১
রূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামের পিছনে কী যেন একটা উপাধি ছিল; কিন্তু এখন তার কোন নিশানা নেই। রঘুনাথ শিরোমণি, বাসুদেব সার্বভৌম থেকে জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন প্রভৃতি অনেক পণ্ডিতই কয়েক শতাব্দী ধরে ভারতজোড়া খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। রূপেন্দ্ৰনাথ সে জাতীয় বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন না নিশ্চয়। কিন্তু বর্ধমানের সেই সোঞাই গ্রামখানিকে কেন্দ্রবিন্দু করে মানচিত্রে পঁচিশ ক্রোশ ব্যাসের একটি বৃত্ত টানলে সে আমলে দেখা যেত ঐ বৃত্তের অন্তর্ভুক্ত গ্রামগুলিতে তিনি অপরিচিত নন। তবে তাঁকে সবাই চিনত দুটি বিচিত্র নামে—’একবগ্গা ঠাকুর’ অথবা ‘ধন্বন্তরি’।
দ্বিতীয় উপাধিটা তাঁকে দান করেছিলেন স্থানীয় জমিদার ব্রজেন্দ্রনারায়ণ ভাদুড়ী। ভেবেচিন্তে নয়, তাৎক্ষণিক উচ্ছ্বাসের বশে। কিন্তু নামটা পাকাপোক্ত হয়ে গেল। শুধু তাই নয়। সোঞাই গাঁয়ে গেলে আজও দেখতে পাবে তাঁর নামে একটা দীঘি এখনো টিকে আছে। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের এঞ্জিনিয়ার পাকা সড়ক বানাবার সময়—এই তো সেদিন—তার চারধার চৌকশ করতে চেয়েছিল। গ্রামবাসী বাধা দেওয়ায় কাজটা করা যায়নি। ভালই হয়েছে। দীঘিটা সার্থকনামা হয়ে রইল। জ্যামিতিক বিচারে দীঘিটি : ট্র্যাপিজিয়াম। দুটি বাহু সমান কিন্তু সমান্তরাল নয়, বাকি দুটি সমান্তরাল, কিন্তু অসমান। তার নাম : ‘একবগ্গা দীঘি’!
প্রথম উপাধিটা দিয়েছিল গাঁয়ের মানুষ—তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক। কারণ সমকালের ধারণায় তিনি এক সুদুর্লভ ব্যতিক্রম! অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমপাদে যা নাকি অচিন্তনীয়—একজন আধুনিকমনা প্রগতিবাদী!
প্রতিটি শাস্ত্রীয় অনুশাসন তিনি নিজ বিবেকের বকযন্ত্রে চোলাই করে গ্রহণ করতেন। তা বেদবাক্য হলেও! যা ভাল বুঝতেন তাই করতেন। কারও পরোয়া না করে। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য তিনি নিজেও কম ভোগেননি, পরিবারবর্গকেও ভুগিয়েছেন। এমনকি ক্রমোজমের মাধ্যমে ভুগিয়েছেন আত্মজাকে। তাই হটী বিদ্যালঙ্কারের স্মৃতিতর্পণ করতে হলে আমাদের প্রথমেই চিনে নিতে হবে সেই ‘একবগ্গা ঠাকুর’কে।
জন্ম : সোঞাই, বর্ধমানভুক্তি।
সময়টা : ফেরঙ্গমতে 1717 খ্রীষ্টাব্দ।
অর্থাৎ শেষ গ্র্যান্ড-মোঘল আলমগীর বাদশাহর মৃত্যুর দশ বছর পরে।বাঙলার তদানীন্তন সুবেদার আজিম উসমানের সঙ্গে মনোমালিন্যের ফলে পূর্বদশকে সম্রাটনিযুক্ত বঙ্গশাসক ঢাকা থেকে রাজধানী সরিয়ে এনেছেন মুখসুদাবাদে। নতুন নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর নাম অনুসারে ভাগীরথী তীরের এই নতুন রাজধানীর নাম হয়েছে; মুর্শিদাবাদ। বস্তুত রূপেন্দ্রনাথের জন্ম- বৎসরে মুর্শিদকুলী পাকাপাকিভাবে বাঙলার সুবেদার হলেন—বাদশাহী ফরমান মোতাবেক। মুর্শিদকুলী লোভী ছিলেন না। নিজে সংযত জীবন যাপন করে গেছেন, যা নাকি সে-আমলে নবাব-বাদশাহদের ভিতর নিতান্ত অপ্রত্যাশিত। উপপত্নী তো নয়ই—এমনকি একটি মাত্র পত্নী নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন!
সুবেদার ও দেওয়ান একই ব্যক্তি। রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে তাঁকে নির্মম হতে হত, কিন্তু অতিরিক্ত আদায়ের লালসা ছিল না। আদিতে ছিলেন ব্রাহ্মণ-সন্তান। তিনি ধর্মান্তরিত মুসলমান।
বালক বয়সেই রূপেন্দ্রনাথ ত্রিবেণীতে চলে যান। গুরুগৃহে বিদ্যার্জনমানসে। নবদ্বীপেই যাওয়ার কথা। নবদ্বীপ সেই কানভট্ট শিরোমণির কাল থেকে নব্যন্যায়ের পীঠস্থান। তার পূর্বযুগে বঙ্গদেশীয় পণ্ডিতদের যেতে হত মিথিলা অথবা কাশীধাম। কিন্তু ত্রিবেণীর এক ক্ষণজন্মা পণ্ডিতের কথা শুনে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন সৌরীন্দ্রনাথ—রূপেন্দ্রনাথের পিতৃদেব। সেই আশ্চর্য নৈয়ায়িকের গুরুকুল চতুষ্পাঠীতে পাঠিয়েছিলেন পুত্রকে।
তিনি রূপেন্দ্রনাথ অপেক্ষা ত্রয়োবিংশতি বৎসরের বয়ঃজ্যেষ্ঠ। তখনো হয়তো তাঁর ভারতজোড়া খ্যাতি হয়নি, কিন্তু সেই আমলেই তিনি নবদ্বীপের গর্ব খর্ব করে নব্যন্যায়ের এক নতুন পীঠস্থান গড়ে তুলতে শুরু করেছেন ত্রিবেণীতে। ঠিক যেভাবে মিথিলার পণ্ডিত পক্ষধর মিশ্রের পক্ষশাতন করে নবদ্বীপকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন পূর্বজমানায় কানভট্ট রঘুনাথ শিরোমণি।
রূপেন্দ্রনাথের সেই শিক্ষাগুরুর নাম : জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন।
সেই ক্ষণজন্মা পুরুষের কীর্তিকাহিনী সর্বজনবিদিত। অনেকানেক পণ্ডিত তাঁর সঙ্গে তর্কযুদ্ধ করতে এসে মাথা নত করে ফিরে গেছেন। তার ভিতর একটির নাম: অষ্টাদশ শতাব্দী।
শতাধিকবর্ষের আয়ুর কথা নিতান্ত বিরল। তবু তা ব্যতিক্রম হিসাবে হয়তো শোনা যায়। কিন্তু আমি তো ‘বায়োগ্রাফিকাল ডিক্সনারী’ ঘেঁটে দ্বিতীয় আর কোনও বিখ্যাত ব্যক্তির নাম খুঁজে পাইনি যার চরণপ্রান্তে একটি গোটা খ্রীষ্টীয় শতাব্দী ‘অজয়-পত্র’ লিখে দিয়ে গেছে!
ওঁর জন্মতারিখ : 13. 9. 1694,
তিরোধান দিবস : 19. 10. 1807
গোটা অষ্টাদশ শতাব্দী তাঁর প্রতিভার বিকাশ দেখতে দেখতে বুড়িয়ে, ফুরিয়ে গেছে! এহেন গুরুর গৃহে রূপেন্দ্রনাথ ছিলেন প্রায় দশবৎসর কাল। স্মৃতি অথবা নব্যন্যায়, কীসের উপর যেন তিনি উপাধিও লাভ করেন। তবে নিজের নামের সঙ্গে উপাধিটা সংযুক্ত করা তিনি পছন্দ করতেন না। গ্রামে তাঁকে কেউ তর্কালঙ্কার, ন্যায়তীর্থ বা ঐ জাতীয় কোন সম্বোধন করলে ভর্ৎসিত হত। অব্যবহারে তরোয়ালের পর্যন্ত ধার ক্ষয়ে যায়, আর এ তো সামান্য উপাধি। ফলে, এতদিন পরে সঠিক তথ্যটা আর উদ্ধার করার সম্ভাবনা নাই। ‘একবগ্গা ঠাকুর উপাধিটাও সম্বোধনে ব্যবহৃত হত না, হত নেপথ্যে। ‘ধন্বন্তরি’ সম্বোধনটাও প্রায় তাই। গ্রামের মানুষ ওঁকে যে দুটি নামে সম্বোধন করত তার একটি ‘কোবরেজ মশাই”, দ্বিতীয়টি ‘পণ্ডিতমশাই”।
প্রথমটি ওঁর বৃত্তি অনুসারে। দ্বিতীয়টি, যেহেতু ইচ্ছার বিরুদ্ধে এককালে তাঁকে একটি চতুষ্পাঠী খুলে বসতে হয়েছিল। কন্যাকে কোন’ চতুষ্পাঠীতে ভর্তি করতে না পেরে।
ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে কাজটা করতে হয়েছিল বটে, কিন্তু সেটিই তাঁর কৌলিক বৃত্তি। পিতৃদেব এবং পিতামহ এই গ্রামে আজীবন অধ্যয়ন-অধ্যাপন নিয়েই কালাতিপাত করেছেন। কিন্তু রূপেন্দ্রনাথকে ভিন্ন পথের পথিক করতে চেয়েছিলেন তাঁর টুলোপণ্ডিত পিতা। সোঞাই গ্রামের কাছে-পিঠে সে আমলে ভাল কবিরাজ ছিল না। মুশকিল এই—সেটা যে একটা অভাব এ বোধটাও ছিল না কারও। তার অর্থ কী? অসুখ-বিসুখ, আধিব্যাধি কি ছিল না? যথেষ্টই ছিল। ম্যালেরিয়া তো ব্যাপক। এ ছাড়া ঐ অঞ্চলে ঘরে ঘরে ছিল আন্ত্রিক রোগ। কিন্তু এইসব আধি-ব্যাধির বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রয়োজনে কোনও কবিরাজ বা ভেষগাচার্যের অভাব বোধ করত না পঞ্চগ্রামের মানুষ। কোন চণ্ডীমণ্ডপে কেউ কখনো প্রস্তাব রাখেনি—এ গ্রামে একঘর কবিরাজ এনে বসালে মন্দ হয় না। সকলেই ছিল ভিন্ন পথের পথিক, ভিন্ন অস্ত্রে বিশ্বাসী : ঝাড়-ফুঁক, মন্ত্র-তন্ত্র, তাবিজ-কবচ। অর্থবানদের জন্য যজ্ঞ, গ্রহশান্তি, অথবা, ডাকিনী-যোগিনী বিদ্যা।
রূপেন্দ্রনাথের পিতৃদেব, সৌরীন্দ্রনাথ—যার ‘পাপে’ রূপেন্দ্র হয়েছিলেন ‘একবগ্গা ঠাকুর’ আর রূপমঞ্জরী ‘হটী’;—তিনি নিজে ছিলেন স্মার্ত-পণ্ডিত। কিন্তু পরিণত বয়সে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এসব ঝাড়ফুঁক-মন্ত্রতন্ত্র গ্রামজীবনকে বাঁচাতে পারবে না। তাই চেয়েছিলেন নিজের ছোট ভাইটিকে কবিরাজ করে তুলতে। বিধি বাম। ছোটভাই সমীরেন্দ্রনাথ একদিন গোপনে গৃহত্যাগ করল। সন্ন্যাস নিল সে। অগত্যা পুত্রটিকেই চেয়েছিলেন আয়ুর্বেদশাস্তে পারঙ্গম করে তুলতে।
চরক, সুশ্রুত, নিদান আয়ত্ত করতে হলে সংস্কৃত জ্ঞানটা আবশ্যিক। সে জ্ঞান নিজেই দিতে পারতেন, যেহেতু তিনি স্বয়ং একটি চতুষ্পাঠী পরিচালনা করেন। কিন্তু সে পথে যাননি পুত্রটিকে রেখে এসেছিলেন ত্রিবেণীর নব্যপণ্ডিতের গুরুগৃহে।
জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের ব্যবস্থাপনাতেই পরে আয়ুর্বেদশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে চলে যা সরগ্রামে। পরবর্তীকালের সরগ্রামনিবাসী স্বনামধন্য কবিরাজ আচার্য গোকুলানন্দের পিতামহ কাছে দীর্ঘ সাত বৎসর আয়ুর্বেদশাস্ত্র, চরক, সুশ্রুত ও নিদান আয়ত্ত করেন।
স্বগ্রামে যখন প্রত্যাবর্তন করেন তখন তাঁর বয়ঃক্রম আনুমানিক পঞ্চবিংশতি বৎসর। দীর্ঘ পনের বৎসর পরে।
সেটা 1742 খ্রীষ্টাব্দ। ইতিমধ্যে বঙ্গদেশের ভাগ্যাকাশে অনেক উত্থান-পতন ঘটেছে বাঙলার মসনদে মুর্শিদকুলীর জামাতা ‘মতোমন-উল্-মুলক সুজাউদ্দীন বাহাদুর অসদ্ জঙ্গ এসেছেন ও গেছেন। সুজাউদ্দীনের এন্তেকাল হলে মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন সরফরাজ খাঁ বাহাদুর। কিন্তু সিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজকে পরাজিত করে বিহারের সুবাদার এসে বসেছেন বাঙলার মসনদে : ‘সুজা-উল্-মুলক হেসামুদ্দৌলা মহাবৎ জঙ্গ বাহাদুর। অতবড় নামটা তো মনে থাকে না, তাই ইতিহাস তাকে সংক্ষেপে বলে : · : আলিবর্দী
বঙ্গদেশের বিভিন্ন সামন্ততান্ত্রিক ঔদ্ধত্য মুর্শিদকুলির আমলেই অবদমিত হয়েছিল। এতদিনে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত। খাজনা আদায়ের অত্যাচার আছেই; কিন্তু সমগ্র রাজ্যে নিরঙ্কুশ শান্তি। চোর-ডাকাতেরা হয় তাদের বৃত্তি ত্যাগ করেছে অথবা প্রতিবেশী রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছে। যারা দুটোর একটাও করেনি তাদের বাদশাহী সড়কের দু-পাশে ঝুলতে দেখা গেছে। মাঠে-মাঠে ধান, গোলায়-গোলায় শস্য। মুর্শিদাবাদের বাজারে তখন এক তঙ্কায় পাঁচ মণ চাউল। তন্তুজাত দ্রব্য, কাঁসার বাসন, লাক্ষার কাজ, লোহা-ঢালাই প্রভৃতি। এমনকি বীরভূমে লোহা ঢালাই করে কামান-বন্দুক পর্যন্ত নির্মিত হত। সুজাউদ্দীনের আমলেই সুবাদার দিল্লীর বাদশাহকে প্রায় সওয়া কোটি টাকা রাজস্ব পাঠাতেন। তার মানে এ নয় যে, রাজ্যে দারিদ্র্য না—ছিল। গ্রামবাসীর উপার্জনও অল্প, প্রয়োজনও অল্প। তার চেয়ে বড় কথা তাদের ছিল অভাব-বোধের অভাব। তারা উচ্চাভিলাষী হত কদাচিৎ। তাদের পার্থিব-কামনার শেষশীমান্ত “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।” সদ্যবিবাহিতা আত্মজাকে বিদায় দেওয়ার সময় জামাতা বাবাজীবনকে শাশুড়ী ঠাকরুণ অনুরোধ করতেন, “হাঁটু ঢাকি বস্ত্র দিহ, পেট ভরি ভাত।” ঢাকায় মসলিন পয়দা হয় কি হয় না সে খোঁজ কে রাখে? হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা শাড়ি পেলেই যখন লজ্জানিবারণ হয়।
ঘরে ঘরে তাঁত। রেশমের চাষও হয়! বিভিন্ন বৃত্তিতে মানুষ মোটামুটি সন্তুষ্ট। লেনদেন বিনিময় প্রথায়—কড়ি-কপর্দকও বাজারে চলে। সরকারী কর্মচারী বাজারে বাজারে ঘুরে নজর রাখে। তদারকি করে। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে যারা পড়ে, তাদের ললাটে অশেষ দুর্গতি—মৃত্যু পর্যন্ত।
বর্গীর হাঙ্গামা যে আসন্ন তা কিন্তু তখনো কেউ টের পায়নি।
ততদিনে রূপেন্দ্রনাথের পিতৃবিয়োগ ঘটেছে। গুরুগৃহ থেকে স্বগ্রামে এসে পিতৃশ্রাদ্ধ সমাপ্ত করে তিনি পুনরায় গুরুগৃহে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। জননীকে হারিয়েছেন তো শৈশবেই। স্বগ্রামে যখন প্রত্যাবর্তন করলেন তখন সংসারে মাত্র দুটি প্রাণী—বৃদ্ধা পিতৃস্বসা আর তাঁর কন্যা। পিসেমশায়ের জীবিত কালেই জগু-পিসিমা ভাইয়ের সংসারে ফিরে এসেছিলেন সকন্যা। এমনকি স্বামীর মৃত্যু সংবাদ পেয়েও শ্বশুরালয়ে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যোগ দিতে যাননি। এ গ্রামেই শাঁখা-সিন্দুর ঘুচিয়ে থান পরে কন্যাটিকে দিয়ে পৃথক চতুর্থীশ্রাদ্ধ করিয়েছিলেন।
হেতুটি সামান্য এবং অসামান্য। পিতৃস্বসার এই বিদ্রোহের হেতু বৃদ্ধ বয়সে পিসেমশাই একটি পঞ্চদশীকে দ্বিতীয় পক্ষে ঘরে এনেছিলেন। সে আমলে এ হেতুটা হাস্যকর : ওমা, আলি কোথায় যাব! কুলীন বামুন—আড়াইকুড়ি বয়সে মাত্তর দ্বিতীয় পক্ষ করল আর তাও সইল না জগু ঠাকুরুণের? হেসে বাঁচিনে!
তা তোমরা হাস আর কাঁদ, এ অনাচার সহ্য হয়নি জগদ্ধাত্রী দেবীর। ঘরে-ঘরে কুলীন ব্রাহ্মণের প্রথমা ভার্যার দল যেটাকে অনিবার্য নিয়তি হিসাবে মেনে নেয়- বাৎসরিক কালবৈশাখী ঝড়ের মতো—বছরে বছরে সপত্নীসংখ্যার বৃদ্ধি, যৌবন-অবসানে যৌবনবতী নবাগতার অঞ্চলপ্রান্তে সিন্দুকের চাবিগোছা বেঁধে দেওয়া আর নিজ অঞ্চলপ্রান্তের গিঁট খুলে স্বামীর অধিকার ত্যাগ করা, তা জগুঠাকরুণের মতে : অসৈরণ!
বিপর্যয়টা ছিল রক্তে। বাড়ুজ্জে বংশের শোণিতে! না হলে তাঁর ভাইপো কেন হবে ‘একবগ্গা ঠাকুর’, নাতনী : ‘হুটী’?
পিসতুতো বোনটি রূপেন্দ্রনাথের অপেক্ষা প্রায় দশ বৎসরের অনুজা। যথারীতি তারও হয়েছিল নবমবর্ষে গৌরীদান। আবছা মনে পড়ে কাত্যায়নীর। অঘ্রাণের এক শীতের রাত্রে নাকে নোলক, ললাটে চন্দনের ছাপ নিয়ে দাঁড়াতে হয়েছিল ছাদনাতলায়। কলকোলাহল, উলু-উলু, শঙ্খধ্বনি, অগ্নয়ে স্বাহা-অগ্নয়ে স্বাহা! বরের মুখটা ওর ভাল মনে নেই, তবে মনে পড়ে, গায়ে ছিল উড়ুনি, মাথায় টোপর আর গলায় গোড়ের মালা! সেই একটিবার মাত্র দেখেছে লোকটাকে, যার কল্যাণে আজও ওর সিঁথিতে সিন্দুর, হাতে খাড়ু শাঁখা।
গুরুগৃহে শিক্ষা সমাপন করে রূপেন্দ্রনাথ যখন স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন তখন কাত্যায়নী ষোড়শী। যৌবন তার ভরা দামোদরের মতো কানায় কানায়। বিবাহের পর আর তার স্বামী-সন্দর্শন ঘটেনি। ভিন্ন গাঁয়ের যে নৈষ্য কুল।নটি জগু ঠাকরুণকে কন্যাদায় থেকে মুক্তি দিয়ে ছিল, বরপণটি উত্তরীয়-প্রান্তে বেঁধে চলে গিয়েছিল, সে আর কোনদিন ফিরে আসেনি। তার পৈত্রিক ভদ্রাসন গো-আড়ি গ্রামে। বর্ধমানরাজের এক্তিয়ারভুক্ত নয়। নবদ্বীপরাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজধানীর সন্নিকটে। দূরের গ্রাম সন্দেহ নাই। এ জাতীয় ভ্রাম্যমাণ কুলীন বিবাহ-বিশারদেরা যজন, যাজন, পূজা পাঠ কিছুই করেন না। শাস্ত্রে নিষেধ! তাঁরা শুধু দু-এক বৎসর পর-পর শ্বশুরালয়ে শুভাগমন করে থাকেন। সেটাই প্রথা। বস্তুত স্বগৃহে নিত্য অরন্ধন। বৎসরের ‘বারোমাস্যায়’ বিভিন্ন ব্রাহ্মণবাড়িতে তাঁর পর্যায়ক্রমে জামাই আদর, এবং রাত্রে নিত্যনতুন শয্যাসঙ্গিনী—সবকয়টি সীমন্তিনীই ওঁর অগ্নিসাক্ষী সহধর্মিণী। সারাটি বছর স্বামী সন্দর্শনের তীব্র কামনা নিয়ে হতভাগিনীর দল অধীর প্রতীক্ষায় প্রহর গনে! পরদিন জামাই-বিদায় নগদে গ্রহণ করে গ্রামান্তরে চলে যায় সেই বিবাহ-বিশারদ নৈকষ্য কুলীন। উপায় কী? বৎসরে মাত্র তিনশত পঁয়ষট্টির অধিক রাত্রির ব্যবস্থা যে করেননি কৃপণ বিধাতা! ভাবছ, তাদের জীবন সুখের? কী বুঝবে তোমরা? বারোমাস্যায় লাভের অংশটাই শুধু দেখলে হে, কিন্তু লোকসানের খতিয়ানটা সমঝে নিলে না! নিদ্রা নাই, বিশ্রাম নাই—প্রতিটি রজনীতে ক্ষুধিতা বাঘিনীর আক্রমণ! দুটো সুখ-দুঃখের কথা প্রাণ খুলে বলার অবকাশ নেই—দুজনেই দুজনের অপরিচিত-অপরিচিতা! ওদের বাসাই নেই, তার ‘ভালোবাসা’! সাংসারিক চিন্তা নেই, সময় নেই, সন্তানের সান্নিধ্য নেই—শুধুই নিরঙ্কুশ জৈবিক আচরণ। একজনের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা—একরাত্রির মেয়াদের, আরজনের নিদারুণ ক্লান্তি—নিত্য অবক্ষয়ের! কোন কোন শ্বশুরালয়ে অবশ্য একাধিক রাত্রি বাস করতে হয়—কখনো বা পুরো সপ্তাহ! সে আমলে কেউ পরিসংখ্যান রাখেনি, রাখলে দেখা যেত—সেই শ্বশুরালয়ের প্রোষিতভর্তিকাটির সৌন্দর্য বা যৌবন এভাবে বিবাহ-বিশারদকে বন্দী করত না—করত শ্বশুরমশায়ের আর্থিক সঙ্গতি! ওরা রাতপিছু দক্ষিণা পেত!
কাত্যায়নীর বিবাহ হয়েছে সাত বৎসর পূর্বে। জামাতা বাবাজীবনের সেই লালরঙের খেড়ো-খাতায় এই হতভাগিনীর নামধাম লেখা পৃষ্ঠাটি যদি ইতিমধ্যে কীটদষ্ট না হয়ে থাকে, তাহলে তার এতদিনে অন্তত একবার আসা উচিত ছিল। এটুকু গণিতশাস্ত্রের অধিকার তার নিশ্চয় আছে। সাত বৎসর পূর্বে সে যে নোলকপরা বেনারসীর পুঁটুলীটিকে দেখে গিয়েছিল, এতদিনে তার যৌবন কানায় কানায় টলমল! অথবা কে জানে, নিত্য-অবক্ষয়ে সেটাই ওর আতঙ্ক কি না! মোট কথা, সে আসেনি! কেন, কে জানে? রূপেন্দ্রনাথ ছোট বোনটির মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে পারেন। খোঁজ নিতে একবার গো-আড়ি গায়ে যেতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু জগুঠাকরুণের প্রবল আপত্তি। হেতুটা তিনি স্পষ্টাক্ষরে জানাননি। সেটা অনুমানসাপেক্ষ! সেই বাড়জ্জে-বংশের অভিমান!
—আমার মেয়ে কি ফ্যালনা?
‘ফ্যালনা’ না হলেও খেলনা তো বটে! পুতুল-খেলার অধিকার নিয়ে সে কি দুনিয়াদারী করতে আসেনি? কিন্তু কে শোনে সে কথা! জগু ঠাকরুণ শেষ নিদান হেঁকে রেখেছিলেন, খবর্দার! জামাইয়ের তল্লাশে গো-আড়ি যেতে পারবি না। আমি এই দিব্যি দিয়ে রাখলাম, রুপো!
কাত্যায়নীর প্রতিক্রিয়া বোঝা যায় না। সে নীরবে তর্জনীতে অঞ্চলপ্রান্ত জড়াতে ব্যস্ত ছিল তখন।
পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত থাকাটাই সে আমলে কোন কুলীন সুপাত্রের পক্ষে এক ভেল্কি। ঘটকীদের নিত্য শুভাগমন লেগেই থাকত। এ-গ্রাম সে-গ্রাম থেকে। কুলীন রাঢ়ী শ্রেণীর ব্রাহ্মণ কোন গ্রামে কয় ঘর তা ওদের নখদর্পণে। মায় তাদের কার ঘরে কয়টি অরক্ষণীয়া। আর কী আশ্চর্যের কথা—জগুঠাক্রণ যখন যে পাত্রীটির বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে পড়েন তখনি দেখা যায়, সেটিই তদানীন্তন বঙ্গদেশের সবচেয়ে রূপবতী, গুণবতী, লীলাবতী! পূর্ব-জমানায় স্বয়ম্বরার কাছে ভাট যেমন বিভিন্ন পাণিপ্রার্থীর গুণাবলী গড়গড় করে আউড়ে যেত, ঘটকীরা তেমনি অনর্গল বর্ণনা করে যেত সেই নেপথ্যনায়িকাদের।
মুশকিল এই যে, রূপেন্দ্রনাথ তাঁর পূজ্যপাদ পিসিমাতা ঠাকুরানীকে স্পষ্টাক্ষরে জানিয়ে রেখেছেন তাঁর সুদৃঢ় অভিমত : ব্রহ্মচারীর জীবন যাপন করবেন তিনি। আজীবন আর্তজনের সেবায় ব্রতী থাকবেন—দারপরিগ্রহ আদৌ করবেন না। এমনকি ভীতি প্রদর্শন পর্যন্ত করে রেখেছেন—বেশি বিরক্ত করলে খুড়ামশায়ের পদচিহ্ন-রেখা ধরে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবেন।
জগুঠাকুরণের ছোটভাইটি সন্ন্যাসী হয়ে গেছে
ভিনগাঁয়ের অরক্ষণীয়াদের কথা থাক, স্বগ্রামেই কি বিবাহযোগ্যা সুপাত্রীর অভাব ছিল? গাঁয়ে অন্তত পঁচিশ-ত্রিশ ঘর ব্রাহ্মণ। অধিকাংশই রাঢ়ী শ্রেণীর। সবাই যে কুলীন, তা নয়। কিন্তু কুলীনের ঘর থেকে শুধু জামাতাই সংগ্রহ করতে হয়। না-হলে কৌলিন্য থাকে না। কন্যা সংগ্রহ করায় আপত্তি নাই। তাতে কৌলিন্য খোয়া যায় না—কিন্তু সেটা অধর্ম! একজন কুলীনকন্যাকে বঞ্চিতা করা! নেহাৎ তেমন-তেমন কৌলিন্য-মর্যাদা না পেলে তাই শ্রোত্রিয়ের ঘর থেকে পাত্রী সংগ্রহ করার প্রথা নেই।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের যে আবর্তে এখন আমাদের কাহিনী পাক খাচ্ছে তাকে আর একটু ঘনিষ্ঠভাবে চিনে নেওয়া দরকার। সে-কালটাকে আমরা বিশেষ চিনি না। সে আমলের রাজনৈতিক ইতিহাস শাঠ্য-ষড়যন্ত্রে আর নীচতায় কানায় কানায় ভরা। গোটা রাজ্য কঙ্কালসার—অর্থনৈতিক শোষণে। শতাব্দীর প্রারম্ভে যে প্রাচুর্য ছিল—নিরন্ন কৃষিজীবীদের না হলেও, যাকে বলে ‘জাতীয় আয়’—দিন দিন তা ক্ষয়িত হয়ে যাচ্ছে। এক দিকে মুসলমান সুবেদার, সুবেদার, দেওয়ান আর তাদের উচ্ছিষ্টলোভী পরগাছার দল, অপর দিকে বিদেশী বণিক আর তাদের প্রসাদলোভীর আক্রমণে তিলেতিলে অবক্ষয়ের পথে ঢলে পড়ছে সুজলা সুফলা বঙ্গদেশ। অন্নপূর্ণা এতদিন ছিলেন যাঁর গৃহলক্ষ্মী, এবার তাঁকে বাঘছাল পরে ভিক্ষায় বের হতে হচ্ছে! তবু আমরা কাহিনীর যে মাঝদরিয়ায় আছি সেখানে এখনো এসে উপস্থিত হয়নি বাঙলার ভাগ্যাকাশে সেই শতাব্দীর সবচেয়ে সর্বনাশা বিভীষিকা : বর্গীর হাঙ্গামা!
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর তো তার পরের কথা!