২০
সেদিন অপরাহ্ণবেলা।
রূপেন্দ্রনাথ অশ্বপৃষ্ঠে ফিরে আসছিলেন তিজলহাটি থেকে। তিন ক্রোশ দূরের গ্রাম। তিজলহাটির পাঁচকড়ি ঘোষালের জোয়ান ছেলেটাকে সাপে কামড়েছে শুনে তড়িঘড়ি ছুটে গিয়েছিলেন ভিন গাঁয়ে। ভাগ্য ভাল—সাপটি বিষাক্ত ছিল বটে, কিন্তু জুৎ করে কামড়াতে পারেনি। বিষ ঢালতে পারেনি ঠিক মতো। তাছাড়া স্থানীয় গুণিন ওঁর নির্দেশ মোতাবেক বাঁধনটা দিয়েছিল ভালই। নির্দেশ উনি আজ দেননি। দিয়েছিলেন অনেকদিন আগে।
এ অঞ্চলে সাপের উপদ্রব খুব বেশি। গোখরো, কেউটে, লাউডগা, খরিশ—নানান জাতের। প্রতি মাসেই এক-আধটা সর্পদংশনের রোগী জোটে। রূপেন্দ্র প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্থানীয় ওঝা-গুণিনদের শিখিয়ে দিয়ে আসেন ‘টুর্নিকেট’বাধার কায়দাটা। ওঝাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বুঝিয়ে বলতেন, শোন্ বাবা, তোরা ঝাড়ফুঁক করিস, মা-মনসাকে স্তবস্তুতি করিস, ভাল কথা। তাতে আমি বাধা দিচ্ছি না। কিন্তু এই বাঁধনটা দিতে ভুলিস না।
সাপের বিষ কী-ভাবে শিরা-ধমনীর পথ বেয়ে আক্রান্তের মৃত্যু ঘটায়—কোথায় বাঁধন দিতে হবে, কতটা জোরে বাঁধতে হবে, কতক্ষণ পর-পর বাঁধন একটু আলগা করে আক্রান্ত প্রত্যঙ্গে রক্তসঞ্চালন সচল রাখতে হবে, সব শিখিয়ে দিতেন। ওদের রুজি-রোজগারে হাত পড়ছে না দেখে অনেকেই ধন্বন্তরি বাবামশায়ের নির্দেশটা মেনে চলত।
দু-একটি ক্ষেত্রে এক আসুরিক পদ্ধতিতে তাঁকে সর্পদংশনের চিকিৎসাও করতে দেখেছে ওরা। দংশনের অনতিবিলম্বে উপস্থিত হতে পারলে তিনি অকুতোভয়ে দংশিত ক্ষতচিহ্নে মুখ লাগিয়ে বিষাক্ত রক্তটা শুষে নিতেন-থু-থু করে ফেলে মুখটা ধুয়ে ফেলতেন। তাজ্জব হয়ে যেত সবাই। উনি বুঝিয়ে বলবার চেষ্টা করতেন—এ কোন অলৌকিক ক্ষমতা নয়, সাপের বিষ যতই মারাত্মক হোক না কেন, রক্তের সঙ্গে না মিশলে, শুধু মুখে টেনে নিলে বিপদের কোনও আশঙ্কা নেই যদি না মুখে কোনো ক্ষত থাকে।
ওরা বিশ্বাস করত না। হাসত। বলত, জানি, জানি, ঠাউর! তুমি কবুল খাবে না। মা মনসা স্বয়ং এসে তোমাকে মন্ত্র দে গেছে!
পাঁচকড়ি ঘোষালের সন্তানটির জীবন রক্ষা পাওয়ায় মনটা খুশি। ঘোষাল মশাই সম্পন্ন গৃহস্থ। পঞ্চাশ বিঘে আউসের জমি আছে, তিন জোড়া হেলে-বলদ। পাঁচটি রজতখণ্ড ওঁর চরণমূলে নামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, খোকার জীবনের দামের তুলনায় এ কিছুই নয়, কিন্তু আপনার আরোগ্য নিকেতনে একটি ঘর তুলে দেবার মতো আর্থিক সঙ্গতি আমার নেই কোবরেজ-মশাই! এই কয়টি মুদ্রা প্রত্যাখ্যান করলে খুবই মনঃকষ্ট হবে আমার।
রূপেন্দ্র ইঙ্গিতটা বুঝতে পারেন। বলেন, না ঘোষাল-মশাই। সে বাতিক আর নেই আমার। এখন যে যা দেয় আমি গ্রহণ করি।
পাঁচটি টাকা উঠিয়ে নেন। সত্যই প্রীত হলেন ঘোষাল। বলেন, আপনি বাঁচালেন আমাকে।
—বাতিকটা কীভাবে, কার নির্দেশ ত্যাগ করলাম জানেন?’ একমুঠি-বাবার কথায়।
ভিন গাঁয়ের মানুষ হলেও ঘোষাল-মশাই চিনতে পারেন। বলেন, কী রকম? যদি আপত্তি না থাকে তো শুনি।
—না, বাধা আর কিসের, শুনুন।
একমুঠি-বাবা সোঞাই গাঁয়ের এক পাগলা সাধক। তাঁর বয়সের কোন গাছ-পাথর নেই। পাগলামোরও। সন্ন্যাসী মানুষ। ভিক্ষাজীবী। তবে তাঁর ভিক্ষাপদ্ধতি বড় বিচিত্র। দৈনিক তিনি একজনের কাছে থেকে মাত্র একমুঠি ভিক্ষা নিয়ে থাকেন। পাঁচবাড়ি প্রত্যাখ্যাত হলে ষষ্ঠ গৃহস্থের দ্বারে হানা দিতে সঙ্কোচ করেন না; কিন্তু প্রথম গৃহস্থ যদি মুষ্ঠিভিক্ষা দেয়, তাহলে সেদিন আর দ্বিতীয় বাড়িতে যান না। তাঁর বিশ্বাস দিনান্তে এক মুঠিতেই তাঁর অধিকার। প্রথম গৃহস্থ এক মুঠি ভিক্ষা দিলে মনে করেন—দিনটি সার্থক! কারণ সেদিন ভজন-পূজনের সময়টা বেশি পাওয়া যায়।
সেই একমুঠি-বাবা পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছেন। খবর পেয়ে রূপেন্দ্র গিয়েছিলেন চিকিৎসা করতে। ঔষধ আর মালিস দিয়ে নিদান হাঁকেন, সাতদিন তাঁকে শুয়ে থাকতে হবে। হাঁটা-চলা বারণ।
সন্ন্যাসী রুখে ওঠেন, বহ্ কৈসে হোগা? মুঝে ভিখ্ তো মাংনা চাহিয়ে!
রূপেন্দ্র বলেছিলেন, না! সাত দিনের সাতমুঠি ভিক্ষা আপনাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি না হয়।
তাতেও রাজী নন্–বহ্, কৈসে হোগা?
সাতদিনের ভিক্ষা তিনি একদিনে কেমন করে নেবেন? তা হয় না! রূপেন্দ্র রুখে ওঠেন, আপনি তো আচ্ছা একবগ্গা মানুষ।
হা-হা করে ঠারে ঠারে হেসেছিলেন সন্ন্যাসী। তুলসীদাসজী না কবীর কার যেন একটা দোঁহা আবৃত্তি করে শোনান। যার নির্গলিতার্থ : ‘জীব মাত্রেই দর্পণ! সর্বজীবে সে নিজের প্রতিবিম্বই দেখতে পায়। সাধু দেখে সবার মধ্যেই আছেন শিউজী, পাপী দেখে সবার মধ্যেই আছে নরক!
অর্থাৎ একবগ্গারই শুধু অধিকার অপরের মধ্যে ঐ একবগ্গামি দেখতে পাওয়া।
বুঝিয়ে বলেন, কেন তিনি ঐ বিচিত্র পদ্ধতিতে ভিক্ষা করেন। নিজের জন্য নয়, যে ভিক্ষা দিচ্ছে, তার স্বার্থে। লোকহিতার্থে। বারেবারে ভিন্ন ভিন্ন গৃহস্থকে হাত উবুড় করা শেখাতে। রূপেন্দ্র প্রশ্ন করেন, তাহলে শুধু একমুঠি কেন? একজনই যদি পাঁচমুঠি দিতে চায় তাহলে তা নেন না কেন?
—কেমন করে নেব? শিউজী আমার জন্য সিরেফ এক মুঠি বরাদ্দ করেছেন যে। তবে শুধু চাউলই নয়। বিয়াস না হলে তুই একমুঠি মোহর দিয়ে দেখ! আমি নিয়ে নেব। একটা ভাঙিয়ে একমুঠো চাউল খরিদ করব। বাকিটা আবার দান করে দেব। কোঁও-কি মুঝে তো কল ফিন নিকানা চাহিয়ে না?
জ্ঞানচক্ষু খুলে গিয়েছিল রূপেন্দ্রের। তাই তো! অর্থাভাবে তাঁর নানান পরিকল্পনা আটকে আছে। বাগদি পাড়ায় তিনটি পুষ্করিণীর মধ্যে একটিকে সংরক্ষিত করতে চান—ওরা রাজীও হয়েছে—কিন্তু সেটাকে বেড়া দিয়ে ঘিরতে হবে, ঢেঁকিকল আর বালতি বানাতে হবে। তিনি তো একই পদ্ধতিতে তাঁর সম্মানদক্ষিণা গ্রহণ করতে পারেন!ধনী গৃহস্থ যদি কৃতজ্ঞতার নিদর্শন- স্বরূপ কিছু বেশী দিতে চায়, তাহলে নেবেন না কেন? তাঁর সংসারের প্রয়োজনের জন্য ‘একমুঠি’ সরিয়ে রেখে বাকিটা সৎকাজে ব্যয় করতে পারবেন। কেও-কি কল্ তো ফিন নিকানা চাহিয়ে না?
তিজলহাটি থেকে সোঞাই ঘণ্টাখানেকের অশ্বপথ। গ্রামটা ছাড়িয়েই একটা বন। বন নয়, আগাছার জঙ্গল। পতিত জমি। সেটা পার হলেই পৌঁছাবেন দামোদরের তীরে। বাকি পথ দামোদরের বাঁধ বরাবর। অপরাহ্ণ বেলায় বার হয়েছিলেন। সন্ধ্যার পূর্বেই তাঁকে সোঞাই পৌঁছতে হবে। সূর্যাস্তের আগেই বেষ্টা বায়েনের চিতায় আগুন দেওয়া হবে। ঐ সময় উপস্থিত থাকা চাই।
শরৎকালের পল্লীদৃশ্য। বাঁ-দিকে দিগন্তবিস্তৃত আউসের ক্ষেত—এখন নাড়া-মুড়ো ভরা। ফসল সব উঠেছে মড়াইয়ে। তিৎপল্লার হলুদ রঙের ফুলে-ফুলে বনলক্ষ্মীর আঁচলে হাজারবুটির নকশা। স্বর্ণলতা কণ্ঠবেষ্টন করে ধরেছে বাবলা গাছটার। তালগাছের মাথায় বাবুইয়ের বাসা ঝুলছে। বনপথটা পাড়ি দিয়ে এবার এসে পৌঁছালেন দামোদরের কিনারে।
ঐ সেই বটগাছটা।
যাতায়াতের পথে এখানে এলে তিনি কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ান। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন ঐ বিশাল বটগাছটার দিকে। অতি বিশাল, বয়ঃবৃদ্ধ। দীর্ঘ বাহু বিস্তার করে যেন মিলনপ্রয়াসী মহাপাদপ সবাইকে কাছে ডাকছে। অযুত-নিযুত ঝুড়ি নেমেছে তা থেকে। কত বিচিত্র পাখি যে বাসা বেঁধেছে তার আর ইয়ত্তা নেই। এমনকি যাযাবর পাখিরাও ঐ গাছের আকাশছোঁয়া ডালে দু-দণ্ড আশ্রয় নিয়ে যায়—সিল্লি, বেলে হাঁস, মরাল, শামকূট, সারস।
রূপেন্দ্র ঐ জ্ঞানবৃদ্ধ মহাপাদপের মধ্যে যেন একটি রূপককে খুঁজে পান!
ও যেন এই সনাতন ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতীক।
ও কিছু চায় না, শুধু উন্মুখ, উদার আগ্রহে সে দুইহাতে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চায়। নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দেয়। রৌদ্রতাপদগ্ধকে ছায়া।
বাল্যকালে, মনে আছে—বাবামশায়ের হাত ধরে একবার তিজলহাটিতে যেতে হয়েছিল—কী-যেন সামাজিক নিমন্ত্রণরক্ষা করতে। তখন প্রথম ঐ মহাপাদপকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। সেই প্রথম সাক্ষাৎ। দিগন্তচুম্বী মাঠের মাঝখানে নিঃসঙ্গ একান্তচারী—যেন কোন মুনিঋষি ধ্যান করছেন! নদী কিনার থেকে বহুদূরে, নির্জনে। তার ডালে ডালে ঢিল বাঁধা। নিচে তেল-সিঁদুর মাখানো একটি লৌকিক দেবতা—ষষ্ঠী ঠাকরুণ। সন্তানহীনার দল মানত করে ওর ডালে ঢিল বেঁধে দিয়ে যায়। এই দশ বছরে ফাঁকা মাঠ ছেড়ে কী-জানি কেন সন্ন্যাসী পায়ে পায়ে নদীর দিকে সরে এসেছেন। এখন তিনি দামোদরের কিনার সই-সই। না—মহীরূহ এগিয়ে আসেনি। স্থির, স্থবির তন্নিষ্ঠায় আত্মসমাহিত ঋষি বাল্মীকির মতো ধ্যানমগ্ন। বরং ক্রৌঞ্চ-মিথুনকে হত্যা করতে দামোদর ব্যাধই নাচতে নাচতে ওঁর কাছে এগিয়ে আসছে। তার শুধু ভাঙার মন্ত্র। প্রতি ভাদ্রেই দশ-বিশ হাত পাড় ভেঙে সে এগিয়ে আসছে ঐ ধ্যানস্তিমিত সন্ন্যাসীর কাছে। লঘুচিত্ত, প্রগল্ভ, অন্ধ কুসংস্কারের ফেনিল আবর্তে সে খলখল করে হাসছে! সে যেন এই অবক্ষয়ী হিন্দুসমাজের প্রতীক!
হয়তো আগামী বর্ষাতেই শেষ হয়ে যাবে মহাপাদপের যুগযুগান্তরের সাধনা! মুখ থুবড়ে পড়বে ঐ ফেনিল আবর্তে!
আজ ওঁর হাতে সময় নেই। বৃক্ষদেবতার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন বাঁধ বরাবর। ফুল্লরা গায়ের কাছাকাছি আসতেই কানে গেল একটি দূরাগত আহ্বান : ঠা-উর-মশাই!
অশ্বের গতিবেগ রুদ্ধ করলেন। কে ডাকে?
নজর হল মাঝ-দরিয়ায় ভাসছে একটি জেলে ডিঙি। তিনচারজন পারানি-যাত্রী। তাদেরই একজন ডাকছে তাঁকে।
একটু পরে নৌকাটা তীরে এসে ভিড়ল। ছুটতে ছুটতে ওঁর কাছে এগিয়ে এল প্রহ্লাদ বায়েন। বলে, পেন্নাম ঠাউরমশাই। আপনারে পিছু ডাকলম। কী করি? এই হতচ্ছাড়াকে টুক বুঝায়ে দেন কেনে! ও মুয়ে আগুন না দিলি বেষ্টার যে গতি নাই!
নজর হল দুজন শক্ত করে ধরে রেখেছে কিশোর বিদ্রোহীর দুটি হাত। তার পরনে একটা খেটো কোরা ধুতি। খালি গা। গলায় সেই সুতোটা—নবা বায়েন।
—কী হয়েছে? নবা বাপের মুখাগ্নি করবে না বলছে?
—হুঁ কর্তা!• অরে টুক্ বুঝায়ে দেন কেনে!
কী বিড়ম্বনা। নবা বায়েন সারাদিন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বলেছে, সে বাপের মুখাগ্নি করবে না! কিছুতেই না।
রূপেন্দ্র ঘোড়া থেকে নেমে এলেন। লাগামটা ধরতে দিলেন প্রহ্লাদকে। তাঁর ইঙ্গিতে দুজন জোয়ান, যারা ওকে ধরে রেখেছিল তারা সরে দাঁড়ালো। রূপেন্দ্র দুই হাতে ধরলেন ওর বাহুমূল। সস্নেহে বললেন, কী পাগলামি শুরু করেছিস্ নবা! এ যে ছেলের কর্তব্য। তুই বাপের বড় ছেলে! তুই না করলে কে করবে বল? আয় বাবা, আর মাথা গরম করিস না!
নবা রুখে ওঠে, উয়ারা মায়েরে বিষ দিলেক কেনে?
—বিষ! কী বলছিস!’ কে দিয়েছে? তোর মাকে?
—শুধাও কেনে ও-দিগে!
পীতম বায়েন করজোড়ে বললে, না ঠাউর, বিষ লয়। টুক ধুতরা, না ভাঙ কী-যেন উয়ারা খাওয়াই দিলেক!
—ধুতরা, না ভাঙ! যমুনাকে? কেন?
ওরা যে ব্যাখ্যাটা সবিনয়ে দাখিল করে তাতে বজ্রাহত হয়ে গেলেন। এটাই যে প্ৰথা! সম্পূর্ণ সজ্ঞানে কি কেউ জ্বলন্ত চিতায় উঠতে পারে? সতী হতে পারে?
সতী? যমুনা সহমরণে যাচ্ছে! কেন? কে এ বিধান দিল! যমুনা রাজি হয়েছে? হতেই পারে না। যমুনা তো জানে! যে গোপন তথ্যটা তিনি নিতান্ত ঘটনাচক্রে জানতে পেরেছেন তা তো যমুনারও জানা! যমুনার ক্রোড়ে একটি দেড় বছরের শিশুকন্যা; এবং সে আবার মা হতে চলেছে! তার গর্ভে ভ্রুণের বয়স তিন মাস
এপাশে ফিরে দেখলেন। সোঞাইয়ের শ্মশান ঘাটটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যদিও বহুদূরে, তবু ঘাটটা স্পষ্ট দেখা যায়। লোকে লোকারণ্য! ভিড়টা আগেই নজরে পড়েছিল। মনে মনে খুশি হয়েছিলেন—সারা গ্রাম এসেছে শ্মশানে। বেষ্টা অন্ত্যজ বলে উপেক্ষা করেনি। এখন বুঝতে পারেননা, ওরা বায়েনকে শেষ· সম্মান জানাতে আসেনি, এসেছে সতীদাহ দেখতে। অনেকদিন পরে গাঁয়ে সতী হচ্ছে।
স্পষ্ট শুনতে পেলেন অন্তরীক্ষ থেকে বেষ্টা বায়েনের আর্তি—শালারা মজা লুটতে এয়েছে ঠাউর। পোয়াতি মাগীটা দাউ দাউ করি পুড়বে তাই দ্যাখতি আয়েছে অরা। বুয়েছেন না?
শিউরে উঠলেন রূপেন্দ্ৰ।[১]
[১. অনেকের ধারণা আছে, সেকালে সতী হতেন শুধু বর্ণহিন্দুশ্রেণীর সদ্যোবিধবারা—ব্রাহ্মণ, কায়স্থ পরিবারের। ধারণাটা ভ্রান্ত। অন্ত্যজ পরিবারের মধ্যেও অনেকে সতী হতেন। গবেষক বিনয়ভূষণ রায় (বাংলায় সতীদাহ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্যায়ন, পৃ: 120) সঙ্কলিত একটি তথ্যে দেখতে পাচ্ছি, লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরী রেকর্ডস্ অনুসারে শুধুমাত্র বর্ধমান জেলাতেই 657টি সতীর ভিতর “455জন ছিলেন বর্ণহিন্দুশ্রেণীর—বাকি 202 জন বিভিন্ন শ্রেণীভুক্ত—জলচল ও জল-অচল : সদগোপ, বাগদি, কৈবর্ত, তাঁতি, তেলী, গোয়ালা, আগুরি, প্রভৃতি। এ পরিসংখ্যান অবশ্য কিছু পরের জমানার। অর্থাৎ আমাদের কাহিনীর নায়িকা—যার কথা আমরা এতক্ষণে প্রায় ভুলতে বসেছি, সেই রূপমঞ্জরী বা হটী বিদ্যালঙ্কারের তিরোধানের পরের দশকের।]
—যমুনা কোথায়?—জানতে চাইলেন রূপেন্দ্র।
—তারে অরা শ্মশানঘাটে নে-গেছে।
রূপেন্দ্রের মুষ্টি এবার দৃঢ়তর হল। সবলে ওর বাহুমূল ধরে চললেন, নবা! এ আমি হতে দেব না, কিছুতেই না। কিন্তু একা আমি পারব না রে। বুঝে দেখ—সারা গাঁ এককাট্টা, আর আমি একা! তুইও আয়। দুজনে মিলে….
চোখ দুটো জ্বলে উঠল কিশোরটির। বললে, তয় তুমার ঘোড়া ছুটাই দাও ঠাউর। মুই দৌড়ে তোমার নাগাল ধরব অনে!
বিদ্যুৎবেগে রূপেন্দ্র ছুটিয়ে দিলেন তাঁর অশ্বটিকে।
ঝড়ের বেগে ছুটে চলল নবা বায়েন। পিছন পিছন ওরাও।
সতী-মন্দিরের ভাস্কর্য, ই. বি. হ্যাভেল সংগৃহীত
ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্তকে বলেছিল, ‘মড়ার কি জাত থাকে রে?
বেচারি ইন্দ্রনাথ : দুর্জয় সাহস আর বুকভরা ভালবাসা নিয়ে সে এই বাঙলা দেশে জন্মেছিল শ’দেড়েক বছর পরে। সে আমলে এলে দেখত : মড়ার জাত থাকবে না কী অসৈরন অশাস্ত্রীয় কতা গো!
শ্মশানঘাটের তিন-দিকে তিনটি চিহ্নিত স্থান। এ-প্রান্তে বামুনদের চিতা—তবে কুলীন-শ্রোত্রিয়-কাপ ছাই হয় একই চিতায়। ও-পাশে কায়স্থ, বৈদ্য, সদগোপ জাতীয় জলচল জাতের। তৃতীয় একটি ছোট্ট এলাকা জল-অচলদের।
ছোট্ট—কারণ চিতায় ওঠার সৌভাগ্য সচরাচর অন্ত্যজ পরিবারভুক্তদের হয় না। তাদের গতি দামোদর। তবে তাদের মধ্যেও ক্বচিৎ কখনো কেউ চিতায় চড়ে—যৌবনবতী চণ্ডাল- কন্যাকেও কখনো কখনো পুড়তে দেখা গেছে, বাবুদের খরচে। নেহাৎ কোনও সদ্য মৃতের সহধর্মিণী সহমরণে যেতে স্বীকৃত হলে তখন তাকে দাহ করার আয়োজনও হয়। এমনকি সে-ক্ষেত্রে সেই অচ্ছুৎ সতীকে সতীমন্দিরে প্রবেশ পর্যন্ত করতে দেওয়া হয়। জল-অচল জাত বলে সমাজ আপত্তি করে না। বুঝে দেখ তোমরা—হিন্দু সমাজ কত উদার! সতীর মাহাত্ম্য যদি লাভ করতে স্বীকৃত হও তাহলে তোমার জন্মদোষ পর্যন্ত ক্ষমা করা হবে।
সতীমন্দির একটি পাকা কোঠা। শ্মশানপ্রান্তে। সতীমায়ের একটা মূর্তি আছে, মূর্তি ঠিক নয়, তেল-সিঁদুরে রাঙা একটি প্রস্তরখণ্ড। চিতায় ওঠার আগে সতী-মা তাতে তেল-সিদুরের প্রলেপ দিয়ে যান। এ কক্ষটি সতীর শেষ বিশ্রামস্থল। স্নানান্তে এখানেই তাকে একবস্ত্রা করা হয়। চিতায় উঠতে হবে লালপাড় কোরা শাড়ি পরে। দ্বিতীয় বস্ত্রখণ্ড থাকবে না গায়ে। হাতে লোহার খাড়ু, আর শাঁখা। স্বর্ণালঙ্কারগুলি খুলে রাখা হয়। কপালে কনে-চন্দন, ব্ৰহ্মতালুটা সিঁদুরে মাখামাখি। গলায় গোড়ে-মালা। পায়ে আলতা। পায়ের পাতার কিনারা ঘেঁষে, নয়, পায়ের পাতা দুটিও বারে বারে অলক্তকরাগরঞ্জিত। পাঁচ বাড়ির এয়ো আলতাছাপ সংগ্রহ করে নিয়ে যায় যে। লৌকিক কানুনে এ গৃহাভ্যন্তরে কোন পুরুষের প্রবেশাধিকার নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সতী-মন্দিরে যখন সদ্যোবিধবাকে নিয়ে আসা হয় তখন তিনি সজ্ঞানে থাকেন না। থাকেন একটা ঘোরের মধ্যে। তার পূর্বেই তাকে নানান জাতের ‘মন্ত্রঃপূত পবিত্র পানীয়ে তৈরী করে নেওয়া হয়।
ওঁরা যখন অকুস্থলে পৌঁছালেন তখন শ্মশান ঘাটে তিলধারণের ঠাঁই নেই। বেষ্টা বায়েনের স্নান সারা। কোরা কাপড় পরে চিতায় শুয়ে আছে সে। যমুনারও স্নানপর্ব সমাপ্ত। এমনকি তাকে লালপাড় নতুন কাপড়খানা পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আচ্ছন্নের মতো সে ভূশয্যালীন।
চিতা এতক্ষণ জ্বলে ওঠার কথা।
শিরোমণি মশাই পঞ্জিকা ঘেঁটে বলে রেখেছেন, বেলা চার ঘটিকা বত্রিশ মিনিট গতে শুভ লগ্ন—সূর্যাস্ত-তক্। তার পরেই ত্রিপাদ-দোষ বর্তাবে। শুভকার্য এখনো সম্পন্ন হয়নি, যেহেতু মৃতের জ্যেষ্ঠপুত্রটি ছিল না-পাত্তা। নবা বায়েনকে দূর থেকে দেখতে পেয়েই একটা সোরগোল উঠল: ঐ তো! ঐ তো…..
দু-একজন ছুটে এসে পাকড়াও করল তাকে।
রূপেন্দ্র ঘোড়া থেকে নেমে পড়েন। জীবন দত্ত এগিয়ে এসে ঘোড়ার লাগামটা ধরল। তার অপর হাতে কবিরাজ মশায়ের সেই ঔষধপত্রের পুলিন্দা। রূপেন্দ্র প্রশ্ন করেন, যমুনা কোথায়?
—সতীমন্দিরে। জ্ঞান নেই তার।
—জ্ঞান নেই? কী হয়েছে তার?
—ওরা কী যেন খাইয়ে দিয়েছে। মুখ দিয়ে গাঁজলা বার হচ্ছে।
—নাড়ি দেখেছিলে?
—ওরা আমাকে ঢুকতেই দেয়নি।
রূপেন্দ্র ওর হাত থেকে ঔষধের পুলিন্দাটা নিলেন। গট্ করে এগিয়ে গেলেন সতীমন্দিরের দিকে। তিন চারটি সোপান পেরিয়ে মন্দিরের পোতায় পৌঁছাতে সবাই দেখতে পেল তাঁকে। মেয়েরা সসঙ্কোচে সরে দাঁড়ায়।
ভিড়ের ভিতর থেকে শিরোমণি হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন, ওটা কী হচ্ছে?
রূপেন্দ্র ঘুরে দাড়ালেন, আমাকে বলছেন?
—আবার কাকে? তোমার এতটা বয়স হল তবু জান না—সতী-মন্দিরে কোন পুরুষের প্রবেশাধিকার নেই! ওটা অন্দরমহল?
রূপেন্দ্রের চোখ দুটি জ্বলে উঠল। কিন্তু কণ্ঠস্বরে সে উত্তাপ সঞ্চারিত হল না। প্রশ্ন করলেন, কোন শাস্ত্রে লেখা আছে বলুন তো?
শিরোমণি অপমানিত বোধ করলেন। বলেন, ঔদ্ধত্যের একটা সীমা থাকা উচিত রূপেন্দ্রনাথ। এটা কোন শাস্ত্রে লেখা নেই—এ হচ্ছে লৌকিক আচার!
—তাহলে শাস্ত্রীয় বিধানটা আমার কাছে শুনে নিন, শিরোমণি কাকা! শাস্ত্রে এ বিষয়ে পরিষ্কার নির্দেশ আছে!
—কোন শাস্ত্র?
—অথর্ববেদ। যার একটি বেদাঙ্গ হচ্ছে আয়ুর্বেদশাস্ত্র। তাতে স্পষ্ট নির্দেশ আছে : কোন আর্ত রোগিণী যদি অন্দরমহলে অসুস্থা হয়ে পড়ে তাহলে একমাত্র ভেষগাচার্যের অধিকার আছে দ্বিতীয়া মহিলার উপস্থিতিতে সেখানে প্রবেশ করার। সতী-মায়ের মন্দিরে আমার অনেক মা এখন আছেন!
শিরোমণি একটি জুৎসই জবাব দেবার আগেই তিনি প্রবেশ করলেন সতীমন্দিরে।
যমুনা চিৎ হয়ে পড়ে আছে ভূশয্যায়। জ্ঞানহীনা। তার মুখ দিয়ে গাঁজলা বার হচ্ছে। একটি প্রৌঢ়া মহিলা—চিনতে পারলেন না উনি, প্রহ্লাদের বউ—মুর্ছিতার মাথাটি কোলে নিয়ে বসে আছেন। যমুনা একবস্ত্রা।
সে যে গর্ভিণী তা বোঝা যায় না। মাতৃত্ব লক্ষণ তার মধ্যে প্রকট হয়ে ওঠেনি এখনো; কিন্তু ঊর্ধ্বাঙ্গে তা পরিস্ফুট। তার বুকের কাপড় সরানো। একটি শিশু তার উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। অচৈতন্য মাতার অমৃতভাণ্ড থেকে অমৃতরস আহরণ করছে। ভেষগাচার্যকে দেখে প্রৌঢ়া তার বুকের উপর আঁচলটা টেনে দিলেন।
রূপেন্দ্র ওর মণিবন্ধে নাড়ির গতি লক্ষ্য করলেন। একটি ঔষধ নিয়ে প্রৌঢ়াকেই বললেন অধরোষ্ঠ উন্মুক্ত করে দিতে। পাঁচফোঁটা ওষুধ দিলেন তার মুখ-বিবরে। তারপর বার হয়ে এলেন।
ভিড়ের পিছন থেকে তারাপ্রসন্ন বলেন, কেমন আছে?
মন্দির-পোতায় দাঁড়িয়ে রূপেন্দ্র বললেন, না, মারাত্মক কিছু না। এখনি জ্ঞান হবে।
দুর্গাচরণ বলেন, হলেই ভাল। অজ্ঞান অবস্থায় সতীকে চিতায় তুলতে নেই। শাস্ত্রে মানা।
রূপেন্দ্র জানতে চাইলেন না : কোন শাস্ত্ৰ।
শিরোমণি বলেন, কিন্তু সময় তো খুব বেশী নাই। সূর্যাস্তের পূর্বে চিতা প্রজ্জ্বলিত না হলে ত্রিপাদ দোষ বর্তাবে।
রূপেন্দ্র স্পষ্টাক্ষরে বলেন, তাহলে আর দেরি করবেন না শিরোমণি কাকা। এখনই দাহকাৰ্য শুরু করে দিন।
—কিন্তু যমুনা….?
—না! যমুনা সহমরণে যাবে না।
প্রথমটা সকলে একটু হকচকিয়ে যায়। রূপেন্দ্র তখনো মন্দিরপোতার উপরে দাঁড়িয়ে। সবাই তাঁকে দেখতে পাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে তাঁর কথা।
নন্দ চাটুজ্জে বলেন, বটে! তা বিধানটি কোন পণ্ডিত দিচ্ছেন? তুমি? তোমার আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে লেখা আছে বুঝি?
রূপেন্দ্র তাঁর দিকে ফিরে বললেন, না খুড়ো। আয়ুর্বেদশাস্ত্র নয়। নারদীয় পুরাণের দ্বিতীয়খণ্ডে মহামুনি নারদ বলেছেন, স্বামীর মৃত্যু সময়ে জননীর ক্রোড়ে দুগ্ধপোষ্য শিশু থাকলে অথবা সে গর্ভবতী হয়ে থাকলে কোন সদ্য-বিগতভর্তা স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যেতে পারে না।
শিরোমণি বলেন, এমন আজব কথা তো কখনো শুনিনি।
রূপেন্দ্র বলেন, আমার সংকলনেই নারদীয় পুরাণের পুঁথি আছে। আমি এখনি এনে দেখাচ্ছি।
বাচস্পতি বলেন, দেখাতে হবে না। আমরা জানি। ঋষি বৃহস্পতি নারদোক্ত ঐ সূত্রটির ব্যাখ্যা করে বলেছেন—যদি অন্য কোনও রমণী ঐ দুগ্ধপোষ্য শিশুর দায়িত্ব গ্রহণ করে সে-ক্ষেত্রে সেই শিশুর জননী সহমরণে যেতে পারে। তুমি যদি চাও, তাহলে সেই নির্দেশটি আমিও দেখাতে পারি। পুঁথিটি আমার সংকলনে আছে। তবে দেবনাগরী হরফে। পড়তে পারবে তো, বাবা?
শিরোমণি এই মুখের মতো জবাবটি শুনে নিজের নাসারন্ধ্রে একটিপ নস্য চালিয়ে দিলেন।
রূপেন্দ্র এ ব্যঙ্গোক্তিতে ভ্রূক্ষেপও করলেন না। বললেন, আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন বাচস্পতি-কাকা। আমি যমুনার দুগ্ধপোষ্য শিশুর প্রসঙ্গ আদৌ তুলিনি।
—তা হলে?
—হেতুটা এই : যমুনা গর্ভবতী! তার জঠরে অজাত সন্তান। বৃহস্পতি ঋষিও কিন্তু গর্ভবতী রমণীকে সহমরণে যেতে নিষেধ করেছেন। তাই না? আপনার সংকলনেই তো পুঁথিটা আছে বললেন।
এ এক নতুন ফ্যাকড়া! নন্দ বলেন, একথা কে বলেছে?
—ঐ যে বললাম—নারদীয় পুরাণ এবং বৃহস্পতির টিকা-টিপ্পনি!
—আহাহা। তা বলছি না। যমুনা যে পোয়াতি সে কথা কে বলছে?
—আমি শ্রীরূপেন্দ্রনাথ দেবশর্মা। এ-কথা ঘটনাচক্রে আমি জানি, যেহেতু বেষ্টা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল তার স্ত্রীকে দেখাতে। জানতো বেষ্টা, আর জানে যমুনা নিজে।
নন্দ এবার রুখে ওঠেন, তাহলে কিছুই প্রমাণ হয় না। তুমি ওকে বাঁচাতে চাইছ—যা মন চায় তাই বলছ। যমুনা তো সজ্ঞানে ওকথা বলবেই—সত্য হোক, মিথ্যা হোক!
রূপেন্দ্রের চোখ দুটি জ্বলে উঠল। বলেন, আপনি আমাকে সর্বসমক্ষে মিথ্যাবাদী বললেন; কিন্তু বলুন তো নন্দ খুড়ো—এতে আপনার কী স্বার্থ? একটা নৃশংস দৃশ্য দেখার জন্য আপনারই বা এত আগ্রহ কিসের?
নন্দ গর্জে উঠেন, মুখ সামলে কথা বল রুপেন!
দুর্গা গাঙ্গুলী এগিয়ে আসেন এবার। বলেন, আহাহা! তুমি মেজাজ খারাপ করছ কেন চাটুজ্জেভায়া? রূপেন্দ্র তো কালকের ছেলে! ও কী জানে এই সনাতন ধর্মের মহিমা? আর ওর একার কতায় তো কিছু হবে না! বেষ্টা বায়েনের রাড় সতী হতে চায়, সমাজের কাছে অনুমতি চেয়েছে। সমাজ অনুমতি দিয়েছে, বিধান দিয়েছে। আমার মতো ক্ষুদ্র মনিষ্যির কতা না হয় ছেড়েই দাও, তুমি শিরোমণি-মশাই, বাচস্পতি-মশাই, তর্কালঙ্কার-ভায়া, স্বয়ং ভাদুড়ীমশাই… রূপেন্দ্র চমকে ওঠেন, ভাদুড়ীমশাই! জেঠামশাই অনুমতি দিয়েছেন! অসম্ভব! তিনি তো চিরকাল সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে। তাঁর পরিবারে…..
—সে তাঁর নিজের পরিবারে। যমুনার বেলা তিনি অনুমতি দিয়েছেন!
ভিড়ের পিছন থেকে তারাপ্রসন্ন বলে ওঠেন, না! ভুল বলছেন গাঙ্গুলীকাকা, বাবামশায়ের এতে ঘোরতর আপত্তি। তিনি বেষ্টার শ্মশানবন্ধু হতে স্বয়ং আসছিলেন, কিন্তু তার স্ত্রী সহমরণে যাচ্ছে শুনে ফিরে গেছেন। তাঁর সম্মতি নিশ্চয় নেই।
দুর্গাচরণ কাষ্ঠ হাসি হেসে বলেন, ও-কথা বললে শুনব কেন বাবা তারাপ্রসন্ন? যমুনা এখন যে লালপাড় কোরা শাড়িখানা পরে আছে, সেটা সে পেল কোথায়? নবাকেই শুধিয়ে দেখ না একবার?
নবা বিহ্বলের মতো এদিকে ওদিকে তাকায়। ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারে না।
দুর্গা হেসে বলেন, আমি যে তখন স্বয়ং উপস্থিত। রূপেন্দ্র এখন শাস্তর আওড়াচ্ছে, কিন্তু সেও স্বচক্ষে দেখেছে! ভাদুড়ীমশাই ঐ নবার হাতে লালপাড় শাড়িখানা দিয়ে বললেন, তোর মাকে পরতে দিস্। ঐ তো নবা দাঁড়িয়ে আছে। ওকেই জিজ্ঞেস কর তোমরা।
নন্দ উত্তেজনার বশে স্পর্শদোষের কথা বিস্মৃত হয়ে গেলেন। খপ্ করে চেপে ধরলেন কিশোরটির বাহুমূল। গর্জে ওঠেন, কী রে হতভাগা? বামুনের ঠেঞে মিছে কথা বললে জিব খসে যাবে! বল হারামজাদা—ঐ লালপাড় শাড়িখানা তোরে কে দিয়েল?
নবা ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলে। এই স্বীকৃতির মধ্যে কী আছে তা না বুঝেই! তারাপ্রসন্ন ততক্ষণে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসেছেন। রোরুদ্যমান কিশোরটিকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলেন, ওকে দিয়ে কবুল করাতে হবে না নন্দকাকা। তখন আমিও সেখানে ছিলাম। শুনুন—বায়েন-বিদায়ের পুঁটিলিটা অনেক আগেই বেঁধে চালচিত্রের পিছনে রাখা হয়েছিল। আপনারা সবাই জানেন—তাই থাকে। বেষ্টা তখনো বেঁচে। না হলে সদ্যোবিধবাকে বাবামশাই অহেতুক কেন ঐ লালপাড় শাড়িখানা দেবেন বলুন?
—অহেতুক নয়, তারা। তার একটিমাত্র হেতু! তোমার বাবা আমাদের মতো অর্বাচীন নন। তিনি পাকামাথার মানুষ। সদ্যোবিধবাকে লালপাড় শাড়ি দান করার অর্থ একটিই—তিনি তির্যক-ইঙ্গিতে জানিয়ে দিলেন তাঁর সম্মতি! সহমরণে যাবার নির্দেশ! এ কথা যদি মেনে না-নাও তারাপ্রসন্ন, তাহলে তার পরিণাম যে সাঙ্ঘাতিক!
রূপেন্দ্র বুঝতে পারেন—দুর্গাচরণ কোন দিকে চলেছেন! নিরুদ্ধ আক্রোশে ফুঁসতে থাকেন তিনি।
নন্দ ঐ শেষ শব্দটার প্রতিধ্বনি করলেন মাত্র: সাঙ্ঘাতিক?
—নয়? এ যে যারপরনাই সামাজিক অপরাধ! বিধবাকে লালপেড়ে শাড়ি দান করা! বাচস্পতি-মশাইকে জিজ্ঞেস কর, তর্কালঙ্কার-ভায়া জানে! প্রতিটি সমাজপতির পদস্পর্শ করে অপরাধীকে ক্ষমা চাইতে হয়! না, না—সে কিছুতেই হতে পারে না। ভাদুড়ী মশাই বয়োজ্যেষ্ঠ! মানী ‘লোক! তাছাড়া অপরাধ তো তিনি কিছু করেননি যে প্রাচিত্তির করতে হবে! তারা ছেলেমানুষ—ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারেনি, এই যা?
নন্দ উচ্ছ্বসিত! এতো দারুণ একটা ফন্দি বার করেছে দুর্গাদা! দাবা ধরে ঘোড়ার কিস্তি! বাহারে বাহা! তিনি তারাপ্রসন্নের দিকে ফিরে বলেন, তুমি কী বলছ তারা? ভাদুড়ীমশাই বেষ্টার রাঁড়কে সহমরণে যাবার অনুমতি দেননি? সেজন্যই ফিরে গেছেন? তাই বলছ এখনো?
দুর্গা গাঙ্গুলী ধুরন্ধর—জানেন, লেবু কতটুকু কচলাতে হয়। দুর্গা ধমক দেন নন্দকে, তুমি থামতো নন্দভায়া! তিনি কীজন্যে ফিরে গেছেন, তা কি বোঝ না? তাঁর মনটা নরম! এই পুণ্যকর্মটি দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখার মতো মনের জোর নেই। তা তো আমারও থাকে না। বুকের মধ্যে হু-হু করে জ্বলতে থাকে! কিন্তু কী করব? সইতে হয়! সামাজিক দায়!
শিরোমণি বলেন, মোটমাট কী সিদ্ধান্ত হল তাইলে?
দুর্গা নিদেন হাঁকেন, ঐ তো বল্লাম! বেষ্টার রাঢ় সহমরণে যাবার অনুমতি চেয়েছে। সমাজ তা অনুমোদন করেছে। মায় স্বয়ং ভূস্বামী সমাজের তরফ থেকে তাকে সহমরণের বস্ত্রখণ্ডটি দান করেছেন! এখন শুভস্য শীঘ্রম! মেয়েটি গর্ভবতী বলে রুপেন একটা আষাঢ়ে আপত্তি তুলেছিল—পঞ্চজন সেটাও বিচার করে দেখেছেন। তার কোন প্রমাণ নেই, সাক্ষী নেই:
কোথাও কিছু নেই হঠাৎ মন্দির-পোতা থেকে শোনা গেল প্রতিবাদ : না! আছে!
সকলেই সেদিকে ফেরে। কণ্ঠস্বর মহিলার। কাংসবিনিন্দিত। সবাই দেখতে পায় সতী-মন্দিরের পোতায় দাঁড়িয়ে আছেন জগু-ঠাকরুণ। মাথায় আধ-ঘোমটা। সকলে সেদিকে ফিরলে জগুঠাক্রণ বলে ওঠেন, এর কথাটুকু শুনে আপনারা শেষ রায় দিন!
শিরোমণি বলেন ‘এর কথা’ মানে?
—এই যে আমাদের রেসো!
দেখা গেল, জগু-ঠাকুরুণের পাঁজর ঘেঁষে যুক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে এক অবগুণ্ঠনবতী। ঘোমটা এতবড় যে, মুখখানা দেখা যাচ্ছে না।
নন্দ বলেন, রেসো! রেসো কে?
দুর্গাচরণ কিন্তু চিনতে পেরেছেন। ঐ মেয়েটি রেসো-দাই—রাসমণি। সোঞাই গাঁয়ের একমাত্র ধাত্রী। দিনসাতেক আগেও সে মৃন্ময়ীকে দেখে এসেছে। অতি বিচক্ষণ ধাত্রী। ধন্বন্তরি পারেনি, কিন্তু সে মাগী মৃন্ময়ীর পেটে কান পেতে শুনে ওঁকে বলে দিয়েছে—ছেলেই আছে মৃন্ময়ীর গর্ভে, মেয়ে নয়। মৃন্ময়ী সহমরণ দেখতে আসেনি। পোয়াতি মেয়েদের দেখতে নেই। শাস্তরে মানা।
দুর্গা তাড়াতাড়ি বলেন, হচ্ছে সমাজের বিচার, তার ভিৎরি রাসু-দাই আবার কী বলবে?
জগু রাসমণিকে একটা খোঁচা মেরে বলেন, বল্ না মুখপুড়ি! আ-হাহা! তোর সরম দেখে বাঁচি না!
রাসমণি আরও কুঁকড়ে যায়। লজ্জায় নয়, ভয়ে। সোনার নাকছাবি খোয়াবার ভয়ে। গাঙ্গুলীমশাই যে তাকে খুশি হয়ে বলেছেন—সত্যিই যদি নিরাপদে ওর পেট থেকে ছেলে বার করতে পারিস….
রাসমণি বুঝে নিয়েছে, গোপন কথাটা বেমক্কা জগু-ঠাকুরুণকে বলে ফেলা বোকামি হয়ে গেছে তার। গাঙ্গুলীমশাই চটে যাবেন! গেল—নাকছাবিটে
কিন্তু জগুঠাকুরুণ নাছোড়বান্দা। হাজার হোক একবগ্গার পিসি তো তিনি! তাই উচ্চকণ্ঠে বাঙ্ময় করে তোলেন রাসুর অনুক্ত এজাহারটা : রেসো বলছে, কতাটা সেও জানে—সেও অবাগীটারে দেকেছে! রুপো ভুল বলেনি কিছু! হ্যাঁ, যমুনা তিনমাসের পোয়াতি!
শিরোমণির মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে ওঠে। শুভকার্যে ক্রমাগত বাধা সৃষ্টি হলে কারই বা মাথার ঠিক থাকে! খিঁচিয়ে ওঠেন, ন্যাও ঠেলা! চোরের সাক্ষী এবার গাঁটকাটা!
একটা থমথমে ভাব! সুযোগ বুঝে যুক্তকরে এগিয়ে আসে পেল্লাদ বায়েন। সবিনয়ে বলে, পঞ্চজনা উপস্থিত আছেন। তাইলে এই অধমের কতাটুকুও নিবেদন করতি দেন আপনকার ছিচরণে—
গর্জে ওঠেন নন্দ। প্রহ্লাদ তাঁর খাতক। বলেন, তুই চুপ-যা, হারামজাদা! এবার কি বায়েন-পোর কাছে শাস্তর ব্যাখ্যা শুনতে হবে নাকি?
প্রহ্লাদ সভয়ে একপা পিছিয়ে যায়। তার হঠাৎ মনে পড়ে যায়, শ্রাবণ-কিস্তির সুদটা এখনো দেওয়া হয়নি। কিন্তু পিছন থেকেও হুড়ো খেতে হল তাকে। কে যেন বজ্রমুষ্টিতে ওর গর্দানা পাকড়ে সামনের দিকে ঠেলে দেয়। পিছন ফিরে দেখে, ভীমা। প্রহ্লাদ হকচকিয়ে যায়—পিছুলি ভেড়োর ভেড়ো, এগুলি নিৰ্ব্বংশর বেটা!
ভীমা ওকে ঠেলে সরিয়ে নিজেই এগিয়ে এল। বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠাউর। শাস্তর ব্যাক্খা টুক্ ঐ বায়েন-পোর কাছ থিকেই শুনতে হবে।
ভীমা বাগদিকে ধমকে থামানো যায় না—তা হোক না কেন সে জল-অচল। নন্দ ঢোক গিলে বলেন, মানে?
ভীমা এবার শাঙ্করভাষ্য দাখিল করে : শোনেন! পেল্লাদ হতিছে বায়েনপাড়ার মাতব্বর! যারে পোড়ায়ে মারতি চান সেই আবাগী বামুন-কায়েত লয়, বায়েন! হক্ কতা কি না? তা, কুন বায়েন-মাগী সতী হবে-কি-হবেনি .সি-কতাটো বলার হক আছে পেল্লাদের। বল রে, পেল্লাদ! তুর যা প্রাণ চায় তুই পঞ্চজনার ছিচরণে নিভয়ে নিবেদন কর! মুই হেথা খাড়ায়ে আছি।
ভয়ে-কি-নির্ভয়ে বোঝা গেল না, কিন্তু প্রহ্লাদ যেন মরিয়া হয়ে এবার এক দামোদর কথা হড়বড়িয়ে বলে গেল : ব্যাবারডা হতিছে অ্যাই—মোরা তো জানতম না যে, যীর প্যাটে বাচ্চা আছে? যী রাজি হয়েল, হক কতা, ল্যায্য কতা! কিন্তুক বাচ্ছাড়া? সে বেটা তো বেষ্টার রাঁড় লয়! তাইলে? সে ক্যান পুড়ি মরবে! কতাটো বুঝায়ে দ্যান, আজ্ঞে। শাস্তরে কী বলিচে?
নীরন্ধ্র অন্ধকারে এবার আশার আলোক দেখতে পেলেন রূপেন্দ্র! বলে ওঠেন, তুমি ঠিক কথা বলেছ প্রহ্লাদ! বায়েন-পাড়ার মোড়লের মতো কথাটা বলেছ! শান্তর যমুনাকে এ ক্ষেত্রে সতী হতে মানা করছে!
ভীমা বলে ওঠে, ব্যাস্ ব্যাস্! একবগ্গা ঠাউর বিধান দি-দিল! আর কুন কতা লয়! আয় রে লবা, বাপের মুখে নুড়োডা জ্বালি দে যা! আপনেও আসেন শিরোমণি ঠাউর। কীসব অং বং মন্তর আছে পড়ায়ে দে যান! যমুনা সতী হবেক নাই!
যেন মুর্শিদাবাদী নবাবী ফতোয়া নয়, খাশ দিল্লীর বাদশাহী ফৰ্মান!
শিরোমণি ইতস্তত করেন।
দুর্গা একবার শেষ চেষ্টা করেন : কাজটা ভাল করলি না ভীমা! চিতাভ্রষ্ট হলে তার কী দুর্গতি হয় জানিস?
ঈশেন ভুল বুঝল। উনি যে পারলৌকিক দুর্গতির কথা বলতে চাইছেন তা ওর মোটা মাথায় ঢোকেনি। পরলোক-ফরলোক ও বেটা বোঝে না ছোটলোক তো?—চেনে শুধু ইহলোকের লেনদেনটুকু। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে, কারে দুগ্যতির ভয় দেখাইছেন ঠাউর? খুড়োরে? বলি, করবেনডা কী! ভীটে-মাটির থর্নে উচ্ছিদ? করেন, তাই করেন! খুড়ো-ভাইপো ফিরে-ফিত্তি ডাকাত হই যাব নে? ভুখা মরব না! দুজ্জনে বলে, আপনের সিন্দুকে নাকি রূপার ট্যাহা নাই—বেবাক মোহর! তা চান তো আপনের ভিটে থিকেই ‘লতুন-খেল’-এর বউনিটা শুরু করব অনে!….আয় রে লবা!
দুর্গাচরণের হাত-পা পেটের ভিতর সেঁদিয়ে যাবার উপক্রম! এদিকে বর্গীর হাঙ্গামা, ওদিকে নবাবের নতুন ‘আবওয়াব’, তদুপরি মহাষ্টমীতে নাকি মোহান্ত-মহারাজের ফৌজ আসবে! তার উপর এই সর্ষের মধ্যে যদি ভূতের কেত্তন শুরু হয়ে যায়, তাহলে তাঁর মতো সম্পন্ন গৃহস্থ দাড়ায় কোথায়?
ভিড়টা ততক্ষণে পাতলা হয়ে যেতে শুরু করেছে। সবাই বুঝে নিয়েছে ভাঙ-ধুতুরা খাইয়েও মেয়েটিকে কব্জা করা গেল না।
রূপেন্দ্র খুশিয়াল! মহাষষ্ঠীর দিনটি সার্থক। ধর্মরক্ষা করা গেছে। প্রহ্লাদ, ভীমা, ঈশেন সবাই যদি ওঁকে সাহায্য না করত, রুখে না দাঁড়াতো….
হঠাৎ যেন স্পষ্ট শুনতে পেলেন অলক্ষ্যলোক থেকে একটা প্রতিবাদ : ইটা. কি বুলছেন ঠাউর! গোটা গাঁয়ের মহড়া নিল তো ঐ পুঁচকেটা! বোয়েচেন না?
বেষ্টা বায়েনের কণ্ঠস্বর! রূপেন্দ্র, মনে মনে প্রতিপ্রশ্ন করেন, কার কথা বলছ বেষ্টা?
—যীর প্যাটে আমার বাচ্চাডা! বেটা না জন্মেই শিঙে ফুঁকি দিল! বোয়েচেন না?
মহাসপ্তমী। পরদিন। রূপেন্দ্র একা বসে আছেন তাঁর দাওয়ায়। ভোরবেলাতেই পিসি আর কাতু চলে গেছে পূজাবাড়িতে। সেখানে কত কাজ! পাঁচবাড়ির মেয়েরাই তা করে হাতে হাতে।
দাওয়ায় বসে রূপেন্দ্র গত দুদিনের কথাই চিন্তা করছিলেন। কী ঘটনাবহুল দুটি দিন! পঞ্চমীতে হল বর্গীর আক্রমণ—গাঁয়ের তরফে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ—একটি প্রাণ। আর গতকাল লড়াই করতে হল গ্রাম্য কুসংস্কারের বিরুদ্ধে—এবার রক্ষা পেল একটি প্রাণ। না, একটি নয়, দুটি! লাভক্ষতির হিসাব নিরবচ্ছিন্ন ধারায় প্রবাহিত।
—নজর পড়ল সামনের আরোগ্যশালার নবনির্মিত কুটিরগুলির দিকে। তিনখানি ঘরই ফাঁকা। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে জেঠামশাই কুসুমমঞ্জরীকে অপসারিত করেছেন তাঁর প্রাসাদে। তার সেই মাসিটিও গেছে। সেদিকে নজর পড়তেই মনে পড়ে গেল—‘ছোট হুজুর হুমকি দিয়ে গেছে, মহাষ্টমীতে সে ফিরে আসবে। এবার সসৈন্য। বন্দুকধারী। বলে গেছে, এবার তার সঙ্গে থাকবে হাতি আর কামান। সাবধানবাণী শুনিয়ে গেছে : সোঞাই গ্রামে সে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে চায় না—যদি না ঐ গোয়ারগুলো তাদের তীরধনুক নিয়ে কেরামতি দেখাতে আসে! কথাটা নিয়ে ভীমা বা ঈশেনের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি। সত্যই যদি মোহন্ত মহারাজ এ জাতীয় ব্যবস্থা নিতে চায়, তাহলে কী হবে ওঁদের রণকৌশল? জেঠামশাই অবশ্য বলেছেন, মোহন্ত-মহারাজের এ জাতীয় দুর্মতি হবে না। যতক্ষণ না ভাস্কর পণ্ডিত তার ‘চাল দিচ্ছে ততক্ষণ মোহান্তের ‘দান নেই। তাকে অপেক্ষা করতে হবে। সমঝে নিতে হবে, ভাস্কর পন্থ কোন দিকে যায়—বর্ধমান না মুর্শিদাবাদ। যে পথেই যাক বর্গীদের পথেই পড়বে রূপনগর দাইহাট থেকে মুর্শিদাবাদ যেতে হলে ভাস্করের গতিমুখ উত্তরে। বর্ধমান আসতে হলে তার গতিমুখ দক্ষিণ-পশ্চিমে, মঙ্গলকোট ভাতার হয়ে। কিন্তু দুটি পথই কাটোয়াকে ছুঁয়ে—কেতুগ্রাম মৌজায়। সেই যেখানে অজয় নদ বিলীন হয়েছে ভাগীরথীতে। আর কাটোয়া থেকে রূপনগর তো আধবেলার অশ্বপথ! সুতরাং ভাস্কর পন্থ-এর পরবর্তী পদক্ষেপের সঙ্গে মোহন্ত-মহারাজের আচরণ সম্পৃক্ত।
.
নবাব আলিবর্দী গলদঘর্ম। বয়স সত্তর ছুঁই-ছুঁই। বিহারের সহকারী সুবেদার আলিবর্দী যেদিন তাঁর আজিমাবাদ (পাটনা) প্রাসাদ ত্যাগ করে রাজমহলের পথে রওনা হয়েছিলেন সরফরাজ খাঁর হাত থেকে নবাবী ছিনিয়ে নিতে, সেদিন থেকেই তাঁর আর স্বস্তি নেই। গিরিয়া প্রান্তরে মুখোমুখি হয়েছিল দুই ভাগ্যান্বেষী—একদিকে বিহারের সহকারী সুবেদার আলিবর্দী, অপরদিকে সুবে বাঙলা-বিহার-উড়িষ্যার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা সরফরাজ খাঁ। বেচারি সরফরাজ—সুজাউদ্দীনের অযোগ্য পুত্র—সম্মুখ যুদ্ধে প্রাণ দেওয়ার সৌভাগ্যও হল না তার। গভীর রাত্রে অতর্কিত আক্রমণে নিহত হল সরফরাজ। আলিবর্দী সগৌরবে এসে পৌঁছাল মুর্শিদাবাদে। চিহিল সাতুনে’ সাড়ম্বরে সুবেদার হয়ে বসল।
কিন্তু সেদিন থেকেই নবাবী করার খেসারত দিতে শুরু করল সে। প্রথমেই দিল্লীর অপদার্থ বাদশাহ্ মহম্মদ শাহকে প্রচুর উৎকোচ দিয়ে সংগ্রহ করতে হল বাদশাহী ফরমান। তারপর সরফরাজের অনুতপ্ত পরিবারবর্গকে দিতে হল যথেষ্ট অর্থ-উপঢৌকন—প্রতিকূল শক্তিকে করায়ত্ত করতে। আলিবর্দীও মুর্শিদকুলীর মতো একপত্নিক—সংযমী পুরুষ। তাঁর তিন কন্যা—পুত্রসন্তান নাই। তিন কন্যার সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন জ্যেষ্ঠভ্রাতা হাজি মহম্মদের তিন পুত্রের। বড় জামাই ঘসেটি বেগমের স্বামী হ’ল ঢাকার, মধ্যম জামাতা সৈয়দ আহম্মদ হল উড়িষ্যার আর কনিষ্ঠ জামাতা সিরাজদ্দৌলার পিতা জৈনউদ্দীন হল বিহারের শাসনকর্তা। তিন জামাইকে তিন খুঁটি বানিয়ে চুটিয়ে শুরু করলেন নবাবী।
শুরুতেই বিপত্তি। মধ্যম জামাতা বাবাজীবন গদি লাভ করেই শুরু করে দিল নানান জাতের অত্যাচার। স্থানীয় সম্ভ্রান্ত লোকেরা বিদ্রোহ করল। জামাতা বাবাজীবন কটকে কারারুদ্ধ হল অচিরে।
দুঃসংবাদ পেয়ে বৃদ্ধ আলিবর্দীকে দৌড়াতে হল কলিঙ্গ দেশে। বিদ্রোহীদের শায়েস্তা ও দামাদকে কারামুক্ত করে তিনি ফিরে আসছিলেন মুর্শিদাবাদে। পথে, বালেশ্বরে পৌঁছে পেলেন অন্য এক দুঃসংবাদ। মারাঠা বর্গীর দল আবার ফিরে এসেছে। পূর্ববৎসর দাঁইহাটিতে যে কাফেরটাকে অতর্কিত আক্রমণে বিধ্বস্ত করেছিলেন, সেই ভাস্কর পণ্ডিতই প্রত্যাবর্তন করেছে—লুটতরাজ শুরু করেছে ভাগীরথীর পশ্চিম পারের নানান গ্রামে।
আলিবর্দী দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছেন মুর্শিদাবাদের দিকে।
যে মহাসপ্তমীর ঘাটে আমাদের কাহিনীর নৌকা এখন নোঙর গেড়েছে তখনো আলিবর্দী মুর্শিদাবাদ পৌঁছাতে পারেননি।
—সোনাদা!
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো সোজা হয়ে উঠে বসেন। শুধু কণ্ঠস্বর নয়, সম্বোধনটিও যে একান্ত চিহ্নিত! নজর হল—মুক্তদ্বার পথে একটি অপূর্ব-নারী মূর্তি। পরিধানে আকাশী-নীল মুর্শিদাবাদী, ভূমধ্যে সিন্দুর বিন্দু, চরণপ্রান্তে অলক্তক-রেখা, চূড়ো করে বাঁধা খোঁপায় একটি রেলফুলের মালা, চোখে কজ্জ্বল!
বলেন, মীনু! তুমি! এমন অসময়ে? কার সঙ্গে এসেছ?
মৃন্ময়ী হাসল। দেখা গেল তার সঙ্গে আছে একটি বালক। তাকে দেখিয়ে বললে, এই নিতুর সঙ্গে। নিতাই। আমার দেওর-পো। ভিতরে আসব?
মনে পড়ে গেল কবির বর্ণনা!
“আদ্রাদ্রচন্দন কুচার্পিত সূত্রহারঃ
সীমন্তচুম্বিসিচয় স্ফূটবাহুমূলঃ।
দূর্বাগ্রকাণ্ড রুচিবাস্তগুরূপভোগাদ্
গৌড়াঙ্গনাসু চিরমেষ চকান্ত বেষঃ।”[১]
[১. “বক্ষে আর্দ্র-চন্দন, কণ্ঠে সূত্রহার, সীমন্ত পর্যন্ত আনত অবগুণ্ঠন, অনাবৃত বাহুমূল, করঅঙ্গে অগুরু প্রসাধনের সৌরভ, দেহ-বর্ণ যেন নবদুর্বাদলের মতো শ্যাম—ইহাই গৌড়দেশবাসিনীর সজ্জা।”]
—কী দেখছেন অমন করে?
—কিছু নয়। মানে, কাতু তো বাড়িতে নেই। পিসিমাও নেই।
—জানি। আমি পূজাবাড়ি থেকে আসছি। তাঁদের সেখানে দেখে এলাম যে। তাই টুক করে পালিয়ে এসেছি। ভাবলাম, এখন এলে নির্জনে আপনার দেখা পাব!
‘নির্জনে দেখা পাব!’—রূপেন্দ্রনাথ ঘামতে শুরু করেন। মৃন্ময়ী সেটা লক্ষ্য করল। আবার হেসে বলে, আমি বাঘ না ভালুক? অনেকটা হেঁটে এসেছি। একটু বসব?
—হ্যাঁ, হ্যাঁ। বসবে বইকি! বস।—নিজে উঠে দাঁড়ান চৌকি ছেড়ে।
মৃন্ময়ী চৌকির তলা থেকে একটা কুশাসন টেনে নিয়ে বসে। মাটিতেই। বলে, না, না, আপনি উঠে দাঁড়ালেন কেন? আমি ‘একাসনে বসার কথা বলিনি, সোনাদা!
রূপেন্দ্র বুঝে উঠতে পারেন না, সেই লাজুক মেয়েটি হঠাৎ কী করে আজ এমন প্রগল্ভ হয়ে উঠেছে। পুনরায় উপবেশন করতে করতে বলেন, তুমি আমাকে ‘সোনাদা’ ডেক না!
—মৃন্ময়ী সাত-সকালেই পান খেয়েছে। ঠোঁট দুটি রাঙা। সেই রাঙা ঠোটে ফুটে উঠল বিচিত্র হাসির আলিম্পন। বললে, নিতু সোনা-রূপার ফারাক বোঝে না! জানে না, কোনটা বেশি দামী। আমার মতই বোকা! সোনা ফেলে আঁচলে গেরো দেয়!
—নিতুর কথা বলছি না। কে কোথা থেকে শুনে ভুল বুঝবে।
—নিতু ছাড়া ঘরে তো শুধু আপনি! আপনি তো কখনো ভুল করেন না, ভুল বোঝেন না! তা বেশ! সাবেক নামে যদি না ডাকি, তাহলে নতুন কী নামে ডাকব, গৌর?
এতক্ষণে বুঝতে পারেন—কেন আজ মৃন্ময়ী এত প্রগল্ভ। কাতুর কাছ থেকে অনেক কিছু জেনেছে। অনেক মুখরোচক কেচ্ছা শুনেছে। নিজের মতো তার অর্থ বানিয়ে নিয়ে এসেছে তাঁকে খোঁচা দিতে। প্রসঙ্গটা বদলে তাই বলেন, তুমি কি বিশেষ কোন কথা বলতে এসেছ আমাকে?
—হ্যাঁ! একটা কথা জানতে এসেছি। আর সেই জন্যই এই নির্জন সাক্ষাৎ। বিশ্বাস করুন, আমার অন্য কোনও উদ্দেশ্য নেই। বলুন তো—কেন আপনি এভাবে আমার সঙ্গে শত্রুতা করছেন?
—শত্রুতা করছি! আমি? তোমার সঙ্গে? মানে? কে বললে?
—কে আবার বলবে? আমি তো নিজের কানেই শুনলাম সেদিন। আপনি আপনার পূজ্যপাদ খুড়ো-মশাইকে বললেন না—রাতারাতি দশ-বিশটা খুড়িমা ঘরে আনতে?
রূপেন্দ্র একটু অবাক হয়ে যান। মেয়েটি কী চায়? এমন গায়ে-পড়ে ঝগড়া করতে এসেছে কেন? বলেন, বলেছি। কিন্তু কী কথার জবাবে, কেন বলেছি, তাও তো তুমি জান মৃন্ময়ী। এবং একথাও জান যে, আমার সে তিরস্কার শুনে গাঙ্গুলীখুড়ো তখনই এককুড়ি টোপর কিনতে ছোটেননি।
—কিন্তু একটা টোপর যে তিনি কিনতে ছুটেছেন তা কি আপনি জানেন না?
এবার রীতিমতো অবাক হয়ে যান। এসব কী বলছে ও! দুর্গা গাঙ্গুলী কি সত্যই বিবাহ করতে চাইছেন! এই বয়সে? চতুর্থা পত্নী যখন আসন্নপ্রসবা? না কি এটাও ঐ মৃন্ময়ীর মনগড়া একটা আশঙ্কা। বলেন, বিশ্বাস কর মৃন্ময়ী—আমি কিছুই জানি না। তুমি কী বলছ, তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। দুর্গাখুড়ো কি সত্যই আবার বিবাহ করার কথা ভাবছেন? পাত্রী কোথায়?
মৃন্ময়ী এতক্ষণে অধোবদন হল। প্রগল্ভতা ত্যাগ করে এক নিশ্বাসে অনেকগুলো কথা বলে গেল :
জেঠামশাই, অর্থাৎ ব্রজেন্দ্রনারায়ণ নাকি বলেছেন—রূপনগরের ঐ মেয়েটির দায়িত্ব তিনি নিতে পারবেন না, যদি না সে এই সোঞাই গাঁয়ের কুলবধূ হয়। তা তিনি সত্যিই পারেন না। তার সেই কাকামশাই যদি রূপনগর থেকে ফিরে এসে ভাইঝিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়, তাহলে তাকে প্রত্যাখ্যান করার তাঁর না আছে নৈতিক অধিকার না সামাজিক। অথচ মেয়েটি তার কাকার কাছে ফিরে যেতে চায় না। জানে, তার অর্থ আবার ঐ পাপ-পঙ্কে নিমজ্জিত হওয়া। ভাদুড়ীমশাই তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেই রূপনগরী ‘রাইরানীকে অবিলম্বে সোঞাই গাঁয়ের বধূতে রূপান্তরিতা করতে হবে। রাঢ়ী শ্রেণীর কুলীন সুপাত্র চাই—যে বিনাপণে ঐ অনাথাকে পায়ে ঠাঁই দেবে। মৃন্ময়ী নাকি এইমাত্র পূজাবাড়ির অন্দরমহলে শুনে এসেছে—জেঠামশায়ের দুটি সুপাত্রের কথা মনে হয়েছে—নন্দ চাটুজ্জে, অথবা দুর্গা গাঙ্গুলী। দুজনেই কুলীন, দুজনেই স্বগোত্র নন, এবং দুজনেই হয়তো বিনাপণে বিবাহে স্বীকৃত হবেন। যদিও নন্দ চাটুজ্জের বয়স কম, তবু জেঠামশায়ের মতে দুর্গা গাঙ্গুলী পাত্র হিসাবে অধিকতর বাঞ্ছনীয়। দুজনেরই তিন-চারটি ধর্মপত্নী। কিন্তু গাঙ্গুলী-মশায়ের মাত্র একটি পত্নীই বর্তমান, বাকি অতীত। নন্দের তিন ঘরণীই বর্তমান। তদুপরি তাঁর নামে সৌদামিনী সংক্রান্ত কিছু কলঙ্কও আছে। মৃন্ময়ীর আশঙ্কা—প্রস্তাব উত্থাপন মাত্র সেই ছয়-দশকের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পাত্র সলজ্জে স্বীকৃত হয়ে যাবেন। এক : জনশ্রুতি—মেয়েটি অসামান্যা রূপবতী! রূপনগরের নির্বাচিতা ‘রাইরানী’। দুই: গাঙ্গুলী-মশায়ের চিকিৎসক পরামর্শ দিয়েছেন—অবিলম্বে তিনি গোটাকতক বিবাহ করলে তাঁর অপুত্রক অবস্থায় তিরোহিত হওয়ার আশঙ্কাটা কমবে!
রূপেন্দ্রনাথ বজ্রাহত হয়ে গেলেন। সন্মুখে উপস্থিত মেয়েটিকে যেন আর দেখতে পাচ্ছেন না। তাঁর মনের পটে ভেসে উঠেছে নেপথ্য নায়িকার আলেখ্য!
দুজনেই নিশ্চুপ বসে আছেন মুখোমুখি।
—জেঠিমা! বাড়ি যাবে না?—নিতু তাগাদা দেয়।
—যাব সোনা! না, ভুল হল! ‘সোনা’ বলতে নেই! আয়, মোয়া খাবি?
নিতুকে নিয়ে সে ভিতরে চলে যায়। ভাড়ার ঘরে কোন বেতের ঝাঁপিতে মুড়ির মোয়া থাকে তা ওর জানা। এ-বাড়ির প্রতিটি অন্ধিসন্ধি তার নখদর্পণে। রূপেন্দ্র নিশ্চুপ বসে থাকেন। জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে! তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছে কুসুমমঞ্জরীর সঙ্গে বিদায়কালীন সাক্ষাতের কথা। জমিদার-বাড়িতে রওনা হবার পূর্বে সে কাতুকে দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছিল রূপেন্দ্রকে। পূজার ‘পার্বণী’ চেয়েছিল অসঙ্কোচে—তার প্রাপ্য যেটা—রূপেন্দ্র প্রতিশ্রুত। দিতে হয়েছিল তাঁকে—ওর হাতে : তীব্র কালকূট!
মৃন্ময়ী ফিরে এল নিতুকে নিয়ে। একটা রেকাবিতে কিছু মুড়ির মোয়া। নিতু থাপন জুড়ে বসে টুকিয়ে টুকিয়ে মোয়া খেতে থাকে। মৃন্ময়ী বলে, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব রুপোদা। সত্যি করে বলবেন?
রূপেন্দ্রনাথ নির্বাক ওর চোখের দিকে তাকালেন।
মৃন্ময়ী ম্লান হাসল। বললে, মাপ চাইছি। মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যায়। সংসারী মানুষ তো!
আপনি যে মিছে কথা বলতে পারেন না, সেটা মনে থাকে না।
—কিন্তু প্রশ্নটা কী?
—ঐ কুসুমমঞ্জরী আপনার পরিচয় পাওয়ার আগেই, প্রথম দিনেই, আপনার গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল—‘এতক্ষণে এলে? এত দেরী হল যে!’ বলেছিল?
বুঝতে পারেন। কাতুর কাছে শুনেছে। কিন্তু কাতু তো জানে, মেয়েটি নিতান্ত বিকারের ঘোরে ও-কথা বলেছে। সে-কথাটা কি বুঝিয়ে দেয়নি? নাকি, সব জেনে-বুঝেও মৃন্ময়ী এ-প্রশ্ন তুলেছে? অন্য কী একটা হেতুতে তার বুকটা টন্টনিয়ে উঠছে বলে! হয় তো ঠিক ঐ কটা কথাই সে নিজে বলতে চেয়েছিল—রূপেন্দ্রনাথ দীর্ঘদিন গুরুগৃহে বাস করে যখন প্রথম গ্রামে ফিরে এলেন। এসে দেখলেন—পাশের বাড়ির সেই একফোঁটা মেয়েটা—পীতুকাকার আদরের মীনু—হঠাৎ হয়ে গেছে তার পরমপূজ্য ‘খুড়িমা! আহা! তখন কেন ওর ঘোর বিকার হয়নি! কেন তখন সে প্রলাপ বকার সৌভাগ্য লাভ করেনি? তাহলে তা লোকলজ্জাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে সেও তার সোনাদার গলাটা জড়িয়ে ধরে হু-হু করে উঠতে পারত: ‘এতদিনে এলে? এত দেরী হল যে?
—থাক! আপনাকে বলতে হবে না। আমি জবাব পেয়ে গেছি। কাতু মিছে কথা বলেনি! রূপেন্দ্রনাথ বলেন, ‘না, কাতু মিছে কথা বলেনি। কিন্তু এ-কথাও কি সে বলেনি যে, মঞ্জু সেদিন নিতান্ত বিকারের ঘোরে …
—মঞ্জু! ওর নাম তো ‘কুসুমমঞ্জরী’?
—হ্যাঁ, তাই! মানে …..
—থাক্ রূপেন্দ্রদা! এ কিছু সংস্কৃত শোলক নয় যে, অন্বয়-ব্যাখ্যা ছাড়া আমি ‘মানে বুঝব না। কিন্তু যে-কথা আমি জানতে এসেছি তার জবাব তো এখনো দিলেন না?
—তুমি তো কোন প্রশ্ন করনি মৃন্ময়ী। একটা তথ্য পরিবেশন করেছ মাত্র। হ্যাঁ, স্বীকার করছি, সেটা অতি বিচিত্র তথ্য—আমি তার বিন্দু-বিসর্গও জানতাম না। ও হ্যাঁ, সেই প্রসঙ্গে তুমি একটি প্রশ্নও পেশ করেছিলে—‘কেন আমি জেনেশুনে তোমার শত্রুতা করছি। তার জবাবটা তোমার জানা। এ অভিযোগ তোমার হতাশা থেকে, বেদনা থেকে—এ তোমার দুরন্ত অভিমানের তির্যক প্রকাশ! আমি জানি না, তুমি নিজেও হয়তো জান না—সে অভিমানের পাত্র কতটুকু আমি আর কতটুকু দুর্গা-খুড়ো। কিন্তু তুমি সন্দেহাতীতভাবে জান—তাঁকে আমি বিবাহ করার পরামর্শ সেদিন দিইনি। দিয়েছিলাম—ধিক্কার!
মৃন্ময়ী ধৈর্য ধরে সবটা শুনল। বলল, আমারই ভুল। না, প্রশ্নটা এখনো পেশ করিনি। এখন করছি—আপনি কি দয়া করে আমাকে উদ্ধার করবেন? ‘দয়া করে! আমার প্রতি ‘দয়া”! তার প্ৰতি নয়।
রূপেন্দ্র বলেন, আমি তোমার প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারছি না মৃন্ময়ী। কী চাইছ?
—খুবই দুর্বোধ্য ন্যায়ের সূত্র, নয়? আপনি কি পারেন না জেঠামশাইকে গিয়ে বলতে যে, এই সোঞাই গাঁয়ে ঐ দুই বুড়ো-হাবড়া ছাড়াও আর একটি কুলীন সুপাত্র আছে—আপনার ঐ ‘মঞ্জু’র সঙ্গে যাকে দারুণ মানাবে! গৌর-বিষ্ণুপ্রিয়া!
রূপেন্দ্র,উঠে দাড়ান। প্রস্তাবটা অকল্পনীয় নয়, ছিল না। তবে অবচেতনের কোন কোণায় যে লুকিয়েছিল- তা টের পাননি এতদিন! মৃন্ময়ী, মীনু, সেই অন্তর্লীন ভাবনাটাকে টেনে বার করে নিয়ে এসেছে প্রকাশ্যে। কী তার মূল উদ্দেশ্য তা সে-ই জানে। হতে পারে, এ তার নিতান্ত জৈবিক বৃত্তি—প্রাণধারণের তাগিদে। ‘পৌলমী’ তার ইন্দ্রলোকের অসপত্ন অধিকার রক্ষা করতে চায় বলে! অথবা কে জানে—মেয়েটি হয়তো বুঝে ফেলেছে—কোন্ সুগোপন হেতুতে রূপেন্দ্রনাথ আজীবন কৌমার্যব্রত গ্রহণ করে আর্তের সেবা করে যেতে চেয়েছিলেন। হয়তো সে নিজেকেই দায়ী করে সে জন্যে–হয়তো দায়ী করে এক অলক্ষ্য ভাগ্যদেবতাকে! কিন্তু সেই কাঁটাখানা খচখচ করে প্রতিনিয়ত ওকে বিদ্ধ করে বলেই ও সংসারে মন দিতে পারে না। হোক বুড়ো বর তবু তাকে জড়িয়ে ধরেও শান্তি পায় না। বেচারির ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে যায়—তার ‘সোনাদা সংসারী হয়নি আজও!
রূপেন্দ্রনাথ নীরবে পদচারণা করছিলেন। মৃন্ময়ী কোনও কথা বলেনি। অপেক্ষা করছিল। বার-কয়েক পদচারণা করে ফিরে এসে চৌকির প্রান্তে উনি বসতেই আবার বলে, তোমার ঐ ‘মঞ্জু’কে আমি দেখেছি, সোনাদা! শুধু সোঞাই গায়ে নয়, এমন সুন্দরী আমি কখনো কোথাও দেখিনি!
রূপেন্দ্রনাথ হেসে ফেলেন। বলেন, তুই এমন ভাবে কথা বলছিস্ মীনু যেন, কাটোয়া, নবদ্বীপ, মুর্শিদাবাদ, মায় শহর কলকাতা তোর চষে বেড়ানো!
মৃন্ময়ীও হেসে ফেলে। বলে, তা সত্যি। জীবনে সোঞাই গাঁয়ের বাইরে কখনো যাইনি। কিন্তু তুমি তো গেছ! বল? তুমি কখনো দেখেছ?
রূপেন্দ্র সে-কথার জবাব না দিয়ে বলেন, তুই সত্যিই তাই চাস? আমি রাজী হলে তুই খুশি হবি?
মৃন্ময়ী চোখে আঁচল চাপা দিয়ে বলল, হব! হব! হব! ‘তিন-সত্যি’ করছি! সত্যিই খুশি হ্ব!
—তাহলে বোকার মতো কাঁদছিস্ কেন রে?
মৃন্ময়ী লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। ঘর ছেড়ে যাবার আগে বলে যায়, আনন্দে কাঁদছি, সোনাদা! এ তুমি বুঝবে না!
তা বটে! এ তো বেদান্তের শাঙ্কর ভাষ্য নয়! এ যে মেয়ে-মন! কী করে বুঝবেন রূপেন্দ্র? তিনি চুপচাপ বসে থাকেন।
বেশ কিছুটা সময় নিয়ে ফিরে এল মৃন্ময়ী। এখন তাকে কিন্তু দিব্যি প্রফুল্ল দেখাচ্ছে। কে বলবে—একটু আগে ঐ মেয়েটি কাঁদছিল—হোক তা আনন্দাশ্রু। হাসি-হাসি মুখে বললে, তাহলে আবার যাই পুজোবাড়ি? বড়মাকে বলে আসি!
—না রে, মীনু! বড়মা নয়। তুই শুধু চুপিচুপি কাতুকে বলিস। সে আবার চুপিচুপি বলবে পিসিকে। প্রস্তাবটা পিসিই তুলবে। না হলে পিসি মনে দাগা পাবে। সে বেচারি তো কম চেষ্টা করেনি তার এই একবগ্গা ভাইপোটার নাকে দড়ি পরাতে! কাঁধে জোয়াল চাপাতে। তুই সরাসরি বড়-মাকে বললে পিসির অভিমান হবে।
মৃন্ময়ী স্বীকার করে। হেসে বলে, মাঝে-মাঝে তুমি এমন পাকা মাথার পরামর্শ দাও না সোনাদা, ঠিক মনে হয় পুঁথি-টুথি নয়, সারা জীবন তুমি যেন মনুষ্যচরিত্র ঘাঁটছ। আমি মেয়েমানুষ, আমারই তো বোঝার কথা যে, পরের মুখে এ-কথা শুনলে পিসির কেমন লাগবে! অথচ আমার সেটা খেয়াল হল না, আর তুমি—আজন্ম বই-পোকা—মেয়েদের দিকে কখনো চোখ তুলে তাকাও না, তোমার মনে পড়ে গেল! ‘সোনাদা’ নয়, তোমাকে ‘হীরেদা’ বলব এর পর থেকে—তা বৌঠান শুনুক, না শুনুক।
—বৌঠান?
—ঐ তোমার আদরের ‘মঞ্জু’ গো! .
নিতুর মোয়ার রেকাবি শূন্য হয়ে গেছে। সে আবার তাগাদা দেয়।
মৃন্ময়ীর মুখটা ততক্ষণে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সোনাদা সংসারী হতে রাজী হয়েছে। তার সঙ্গে আজ থেকে নতুন একটা সম্বন্ধ পাতানো গেল। বৌঠানকে উপলক্ষ্য করে সোনাদাকে উত্যক্ত করতে যখন-তখন এ বাড়ি এলে কেউ কিছু মনে করবে না! মৃন্ময়ী বলে, শোন, অঘ্রাণের সাত-তারিখ দিন আছে। মাসখানেক ধৈর্য ধরে থাক। আমি নিজে এসে বৌঠানকে বরণ করে ঘরে তুলব!
রূপেন্দ্র হেসে ওঠেন, ওরে বাবা! তুই যে পাঁজিপুঁথি দেখে বসে আছিস্!
—থাকব না? গরজটা যে আমার! অঘ্রাণ ফসকে গেলে আমি নিজেই যে ফেঁসে যাব। মাঘ-ফাল্গুনে আমি আটকা পড়ব আঁতুড়ঘরে। তোমাকে বরসাজে সাজাতে আসতে পারব না! রূপেন্দ্র বলেন, তাহলে মাঘ-ফাল্গুনেই ব্যবস্থা করব। তোকে ঠিক জব্দ করা যাবে! শোধ তোলা যাবে। তোর বিয়েতে যেমন আমি …
মাঝপথেই থেমে যান। ফুলে ফেঁপে ওঠা বেলুনটায় যেন বেমক্কা একটা সূচ বিদ্ধ করে দিয়েছেন। মৃন্ময়ীর প্রভাতী প্রফুল্লতার ঝলমলে আলোর উপর ঘনিয়ে এল একখানা কালো মেঘ। মুখটা হঠাৎ বেদনার্ত হয়ে ওঠে। মুখটা নেমে আসে বুকের উপত্যকায়। যে ‘আনন্দাশ্রুকে এতক্ষণ কোনক্রমে ঠেকিয়ে রেখেছিল তা টপটপ করে ঝরে পড়ল মাটিতে। সোনাদার ‘উদ্বাহন’ থেকে মনটা হঠাৎ সরে গেছে নিজের ‘উদ্বন্ধনে’! অস্ফুটে বলে, সে সময় গায়ে থাকলে তুমি তোমার খুড়িমার বিয়েতে একপেট মণ্ডা-মিঠাই গিলতে পারতে, সোনাদা? ছিঃ ছিঃ ছিঃ! এ কী ভ্ৰান্তি! অজান্তে এমন আনন্দঘন মুহূর্তে কেন হঠাৎ মাড়িয়ে দিলেন ওর বেদনার স্থলটি!
নিতু আবার তাগাদা দেয়, কই বাড়ি চল?
—চল যাই! আজও একটা প্রণাম করে যাব কিন্তু, সোনাদা! পুজোয় নতুন শাড়ি পরেছি তো। গুরুজনদের প্রণাম করতে হয়! আশা করি তুমি বাধা দেবে না তোমার খুড়িমাকে! প্রতিবর্তী প্রেরণায় প্রণামগ্রহণ কালে যে অভ্যস্ত মন্ত্রটি উচ্চারণ করে ওঁর ওষ্ঠাধর, তা অনুক্ত রইল। এ প্রণাম নারায়ণকে নিবেদন করা যায় না।
এ যে খুড়িমার প্রণাম! পুজোর দিনে স্বামী-সোহাগী নতুন শাড়ি পরার অজুহাতে নিবেদন করছে ভাশুর-পো-কে!
এ কি “নারায়ণকে নিবেদন করা যায়?