৬
রূপেন্দ্রনাথকে বৈঠকখানায় প্রবেশ করতে দেখে দুর্গাচরণ উদাত্তকণ্ঠে আহ্বান জানান, এস, বাবাজীবন! কতকাল পরে তোমাকে দেখলাম। তুমি গাঁয়ে ফিরে আসার পর রোজই ভাবি…..
একই কথা সবিনয়ে নিবেদন করলেন আগন্তুক। আমারই আগে আসা উচিত ছিল, কাকা। কিন্তু নানান কাজে—
—জানি, জানি। তোমার তো এখন দারুণ পশার! ক্রমাগত রুগীবাড়ি থেকে ডাক আসছে।
রূপেন্দ্রনাথ বুঝে উঠতে পারেন না—এটা অজ্ঞানকৃত না ব্যঙ্গোক্তি। পীরপুর এবং অন্ত্যজ পরিবারগুলি ছাড়া চিকিৎসক হিসাবে তাঁকে ইতিপূর্বে খুব অল্প লোকেই ডেকেছে। সেদিক থেকে আজই তাঁর প্রথম অভিযান। একটি বনেদী পরিবারে কবিরাজ হিসাবে আহ্বান পেয়ে আসা।
দুর্গাচরণের বৈঠকখানায় কাজ সারা হয়নি। তিনি রূপেন্দ্রনাথকে সংলগ্ন একটি কক্ষে নিয়ে এলেন। বার-মহলেই—একটি জনান্তিক কক্ষ। তেমন-তেমন গোপন পরামর্শের প্রয়োজনে ঘরটি ব্যবহৃত হয়। এঘরে এসে দুজনে দুটি চৌ-পায়ায় বসলেন। ভূমিকা ছেড়ে সরাসরি নেমে আসেন কাজের কথায়, তুমি হয়তো শুনে থাকবে গত বৎসর আমি একটি দারপরিগ্রহ করেছি। তোমাদের পাড়ারই পীতাম্বর ঠাকুরের কন্যাটিকে
—হ্যাঁ, গাঁয়ে ফিরে এসে শুনেছি।
—তিনিই রুগী। তাকেই একটু দেখতে হবে।
—কী উপসর্গ তাঁর?
—ক্ষুধামান্দ্য, অজীর্ণ এবং বারে বারে বমি করছে।
—ক্ষুধামান্দ্য এবং বমন! ওঁর কি …অর্থাৎ?
একগাল হাসলেন বৃদ্ধ, এ না হলে ভেষগাচার্য! ঠিকই ধরেছ, বাবাজীবন। হ্যাঁ, জন্মসার্থক হতে চলেছে তাঁর। অনুমান এটি তৃতীয় মাস। শিরোমণি মশাই শান্তি-সস্ত্যেন করে গেছেন। শনি বক্রী চলছে ওঁর। জনাই ওঝা এসে ঝাড়ফুঁকও করে গেছে। ওঁর জন্মপত্রিকা অনুসারে পুত্রসন্তানই হবার কথা—নির্বিঘ্নেই; অবশ্য একটি কবচ ধারণ করতে হবে। সে ব্যবস্থাও নিয়েছি…
রূপেন্দ্রনাথ নতনেত্রে বলেন, আমাকে তা হলে কেন ডেকে পাঠিয়েছেন গাঙ্গুলীকাকা? ব্যবস্থা যা নেবার সবই তো নিয়েছেন দেখছি।
—না, বাবা তুমি অভিমান কর না। তোমরা আজকালকার ছেলে, এসব মানতে চাও না। আমি সবরকম আটঘাট বেঁধেই কাজ করতে চাই। খরচ করতেও কুণ্ঠিত নই আমি শান্তি-সস্ত্যেন, ঝাড়ফুঁক, তাবিচ-কবচ, কোবরেজি ঔষধ সব এক যোগে চলবে। বুয়েছ না? লাগে তাক, না লাগে তুক। এই বোধহয় শেষ চেষ্টা। এবার পুত্রসন্তান আমাকে লাভ করতেই হবে। পুন্নাম নরক অতি ভয়াবহ!
রূপেন্দ্রনাথ নীরব রইলেন।
—তুমি তোমার খুড়িমাকে একটি বার দেখ বাবা। ওষুধ-পাঁচন যা বিধান দেখে সব মানা হবে!
—পারবেন তো? লোকলজ্জায় পিছিয়ে যাবেন না?
—পারব না মানে? দুর্গা গাঙ্গুলী কাকে পরোয়া করে? আর লোকলজ্জার কথাটা এখনই আসছে কেন?
—রুগী না দেখেই বলছি—দেখলে হয়তো মতটা বদলাতেও পারে—সাধারণভাবে আমাদের চিকিৎসা-শাস্ত্র বলে এসময় মুক্তবায়ুতে প্রত্যহ কিছুটা পদব্রজে ভ্রমণ করতে হয়। খুড়িমাকে তা অনুমতি দেবেন তো?
আকাশ থেকে পড়লেন গাঙ্গুলী! গ্রামের পথে একটি স্ফীতোদরা সীমন্তিনী পদব্রজে প্রায়চারি করছেন! ভাবা যায়? একবার ইচ্ছে হল প্রশ্ন করেন, তোমাদের শাস্ত্রের কী নির্দেশ বাবাজীবন? সেই আসন্ন জননীর পরিধানে অন্তত একটা বস্ত্র থাকবে তো? না কি তাতে হাওয়া-খাওয়ায় বাধা হবে? কুণ্ঠিত হয়ে প্রকাশ্যে বলেন, সেটা যে নিতান্ত অসম্ভব তা তো বুঝতেই পারছ বাবা। তবে আমার অন্দরমহলের প্রাঙ্গণটি ছোট নয়। সেখানে যদি পদব্রজে …
—ঠিক আছে। আগে রুগী দেখি। আপনি ভিতরে খবর পাঠান।
অন্দরমহলে খবর দেওয়া হল। ইতিমধ্যে একটি রূপার থালায় কিছু জলযোগ নিয়ে উপস্থিত হল একটি পরিচারিকা। সঙ্গে শোভারানী। গৃহস্বামী বললেন, আমার জ্যেষ্ঠা কন্যা, শোভা।
শোভা ব্রাহ্মণের পদধূলি নিল। বাপের দেহের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে এতক্ষণ নির্নিমেষ নেত্রে দেখছিল ঐ কন্দৰ্পকান্তি নব্যপণ্ডিতকে। শোভা জানে—ঐ লোকটির সঙ্গে বাবামশাই তার বিবাহ প্রস্তাব তুলেছিলেন, তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। না, শোভাকে দেখে তিনি ‘অপছন্দ করেননি। বিবাহ করবেন না বলে স্থির করে রেখেছেন বলেই এ প্রত্যাখ্যান। আচ্ছা, সে-কথা ওঁর কি মনে আছে? শোভার দিকে চোখ তুলে যখন দেখলেন তখন কি তাঁর মনে হয়েছিল—ঐ মেয়েটি হলেও হতে পারত তাঁর জীবনসঙ্গিনী?
একটু পর ডাক এল ভিতর থেকে।
দুর্গাচরণ ওঁকে পথ দেখিয়ে নিজের শয়নকক্ষে নিয়ে এলেন। পিছন পিছন শোভারানী। দ্বারের সম্মুখে চৌকাঠের ফ্রেমে বাঁধানো যেন একটি দেবী প্রতিমা। রক্ত চীনাংশুক তার পরিধানে, মাথায় আধো ঘোমটা, সর্বাঙ্গে নানান অলঙ্কার—এ ভদ্রাসনের নববধূ সে। রূপেন্দ্রনাথ অবশ্য সেসব কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না—তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল অলক্তকরাগ-রঞ্জিত নূপুরশোভিত একজোড়া রাতুল চরণে। মৃন্ময়ীর কিন্তু কোন সঙ্কোচ নেই। কেন থাকবে? উনি তো ওর সোনাদা! কাল সারারাত যাকে স্বপ্ন দেখেছে, আজ সারা সকাল যার আগমন প্রতীক্ষা করেছে। নির্নিমেষ দুটি কাজলকালো চোখ মেলে সে দেখছিল ঐ অদ্ভুত মানুষটাকে। তারপর গলায় আঁচল দিয়ে সেই সেবারের মতো নিচু হয়ে ওঁকে প্রণাম করার উপক্রম করল। কিন্তু তার পূর্বেই রূপেন্দ্রনাথ নত হলেন মৃন্ময়ীর পদধূলি নিতে।
শিউরে উঠল মেয়েটি। এক লাফে পিছিয়ে গেল কিছুটা। অস্ফুটে আর্তনাদ করে উঠল, আমি মৃন্ময়ী, মীনু!
এতক্ষণে মুখ তুললেন। কাব্যের ভাষায় যাকে বলে ‘চারিচক্ষের মিলন হওয়া’—তাই ঘটল। ম্লান হেসে রূপেন্দ্রনাথ বললেন, জানি, জানি, খুড়িমা। ঠিক আছে, আপনি বয়ঃকনিষ্ঠা, আমার প্রণাম যদি না নেন, তো নাই নিলেন।
পিছন থেকে দুর্গাচরণ হঠাৎ ফোড়ন কাটেন, প্রথম পোয়াতি তো! বড়ই-লজ্জা ওর! এমনকি পেন্নাম নিতেও।
রূপেন্দ্রনাথ পিছনে ফিরলেন। একটু কঠিন শোনালো তাঁর কণ্ঠস্বর। বৃদ্ধকে বললেন, আপনি বৈঠকখানায় গিয়ে অপেক্ষা করুন। রোগিণীকে দেখা শেষ হলে আপনার সঙ্গে কথা হবে।
দুর্গাচরণ ঘাবড়ে যান। যা বাবা! এ আবার কি অসৈরণ কথা! ‘সোয়ামি’ বলে কতা! তাকেও খেদিয়ে দেবে! মলবখানা কী?
—না, তুমি যেও না। তুমি থাকবে।
শেষ নির্দেশটা শোভারানীকে।
বৃদ্ধকে বিতাড়িত করে তিনজনে কক্ষের ভিতরে এলেন। এটাই বড়কর্তার শয়নকক্ষ। এক প্রান্তে বিরাট পালঙ্ক। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত দু-একটি চারপাই ও বেতে-বোনা মোড়া। একটি আরাম-কেদারা। দেওয়ালে দেবদেবীর পটে আঁকা ছবি। কুলুঙ্গিতে কালিমাচিহ্ন—প্রদীপ রাখা হয় সেখানে। রূপেন্দ্রনাথ এবার প্রশ্ন করেন, আপনার শারীরিক কষ্ট কী জাতীয়?
মৃন্ময়ী এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। সেই ‘নয়’ এর হিসাবটা! যে মানুষটার কাঁধে চেপে এককালে দামোদরে নৌকায় বাইচ খেলা দেখেছে, সে ওর চেয়ে কত বড়? অথবা কত ছোট? ‘তুই’ থেকে যেদিন হঠাৎ ‘তুমি’তে উঠেছিলেন—বলেছিলেন ‘তুমি এখনো খুকি তখন মনে মনে কী যেন একটা প্রশ্ন করেছিল না মৃন্ময়ী? আজ সেই ‘তুমি’ ছেড়ে ‘আপনি-তে ওঠায় মনে-মনেও কোন প্রশ্ন করতে পারল না। বুকের মধ্যে একটা ব্যথা টনটনিয়ে উঠছে শুধু।
—বলুন খুড়িমা? কী কষ্ট হয় আপনার?
অজান্তে সত্য কথাটাই বার হয়ে এল মুখ দিয়ে, বুকে বড় ব্যথা!
—বুকে ব্যথা! ঠিক কোনখানটায়? আচ্ছা, আপনি বরং শুয়ে পড়ুন। চিৎ হয়ে।
একটু চমকে ওঠে! চিৎ হয়ে! লোকটা বলে কী?
শোভারানীও অবাক হয়েছিল। তবু মায়ের হাত ধরে নিয়ে এসে পালঙ্কে শুইয়ে দেয়। চাদরটা টেনে পা দুটি ঢেকে দেয়।
—আপনার হাতটা দিন?—নিজের হাতটি প্রসারিত করে দেন চিকিৎসক।
—হাত! কেন?
—বাঃ! নাড়ি দেখব না?
আপাদমস্তক শিউরে উঠল মৃন্ময়ীর। একদিন সাহসে ভর করে ওঁর চরণ ছুঁয়ে প্রণামটা পর্যন্ত করতে পারেনি। আজ সেই তিনিই বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর হাত–পরস্ত্রীর পাণি গ্রহণ করবেন বলে! কিন্তু শুধু সেটুকুই নয়—মৃন্ময়ীর মনে পরে গেল, কোথায় যেন শুনেছে: অভিজ্ঞ কবিরাজ নাড়ি ধরে রোগিণীর মনের ভিতরের কথাটা টের পেয়ে যান! উনি যদি বুঝে ফেলেন! ওর বুকের ভিতরটা কী ভাবে উথাল-পাতাল হচ্ছে! কেন হচ্ছে!!
মৃন্ময়ী নিজের হাতটা গুটিয়ে নিয়ে শুধু বললে, ন্-না!
হাসলেন রূপেন্দ্রনাথ। তাঁর মনে পড় গেল আর একদিনের কথা। মীনুর কী দোষ? সে তো স্বয়ম্বরা হয়ে রাজরাজেন্দ্রাণী হয়নি। সে তো ছাগশিশু মাত্র। সমাজ তার গলায় দড়ি বেঁধে এই যূপকাষ্ঠে এনে ফেলেছে! তাই হাসতে হাসতেই বলেন, ‘না’ কেন? আমি তো আপনার মুখে আবীর মাখিয়ে দিতে চাইছি না!
বুকের মধ্যে আবার মুচড়ে উঠেছে হতভাগিনীর। ইচ্ছা করছিল একটা জান্তব আর্তনাদ করে প্রতিবাদ করতে! সেই সুখস্মৃতিটুকু নিয়ে এ জাতীয় ব্যঙ্গ ও সহ্য করতে পারবে না। কিন্তু মুখ ফুটে তা বলতে পারল না। একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে সে নীরব প্রতিবাদ জানাতে চায় “না’-য়ের ভঙ্গিতে হাত নেড়ে।
উনি ভুল বুঝলেন। এটা যে নীরব প্রতিবাদের ভঙ্গি তা বুঝলেন না। ওর প্রসারিত কর গ্রহণ করে নাড়ি দেখতে শুরু করলেন। মৃন্ময়ী দাঁতে দাঁত দিয়ে তার আন্তর আকৃতিটাকে গোপন করবার চেষ্টা করতে থাকে।
দীর্ঘ সময় নাড়ির গতি পরীক্ষা করে রূপেন্দ্রনাথ বুঝতে পারেন, ভয়ের কিছু নাই। নাড়ির গতি দ্রুত—সম্ভবত উত্তেজনায়। হয়তো যে কথাটা গোপন করতে চাইছিল মীনু, তা বুঝে ফেলেছেন। নাড়ির স্পন্দনে নয়, ওর আচরণে, ওর মুখের রক্তিমাভায়। ওর সর্বাবয়বে সেই গোপনবার্তার অনুরণন। এ যে মানুষে কেমন করে বোঝে তা বোঝানো যায় না। বোধ করি একই তরঙ্গভঙ্গে যখন দুটি হৃদয় স্পন্দিত হতে থাকে তখন ‘বে-তারে’ ধরা পড়ে একের কাছে অপরের গোপন কথা!
হয়তো ওঁর গোপন কথাটাও বুঝে ফেলেছে ঐ বোকা মেয়েটা—কেন তিনি গ্রামে ফিরে আসার পর জগুঠাকরুণকে জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর সিদ্ধান্ত : তিনি আজীবন কৌমার্যব্রত পালন করে আর্তের সেবা করে যাবেন।
ধীরে ধীরে রোগিণীর হাতটা নামিয়ে রেখে বলেন, ভয়ের কিছু নাই। শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ। বমনের যে বেগটা আছে ওটা স্বাভাবিক—জৈব বৃত্তি। নির্বিঘ্নেই সন্তান জন্মাবে।
এবার উনি ‘আপনি তুমি’ এড়িয়ে কথা বলেছেন।
শোভারানী হঠাৎ ফস্ করে প্রশ্ন করে বসে, ছেলে না মেয়ে?
রূপেন্দ্র ওর দিকে তাকিয়ে প্রশান্ত হাসলেন। বলেন, সে কথা দৈবজ্ঞই শুধু বলতে পারেন, শোভা, চিকিৎসক পারে না।
নিজের অজান্তেই মীনুও হঠাৎ একটা কথা বলে বসেছে, কিন্তু ব্রাহ্মণের আশীর্বাদ…
চোখে চোখ পড়তেই থেমে যায়।
রূপেন্দ্রনাথের মনে পড়ে যায়, ‘জয়ন্তপ্রতিম সুতঃ!
ম্লান হেসে বলেন, ব্রাহ্মণের আশীর্বাদ একালে অমোঘ নয়—‘অমোঘ ব্রাহ্মণাশীষঃ নীতিবাক্যটা শুধুমাত্র সত্যযুগের জন্য। কলির ব্রাহ্মণের সে ক্ষমতা নেই, মৃন্ময়ী।
মৃন্ময়ী! ‘খুড়িমা নয়! চোখ দুটি জলে ভরে আসে।
‘পৌলমী’ সে হতে চায়নি, পাকেচক্রে হয়ে গেছে। কিন্তু একটি পুত্রসন্তান যে তার চাই-ই! না হলে তাকে এ ইন্দ্রপুরী থেকে নেপথ্যে সরে যেতে হবে! তার অবমাননার শেষ থাকবে না!
রূপেন্দ্রনাথের পরবর্তী কথাটায় এ চিন্তার ছেদ পড়ল। কথাটা শুনে যেন বজ্রাহতা হয়ে গেল মৃন্ময়ী!
রূপেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, এবার বুকটা একবার দেখব, মীনু!
কথাটা বলে তিনি পুলিন্দা হাড়াতে থাকেন
‘স্টেথোস্কোপ’ যন্ত্রটা তখনো আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু তার একটি আদিমরূপের ব্যবহার ছিল আরব-পারস্যে। মুঘলযুগে হাকিম-উল্-মুলুকদের মাধ্যমে সেটি এসে পৌচেছে ভারত-খণ্ডেও। দু-মুখো ক্ল্যারিওনেট জাতীয় একটা যন্ত্র। তার দুপ্রান্তে দুটি ভেক-চর্ম। এক প্রান্ত রোগীর বক্ষস্থলে স্থাপন করলে অপরপ্রান্তে চিকিৎসকের কর্ণমূলে হৃদস্পন্দনের শব্দ শ্রুত হয়। রূপেন্দ্রনাথের তেমন একটি যন্ত্র ছিল পুলিন্দায়। তিনি সেটি খুঁজে বার করতে নিচু হয়েছেন। তাই নজরে পড়েনি, তাঁর কথাটা শুনে কী জাতীয় প্রতিক্রিয়া হয়েছে কক্ষে উপস্থিত দুটি যুবতীর মুখাবয়বে। মৃন্ময়ীর মুখটা ক্ষণেকের জন্য আরক্তিম হয়ে উঠেছিল—পরমুহূর্তেই তা রক্তশূন্য। শোভারানীও বিচলিতা। বস্তুত ‘কবিরাজ’ জীবটিকে সে ইতিপূর্বে কখনো দেখেনি। চিকিৎসা- পদ্ধতি কী জাতীয় হয় কিছুই জানা নেই। তার মনে হল–হয় তো এটাই নিয়ম। নাড়ি দেখার পর বুক দেখা! নাড়ির স্পন্দনের পর বুকের স্পন্দন!
মৃন্ময়ী আর শায়িতা নয়। উঠে বসেছে। অস্ফুটে বলে, কী বললেন?
তখনও যন্ত্রটা খুঁজে পাননি। মুখ নিচু করেই পুনরুক্তি করেন, বুকটা একটু দেখব!
মৃন্ময়ী যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারল না।
যন্ত্রটা খুঁজে পেয়েছেন। সেটা হাতে নিয়ে সোজা হয়ে বসেই ওঁর নজর পড়ল রোগিণীর দিকে। প্রশ্ন করেন, কী হল?
—আপনি … আপনি …
শোভারানী ওর বাহুমূল ধরে ফেলে।
অস্ফুটে বলে, এটাই নিয়ম ছোট মা। আমি কাঁচুলির বাঁধন খুলে দিচ্ছি। লজ্জা করবেন না। উনি এবার আপনার বুক দুটো দেখবেন।
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন রূপেন্দ্রনাথ। কী সর্বনাশ! তাঁর উচ্চারিত ‘বুক’ শব্দটা সহসা দ্বিবচনে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ায় মূহূর্তমধ্যে প্রণিধান করেছেন—এদের কী মর্মান্তিক ভ্রান্তি হয়েছে।
কিন্তু প্রতিবাদে তিনি কোন কথা বলার পূর্বেই গৃহের দ্বার উন্মোচিত হল। বোঝা গেল, গৃহস্বামী দৃষ্টিসীমার বাহিরেই ছিলেন শুধু, শ্রুতিসীমার নয়। ধীর পদক্ষেপে গৃহমধ্যে প্রবেশ করে এবার কন্যাকে বলেন, তুই ভিতরে যা!
শোভারানী তার বিমাতার পৃষ্ঠদেশে কঞ্চলিকার ফাঁসটি সবেমাত্র উন্মোচিত করেছে। নিদারুণ আতঙ্কে, লজ্জায় আরক্ত আননে মৃন্ময়ী বাধা দিতে ভুলে গেছে যেন। বাবার আদেশে ঐ অবস্থাতেই শোভারানী শয়নকক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। বৃদ্ধ বললেন, তোমার রুগী দেখা শেষ হয়ে গেছে, রূপেন্দ্রনাথ। এস, আমার সঙ্গে এ ঘরে এস।
রূপেন্দ্রনাথ আর্তকণ্ঠে বলে ওঠেন, না! আপনারা আমাকে ভুল বুঝেছেন! সে কথা বলতে চাইনি আমি।
দুর্গাচরণ দৃঢ়স্বরে বলেন, এ ভদ্রাসনটি আমার। আমিই গৃহস্বামী। আমি তোমাকে আদেশ করছি রূপেন্দ্রনাথ। বাইরে এস। তোমার যা কৈফিয়ৎ তা আমাকেই দিও। এস—
রূপেন্দ্রনাথ একবার পিছন ফিরে দেখলেন। ভয়ে, বিস্ময়ে, লজ্জায় এবং সম্ভবত আরও কোন অনুভূতিতে মৃন্ময়ী আর মানুষ নয় : মৃন্ময়ী!
বৈঠকখানার নির্জনে এসে গাঙ্গুলী বলেন, আমি তোমার কোন কৈফিয়ৎ শুনতে চাইনে–এ তোমার সাময়িক চিত্তচাঞ্চল্য, দুর্মতি না চিকিৎসাপদ্ধতির অঙ্গ তা জানবার কোন কৌতূহল নেই আমার। যদি চিকিচ্ছেই হয়, তাহলে বলব সেটি …. থাক! শুনেছি, তোমরা প্রতিবেশী—নিতান্ত অল্পবয়সেই তোমাদের দুজনের মধ্যে…
—কী বলছেন আপনি! শুনুন
—না। তোমাকে বৈদ্যবিদায় হিসাবে কয় কপর্দক দিতে হবে তাই শুধু বল। এ পৈশাচিক চিকিৎসার কথা আমি কিছু শুনব না। তবে একটা কৌতূহল যদি মিটিয়ে যাও তাহলে খুশি হব—
—কী?
—যুবতী নারীর বুকজোড়া দেখার সখ যদি এতই প্রবল, তাহলে কুলীন বামুন হয়ে তুমি কেন….
রূপেন্দ্রনাথ তাঁর পুলিন্দাটা তুলে নিয়ে বললেন, থামুন! আপনি বয়োজেষ্ঠ। সম্পর্কেও বড়। তবু আপনার সঙ্গে বাক্যালাপ করতে আমার আজ ঘৃণা হচ্ছে। আজ থেকে আপনার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই!
—বুঝলাম! তা বাবা সম্পর্কটা কার সঙ্গে রাখবে? দুর্গা গাঙ্গুলী তোমার শত্রুর, নন্দ চাটুজ্জেও তাই। তোমার পরমাত্মীয় কি ঐ পীরপুরের কলিমুদ্দীন মোল্লা? সোঞাই গাঁয়ে তিষ্ঠুতে পারবে?
বিনা প্রত্যুত্তরে রূপেন্দ্রনাথ বার হয়ে গেলেন।