৩
দুর্গাবাড়ির দিকে যাওয়ার পথে আম-জাম-কাঁঠাল গাছের ছায়া-সুনিবিড় একটি বিঘে-তিনেকের বাগান। এই ব্রহ্মোত্তর ভূখণ্ডেই দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণবের গুরুকুল-চতুষ্পাঠী। ছাত্রসংখ্যা এত বেশী যে, গৃহাভ্যন্তরে জ্ঞানচর্চা সম্ভবপর নয়। শুধু বর্ষাকালের কয়েক মাস বাগানে বসা যায় না। বৎসরের বাকি সময়কালে অধয়ন-অধ্যাপনের আয়োজন উপনিষদী ঢঙে—গাছের ছায়ায়।
দুজন সুবেশ অশ্বারোহী রাজপুরুষ যে কঞ্চির বেড়া-দেওয়া বাগানের বাহিরে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করেছে এটা নজর হয়নি বিদ্যার্ণবের ওরা ‘কেন’ এসেছে—এই সামান্য প্রশ্নটাকে অতিক্রম করে বোধকরি সে সময় উনি আর একটি
উত্তর খুঁজছিলেন : ‘কেনেষিতং পততি প্রেষিতং মনঃ/কেন প্রাণঃ প্রথমঃ (কেন প্রাণ ‘তার প্রথম বেগ নিয়ে পৃথিবীতে এল, ইত্যাদি)।
অসামান্য ‘কেন-’র প্ৰৈতি যুক্তঃ।।’
নজর হল একটি শ্যামবর্ণ কিশোর ছাত্রের। সে দ্রুতপদে অগ্রসর হয়ে এল যুগল অশ্বারোহীর সমীপে। যুক্তকরে অভিবাদন করে বললে, আপনারা নিশ্চয় পথশ্রমে ক্লান্ত, আসুন আমাদের গুরুকুল-আশ্রমের আতিথ্য গ্রহণ করুন।
আড্ডাধারী বলে ওঠে, না হে ছোকরা, আমরা আদৌ পথশ্রান্ত নই। একটা কথা বলতে পার? হটী বিদ্যালঙ্কারের চতুষ্পাঠী কোনটা?
—এটাই। আসুন, ভিতরে আসুন ….
—কিন্তু ঐ যে লোকটা ছাত্তরদের ঠেঙাচ্ছে ও তো বুড়ি নয়, বুড়ো!
ছেলেটি মর্মাহত হল। বুঝল, আগন্তুকের কোন শিক্ষাদীক্ষা নেই। ‘ছাত্তর-ঠ্যাঙানো একটা প্রাকৃতজনভাষ—যার অর্থ বিদ্যাদান করা। বললে উনি আমাদের গুরুদেব, মহামহোপাধ্যায় দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণব। মা আজ অনুপস্থিত। তাই গুরুদেব স্বয়ং …
অড্ডাধারী বললে, অ! তা তোমার ঐ গুরুঠাকুরকে বল একটু করুণা করতে। উনি তো আমাদের মতো চুনোপুঁটির দিকে চোখ তুলে নজরই করছেন না।
কিশোর আশ্রমিক বলে, আজ্ঞে হ্যাঁ, উনি এই সময় একেবারে তন্ময় হয়ে যান। আসুন, আশ্রমের ভিতরে আসুন, পদপ্রক্ষালনের জন্য …
আড্ডাধারী খিঁচিয়ে ওঠে, ক্রমাগত একই কথা ঘ্যানর ঘ্যানর কর না তো হে ছোকরা। তোমাকে যা বলছি কর। তোমার ঐ গুরুঠাকুরকে উঠে আসতে বল।
ছাত্রটি নতমস্তকে বিদ্যার্ণবের দিকে অগ্রসর হয়ে যায়।
ওরা দুজনও গুটিগুটি এগিয়ে আসে।
এতক্ষণে বিদ্যার্ণবের নজরে পড়ে। গাত্রোত্থান করে তিনি অগ্রসর হয়ে আসেন, এস, এস, বস’ তোমরা।
পুরন্দর বুঝতে পারে বৃদ্ধ ওকে শনাক্ত করতে পারেনি। তাই বয়সের পার্থক্য বিচার করে এই ‘তুমি’ সম্বোধন। বললে, বসতে আমরা আসিনি পণ্ডিতমশাই। দু একটা কথা জানতে এসেছি শুধু। প্রথম কথা, এ চতুষ্পাঠীর মালিক কে? আপনি, না হটী বিদ্যালঙ্কার?
বিদ্যার্ণব প্রশান্ত হাসলেন। বললেন, মালিকানা স্বয়ং বাগদেবীর। আমি এতদিন ছিলাম তাঁর সেবায়েত। বর্তমানে আমার কন্যাটি সে দায়িত্ব নিয়ে আমাকে অবসর দিয়েছে।
—বটে! তা হলে সে কই? আপনি ক্লাস নিচ্ছেন কেন?
‘ক্লাস নেওয়া’ ক্রিয়াপদের অর্থ নিশ্চয় ছাত্রদের বিদ্যাদান। বৃদ্ধ বললেন, আজ একাদশী তিথি বাবা। মাসের এ দুটি দিন আমি তাকে—কী বলে-ভাল ‘ক্লাস’ নিতে দিই না।
—কেন? ত্রয়োদশীতে অলাবুভক্ষণের মতো কি একাদশীতে ক্লাস নেওয়া বারণ? বৃদ্ধ প্রণিধান করতে পারেন না এ জাতীয় ব্যঙ্গোক্তির অর্থ কী! গম্ভীর হয়ে বলেন, আজ যে সে নিরম্বু-উপবাস করছে।
—নাকি? তাহলে একাদশীটা অন্তত সে করে? তা পণ্ডিতমশাই, আপনি সম্ভবত আমাকে চিনতে পারেননি। আমার পিতৃদত্তনাম পুরন্দর ছেত্রী।
—কেন চিনব না বাবা? তুমি তো স্বনামধন্য…
খুশিয়াল হয়ে উঠতে শুরু করেছিল পুরন্দর। প্রদীপটা দপ করে নিভে গেল বাক্যটা সমাপ্ত হলে।
—স্বনামধন্য স্বর্গত কাশীনরেশের দেহান্তে নাবালকের তরফে রাজকার্য পরিচালনা করছ।
পুরন্দর গম্ভীর হয়ে বললে, হ্যাঁ, তাই করছি। জানেন নিশ্চয়, রাজার কর্তব্য হচ্ছে শিষ্টের পালন আর দুষ্টের দমন। এবার বলুন তো পণ্ডিতমশাই, এই বুড়ো বয়সে ঐ দুষ্টামির ধাষ্টামো কেন চাপলো আপনার ঘাড়ে?
বিদ্যার্ণব স্তম্ভিত! তিনি কাশীধামের একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় মহামহোপাধ্যায়, এই দুর্বিনীত লোকটা কি ভদ্রভাবে বাক্যালাপ করতেও শেখেনি?
—কী মশাই? ন্যাকা সাজতে চাইছেন মনে হচ্ছে! যেন বুঝতেই পারছেন না, আমি কী বলছি!
বৃদ্ধ গম্ভীরভাবে বলেন, আমি সত্যই অনুধাবন করতে পারছি না…
—আপনার বুঝে কাজ নেই। আপনার পালিতা কন্যাটিকে পাঠিয়ে দিন। বোঝাপড়া তার সঙ্গেই হবে।
—এখনই তো বললাম সে কথা। আজ একাদশী…..
বাক্যটা সমাপ্ত হল না। নজরে পড়ে—পর্ণকুটিরের দ্বার উন্মোচন করে ধীরপদে অলিন্দে বাহির হয়ে এসেছেন তাঁর কন্যাটি। পরিধানে ধুতি, ঊর্ধ্বাঙ্গে গেরুয়া-রঙের আলখাল্লা ধরনের একটি পোশাক। তদুপরি উত্তরীয়। শান্তকণ্ঠে বলেন, কী চান আপনারা?
পুরন্দর মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। মহিলাটির বয়স ওর চেয়ে কিছু কম—অনুমান ত্রিংশতি বর্ষ। উজ্জ্বল গৌর বর্ণ, আয়ত চক্ষু, বুদ্ধিদীপ্ত একটি আভা। সর্বোপরি যেটা নজরে পড়ে তা ওর ব্যক্তিত্ব। ওর ঐ অপ্সরী-বিনিন্দিত রূপকে ছাপিয়ে সেটা যেন হীরকখণ্ডের দ্যুতির মতো বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। পানগুবাক নিশ্চয় সেবন করে না—বিধবা সে, তাহলে ওর ওষ্ঠাধর কী করে হয় অমন রক্তিম বর্ণের? শুধু ব্যক্তিত্ব নয়, ওর সর্বাবয়ব ভেদ করে যেটা বিচ্ছুরিত হচ্ছে তার সঙ্গে মিশে আছে কিছু দাও। রাজাসাহেব নামক জীবটিকে সে যেন ভ্রুক্ষেপই করতে চাইছে না। একটা বিরক্তিকর মক্ষিকা যেন! পুরন্দর ওকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললে, চাই অনেক কিছুই। সর্বপ্রথমে চাই একটা কৈফিয়ৎ। তুমি সেই সুদূর বঙ্গদেশ থেকে এখানে মরতে এসেছ কেন?
‘তুমি’ সম্বোধনটা অবমাননাকর কিনা এ প্রশ্ন যেন জাগলই না বিদ্যালঙ্কারের মনে। মক্ষিকার ধর্মই তো ভ্যানভ্যান করা। মাথা খাড়া রেখেই বললেন, মরতে তো আসিনি। এসেছিলাম বাঁচতে। তবে অন্তিমে যখন মরতে হবেই তখন কাশীধামই তো সেক্ষেত্রে কাম্য!
‘হটি’! ‘হটি’ মানে কী? পুরন্দর ভাবছে। প্রয়াগ ক্যান্টনমেন্ট-এ কয়েকটি ইংরাজ সৈনিকের সঙ্গে দোস্তি হয়েছে। অল্প-বিস্তর ইংরাজি শব্দ রপ্তও হয়েছে। ওর মনে পড়ল—ফেরঙ্গভাষায় হট’ মানে উত্তপ্ত, গরম। তাহলে ‘হটি’ অর্থে—গরমাগরম! ‘অমৃতে’র চাট যেমন বেগুনি-ফুলুরি। নামটা সার্থক! বললে, তুমি ধুতি পরে আছ কেন?
—আপনার তাতে আপত্তি আছে?
—আছে। আলবৎ আছে। লোকাচার ঠিক মতো পালিত হচ্ছে কিনা রাজাকেই দেখে নিতে হয়।
—’রাজাকে’! রাজা কে?
বিদ্যার্ণব তাড়াতাড়ি অন্বয়-ব্যাখ্যা দাখিল করতে তৎপর হয়ে ওঠেন, উনি পুরন্দর ক্ষেত্রী। স্বর্গত কাশীনরেশের ভাগিনেয়। নাবালকের তরফে…
—ও! ‘তরফে’! তা বেশ, রাজসরকারের যদি আপত্তি থাকে তাহলে আমি স্ত্রীলোকের পাশাকই পরিধান করব অতঃপর।
পুরন্দর বিচিত্র হেসে বলে, অত সহজে তো মিটবে না সুন্দরি! চতুষ্পাঠীতে এই সব সমবয়সী পুরুষ ছাত্রদের নিয়ে রাসলীলাও চলবে না।
বিদ্যালঙ্কারের মুখে রক্তিমাভা। লোকটার ‘তুমি’ সম্বোধন তিনি অগ্রাহ্য করেছিলেন। কিন্তু এই ‘সুন্দরি’ সম্বোধন এবং ঐ অশ্লীল ইঙ্গিত কি প্রতিবাদযোগ্য নয়? কিন্তু তিনি কিছু বলার পূর্বেই বিদ্যার্ণব কথা বলে ওঠেন। ইতিমধ্যে নিজের অজ্ঞাতেই তিনি নিজে কিন্তু ‘তুমি’ থেকে ‘আপনি’তে উঠে এসেছেন। বলেন, আপনি বোধহয় জানেন না, এ নিয়ে সম্প্রতি একটি বিচারসভা হয়েছিল। কাশীর পণ্ডিতসমাজ সর্ববাদীসম্মতভাবে—
হুঙ্কার দিয়ে ওঠে পুরন্দর, আপনি থামুন! মেলা পণ্ডিত্যেমি করতে আসবেন না! আপনিই তো যত নষ্টের গোড়া।
বিদ্যার্ণব স্তম্ভিত!
আশ্রমিক ছাত্ররা শ্রুতিসীমার বাহিরে। তারা নিজ নিজ পাঠাভ্যাসে মগ্ন। কিন্তু ঘনিয়ে এসেছে রমারঞ্জন ভট্টশালী—বিদ্যার্ণবের আর এক প্রিয়শিষ্য। প্রায় হটী বিদ্যালঙ্কারের সমবয়সী ও সহাধ্যায়ী। সে দৃঢ়স্বরে প্রতিবাদ করে ওঠে, আপনি সংযতভাবে বাক্যালাপ করুন মহাশয় বিস্মৃত হবেন না—যাঁর সঙ্গে কথা বলছেন তিনি কাশীধামের একজন মহামহোপাধ্যায়।
আড্ডাধারী একটা বিভৃম্ভণ বিতারণ করে বলে ওঠে, এই আর এক ভেজাল জুটল! নাও হে বয়স্য, তোমার যা কাজের কথা আছে চটপট সেরে নাও।
বিদ্যালঙ্কারের নাসারন্ধ্র স্ফুরিত হয়ে ওঠে! অগ্নিবর্ষী দুটি চক্ষু ঐ রাজাসাহেবের দিকে মেলে বলে ওঠেন, আপনাদের দুজনের কোমরবন্ধে তরবারি আছে। আশ্রমিকেরা নিরস্ত্র। এটাই কি আপনাদের দুজনের স্বপক্ষে একমাত্র যুক্তি? ভুলে যাবেন না—কাশীর পণ্ডিতসমাজ বিধান দিলে ঐ নাবালকের ‘তরফে’ রাজাগিরি করার মেয়াদ কিন্তু আপনার ফুরিয়ে যাবে।
পুরন্দরের মনে পড়ে গেল মেজর কিলপ্যাট্রিকের কথা। প্রয়াগ ক্যান্টনমেন্টের সেই দুর্ধ সৈনিকটি। সে বলেছিল—দিগ্বিজয়ী সেকেন্দার শাহর নাকি অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল বন্য ঘোটব বশে আনানোর ব্যাপারে। পুরন্দরের সে অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু বন্য ঘোটকীকে যদি রজ্জুবদ করে ফেলা যায়, তখন কি তার পিঠে সওয়ার হওয়া যায় না? পিরান চড়িয়ে আর মাথা কামিে তো তোমার নারীত্বকে লোপ করতে পারনি সুন্দরি! নির্জন অর্গলবদ্ধ কক্ষে পুরুষের পরুষবাহু নিষ্পেষণে দম যখন বন্ধ হয়ে আসবে তখনো কি বজায় থাকবে তোমার তেজ? দেখতে হবে
পুরন্দর সংস্কৃতজ্ঞ নয়। তবে নিত্য শুনে শুনে চণ্ডীর দুচারটি শ্লোক তার আয়ত্তে। সহাসে বললে, ‘গর্জ! গর্জ! ক্ষণং মূঢ়ঃ! যাবন্মধু পিবাম্যহম্!’
—তার অর্থ?
—অর্থ প্রাঞ্জল। অস্ত্র নয়, যুক্তিতর্কই করব, সুন্দরি! তুমি যতক্ষণ না দ্বন্দ্বযুদ্ধে আমাকে পরাস্ত করতে পারছ ততক্ষণ তোমাকে আমার এই কাশীধামে টোল খোলার অনুমতি আমি দিতে পারি না। পাতসাহী মিলবে না!
বিদ্যালঙ্কার সবিস্ময়ে বলেন, আপনি শাস্ত্রজ্ঞ? তর্কশাস্ত্রের রীতিনীতি জানেন?
—সেটা তোমার আমার দ্বৈরথসমরে প্রমাণিত হবে, সুন্দরি!
হটী বিদ্যালঙ্কার ঘৃণায় মুখ সরিয়ে নিলেন। অন্যদিকে ফিরে বলেন, বেশ। তাই যদি আপনার অভিরুচি, তাহলে আমি সম্মত। বলুন, কবে? কোথায়?
—আজ থেকে উনিশ দিন পরে। আগামী চৈতালী পূর্ণিমারাত্রে। অসিঘাটে আমার বাগানবাড়িতে।
—বাগানবাড়িতে!
—হ্যাঁ, দ্বৈরথ-সমরের পক্ষে স্থানটা মনোরম! আশেপাশে জনমানব নেই—যারা তোমার ‘গর্জনে’ অথবা আমার ‘মধুপানে’ বাধা সৃষ্টি করতে পারে। সে দ্বৈরথযুদ্ধে শ্রোতৃবৃন্দ বা দর্শক, কেউ থাকবে না—শুধু তুমি আর আমি। বিচারক থাকবেন, তবে তাঁকে চর্মচক্ষুতে দেখা যাবে না। কারণ তিনি ‘অনঙ্গ’!
হটী বিদ্যালঙ্কারের বাক্যস্ফুর্তি হল না।
—এবার বুঝতে পারছ, সুন্দরি? প্রতর্কের বিষয় : ‘কুলীনঘরের ব্রাহ্মণের বিধবা সহমরণে যেতে ভীতা হলে তার কী অন্তিমগতি হয়!’ একটা রাজাদেশ শুধু জানিয়ে যাই : এই উনিশ দিন তুমি মাথা কামাতে পারবে না। ন্যাড়ামণ্ডির সঙ্গে দ্বন্দযুদ্ধটা আমার লা-পসন্দ! আড্ডাধারী। আমার যা বলার ছিল, তা বলা শেষ হয়ে গেছে।
ওরা দুজন ধীরপদে নির্গমন-দ্বারের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
শুধু বিদ্যালঙ্কার একা নন্, বিদ্যার্ণব এবং ভট্টশালীও বজ্রাহত!