কাশীধাম : 1774 - প্ৰথম পৰ্ব
সোঞাই : 1742 - দ্বিতীয় পৰ্ব
নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর : 1742 - তৃতীয় পৰ্ব
তীর্থের পথে : 1742 - চতুর্থ পর্ব
1 of 2

সোঞাই – ২

কিন্তু বিলাসী, উচ্ছৃঙ্খল, দুর্নীতিপরায়ণ মুসলমান শাসককুলের অর্থগৃধ্নতা আর ঘৃণ্য আদর্শ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষক্রিয়া শুরু করেছে। বিদেশী বণিকদলের শোষণের পূর্বযুগ থেকেই বাঙলার ধনসম্পদ একমুখী স্রোতে ক্রমাগত চলেছে দিল্লীমুখো—রাজস্ব, নজরানা, আবওয়াব পরিপূরণের কোনও আয়োজন নাই। ক্রমাগত অবক্ষয়ে কুবেরও হয়ে পড়েন কর্পদকহীন, অন্নপূর্ণার হাত ধরে শিবকে পথে নেমে পড়তে হয়—ভিক্ষায়

মুর্শিদাবাদের বিলাসের স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এদিকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে—শহর কলকাতা। ইংরাজ বণিকের নবীন আস্তানা। অষ্টাদশ শতাব্দীর ঊষাযুগে—আওরঙ্গজীবের মৃত্যুর কালে সেই সুতানুটি-গোবিন্দপুর অঞ্চলের লোক-সংখ্যা ছিল মাত্র পনের হাজার; আমাদের কাহিনীর কালে, পলাশী যুদ্ধের প্রাক্কালে, তা বর্ধিত হয়েছে এক লক্ষে।

এই অর্ধশতাব্দীকালে শুধু অর্থনৈতিক আর সমাজনৈতিক অধঃপতনই নয়, সমান্তরালে সংঘটিত হচ্ছিল আর এক মর্মন্তুদ অবক্ষয় : সাংস্কৃতিক দেউলিয়াপনা!

প্রাগ্-মুসলমান যুগে ভারতবর্ষে যে সংস্কৃতির কাঠামো রতীয় সমাজ তথা ধর্মকে ধরে রেখেছিল তাকে বলি : ব্রাহ্মণ্য ধর্ম। সে কালের জ্ঞানমার্গী সাহ্মণ আচার্যের দল সমাজের কাছ থেকে যে খুদকুঁড়ো গ্রহণ করতেন, দান করতেন তার চেয়ে অনেক বেশী।

‘তিস্তিড়ি-পল্লবের’ ব্যঞ্জনেই তাঁদের তৃপ্তি—নিরলস নিষ্ঠায় সমাজের নানাবিধ ‘অনুপপত্তি বিদূরিত করতেন তাঁরা। তাঁদের ধর্মপন্থীরাও অশন-ব্যসনের প্রত্যাশী ছিলেন না—তাঁদের মাথার সিঁদুর আর হাতের শাঁখাই নবদ্বীপ-মহিষীর অলঙ্কার-প্রাচুর্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত!

সেই সংস্কৃতির মূল লক্ষ্য ছিল—সামুহিক সামাজিক উন্নতি। আপামর জনসাধারণের শুধু ইহলোক নয়, পরলোকের উন্নতিবিধান। মানুষের অভাববোধ ছিল অল্প। আত্মসন্তুষ্টি তাদের অন্তরের গভীরে। যে-যার বৃত্তিতে চতুর্বর্গের ফললাভের চেষ্টা করত–ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ

বঙ্গসংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল মুসলমান আধিপত্যের পরে। শাসিত সম্প্রদায়ের—অর্থাৎ সংখ্যাগুরু হিন্দুদের ইহলোকের উন্নতির আশা আর রইল না। হতাশার ধর্মই হচ্ছে অলৌকিকত্বে আস্থাশীল হয়ে পড়া। ফলে তারা পার্থিব কামনার অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মীকে তো ছাড়লই তদুপরি সরস্বতীও তাদের ত্যাগ করে গেলেন।

ইহকাল পরকাল দুইই গেল।

ব্রাহ্মণ আচার্যের স্থলে বৃহত্তর বঙ্গসমাজে এসে আসর জমালেন টুলো-পণ্ডিতের দল। গুরু, কুলপুরোহিত, তান্ত্রিক, ডাকিনী-যোগিনী বিদ্যায় পারঙ্গমের দল। বিদ্যার স্থানে অবিদ্যা। নগরকেন্দ্রিক সভ্যতায় আবার কিছুটা রকমফেরও হল—মুর্শিদাবাদ, শহর কলকাতায়, বর্ধমানে বা নবদ্বীপরাজের নূতন রাজধানী কৃষ্ণনগরে। এসব স্থলে প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করল—বৈশ্যসমাজ। বিশেষ করে কলকাতায়। সমাজপতি না হলেও সমাজের কর্ণধার হয়ে পড়ল এক কায়স্থ-সমাজ। টুলো-পণ্ডিত ব্রাহ্মণেরা কায়স্থসেব্য হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নৈবেদ্যচূড়ার সন্দেশটির মতো শোভা পেতে থাকেন। হিন্দু বণিক-কায়স্থরা হল সমাজের মেরুদণ্ড। বৈশ্য-সম্প্রদায়ের অপরাপর লোকেরা তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। এ-সমাজ পূর্বযুগের মতো বর্ণাশ্রম-ধর্মের কাঠামোয় গড়া নয়। আর্থিক সঙ্গতিই এই সমাজের জিয়নকাঠি-মরণকাঠি। কলকাতায় তা ছিল ইংরাজের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, ঢাকা বা কৃষ্ণনগরে এই রূপান্তর পূর্বযুগ থেকেই ধীরে ধীরে দেখা গিয়েছিল ভিন্নতর হেতুতে—

মুর্শিদকুলী খাঁ তাঁর মুসলমান রাজকর্মচারীদের উপর আস্থা রাখতে পারতেন না। সঙ্গত কারণে। মুসলমান কর্মচারীরা অনেকসময় আদায়ী রাজস্বের হিসাব দিতে পারত না।-হেতু দ্বিবিধ—অশিক্ষা এবং অসাধুতা। মুর্শিদকুলী তাই গোটা বাঙলাদেশকে তেরটি প্রধান বিভাগে—বা চাকলায় ভাগ করেছিলেন। তিনি বেছে বেছে বিশ্বস্ত হিন্দু কর্মচারীদের নিয়োগ করতেন—যারা হিসাব বোঝে, হিসাব দিতে জানে এবং পরস্বাপহারক নয়। এই জাতীয় লোক ক্রমাগত নিয়োগ হতে থাকে ইজারাদার বা দেওয়ানী বিভাগে। ঐ সব ইজারাদার রাজস্বের অতিরিক্ত যদি কিছু উপার্জন করত তাতে চোখ বুজে থাকলেই হল। এই ইজারাদার-প্রথা প্রবর্তনের পিছনে আরও একটি মর্মন্তুদ হেতু আছে। মর্মন্তুদ এজন্য যে, তার সুদূরপ্রসারী ফল সমাজের উপর পড়েছিল।

শাসকদল হঠাৎ বুঝে ফেললেন যে, এতাবৎকালের জমিদারবৃন্দ প্রকারান্তরে প্রজার মঙ্গল চাইতেন। কেন? অনেকগুলি হেতুতে। প্রথমত তাঁরা গ্রামেই বাস করতেন—প্রজাদের সুখ- দুঃখের ছিলেন ভাগিদার। অজন্মা-দুর্ভিক্ষ-বন্যা তাঁদের প্রত্যক্ষ সত্য। খাজনা মাপ করা তাঁদের একটা বাতিক! দ্বিতীয় কথা—যে হাঁস বছর বছর সোনার ডিম পাড়ে তার মাংস খেতে তাঁরা নারাজ। ভূস্বামীর সঙ্গে কৃষিজীবীর—মন্দিরচূড়া আর বনিয়াদ—একটা অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ ছিল। মূর্খ জমিদারগুলো কিছুতেই বুঝতে পারে না যে, এক ঝাঁক স্বর্ণডিম্বপ্রসূ হংসের বিলোপে আর এক ঝাঁক এসে হাজির হবে পরবর্তী প্রজন্মে!

তাই শাসকশ্রেণী প্রবর্তন করল ‘ইজারাদারী’ ব্যবস্থা। ইজারা যে নিচ্ছে সে যে গ্রামে থাকবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। নায়েব-গোমস্তা-পাইক পাঠিয়ে সে রাজস্ব আদায় করবে। রাজা-প্রজা সম্পর্কের সূত্রে মহানুভবতা দেখানোর বাতিক তাদের থাকবে না। দোল-দুর্গোৎসবে আপামর জনসাধারণকে ডেকে পাত পাড়তে বলবে না নিজ ভদ্রাসনে। গ্রাম্যজীবনের বাহিরে থেকে আদায় করে যাবে প্রাপ্য—দেখবে না, ওরা কিসের বিনিময়ে কী-ভাবে খাজনা দেয় ‘আৰু দিয়ে, ইজ্জৎ দিয়ে, ইমান দিয়ে’ না ‘বুকের রক্ত দিয়ে!’

ধীরে ধীরে সে-কালীন ভূস্বামীদের অবসান হয়ে আসে। তার পরিপূরকরূপে আবির্ভূত হতে থাকে ইজারাদারেরা—পরবর্তীকালে বঙ্গভূমে অত্যাচারী ‘জমিদার’ নামক যে সমস্ত রক্ত-শোষকের আবির্ভাব হয়েছিল তারা এই অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের ইজারাদারদেরই বংশধর।

সোঞাই গ্রামখানি উত্তর দক্ষিণে দীর্ঘায়ত। দামোদর নদের দক্ষিণ বরাবর। ভদ্রপল্লী স এই তটে। ও পারে—উত্তর পাড়ে, জল-অচল অচ্ছুৎদের বাস। উত্তরে অজয়, দক্ষিণে দামোদর। দুটিই পূর্বাভিমুখী। অচ্ছুতেরা পারানি-নৌকায় নিত্য এ পারে আসে রুজি-রোজগারের ধান্দায়। এক ক্রোশ উজানে একটি মুসলমান পল্লী—পীরপুর। এ পারে ঘনিবদ্ধ একটি ব্রাহ্মণ পল্লী। রাঢ়ী সম্প্রদায়ই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিছু দূরে কায়স্থ পাড়া, আল ভাঁটিতে বেশ কতকগুলি তন্তুবায় পরিবার। গ্রামের সীমানা—পশ্চিমে তেঁতুলবট, পূর্বে ভোলাবাবার মন্দির।

দামোদর—শুধু দামোদরই বা কেন, অজয় নদেরও তখন প্রকৃতি ছিল ভিন্নতর। ‘হিরোসিমা’ বা ‘ক্র্যাকাটোয়া’ জাতীয় ভৌগোলিক নামগুলি শুনলেই যেমন আমাদের চিন্তাজগতে উদয় হয় ‘বিস্ফোরণ’ শব্দটা, তেমনি সে-আমলে ‘দামোদর’, এই ভৌগোলিক নামটির সঙ্গে ‘বন্যা’ শব্দটা অঙ্গাঙ্গি-সম্পর্কে যুক্ত ছিল না। তার হেতুটা সহজবোধ্য। তখনো ঐ প্রাকৃতিক আশীর্বাদটিবে মানুষ শৃঙ্খলিত করেনি। বর্ষায় বন্যা হত না, হত—জলস্ফীতি। ভাদ্র-আশ্বিনে। দুই কূল ছাপিয়ে দামোদর প্রবেশ করত গ্রামে। আপাতদৃষ্টিতে আদিগন্ত সমুদ্র। কিন্তু জলের গভীরতা সামান্য।। ঘরবাড়ি ডুবিয়ে, তালগাছ ছাপিয়ে নয়। দামোদর—ভুললে চলবে না, নদী নয়, নদ। অর্জয়ও তাই। তারা সে-আমলের নৈকষ্য কুলীন নদ! বৎসরান্তে শ্বশুরবাড়িতে আসত। আদিগন্ত কৃষিক্ষেত্র মাথায় সিঁদূর আর হাতে শাঁখা নিয়ে গোটা বছর তার জন্য প্রতীক্ষা করে থাকত। পলিমাটির আশীর্বাদে সেই শবরীর-প্রতীক্ষারতাদের দামোদর আর অজয় সার্থক করে যেত। সন্তান জন্মাতো পাকা ধানের মাথায় মাথায়। বন্যার জল ভেঙে যখন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যেত গ্রাম্যবধূরা তখন তাদের হাঁটুর উপর শাড়ি তুলতে হত না। দামোদরের আশীর্বাদে পেট ভরে তারা ভাতও খেতে পারত।

সে-আমলে নৈকষ্যকুলীন দামোদর রাঢ়-শাশুড়ী ঠাকরুনের সেই কন্যা-বিদায়কালীন মিনতিটুকুর মর্যাদা দিত : ‘আঁটু ঢাকি বস্ত্ৰ দিহ, পেট ভরি ভাত।’

ভৌগোলিক বিচারে সোঞাই পুব-পশ্চিমে দীর্ঘায়ত হলেও অর্থনৈতিক আর সামাজিক জ্যামিতির ছকটা ছিল ত্রিকোণাকৃতি। সমকোণী ত্রিভুজ। শীর্ষবিন্দুটি সাবেক জমিদার ব্রজেন্দ্রনারায়ণ ভাদুড়ী, আর ত্রিকোণভূমির দুই প্রান্তের দুই কোণে দুটি ‘হঠাৎ-নবাব’—নন্দ চাটুজ্জে আর দুর্গা গাঙ্গুলী।

আসুন, একে একে পরিচয় করিয়ে দিই : ব্রজেন্দ্রনারায়ণ সাবেক ভূম্যধিকারী। চার পুরুষে সোঞাই গ্রামের ভূস্বামী। ব্রজেন্দ্রের বৃদ্ধ-প্রপিতামহ ঠিক কী হেতুতে তাঁর বরেন্দ্রভূমের সাবেক আবাস ছেড়ে এই রাঢ়খণ্ডে আবির্ভূত হয়েছিলেন সেটা ইতিহাসের একটা অনুদ্ঘাটিত অধ্যায়। সাবেক জমিদারবাড়ি ঘিরে একটি বারেন্দ্রপাড়া। খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেইসব ভদ্রাসনের আদি-পুরুষেরা এসেছিলেন ঘরজামাই হিসাবে। ক্রমে আর্থিক সঙ্গতি লাভের পর নিজ-নিজ ভদ্রাসন নির্মাণ করেছেন। ব্রজেন্দ্রনারায়ণের বৃহৎ পরিবার। দিনে, দুবেলায় অন্তত পঞ্চাশটি পাতা পড়ে। তাঁর গৃহে দোল-দুর্গোৎসব হয়। জমিদার বাড়ির ভিতরেই আছে একটি দেবালয়—শিবমন্দির। নিত্যপূজার ব্যবস্থা। ভাদুড়ীদের কীর্তি সোঞাই গ্রামের চতুর্দিকে ছড়ানো—নীল সায়র, পদ্মদীঘি, চতুষ্পাঠী এবং গ্রামপ্রান্তে সর্বসাধারণের জন্য ভোলাবাবার মন্দির।

নন্দ ও দুর্গা ‘হঠাৎ-নবাব’ হয়েছেন মাত্র এক-পুরুষে। সম্পত্তি তাঁদের স্বোপার্জিত। তাঁরা দুজনেই এ গ্রাম্য-সমাজের মাথা। তাঁদের যৌথ নিদানই ইদানীং গ্রামবাসীর কাছে বেদবাক্য। এক-পুরুষ আগেও ব্রজেন্দ্রনারায়ণের পিতৃদেব ছিলেন এ গ্রামের একজন সমাজপতি। ব্রজেন্দ্র সম্প্রতি স্বেচ্ছায় সে অধিকার ত্যাগ করেছেন। দুটি হেতুতে। প্রথমত তিনি নির্লিপ্ত থাকতে চান, দ্বিতীয়ত দুই ‘হঠাৎ নবাব’ উঠে পড়ে লেগেছেন প্রমাণ করতে যে, এই রাঢ়ভূমে ঐ কয়টি পরিবার বহিরাগত। ওদের লৌকিক আচার-বিচার ভিন্নতর। ওদের কুশণ্ডিকা পর্যন্ত হয় বরের বাড়িতে, কন্যাগৃহে নয়! এঁরা দুজনেই রাঢ়ী ব্রাহ্মণ, এঁদের কৌলীন্য যাবৎচন্দ্রাকমেদিনী না হলেও সেই বল্লাল সেন অথবা আদিশূরের আমল থেকে! বল্লাল আর আদিশূরের মধ্যে কে যে বয়োজ্যেষ্ঠ সেটা ওঁরা ঠিক মতো জানেন না—মোটকথা সেই প্রাচীনতর আমল থেকে। জমিদার যে ‘বারিন্দির’ এই সহজ কথাটা এতদিন বেমালুম ভুলে ছিল এই রাঢ়ভূমের ব্রাহ্মণ সমাজ। এতদিনে ওঁরা সে তত্ত্বটা বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু গেঁয়ো ভূতগুলো গাধারও অধম। বোঝে না, অর্থকৌলীন্যে ওঁরা দুজন একপুরুষেই ব্রজেন্দ্রর কাছাকাছি উন্নীত হয়ে পড়েছেন। ঐ দুই ‘হঠাৎ-নবাব’কে দেখলে গাঁয়ের মানুষ ঘাড় নিচু করে ‘পাতঃপেন্নাম’ জানায়, আর দূর থেকে সাবেক জমিদার-মশায়ের পালকি আসতে দেখলে আজও সাষ্টাঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে

নন্দ চাটুজ্জে উপ-ইজারাদার। অর্থাৎ বর্ধমান শহরের ধনকুবের নরেশ দত্তের তরফে রাজস্ব আদায় করে থাকেন। ক্রমে ক্রমে মাছের তেলে মাছ ভাজতে শুরু করেছেন। ব্রজেন্দ্ৰ অনেকগুলি মহাল ছেড়ে দিয়েছেন—ক্রমশই যেন জমিদারী সঙ্কুচিত করে আনছেন। হয়তো এ গ্রাম ত্যাগ করে যাবারই একটা গোপন বাসনা আছে তাঁর। দুই নবীন প্রতিযোগীর আরও কিছু অর্থাগমের ব্যবস্থা আছে। নন্দ ইজারা নিয়েছেন দামোদরের পারানি ঘাট ও বাজার। হাটে যা বিকি-কিনি হয় তার উপর খাজনা আদায় করেন, ধান-চালের উপর ‘কোহালী’ পান। গ্রামে কেউ স্থাবর সম্পত্তি কিনলে ‘সেলামি দিতে হয়। কোন বিয়ে-সাদি হলে ইজারাদারকে বরপক্ষ দেন দেড়টাকা, কন্যাপক্ষ তিনটাকা। এসবকিছুই আদায় হয় মূল ইজারাদার নরেশ দত্তের নামে। নন্দ চাটুজ্জে একটি কমিশান পান মাত্র। তহশীলদার ইত্যাদির বেতন তাঁকে দিতে হয় না। সেটাও ইজারাদারের দেয়।

গাঙ্গুলীমশাই নিয়েছেন তন্তুবায়দের শোষণ-দায়িত্ব। পাঁচখানা গ্রামে যা কিছু উৎপন্ন হয় তার তুলোর যোগান থেকে উৎপন্ন-দ্রব্যের বিক্রি-ব্যবস্থা গাঙ্গুলীর। গো-গাড়ির সারি প্রথমে যায় উত্তর-মুখো। অজয়ের তীর পর্যন্ত। তারপর নৌকাযোগে পুবমুখো—ইলামবাজার, কাটোয়া, ফরাসডাঙা, মায় শহর কলকাতা। ফেরার পথে নৌকা নিয়ে আসে লবণ আর গঙ্গাজল। দুটিই এ গ্রাম্যজীবনে আবশ্যিক উপাদান। লবণ-এর মহাজনী নৌকা দু-দিন দেরি করে এলে তবু জীবনযাত্রা থেমে থাকবে না—কাঁচা ফলার বা আলুনিব্যঞ্জনে জীবনধারণ করা সম্ভব। কিন্তু এই নিগঙ্গার দেশে গঙ্গাজল না পেলে যে সূয্যি ঠাকুরও মাঝ-আকাশে থমকে দাঁড়িয়ে পড়বেন! ঠগ-জুয়াচোরের তো আকাল পড়েনি—তাই গাঙ্গুলী-মশায়ের গঙ্গাজলের কলসি গোটা এলাকায় বিক্রি হয়। বর্ধমান-বীরভূম-বাঁকুড়া মায় জঙ্গলমহল। কলসির মুখ গামছা দিয়ে বাঁধা। দড়ির গ্রন্থির উপর গাঙ্গুলীমশায়ের ‘আগমার্ক’ ছাপ। সীলমোহর ছাপ দেন ইমানদার ব্রাহ্মণ!

ক্রমে ক্রমে নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছেন ব্রজেন্দ্রনারায়ণ। ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’ প্রবাদবাক্যটা সমঝে নিতে না পারায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *