তীর্থের পথে – ৩

অভ্যর্থনার কোন ত্রুটি হয়নি। আন্তরিকতায় না হলেও আড়ম্বরে। সোঞাই গাঁ থেকে এসেছেন দত্তজার সৌখীন বজরায়, দামোদর বেয়ে—সোজা পুবমুখো। তারপর দামোদরের শাখানদী বাঁকা ধরে বর্ধমানে। দত্তজার ভদ্রাসন একেবারে বাঁকা সই-সই। অর্থাৎ সদর দ্বার রাজপথে কিন্তু প্রাসাদের খিড়কি ঘেঁষে বহে চলেছে বাঁকা। প্রাচীরবেষ্টিত প্রাসাদে পাশাপাশি দুটি ঘাট, পুরুষ ও স্ত্রীলোকদের। অর্থাৎ অবগাহন স্নানের প্রয়োজনে কাউকে বাড়ির বাইরে যেতে হয় না।

বজরাটা ঘাটে এসে ভিড়ল সূর্যোদয়ের একটু পরে। মাস ফাল্গুন। ঘাটে এখনো স্নানার্থীরা কেউ নেই। নির্জন। বড় মাঝি গলুইয়ের মাথায় দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্বমুখে একটি শাঁখ বাজিয়ে দিল। বোধহয় এটাই প্রথা—এভাবেই ঘাটের মাঝি গৃহস্থের শ্রুতি আকর্ষণ করে।

রূপেন্দ্র ঘাটে নামলেন। হাত ধরে সাবধানে নামিয়ে আনলেন মঞ্জুকে। মাঝিরা হাতে-হাতে নামিয়ে দিল পোটলা-পুঁটলি। শঙ্খধ্বনি হবার একটু পরেই সোপান বেয়ে নেমে এল একজন তরুণ, সঙ্গে এক অবগুণ্ঠনবতী। পিছন পিছন কিছু খিদমদার। তরুণ-তরুণী দুজনেই প্রণাম করল এঁদের। মঞ্জরী সঙ্কোচে আপত্তি জানায়। তরুণ শুনল না, বললে, সে কী মা? আপনি ব্রাহ্মণী, প্রণাম নিতে হবে বইকি।

তারপর রূপেন্দ্রকে বলে, আমার নাম শিবতোষ, ঠাকুরের নাম শ্রীনগেন্দ্রনাথ দত্ত। আমি তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র। বজরায় অসুবিধা হয়নি তো কিছু?

রূপেন্দ্র বলেন, কিছু না।

—আসুন, আমার সঙ্গে।

রূপেন্দ্রনাথ ঐ তরুণটির পিছন পিছন গোটা বাড়িটা প্রদক্ষিণ করে সামনের অতিথিশালার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। লক্ষ্য হল, অবগুণ্ঠনবতী মঞ্জুর হাত ধরে নিয়ে চলেছে অন্দরমহলে। পোঁটলা-পুঁটলি সবই তার পিছন-পিছন।

অতিথিশালায় নির্দিষ্ট কক্ষটি দেখিয়ে দিয়ে শিবতোষ প্রশ্ন করে, আপনার প্রাতরাশ পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করি?

—না! আমি প্রথমে স্নান করব, তারপর সন্ধ্যাহ্নিক। তারপর ওসব হবে। দত্ত-মশাই কি শয্যাত্যাগ করেছেন?

শিবতোষ বক্রপন্থায় প্রত্যুত্তর করল, প্রথম সুযোগেই তাঁকে জানিয়ে দেব যে, আপনারা নিরাপদে উপস্থিত হয়েছেন।

তিনি গাত্রোত্থান করেছেন কিনা বোঝা গেল না।

দ্বারপ্রান্তে একটি গামছা কাঁধে দাঁড়িয়েছিল। শিবতোষ বললে, এ হল কালী। আপনার খিদমদ্‌গার। জাতে উগ্রক্ষত্রিয়। জলচল। সর্বক্ষণ এখানেই থাকবে। যখন যা প্রয়োজন হবে, বলবেন। আপনি প্রস্তুত হয়ে নিন। পরে আসব।

কালী এসে প্রণাম করল ব্রাহ্মণকে। শিবতোষ প্রাসাদের দিকে ফিরে গেল।

পাকা ইটের গাঁথনি, কক্ষটি বেশ বড়। চারটি শয্যা চারপ্রান্তে। তিনটি শূন্য। উপরে টানা পাখা। দেওয়ালে হরিণের শিং। এক পাশে একটি মেজ, তদুপরি ভৃঙ্গার ও পানপাত্র–পানীয় জলের।

কালী বললে, তেল মাখবেন তো কোবরেজ-মশাই?

রূপেন্দ্র বলেন, সে ঘাটে গিয়ে। কিন্তু মার্জনা-অঙ্গবস্ত্র না হলে—

কালী মুখব্যাদন করল।

—মানে, গামছা আর কি। স্নান করে গা মুছতে হবে তো? তুমি এক কাজ কর, কালি—অন্দরমহল থেকে তোমার গিন্নি-মায়ের কাছ থেকে … মানে, আমার স্ত্রী আর কি, একখানা ধুতি আর একটা গামছা চেয়ে নিয়ে এস। পোঁটলা-পুঁটলি তো সব তাঁর কাছে।

কালী অত্যন্ত অপ্রস্তুতভাবে মুখ নিচু করে ঘাড় চুলকাতে থাকে!

–কী হল? কী বললাম বুঝতে পারলে না?

—বুঝবনি কেনে ঠাউর; কিন্তুক তাতে যে অনেক বখেড়া। একটি বেলা যাবে …

রূপেন্দ্র বুঝে উঠতে পারেন না, সমস্যাটা কী? অন্দরমহল তো এক রশি দূরে।

কালী বুঝিয়ে দেয়। ওঁর আদেশ পালন করতে হলে ওকে মাঝমহলের গোমস্তা-মশায়ের কাছে আর্জি পেশ করতে হবে তাঁর এত্তেলা পেয়ে অন্দর মহল থেকে ক্ষান্তমণি বা নিভাননী বা আর কেউ—যার ‘হাত-অপসর’ আছে, সে মাঝমহলে এসে সংবাদটা শুনবে। তারপর সেই সংবাদটা জ্ঞাত করবে মাঠানের নির্বাচিতা খাশদাসীকে কল্যাণেশ্বরী জানেন, সে কে! এর পর সেই দাসীটি ঐ দুটি দ্রব্য সংগ্রহ করে এনে মাঝমহল পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। কালী তা নিয়ে ফিরে আসতে আসতে একদণ্ড পার হয়ে যাবার আশঙ্কা!

রূপেন্দ্র কী করবেন ভেবে পেলেন না। ভবিষ্যতে দুটি পৃথক গাঁটরি বানাতে হবে এটা বুঝতে পারেন। এ জাতীয় বিড়ম্বনা বারে বারেই হবার আশঙ্কা। কিন্তু আপাতত কী করা যায়?

সমাধান বাৎলালো কালী নিজেই। তার হেপাজতে নতুন বস্ত্র এবং গামছা আছে। অনেক অতিথি অতর্কিতে নৈশবাসে বাধ্য হন। তখন তাঁদের যাতে কোন অসুবিধা না হয়, তাই অতিথিশালায় এ জাতীয় বিকল্প ব্যবস্থা রাখা থাকে। ঠাকুর-মশাইয়ের আপত্তি না থাকলে সে বার-মহলের গোমস্তামশায়ের অনুমতি নিয়ে এক প্রস্থ কাপড়-গামছা এখনি এনে দিতে পারে। রূপেন্দ্র ইতস্তত করছিলেন, কিন্তু কালীর পরবর্তী সংযোজনে তিনি সম্মত হয়ে যান—অতিথি যদি ঐ আনকোরা নতুন বস্ত্র ও গামছা সঙ্গে নিয়ে না যান তবে তা দ্বিতীয় অতিথিকে প্রদান করার হুকুম নেই। সেটি পরিচারকের প্রাপ্য হয়—অর্থাৎ এক্ষেত্রে কালীচরণের।

স্নানাহ্নিকের· পর কালীচরণ পরিবেশন করল ঠাকুরের বাল্যভোগের প্রসাদ। ফল-মূল-মিষ্টান্ন। একটি পরিচিত মিষ্টান্ন নজরে পড়ল ওঁর : ল্যাংচা।

রূপেন্দ্র প্রশ্ন করলেন, দত্তমশায়ের জলযোগ হয়েছে?

কালী জবাবে বললে, এখনো তাঁই আসেননি।

—আসেননি! উনি কি বর্ধমানে নেই?

কালী ইতস্তত করল। তারপর স্বীকার করল, বদ্দমানেই আছেন। মানে, বাগানবাড়ির থনে এখনও আসেননি।

দত্তমশায়ের এ বিষয়ে কোনও লুকোচুরি নেই। তাই প্রথমে ইতস্তত করলেও স্বীকার করতে ওর বাধল না। অর্থকৌলিন্য যার আছে সে বাগানবাড়িতে রাত কাটাবে এর মধ্যে লুকোছাপার কী আছে?

এক প্রহর বেলায় শিবতোষ ওঁকে নিয়ে গেল বৈঠকখানায়। গৃহস্বামী প্রত্যাবর্তন করেছেন প্রতীক্ষা করছিলেন। বয়স পঞ্চান্ন হতে পারে, কিন্তু শরীর মজবুত। বার্ধক্য তো দূরের কথা প্রৌঢ়ত্বও যেন এখনো তাঁর নাগাল পায়নি। রূপেন্দ্রনাথকে সাড়ম্বরে অভ্যর্থনা করে বসালেন নানান কুশল প্রশ্ন করলেন। রোগিণীর কথাও কিছু বললেন। স্থানীয় চিকিৎসক বলেছেন ব্যাধিটার নাম : মৃগী!

অর্থাৎ মূর্ছারোগ আর কি। বিবাহের পর প্রথম ছয়মাস এ উপসর্গ ছিল না। কুমারী অবস্থায় কখনো হয়নি। প্রথম দিকে দু-তিন মাস পর পর হত; ইদানীং প্রতি সপ্তাহেই দু-একবার হচ্ছে। রোগের আক্রমণ হলে হাত-পায়ের ক্ষেপণ হয়, জ্ঞান থাকে না, দাঁতে দাঁত লেগে যায়।

সমস্ত বিবরণ শুনে, কী-জাতের চিকিৎসা ইতিপূর্বে হয়েছে জেনে নিয়ে রূপেন্দ্র বললেন, অপরাহ্ণে আমি রোগিণীকে দেখব। তারপর কথা হবে আপনার সঙ্গে।

দত্তজা বলেন, এসে যখন পড়েছেন তখন দু-দশদিন বর্ধমানে থাকুন।

—না, আমি দিন-দুয়েক থাকব। তারপর যাব ত্রিবেণী। সেখান থেকে নবদ্বীপ।

নগেন্দ্রনাথ ওঁর সস্ত্রীক তীর্থ পরিক্রমার মনোবাসনা কথা শুনে বললেন, আমার পরামর্শ—সবার আগে সিংহল দ্বীপে যান। সেখানে “বাবাকে দেখে চলে যাবেন ভাগীরথীর কিনারে। দক্ষিণ দিক থেকে উজানে চলতে থাকুন—দুপাশে অসংখ্য মন্দির আর তীর্থ। ত্রিবেণী পাবেন, আরও উত্তরে এসে নবদ্বীপ।

রূপেন্দ্র অবাক হয়ে বলেন, সিংহল দ্বীপ! সে তো সাগর-পারে!

—না, না, আমি সেই বিজয়সিংহের সিংহল দ্বীপের কথা বলচিনি। এই দামোদর ধরেই এক রাত দক্ষিণবাগে যেতে হবে। ভোর ভোর পৌঁছাবেন এক বিজন বনে। সেখানে সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে এক অনাদি শিবলিঙ্গ। ভারী জাগ্রত দেবতা। হুগলি জেলায়। শুনুন মশাই, একটা দারুণ সুযোগও হয়ে যাচ্ছে। পশু এখান থেকে একটা মহাজনী, নৌকা যাবে ভারামলপুরে। মন্দির তৈরীর সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে। তাতেই যাতে যেতে পারেন তার করে দিচ্ছি।

শোনা গেল, ঐ বিজন বনে এই অনাদিলিঙ্গ শিবকে খুঁজে বার করেছে একজন স্থানীয় গে তার নাম মুকুন্দ ঘোষ। কী একটা অলৌকিক সূত্রে—বিস্তারিত জানা নেই নগেন্দ্রনাথের। তবে সেই স্বয়ম্ভূলিঙ্গ শিব নাকি হুগলির এক রাজা—বাহিরগড়ের ক্ষত্রিয় রাজবংশীয় রাজা বরামল্লকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন, বাবার জন্য মন্দির বানিয়ে দিতে। তাতেই এই মহাজনী নৌকায়, বোঝাই হয়ে মন্দির নির্মাণের মালমশলা চলেছে সেই অরণ্যে। নগেন্দ্রনাথের মতে, এ এক দৈব যোগাযোগ—না হলে, পথঘাট কিছুই নাই, নবাবিষ্কৃত এই তীর্থ সাধারণ যাত্রীর পক্ষে দুরতিক্রম্য। রূপেন্দ্র স্বীকৃত হলেন।

নগেন্দ্রনাথ পুত্রকে ডেকে বলে দিলেন, ভেষগাচার্য মাত্র দুইদিন বর্ধমানে থাকবেন। ওঁদের দুজনকে যেন স্থানীয় দ্রষ্টব্য সব কিছু ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়। পাল্কিতে নয়, হেরম্বদাসের পিঠে।

নন্দ চাটুজ্জের মাধ্যমে নগেন্দ্রনাথ ব্রজেন্দ্রনারায়ণের কাছ থেকে ঐ প্রকাণ্ড হাতিটা কিনে নিয়েছেন। ব্রজেন্দ্রনারায়ণ বলেছিলেন, হাতির মালিক তিনি নন, সোঞাই গ্রামবাসী। তিনি অছি মাত্র—হস্তির খাদ্যের জোগান দেন এবং ব্যবহার করেন। ফলে নগেন্দ্রনাথ নিজ ব্যয়ে সোাই গাঁয়ের হাটতলাটি পাকা করে দিয়েছেন। বর্ষার সময় যাতে ব্যাপারী আর খরিদ্দারেরা ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে পারে। একটি সাঁকোও বানিয়ে দিয়েছেন।

সেই মতই ব্যবস্থা হল। হস্তিপৃষ্ঠে নগর পরিদর্শন।

বর্ধমান রাজবংশের কথা ইতিপূর্বেও কিছু বলেছি। সঙ্গম রায় কাপুর থেকে কৃষ্ণরায়ের আত্মজা সত্যবতীর আত্মদানের কথা। জনপদটি কিন্তু তার বহু যুগ আগে থেকেই ছিল। কেউ কেউ বলেছেন, এই নামটি জৈন তীর্থঙ্কর বর্ধমান মহাবীরের নামানুসারে। প্রাচীন জৈন ধর্মগ্রন্থ ‘অঙ্গ-পাঠে জানা যায় যে, ঐ ধর্মপ্রচারক এখানে তাঁর সদ্ধর্ম প্রচার মানসে আগমন করেছিলেন। তখন এখানে আর্যবসতি ছিল না। ঐ গ্রন্থে তাদের বলা হয়েছে ‘চুয়াড়’। তারপর আড়াই হাজার বছর কেটে গেছে। বর্ধমান মহাবীরের ধর্মমত এ বঙ্গভূমি থেকে সরে গেছে অনেক অনেকটা দূরে; কিন্তু ‘চুয়াড়’-রা স্বধর্মচ্যুত হয়নি। তারা সমান দাপটে আজও বঙ্গভূমে মস্তানি করে চলেছে!

বর্ধমান মহাবীর ঐ ধর্মগ্রন্থ মতে প্রথমে চুয়াড়দের দ্বারা অপমানিত ও প্রহৃত হন, যদিও শেষে তারা তাঁর ধর্মমত গ্রহণ করে। সেটা খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর ঘটনা।

কারও মতে গ্রীক ঐতিহাসিক বর্ণিত গঙ্গারিডি রাজ্যের রাজধানী ‘পার্থোলিস্’ বাস্তবে এই বর্ধমান শহর। সে রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী ছিল সপ্তগ্রাম। ইতিহাসে দেখছি, 1574 খ্ৰীষ্টাব্দে আকবরের সৈন্যদল বর্ধমান-শাসক দাউদ খাঁর পরিজনবর্গকে বন্দী করে আর 1606 খ্রীষ্টাব্দে, আকবরের মৃত্যুর পরের বছর নিহত হন শের আফকন, জগৎবিখ্যাতা সুন্দরী নূরজাহাঁর প্রথম স্বামী। ঐ শের অফকন ও তাঁর কন্যা লাডলি বেগমকে নিয়ে গোটা একটা উপন্যাসই ইতিপূর্বে লিখে ফেলেছি। ফলে সে-সব কথা যাক।

শিবতোষ পিতার আদেশে বর্ধমানের দ্রষ্টব্য সব কিছু ওঁদের ঘুরিয়ে দেখাল। কিন্তু সে-আমলে দেখার মতো ছিলই বা কী? মহারাজার প্রাসাদটাও আকারে অনেক ছোট। বর্তমানে যে প্রাসাদ দেখা যায়, তা পরবর্তীকালের মহারাজ মহাতারকাদের নির্মিত। তিনিই গোলাপবাগে একটি পশুশালা নির্মাণ করেন। লর্ড কার্জনের সম্মানার্থ নির্মিত ‘ভারতদ্বার’ তোরণ তো আরও পরবর্তী জমানার। সে আমলে অবশ্য ছিল শ্যামসায়র আর কৃষ্ণসায়র দীঘি, আর বর্ধমান শহরের এক ক্রোশ পশ্চিমে, শাহী সড়কের ধারে আর একটি কীর্তি। নবাবহাট গ্রামে একটি দীর্ঘিকা, আর তাকে ঘিরে একশ আট শিবমন্দির। অদূরেই তালিতগড় দুর্গ। আমাদের কাহিনীর কালে বর্ধমানরাজ তিলকচাঁদ বারে বারে ঐ দুর্গে গিয়ে আশ্রয় নিতেন—বর্গীর দল এগিয়ে আসছে সংবাদ পেলেই।

.

একটা অবান্তর কথা বলি, কিছু মনে কর না :

আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে ঐ নবাবহাটের একশ আট শিবমন্দিরে এ গ্রন্থের লেখক সস্ত্রীক কাটিয়ে এসেছিল একটি মধ্যাহ্ন। আমরা খিচুড়ি বানিয়ে খেয়েছিলাম। তখন দেখেছিলাম, ঐ দীঘির জলে স্নান করা মানা, বাসন-পত্র ধোয়া বারণ। দীঘি থেকে শুধু পানীয় জল সংগ্রহ করা যেত। এখন হয়তো নলকূপ বসেছে, পাইপ-লাইনও বসেছে; কিন্তু এ গ্রন্থের লেখক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় সেখানে দেখে এসেছিল সেই ব্যবস্থাটি, যা রূপেন্দ্রনাথ করেছিলেন সোঞাই গাঁয়ে, আড়াইশ বছর আগে, তাঁর একবগ্গা দীঘিতে!

.

পরদিন সকালে রূপেন্দ্রনাথ বর্ধমান থেকে বিদায় নিলেন। রুগী দেখেছেন, রোগ নির্ণয়ও করেছেন। তা নিয়ে কিছু অপ্রিয় আলোচনাও হয়েছে।

নগেন্দ্রনাথ জানতে চেয়েছিলেন, কী বুঝলেন বলুন কোবরেজমশাই, এ অসুখ সারবে?

-সারবে। নিশ্চিত সারবে। ঠিক মতো চিকিৎসা করলে। কিন্তু আপনি কি পারবেন?

কী বলছেন? পারব না? আমার অসাধ্য কিছু নেই! বলুন, কী করতে হবে?

তখন শিবতোষও উপস্থিত। রূপেন্দ্র তাকে বললেন, তুমি একটু অন্যত্র যাও শিবতোষ; আমি তোমার বাবার সঙ্গে কিছু কথা গোপনে আলোচনা করতে চাই।

শিবতোষ তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ায়। নগেন্দ্রনাথ বলেন, না, না, তুই বস।

তারপর রূপেন্দ্রর দিকে ফিরে বলেন, শুনুন কোবরেজমশাই, আমার সময় হয় না আদৌ। সেবা-শুশ্রূষা, ঔষধপত্র দেওয়া, সব করে বধূমাতা আর এই শিবু। আপনার যা বলার আছে অসঙ্কোচে ওর সামনে বলতে পারেন। ওরাই তো সবকিছু করবে।

রূপেন্দ্র বলেন, গোপনীয়তার প্রয়োজনটা আপনার না থাকতে পারে, আমার আছে।

ভ্রূকুঞ্চিত হল নগেন্দ্রনাথের। তাঁর কথার প্রতিবাদ কেউ করে না, করতে সাহস পায় না। সামলে নিয়ে বললেন, ও, আচ্ছা। ঠিক আছে, তুই যা।

শিবতোষ কক্ষত্যাগ করার পর বলেন, এবার বলুন?

—আমি এইমাত্র বলেছি, ঠিক মতো চিকিৎসা করালে ওঁর রোগমুক্তি হবে; কিন্তু চিকিৎসার প্রয়োজন ওঁর নাই। প্রয়োজন আপনার। তাই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলাম—আপনি কি পারবেন?

নগেন্দ্রনাথ নির্বাক তাকিয়ে রইলেন কয়েকটি মুহূর্ত। তারপর বললেন, বুঝলাম না।

—আপনার স্ত্রীর অসুখটা দৈহিক নয়, মানসিক। রোগের মূল হেতু—যেহেতু তিনি আপনার কাছে যথাযথ স্ত্রীর মর্যাদা পাচ্ছেন না!

—স্ত্রীর মর্যাদা পাচ্ছে না? কী বলছেন আপনি? সে তো যা চায়, তাই পায়।

—না, পান্ না। নিশ্চয় জানেন, ভেষগাচার্যের কাছে কোন কিছু গোপন করতে নেই। এবার বলুন তো দত্তমশাই—আপনি কতদিন পূর্বে আপনার স্ত্রীর সঙ্গে এক শয্যায় রাত্রি-যাপন করেছেন? কবে তার স্ত্রীর মর্যাদা শেষ মিটিয়েছেন?

নগেন্দ্রনাথের মুখমণ্ডল রক্তবর্ণ ধারণ করল। বললেন, আপনার স্পর্ধার একটা সীমা থাকবে তো, কোবরেজমশাই! কতদিন আগে আমি স্ত্রীকে নিয়ে এক শয্যায় শয়ন করেছি এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে আপনার বাধল না?

—প্রশ্ন করতে আমার যে বাধেনি তা তো দেখতেই পাচ্ছেন, উত্তর দিতেই না বাধছে আপনার? শুনুন, ক্ষুৎপিপাসা-নিদ্রার মতো এও এক জৈবিক প্রবৃত্তি। আমি জানি না, কেন আপনি দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করেছেন; কিন্তু আমার আশঙ্কা আপনার স্ত্রী অক্ষতযোনি!

—চোপরও বেয়াদপ!—গর্জন করে উঠে দাঁড়ান নগেন্দ্রনাথ। পিঞ্জরাবদ্ধ শার্দুলের মত বার-কতক কক্ষ মধ্যে পায়চারি করে ফিরে এসে ওঁর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেন, আপনাকে ওর চিকিৎসা করতে হবে না। কী বৈদ্যবিদায় দিতে হবে শুধু বলুন?

রূপেন্দ্রনাথও উঠে দাঁড়িয়েছেন। বললেন, ভিতরবাড়িতে খবর পাঠান। আমার স্ত্রীকে জিনিসপত্র সমেত বাইরে চলে আসতে বলুন। আমি আপনার দেউড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি।

নগেন্দ্রনাথ হঠাৎ নিবে যান। ওঁর হাতটা ধরে বলেন, আমার অন্যায় হয়ে গেছে। কিছু মনে করবেন না। মানে, আত্মসংযম হারিয়ে…..

—না! কিছু মনে করিনি আমি। আপনি প্রচুর অর্থের মালিক, শিক্ষাদীক্ষা বোধকরি কিছু নেই। ভদ্রভাবে কথাবার্তা বলতে পারবেন না, এ তো প্রত্যাশিত। যা হোক, ভিতরে খবর পাঠান।

—আমি আপনার হাত ধরে ক্ষমা চাইছি,ভেষগাচার্য! ঠিকই বলেছেন আপনি! শিক্ষাদীক্ষা, আমার তেমন কিছু হয়নি! বলুন, ক্ষমা করেছেন?

—করেছি।

দুজনেই উপবেশন করেন অতঃপর। নগেন্দ্রনাথ বলেন, এবার বলুন, কী চিকিৎসা করতে চান? ঔষধপত্রের ব্যবস্থা…

—সে-কথা আমি আগেই বলেছি, দত্তমশাই। আপনি আপনার জীবনযাত্রায় পরিবর্তন না করলে আমি তাঁর চিকিৎসা করতে পারব না।

–বেশ বলুন, আমাকে কী করতে হবে?

—মদ্যপান ত্যাগ করতে বলছি না, কিন্তু সন্ধ্যার পর বাগানবাড়ি যাওয়া বন্ধ করতে হবে। সাত দিন ঐ ঔষধই চলবে, অষ্টম দিনে তাঁর কাছে গিয়ে বলতে হবে, এইমাত্র আমাকে যা বললেন—

—বুঝলাম না। কাকে কী বলতে হবে?

—আপনার ধর্মপত্নীকে গিয়ে বলবেন, যা আমাকে এইমাত্র বললেন : ‘আমি তোমার হাত ধরে ক্ষমা চাইছি। বল, ক্ষমা করেছ?

নগেন্দ্রনাথ নতনেত্রে অনেকক্ষণ বসে রইলেন চুপ করে। তারপর বললেন, তাহলেই ও ভাল হয়ে যাবে?

—খুবই সম্ভাবনা। মোট কথা—এটাই একমাত্র চিকিৎসা। আপনার সঙ্গে তাঁর বয়সের যথেষ্ট পার্থক্য। আপনার জীবনযাত্রার সঙ্গেও তাঁর পরিচয় আছে। বাগানবাড়ি, বাইজী বা উপপত্নীকে আপনি একেবারে ত্যাগ করতে পারবেন বলে মনে হয় না; কিন্তু আপনার স্নেহ, প্রেম, সোহাগ পেলে খুব সম্ভব তাঁর এ মূর্ছা রোগ সেরে যাবে। গেল কি গেল না, আপনি আমাকে জানাবেন। না গেলে, আমি আবার তাঁকে দেখব।

নগেন্দ্রনাথ বললেন, আমি চেষ্টা করব। ক্ষমা যখন করেছেন এবার বলুন, কী বৈদ্যবিদায় দেব?

—না, দত্তমশাই! আমি কর্পদকমাত্র নিতে পারব না এখন।

–কেন?

—আমাকে বৈদ্যবিদায় দেবার অধিকার আপনাকে অর্জন করতে হবে। আমি যে ব্যবস্থা দিয়ে গেলাম তা যদি যথাযথ পালন করতে পারেন, আপনার ধর্মপত্নীকে সুস্থ করতে পারেন তখনই আমি আপনার কাছ থেকে হাত পেতে কিছু নিতে পারব!

—কিন্তু বৈদ্যের পরামর্শ নিয়ে বৈদ্যবিদায় না দিলে যে নরকদর্শন করতে হয়।

—জানি! অন্তত সেই ভয়েই যদি আপনি আপনার জীবনযাত্রার ছকটা পাল্টাতে পারেন তাহলেই আমি আনন্দিত। আমার বৈদ্যবিদায় প্রত্যাখ্যান করার সেটাও একটা হেতু।

নগেন্দ্রনাথ অধোবদন হলেন। একথার জবাব নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *