হলুদ চাঁদ এবং একপাত্র খুশি

হলুদ চাঁদ এবং একপাত্র খুশি

স্টেশনের নাম হেহেগাড়া। দু-পাশে খাড়া পাহাড় নিবিড় জঙ্গলাকীর্ণ। লাল ধুলোর ঝড় উড়ছে চৈত্র মাসের হাওয়ায়। বহুবর্ণ শুকনো পাতার হাওয়ার সওয়ার হয়ে বিভিন্ন দিকে চলছে।

প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করছিলাম। একবারে জনশূন্য। স্টেশনমাস্টার একা তাঁর ঘরে ফতুয়া গায়ে টক্কাটরে টক্কাটরে করছেন। সিগনালম্যান তার নীল জামাটা গায়ে চাপিয়ে, হাতে তারের চাকতিটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইঞ্জিনের ড্রাইভারকে দেবে। দু-এক জন আদিবাসী লোক শুয়ে-বসে আছে স্টেশনের পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায়। একমাত্র ডালটনগঞ্জ ছাড়া বোধ হয় পালামৌর এই জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ময় রেলস্টেশনগুলোর একই ছবি।

ট্রেন এসে গেল। সিগনাল ডাউন হয়েছে। সৌমেনকে নিতে এসেছি আমি। আমি এখানে বাঁশের ঠিকাদারের ম্যানেজার হয়ে আসার পর এক বছর কেটে গেছে। অনেক বন্ধুই লিখেছিল আসবে বলে কিন্তু শেষপর্যন্ত এই পান্ডববর্জিত দেশে জংলি জায়গায় কেউই আসেনি। আজ সৌমেনও যে আসছে তা নিছক আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য নয়। ওর শিকারের শখ প্রচন্ড। তাই শিকারে আসছে এখানে। রথ দেখা, কলা বেচা দুই-ই হবে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম। আমার অন্য কোনো বন্ধুই এখানে এল না। শেষপর্যন্ত সৌমেনই আসছে। অথচ যার সঙ্গে আমার কোথাও এতটুকু মিল নেই। ও একেবারে খরস্রোতা ছেলে। বিচিত্রবীর্য। জীবনে কোথাও কোনো বাধা বা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। ওর যৌবনের তেজও কিছুটা নগ্ন প্রাচুর্যে ও নিজের লক্ষ্যে পৌঁছেছে। ও আজকে একজন রীতিমতো কৃতী ছেলে। ডাকসাইটে ইঞ্জিনিয়ার। এমন প্রতিভাবান ছেলে নাকি ওর উপরওয়ালারা দেখেনইনি আজ পর্যন্ত। আর আমি সাইকোলজিতে এম.এ. পাশ করে আজকে বাঁশের ঠিকাদারের ম্যানেজারি করছি পালামৌর গভীর জঙ্গলে। সে জঙ্গল আমার ভালো লাগে না। যার সঙ্গে আমার কোনো আত্মিক যোগ নেই। কলকাতার ছেলে আমি। আজীবন যেখানে মানুষ, সেখান থেকে আমার জীবিকা আমায় উপড়ে এনে এই জংলি জায়গায় ফেলেছে। আমার দম বন্ধ হয়ে যায়। নেহাত পেটের দায়ে পড়ে আছি। এই ঠিকাদারের ম্যানেজারকে সৌমেন যে মনে করেছে এইটে ভেবেই খুশি খুশি লাগছে। থাকলেই-বা ওর অন্য উদ্দেশ্য। তবু আমার কাছে তো আসছে।

ট্রেনটা যখন সত্যিই ধুলোর ঝড় উড়িয়ে স্টেশনে ঢুকল, তখন বেশ আনন্দই হল। যাক, সৌমেন তাহলে সত্যিই এল। ফার্স্টক্লাসের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল সৌমেন। পরনে ট্রাউজার এবং চেক চেক হাফ শার্ট। চোখে সানগ্লাস। মুখে পাইপ। সুন্দর দীর্ঘদেহী সুপুরুষ। একমাথা চুল উলটো করে ফেরানো। ট্রেনটা থামল। গাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে সৌমেনের কাছে বেঁটেখাটো রোগা-পাতলা আমি যেন কেমন মিইয়ে গেলাম। আমার হীনম্মন্যতাটা যেন নতুন করে সিন্ধবাদ নাবিকের মতো আমার কাঁধে চেপে বসল।

ট্রেন থেকে নেমে, আমার কাঁধে ওর বলিষ্ঠ হাতের এক চাপড় মেরে বলল, ‘কী রে কবি, কেমন আছিস?’

মিন মিন করে বললাম, আছি, এই পর্যন্ত। সৌমেনের এই ছোটোবেলার অভ্যেস। মুখ এবং হাত সমানে চলে। আমার কাছে এটা এক ধরনের ক্রুডনেস ছাড়া আর কিছুই নয়। যতই কৃতী হোক-না-কেন সৌমেন, ওরমধ্যে রিফাইনমেন্টের অভাব আছে। এটা আমার বরাবরের ধারণা। এবং এরকম সশব্দ আমার আদপে পছন্দ নয়। তবু কী করে যে আজ অবধি বন্ধুত্বটা টিকে রইল তাও বুঝতে পারছি না। টিকে রইল, তার কারণ বোধ হয় সৌমেনই ভাঙতে দেয়নি। যতই দোষ থাক, একটা গুণ আছে ছেলেটার। কখনো কোনো ভুল করলে, সঙ্গে সঙ্গে দোষ স্বীকার করে নিতে পারে। তা যদি না থাকত তবে তো শর্মিলার ব্যাপার নিয়ে আমাদের সম্পর্ক চুকেবুকে যেত। সেসব কত বছর হয়ে গেল ভাবলে আশ্চর্য লাগে।

আমাকে আবার ধাক্কা দিয়ে সৌমেন বলল, কী রে, এই কাঠফাটা রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে থাকবি, না যাবি? আচ্ছা কবির পাল্লায় পড়লাম যা হোক।

প্রায় স্বপ্নোত্থিতের মতো বললাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, চল চল।’

জিপে উঠে বসলাম। স্টেশন থেকে আমার বাংলো বেশিদূর নয়, কিন্তু সৌমেন বলেছে শিকারের সুবিধের জন্য বনবিভাগের বাংলোতেই থাকতে হবে। কুমাণ্ডিতে। হেহেগাড়া থেকে অনেকটা পথ।

জিপ চলছে। লাল ধুলোর ঝড় উড়িয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। দু-পাশে কত যে ফুল! অশোক, শিমুল এবং পলাশে একেবারে আকাশে আগুন লেগে গেছে। নীচে আছে ফুলদাওয়াই। সিমোসাজাতীয় ফুল এগুলো।

ফুলদাওয়াই লাল। লাল বললে ঠিক বলা হয় না। এমন লাল যে, মাথার মধ্যে ঘা দিতে থাকে। এমন অনেক ভাবনা যা সচেষ্টভাবে চাবিবন্ধ করে রাখার চেষ্টা করি, সেগুলো সব পিন পিন করে হুলে ঢিল-খাওয়া মৌমাছির মতো বেরিয়ে পড়ে। পিরহুলের রং গাঢ় বেগুনি। শেষ কৈশোরের স্বপ্নের মতো। একবার চাইলে চোখ ফেরানো যায় না। তা ছাড়া কত যে রঙিন পাতা, কত যে রঙিন প্রজাপতি, কত যে বিচিত্রকন্ঠ পাখি, তার হিসেব নেই। ইচ্ছে করে থুথু দিই এই সৌন্দর্যে। নিষ্ঠুর, নির্বাক, উদগ্র এই প্রকৃতি। বোবা প্রকৃতি। আর বেশিদিন থাকলে পাগল হয়ে যাব।

সৌমেন দু-ধারে তাকাচ্ছে আর ‘বা: বা:’ করতে করতে চলেছে। এক-এক বার ‘বা: বা:’ করছে আর আমার মাথার ভেতরে হাতুড়ি পড়ছে। সৌমেন বলল, ‘বুঝলি কবি, চৈত্র মাসের জঙ্গলের তুলনা নেই। ইচ্ছা করে, তোর কাছেই থেকে যাই।’

রাগে আমার গা জ্বলে। বললাম, থাকলেই তো হল।

সিরিয়াসলি ভাবছি।

—তা থাক। মজাটা বুঝবি। এই নির্জনতাটা যখন তোর গলা টিপে ধরবে, সেদিন তোকে আমি দেখব।

সৌমেন হা-হা করে ওর স্বভাবসিদ্ধ হাসি হেসে ওঠে। বলে, এইজন্যেই তো তোকে কথাটা বললাম। তুই ভয় পাস।

—কী ভয় পাই?

—পাস না?

—কী?

—এই প্রকৃতিকে ভয় পাস না? এখান থেকে পালাতে চাস না? জানি, জানি রে কবি, সব জানি। তোর মতো কবি আমি অনেক দেখেছি। শুধু তুই কেন? প্রকৃতিকে ভয় কে পায় না?

ওর কথা বলার ধরন দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। সারা গা শিউরে উঠল। বললাম, সবাই মানে? তুইও পাস?

উত্তরে আমার প্রশ্নের ভয়াবহতা আরও নিবিড় করে ও বলল, সবাই পায় রে, আমিও পাই।

আশ্চর্য! যে সৌমেন মাটিতে দাঁড়িয়ে আকছার বাঘ মারে, সেও এই ফুল-লতা-পাতা-পাখি-প্রজাপতিকে ভয় পায়? ভাবতে পারছি না। আমার অত্যধিক সিগারেট পানে অসুস্থ বুকে আর সহ্য হচ্ছে না। তা হলে ব্যাপারটা যা দাঁড়াচ্ছে, এতো একটা সমস্যা। সৌমেন যখন ভয় পায়, তখন এই প্রকৃতির মুখে থুতু দেবার ইচ্ছাটা আমার নিছক পাগলামি নয়। অথচ সকলেই যদি ভয় পায় তো আমার এই সামান্য থুতু দিয়ে এর কী ক্ষতি হবে? না, আর ভাবতে পারছি না। পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে সিগারেট একটা বার করলাম।

জিপ চলেছে। সৌমেন ড্রাইভারের সঙ্গে শিকারের গল্প জমিয়ে নিয়েছে। কথা আছে আগামীকাল কোয়েল নদীর পাশে বাগেচম্বাতে সকাল থেকে সন্ধে অবধি ছুলোয়া হবে। আমার মালিক যে কাগজ কোম্পানির ঠিকাদার, সে কোম্পানির সাহেবরাও সব শিকারে আসছেন। ওঁরা রাঁচি থেকে গাড়িতে আসবেন। ওঁদের সঙ্গেই ভিড়িয়ে দেব সৌমেনকে। শিকারটিকার আমার আসে না। বাঘ-ভাল্লুকের জন্যে ভয়ও লাগে আবার হরিণ-টরিনের জন্য মায়াও লাগে। তবে কেউ হরিণ মারলে মাংস পাঠায়। একটু-আধটু খাই। মন্দ লাগে না। তবে নিজে হাতে মারার কথা কোনোদিন ভেবে দিখিনি। ভালো লাগে না। ক্ষমতাতেও কুলোয় না।

শিকারি হিসেবে সৌমেনের খ্যাতি আছে। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি পত্রপত্রিকায় সৌমেনের লেখা বেরোয়। কাগজ কোম্পানির সাহেবরা নাকি বলেছেন, ‘ইউ উড বি এ গ্রেট প্লেজার টু সুট, উইথ হিম।’ হঠাৎ একটা বাঁকের মুখে একটা কোটরা হরিণ রাস্তা পেরোল। সৌমেন আফশোস করতে লাগল। ‘ইস, বন্দুকটা যদি বের করা থাকত।’ ড্রাইভারটা দার্শনিকের মতো বলল, ‘ছোড় দিজিয়ে হুজোর। উসকো মরনা নেই থা। জি খতম হোগা, তব না মরেগা।’ কথাটা বেশ লাগছে। অনেক বার শোনা কথা। তবুও ভালো লাগল। মরার সময় না হলে কি মরে?

কুমাণ্ডি ফরেস্ট বাংলোতে পৌঁছোতে পৌঁছোতে আমাদের প্রায় বিকেল গড়িয়ে গেল। এ বাংলোয় আমি আগে আসিনি। বেশ চমৎকার বাংলো। একটা পাহাড়ের মাথায়। পাহাড়ের নীচে গাড়ি ঢোকার গেট। ঘোরানো রাস্তা উঠে গেছে পাহাড়ে, বাংলোতে। ড্রাইভের পাশে সুন্দরভাবে লাগানো কৃষ্ণচূড়া, জ্যাকারাণ্ডা, চেরি এবং অন্যান্য সুন্দর সুন্দর গাছ। বাংলোর বারান্দায় বসে চাইলে, চতুর্দিকে পাহাড়। চোখে পড়ে ঘন জঙ্গলের আস্তরণ। মহুয়ার গন্ধে বন একেবারে মাতাল হয়ে উঠেছে। পাহাড়ের মাথায় মাথায় মাঝে মাঝে পলাশ অথবা শিমুলের গাঢ় লাল। অন্যান্য হলুদ ও সবুজ পাতাঅলা গাছেদের মধ্যে চমৎকার দেখাচ্ছে। বেলা পড়ে আসছে। চারপাশ থেকে সন্ধ্যা হওয়ার খবর এসে পৌঁছোচ্ছে ঘরে। ময়ূর ডাকছে ‘কেয়া-কেয়া-কেয়া’ করে একটানা তীক্ষ্ণস্বরে। গায়ে কাঁটা দেয় ময়ূরের ডাক শুনলে। মনে হয় কী-একটা প্রশ্ন যেন একেবারে বুকের মধ্যিখানে ছুড়ে মারছে। মোরগ ও মুরগির স্বর অন্যান্য পাখিদের স্বর ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে। দুটো কাঠঠোকরা কাছেই কোনো বড়ো গাছে বসে সামনে ঠকাঠক ঠকাঠক করে চলেছে। সূর্যটা ডুববেই, কিছুতেই বাঁচানো গেল না।

সৌমেনকে বললাম, এবার আমায় ছুটি দাও বাবা। তোমার জন্য মালিকের একজন পেয়ারের বাবুর্চি এনে দিয়েছি। বাথরুমে জল এনে দেবার এবং তোমার খিদমতগারি করার জন্যে একজন লোককে ঠিক করা হয়েছে। খাওদাও বিশ্রাম করো। কিংবা ইচ্ছা হলে শিকার করো। আমি আমার বাংলো পৌঁছে তোমাকে জিপ পাঠিয়ে দেব। তুমি এ জিপ নিয়ে কাল সকালে বাগেচম্বা যাবে। সাহেবরা সব সকাল আটটার মধ্যে সেখানে পৌঁছে যাবেন।

সৌমেন বলল, এতদূর পথ এলি, এরই মধ্যে যাবি কী? দাঁড়া, চা-খাই একসঙ্গে। এখানে চানটান করে তারপর চাঁদের আলোয় ফুরফুরে হাওয়ায় চলে যাবি জিপে চেপে।

আমি বললাম, থাক ঢের হয়েছে। শুনেছি নাকি এ রাস্তায় ১৫ মাইলের মাথায় একটা বড়োবাঘ প্রায়ই রাস্তা পার হয় সন্ধের ঘণ্টাখানেক পর। ও জায়গা আমি তার আগেই পেরিয়ে যেতে চাই। তোমার সঙ্গে আড্ডা মারতে গিয়ে শেষে প্রাণটা খোয়াই আর কী! আমি চললাম। কাল বিকেলে তুই শিকার থেকে ফিরলে আবার আসব। মানে চেষ্টা করব।

আমি যখন জিপের দিকে যাচ্ছি, তখন সৌমেন আমায় আবার ডাকল। বলল, এই কবি, হুইস্কি খাবি? আমার বুকটা নেচে উঠল। চোখটা জ্বলজ্বল করে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই দপ করে নিবে গেলাম। নিশ্চয় সৌমেন ইয়ার্কি মারছে। ও তো কোনোদিন ওসব…….। বরঞ্চ আমিই আমার ইন্টেলেকচুয়াল বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে খিচুড়ি দিয়ে রাম এবং পাঁপড় ভাজার সঙ্গে দিশি হুইস্কি খেয়েছি। সৌমেন তো বরাবর গালাগালিই করেছে আমাকে এবং আমার ‘স্নব’ বন্ধুবান্ধবদের। সৌমেন আবার বলল, ভালো জিনিস। বিলিতি। হোয়াইট লেবেল।

একগাল হাসিতে আমার মুখ ভরে গেল। বললাম, সত্যি!

