কাশীধাম : 1774 - প্ৰথম পৰ্ব
সোঞাই : 1742 - দ্বিতীয় পৰ্ব
নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর : 1742 - তৃতীয় পৰ্ব
তীর্থের পথে : 1742 - চতুর্থ পর্ব
1 of 2

সোঞাই – ১০

১০

—কইরে, তোরা কোথা গেলি সব? খেঁদি, বুঁচকি, ছোটখুকি, শোভা-মা?

নন্দ চাটুজ্জে সটান অন্দরমহলে ঢুকে পড়েছেন।

গাঙ্গুলীবাড়িতে অবশ্য তাঁর অবারিত দ্বার। মৃন্ময়ী রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে মোচা কুটছিল। তার মাথায় আধো-ঘোমটা, কারণ ঠাকুরপোরা কেউ বাড়ি নেই। হঠাৎ পুরুষকণ্ঠে ঐ বাজখাঁই অওয়াজ শুনে সে শশব্যস্তে কপাটের আড়ালে আত্মগোপন করে।

নন্দ একগাল হেসে বলেন, আমাকে দেখে আপনার অত সরম কিসের বোঠান? আর বঁটিটে যে খাড়া করা রইল, ভর সন্ধ্যেবেলা!

এটা অশাস্ত্রীয় কাজ। মৃন্ময়ী ইতস্তত করে। বঁটি ছেড়ে উঠে যাওয়ার সময় সেটাকে শুইয়ে রেখে যেতে হয়। নাহলে গৃহস্থের অকল্যাণ। কিন্তু নন্দ ঠাকুরপো যেভাবে ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন—

শোভা বুঝল। চট করে বঁটিটা শুইয়ে দিয়ে বললে, আসুন কাকা। বসবেন আসুন-

—তোর বাপ কি কচ্ছে রে শোভা?

—আহ্নিক করছেন। এই হয়ে এল।

—আহ্নিক! বলিস কী রে? আজ যে সায়ংসন্ধ্যা নাস্তি।

ঠাকুরঘর এমন কিছু তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে নয়। তাছাড়া দুর্গাচরণ যখন সন্ধ্যাহ্নিক সারেন তখন কান দুটি সজাগ রাখেন। নন্দভায়ার নিদান শুনেই ‘শ্রীবিষ্ণু’ বলে উঠে বাহিরে আসেন। পরিধানে পাটের কাপড়, বরাঙ্গে নামাবলী, শিখাপ্রান্তে একটি কলকে ফুল। বলেন, চাটুজ্জে নাকি? এস, এস। কিন্তু ওটা কী বললে? আজ সায়ংসন্ধ্যা নাস্তি? কই, তিড়বিড়ে তো সকালে সেকথা বলে গেল না?

‘তিড়বিড়ে’ ওঁর পিতৃদত্ত নাম নয়। তবে নিত্যপূজার ব্যবস্থা যাঁর হেপাজতে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের হেতুতেই সবাই বলে তিড়বিড়ে-ঠাকুর। দুর্গার অভিযোগ, সেই তিড়বিড়ে-ঠাকুরের উচিত ছিল জানিয়ে যাওয়া যে, আজ সায়ংসন্ধ্যার প্রয়োজন নেই।

নন্দ বলেন, দুটো পাঁজিতে দু-রকম মত কিনা, তাই—

—সেক্ষেত্রে যজমানের যেটা সুবিধা সেই মতই তো বিধান দেবে! ‘আস্তি-নাস্তি’ বেছে নিয়ে। আধঘণ্টা ধরে অহেতুক মশার কামড় খাচ্ছি!

নন্দভায়াকে নিয়ে এসে বসালেন তাঁর ঘরে। শোভারানীকে বললেন, বিশুকে বল, কুলীনহুকোয় তামাক দিয়ে যেতে।

বাঙলা দেশের গ্রামে তখন সচরাচর তিন জাতের হুঁকো : বামুন, কায়েৎ আর বেনৈ। বাদবাকিরা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। তবে এ গ্রামের নিষ্ঠাবান সমাজপতিরা কিছু উপবিভাগের বিধান দিয়েছেন। বামুন-হুকোও আবার তিন জাতের : কুলীন, কাপ আর ছুরিত্তির। আর কিছু না, তাতে কার কতটা কৌলীন্য-মর্যাদা সেটা বারে বারে ঝালিয়ে নেওয়া যায়। তাছাড়া কুলীনদের মনে রাখা দরকার—কৌলীন্য খোয়ালে, হুঁকা-শ্রেণীবিন্যাসেও সমাজে একধাপ নেমে যেতে হবে।

আলোচনার শুরুটা হয়েছিল ভালই—চাষবাস, ফলন, ইত্যাদি দিয়ে। ক্রমে অনিবার্যভাবে ইদানিং কালের আচারভ্রষ্টতা আর ছোটজাতের ঔদ্ধত্যে। পরে নন্দ বললেন, ‘একটা খপর শুনেছ দাদা, দীঘির পাড়ে ঘর উঠছে?

দুর্গাচরণ বললেন, ওটা আমার শ্বশুরবাড়ির পাড়া চাটুজ্জে। খপর না পাবার কোন হেতু নেই। একবগ্গার রুগীপত্র নাকি গাছতলায় কষ্ট পাচ্ছে, তাই দানসাগর ঘর তুলে দিচ্ছেন।—তা দিন। তাঁর জমি, তাঁর সম্পত্তি, আমাদের কী বলার আছে; কিন্তু বিশু বললে, বা স্থা হচ্ছে একই ঘরে ওঁরা ছত্রিশ জাতকে ঠাঁই দেবেন। বলি, সেটা শুনেছ?

—শুনেছি। সে-কথার জবাবটাতো তুমিই দিলে। জমি তাঁর, সম্পত্তি তাঁর, কাকে থাকতে দেবেন তার বিধান কি তুমি-আমি দেব?

—এটা একটা কথা হল? আমি যদি গাঁয়ের পঞ্চজনাকে আমার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে সাত জাতকেএকপংক্তিতে বসাই, তাহলে তা মেনে নেবে দুর্গাদা? যেহেতু জমি আমার, ভূরিভোজের ব্যবস্থা আমার?

দুর্গা বললেন, কথাটা ভাববার। নেমন্তন্ন করার কথায় মনে পড়ে গেল, হ্যাঁ চাটুজ্জ্যে, একবগ্গা নাকি তোমার নেমন্তন্ন নেয়নি? কথাটা ঠিক?

—কে বললে?

—বলেনি কেউ। সেদিন মায়ের প্রসাদ নিতে সে তো এল না? কেমন যেন একটা কানাঘুষো শুনলাম।

—একবগ্গা বলেছে, সে ‘মহাপ্রসাদ’ ছোঁয় না! সে নাস্তিক!

দুর্গা আকাশ থেকে পড়লেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কিছু শুনলেন। বলা বাহুল্য নন্দ চাটুজ্জে সেদিন সন্ধ্যার কথোপকথন যতখানি সম্ভব বিকৃত করে পেশ করলেন। উপসংহারে বললেন, একটা কিছু বিহিত কর গাঙ্গুলীদা! শুধু ধোপা-নাপিত বন্ধ করলেই চলবে না, গাঁ থেকে তাড়াতে হবে।

দুর্গাচরণ, বললেন, হুঁ! ব্যবস্থা একটা কিছু করতে হচ্ছে। অঙ্কুরেই এসব পাপ বিনাশ করা উচিত! এতবড় দুঃসাহস!

নন্দ ঘনিয়ে এসে বলেন, আমিও একটা উড়ো খপর শুনলাম, কতাটা সত্যি?

—কী?

—বোঠানকে দেখতে এসে নাকি একবগ্গা কী এক কুপ্রস্তাব দিয়েছিল?

যেন প্রতিবর্তী প্রেরণা। দুর্গাও বলেন, কে বললে?

—কে বললে, সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু কতাটা সত্যি?

দুর্গাচরণ ইতিমধ্যে উপলব্ধি করেছেন, একবগ্গার কোন কুমতলব সেদিন ছিল না। কথাটার মধ্যে অশ্লীল কিছু থাকলে সবার সমুখে সে জমিদার গিন্নিকে বলতে পারত না ‘–বড়মা আপনার বুকটা একটু দেখব।’ তাছাড়া জামা-কাপড়ের উপর দিয়ে বুক-দেখার সেই আজব যন্ত্রটাকেও এতদিনে চিনে নিয়েছেন। তাই কথাটা ঘুরিয়ে নিলেন, না হে, কু-প্রস্তাব কিছু নয়। সেখানে তো শোভা ছিল, আম্মো ছিলাম। তবে কতার ধরনধারণ ঠিক ভদ্রজনোচিত নয়। খুড়িকে বার দুই নাম ধরে ডেকে বসল। হোক তোর পাড়ার মেয়ে। তাই বলে, শোভার সমুখে তুই ওকে ‘মীনু’ বলে ডাকিস কোন আক্কেলে?

নন্দ সায় দিলেন, শিক্ষাদীক্ষা না থাকলে যা হয়। ছেলেবেলা থেকে বাউণ্ডুলের মতো এ গাঁয়ে সে গাঁয়ে ঘুরেছে তো। কিন্তু কী করে ওকে কায়দা করা যায় বল তো?

—দেখছি! ছিদ্দির একটা বার করি আগে।

—ঐ তো ছিদ্দির! ‘মহাপ্রসাদ খাব না’ বলা!

দুর্গা ধমকে ওঠেন, বোকার মতো কথা বল না, চাটুজ্জে। সে ঘরের কোণে তোমাকে কী বলছে তাই নিয়ে ঘোঁট পাকানো কি ঠিক? টুটি টিপে ধরলে সে যদি বলে, কে বলেছে? বাজে কথা!

—জগুঠাকরুণ শুনেছে। কাতু ছিল।

—তারা তো তখন চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা। বলবে, “কই না তো! তখন? একবগ্গা যদি বলে বসে, নিয়ে আসুন গোটা পাঁঠা। বলি দিয়ে আমি একাই খাব? তখন? তাছাড়া, বুয়েছ না, জমিদার গিন্নির ব্যাপারে এখন সবাই ওকে মাথায় করে নাচছে। ঝড়ে কাক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে—

—’ঝড়ে কাক মরে’?

—মরে না? অতবড় তান্ত্রিক সাধক কৃষ্ণানন্দ বাচস্পতি যজ্ঞ করলেন, আড়াই মণ গব্য ঘৃত আহুতি দিলেন, সেসব কিছুই না?

—তা বটে! তাহলে?

—শোন ভায়া। এসব ব্যাপারে তাড়াহুড়া করা ঠিক নয়। ঝোপ বুঝে কোপ মারতে হবে। যাতে এক কোপেই ধড় থেকে মাথাটা নেমে যায়। শাস্ত্রে বলেছে না—‘মনসা চিন্তেৎ কৰ্ম্মো, বচসা ন প্রকাশয়েৎ’।

—কথাটা আম্মো শুনেচি। মানেটা জানি না। কোন শাস্ত্রে আছে গো গাঙ্গুলীদা?

—মনসামঙ্গলে।

—অ! তা মানেটা কী?

—মা মনসা কখনো কারও সাথে বচসা করেন না, চরম মুহূর্তে একটি ছোবলেই কম্মো সারা! বুয়েচো না?

পরাজয় স্বীকার করে নেননি বৃদ্ধ জমিদার ঐ তরুণ ভেষগাচার্যের কাছে। খনন করা হল নূতন পুষ্করিণী। আজব তার আকৃতি। প্রথমটা সকলে ধরে নিয়েছিল এটা খননকারকদের একটা মারাত্মক ভ্রান্তি। দু-একজন বড় মিস্ত্রিকে সেটা দেখিয়ে দিতেও চেয়েছিল; কিন্তু বড় মিস্ত্রি বলে–না, বড় কর্তার ঐ রকমই হুকুম। পুষ্করিণীর উত্তর ও দক্ষিণ পাড় সমান্তরাল, পুব-পশ্চিম পাড় তা নয়। হেতুটা সহজবোধ্য। উত্তরপাড়ের দৈর্ঘ্য চারশ দশ হাত, দক্ষিণ পাড়ের তিনশ ষাট! অর্থাৎ পঞ্চাশ হাতের হেরফের। কারা বুঝি ব্রজেন্দ্র—নারায়ণের কাছে দরবার করতেও গিয়েছিল, তাঁর এমন অদ্ভুত নির্দেশ সত্যই আছে কিনা জানতে। অথবা মিস্ত্রি নিজের ভ্রান্তিটা কর্তার ঘাড়ে চাপাতে চাইছে।

শুনে ব্রজেন্দ্র শুধু গম্ভীরভাবে বলেছিলেন, বল কী? দীঘিটাও অমন ‘একবগ্গা’ হয়ে গেল! এবার ঠেকাতে পারেননি। আরোগ্য নিকেতনের সঙ্গে নিজের নাম যুক্ত করতে রাজি হননি। এবার পারলেন না। দীঘির নাম হয়ে গেল—অনিবার্যভাবে : ‘একবগ্গা দীঘি!’

তার চারিদিকে উঠল প্রাচীর। না, বাঁশ বা শালখুঁটির বেড়া নয়। পাকা ইটের পাঁচিল। চুন-সুরকি মশলার। নির্মিত হল তিনটি আশ্রয়গৃহ। ধন্বন্তরির তত্ত্বাবধানে। গ্রামে ঢেঁড়া দেওয়া হল—ঐ পুষ্করিণী থেকে শুধুমাত্র পানীয় জলই সংগ্রহ করা যাবে, অবগাহন নিষিদ্ধ। এমনকি সংগ্রহকারী নিজ নিজ জলপাত্র ঐ পুষ্করিণীতে নিমজ্জিত করতে পারবে না। পানীয় জল সংগ্রহ করতে হবে বিচিত্র পদ্ধতিতে—একটি ঢেঁকিকলের রজ্জুর সঙ্গে আবদ্ধ নির্দিষ্ট জলপাত্রের সাহায্যে। বিচিত্র তার আকৃতি। সতীশ কামার রূপেন্দ্রনাথের নির্দেশ মোতাবেক এই অদ্ভুত পাত্রটি তৈরী করে বলেছিল, সারা জেবনভর কয়েক হাজার পাত্তর বানিয়েছি বাবু-মশাই, কিন্তুক্—এমন আজব পাত্তর বানাই নাই, যা মাটিতে থোওয়া যায় না।

তা সত্যি। পাত্রটির তলদেশ সূচালো। জমিতে তাকে রাখা যায় না। সেটি রজ্জুবদ্ধ অবস্থায় ত্রিশঙ্কুর মতো আকাশমার্গে ঝুলতে থাকে। ঢেঁকিকলের মাধ্যমে পানীয় জলটা সংগ্রহ করে তা পাত্রান্তরে সঞ্চয় করতে হয়!

পাগলের খেয়াল যাকে বলে!

একবগ্গা-ঠাউরের উৎকট রসিকতা!

শিরোমণি মশাই একদিন মাঝ সড়কে পাকড়াও করলেন ওঁকে। বললেন, আমাকে বুঝিয়ে বল তো রূপেন, এমন অদ্ভুত একটা জলপাত্র তুমি কেন তৈরী করালে? আর অমন চমৎকার একটা পুষ্করিণী খনন করিয়ে তা ‘প্রতিষ্ঠা করতে দিলে না কেন?

রূপেন্দ্রনাথ জানেন, এইসব স্থবির কূপমণ্ডূকদের সংস্কারকে যুক্তিতর্ক দিয়ে দূর করা যায় না। এ বিষয়ে তাঁর দীর্ঘ দিনের তিক্ত অভিজ্ঞতা। পাঁজি-পুঁথিতে দেবনাগরী হরফে যা লেখা আছে তাই হচ্ছে ধ্রুব সত্য। ‘আয়ুর্বেদ’ যদি ‘বেদ’ না হত, অথর্ববেদের অংশভাক্ বলে তাকে প্রচার না করা হত, তাহলে কেউ ওঁর ঔষধ মুখে তুলেই দেখত না। তাই তিনি ‘মা ব্লুয়াৎ সত্যমপ্রিয়ম্ নীতিবাক্যটাই সম্প্রসারিত করে নিয়েছেন। যাতে সাধারণের সামূহিক মঙ্গল তা তথ্যগতভাবে মিথ্যা হলেও তত্ত্বগতভাবে সত্য। তাই অনায়াসে বলতে পারেন, আমি যে স্বপ্নে ঐরকমই একটা প্রত্যাদেশ পেয়েছিলাম শিরোমণি-কাকা।

সহজ সরল কথা। বুঝতে কোন অসুবিধা হল না শিরোমণি-ঠাকুরের। বলেন, তাই বল!

বৃদ্ধ শিরোমণিকে যত সহজে নিবৃত্ত করতে পেরেছিলেন অত সহজে সন্তুষ্ট করা গেল না কিন্তু যুবক জমিদারতনয়কে। তারাপ্রসন্নও একদিন পাকড়াও করলেন ওঁকে, কী প্রত্যাদেশ পেয়েছ রূপেন্দ্র?

রূপেন্দ্রনাথ সেই সংক্ষিপ্ত আলাপচারী বিস্মৃত হয়ে গেছেন। সবিস্ময়ে জানতে চান, কী প্রত্যাদেশ? কে বলেছে।

—শিরোমণি ঠাকুরকে নাকি তুমি বলেছ যে, মায়ের প্রত্যাদেশেই ঐ একবগ্গা দীঘিকে তুমি প্রতিষ্ঠা করতে দাওনি।

রূপেন্দ্রনাথ মিটি মিটি হাসতে থাকেন।

—না, না, হেসে পার পাবে না। বল, স্বপ্নে তুমি কী প্রত্যাদেশ পেয়েছিলে?

—কোন প্রতিষ্ঠিত পুষ্করিণী থেকে নয়, শুধু মাত্র সংরক্ষিত পুকুরের জলপান করলেই সোঞাই গাঁয়ের এই ব্যাপক আন্ত্রিক রোগ দূরীভূত হবে। একে একে প্রতিটি পাড়াতেই আমি এ-ভাবে দু-একটি পুষ্করিণীকে সংরক্ষিত করব।

কেন এ প্রচেষ্টা—এই প্রশ্নটা জাগাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারাপ্রসন্ন সে দিক দিয়েও গেলেন না। তদানীন্তন চিন্তাধারায় তাঁর পরবর্তী প্রশ্নটি হল, কিন্তু ঁমায়ের কোন মূর্তিকে স্বপ্নে দেখতে পেলে তুমি? কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী—

বিচিত্র মানুষের কৌতূহল।

রূপেন্দ্রনাথ বললেন, না, তারাদা, কোন দেবীমূর্তিকে আমি স্বপ্নে দেখিনি।

—তাহলে তোমাকে প্রত্যাদেশটা দিলেন কে?

এবার হেসে বলেছিলেন, তারাদা, তুমি বাবামশায়ের টোলে বেশ কিছুদিন ব্যাকরণ অধ্যয়ন করেছিলে। বল দেখি, ‘প্রত্যাদেশ’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি কী?

—সেসব কবে ভুলে মেরে দিয়েছি। এ-কথা কেন?

—প্রতি+আ+দিগ্‌+অ (ভো)!

—এই শুরু হল পণ্ডিত্যেমি! বেশ, না হয় তাই হল। তাতে কী? আমার প্রশ্নের জবাব কোথায়?

—‘প্রত্যাদেশ’ শব্দটির দুটি অর্থ। প্রথম অর্থ : ‘দৈববাণী’, যে অর্থ গ্রহণ করেছিলেন শিরোমণি-ঠাকুর, করেছ তুমি। কিন্তু ওর দ্বিতীয় আর একটি অর্থ আছে: ‘পূর্বের আদেশ প্রত্যাহার করা’। আমি দ্বিতীয় অর্থে শব্দটা ব্যবহার করেছি। মিথ্যাভাষণ করিনি।

—কিন্তু কার আদেশ? কী আদেশ প্রত্যাহার করার কথা বলছ?

—কার আদেশ তা এখনি সঠিক বলতে পারছি না, তুমি এ গ্রামের কোন ঠাকুরমশাইকে প্রশ্ন করে জেনে নিতে পার। কোথাও না কোথাও এই শাস্ত্রীয় নির্দেশটি নিশ্চয় লেখা আছে দেবনাগরী হরফে—প্রতিষ্ঠিত পুষ্করিণীর দৈবমাহাত্ম্য এমন যে, তাতে আন্ত্রিক রোগাক্রান্ত রোগীর বস্ত্রাদি ধৌত করলে জল অপবিত্র হয় না।

তারাপ্রসন্ন বলেন, জিজ্ঞাসা করার কী আছে? এ কথা তো শিশুও জানে, প্রতিষ্ঠিত পুকুরের জল অপবিত্র, হয় না।

—সেই দেবনাগরী হরফে লেখা আদেশটা ‘প্রত্যাহার’ করার একটা প্রত্যাদেশ পেয়েছিলাম—স্বপ্নে নয়, শিক্ষায়। শাস্ত্রজ্ঞানে নয়, বিজ্ঞানের আশীর্বাদে।

তারাপ্রসন্ন স্বীকার করেন, বুঝলাম না।

—বসো। বুঝিয়ে বলি।

তারাপ্রসন্ন নব্যযুগের মানুষ। রূপেন্দ্রনাথের অপেক্ষা মাত্র বছর-পাঁচেকের বড়। ভবিষ্যৎ-জমিদার। তাঁকে স্বদলে আনতে হবে। রূপেন্দ্রনাথের অনেক-অনেক স্বপ্ন। এই সোঞাই গ্রামকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে আধুনিকতার একটা বাতাবরণ সৃষ্টি করবেন। অন্ধ কূপমণ্ডূকগুলোকে বুঝিয়ে দিতে হবে—দেবনাগরী হরফে যেখানে যা কিছু লেখা আছে তাই অভ্রান্ত সত্য নয়! গ্রাম্য জীবনের নৌকার কাণ্ডারী হচ্ছেন ভূস্বামী। জমিদার নিজেই যদি কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয় তবে বিবেকবুদ্ধির বর্তিকায় নতুন করে পথ খোঁজা যাবে না। ব্রজেন্দ্রনারায়ণ বার্ধক্যে উপনীত; তারাপ্রসন্ন নব্য যুবক। তাকে স্বদলে আনতে হবে।

বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব তাঁকে বোঝাতে থাকেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *