৫
দেখতে দেখতে দশটা দিন কেটে গেল। সূর্যদেব কুম্ভরাশি ত্যাগ করে মীনরাশিতে সংক্রামিত হয়েছেন। কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়ার গাছগুলি ফুলের ভারে আনত আম্রমুকুলের গন্ধে আকাশ-বাতাস আমোদিত। কোকিলের কণ্ঠে শোনা যায় বসন্তের পুনরাগমনবার্তা!
গঙ্গাবক্ষে ভেসে যায় বড় বড় মহাজনী নৌকা। কাশীর গঙ্গাঘাটের দৃশ্যে কোনও পরিবর্তন হয় না। পালোয়ানেরা প্রত্যুষে ডন-বৈঠক করে, সন্ন্যাসী অবধূতেরা ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে থাকেন। কুলরমণীর দল অবগুণ্ঠনে মুখ ঢেকে টুপ-টুপ ডুব দেয়; আর কিশোর দল জলে ঝাঁপাই জোড়ে।
খবরটা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র।
গোপন রাখার কোন চেষ্টাও করেনি রাজাসাহেব। সে চায় এ নিয়ে আলোচনা হক। লোকে জানুক, বুঝুক—সামাজিক বিধান অস্বীকার করলে সমাজ কী জাতের শাস্তি দেবে। সমাজ যদি সাহস না পায় তাহলে রাজশক্তি এসে কীভাবে সমাজপতিদের দায়িত্ব নিতে পারে।
পথেঘাটে এটাই আলোচ্য বিষয়। কেউ বলেনি খবরটা গোপন রাখতে। তবু সেটাকে গোপন রাখতে সবাই উৎসাহী। সবাই বলে, তোমাকেই শুধু বললাম ভাই, দেখ, পাঁচ-কান কর না।
একদিন জগমোহন পণ্ডিত গোপনে এসে দেখা করলেন বিদ্যার্ণবের সঙ্গে। তাঁর চরণদুটি ধরে বললেন, বিশ্বাস করুন পণ্ডিতমশাই। এ আমরা চাইনি, চাই না। এ কী বীভৎস অত্যাচার! এ কী হয়ে গেল! আমরা রাজাসাহেবের কাছে এ নিয়ে দরবার করতেও গিয়েছিলাম, তিনি কর্ণপাত করলেন না।
বিদ্যার্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, পিশাচসিদ্ধ হতে চাইলে এ রকম পরিণামই হয় তর্কবাগীশ! তোমরা ন্যায়ধর্মকে অতিক্রম করতে চেয়েছিলে পিশাচের পাশবিক বৃত্তিকে উজ্জীবিত করে! এখন সেই তামসশক্তি তোমাদের ক্ষমতার বাইরে।
বিষয়টা নিয়ে অসিঘাটের বাগানবাড়িতেও আলোচনা হয়। আড্ডাধারী বলে, কাজটা তুমি ভালো করনি বয়স্য!
—ভালো করিনি? কী বলতে চাইছ তুমি?
—না, না,। সে কথা বলছি না! আমি বলতে চাইছি উনিশটা দিন ওকে সময় দেওয়াটা উচিত হয়নি। সেদিনই ওকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে আসা উচিত ছিল এই বাগানবাড়িতে! রাজাসাহেব পানপাত্রটা পূর্ণ করার অবকাশে বলেন, তুমি মূর্খ! এই জন্যেই সারাটা জীবন শুধু মোসায়েব হয়েই কাটালে! কোন দায়িত্বপূর্ণ পদে তোমাকে গদিয়াল করে দিতে পারলাম না!
—তার মানে?
—বুঝলে না? আমি যদি সেদিনই ঐ মাগীটাকে দড়িদড়া দিয়ে বেঁধে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসতাম, সে রাত্রেই ওর ধর্মনষ্ট করতাম তাহলে সারা রাজ্যের লোক বলত—রাজাসাহেব কামোন্মত্ত হয়ে একাজ করেছে! ঠিক কি না?
—সে কথা বলতে পার!
—দ্বিতীয়ত, বাদশাহ জাহাঙ্গীরের কথা ভেবে দেখ। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন—মৃতপশুর দেহের খোলে ঐ দুই বিদ্রোহীকে এমনভাবে সেলাই করতে হবে যাতে তারা তৎক্ষণাৎ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা না যায়। যেন সমস্ত দিন গো-শকটের উপর ঐ দুটো মৃতপশু ধড়ফড় করতে থাকে! কেন? যাতে সমস্ত শহর সে দৃশ্যটা দেখতে পায়! যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ বিদ্রোহের কথা চিন্তাও করতে না পারে! আমিও তাই চাই—এই উনিশ দিন ধরে ঘরে ঘরে ঐ কথা আলোচনা হক। সে মাগীও পক্ষকাল ধরে ধড়ফড় করুক! শিরশ্ছেদ তো মুহূর্তে ঘটে যায়—শাস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায়—মেয়াদটা দীর্ঘায়ত করে। এ অতি কঠিন কুটিল কৌটিল্য-নীতি, বয়স্য!
কাব্যতীর্থ ফোড়ন কাটে, ন্যায্য কথা। একটা উপমা দিয়ে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা যায়। ধর কৈ মাছ! বাজার থেকে কিনে এনে তাকে তৎক্ষণাৎ রন্ধন করলে সেই স্বাদ পাওয়া যায় না, যা পাওয়া যায় জিয়োনো কৈ-এ! কিন্তু একটা কথা রাজাসাহেব। মনে আছে নিশ্চয় শিবাজী-মহারাজের কথা! আফজল খাঁর সঙ্গে তাঁর সেই একান্ত সাক্ষাৎ? তুমি এই বাগানবাড়িতে বিদ্যালঙ্কারের সঙ্গে দ্বৈরথ-সংগ্রামে ব্রতী হতে চাও—ভাল কথা; কিন্তু তার পূর্বে আমাকে অনুমতি দিতে হবে। অর্গলবদ্ধ-কক্ষে মেয়েটিকে প্রবেশ করতে দেওয়ার পূর্বে আমি তার সর্বাঙ্গ তল্লাসী করে দেখব—তার কাঁচুলীর ভিতর বা ঘাঘরার নিচে কোনও অস্ত্র লুকানো আছে কিনা।
বটু বললে, তল্লাসীর কাজটা আমরা ভাগাভাগি করে সারতে পারি। আপনি লম্বা মানুষ—প্রথম দায়িত্বটা নিলে, দ্বিতীয়টা আমিই নিতে পারি।
রাজাসাহেব মনে মনে হাসলেও মুখে বিরক্তি প্রকাশ করলেন, তোমাদের সব তাতেই ঐ এক অশ্লীল রসিকতা! আমার উদ্দেশ্যটা তোমরা আদৌ বুঝতে পারনি। আমাকে এ কাজটা করতে হচ্ছে নিতান্ত কর্তব্য হিসাবে। সামাজিক দুর্নীতি দূরীকরণে দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাকে এ জাতীয় কর্তব্য পালন করতে হয় বলে। কখনো বা নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও।
বয়স্যরাও মনে মনে হাসে। তবে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। রাজাসাহেব যদি নচের আড়াল দিয়ে তামাক সেবন করতে চান তাহলে তাঁর বেতনভুক মোসায়েব হিসাবে ওদের ভান করতে হবে যে, নচের আড়াল পড়ায় দৃশ্যটা দেখা যাচ্ছে না।
কাব্যতীর্থ বললে, সে-কথা ঠিক! কিন্তু আমি একটা খবর পেয়েছি রাজাসাহেব। আপনার রাজাদেশটা বিদ্যালঙ্কার মানছে না। সে নাকি এখনো তার মাথা কামিয়ে চলেছে! এটা মূল অপরাধের অতিরিক্ত। এ পাপের শাস্তিবিধানের দায়িত্বটুকু কি আপনি আমাদের ভাগাভাগি করে নিতে দেবেন? আমাকে আর বটুকে?
রাজাসাহেব বলেন, তোমাদের কিছু করতে হবে না। খবরটা আমার অগোচর নয়। ব্যবস্থা আমি নিয়েছি ইতিমধ্যে। কাশীশ্বরী যাত্রাপার্টির অধিকারীকে নির্দেশ পাঠিয়ে দিয়েছি—চৈতালী পূর্ণিমার সন্ধ্যায় সে আমাকে একটি সুদৃশ্য সুগন্ধী পরচুলা পাঠিয়ে দেবে। এই বাগানবাড়িতে।
আড্ডাধারী জানতে চায়, কিন্তু সেদিন সেই যে শোভাযাত্রার কথা বলেছিলেন তার তো কোনও উদ্যোগ দেখছি না? বিদ্যালঙ্কার—তোমার সঙ্গে দ্বৈরথসমরে জয়ী হোক আর পরাজিত হক—তাকে যে ঢাক-ঢোল-শিঙা বাজিয়ে রন্ডিবাজারে পাঠিয়ে দেওয়া হবে তার কী আয়োজন হল?
রাজাসাহেব বললেন, না! সে সিদ্ধান্ত আমি পরিবর্তন করেছি। কুলীন ব্রাহ্মণের বিধবা সহমরণে যেতে ভয় পেলে তার কী অন্তিম পরিণতি হয় এটা সমাজকে বুঝিয়ে দেবার পর মেয়েটির মৃতদেহ গঙ্গাবক্ষেই নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি।
তিন বয়স্য নীরব থাকে। রসিকতা করতেও ভুলে যায়! স্তব্ধতা ঘনিয়ে আসে।
ওরা কিন্তু আদৌ বুঝতে পারেনি কেন এই পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত। সে প্রশ্নটা ওরা উত্থাপন করতেও ভুলে যায়। মৃত্যুর এমনই মহিমা।
পুরন্দর, আগেই বলেছি, ধুরন্ধর।
সে অনেক কিছু ভেবে দেখেছে।
তার আশঙ্কা হয়েছে—হয়তো ঐ পাশবিক শোভাযাত্রায় বিপরীত প্রতিক্রিয়া হবে। লোকচক্ষুর অন্তরালে একটি রমণীর ধর্ষিতা হওয়ার সংবাদ মানুষে সহজে ভুলে যায়; কিন্তু বিবস্ত্রা একটি যুবতীকে জনবহুল সড়ক দিয়ে পদব্রজে অগ্রসর হতে স্বচক্ষে দেখলে দৃশ্যটা মানুষে ভুলতে পারে না। কাশীর প্রজাসাধারণের মধ্যে শুধুমাত্র পাষণ্ডই নেই, আছেন মহামান্য অসংখ্য পণ্ডিত। হয়তো বিদ্রোহ ধূমায়িত হয়ে উঠবে ঐ জ্ঞানী মানুষগুলির অন্তরেই। ওদের তীরধনুক-বল্লম-তরবারী নাই—কিন্তু ‘ব্রহ্মশাপ’-এর ব্রহ্মাস্ত্র আছে! তাঁরা যদি সমবেতভাবে নিদান হাঁকেন তাহলে রাজাসাহেবের গদিও হয়তো টলে উঠবে।
রাজাসাহেব বিকল্প ব্যবস্থা করেছে। বয়স্যদের কাছেও সংবাদটা গোপন রেখেছে। জানে ওর দুএকটি অত্যন্ত বিশ্বস্ত অনুচর—রামলগন, ভিখন আর ছেদীলাল। স্থির হয়েছে ঐ মেয়েটিকে এই বাগানবাড়ির একটি কক্ষে পক্ষকাল বন্দিনী করে রাখা হবে। নিত্য সন্ধ্যায় তাকে উপস্থিত করা হবে রাজাসাহেবের শয়নকক্ষে। পক্ষকালের নিত্যধর্ষণ!
‘গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ় যাবন্মধু পিবাম্যহম্’।
বিগতভর্তা যৌবনবতীর জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে এই পক্ষকালকে ‘ক্ষণ’ বলা অযৌক্তিক নয়! অসহায় ধর্ষিতা নারীর গর্জন পাষাণ প্রাচীরের বাহিরে শোনা যাবে না—রাজাসাহেব নিশ্চিন্তে মধুপান করতে পারবে। তারপর, ওর মাথায় কিছু চুল গজালেই—না, গঙ্গাবক্ষে তার মৃতদেহটি নিক্ষিপ্ত হবে না; তাকে রাতারাতি বজরায় চাপিয়ে রওনা দেবে দক্ষ লাঠিয়াল রামলগন। পূর্ব মুখে। পৌছে দেবে এলাহাবাদ ক্যান্টনমেন্টে। মেজর কিপ্যাট্রিকের খিদমতে।
কাশীরাজ একটি ক্রীতদাসীকে উপঢৌকন পাঠিয়েছেন। কিলপ্যাট্রিক একদিন, শ্যাম্পেনের নেশার ঝোকে সক্ষেদে বলেছিল, এ দেশীয় ক্রীতদাসী, কবি অথবা উপপত্নীতে তার মন ভরে না—সব ‘কালা ঔরৎ’!
রাজাসাহেব ওকে খুশি করে দেবে এতদিনে! দ্যাখ শালা! এ কালা-আদমির দেশেও পদ্মফুল ফোটে!