৬
সে রাত্রে কবির ঘুম এল না। কাতু, কাত্যায়নীকে তিনি দেখেননি, চেনেন না। মনে মনে তার একটা আন্দাজী আলেখ্য আঁকতে পারেন শুধু। রূপেন্দ্র রূপবান—সম্ভবত তার ভগ্নীটিও রূপসী। বয়স তার ষোলো। হাতে শাঁখা, লোহার খাড়ু। সিঁথিতে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে সিন্দুর বিন্দু। শান্তিপুরে ডুরে শাড়ি পরে মেয়েটি প্রদীপ হাতে তুলসীমঞ্চে প্রদীপ নামিয়ে রেখে মৃত্তিকা বেদিকায় মাথাটা নামিয়েছে। গলায় আঁচল দিয়ে ….
কিন্তু এ কী? ও তো কাত্যায়নী নয়! ও যে—রাধা!
রাধা! এগারো বছর বয়সে তাকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল একটি পনের বছরের শ্যামবর্ণ কিশোর—কবি হবার স্বপ্ন দেখত সে! কবি তার সিঁথিতে সিঁদুর আর হাতে শাঁখা ছাড়া আর কী দিতে পেরেছেন? না, দিয়েছেন! একটি পংক্তি—তাঁর কাব্যে :
“রাধানাথ তব দাস পুরাও মনের আশ
তব ঋণিচক্রে ঋণে তর গো।।”
ঐ কাব্যগ্রন্থের আদর যতদিন থাকবে—রসপিপাসু বাঙালী যতদিন ভারতচন্দ্রের কাব্যরস আহরণ করবে—ততদিন বেঁচে থাকবে ঐ বঞ্চিতা হতভাগিনী সীমন্তিনীর নামটা!
কবি ভারতচন্দ্র হচ্ছেন: ‘রাধানাথ’![১]
[১. প্রসঙ্গত কুলীন ব্রাহ্মণকবি ভারতচন্দ্রও একপত্নিক।]
নিদ্রাহীন রাত্রে অতীত জীবনের স্মৃতি যেন ভিড় করে আসছে। একের পর এক ধনী ভূস্বামী বংশে ভারতচন্দ্রের জন্ম। প্রাচীন বাঙলার সুবিখ্যাত সারস্বততীর্থ ভূরিশ্রেষ্ঠ এলাকায় পাণ্ডুয়া গ্রামে তাঁর জন্মভূমি ও শৈশব-লীলা। চতুরানন নামে এক ব্রাহ্মণ চতুর্দশ শতাব্দীতে ভুরসুট পরগণায় একটি রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পুত্র-সন্তান ছিল না। তাঁর জামাতা-শাখা ভুরশুটে প্রাধান্য পায়। ঐ রাজবংশের একটি শাখায় ভারতচন্দ্রের জন্ম। সেটা 1712 খ্রীষ্টাব্দ। অর্থাৎ উনি রূপেন্দ্রনাথের চেয়ে বয়সে পাঁচ বছরের বড়। পিতার নাম নরেন্দ্রনারায়ণ বায়। বিরাট সম্পত্তি তাঁর। ভারত পিতার কনিষ্ঠ সন্তান। সম্পত্তির ব্যাপারে বর্ধমানরাজ কীর্তিচন্দ্রের সঙ্গে নরেন্দ্রনারায়ণের বিবাদ দেখা দেয়। বেগতিক দেখে কনিষ্ঠ পুত্রটিকে নরেন্দ্রনারায়ণ তার মাতুলালয়ে পাঠিয়ে দিলেন। মণ্ডলঘাট পরগণায় নওয়াপাড়া গ্রামে। সেখানে চতুষ্পাঠীও আছে, মক্তবও আছে। অভিভাবকদের নির্দেশ ছিল, তিনি মাতুলালয়ে ফারসী শিখবেন, যাতে ভবিষ্যতে কোন রাজ সরকারে কর্ম সংস্থান করতে পারেন। কিশোর ভারতচন্দ্র সে নির্দেশ তুচ্ছ করে ভর্তি হলেন চতুষ্পাঠীতে। তাঁর স্বপ্ন কবি হবার—সংস্কৃতটা তাই আবশ্যিক। চৌদ্দ-পনের বছর বয়সে তিনি সংস্কৃত ভাষায় যথেষ্ঠ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন এবং শিক্ষাগুরুর প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন।
তাঁর বয়স যখন মাত্র পনের তখন একটা ঘটনা ঘটল—যে ঘটনা তাঁর জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। পাঠশালায় যাতায়াতের পথে পাশ্ববর্তী গ্রাম তেজপুরের একটি পর্ণকুটীরের গবাক্ষে একটি বালিকাকে প্রায়ই লক্ষ্য করতেন। নির্দিষ্ট সময়ে—ওঁর যাতায়াতের নির্দিষ্টকালে মেয়েটি প্রতিদিন জানলায় এসে বসে থাকত আর ডাগর চোখে ওঁকে দেখত। ভারত কৌতূহলী হয়ে পড়েন। সন্ধান নিয়ে জানলেন, ঐ ভদ্রাসনটি কেশরকুনী আচার্যের। মেয়েটি তাঁরই কন্যা বছর নয়-দশ বয়স তার। বালিকার এই বিচিত্র ব্যবহারে ভারত কৌতুক বোধ করেন। লক্ষ্য করে দেখেছেন, চোখাচোখি হলেই সে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কী দেখে মেয়েটি? মাত্র পনের বছর বয়স হলেও কিশোরটি ভবিষ্যতে হতে চলেছে ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর—হেতুটি প্রণিধান করতে অসুবিধা হয় না।
তাঁর হৃদয়ও কি ব্যাকুল হত না? হত। তবে তিনি তো ঐ নিরক্ষরা মেয়েটির মতো ‘ভূবিলাসানভিজ্ঞা’ সরলা বালিকা নন! মনে মনে বলতেন : “ভো ভো রাজন্ আশ্রমমৃগো২য়ং ন হন্তব্যো ন হন্তব্যঃ!”
তারপর একদিন। তিথিটা মনে আছে। মাঘী শ্রীপঞ্চমী। চতুষ্পাঠীতে সেদিন পাঠ বন্ধ! বাগদেবীর আরাধনা হচ্ছে। ছুটির দিন—তবু কী জানি কিসের টানে উনি পার্শ্ববর্তী গ্রামের দিকে চলতে থাকেন। সেই সুচিহ্নিত গৃহটির সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখতে পেলেন শিউলি-বোটায় ছোপানো একটি শাড়ি পরা মেয়েটি বসে আছে জানলায়। চোখাচোখি হতে আজ সে মুখ ফিরিয়ে নিল না। যেন সে ওঁরই প্রতীক্ষায় বসে ছিল এতক্ষণ। ডাক দিল, শুনুন? ভারতচন্দ্র নিজের পিছন দিকে তাকিয়ে দেখলেন। না, পথে দ্বিতীয় ব্যক্তি নাই। তবু নিশ্চিন্ত হতে প্রশ্ন করেন, আমাকে বলছ?
—হ্যাঁ, একবারটি আসবেন? বাবা আপনাকে কিছু বলবেন।
দুরন্ত কৌতূহলে ভারতচন্দ্র আচার্যমশায়ের ভদ্রাসনের দিকে অগ্রসর হয়ে যান। গৃহাভ্যন্তর থেকে বার হয়ে এলেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। গৃহস্বামী নিশ্চয়। মুণ্ডিত মস্তক। দীর্ঘ অকফলা। গায়ে উত্তরীয়, পায়ে খড়ম।
ভারতচন্দ্র বলেন, আপনি কি আমাকে খুঁজছিলেন?
—হ্যাঁ, বাবা। আমার একটি উপকার করবে?
—বলুন?
—তুমি ব্রাহ্মণ তো?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার নাম ভারতচন্দ্র, ঠাকুরের নাম নরেন্দ্রনারায়ণ রায়। আমরা রাঢ়ী শ্রেণীর। কৌলীক উপাধি মুখোপাধ্যায়। কেন, ঠাকুর মশাই?
—তুমি কি প্রাতরাশ করেছ?
ভারতচন্দ্র রীতিমতো অবাক হয়ে যান। বলেন, আজ্ঞে না। চতুষ্পাঠীর দিকে যাচ্ছিলাম! অঞ্জলি দিয়ে প্রসাদ পাব।
—ও! তা বাবা আমার একটি উপকার করে যাও। প্রতি বৎসর আমার ভদ্রাসনে বাগদেবীর পূজা করি। মূর্তিপূজা নয়, গ্রন্থ পূজা। আমি নিজেই করি। সব ব্যবস্থাই হয়ে আছে। কিন্তু এই মাত্র একটি দুঃসংবাদ শুনলাম—আমার অতি দূর সম্পর্কের একটি জ্ঞাতি দুনিয়ার মায়া কাটিয়েছেন। দূর সম্পর্ক বটে, তবে দশরাত্রের জ্ঞাতি! তুমি বাবা দুটি ফুল ফেলে পূজাটা সেরে দিয়ে যাবে? তাহলে রাধা অঞ্জলি দিয়ে দুটি প্রসাদ মুখে দিতে পারে।
ভারতচন্দ্র যথারীতি ন্যাকা সাজলেন, রাধা! রাধা কে?
—আমার কন্যা। সেই তো বললে তুমি ব্রাহ্মণ। কই রে রা–ধে!
বাসন্তী রঙের ছোপানো শাড়ি পরে নোলক-পরা দশমবর্ষীয়া মেয়েটি এসে বাপের পাঁজর ঘেঁষে দাঁড়ায়। নত নেত্রে।
ভারতচন্দ্র মেয়েটিকে প্রশ্ন করেন, তুমি কেমন করে জানলে আমি ব্ৰাহ্মণ?
মেয়েটির কুমারী-সিঁথি দেখা যাচ্ছে এখন। সরমে মাথাটা প্রায় বুকের উপর।
ততক্ষণে মাথায় আধো-ঘোমটা টেনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন পণ্ডিতগৃহিণী। বললেন, আমিও অরে তাই জিগাই। তা রাধা কইল কি তোমারে উড়ুনী জড়ানো গায়ে দ্যাখছে, পৈতাগাছখান কান্ধে আছিল।
প্রমাণিত হল, এক কালে আচার্যমশাই টোপর মাথায় গঙ্গার ওপারে গেছিলেন। পণ্ডিতগৃহিণীর ‘সুমধুর ভাষাৎ’—হেত্ব্যর্থে পঞ্চমী সূত্রে।
ভারতচন্দ্র পূজা করলেন। লৌকিক আচার অনুসারে রাধাও অঞ্জলি দিতে পারল না। তারও অশৌচ চলছে। তবে পূজান্তে টোপাকুল মুখে দিল মহানন্দে।
ভারতচন্দ্র মেয়েটিকে প্রশ্ন করেন, তুমি পড়াশুনা কর? সরস্বতীর পূজা তো খুব করছ ঘটা করে। বাঙলা পড়তে পার?
রাধা সলজ্জে মাথাটা নিচু করে। শিরশ্চালনে জানায়, না!
পণ্ডিতগৃহিণী বলেন, মাইয়া-মানুষের নেখাপড়া শিতি নাই! জান না?
ভারতচন্দ্র রাধার বাবাকে প্রশ্ন করেন, আপনারও তাই বিশ্বাস?
প্রৌঢ় পণ্ডিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, কী করব বল বাবা? লোকাচার! মূর্খগুলো ভেবে দেখে না—স্বয়ং বাগেশ্বরী কী করে সাক্ষর!
পণ্ডিতগৃহিণী একটি রেকাবিতে ফল মিষ্টি প্রসাদ সাজিয়ে নিয়ে এলেন। স্বীকৃত হতে পারলেন না ভারতচন্দ্র। অজুহাত দেখালেন—তাঁদের চতুষ্পাঠীতে পূজা এখনো অসমাপ্ত
রাধার মা বললেন, তাইলে একদিন মধ্যাহ্নে এই হানে আইস্যা দুটি অন্ন সেবা করি যেও! অশৌচ মিটলে। আইবে তো?
ভারতচন্দ্র স্বীকৃত হলেন। রাধার দিকে ফিরে বলেন, লেখাপড়া তো শেখনি, রান্না করতে শিখেছ?
রাধা নোলক নেড়ে বলেছিল, বলব না!
–বলবে না! কেন? বলবে না কেন?
–বলতে হবে আপনাকে!
—আমি রাঁধতে জানি কি না?
—তা নয় মশাই! যেদিন অন্নসেবা করতে আসবেন সেদিন খেয়ে বলতে হবে, কোন ব্যঞ্জন মায়ের হাতের, কোনটি মেয়ের।
বেশ কিছুদিন পরের কথা। সহপাঠী বংশীলাল একদিন বললে, শুনেছিস ভারত, সেই মেয়েটার বে ঠিক হয়ে গেছে! কী কপাল! বরটা বুড়ো-হাবড়া! তিনকুড়ি বয়স তার!
—কোন্ মেয়েটা রে?—ভারত কৌতূহলী।
—সেই যাদের বাড়ি তুই সরস্বতী পূজা করে দিয়ে এসেছিলি। তেজপুরের আচায্যি বাড়ির। রাধা! তোর তো নিমন্ত্রণও ছিল! গেলি না কেন?
বুকের মধ্যে টন্টনিয়ে উঠেছিল। বংশীর হাতটা চেপে ধরে বলেছিল, তুই ঠিক জানিস? বুড়ো বর?
—ওমা, জানব না কেন? ললিত গাঙ্গুলীর বয়সের কি গাছ-পাথর আছে? মুখে একটা দাঁত নেই। এক মাথা পাকা চুল। তার বড় নাতিরও তো বে হয়ে গেছে!
পনের বছরের কিশোর! রক্তে তখন আগুন জ্বলে! হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়ে গেল তার গোপনে গিয়ে সাক্ষাৎ করল কেশরকুনী আচার্যের সঙ্গে। বললে, এ আপনি কী করছেন পণ্ডিত মশাই! অমন লক্ষ্মীর প্রতিমাকে ভাসিয়ে দিচ্ছেন?
অরক্ষণীয়া কন্যার পিতা ম্লানমুখে বলেন, কী করব বাবা? কৌলিন্য মর্যাদা দেবার সামর্থ্য যে আমার নেই। উপযুক্ত পাত্র কোথায় পাব? গাঙ্গুলী-মশাই এক কপর্দক মাত্র কৌলিন্যমর্যাদা নিয়ে …
অপরিসীম দার্ঢ্যে কিশোরটি বলেছিল, উপযুক্ত পাত্র কিনা জানি না, তবে আমার পিতামহের হাতি ছিল, আমাদের বাড়ি আজও দোল-দুর্গোৎসব হয় …..
পণ্ডিতমশাই আকাশ থেকে পড়েন, তুমি! তোমার মাতুল রাজী হবেন?
–সম্ভবত নয়। আপনার কন্যা যদি রাজী থাকে আর আপনার যদি হিম্মৎ থাকে তাহলে আমি স্বীকৃত! গোপনে! আমি কুলীন, এবং পাটি ঘর।
আচার্য ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, এ যে আমার স্বপ্নেরও অতীত বাবা! বেঁচে থাক তুমি। দীর্ঘজীবী হও! এমন হৃদয় তোমার! তুমি দেশের মুখোজ্জ্বল করবে।
ভবিষ্যদ্বাণীটি আধাআধি সার্থক করেছিলেন আচার্যের জামাতা বাবাজীবন।
দীর্ঘজীবী হতে পারেননি। কিন্তু স্বল্পজীবনের মধ্যেই দেশের মুখোজ্জ্বল করেছিলেন।
কিন্তু লক্ষ্মীর প্রতিমাকে ঘরে আনতে পারেননি।
সংবাদ পেয়ে ভারতের অভিভাবকেরা তাকে মাতুলালয় থেকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। ওঁদের সংসারে তখন প্রচণ্ড অশান্তি—বর্ধমানরাজের অত্যাচারে। তার উপর নাবালকটির ঐ হঠকারিতায় কবির লাঞ্ছনার আর অবধি রইল না। কিশোর-কবি ক্ষোভে অভিমানে গৃহত্যাগ করেন। আশ্রয় পান হুগলী জেলার বাঁশবেড়িয়া গ্রামের পশ্চিমে দেবানন্দপুর নিবাসী রামচন্দ্ৰ মুন্সীর বাড়িতে। সেখানে থেকে বহু কষ্টে ফারসী ভাষা আয়ত্ত করেন। কবি ঈশ্বরগুপ্ত সে-আমলে ভারতচন্দ্রের কৃচ্ছসাধন বর্ণনা করতে লিখছেন, “দিবসে একবার মাত্র রন্ধন করিয়া সেই অন্ন দুই বেলা আহার করেন, প্রায় কোন দিবস ব্যঞ্জন পাক করেন নাই। একটা বেগুন পোড়ার অর্ধভাগ এ-বেলা এবং অর্ধভাগ ওবেলা আহার করিয়া তাহাতেই তৃপ্ত হইয়াছেন।” এখানে থাকতেই তিনি মুন্সীর বাড়িতে সত্যনারায়ণের পূজা উপলক্ষ্যে একটি ‘ব্রতকথা’ রচনা করেন: কবির প্রথম রচনা।
ফারসী ভাষা আয়ত্ত করে কবি ফিরে এলেন স্বগৃহে। দাদারা তাঁর পুনর্বার বিবাহ দেবার আয়োজন করল। দৃঢ় প্রতিবাদ করলেন কবি। বললেন, আমার এক স্ত্রী বর্তমান। আপনারা তাকে গ্রহণ করেননি। উপার্জনক্ষম হলে আমি তাকে স্বগৃহে নিয়ে আসব। দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ কদাচ করব না।
এই সময় কবিকে পাঠিয়ে দেওয়া হল বর্ধমানে। বর্ধমানরাজ কর্তৃক অপহৃত সম্পত্তি উদ্ধার করতে। মোক্তার হিসাবে। রাজশক্তির অসীম ক্ষমতা! কবি মিথ্যা অজুহাতে গ্রেপ্তার হলেন। কারারুদ্ধ কবি কোনক্রমে পালিয়ে যান। এই পলায়নে তাঁকে সাহায্য করেছিল পারিবারিক পুরাতন ভৃত্য ভোলা নাতে! দুজনে বনজঙ্গল দিয়ে পথ খুঁজে খুঁজে উপনীত হন কটকে। কবির পরিচয় ও জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়ে যান মহারাষ্ট্রীয় সুবেদার শিব ভট্ট। রঘুজী ভোঁসলের তরফে তিনি তখন কটকের শাসনকর্তা। তাঁর অনুগ্রহে পুরুষোত্তমধামে বাস করার অনুমতি পান। তখন তিনি প্রায় সন্ন্যাসী! কিন্তু ভোলা প্রামাণিক ছায়ার মতো তাঁর সঙ্গে লেগে আছে।
কী ভাবে ঐ ধূর্ত প্রামাণিকের চক্রান্তে কবি আবার সংসারে ফিরে আসতে বাধ্য হন তার প্রামাণিক ইতিহাস নাই; আছে শৈল্পিক ইতিকথা: নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের—’অমাবস্যার ‘গান’-এ। নারায়ণ গাঙ্গুলীর কল্পনা অনুসারে ঐ সময় রাধার সঙ্গে ভারতের পুনর্মিলন হয়—পুনর্মিলনই বা বলি কেন? বিবাহকালে রাধা ছিল এগারো বৎসরের বালিকা—এই তার প্রথম স্বামী সন্দর্শন! [১]
[১. ‘মিতে’–দার কল্পনা ছাড়া এ বিষয়ে পণ্ডিত গবেষকেরও সমর্থন আছে। যথা—ডঃ ভূদেব চৌধুরীর ‘বাঙলা সাহিত্যের ইতিকথা’ প্রথম খণ্ড।]
অনতিবিলম্বেই কবি চলে যান ফরাসডাঙায়—দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর আশ্রয়ে কর্মের অনুসন্ধানে। রাধাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান, মাথা-গোঁজার একটা ব্যবস্থা হলেই, দুবেলা দু-মুঠো অন্নের সংস্থান হলেই, তাকে নিজের কর্মস্থলে নিয়ে যাবেন। সুযোগ হয়নি। দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণের সুপারিশে এসেছেন কৃষ্ণনগরে। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে আশ্রয় দিয়েছেন, বৃত্তি দিয়েছেন; কিন্তু তাঁর উপার্জন এখনো এমন হয়নি যে, সেই সূর্যমুখী ফুলের চারাগাছটিকে গোয়াড়ি-কৃষ্ণনগরের উদ্যানে এনে রোপণ করেন।
বিশ্বাস করতে মন চায় না, নয়? যে ‘অন্নদামঙ্গল’ আজ এম-এ-র পাঠ্য—তা স্বীকৃতি পাওয়ার পরেও ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর সস্ত্রীক বসবাসের মতো সচ্ছলতার মুখ দেখতে পাননি তাঁর আটচল্লিশ বছর জীবনের ত্রিশটি বছর কিন্তু ইতিমধ্যে কেটে গেছে!
রাজাদেশে কবি এখন অন্নদামঙ্গলের সম্প্রসারণ করছেন। বিদ্যাসুন্দরের আদিরসাত্মক পদগুলি রচনা করছেন! ‘অমাবস্যার গান’ গাইছেন!
তোমরা কি কবির জন্য দু-ফোঁটা চোখের জল ফেলবে?
তোমরা ফেলবে কি না জানি না, কবি ফেলেছিলেন—সে রাত্রে। না, রাধার জন্য নয়। সেই না-দেখা, না-চেনা কাত্যায়নীর উদ্দেশ্যে!
কবি জানেন, সেই উপেক্ষিতা যৌবনভারনম্রার অন্তর্লীন বেদনাটি কী তীব্র। তিমি যে কবি!