কাশীধাম : 1774 - প্ৰথম পৰ্ব
সোঞাই : 1742 - দ্বিতীয় পৰ্ব
নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর : 1742 - তৃতীয় পৰ্ব
তীর্থের পথে : 1742 - চতুর্থ পর্ব
1 of 2

কাশীধাম – ৬

অবশেষে সিদ্ধান্তে এলেন অশীতিপর বৃদ্ধ বিদ্যার্ণব।

মেয়ের হাতদুটি টেনে নিয়ে বললেন, আমি সমাধানে পৌঁচেছি, মা জননী। শোন, বুঝিয়ে বলি—গত দশ দিন তুই আমি দুজনেই ঘরের বার হইনি। চতুষ্পাঠী পরিচালনা করেছে রমারঞ্জন। আমরা দুজন এ দশ দিন গঙ্গাস্নানও করিনি। কাল করব। পুব-আকাশে- আলো ফোটার আগেই বাপ-বেটিতে বেরিয়ে যাব। বুঝলি?

—বেশ তো, যাব। এটা কী-এমন বড় জাতের সিদ্ধান্ত?

—না, সবটা বলা হয়নি। গঙ্গাস্নান একটা অছিলা। রমারঞ্জন ব্যবস্থা করেছে। দশাশ্বমেধ ঘাটে ওর একজন বিশ্বস্ত মাঝি—নকুলেশ্বর কাহার—অপেক্ষা করবে। সে আমাদের ব্যাসকাশী পৌঁছে দেবে। সেখানে থেকে আমরা বাপ-বেটিতে বাদশাহী-সড়ক ধরে কাশীত্যাগ করব। পদব্রজে চলে যাব রোহিতাশ্ব

—কাশীত্যাগ করবেন! এই বৃদ্ধ বয়সে! এই ভদ্রাসন? এই গুরুকুল-চতুষ্পাঠী!

—রমারঞ্জন দায়িত্ব নিয়েছে। সে সব কিছুর দায়িত্ব নেবে—যতদিন না আমরা বাপ-বেটিতে ফিরে আসি। তুই ঠিকই বলেছিলি—রমার সঙ্গে গৃহত্যাগ করলে তার নানান প্রতিক্রিয়া হত। আমার ক্ষেত্রে তা হবে না।

—কতদিন পরে আমরা ফিবে আসব?

—কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ সাবালক হলেই। পুরন্দরের হাত থেকে শাসনদণ্ডটা গ্রহণ করলেই।

—সে তো তিন-চার বছর, বাবা?

—হোক না! ‘কালোহ্যয়ম্ নিরবধি বিপুলা চ পৃথ্বীঃ’। এখন আমাদের স্মরণে রাখতে হবে—কাল অনন্ত, পৃথ্বী বিপুলা। একদিন-না-একদিন ফিরে আসবই। কোথাও না কোথাও আশ্রয় জুটবেই। আর নেহাৎ নাই যদি জোটে তাতেই বা ক্ষতি কী? আত্মমর্যাদা তো খোয়াব না!

হটী বিদ্যালঙ্কার সম্মত হলেন। ঐ জরাগ্রস্ত বৃদ্ধের বলিরেখাঙ্কিত হাতটি ধরে নিরুদ্দেশ যাত্রায় পুনরায় গৃহত্যাগ করতে।

পরদিন—না পরদিন নয়, সেই রাত্রেরই শেষ প্রহর। মাথার উপর তখনো এক-আকাশ তারা। শুক্লা সপ্তমী তিথি। চাঁদ অস্ত গেছে অনেক আগে। কিন্তু তারার দলের কৌতূহল মেটেনি। তারা ঝুঁকে পড়ে দেখছে এক বৃদ্ধ আর তার কন্যার আজব অভিসার। ওরা ঘর ছেড়ে পথে নামছে। রাজার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে প্রজা।

না, রাজা একা নয়—ভাবেন বিদ্যালঙ্কার। রাজা-সাহেব এই পুরুষশাসিত কূপমণ্ডূক সমাজের এক প্রতীক মাত্র। সমাজের সর্বস্তরে গ্লানি, ক্লেদ, পঙ্ক। বঙ্গভূমে দেখে এসেছেন কী প্রচণ্ড সামাজিক অবক্ষয়। ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যায় মঠে মঠে বীভৎস বামাচার। জায়গীরদারের দল বিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়েছিল। প্রজার সঙ্গে একটিমাত্র সম্পর্ক—খাজনা আদায়। সমাজপতিরাও সেই পঙ্কস্রোতে গা ভাসালো। মুষ্টিমেয় যে কজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ প্রতিবাদ করতে রুখে দাঁড়ালো তাদের ওরা ফাঁসিকাঠ থেকে লটকালো। এই অবক্ষয়ের অনিবার্য ফল—বর্গীর আক্রমণ। সোনার বাঙলা শ্মশান হয়ে গেল! একজনও মাথা খাড়া করে দাঁড়াতে পারল না। তারপর এল বিদেশী বেনিয়ার দল। সহজেই দখল করে নিল দেশ-শাসনের অধিকার। শুধু বাঙলা নয়, সারা ভারতবর্ষে তখন ঐ অবক্ষয়ী অধঃপতনের যুগ ভাঁগোয়া-ঝাণ্ডার ধারক স্বয়ং ভবানী মাতার বরপুত্র শিবাজী-মহারাজের উত্তরসূরীরা আজ লুটেরা ডাকাত; রাণা প্রতাপের ঐতিহ্যের ধারক আজ বাদশাহী-সড়কের ঠগী!

এবং তারপর ছিয়াত্তরের মন্বন্তর! তার ভিতরেই তিনি কাশীযাত্রা করেন।

কাশীনরেশের প্রয়াণে এই পুণ্যভূমিতে শাসনের নামে যে শোষণ করতে এসেছে সেই রাজাসাহেব ঐ অবক্ষয়ী পাশবিকতার এক মূর্ত প্রতীক মাত্র!

মা-জননীর হাতটি দৃঢ়মুষ্টিতে ধরে অতি সন্তর্পণে বিদ্যার্ণব গৃহদ্বার উন্মুক্ত করলেন।

চরাচর নিস্তব্ধ। পাখির কাকলি এখনো শুরু হয়নি। পথে দেখা দেয়নি প্রত্যূষ স্নানার্থীর দল। দুইজনে পথে নামলেন।

ইষ্টনাম স্মরণ করার পূর্বেই বাধা

—কে! কে ওখানে?

অন্ধকারের ভিতর থেকে অগ্রসর হয়ে এল এক দশাসই জোয়ান। মাথার ঝাঁকড়া চুল একটি গামছায় ফেট্টি দিয়ে বাঁধা। কটিবন্ধে তরবারী, হাতে দীর্ঘ বংশদণ্ড। বিদ্যার্ণবকে নত হয়ে প্রণাম করল। বললে, ডরিয়ে মৎ পণ্ডিত মোশা। হামি রামলগন আছি

—রামলগন! কে তুমি বাবা, রামলগন? এখানে কী করছ?

অতি বিনীতভাবে লোকটা আত্মপরিচয় দিল। সে রাজসরকারের বেতনভুক্ত লাঠিয়াল। শহরের অনেক মানুষ নাকি আজ পণ্ডিতজী আর তাঁর কন্যা ঐ মাতাজীকে বিষ নজরে দেখে। যে কোন মুহূর্তে তারা নাকি এই চতুষ্পাঠী আক্রমণ করে মাতাজীকে অপহরণের চেষ্টা করতে পারে। তাই তাঁর নিরাপত্তাবিধানে সে রাজসরকার-নিয়োজিত প্রহরীমাত্র—যাবৎ পূর্ণমাসী!

বললে, গঙ্গাজীমে যাইবন নু? আসেন হমার সাথ। কৌন ঘাট? দশাশ্বমেধ সায়েদ?

মুহূর্তে ধুলিসাৎ হয়ে গেল যাবতীয় পরিকল্পনা!

প্রণিধান করলেন, তিনি সকন্যা গৃহবন্দীমাত্র। ওর ঐ ‘যাবৎপূর্ণমাসী’ শব্দটি বিশেষ অর্থপূর্ণ অর্থাৎ, অনর্থবহ! চৈতালী পূর্ণিমায় কামাগ্নির চিতায় তাঁর আদরের কন্যাটিকে পূর্ণাহুতি দেওয়া হবে। চিতাভ্রষ্টার অন্তিম গতি—ব্যভিচারীর কামাগ্নিচিতা।

কী যেন বলেছিল রমারঞ্জন? সেই মালোয়া-জনপদকল্যাণীর নাম?

এতক্ষণে পুব-আকাশটা একটু একটু করে ফর্সা হচ্ছে। দশাশ্বমেধ ঘাটে পৌঁছে রামলগন বসল পাযাণ-রানার একান্তে—যেখানে থেকে ঘাটের স্নানরতাদের নজর করা যায়। পাণ্ডাজীর গোলছাতির আড়াল থেকে। বিদ্যার্ণব আর বিদ্যালঙ্কার পায়ে পায়ে নেমে গেলেন গঙ্গার দিকে। ডাইনে পুরুষদের ঘাট, বামে স্ত্রীলোকদের। বিদ্যার্ণব পুরুষদের ঘাটের দিকে অগ্রসর হয়ে গেলেন। দশ-পনেরজন স্নানার্থী ইতিপূর্বেই এসেছে। তাদের মধ্যে একজন ওঁকে দেখে চিনতে পারেন। বলেন, প্রাতঃপ্রণাম ঠাকুরমশাই, কিছু সুরাহা হল?

বিদ্যালঙ্কারের মনটা বিষিয়ে ওঠে। সর্বত্র ঐ আলোচনা। দ্রুতপদে তিনি স্ত্রীলোকদের ঘাটের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। তবু পরবর্তী কথাটাও কানে যায়, ঘোর কলি পণ্ডিতমশাই! কী করবেন বলুন? ঐ রাজাসাহেবের চরণদুটি আঁকড়ে ধরে ক্ষমা চান

বিদ্যালঙ্কার শিহরিতা হয়ে ওঠেন। কে যেন সপাৎ করে একটা চাবুক মেরেছে ওঁর পৃষ্ঠদেশে। ওপাশ থেকে আবার একজন বলে ওঠে, কী বলছ বসুজা? মহামহোপাধ্যায় বিদ্যার্ণব ক্ষত্রিয়ের পদস্পর্শ করবেন?

বিদ্যালঙ্কার দুহাতে কর্ণমূল চেপে ধরে এ-ঘাটে দ্রুত প্রবেশ করেন। একজন বর্ষিয়সী মহিলা তাঁকে সম্বোধন করে বলে ওঠেন, এ ঘাটে নয় পণ্ডিতমশাই, এটা মেয়েদের ঘাট।

বিদ্যালঙ্কার যেন দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়েন মা গঙ্গার বুকে। বৃদ্ধা চিৎকার করে প্রতিবাদ করতে যান; কিন্তু তার পূর্বেই একটি বধূ ওঁর কর্ণমূলে বলে ওঠে, কাকে কী বলছ ঠাম্মা? উনি যে সেই আজব ‘মেয়ে-পণ্ডিত!

বিদ্যালঙ্কার এক ডুব দিয়ে তখন পুনরায় দাঁড়িয়ে উঠেছেন, কোমর জলে। তাঁর ঢিলেঢালা পিরান গায়ের সঙ্গে সেঁটে গেছে। গৈরিক সিক্ত বসন ভেদ করে বিদ্যালঙ্কারের পরিচয় ততক্ষণে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। তিনি আবার ডুব দিলেন।

ঘাটের উপরে পাষাণরানায় রামলগন বসে নজর রেখেছিল। বন্দিনীর জিম্মাদারী তার। নজরে রাখা তার রাজকর্তব্য; কিন্তু ধর্মভীরু লোকটা চোখ ফেরালো। সিক্তবসনা ঐ অনিন্দ্যকান্তি রমণীর রূপ থেকে মনটাকেও ফেরাবার চেষ্টা করল : জয় শিউজী! জয় বজরঙ্গবলী!

ওর মনে পড়ে গেল পূর্বদিনের সন্ধ্যার কথা। সিদ্ধির আসরে সুখিয়া ওকে জনান্তিকে প্রশ্ন করেছিল, এক বাৎ পুছুঁ লগনভাই?

—কা বাৎ?

সুখিয়া জানতে চেয়েছিল, শহরে যে গুজবটা মুখে মুখে ছড়াচ্ছে তা কি সত্যি? ঐ পণ্ডিত মহিলাটিকে শাস্তিদানের পর নাঙ্গা অবস্থায় শোভাযাত্রা করে পৌঁছে দেওয়া হবে রণ্ডিবাজারে?

রামলগন বলেছিল, ম্যায় কা জানতা?

স্বীকার করেনি। মন্ত্রগুপ্তির নির্দেশ ছিল—কথাটা তাই পাঁচকান করেনি। রামলগন জানত—না, ঐ মহিলাটিকে নগ্ন অবস্থায় ঢাল-ঢোল-শিঙ্গা বাজিয়ে শোভাযাত্রা করে রণ্ডিবাজারে আদৌ পৌঁছে দেওয়া হবে না। তার অন্তিমগতি প্রয়াগ ক্যান্টনমেন্টে। যবন শ্বেতাঙ্গ… সৈনিকদের কাম চরিতার্থ করতে করতেই মাতাজীর যৌবন বিকাবে। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল রামলগনের।

—হে শিউজী! হে বজরঙ্গবলী! এ তোমাদের কেমন বিচার? কী পাপ করেছে ঐ পণ্ডিতমাঈ। সে তো কারও পাকাধানে মই দেয়নি? লিখা-পড়ি নিয়ে সে তো দিব্যি ছিল বড় পণ্ডিতজীর ডেরায়। কেন তাকে তোমরা বেইজ্জত করছ?

কেন পাঠিয়ে দিচ্ছ জঙ্গী ফিরিঙ্গিদের ছাউনিতে?

রাজাসাহেবের উপর এই ধর্মভীরু মানুষটি খুশি নয়। রাজাসাহেব মত্তাবস্থায় ভাঙের ভাণ্ড ওর মস্তক লক্ষ্য করে মেরেছিলেন একদিন—মাথা ফেটে রক্তপাত হয়েছিল—তা হোক; সে জন্য রামলগনের কোন ক্ষোভ নেই। রাজাসাহেব মালিক, সে নোকরমত্তাবস্থায় রাজাসাহেব যদি ওর রক্তপাতের উপলক্ষ্য হন তাহলে জন্মদাস রামলগনের মতো মানুষরা ক্ষুব্ধ হয় না। ওদের সাতপুরুষের নিয়তি। মদ্যপান বা নিত্যনতুন নারীসঙ্গের জন্যও সে রাজাসাহেবের উপর বিরক্ত হয়নি—এমনটা তো হয়েই থাকে। বুড়ঢারাজার এসব দোষ ছিল না—কিন্তু তিনি তো ব্যতিক্রম। রামলগন জানে, এটাই বড়লোকের রেওয়াজ। তামাম হিন্দুস্থানে। রামজীর মতো প্রজা-পালক, জনকরাজার মতো রাজর্ষি এ যুগে দুলর্ভ। রামলগন ক্ষুব্ধ—যেহেতু ঐ রাজাসাহেব লোকটা কসবি বা রণ্ডি নিয়ে খুশ থাকে না। তার নজর—ঘরানা-ঘরের বধূ, গৃহস্থ ঘরের কন্যা! তাদের মুখে ফেট্টি বেঁধে নিয়ে আসে বেতনভুক অপহারকের দল। দু-চার রাত ফুর্তি-ফার্তা করে রাজাসাহেব জানায়—সখ মিটে গেছে! তখন হয়তো হতভাগিনী আত্মহত্যা করে। অনেকে আশ্রয় নেয় রণ্ডিবাজারে। কেউ কেউ নিঃশব্দে পাল্কি চেপে ফিরে যায় স্বগৃহে। কখনো বাড়ির লোক নিঃশব্দে মেনে নেয়। কখনো বা তার মৃতদেহ নিজেরাই সৎকার করে!

চমক ভেঙে রামলগন সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায়।

স্নানান্তে পণ্ডিতজী সকন্যা ফিরে আসছেন। বগলে সিক্তবসন। পরিধানে শুষ্ক পোশাক।

—চলিয়ে পণ্ডিতজী।

—না। আমি একবার ওপারে যাব। ব্যাসকাশী।

রামলগন অবাক হয়। বলে, কেও?

বিদ্যার্ণব বিরক্ত। বলেন, আমার খুশি। তুমি এখন কী করবে?

—ম্যয় ভি যাউঙ্গা! ক্যা করু? চলিয়ে—

ঘাটে নির্দেশমতো অপেক্ষা করছিল নকুলেশ্বর। সে বিস্মিত হল। রমারঞ্জনের কাছ থেকে সে নির্দেশ পেয়েছিল—ভোররাত্রে, পণ্ডিতজী আর মাতাজী ঘাটে আসবেন—সঙ্গে আর কেউ থাকবে না। নকুলেশ্বর কোন কথা বলবে না। শুধু দুজনকে ওপারে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসবে। আর কাকপক্ষীকেও সে-কথা বলবে না। রমারঞ্জনের নির্দেশটি ছিল প্রাঞ্জল। বুঝতে কিছু অসুবিধা হয়নি নকুলের। সে কাশীরই বাসিন্দা। সবাই যা জানে, তা তার অবিদিত নয়। সে সহজেই বুঝতে পেরেছিল—ওঁরা বাপবেটিতে কাশীত্যাগ করতে চাইছেন। আসন্ন মৃত্যুর মুখ থেকে অব্যাহতির শেষ চেষ্টা। নকুলেশ্বর রাজি হয়েছিল। বোধকরি এ জন্য পারিশ্রমিক না পেলেও সে রাজি হত। রাজাসাহেবকে সেও অত্যাচারী শাসক বলে মনে করে। ঐ নির্বিরোধী পণ্ডিতজী আর তাঁর সেই সাক্ষাৎ দুর্গাপ্রতিমার মতো কন্যাটিকে সে আন্তরিক শ্রদ্ধা করে— কিছু না বুঝেও। তাই সে অবাক হল, যখন দেখলো ওঁরা দুজনে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন সশস্ত্র দেহরক্ষীটিকে। রামলগনকে ভালভাবেই চিনত নকুলেশ্বর। জেনে-বুঝেও সে প্রশ্ন করে; কাঁহা—যাইবন পণ্ডিতমোশা?

—ওপারে। ব্যাসকাশীতে।

নৌকায় তিনজনে উঠে বসলেন। ছোট্ট ডিঙি নৌকা। বাপবেটি বসলেন একদিকে, ঘেঁষাঘেষি করে। সামনের পাটাতনে লাঠিহাতে রামলগন। নৌকা ছাড়ল। রামলগন হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে প্রায় কানে-কানে বিদ্যার্ণবকে বললে, পণ্ডিতজী, এক বাৎ বাতাউ?

—কী?

—আপনি যা হিঞ্ছা করছেন, উ হোবে না!

—কী বলতে চাইছো তুমি?

—আপনি হমার এক্তিয়ার থিকে ভাগতে পারবেন না। বেহুদ্দো ব্যাসকাশী যাচ্ছেন কেন?

বিদ্যার্ণব দাঁতে-দাঁত দিয়ে নীরব রইলেন।

বিদ্যালঙ্কার বুঝে উঠতে পারেন না, এই গঙ্গা পার হবার হেতুটা কী? নকুলেশ্বর নির্দেশ মতো উপস্থিত ছিলই। তারই নৌকায় ওঁরা গঙ্গা পার হচ্ছেন। কিন্তু এখন তো তার কোনও অর্থ হয় না। মূর্তিমান যমদূতের মতো সশস্ত্র বসে আছে রামলগন

সূর্যোদয় হয়েছে ইতিমধ্যে। গঙ্গার ঘাট এখন লোকে লোকারণ্য। সে-আমলে কাশীর গঙ্গা ছিল হরিদ্বার-গঙ্গার মতোই নির্মল, নীল। ‘কা শীতলবাহিনী গঙ্গা?—কাশীতলবাহিনী গঙ্গা!’

নকুলেশ্বর ওপ্রান্তে বসে একভাবে দাঁড় টেনে চলেছে। লগিটাকে তুলে রেখেছে ঘাটের সীমা পার হবার পর। ছলাৎ-ছল, ছলাৎ-ছল। বহু লোক স্নান করছে—এঘাটে ওঘাটে। তারা চোখ তুলে দেখছে নৌকার যাত্রীদের। তারা জানে না, এই তিনটি ঘেঁষাঘেষি পারানির যাত্রীর দুজন বন্দী আর একজন পাহারাদার।

ক্রমে এপারের দৃশ্য আবছা হয়ে এল। এগিয়ে এল ওপারের দৃশ্য। দিগন্তজোড়া শুধু ধূ-ধূ বালির চড়া। জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই। কিছু জলচর পাখি শুধু ভিড় করে আছে—কাদা-খোঁচা, জলপিপি, গাঙশালিক, চখাচখী—এমনকি কিছু শীতালী পাখি, যার এখনও মানসযাত্রা শুরু করেনি।

রামলগন পুনরায় নিচু হয়ে একই কথা বলল, পণ্ডিতজী! এক বাৎ কহুঁ?

বিদ্যার্ণব রীতিমতো বিরক্ত। তিনি নিজের চিন্তায় বিভোর ছিলেন। বলেন, বার-বার একই কথা বলছ কেন, রামলগন?

—নেহি, নেহি পণ্ডিতজী। ইবার ম্যয় দুসরা বাৎ কনে চাহতা

—ক্যা বাৎ?

রামলগন নতনেত্রে তার প্রাকৃতভাষে যে কথা নিবেদন করল তা বেশ কিছুটা অপ্রত্যাশিত হঠাৎ গঙ্গাজলে ডান হাতটা ডুবিয়ে দিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে, এই গঙ্গাজীমে হাঁথ দিয়ে বলছি পণ্ডিতজী! আপ্….আপনি মাতাজীকে নিয়ে ভেগে যেতে পারলে এই রামলগন হারামি ভি খুশি হোবে! লেকিন ক্যা করু? ইয়ে হ্যয় মেরা নসিব!

বিদ্যার্ণব জবাব দিলেন না।

বিদ্যালঙ্কার হঠাৎ কিছুটা অভিভূত হয়ে পড়েন। যুক্তকরে অস্ফুটে উচ্চারণ করেন উপনিষদের মন্ত্র :

‘মাহং ব্রহ্ম নিরাকুর্য্যাং মা মা ব্রহ্ম নিরাকরোদনিরাকরণমত্ত্বনিরাকরণং মেহস্তু। তদাত্মনি নিরতে য উপনিষৎসু ধর্ম্মাস্তে ময়ি সন্তু। তে ময়ি সন্তু।।’

বিদ্যার্ণবের কর্ণে প্রবেশ করল সে মন্ত্রধ্বনি। তিনি পাদপূরণ করলেন, ওঁ শান্তিঃ। শান্তিঃ শান্তিঃ।। হরিঃ ওঁ ॥

বিদ্যালঙ্কারের মনে পড়ল এই কিছুক্ষণ আগেকার একটি ছোট্ট ঘটনা। দশাশ্বমেধ ঘাটে স্নানান্তে তিনি যখন বস্ত্র পরিবর্তন করতে প্রাচীরের অন্তরালে যাচ্ছিলেন তখন পিছন থেকে বে যেন তাঁকে ডেকে উঠেছিল, বাবা! একটু দাঁড়িয়ে যাবেন?

বিস্মিতা হটী বিদ্যালঙ্কার দুরন্ত কৌতূহলে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। তখন তিনি সদ্যস্নাতা। সিত্ত পিরানটি তাঁর দেহের সঙ্গে লেপটে সেঁটে আছে। তাছাড়া তিনি স্ত্রীলোকদের জন্য চিহ্নি অন্তরালে যাচ্ছিলেন বস্ত্র পরিবর্তনের জন্য। এই সময়ে কে তাঁকে ডাকল ‘বাবা’ বলে?

ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলেন সেই বৃদ্ধা। যিনি ওঁকে বারণ করেছিলেন এ ঘাটে স্নান করতে। তাঁর পাঁজর-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বধূটি, অবগুণ্ঠন টেনে।

বিদ্যালঙ্কার বলেছিলেন, কিছু বলবেন?

—হ্যাঁ বাবা! আপনাকে একটি প্রণাম করতে চাই। না, না, আমরা বামুন নই, গন্ধ-বেনে আপনি বয়সে ছোট বলে দোষ নেই।

বৃদ্ধা আর তাঁর নাতবৌ বিদ্যালঙ্কারকে প্রণাম করেছিলেন পদস্পর্শ করে। বিদ্যালঙ্কার আপত্তি করেননি, আশীর্বাদ করেছিলেন। সহাস্যে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি এখনো আমাকে ‘বাবা’ বলে ডাকছেন কেন?

বৃদ্ধা নিদন্ত হাসি হেসে বলেছিলেন, তখন আপনারে চিনতে পারিনি, বাবা। আমার এই নাত–বউ বুঝিয়ে দিল—আপনিই সেদিন সেই কুরুক্ষেত্তর তালাও-এ

বাধা দিয়ে বিদ্যালঙ্কার বলেন, সে তো হল, কিন্তু ‘বাবা’ কেন? কেন নয় ‘মা’?

বৃদ্ধা জোড়হস্তে বলেছিলেন, আপনি বেহ্মজ্ঞানী! ‘বাবা-মা ডাকাডাকির ওপারে!

বিদ্যালঙ্কারের চোখ দুটি অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল! তাঁর সাধনা তাহলে তো নিষ্ফলা নয়! এই গন্ধবণিক বৃদ্ধাটি তো তাঁর অশিক্ষা সত্ত্বেও প্রণিধান করতে পেরেছেন—ব্রহ্মবিদ্যা লাভের এক্তিয়ার শুধুমাত্র পুরুষজাতির দখলে নয়। মহাজ্ঞানের সেই শিখরচূড়ায় উপনীত হলে প্রকৃতি-পুরুষের ভেদাভেদ আর থাকে না!

আর এখন এই রামলগন!

রাজসরকারের বেতনভুক ভৃত্যমাত্র। তবু তার অন্তরে সঞ্চিত এক ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ! অন্যায়ের বিরুদ্ধে! অসত্যের বিরুদ্ধে! সে খুশি হবে যদি বিদ্যার্ণব তাঁর কন্যাটির ধর্মরক্ষা করতে পারেন। রামলগন আজ নিরুপায়। অন্নদাস ভীষ্মের মতো!

নৌকা ওপারে ভিড়ল।

নকুলেশ্বরকে অপেক্ষা করতে বলে বিদ্যার্ণব ব্যাসকাশীর পারে নামলেন। কন্যাকে আহ্বান করলেন, নেমে আয় মা।

বিদ্যালঙ্কার নৌকা থেকে অবতরণ করলেন। নকুলেশ্বর কোনও প্রশ্ন করল না। উদাস দৃষ্টি মেলে বসেই রইল। বিদ্যার্ণব ডানে-বাঁয়ে তাকালেন না। সোজা রওনা হলেন। বিদ্যালঙ্কার এতক্ষণ কোনও প্রশ্ন করেননি। লক্ষ্য করে দেখলেন রামলগনও তার লাঠিগাছখানা তুলে নিয়ে পিছন পিছন আসছে—শ্রুতিসীমার ভিতরেই সে। বিদ্যালঙ্কার তাই সংস্কৃতে প্রশ্ন করলেন, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণবের। বললেন, আর তো কোন পথ দেখতে পাচ্ছি না, মা। এই আমার শেষ চেষ্টা। চল, তোকে বিশ্বনাথের চরণতলে ফেলে দিয়ে আসি। তারপর রাখেন তিনি, মারেন তিনি।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন হটী বিদ্যালঙ্কার! এ কী! বৃদ্ধ কি শোকের আঘাতে, আতঙ্কের তুঙ্গশীর্ষে উঠে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন? তিনি কি এখন উন্মাদ? কাশীধাম ছেড়ে নৌকায় ওপারে ব্যাসকাশীতে এসেছেন বিশ্বনাথের চরণজোড়ার সন্ধানে?

বিদ্যার্ণবের খেয়াল হয়নি অনুগামিনী থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। আপন মনে কথা বলতে বলতে তিনি বালিয়াড়ি ভাঙছেন। বিড়বিড় করে বলছেন, আমি তো সামান্য মানুষ, যাঁরা ব্রহ্মবিদ, বেদজ্ঞ মহামহোপাধ্যায়, তাঁরাও দিশেহারা হয়ে পড়লে ঐ বাবা বিশ্বনাথের চরণজোড়াই আঁকড়ে ধরেন।

হটী বিদ্যালঙ্কার ছুটে এসে পিছন থেকে ওঁর হাত দুটি ধরে ডেকে ওঠেন, বাবা?

—অ্যাঁ?

—বিশ্বনাথের মন্দির তো ওপারে?

হাসলেন বৃদ্ধ। বলেন, না রে মা! আমি সেই অচল বিশ্বনাথের কথা বলছি না। তিনি তো পাষাণ!

—তা হলে? তবে কার কথা বলছেন?

—সচল বিশ্বনাথ!

দেহের সমস্ত রোমকূপে স্পন্দন জেগে ওঠে হটী বিদ্যালঙ্কারের। এ অভিধা অতি পরিচিত। কাশীবাসী কারও অন্বয় ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। নামটুকুই শোনা ছিল, স্বচক্ষে কখনো দেখেননি! সচল বিশ্বনাথ!

সচল বিশ্বনাথ! তাঁর দেখা পাওয়া কি সহজ?

কখন কোথায় থাকেন টেরই পাওয়া যায় না। এই শোনা গেল বাবা আছেন দশাশ্বমেধ ঘাটে। দৌড়ালো শত শত দর্শনার্থীর দল। গিয়ে শুনল, বাবা ভাসতে ভাসতে চলে গেছেন কেদারঘাটে। অসি থেকে বরুণা তিনি ক্রমাগত সাঁতার দিয়ে অতিক্রম করেন—ঘাট দিয়ে, হেঁটে নয়। তিনি যে দিগম্বর! সমস্ত রাত হয়তো আকণ্ঠ-গঙ্গাজলে নিমজ্জিত হয়ে বসে আছেন—কী শীত, কী গ্রীষ্ম। তারপর যেই গঙ্গার ঘাটে প্রথম স্নানার্থীর আবির্ভাব ঘটে অমনি বাবা সাঁতরে চলে যান ব্যাসকাশীতে। জনশ্রুতি—তিনি দাক্ষিণাত্যের সন্ন্যাসী। কাশীধামে প্রথম যখন আসেন তখনো বেণীমাধবের ধ্বজাটা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠেনি। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুই তো হয়েছে 1707 খ্ৰীষ্টাব্দে। তার কত বছর পূর্বে ঐ মসজিদটা হয়েছিল তার আন্দাজ নেই বিদ্যালঙ্কারের।

প্রায় ঘণ্টাখানেক বালিয়াড়ি ভাঙার পর দূর থেকে তাঁর দর্শন পাওয়া গেল। বসে আছেন পদ্মাসনে। জনহীন প্রান্তরে, বালির উপর। চোখ দুটি নিমীলিত। ধ্যানস্থ। সম্পূর্ণ বিবস্ত্র। তবে ওঁর মধ্যদেশ এতই স্ফীত যে, মেদের মৈনাকে তাঁর—না, ভুল হল, তাঁর নয়, দর্শনার্থীর—লজ্জা নিবারণ হয়েছে। বিশালকায় পুরুষ। মুণ্ডিত মস্তক। দাড়ি-গোঁফের বালাই নেই

একজন কাশীবাসী পরামানিকের কীর্তি সেটা।

জপ-তপ, পূজা-উজা সে কিছুই করে না। বিশ্বনাথ দর্শন বা গঙ্গাস্নানের প্রয়োজন নেই তার। সগর্বে বলে, ‘দেখি কোন শালা যমদূত আমাকে মরার পর ছুঁতে আসে!’ কারণ তার সাধনমার্গ অতি বিচিত্র। সপ্তাহে দুদিন—‘বিফে ঔর এতোয়ার সে ঝড়-ঝঞ্ঝা বজ্রপাতের বাধা মানে না ব্যাসকাশীতে চলে আসে তার সরঞ্জাম নিয়ে। ধ্যানস্থ বাবাকে ক্ষৌরি করে দিয়ে যায়। বাবা টেরও পান না!

তবে এজন্য পরামানিককে পাড়ানির কড়ি গুণে দিতে হয় না। একজন পশ্চিমা মাঝি বিনা কড়িতে তাকে পারাপার করে দেয়। তারও বিশ্বাস মৃত্যুর পর তার অনন্ত বৈকুণ্ঠবাস ঠেকাতে পারবে না যমদূতের দল। শ্রমজলই ওদের গঙ্গোদক।

দূর থেকে দেখা গেল—কিছু কাক, গাঙ শালিক আর শৃগাল বাবাকে ঘিরে আছে। লোকজনকে আসতে দেখে তারা স্থানত্যাগ করল। দৃষ্টিসীমার বাহিরে নয়, নিরাপদ দূরত্ব থেকে অপেক্ষা করে—কতক্ষণে এই উটকো আপদের দল বিদায় হয়।

ভক্তরা যা ফলমূল মিষ্টান্ন নিবেদন করে যায় তা পড়ে থাকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। পশুপাখি নির্দ্বিধায় তাতে উদরপূর্ণ করে যায়। ওদের দৃষ্টিতে সচল বিশ্বনাথ যে ধ্যানস্থ অচল বিশ্বনাথ। তাকে আর ভয় কী? বাবা বিশ্বনাথই জানেন ধ্যানভঙ্গ হলে বাবা সেই বায়স ও শিবাকুলের উচ্ছিষ্টে উদরপূর্তি করেন কিনা।

ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসীকে ওঁরা তিনজনে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। ততক্ষণে চৈতালী রৌদ্র চড়া হতে শুরু করছে। রামলগন মাজা থেকে খুলে গামছায় মাথাটা ঢাকল। এমন কত চৈতালী দিনে উদয়ভানু অস্তাচলে পৌঁছে দেখেছেন সমস্ত দুপুরের ‘লূ’-এর ঝড়ে বাবার দেহ প্রায় ঢেকে যেতে বসেছে, কিন্তু তাঁর ধ্যানভঙ্গ হয়নি।

নিতান্ত সৌভাগ্য ওঁদের। বাবার ধ্যানভঙ্গ হল।

ঘোলাটে দুটি চোখ মেলে তিনি আগন্তুকদের দেখলেন। সবার আগে নজর পড়ল বৃদ্ধ বিদ্যার্ণবের দিকে। প্রশ্ন করলেন, ক্যা মাংতা হ্যায় রে, বেটা?

‘বেটা’ সম্বোধন তো প্রত্যাশিত। বাবার বয়স ঐ অশীতিপর বৃদ্ধের প্রায় দ্বিগুণ!

শোনা যায়, তৈলঙ্গস্বামী জীবনের শেষ পর্যায়ে মৌনব্রত পালন করতেন। তা ‘জীবনের শেষ পর্যায়’ বলতে কী বোঝায়? সচল বিশ্বনাথের ক্ষেত্রে সাধারণ গাণিতিক হিসাব অচল। কারণ, জনশ্রুতি—তিনি নাকি প্রায় আড়াই শত বৎসরকাল এই ধরাধামে লীলাময় হয়ে ছিলেন। না, ‘গিনেস-বুক-অব-রেকর্ডস্’-এ তথ্যটা লেখা নেই। তা সে যাই হোক, আমরা আছি 1774 খ্রীষ্টাব্দে—অর্থাৎ বাবার তিরোধান কাল থেকে একশ তেরো বছর পিছিয়ে। সে সময় তাঁর বয়স একশ সাতাশ। ত্রৈরাশিকের অঙ্ক সহজেই বলবে—বাবার তখন যৌবন শেষ হয়েছে, প্রৌঢ়ত্ব শুরু হয়নি। মোটকথা, মেনে নেওয়া যেতে পারে সেটা তাঁর জীবনের শেষ পর্যায় নয়। কাহিনীর অনুরোধে তাই ধরে নেওয়া হচ্ছে, তখন তিনি থোড়াকুছ বাৎচিৎ করে থাকেন।

বিদ্যার্ণব হিন্দিভাষাতে জিজ্ঞাসিত হয়েও প্রত্যুত্তর করলেন সংস্কৃতে—যাতে সেটা ঐ রামলগন লোকটার মাথার উপর দিয়ে যায়। বললেন, আমি কিছু চাই না, বাবা। এই মেয়েটি আমার পালিতা কন্যা। এর বড় বিপদ ….

বিদ্যার্ণবের তর্জনীসংকেতে বাবা এবার এদিকে ফিরে তাকালেন। তাঁর ঘোলাটে চোখের দৃষ্টিতে ধরা পড়ল নতজানু ভঙ্গিতে যুক্তকরে বসে আছেন বিদ্যালঙ্কার। হয়তো প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তসীমায় পৌঁছেও, এই সওয়া শ বছর অতিক্রমণেও, তাঁর অক্ষিগোলকের সম্মুখস্থ ‘লেন্স’-এ / ‘ক্যাটারাক্ট’ দেখা দেয়নি। অন্তত তাঁর আধাবয়সী গন্ধবণিক বৃদ্ধা-গৃহিণীর অপেক্ষা তাঁর দৃষ্টি প্রখরতর। হিন্দিতেই প্রশ্ন করেন: শিউজী ঔর কালীমাঈ—কিষণজী ঔর রাধামাঈ, কোই ফারাক নহী! অ্যাঁ? সব ঝুট হ্যায়! ক্যা রে?

বিদ্যালঙ্কারের ওষ্ঠাধর থরথর করে কেঁপে উঠল। কী বলতে চাইছেন বাবা? এ কি প্রশ্ন, না, তিরস্কার? নারীত্বকে তিনি অস্বীকার করেছেন বলেই কি উনি বিরক্ত? কিন্তু এসব তুচ্ছ জাগতিক অকিঞ্চনের দিকে তো ওঁর নজর পড়ে না? নিজের পোশাকের চিন্তা যার নেই সে কি অপরের পোশাক নজর করে?

তৈলঙ্গ স্বামী পুনরায় বলে ওঠেন, ক্যা মাংতা তু?

‘বেটা’ বা ‘বেটি’ সম্বোধন করেননি এবারও। কিন্তু ‘মাংতি’ নয়, ‘মাংতা’!

এতক্ষণে বিদ্যালঙ্কারের কণ্ঠে স্বর ফুটল। বোধকরি সচেতনভাবে প্রত্যুত্তর করলেন না তিনি। অন্তরের অন্তস্তল থেকে একটা আকৃতি অজান্তেই বার হয়ে এল। সেই আদিমতমা নারীমুক্তির ধ্বজাধারিণী নিশ্চয় জানতেন না—ঐ একই প্রশ্ন শুনে একই জবাব দেবেন ভবিষ্যতে ভারত-আত্মার আর এক সিদ্ধপুরুষ–দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দিরের গর্ভগৃহে দাঁড়িয়ে :

—ভক্তি চাই বাবা! অচলা-ভক্তি!

এতক্ষণে মৃদু হাস্যরেখা ফুটে উঠল মহাযোগীর ওষ্ঠাধরে। বললেন, দীক্ষা নিবি?

হটী বিদ্যালঙ্কারের সহসা মনে হল তাঁর নাভিকুণ্ডলী থেকে একটা বিদুৎপ্রবাহ সুযুা নাড়ি বেয়ে ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে পটাকাশে বিলীন হয়ে গেল!

—যা! পহিলে গঙ্গাজীয়ে নাহা লে।

বিদ্যালঙ্কার উঠে দাড়ালেন। ঘণ্টাখানেক পূর্বেই তিনি দশাশ্বমেধ-ঘাটে অবগাহন করেছেন; ব্যাসকাশীতে স্নানই হয়—গঙ্গাস্নান হয় না—এসব কথা তাঁর মনেই পড়ল না। চকিতে নজর পড়ল ওঁর শিক্ষাগুরুর দিকে। যুক্তকরে বসে আছেন তিনি; দুটি গালে বিগলিত ধারা। তাঁর বহুদিনের মনস্কামনা আজ সিদ্ধ হতে চলেছে। রূপমঞ্জরী গঙ্গার দিকে এক পদ অগ্রসর হতেই বাবা পিছন থেকে হেঁকে ওঠেন, আরে বুদ্ধ! ক্যা করতি হায় রে তু? তেরা ধৌতি ঔর পিরান খোলকে রাখ পহিলে।

এবার কিন্তু ‘করতা’ নয় ‘করতি’! চকিতে ঘুরে দাঁড়ালেন বিদ্যালঙ্কার : বাবা?

কৌতুক যেন উপচে উঠছে বাবার দুচোখ থেকে। তিনি খানদানি হিন্দিতে শুনিয়ে দিলেন এক লব্‌জ—ঈশ্বর জানেন, কে তার রচয়িতা—তুলসীদাসজী, কবীর না তুকারাম। বঙ্গানুবাদে গঃ ‘লজ্জা-ঘৃণা-ভয়/তিন থাকতে নয়।’

দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণব সম্বিত ফিরে পান। তাঁর আর্তকণ্ঠ থেকে শুধু বার হয়ে এল একটি ধ্বনি : ন্–না!

বাবা ভ্রূক্ষেপ করলেন না। রূপমঞ্জরীকেই হিন্দিতে বললেন, প্রকৃতি-পুরুষ ভেদাভেদ তো তুই মানিস না। এই দেখ না আমাকে। মুক্তিকামী মানুষের আবার লজ্জা কী?

নারীর মুক্তিব্রত গ্রহণ করেছিলেন সোঞাই গ্রামের সেই আদিমতমা বিদ্রোহিণী। রাজা রামমোহন রায় তখন দুই বৎসরের শিশু! কিন্তু কী থেকে মুক্তি? শুধুই পুরুষশাষিত সমাজে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা? পুরুষ প্রতিযোগীর সঙ্গে সমানতালে চতুষ্পাঠী পরিচালনার অধিকার? হ্যাঁ, সেজন্যই মস্তক মুণ্ডন করেছেন, শিখা রেখেছেন, শাড়ি-বক্ষাবরণ পরিত্যাগ করে ধুতি-পিরানে লোকলজ্জার হাত থেকে আত্মরক্ষা করেছেন। কিন্তু সেটুকুই কি ছিল ওঁর চরম লক্ষ্য? কুম্ভমেলায় সহস্র সহস্র নাগা-সন্ন্যাসীর সমতলে উঠে না আসতে পারলে কেমন করে প্রতিষ্ঠিত হবে সম-অধিকারের দাবী? নাগা-সন্ন্যাসীরা তো পারেন! পুরুষ-প্রকৃতির ভেদাভেদ তাঁরা অস্বীকার করতে পারেন! লোকলজ্জাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে নগ্ন শোভাযাত্রা করে এগিয়ে চলেন জনাকীর্ণ গঙ্গার ঘাটে—হর হর মহাদেও!

তাহলে তিনিই বা কেন পারবেন না?

দশাশ্বমেধ ঘাটের সেই বৃদ্ধা গন্ধবণিক না বলেছিলেন—উপপদতৎপুরুষ ‘ব্রহ্মবাদিন” শব্দের স্ত্রী-য়াম ঈপ্ ‘ব্রহ্মবাদিনীর’ এক্তিয়ার শুধুমাত্র ব্যাকরণের অন্দরমহলে?

মুক্তিকামীর কি লিঙ্গভেদ থাকতে পারে?

তৈলঙ্গস্বামী অন্তর্যামী! চর্মচক্ষে না দেখলেও তিনি অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে প্রণিধান করেছেন বিদ্যালঙ্কারের শেষ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব! তাই তাঁর সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন এমন একটি কঠিন পরীক্ষা!

এ পরীক্ষায় তাঁকে উত্তীর্ণ হতেই হবে!

গঙ্গার দিকে তাকিয়ে দেখলেন। ধূ-ধূ বালির চড়া। জনমানবের চিহ্নমাত্র নাই। বহুদূরে নৌকার গলুয়ে বসে আছে নকুলেশ্বর কাহার—বিন্দুবৎ। মাঝগঙ্গায় ভাসছে কিছু নৌকা। ওদের হাতে দুরবীন নেই নিশ্চয়। থাকে থাকুক! দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণব মর্মান্তিক প্রয়োজনে দুই জানুর মধ্যে মাথা গুঁজে নিথর নিস্পন্দ। তৈলঙ্গস্বামী অবশ্য তাকিয়ে আছেন। শিশুর সারল্যে মিটিমিটি হাসছেন, যেন মনে মনে বলছেন, কী? কেমন জব্দ?

হটী বিদ্যালঙ্কার তাতে ভ্রুক্ষেপ করবেন না। বাবা তাকিয়ে থাকেন তো থাকুন। সে তো ঐ শেয়ালগুলোও দূরে দাঁড়িয়ে ওঁর দিকেই তাকিয়ে আছে। উনি তো ওদের দলে! হ্যাঁ, ঐ শৃগালগুলোর সঙ্গে কোন প্রভেদ নেই তৈলঙ্গস্বামীর। নারীপুরুষ ভেদাভেদ-জ্ঞানের একপারে ঐ শিবাকুল, আর-পারে উনি। কেন নয়? ওরা সে ভেদাভেদজ্ঞানের সীমান্তে উপনীত হতে পারে না, আর উনি সে রাজ্যটা অতিক্রম করে এসেছেন—এই যা!

একমাত্র দর্শক ঐ রামলগন। বাবা কথা বলেছেন ঠেট হিন্দিতে; রামলগনের বুঝতে কোন অসুবিধা হয়নি। লোকটা উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে উঠেছে। বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে গেছে তার ভাঙের নেশায় লাল চোখদুটো। না, কামনায় লালায়িত নয় তার অবাক চাহনি। সে চোখে শুধুই দুরন্ত বিস্ময়! হয়তো ভাবছে—য়েকথা আন্দাজ করতে পারছে না রূপমঞ্জরী : তাহলে আর কী ফারাক তৈলঙ্গস্বামীর সঙ্গে রাজাসাহেবের? দুজনেই তো বাধ্য করছে ঐ মেয়েটিকে প্রকাশ্যে উলঙ্গ হতে!

কিন্তু না—রূপমঞ্জরী ভাবে—একটু আগেই ঐ লোকটা বলেছিল—পণ্ডিতমাঈজীর বেইজ্জতির আশঙ্কায় সে মর্মাহত। আত্মগ্লানিতে সে নিজেকে ধিক্কার দিয়েছে! গঙ্গাস্পর্শ করে স্বীকার করেছে সে-কথা। ও লোকটা কি এই কটা নির্মম মুহূর্তে পিছন ফিরে দাঁড়াবে না? চোখ দুটি বন্ধ করবে না? সাধারণ সৌজন্যবোধে? সে তো রূপমঞ্জরীকে মাতৃসম্বোধন করেছে। না! এ প্রার্থনা নিরর্থক! হটী বিদ্যালঙ্কার ভ্রূক্ষেপ করবেন না। যদি তাকিয়ে থাকে তবু ওর চোখের সম্মুখেই তিনি নিরাররণা হবেন। মহাযোগী ইদানীং কাউকে মন্ত্রদীক্ষা দেননি, দেন না—তিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে দীক্ষার প্রশ্নটা উত্থাপন করেছেন। বিদ্যালঙ্কারের এ এক জন্মজন্মান্তরের সুকৃতি! এই দুর্লভপ্রাপ্তির মূল্য কড়াক্রান্তিতে মিটিয়ে দিতে হবে বইকি!

এ ওঁর গুরুদক্ষিণা!

রূপমঞ্জরী—নয় বছর বয়সে যে হতভাগিনী শুভদৃষ্টির ছাদনাতলায় তার হবু বরের দিকে অপরিসীম লজ্জায় চোখ তুলে তাকিয়ে দেখতে পারেনি—তের বছর বয়সে দ্বিরাগমনের পূর্বেই যার সিঁথির সিঁদূর মুছে গেছে—স্বামীকে বস্তুত যে কোনদিন, চোখেই দেখেনি, সে শেষ সিদ্ধান্তে এল।

ঊর্ধ্বাঙ্গ থেকে পাক খুলে খুলে উত্তরীয়টি নামিয়ে রাখেন বালির উপর। পিরানের তলায় কোন অধোবাস নেই—ইদানীং পরিধান করেন না। এক এক করে বন্ধনমুক্ত করে দিতে থাকেন পিরানের বোতাম।

রামলগন—ভাঙের নেশায় মাতাল সেই নোরি-খ্যাপলাজালে আবদ্ধ নিরক্ষর লাঠিয়াল, আত্মধিক্কারে দগ্ধ হয়ে.তিক্তকণ্ঠে যে নিজের পরিচয় দিয়েছিল ‘রামলগন-হারামি’ বলে—সেই লোকটা আর স্থির থাকতে পারল না। আত্মবিস্মৃত হয়ে সে চিৎকার করে ওঠে, নেহী! নেহী! মাতাজী! রোখ্ যাইয়ে!

—আহ্! তুই পিছন ফিরে দাঁড়া না বাপু!

না! কথাটা শুধু ওঁর মনের কোণে উদয় হল মাত্র। জিহ্বা উচ্চারণ করল না। শুধু রামলগনের কণ্ঠস্বরে তাঁর পুনরায় স্মরণ হল—এ কৌরবসভা দর্শকহীন নয়!

না হোক! লজ্জাহারী মধুসূদনকে স্মরণ করবেন না তিনি। শরণ নেবেন না।

‘তস্মৈ তপো দমঃ কৰ্ম্মেতি প্রতিষ্ঠা বেদাঃ সৰ্ব্বাঙ্গানি সত্যজায়তম।।’

“দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের নিগ্রহরূপ তপস্যা, ইন্দ্রিয়সংযমরূপ দম, নিত্য ও নিষ্কাম কর্ম, ঋক প্রভৃতি বেদ, শিক্ষাশাস্ত্র প্রভৃতি বেদাঙ্গ”—সবই তো সেই পরমপ্রাপ্তির আশ্রয়!

দেহের এই লজ্জা, ইন্দ্রিয়ের এই গোপনতা, মনের এই সংশয়ই বড় হবে? ব্রহ্মবিদ্যালাভের চেয়েও বড়? পরমাত্মায় বিলীন হওয়ায় চেয়েও বড়?

একে একে পিরানের সব কটা বোতাম খুলে ফেলেন। যেন নারীদেহের গোপনীয়তার বন্ধন-মুক্তি ঘটছে। মাথার উপর দিয়ে পিরানটা খুলে ফেলার উপক্রম করতেই আকাশ কাঁপিয়ে অট্টহাস্য করে উঠলেন শিশু ভোলানাথ।

কাকের দল উঠে গেল আকাশে। শিবাকুল সচকিতে অন্তর্হিত হল কাশঝোপের আড়ালে। থমকে গেলেন হটী বিদ্যালঙ্কার। ঊর্ধাঙ্গ নিরাবরণ করতে পারলেন না। তাকিয়ে দেখলেন বাবার দিকে। ওঁর এই অহৈতুকী অট্টহাস্যের অর্থটা প্রণিধান করতে।

বাবা সস্নেহ তিরস্কার করেন : পালি কাঁহাকা!

বিদ্যালঙ্কার নির্বাক তাকিয়ে আছেন।

তৈলঙ্গস্বামী হাসতে হাসতে হিন্দিতে বললেন, জবর নাম রেখেছিল তোর বাবা—হটী! খুব বীরত্ব দেখিয়েছিস্! যা! ঘর লৌট যা!

বিদ্যার্ণব এতক্ষণে মুখ তুলে তাকিয়েছেন।

হটী বিদ্যালঙ্কার আকুলভাবে বলে ওঠেন, দীক্ষা দেবেন না আমাকে?

—কৈসে দুঁ? তুই তো এখনো দু-কুড়ি-সাতের খেলাটা সাঙ্গ করতে পারলি না? বেটির ঘাট পার হলে তবে তো বাপের ঘাট? না কী রে পাগলি?

—বেটির ঘাট?

—হাঁ রে বেটি! সরস্বতী মাঈকী! যা ভাগ! ঘর যা!

হটী বিদ্যালঙ্কার অধোবদন হলেন।

বিদ্যার্ণব বুঝে নিয়েছেন—মহাযোগী এতক্ষণ তাঁর আদরের কন্যাটিকে পরীক্ষা করছিলেন মাত্র। তিনি নিজেও মহামহোপাধ্যায়—সাধনমার্গের রীতিনীতি তাঁর নখদর্পণে। প্রণিধান করেন—মহাসন্ন্যাসীর মতে হটী বিদ্যালঙ্কারের মানসিক প্রস্তুতিপর্বের পর্যায়টা এখনো অতিক্রান্ত হয়নি। জমি ‘তর’ না হলে বীজবপন সার্থক হয় না। রূপমঞ্জরী—হটী! বিদ্রোহিণী! নিতান্ত জেদের বশে সে প্রকৃতি-পুরুষ ভেদাভেদ জ্ঞানের সীমারেখাটা অতিক্রম করতে চাইছিল। নারীত্বের সচেতনতা সে অস্বীকার করতে চাইছিল মনের জোরে! এভাবে হয় না! আরও, আরও প্রস্তুতির প্রয়োজন। বাবা প্রতিশ্রুত—নিশ্চয় সময় হলে স্বপ্নাদেশে আহ্বান জানাবেন তাঁর কন্যাকে। উপযুক্ত সময়ে তার কর্ণমূলে প্রদান করবেন : বীজমন্ত্র!

কিন্তু সেসব তো আধ্যাত্মিক জগতের কথা। তার পূর্বে যে ভৌতিক জগতের এক বিরাট অন্তরায়! সেই ক্লেদাক্ত পঙ্ককুণ্ড থেকে উত্তরণটা তো এখনো বাকি। তাই করজোড়ে নিবেদন করেন, বাবা! ওর বিপদের কথাটা তো…

বাক্যটা শেষ হল না। বজ্রনির্ঘোষে গর্জন করে ওঠেন সদাশিব : উল্লু! গির! মূর্খ! মহামহোপাধ্যায় নতমস্তকে স্বীকার করে নিলেন এ তিরস্কার। নীরবই রইলেন তিনি। বাবা নিজে থেকেই বলে ওঠেন, ধুতি-পিরান পরে ও যে পুরুষ সেজেছে! ঔরৎ হয়ে তাই শাঁখ বাজানো ভুলে গেছে!

শাঁখ! শঙ্খ! তার অর্থ? এ অপ্রাসঙ্গিক কথা কেন? চকিতে মনে পড়ে গেল—হ্যাঁ, ওঁর কন্যাটির হেপাজতে একটি দুর্লভ বামাবর্ত শঙ্খ আছে বটে। সেটা সে কীভাবে পেয়েছে তা জানেন না, জানতে চাননি কোনদিন। তবে হ্যাঁ, কোনদিন সেটাকে বাজাতে শোনেননি। বাবার সে কথা জানার সম্ভাবনা নেই—অবশ্য তিনি নাকি অন্তর্যামী। হয়তো জেনেছেন। কিন্তু এ অহৈতুকী তিরস্কারের প্রাসঙ্গিকতা কোথায়?

চকিতে পাশ ফিরলেন। তাকিয়ে দেখলেন কন্যাটির দিকে। এ কী?

কার্যকারণসূত্র কিছু বোঝা গেল না। কিন্তু লক্ষ্য হল, হটি বিদ্যালঙ্কারের দুটি আয়ত চক্ষু বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে গেছে। যেন কী একটা বোধের উন্মেষ হচ্ছে তাঁর মস্তিষ্কে!

আবার তাকিয়ে দেখলেন তৈলঙ্গস্বামীর দিকে। দেখলেন, মিটিমিটি হাসছেন তিনি। সহস্যে ধর্মোপদেশ দিচ্ছেন বিদ্যালঙ্কারকে : জীবাত্মাকে বন্দী করে রাখতে নেই—মুক্ত নীলাকাশের দিকে, পরমাত্মার দিকে মিলিত হবার সাধনা তার! ক্যা রে বেটি? সমঝি?—বলেই ধ্যানস্থ। সমাধি!

সাষ্টাঙ্গে লুটিয়ে পড়লেন বিদ্যালঙ্কার বালিয়াড়ির উপর। তাঁর দু-গালে তখন দরবিগলিত ধারা।

2 Comments
Collapse Comments

এখানে তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

বাংলা লাইব্রেরি (Administrator) February 2, 2024 at 12:29 am

সরি, এবার ঠিক করে দেয়া হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *