

রূপেন্দ্রকে বললে, আপনি ঐ বৈঠকখানায় গিয়ে বসুন। আমি হুজুরের কাছে এত্তেলা পাঠাচ্ছি।

নিবারণচন্দ্র বিদায় নিয়ে ফিরে গেলেন। সরকারবাবু অন্দরের দিকে এগিয়ে গেল। রূপেন্দ্রনাথ পায়ে পায়ে অগ্রসর হয়ে আসেন বৈঠকখানায় দিকে।

প্রকাণ্ড ঘরটি। একদিকে বিরাট বড় একটা তক্তাপোষ। তার উপরে জাজিম পাতা। তিনচারজন পণ্ডিত বসে তালপাতার পুঁথি নকল করছেন। অদূরে একটি আরাম-কেদারায় নির্লিপ্তভাবে বসেছিলেন একজন। বয়স ত্রিশের কোটায়। শ্যামবর্ণ। মাথায় বাবরি চুল। শুকচঞ্চু নাসা। চোখদুটি স্বপ্নালু। ভ্রমধ্যে একটি শ্বেতচন্দনের ফোঁটা। নগ্নগাত্রে উত্তরীয়—সামবেদী দীর্ঘ উপবীত। রূপেন্দ্র প্রবেশ করতেই দাঁড়ালেন। যুক্তকরে বললেন, নমস্কার। আপনি নিশ্চয় সেই ধন্বন্তরি! আপনি আজই পৌঁছাবেন; আমরা জানতাম।

অনুলেখকেরা চোখ তুলে ওঁকে দেখল। পুনরায় যে যার কাজে নিমগ্ন হল।

রূপেন্দ্র প্রতিনমস্কার করে বললেন, আপনি ঘটনাচক্রে আমার পরিচয় জানেন; কিন্তু আমি মহাশয়ের পরিচয় জানি না।

যুবক তখনও যুক্তকর। সহাস্যে বলেন, বিবৃত করার মতো পরিচয় যে নাই, কী বলব? আমি নদীয়াধিপতি শ্রীমন্ মহারাজের বৃত্তিভোগী এক সামান্য কবি!

রূপেন্দ্রের মনে পড়ে গেল গুরুদেবের বর্ণনা। হুবহু মিলে যাচ্ছে। তিনিও সহাস্যে বলেন, দর্শনমাত্র আপনি আমাকে সনাক্ত করেছেন। আমারও তাই করা কর্তব্য। …আপনার আদিনিবাস পেঁড়ো, ভুরশুট! ঠিক হয়েছে?

যুবকের আয়ত স্বপ্নময় চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে গেল। বলেন, তাহলে আমি কি ভুল শুনেছি? আপনি চরক-সুশ্রুত নয়, ‘ভৃগু’ আয়ত্ত করেছেন? আমার আদিনিবাস জানলেন কী করে?

—সহজেই! আপনি বাকপ্রয়োগে ‘অ’-প্রত্যয়টি বিনয়বশত পরিত্যাগ করায়।

—’অ’-প্রত্যয়? অস্যার্থ?

—নিজের পরিচয় দিলেন ‘সামান্য কবি’ বলে। ‘অ’-প্রত্যয় বাদ গেছে কিনা তা আপনি বুঝবেন না, আপনার বঙ্গভাষায় অধিকার কম! বঙ্গ-সরস্বতীর বরপুত্র অসামান্য কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর এ স্থলে উপস্থিত থাকলে বুঝতেন!

বিস্ময়বিমূঢ় ভারতচন্দ্র এগিয়ে এসে ওঁর দুটি হাত ধরে বলেন, ইতিপূর্বে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে বলতে চান?

—না। এই আমাদের প্রথম পরিচয়। আপনি ইতিপূর্বে আমাকে দেখেননি, কিন্তু আমি আপনাকে চিনেছি। ঘনিষ্ঠভাবে!

—ঘনিষ্ঠভাবে! কোথায়?

—আপনার ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে। ত্রিবেণীতে। আমার গুরুদেবের সংকলনে আপনার সে কাব্যগ্রন্থের একটি অনুলিপি পুথি আছে।

—আপনার গুরুদেব…?

যুক্তকর ললাটে স্পর্শ করিয়ে রূপেন্দ্র বললেন, আমার শিক্ষাগুরু মহামহোপাধ্যায় জগন্নাথ তর্কালঙ্কার।

ভারতচন্দ্রও উদ্দেশ্যে প্রণাম করে বলেন, এ তো বড় অদ্ভুত কথা শোনালেন আপনি! তাঁর সংকলনে এ দীন কবির গ্রন্থ!

দুজনে বসলেন পাশাপাশি। রূপেন্দ্র প্রশ্ন করেন, ঝষধ্বজ দত্তমশাই তাঁতের কাপড়ের কেনাবেচা করেন শুনেছি। তাঁর দরবারে আপনি?

একটু আগেই যে নির্মল আনন্দে উদ্ভাসিত হয়েছিল কবিবরের মুখমণ্ডল তাতে যেন একটি ছায়াপাত ঘটল। বললেন, আমার পরবর্তী কাব্যের কিছু অংশের অনুলিপি করাচ্ছেন দত্ত-মশাই। মূল পাণ্ডুলিপি থেকে—ঐ যে ওঁরা করছেন। সমস্ত গ্রন্থটি নয়, অংশবিশেষ। প্রায় পঞ্চাশ পৃষ্ঠা। স্বয়ং উপস্থিত থেকে অনুলিপি হয়ে গেলে নিয়ে যাব বলে বসে আছি। মূল পাণ্ডুলিপি তো—খোয়া গেলে সর্বনাশ!

রূপেন্দ্র উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। বলেন, আপনার পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ! কী নাম? কী বিষয়বস্তু?

—না, একে ঠিক ‘পরবর্তী গ্রন্থ বলা’ যায় না। ‘অন্নদামঙ্গলের’ই পরবর্তী কিছু অংশ। পূর্ব অংশের সঙ্গে সংযোজন করা হবে।

—কেন? আমার তো মনে হয়েছিল ‘অন্নদামঙ্গল’ সুসমাপ্ত।

ম্লান হাসলেন ভারতচন্দ্র। বললেন, অহো ভাগ্য! আপনি কেন একজন রাজাধিরাজ হলেন না? তাহলে আপনার সভাকবি হবার জন্য আর্জি পেশ করতাম।

এ বক্রোক্তির অর্থগ্রহণ হল না। রূপেন্দ্র বলেন, দু একটি পৃষ্ঠা দেখতে পারি?

—আপনার অভিরুচি এবং আমার সৌভাগ্য।

অনুলিপিকারকেরা যে পৃষ্ঠাগুলি অনুলেখন করে সরিয়ে রেখেছে তার একটি তুলে নিয়ে পড়তে থাকেন।

প্রথম পংক্তিটাতেই খটকা লাগল—’গিরি অধোমুখে কাঁদে, চকোরি পাইয়া চাঁদে…’

কিসের বর্ণনা? পূর্বাপর পারম্পর্য বুঝে নিতে আগের পৃষ্ঠাটি তুলে নিলেন। ইতিমধ্যে গৃহভৃত্য এসে রায়গুণাকরের হাতে একটি কড়িবাঁধা থেলো হুঁকো দিয়ে গেছে। তিনি গুডুক-গুড়ুক টানছিলেন, আর আড়চোখে পাঠককে লক্ষ্য করছিলেন—তার ভুকুঞ্চন, তার ঔৎসুক্য, তার আগ্রহ। লক্ষ্য হল, পর পর সাত-আটখানি পৃষ্ঠা দ্রুত নিশ্বাসে পাঠ করে রূপেন্দ্রনাথ সেগুলি যথাস্থানে নামিয়ে রাখলেন। আরও অনেকগুলি পৃষ্ঠা অপঠিত থাক দেওয়া ছিল—কিন্তু রূপেন্দ্র সে দিকে হাত বাড়ালেন না। কেমন যেন বেদনার্ত হয়ে উঠেছে তাঁর. মুখখানি।

রায় গুণাকর প্রখর বুদ্ধিমান। বুঝলেন। তবু প্রশ্নটা পেশ না করে থাকতে পারলেন না, কই, কেমন লাগল বললেন না যে?

রূপেন্দ্রনাথ স্পষ্টবক্তা। ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গলং পাঠ করে এককালে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। সংস্কৃত নয়, সর্বজনবোধ্য সহজ বাঙলায় যে এমন সুললিত কাব্য রচনা করা সম্ভব, এটা যেন সেদিন স্বচক্ষে দেখেও বিশ্বাস হয়নি তাঁর। বস্তুত নদীয়া রাজসভার ঐ মধ্যমণিকে প্রত্যক্ষ করার, তাঁর সঙ্গে পরিচিত হবার দুরন্ত বাসনা নিয়েই এতটা পথ এসেছেন। মনের পটে কবির যে মূর্তি এঁকেছিলেন তার সঙ্গে বাস্তবের মিল দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। তাই দর্শনমাত্র তাঁকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। কিন্তু ঐ আট-দশটি পৃষ্ঠা পাঠান্তে তাঁর মোহভঙ্গ হয়ে গেছে! মহাকবির অবক্ষয়ে তাঁর অন্তর ক্ষতবিক্ষত। এ কী অশ্লীল রচনা—কী ক্লেদাক্ত দৈহিক মিলন-বর্ণনা! যেন কবি রায়গুণাকর তাঁর হৃদ্‌পদ্মের কোরকটি বাণীর পদতলে অর্ঘ্য দিতে গিয়ে ভুল করে বারবনিতার চরণতলে অঞ্জলি দিয়েছেন! সদ্যপরিচিত কবিকে একথা বলতে বাধল।

কবি হয়তো বুঝলেন, হয় তো বুঝলেন না। বললেন, বাড়জ্জেমশাই! কবির ভাগ্যে দু-জাতের বিড়ম্বনা। এক: অরসিককে রসনিবেদন; দুই: সুরসিকের উপেক্ষা! প্রশংসা না করতে পারেন তো তিরস্কারই করুন। নীরব কেন পাঠক?

রূপেন্দ্রের নাসাপুট স্ফীত হয়ে উঠল। বললেন, “সত্যং ব্রুয়াৎ প্রিয়ং ব্রুয়াৎ, মা ব্রুয়াৎ সত্যমপ্রিয়ম্। অপ্রিয়ঞ্চাপৃতঞ্চাপি প্রিয়ায়াপি হিতং বদেৎ।।”

ভারতচন্দ্র অধোবদন হলেন। একটু ভেবে নিয়ে বললেন, দীর্ঘ এক বৎসর ধরে আমি যা রচনা করেছি তার মূল্যায়ন কি ঐ কয়খানি পৃষ্ঠা পাঠ করে করা যায়?

রূপেন্দ্র স্পষ্টবক্তা। বললেন, অন্ন সুপরিপক্ক হয়েছে কিনা সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দু একটি চাউলের বেশি পরীক্ষা করতে হয় না।

ভারতচন্দ্র একটু ঝুঁকে আসেন। প্রায় কানে কানে বলেন, কিন্তু আমি তো এক হাঁড়ি আদিরস রন্ধন করিনি, পাঠক! পঞ্চব্যঞ্জন পরিবেশনের বাসনা যে আমার! নবরসের পাকে প্রস্তুত সে আহার্যপাত্রের একটি প্রাত্ত থেকে আপনি স্বাদ গ্রহণ করেছেন। ঘটনাচক্রে সেটি নিম-বেগুন! তা থেকেই আপনি বুঝে নেবেন, পরমান্নটা উৎরেছে কি না?

রূপেন্দ্রনাথ প্রত্যুত্তর করলেন না। কথাটা ভারবার।

ভারতচন্দ্র পুনরায় প্রশ্ন করেন, আপনি ভেষগাচার্য! বিষস্ফোটক অস্ত্রোপচার করেছেন কখনো?

এই অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের তাৎপর্য বুঝতে পারেন না। বলেন, করেছি। সে-কথা কেন?—সেই খণ্ডমুহূর্তে যদি আপনাকে আমি দেখতাম, আর এই ধারণা নিয়ে যেতাম যে,-ঐ লোকটার দু হাতে শুধু রক্ত আর পুঁজ, তাহলে আমার সে সিদ্ধান্ত নির্ভুল?

রূপেন্দ্রনাথ চমকিত হন। কিন্তু প্রত্যুত্তর দেবার অবকাশ হল না। তার পূর্বেই সেই সরকার-মশাই ফিরে এলেন অন্দরমহল থেকে। রূপেন্দ্রকে বললেন, আজ তো রুগী দেখা হবে না, কবিরাজ-মশাই। উনি অসুস্থ। দেখা করতে পারছেন না। কাল সকালে আপনাকে খবর দেব।

রূপেন্দ্র সবিস্ময়ে বলেন, বুঝলাম না। তিনি যদি অসুস্থই হয়ে থাকেন তাহলে কবিরাজের প্রয়োজনই তো সর্বাগ্রে।

সরকারমশাই মাথা চুলকান। কী জবাব দেবেন বুঝে উঠতে পারেন না। তাঁকে রক্ষা করেন কবি ভারতচন্দ্র। বলেন, প্রয়োজন হবে না। এ রোগের প্রতিষেধক ওঁদের জানা। হয়তো কিছু তেঁতুলগোলা জল খাওয়াবেন। বারকয়েক বমি হয়ে গেলেই সুস্থ বোধ করবেন উনি।

দিনের আলো কমে এসেছে ইতিমধ্যে। অনুকারকের দল মূল পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠাগুলি রজ্জুবদ্ধ করে নমস্কারান্তে বিদায় নিয়েছে। ভারতচন্দ্র সেগুলি বগলদাবা করে রূপেন্দ্রের সঙ্গে ঘর থেকে বার হয়ে আসেন। জানতে চান, কোথায় উঠেছেন আপনি?

রূপেন্দ্র তা জানালেন। এ কথাও বললেন যে, সেই ক্লেদাক্ত পরিবেশটি তাঁর পছন্দ হয়নি। তিনি জানতে চাইলেন, এখানে অর্থমূল্যে কোন পান্থশালায় রাত্রিবাসের আয়োজন হতে পারে কি না।

কবি বললেন, পারে। তবে আমাকে যদি কুসঙ্গ বলে না মনে করেন, তাহলে আপনি আমার গৃহেও অতিথি হতে পারেন।

রূপেন্দ্র ওঁর হাত দুটি ধরে বলেন, এ কী বলছেন, কবি! বিশ্বাস করুন, আমি নদীয়ার এসেছি যে কটি বিস্ময় দেখব বলে তার ভিতরে ছিল ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের রচয়িতা। না হলে দর্শনমাত্র কেমন করে আপনাকে চিনব বলুন? কিন্তু এই অবেলায় আমাকে আপনার ভদ্রাসনে নিয়ে গেলে কবিপত্নী অহেতুক বিব্রতা হয়ে পড়বেন।

ভারতচন্দ্র হেসে ফেলেন। বলেন, আপনার আশঙ্কা অমূলক। আমার ভার্যা আছে তার পিত্রালয়ে। আমি এখানে একটি ভৃত্যকে নিয়ে থাকি। আমার আবাল্যসহচর পুরাতন ভৃত্য। কিছু দুর্মুখ। আমার সহে গেছে। আপনাকেও মেনে নিতে হবে। এ ছাড়া আর কোনও অসুবিধা নেই। বরং আমার কিছু স্বার্থ আছে।

—স্বার্থ! সেটা কী?

—তার পূর্বে বলুন, আমরা কি দত্তবাড়ি থেকে সাত পা পার হয়ে আসিনি।

—সাত-পা! অনেকক্ষণ। কিন্তু এ কথা কেন?

—শাস্ত্র বলেছেন, ‘আহুঃ সপ্তপদী মৈত্রী’[১]। সুতরাং আর ‘আপনি-আজ্ঞে’ নয় রূপেন্দ্র! এবার তোমার প্রশ্নের উত্তরটা দিই। তুমি আমার ভদ্রাসনে আতিথ্য নিলে আমি পঞ্চব্যঞ্জনের পাত্রটি স্বহস্তে তোমাকে পরিবেশন করব। লেখক এবং কবির সবচেয়ে বড় প্রয়োজন কী জান? একজন সুরসিক বোদ্ধা পাঠক—যে পাণ্ডুলিপি পাঠান্তে তার অকুণ্ঠ মতামত প্রকাশ করতে পারে। সপ্তপদ গমন করার পর যে ঐ উদ্ভট শ্লোকটার তোয়াক্কা করবে না: ‘মা ব্রুয়াৎ সত্যমপ্রিয়ম্।’ তুমি সে দায়িত্ব নেবে, বন্ধু? আমার ‘বিদ্যাসুন্দর’ পাঠ করে প্রয়োজনে আমাকে তিরস্কার করতে?

রূপেন্দ্রনাথ পথের মাঝেই জড়িয়ে ধরলেন ভারতচন্দ্রকে!

[১. যার সঙ্গে সাত-পা একসঙ্গে হাঁটা যায়, তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায়।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *