কাশীধাম : 1774 - প্ৰথম পৰ্ব
সোঞাই : 1742 - দ্বিতীয় পৰ্ব
নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর : 1742 - তৃতীয় পৰ্ব
তীর্থের পথে : 1742 - চতুর্থ পর্ব
1 of 2

সোঞাই – ২১

২১

রূপেন্দ্র বজ্রাহত হয়ে গেলেন জেঠামশায়ের মুখে কথাটা শুনে—

—না রূপেন্দ্রনাথ! আমি এ বিবাহপ্রস্তাবে সম্মত হতে পারি না!

মহাষ্টমী অতিক্রান্ত। সন্ধিপুজোর ঢাকের বাদ্যি একটু আগে থেমেছে। ব্রজেন্দ্রনাথের খাশ কামরায় বসেছেন ওঁরা দুজন—রূপেন্দ্র আর ব্রজেন্দ্রনাথ। মাটিতে ফুলকাটা পশমের আসনে। সমস্ত দিন মহাষ্টমীর উপবাস গেছে। এখন প্রসাদ পেতে বসেছেন। সামনে দুটি পাথরের থালা। প্রসাদ গ্রহণ শেষ হয়েছে। একটু আগে ঐ দুটি থালায় সাজানো ছিল—নানান ফলমূল, লুচি, নিরামিষ তরকারি, পায়েস, পক্কান্ন, খেজুর গুড়, তিলেখাজা, চন্দ্রপুলি, মায় বর্ধমান থেকে আনানো সীতাভোগ। ভাদুড়ী-বাড়িতে ‘বলি’ হয় না। আগে হত। ব্রজেন্দ্রনারায়ণের পিতৃদেবের আমলে নাকি একবার বলি আটকে যায়। তার পর থেকে ও প্রথা উঠে গেছে। সামনে বসে আছেন বড়মা, তালপাখা হাতে। গরমও নেই, মাছিও নেই—পাখাটা হাতে আছে নিতান্ত অভ্যাসবশে। দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে একগলা ঘোমটা টেনে তারাসুন্দরী—কখন কী প্রয়োজন হয়।

সংবাদটা গোপন—এতদূর গোপন যে, জমিদারবাড়ির সব কয়টি পুরললনাই তা গোপনে জানে। প্রত্যেকেই ঐ মুখরোচক সংবাদটির উপসংহার হিসাবে শ্রোতার সাবধানবাণীটি শুনেছে: তোকেই শুধু বললাম, এখনি পাঁচকান করিস না।

জগুপিসি নাকি আজ দুপুরে তাঁর ‘গঙ্গাজলে’র মাথাটা টেনে নিয়ে কানে কানে বলেছিলেন, তোরে একটা ‘গোপন-কথা’ বলতে এলাম, গঙ্গাজল! একটা বিয়ের-প্রস্তাব! তা আমি বলনি!

ব্রজেন্দ্রসুন্দরীর বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি। তবু ন্যাকা সেজে বলে ছিলেন, এ আবার কী হেঁয়ালী? ‘গোপন-কথা’ বলতে এসেছিস্—আবার বলছিস্–’বলবনি’?

—কেন বলব? আমার একটা ময্যাদা নেই! আমি হলাম গে বরের ঘরের পিসি! আমি কেন প্রস্তাব তুলব? তুই মেয়ের তরফের! তুই কথা তুলবি, আমার হাতে পায়ে ধরবি—আমি শুধু রাজী হব!

ব্রজসুন্দরী বলেছিলেন, ওসব আধিক্যেতা ‘সম্বন্দ-করা’ বিয়েতে হয়! এ কী তাই? এ তো…

মনের উচ্ছ্বাসে তিনি ভুলে গেছিলেন শ্রোতা জগু ঠাকরুণ। কালিদাসের একটি সুবিখ্যাত শ্লোক শুনিয়ে দিয়েছিলেন তিনি—‘যেখানে মদন পঞ্চশর স্বয়ং ব্যবস্থাপক সেখানে পুরোহিত নিষ্প্রয়োজন।’

জগুপিসি ঐ ‘গোপন কথাটা’ জানেন—তাঁর দুঃসাহসিনী গঙ্গাজল ঐ অংবংভাষাটা আয়ত্ত করেছে—নিভ্যয়ে! কেন করবে না? দেবী অংশে জন্ম তার! সে জানে, কোন অলপ্পেয়ে যমদূত সে অপরাধে ওঁর সিঁথির দিকে হাত বাড়াতে সাহস পাবে না—ভস্ম হয়ে যাবার ভয়ে! ধমকে উঠেছিলেন তিনি, ওসব অংবং-মন্ত্র রাত্তিরে শোনাস তোর বরকে! আমাকে যা বলবি তা সাদা-বাঙলায় বল্‌ দিনি?

—কী আর বল্ব বল? একবগ্গা আমাকে ‘জীবন’ দিল, আর আমি ওকে একটা ‘জীবনসঙ্গিনী’ দিতে পারব না?

সমস্ত দিনে গোপনে গোপনে এই রসঘন আনন্দবার্তাটা মহিলামহলে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এ কী অসৈরন নিদান হাঁকলেন বড়কর্তা! তিনি সম্মত নন!

প্রশ্নটা ব্রজসুন্দরীই পেশ করেন, এ কী বলছেন আপনি? কুসুমমঞ্জরীর সঙ্গে রূপেন্দ্রনাথের বিবাহপ্রস্তাবে আপনার সম্মতি নেই?

জনান্তিকে ‘তুমি সম্বোধন করলেও প্রকাশ্যে তিনি ‘আপনি’ বলেন!

ব্রজেন্দ্রনারায়ণ বললেন, সেই কথাই বলেছি, গিন্নি! কারণ আমি জানি, তোমরা রূপেন্দ্রকে বাধ্য করেছ এ বিবাহে সম্মত হতে। তার মনোগত বাসনা—আজীবন কৌমার্যব্রত গ্রহণ করে আর্তের সেবা করে যাওয়া। সে তার সঙ্কল্পচ্যুত হতে স্বীকৃত হয়েছে—শুধু ঐ মেয়েটিকে উদ্ধার করতে!

ব্রজসুন্দরী রুখে ওঠেন, না হয় তাই হল! তাতেই বা আপনার আপত্তি কিসের?

—আপত্তি এজন্য যে, তোমাদের রজ্জুতে সর্পভ্রম হয়েছে। কুসুমমঞ্জরীর যে বিপদের আশ্রঙ্কা তোমরা করেছ সে বিপদ থেকে মেয়েটি ইতিমধ্যে উদ্ধার পেয়েছে। ওর ‘রাইরানী হওয়ার আশঙ্কা আর নেই!

—কেন?

—যেহেতু রূপনগরের মোহান্ত-মহারাজের পরলোকপ্রাপ্তি ঘটেছে! পঞ্চমীর দিন।

রূপেন্দ্রনাথ এতক্ষণ অধোবদনে বসে ছিলেন। এ সংবাদে মুখ তুলে তাকালেন। বললেন, এ সংবাদ জানা ছিল না; কিন্তু আশঙ্কা তো তাতেও দূরীভূত হয়নি, জেঠামশাই! মোহন্ত মহারাজ গতায়ু—কিন্তু তাঁর গদীটা তো আছে! আবার কেউ উঠে বসবে তাতে। হয় তো সেই ‘ছোটহুজুর’!

—না! সেও তীরবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। তরুণ ঈশানের তীরে বিদ্ধ হয়ে।

—ঈশেনের তীরে’! মানে, আমাদের ঈশেন?

—হ্যাঁ তাই! রূপনগরের মঠ ভস্মীভূত হয়ে গেছে। সমস্ত গ্রামটা নিশ্চিহ্ন! মোহন্ত মহারাজের ধনাগার লুণ্ঠিত—তার সেই গোপিকার দল…আহ্!

আচমন করে উঠে পড়লেন তিনি।

ব্রজেন্দ্রনারায়ণ তারপর শোনালেন এক বিচিত্র সংবাদ। বিস্তারিতভাবে। এ সংবাদ তিনি পেয়েছেন বিশেষ সংবাদবহ মারফত। সম্পূর্ণ গোপন রেখেছেন। জানে, একমাত্র তারাপ্রসন্ন! সংক্ষেপে তা এই—

ভ্রাতুষ্পুত্রের মুখে সংবাদটা শুনে হিতাহিতজ্ঞান লোপ পেয়ে গিয়েছিল মোহন্ত মহারাজের! ভাদুড়ী-মশাইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল—অবিলম্বে রূপনগরের মেয়েকে ফেরত পাঠাতে। গো-গাড়িটা আজ প্রায় মাসখানেক অপেক্ষা করছে। স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও গাড়িটা ফিরে আসেনি। মোহন্ত মহারাজ তখন আদেশ দিয়েছিলেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে—মেয়েটিকে ছিনিয়ে আনতে। দুই হাতিয়ারবন্দ সহচরকে নিয়ে ‘ছোটহুজুর মোহন্ত মহারাজের হুকুম তামিল করতে তখনই ঘোড়া ছুটিয়ে রওনা হয়েছিল। সোঞাই গায়ের সেই অর্বাচীন কবিরাজটা তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। খালি হাতে। শুধু তাই নয়—সেই দুঃসাহসী কবিরাজটার চোখের সম্মুখে কে একটা বাগদির-পো মহামহিম মোহন্ত মহারাজের দূতের গালে চপেটাঘাত করেছে। ক্ষিপ্ত হয়ে যাবার কথাই! প্রেমদাস গোঁসাই তৎক্ষণাৎ আদেশ দিয়েছিলেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে—অবিলম্বে সসৈন্য সোঞাই আক্রমণ করতে। শুধু মেয়েটিকে ছিনিয়ে আনলেই চলবে না—শূলে বিদ্ধ করে আনতে হবে সেই কবিরাজ আর তার বাগদি-চেলার ছিন্ন মুণ্ডু দুটো!

ছোট হুজুর জানিয়েছিল, সে মহাষ্টমীতে ফিরে আসবে বলে হুঁসিয়ার’ জানিয়ে এসেছে।

হুঙ্কার করে উঠেছিলেন, না, এখনি! এই মুহূর্তে! কামান নিয়ে যেতে হবে না। তাহলে পৌছতেই তিন দিন লেগে যাবে। সঙ্গে নিয়ে যা এক শ বন্দুকধারী ঘোড়সওয়ার আর হেরম্বদাসকে।

‘হেরম্বদাস’ ওঁর রণহস্তীর পোষাকী নাম।

আদেশমাত্র সৈন্য সমাবেশ করে ওরা রওনা হয়েছিল।

নিয়তির পরিহাস! ভাস্কর পণ্ডিতও সেই সময় চলেছে মুর্শিদাবাদ-মুখো। দাঁইহাটি থেকে উত্তরমুখো, ভাগীরথীর পশ্চিম কিনার ধরে। তার গুপ্তচর এসে সংবাদ দিল সে স্বচক্ষে দেখেছে, রূপনগরের গড় থেকে শতাধিক অশ্বারোহী আর একটি রণহস্তী নিয়ে মোহন্ত-মহারাজের সৈন্যদল পশ্চিমমুখো কোথায় যেন চলেছে। ভাস্কর সাবধানী। সে কাটোয়ায় এক বেলা অপেক্ষা করল—বিস্তারিত সংবাদ সংগ্রহ করল। অচিরেই জানতে পারল সঠিক সংবাদ সৈন্যদল চলেছে বর্ধমানের কী একটা গাঁয়ে—স্থানীয় এক জমিদারকে সায়েস্তা করতে। ভাস্কর তৎক্ষণাৎ বুঝে নেয়—রূপনগরের গড় বস্তুত অরক্ষিত! জনশ্রুতি আগেই সংগ্রহ করা ছিল—মোহন্ত-মহারাজের রত্নভাণ্ডার কুবেরীর্ষিত! বর্গী সৈন্যদল মুখ ঘোরালো।

ছোট-হুজুর সোঞাই গাঁয়ের পারানি-ঘাটে যে দিনটি কলার ভেলায় দামোদর পার হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে, সেই সারাটি দিনে অজয়ের তীরে নির্মূল হয়ে গেছে রূপনগরের গড় ও গ্রাম। সন্ধ্যাবেলায় সেই দুঃসংবাদ দিতেই রূপনগর থেকে ছুটে এসেছিল অশ্বারোহী সংবাদবহ—ছোট হুজুরকে মর্মান্তিক বার্তাটা পেশ করতে। বেচারি এসে শোনে, সেই ছোট- হুজুরও ভেসে গেছে দামোদরের স্রোতের টানে!

সহজ ভাষায় ভীমা আর ঈশান যাদের সঙ্গে সারাদিন কাজিয়া করেছে তারা বর্গী সৈন্য আদৌ নয়—রূপনগরের ফৌজ! এপার থেকে তাদের সনাক্ত করা যায়নি। শুধু বোঝা গিয়েছিল তারা হিন্দু।

ভাস্কর রূপনগরকে ধূলিসাৎ করে, মোহান্ত-মহারাজের দ্বিখণ্ডিত দেহটা অজয়ে নিক্ষেপ করে তারপর রওনা হয় উত্তরমুখো

নিতান্ত সৌভাগ্য গঙ্গার পূর্ব-উপকূলের জনপদগুলির কালীগঞ্জ, পলাশীপাড়া, রেজিনগর, বা বেলডাঙার। বর্গী সৈন্য ভাগীরথীর পশ্চিম উপকূল ধরে চলেছিল উত্তরমুখো—কাটোয়া ঘাট থেকে মুর্শিদাবাদ। গঙ্গা পার হওয়ায় কোন বাধা ছিল না। কিন্তু ভাস্কর পন্থের হাতে সময় ছিল অল্প। তার গোপন খবর ছিল, নবাব আলিবর্দী বালেশ্বরে থাকতেই খবর পেয়েছেন—বর্গী সৈন্য তাঁর রাজধানী আক্রমণ করতে পারে। নবাবী সৈন্য বালেশ্বর-দাঁতন পার হয়েছে। তারাও দ্রুতপদে এগিয়ে আসছে মুর্শিদাবাদের দিকে। তাই শুধু ভাগীরথীর পূর্বপারের জনপদ নয়, পশ্চিমপারের গ্রামগুলিও সে-যাত্রা বর্গী-আক্রমণ থেকে রেহাই পেল—কেতুগ্রাম, ভরতপুর, কান্দি, খড়গ্রাম। বিদ্যুৎগতিতে বর্গী সৈন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল খাশ মুর্শিদাবাদে-লালবাগ, আজিমগঞ্জে।

নবাবী দুর্গ অধিকার করতে পারল না তারা। আলিবর্দী ঐ রূপনগরের প্রেমদাস বাবাজীর মতো মূৰ্খ নয়—যুদ্ধযাত্রা করার পূর্বে নিজের প্রাসাদ ও তোষাখানা সুরক্ষিত করে রাখার কথা ভোলে না। কিন্তু বর্গী সৈন্য অনায়াসে দখল করে নিল জগৎশেঠের ধনাগার!

বর্গীরা আক্রমণ করতে আসছে শুনে জগৎশেঠ ফতেচাঁদ সপরিবারে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে আত্মগোপন করেছিলেন। ভাস্করপন্থ তাঁর গদি লুট করে পেয়েছিলেন দু কোটি আর্কট মুদ্ৰা!

আজকের হিসাবে তা কত হাজার কোটি টাকা তা বলতে পারব না! শুধু মনে করিয়ে দিতে পারি—মুর্শিদাবাদের বাজারে তখন এক তঙ্কায় পাঁচ মণ চাউল পাওয়া যেত! সেটাও কিন্তু আমার কাহিনীর শেষ চমক নয়! এর পরে আমাকে বলতে হবে—ঐ ক্ষয়ক্ষতিতে বিশেষ বিব্রত হননি জগৎশেঠ ফতেচাঁদ।

বর্গীর হাঙ্গামা মিটে গেলে আবার গদিয়াল হয়ে বসে নাকি বলেছিলেন—ঐসিন তো হোতাই হ্যয়। থোড়া-বহুৎ নুকসান হো গ্যয়া! ক্যা কিয়া যায়?

পরবৎসরই নবাবকে উপহার দিয়েছিলেন এক কোটি আর্কট মুদ্রা!

সে যা হোক—বিস্তারিত ইতিহাস শুনিয়ে ভাদুড়ী-মশাই তাঁর ধর্মপত্নীর দিকে ফিরে বলেছিলেন, এখন তো বুঝলে, রূপেন্দ্রকে বিবাহ করতে বাধ্য করার কোন প্রয়োজন নেই! কুসুমমঞ্জরী আমার কন্যারূপে এ বাড়িতে অনায়াসে আশ্রয় পেতে পারে—সোঞাই গায়ের কূলবধূ না হলেও!

ব্রজসুন্দরী বললেন, আপনি আমাকে একটা কথা বুঝিয়ে বলুন দেখি। পুরুষ মানুষ বিবাহে সম্মতি দেয় কেন? অরক্ষণীয়া একটি কন্যাকে উদ্ধার করতে?

ব্রজেন্দ্র গম্ভীর ভাবে বলেন, শাস্ত্র বলেছেন,—না! ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভাৰ্যা!

—শাস্ত্রের বাক্য থাক! একবগ্গা শাস্ত্রনির্দেশে চলে না, চলে বিবেকের নির্দেশে!

—তা ওর বিবেক কী নির্দেশ, কেন দিচ্ছে, তা আমি কেমন করে জানব?

রূপেন্দ্রনাথ বুড়োবুড়ির এ জাতীয় কথোপকথনের কোন অর্থ গ্রহণ করতে পারেন না। কী নিয়ে তর্ক? কিসের বিবাদ?

বৃদ্ধা বলেন, আপনি কি শুধু শাস্ত্রই পড়েছেন। কাব্য পড়েননি?

ব্রজেন্দ্র বললেন, তা কাব্য তো তুমিও যথেষ্ট পড়েছ, গিন্নি। বল, তোমার মুখ থেকেই শুনি—

—তাই শুনুন তবে। এই মাত্র যে শব্দটা উচ্চারণ করলেন—‘গৃহিণী’ সেটা ‘গৃহ’ শব্দের সমার্থক—ন গৃহং গৃহমিত্যাহুগৃহিণী গৃহমুচ্যতে’।[১] একবগ্গার গৃহ ‘দ্বিবন্ধা’ না হলে ‘অরণ্যং তেন গন্তব্যং যথারণ্যম্ তথা গৃহম!’[২] কিছু বুঝলেন?

ব্রজেন্দ্র বললেন, একটু একটু!

‘গুণী গুণং বেত্তি ন বেত্তি নিৰ্গুণো
পিকো বসন্তস্য গুণং ন বায়ুসঃ।’[৩]

—তা তো বটেই। সেক্ষেত্রে পিক-কুহু কী বলছে শুনুন,

“কবিতা বনিতা চৈব সুখদা স্বয়মাগতা
বলদাকৃষ্যমানা চেৎ সহসা বিরসায়তে।’[৪]

রূপেন্দ্রনাথ রীতিমতো স্তম্ভিত! এ কী শুরু করেছেন ওঁরা! যেন দুই কাব্যতীর্থ সংস্কৃতে কবির-লড়াই জুড়ে দিয়েছেন! পরমুহূর্তেই বুঝে ফেলেন এই কবির লড়াইয়ের মূল-উৎসটা কোথায়! ওঁরা দুজনে মিলে একটা কৌতুক করছিলেন এতক্ষণ! সমস্তটাই নিদারুণ রসঘন প্রমোদন! যদিও সম্পর্কটা ‘জেঠা-জেঠি, কিন্তু বয়সের ফারাকটা ‘দাদু-দিদার! আনন্দের আতিশয্যে বুড়োবুড়ি আজ উচ্ছসিত! তাই এই প্রগল্ভতা। কিন্তু দ্বারপ্রান্তে অপেক্ষা করছে পুত্রবধূ—তাই তার বোধগম্য ভাষায় হৃদয়ের উচ্ছ্বাসটাকে ব্যক্ত করতে পারছেন না—দুজনেই ক্রমাগত সংস্কৃতে মনের আবেগকে মুক্তি দিচ্ছেন!

ব্রজেন্দ্রকে নীরব দেখে বড়মা বলে ওঠেন, এবার যে আমার ‘চাপান’। আপনারই ‘উতোর’ দেবার কথা। কিছু বলছেন না যে?

কী বলব? ‘ভদ্রং কৃতং কৃতং মৌনং কোকি-লৈৰ্জলদাগমে
দর্দুরা যত্র বক্তারস্ত্রত্র মৌনং হি শোভনম।।’[৫]

হঠাৎ বড়-মার নজরে পড়ে দ্বারপ্রান্তে তারাসুন্দরীর চক্ষুদ্বয় বিস্ফারিত হয়ে গেছে। মাথা থেকে তার যে ঘোমটা খসে গেছে, তাও সে টের পায়নি। বড়-মা লজ্জা পেলেন। তৎক্ষণাৎ নিজেকে সংযত করে বলেন; একবগ্গা! শোন! এ তোমার বড়মার আদেশ! সাতই অঘ্রাণ দিন স্থির হয়েছে! যাবতীয় ব্যবস্থা করে ফেল ইতিমধ্যে।

রূপেন্দ্রর আচমন শেষ হয়েছিল ইতিপূর্বেই। তিনি উভয়ের পদধূলি গ্রহণ করেলেন।

—-

[১. যে গৃহে গৃহিণী অনুপস্থিত তাকে ‘গৃহ’ বলা চলে না। গৃহিণীই গৃহকে গৃহ-মর্যাদা প্রদান করে।

২. তার পক্ষে বনে যাওয়াই ভাল; কারণ তার কাছে অরণ্যও যা, গৃহও তাই।

৩. গুণীব্যক্তিই গুণীর সমাদর করতে পারে। যে নির্গুণ সে কী বুঝবে? বসন্তের মহিমা কোকিলই বোঝে, কাক বোঝে না।

৪. কবিতা আর কবিপ্রিয়া যখন স্বেচ্ছায় সলজ্জচরণে এগিয়ে আসেন তখনই কবি সার্থক। জোর-জবরদস্তি করে ধরে আনলে—কী কবিতা, কী কবিপ্রিয়া—কেউই রসমণ্ডিতা হয় না। সরস হলেও তা শুকিয়ে যায়।

৫. সময়ে সময়ে মৌন থাকাই ভদ্রতা। বর্ষাগমে যখন ভেকদল সরব হয় তখন কোকিলেরা নীরব থাকে।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *