১৩
রূপেন্দ্র শেষমেশ অনুমতি আদায় করতে পেরেছেন। যখন বুঝিয়ে বলতে পারলেন, উনি গয়ারামকে সোঞাই গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান। সেখানকার একজন ধনী গৃহস্থের কন্যাকে বিবাহ করেছিল ঐ গয়ারাম, অর্থাৎ গঙ্গাচরণ। সেই ধনী ভূস্বামীই সন্ধান পেয়ে রূপেন্দ্রকে গোয়াড়ি-গঞ্জে পাঠিয়েছে খরচপত্র দিয়ে-জামাতা বাবাজীবনকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।
এককথায় রাজী হয়ে গেল রসিকলাল। আপদ বিদায় হবে। নিজে থেকেই বলল, আপনি ও-শালাকে রাজী করান। আমি নিজে ওকে নৌকায় তুলে দিয়ে আসব। নিজের খরচে বিদায় করব। নাম-ধাম ঠিকানা লিখে দিয়ে যান শুধু।
রূপেন্দ্র বাহিরে এসে ভারতচন্দ্রকে খুঁজে বার করলেন। কবি ততক্ষণে সামলেছেন। অপ্রিয় প্রসঙ্গটা দুজনেই এড়িয়ে গেলেন—অর্থাৎ বিদ্যাসুন্দরের মূল্যায়ন।
গঙ্গাচরণ চিনতে পারল না রূপেন্দ্রকে। চেনা সম্ভবপরও নয়। এমন কি দামোদর নদের তীরে সোঞাই গ্রামখানার কথাও তার স্মরণে এল না। স্বীকার করল, সে-আমলে কত কত গাঁয়ে গেছি, বে-করেছি। সে-সব লেখা ছিল আমার খেড়ো খাতায়। অত নামধাম কি মুখস্ত থাকে?
জানতে চাইল, সোঞাই গ্রামে তার শ্বশুরের ধাম। রূপেন্দ্র তা বললেন না। রসিকলালকে যে-কথা বলেছিলেন তারই পুনরাবৃত্তি করলেন। জানালেন, ঐ সোঞাই গ্রামের একজন ধনী গৃহস্থ—ওর শ্বশুর মহাশয়—ওকে ফেরত নিয়ে যাবার জন্য রূপেন্দ্রকে পাঠিয়েছেন। গঙ্গাচরণ স্বীকৃত হলে তিনি ওকে নিয়ে যাবেন।
গঙ্গাচরণ আনন্দে আটখানা। বললে, রাজী হব না? কী বলছেন, মহাশয়? তিনি আমাকে জামাই-আদরে নিয়ে যেতে চাইছেন আর আমি এই আস্তাবলে পড়ে থাকব? যাওয়ার জন্যে আমি একপায়ে খাড়া… মানে দু পা থাকলেও একপায়ে খাড়া হতাম!
রূপেন্দ্র বললেন, রায় মহাশয় দু-এক দিনের ভিতর তোমাকে নৌকাযোগে পাঠিয়ে দেবেন। তুমি তৈরী হয়ে নাও!
—আমি তো তৈরীই। কিন্তু আমার শ্বশুর মশায়ের নামটা? সোঞাই গাঁয়ে পৌঁছে কার বাড়ি খোঁজ করব?
রূপেন্দ্রকে থামিয়ে ভারত প্রত্যুত্তর করেন, সেটা এখনি তোমাকে বলতে পারছি না। তুমি গিয়ে উঠবে রূপেন্দ্রনাথ ভেষগাচার্যের আরোগ্যশালায়। সেখানে তোমার থাকার বন্দোবস্ত করে দেওয়া হবে, যতদিন না ইনি গিয়ে পৌঁছান।
গঙ্গাচরণ জানতে চায়, এই লুকোচুরির অর্থটা কী? এখনি বলতে বাধা কোথায়? ভারত বলেন, আমরা প্রথমে আমাদের প্রাপ্যটা আদায় করি। জামাই পেয়ে শেষে ভদ্রলোক যদি আমাদের লবডঙ্কা দেখায়?
গঙ্গাচরণ বুঝতে পারে। এতো সহজ কথা! স্বীকৃত হয়।
প্রত্যাবর্তনের পথে রূপেন্দ্র প্রশ্ন করেন, গঙ্গাকে তার শ্বশুরালয়ের কথাটা কেন বললে না ভারত? এক গঙ্গা মিছে কথা বলে গেলে কেন?
ভারত বলেন, আমি কবি। বানিয়ে বানিয়ে কাহিনী রচনা করা আমার পেশা। তবু একটি বিশেষ কারণে ঐ মিথ্যাভাষণ করেছি। কিন্তু তুমি কেন মিথ্যা কথাটা বললে, রূপেন? তুমিও তো রসিকলালের কাছে স্বীকার করনি যে, ও তোমার ভগ্নিপতি! সত্য গোপন করলে কেন?
রূপেন্দ্র বলেন, দেখ ভারত, ‘সত্য’ শব্দটার লৌকিক অর্থ আমি মানি না। ‘সত্য’ তাই, যা ‘শিব’-এর দিশারী। আমি যদি এখানেই স্বীকার করতাম যে, গঙ্গাচরণ আমার ভগ্নিপতি তাহলে নানান জটিলতার সৃষ্টি হত। নিজের পূর্ণ পরিচয় দিতে হত। গঙ্গাও হয়তো রাজী হওয়ার আগে মোটারকম পার্বণী চেয়ে বসত। রসিকলাল ধূর্ত ব্যবসায়ী মানুষ—আমি অন্য একজন ধনীব্যক্তির নির্দেশে কিছু প্রাপ্তিযোগের প্রত্যাশায় কাজ করছি—এ তথ্যটা সে সহজেই মেনে নিল। গঙ্গাও সেই অচেনা ধনী শ্বশুরের প্রত্যাশায় এককথায় রাজী হয়ে গেল। আমার মূল লক্ষ্য ছিল ‘শিব’, ‘মঙ্গল’। কাতুর, গঙ্গার, রসিকলালের, তার মায়ের, সকলের সমস্যা সমাধান করে মঙ্গল বিধান করেছি। ফলে, ‘মিথ্যাচার’ করিনি আমি। ‘সত্য’ সৃজন করেছি—যে সত্য ‘শিব’-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত!
ভারতচন্দ্র মৃদু হেসে বলেন, সুন্দর কথাটি বলেছ রূপেন—’আমি সত্য সৃজন করেছি।’
—এবার তুমি বল, তুমি কেন মিথ্যার আশ্রয় নিলে?
—আমি ‘পাদপূরণ’ করেছি মাত্র। আমি যে কবি। ‘সত্য’ তো শুধু ‘শিব’-এর সঙ্গেই সম্পৃক্ত নয়, সে যে অচ্ছেদ্যবন্ধনে আবদ্ধ ‘সুন্দর’-এর সঙ্গেও! আমি সেই ‘সুন্দর’-এর উপাসক। ‘সুন্দর’-এর মুখ চেয়ে ‘সত্য’কে সৃজন করেছি।
–বুঝলাম। তবু আর একটু ব্যাখ্যা শুনতে ইচ্ছে করছে।
—আমি যে কুহকটা রচনা করলাম—লৌকিক ব্যাখ্যায় যা ‘মিথ্যা’, আমার ধারণায় তা ‘সত্য’। তার নানানরকম ফলাফল কল্পনা করতে পারছি। অনায়াসলব্ধ নায়িকার কদর নায়কে করে না। সোঞাই আরোগ্য-নিকেতনে পৌঁছে ঐ গঙ্গাচরণ খুঁজতে থাকুক—কে তার নিরুদ্দিষ্টা প্রিয়া। কোন্ সীমন্তিনী তার অজ্ঞাতে অথচ তারই আয়ুষ্কামনায় সিঁথিতে আঁকে সিঁদুরের রেখা, হাতে পরে খাড়-শাঁখা। সোঞাই গাঁয়ের যাবতীয় সীমন্তিনী তার মা-বোন—শুধু একটি ব্যতিক্রম! তাকে খুঁজে বার করতে হবে। তাকে সনাক্ত করতে হবে। সেই উদগ্রীব আগ্রহ, সেই ঐকান্তিক উৎসাহই ওর অন্তরে প্রেমের সঞ্চার করবে। মিলনমুহূর্তটিকে আনন্দঘন করে তুলবে। আবার ওদিক দিয়ে বিচার কর—কাত্যায়নী একটি রুগীর সেবা করছে। সম্পর্কটা আর্ত আর শুশ্রুষাকারিণীর। তবু মাঝে মাঝে কাত্যায়নীর মনে হবে—ও লোকটা অমন করে কী দেখে তার দিকে তাকিয়ে? বেচারী তো জানে না, গঙ্গাচরণ একটি বিশেষ সীমন্তিনীকে খুঁজছে সোঞাই গ্রামে পদার্পণের পর থেকেই!
রূপেন্দ্র অট্টহাস্য করে ওঠেন, ওরে ব্বাবা! তুমি যে ‘কাতু-গঙ্গা’কে নিয়ে মনে মনে এক মহাকাব্য রচনা করে বসে আছ!
ভারতচন্দ্র ম্লান হাসেন, কী করব বল ভাই? ‘খেউড়ানন্দ’ হলেও আমি যে করি!
রূপেন্দ্র তিরস্কার করেন, ছিঃ! ঐ অর্বাচীন মদ্যপটার কথায় তুমি কান দিয়েছ?
ভারত একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে বলেন, ওর কথায় নয়, ভাই। আমার মনে এক আত্মজিজ্ঞাসা জেগেছে! ভাবছি, মহারাজকে সরাসরি প্রশ্ন করব—কেন তিনি আমাকে টেনে নামিয়ে আনলেন এই পঙ্ককুণ্ডে?
রূপেন্দ্র বয়স্যের হাতখানি চেপে ধরে বলেন, না! তুমি তা কর না। প্রশ্নটা আমাকেই করতে দাও। আমি জেনে নিয়ে তোমাকে জানাব। ঠিক যেভাবে আমাকে না জানিয়ে তুমি জেনে নিয়ে ছিলে গঙ্গাচরণের খবর।