ও বলল, সত্যি! চানটান কর। মুরগি তো রান্না হচ্ছেই। তারপর বেশ কয়েক পেগ চড়িয়ে জিপের পেছনে কুকুর কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকবি। জিপ তো আর তোকে চালাতে হবে না। তবে আর ভয় কী?

গদগদ গলায় বললাম, বলছিস? আচ্ছা। কেন জানি মনে হল, সৌমেনকে আমি যতটা ক্রুড ভাবি, আসলে ও ততটা নয়। আসলে বেশ ভালোই। ভালো ছেলে সৌমেন। এই জঙ্গলে কোথায়ই-বা পাই? তা ছাড়া পয়সাও নেই। এই দু-একদিন, হোলির দিন, ছট-পরবের দিন, একটু দিশি না হলে মহুয়া খাই। তাতেই যা রং। বেশ আছি। নিজের ওপর মাঝে মাঝে ঘেন্না হয়। সৌমেন একদিন রাগ করে আমায় এবং আমার বন্ধুদের বলেছিল, তোরা আবার বড়ো বড়ো কথা বলিস কী? ‘ইউ আর ইভেন ইনকেপেবল অফ আর্নিং এ লিভিং।’ রোজ ভাবি। কথাটা সত্যিই বলেছিল। এই লিভিং কী লিভিং? থাক গে অনেক দিন পর একটু ভালো হুইস্কি খাওয়া যাবে। নিজের ওপর এত ঘেন্না সত্ত্বেও বেশ ভালো লাগতে লাগল। মনে পড়ল শর্মিলাদের বাড়ির পার্টিতে একদিন শর্মিলা বলেছিল, ‘কবি, একটু হুইস্কি খাও, দেখবে কেমন খুশি খুশি লাগবে।’ একটা নিশ্বাস পড়ল। হায় শর্মিলা! সৌমেনের ওপর আবার রাগ হতে লাগল। পুরোনো ঘায়ে নুন পড়ল।

স্নানটান করে চেরি গাছের নীচে বেতের চেয়ার পেতে বসলাম। চাঁদটা উঠেছে, কিন্তু পুরো এখনও ওঠেনি। ডেহা-ফরমের পাহাড়ের মাথায় আটকে গেছে। একটা প্রকান্ড হলুদ চাঁদ। আর কিছুই ঢেকে রাখা যাবে না। সবকিছু প্রকাশ হয়ে পড়বে। সৌমেন স্নান করছে। বাথরুমের জানলা দিয়ে ওর গমগমে গলার গান ভেসে আসছে। একটা বোতল খুলে একটু ঢাকলাম।

ভাবছিলাম, শর্মিলার ব্যাপারে আমার পক্ষে ঠিক সৌমেনের ওপর রাগ করাটা সমীচীন নয়। কারণ আমি শর্মিলাকে আমার অভিমানের চেয়েও ভালোবাসতাম; কিন্তু শর্মিলা মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসত সৌমেনকে। অথচ সৌমেন বলত, ওসব প্রেম-ফ্রেম মেয়েলি ব্যাপার, আমার ধাতে সয় না। মেয়েদের মোটে আমি বরদাস্ত করতে পারি না, বিশেষ করে ন্যাকা মেয়েদের। সত্য-মিথ্যা ব্যাপারটা আসলে কী হয়েছিল জানি না। বিরান্দকারের বাড়িতে মুনলাইট পিকনিকে নাকি শর্মিলা পেছন থেকে গিয়ে সৌমেনকে জড়িয়ে ধরেছিল। তাতে নাকি সৌমেন শর্মিষ্ঠাকে ঠাস করে একটা চড় কষিয়েছিল। কী সাহস! নেহাত আমার মস্তিষ্কের তুলনায় আমার শরীরটা নিতান্তই দুর্বল; তাই আমার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হয়নি। শর্মিলা আত্মহত্যা করেনি, উলটে সৌমেনকে চড় মারেনি, সৌমেনের ওপর রাগ করে আমাকে দয়া দেখায়নি—কিছুই না করে চিরকালের মতো ভারতবর্ষ ছেড়ে সে আমেরিকায় তার কাকার কাছে থাকবে বলে চলে গেছিল। এতে শর্মিলা যে কতখানি আঘাত পেয়েছিল তা সকলেই বুঝেছিল। আমার বক্তব্য ছিল এই যে, সৌমেন ওরকম গোঁয়ারতুমি কান্ড না করে শর্মিলাকে বুঝিয়ে বলতে পারত যে, আমি শর্মিলাকে কতখানি ভালোবাসি এবং শর্মিলা আমাকে গ্রহণ করে নিজেকে সার্থক এবং আমাকে ধন্য করতে পারত। পুরোনো কথা না ভাবাই ভালো। একটা সিগারেট বের করে ধরালাম।

সৌমেনের স্নান হল। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে এসে চেরি গাছের নীচে বসল। চেহারাটা বড়ো ভালো ছেলেটার। কেবল উচ্চাতায় ছ-ফুট দু-ইঞ্চি তা নয়, বরাতটাও সে মাপের। যাচ্ছেতাই, যাচ্ছেতাই। আর একটু ঢালি গ্লাসে।

সৌমেন যেন স্বগতোক্তি করল, চেরি গাছটা এ ক-বছরে কত বড়ো হয়ে গেছে।

চমকে উঠে আমি বললাম, তার মানে? না খেয়েই নেশা হল নাকি? তুই আবার কবে এলি এ বাংলোতে?

সৌমেন বলল, এসেছি রে, এসেছি। সে বেশ কয়েক বছর আগে। তখন তুই তো দূরের কথা; তোর মালিকও এখানে আসেনি।

আমি বললাম—কেন এসেছিলি? শিকারে?

—শিকারেই এসেছিলাম মুখ্যত।

—একা এসেছিলি?

—হ্যাঁ! আমি একাই এসেছিলাম। তবে পাশের ঘরে মিস্টার আদিত্য মুখার্জি ও মিসেস শর্মিলা মুখার্জি ছিলেন।

—কে শর্মিলা?

—যে শর্মিলাকে তুই ভাবছিস।

—গুল মারিস না। শর্মিলা তো কবে আমেরিকায় চলে গেছে।

—তোর মাথা!

—মানে? দ্যাখ সৌমেন, একে অনেক দিন হুইস্কি খাই না। তুই আমাকে আগে থেকে সব ব্যাপার গোলমাল করে দিস না।

—আমি গোলমাল করছি না। এই বলে সৌমেন গ্লাসে একটু হুইস্কি ঢালল, ঠাণ্ডা জল নিল বেশি। এখানে সোডা নেই।

আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। এই ‘রোগ’ এই ‘ক্রুড’ সৌমেনটাই আমার জীবনের শনি। আমার সমস্ত জীবনটা গোলমাল করাই ওর উদ্দেশ্য। বরাবর তাই করে এসেছে। এখন আবার এমন সব কথা বলতে আরম্ভ করেছে যার কোনো মাথামুন্ডুই নেই।

ওকে ক্রস করার জন্যে শুধোলাম, মিস্টার আদিত্যটি কে?

সৌমেন বলল, ইণ্ডো-আমেরিকান কোন কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। টাকার কুমির। শর্মিলা থার্ড ওয়াইফ। পাড় মাতাল।

—তাহলে শর্মিলা ওকে বিয়ে করল কেন?

—জানি না। আমাকে জব্দ করার জন্যেই বোধ হয় বিয়ে করেছিল। ভদ্রলোক বয়সে শর্মিলার চেয়ে কমপক্ষে পনেরো বছরের বড়ো ছিলেন।

আমি সে বার শিকারে এসেছিলাম তোর মালিক যে কোম্পানির ঠিকাদার সে-কোম্পানিরই অতিথি হয়ে। বাবাকে ওঁরা ভালো করে চিনতেন। আমি তখন সবে দু-বছর হল পাশ করেছি।

বেশ শিকার-টিকার করছি। বাগেচম্বাতে বাইসন মারতে যাব পরদিন সকালে। দুপুর-বেলা এই চেরি গাছটার নীচে বসে ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছি। এমন সময় একটা ফিকে বেগুনি রঙের মার্সিডিজ গাড়ি এসে ঢুকল। গাড়ি থেকে কাগজ কোম্পানির একজন ডিরেক্টর হুইটলি সাহেব নামলেন। এবং পেছনের দরজা খুলে সসম্মানে এক ভদ্রলোককে নামালেন। ভদ্রলোককে দেখতে এক্কেবারে স্যার উইনস্টন চার্চিলের মতো, কিন্তু লম্বায় পাঁচ ফুটও নন। মুখে চুরুট। চোখ দুটোর দিকে চাইলেই বোঝা যায়, অত্যন্ত বুদ্ধি রাখেন ভদ্রলোক।

আমি গ্লাসটা একঢোকে শেষ করে বললাম, তারপর?

সৌমেন বলে চলল। তারপর সে ভদ্রলোকের পেছনে পেছনে এক অত্যন্ত সুন্দরী মহিলা নামলেন। নামার সময় আমি কেবল তার সুগৌর পা-দুখানি দেখতে পেলাম। কিন্তু ঘুরে দাঁড়াতেই আমার হাত থেকে ম্যাগাজিন পড়ে যাবার জোগাড়। দেখি শর্মিলা। সিঁথেয় সিঁদুর দেয়নি যদিও, তবুও বুঝলাম বিবাহিতা। ততক্ষণে আমায় উঠে যেতে হয়েছে ওঁদের কাছে। হুইটলি সাহেব আমার সঙ্গে কর্তা-গিন্নির আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন যে, এদের একটু শিকার করিয়ে দিতে হবে। মিস্টার মুখার্জি বললেন, আই অ্যাম ডিলাইটেড টু মিট ইউ ইয়ং ম্যান, আপনার নাম শুনেছি, ইঞ্জিনিয়ার এবং শিকারি হিসেবে। আই হোপ উই উইল হ্যাড ওয়াণ্ডারফুল টাইম।

একেবারে সাহেব। বাংলা যেন জানেনই না এমন ভাব। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার মিসেস মুখার্জি দু-হাত তুলে নমস্কার করলেন। একটুও চোখের পাতা পড়ল না, একটুও হাত কাঁপল না, মুখের রেখা একটুও কুঞ্চিত হল না, কে বলবে যে শর্মিলা আমাকে চেনে। আমি একটু অপ্রতিভের মতো হাতজোড় করে নমস্কার করলাম। আমার অবস্থায় তুই যদি পড়তিস। যে প্রণয়প্রার্থীকে চড় মেরেছি, তাকে এখন শিকার দেখাতে হবে। এবং সবসময় অভিনয় করতে হবে যে, আমি ওকে চিনি না। আমার ইচ্ছা করছিল যে, পরদিন সকালেই রওনা হই কলকাতার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তা হবার ছিল না।

আমি সৌমেনকে থামিয়ে দিয়ে বলি, কেন?

কেন? সৌমেন প্রায় ধমক দিয়ে বলে, আহা, শোনো-না।

তাড়াতাড়ি কাঁপা কাঁপা হাতে আবার গ্লাস ভরতি করে নিয়ে বলি, ‘বল বল, আমার যেন আর তর সইছে না। এই এক বোতল খুশিটা থাকতে থাকতে সবটা না শুনতে পারলে আমি বোধ হয় কোনো নৈরাশ্যের অতল গহ্বরে পড়ে যাব, সেখান থেকে কেউ আমায় টেনে তুলতে পারবে না।’

সৌমেন এক চুমুক দিয়ে আবার বলতে শুরু করল।

আমার রীতিমতো ভয় হতে লাগল ওকে দেখে। চাঁদটা এমনভাবে উঠেছিল, সমস্ত বন-পাহাড় এমনভাবে হাসছিল, বাতাসে মহুয়ার গন্ধটা এমন তীব্রভাবে ভাসছিল যে, আমার কেন জানি মনে হতে লাগল, আজ আর কিছু ঢাকা থাকবে না। সৌমেনের মুখ থেকে এখুনি সাংঘাতিক কিছু শুনতে পাব। সেটা এই হুইস্কির বোতলটা খালি হবার আগেই আমি শুনতে চাই।

সারা হাঁকোয়া হয়। জঙ্গলেই লাঞ্চ খাই। মুখার্জির সাহেবদের জন্যে কলকাতা থেকে বাবুর্চি খানসামা এসেছে। সঙ্গে আমারও ভালো-মন্দ জোটে। ফ্লাস্কে করে চিকেন অ্যাসপারাগাস সুপ যায়, আইস-বক্সে করে কিছু কোল্ড মিট, স্যাণ্ডউইচ, চিকেন রোলস ইত্যাদি। অন্য ফ্লাস্কে কফি। রাজসিক শিকার যাকে বলে। মুখার্জির সঙ্গে একজন সুদর্শন গান-বেয়ারা তার গ্রিনার এবং হল্যাণ্ড অ্যাণ্ড হল্যাণ্ডের প্যারাডক্স ধরে নিয়ে বেড়ায়। শর্মিলা রিচেস পরে মাথায় টুপি চড়িয়ে যখন আমার সামনে মুখার্জি সাহেবের সঙ্গে ঢলাঢলি করত, তখন আমার আবার নতুন করে ওকে চড় মারতে ইচ্ছে করত। কিন্তু বাইরে বাইরে রাগ দেখালেও আমি মনে মনে কেমন দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলাম। পিটিস ফুলের কদর্য গন্ধ, শালবনে টিয়া পাখিদের অনন্ত আক্ষেপ, সারাদিন খুশি হওয়ায় শুকনো পাতার নাচন, আমায় যেন কেমন বদলে দিচ্ছিল। এতদিনের শিক্ষা, রুচিবোধ, শুভাশুভ জ্ঞান, নিজের মনোজোর, সব যেন কেমন নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। সন্ধ্যার সময় যখন এই চেরি গাছটির নীচে বিয়ারের বোতল খুলে বসতাম তখন চাঁদটা ঠিক এমনি সাংঘাতিক রকম কমনীয়তায় ভরে উঠত। আর বেলজিয়ান কাট গ্লাসের বিয়ারের মগে হলদে বুদবুদগুলোকে জিভ দিয়ে ভাঙতে ভাঙতে মনে হত, এই হলুদ চাঁদটাকে যদি এমনি করে গুঁড়িয়ে দিতে পারতাম, তবে যেন বেঁচে যেতাম। কোথা থেকে রাতের সেই অলুক্ষণে পাখিটা এসে ডাকতে থাকত পাহাড়ের নীচ থেকে—‘ঢাব-ঢাব-ঢাব।’

তুই জানিস, আমি কোনোদিন নেশাটেশা করি না। সারাদিন গরমে পরিশ্রম করে এসে এক বোতল বিয়ার খেতাম—নেহাত শরীরের জন্যেই। তা ছাড়া এক বোতলে আমার মতো স্বাস্থ্যের লোকের নেশাও হত না। মুখার্জি সাহেব কিন্তু সন্ধের পর হুইস্কি বোতল নিয়ে চুর। তখন কেউ তাঁর পকেট থেকে টাকা বের করে নিলেও হুঁশ থাকত না। রোজই আমি সন্ধের সময় ভাবতাম, কোনোদিন যদি শর্মিলা এই চাঁদের আলোয় চেরি গাছটার তলায় আমার কাছে আসে, তবে হয়তো আমি হেরে যাব। ইদানীং একেবারে ফুরিয়ে এসেছি। রোজ খেতে বসে রাতে মুখার্জি সাহেব তো প্রায় বেহুঁশ হয়ে থাকতেন। তখন শর্মিলা আমার দিকে এমন করে তাকাত যে, আমার ভয় করত। শর্মিলা সুন্দরী তো বরাবরই ছিল, কিন্তু ওর শরীরে যেন কী-একটা চুম্বক শক্তি। চোখ দুটো ওর হ্যাজাকের আলোয় চকচক করত। মনে হত একটা অসম্ভব ধারালো ছুরি। সে ছুরি কোনো শিঙাল শম্বর হরিণকেও ক্ষতবিক্ষত করতে সক্ষম। শর্মিলা যখন পাহাড়ি ঝরনায় স্নান করতে যাবার অছিলায় আমার সামনে দিয়ে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বেশবাসে যেত-আসত তখন আমার ভয় করত। শর্মিলাকে এমনভাবে তো কখনো দেখিনি। এবাড়ি-ওবাড়িতে দেখেছি, ক্লাবে দেখেছি, পার্টিতে দেখেছি। টেনিস খেলতে দেখেছি যখন, তখন ও বেশ ছোটো। কোনো সময়েই এমন বেশবাস বা এমন সর্বনাশ করার চেষ্টায় সচেষ্ট দেখিনি। কিন্তু কী বলব তোকে, যতই দিন যাচ্ছিল ততই আমার জোর কমে আসছিল। আমার ভয় বাড়ছিল। বোবা প্রকৃতির এই অমোঘ অভিশাপ, আমার বুকের মধ্যে চেপে বসছিল। আমার সমস্ত শরীর জ্বালা করত। ঠাণ্ডা বিয়ারেও কিছু হত না। সে জ্বালা কী করে নেবায় তা আমার জানা ছিল না। পিটিস ফুলের গন্ধ সে-জ্বালা আমার বাড়িয়ে দিত।

ওরা যেদিন চলে যাবে তার আগের দিন, আমি অমনি বসে আছি চেরি গাছতলায়। রাত প্রায় আটটা। বাংলোর পেছন দিকে বয়-বাবুর্চিরা আছে। সামনের দিকে, মানে যেখানে আমি বসে আছি, সেদিকে জনমানব নেই। হঠাৎ আমার বুকের মধ্যে চমকে দিয়ে শর্মিলা এসে আমার সামনের চেয়ারে বসল। একটা সাদা শাড়ি আর সাদা জামা পরেছে। কানের নীচে, গলার তলাতে বোধ হয় আতর মেখেছে। খুশবু পাচ্ছি। চাঁদের বুটিকাটা আলো, চেরি গাছের পাতা বেয়ে এসে ওর মুখ ও শরীরময় ছড়িয়ে পড়েছে। এতদিনের মধ্যে এই প্রথম শর্মিলা আমার নাম ধরে, আমায় পুরোনো পরিচয়ে ডাকল। বলল, কী করছ সৌমেন?

বললাম, দেখতেই পাচ্ছ, বিয়ার খাচ্ছি।

শর্মিলা একটু হাসল। বলল, সেই এক বোতল নিয়ে তো সন্ধ্যা থেকে বসে আছ, একে কি খাওয়া বলে?

নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত করে বললাম, বাহাদুরি করার জীবনে অনেক জিনিস আছে। বিয়ার খেয়ে নাম করবার আমার আদৌ ইচ্ছা নেই।

শর্মিলা আবার হাসল। বলল, কথা ঘুরিয়ো না। পারো না তাই বলো। যা পারো না তা পারো না বলে স্বীকার করো।

আমার রাগ হল। বললাম, কী পারি না?

মনে হল, শর্মিলা প্রায় দাঁতে দাঁত চেপে বলল, তুমি কিছুই পারো না। কিছুই কথাটার ওপর এমন জোর দিয়ে বলল যে, আমার সন্দেহ হল ও কেবল বিয়ার খাবার কথা বলছে না।

আমার তখন জেদ চেপেছে। আমি বললাম, সব পারি।

পারো? তবে খাও তো বিয়ার! বলে, নিজে গিয়ে ফ্রিজ খুলে চার বোতল বিয়ার নিয়ে এল।

বলল, খাও।

আমি বললাম, খেতে পারি। কিন্তু খাব না।

তখন ও প্রায় আমাকে গায়ে থুথু দিয়ে বলল, না। তুমি পারো না, পারো না, পারো না।

এখন ভাবি, বললেই পারতাম, পারি না তো পারি না। কিন্তু কী যে হয়ে গেল আমার। চিরকেলে গোঁয়ার। বললাম, বেশ। পারি কি না দ্যাখো। বলে খেতে শুরু করলাম। তিন বোতল খেয়েই আমার মনে হল মাথাটা ঝিমঝিম করছে। আমার মধ্যে আমি নেই। হঠাৎ দেখি শর্মিলা একেবারে আমার কাছে এসে বসেছে। একেবারে কাছে। এত কাছে আমার মা ছাড়া কেউ কোনোদিন বসেনি। ও আমাকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরেছে। চাঁদের আলোয় বিয়ারের নেশায় আর শর্মিলার সুগন্ধে তখন আমি আমার কবরের মাটি খুঁড়ছি। তারপর কী হয়েছে আমার মনে নেই। শর্মিলা আমাকে অনেক কিছু করতে বলেছে। যা বলেছে আমি লঞ্জীছেলের মতো ওর ইচ্ছায় করেছি। আমার শরীরের তখন এমন অবস্থা যে, আমার নিজের ইচ্ছা আমি কারও ওপরে আরোপ করি সে-বল আমার নেই। আমাকে এই প্রকৃতি, এই চাঁদ, আর শর্মিলা সবাই মিলে হারিয়ে দিয়েছে।

তারপর কী হয়েছে আমার মনে নেই। যখন হুঁশ হল, দেখলাম মি. মুখার্জি পাশে দাঁড়িয়ে। শর্মিলা কাঁদছে আর আমাকে আঙুল দেখিয়ে বলছে, দিজ, দিজ বিস্ট…..মিস্টার মুখার্জি চুরুটটা মুখে কামড়ে বললে, ইউ আর এ বাস্টার্ড। বলে আমাকে একটা লাথি মেরে চলে গেলেন।

আমিও যেন সৌমেনের মতো বেহুঁশ হয়ে গেছিলাম, সৌমেনের গল্প শুনতে শুনতে। আমি মনস্তত্ত্বের ছাত্র, কই এমন ব্যাপার তো শুনেছি বলে মনে হয় না। শেষে শর্মিলা!

সৌমেন প্রায় আমায় ধাক্কা দিয়ে বলল, কী রে কবি, শুনেছিস? সৌমেন রায়কে একটা বেহেড মাতাল একটা অপদার্থ লোক কিনা বলে বাস্টার্ড, কিনা, লাথি মারে।

আমি বললাম, তুই কেন গুলি করে মেরে ফেললি না দু-জনকেই।

সৌমেন বলল, থাম তুই। আমার গল্প এখনও শেষ হয়নি। না, গুলিও করিনি। রাগও করিনি। কেবল নিজের গালে চড় মেরেছি। তোর এই ফুল-লতা-গাছ-পাখি-প্রজাপতি-চাঁদ এরাই তো সব সর্বনাশের মূল। এই বোবা প্রকৃতি আমার সব দম্ভ, আমার পুঁজিকরা সব সংযম, সব শিক্ষা, সব গর্ব একটি হলুদ চাঁদের আলোয় ছারখার করে দিল।

মিস্টার মুখার্জি ব্যাপারটাতে যে পুরোপুরি আমারই দোষ তাতে একটুও সন্দেহ রাখলেন না। এবং শর্মিলা, বুড়ো মোটা বরের কোলের কাছে গুঁড়িসুঁড়ি হয়ে নিশ্চয়ই সমস্ত রাত সোহাগে শুয়ে রইল।

তার পরদিন আমি চলে এলাম। আমার বরাত ভালো যে, বাবার কানে কথাটা মিস্টার মুখার্জি দেননি। বোধ হয় নিজের অসম্মানও জড়িত আছে ভেবেই। তারপর এ ক-বছর নিজেকে আরও শক্ত করেছি এবং শিকারে গেলেও জঙ্গলে একসঙ্গে তিন দিনের বেশি থাকিনি। আমার কেমন ভয় হয়ে গেছে। আমার কেমন বুক কাঁপে এই নির্জনতায় এলেই। মনে হয় দুর্বল হয়ে যাচ্ছি।

যাক গে এসব কথা। সাত দিন আগে এই চিঠিটি, বলে পকেট থেকে সৌমেন একটি চিঠি বার করল।

বললাম, কার চিঠি?

ও বলল, শর্মিলার। আমাকে দিয়ে বলল, পড় চিঠিটা।

চিঠিটা কাঁপা কাঁপা হাতে খুললাম। খুলে হলুদ চাঁদের আলোয় মেলে ধরলাম।

২০/৩/৬৪

সৌমেন,

এ চিঠি লেখার প্রয়োজন ছিল বলেই লিখছি। না লিখে কোনো উপায় ছিল না।

কুমাণ্ডির জঙ্গলে যা ঘটেছিল তারজন্যে তোমার কাছে ক্ষমা আমি চাইব না। আমি যা করেছি তা যে তোমাকে জব্দ করবার জন্যে তা তোমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। কিন্তু এই আমি নিজে যে কতবড়ো জব্দ হয়েছিলাম, জব্দ হয়ে এসেছি, জব্দ হয়ে এই পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছি তা আর কারও না হোক অন্তত তোমার জানা উচিত।

তোমাকে আমি যেমন করে ভালোবাসতাম তেমন করে বোধ হয় কোনো মেয়ে কোনো ছেলেকে ভালোবাসেনি। বড়ো হয়ে ওঠা না পর্যন্ত আমি বুঝতে পারিনি যে, স্বীকার করি আর নাই করি, মেয়েরা তাদের শরীরটাকে আমল না দিয়ে পারে না। টেনিস র‌্যাকেট হাতে তুমি যখন সাউথ ক্লাবে প্র্যাকটিসে আসতে, সেদিন থেকে আমি তোমাকে ভালোবাসি। শুধু ভালোবাসি না চাই। তুমি তা কোনোদিন জানোনি। আরও অনেক মেয়ে তোমাকে ভালোবাসত, তুমি তাদের প্রতিও মুখ তুলে চাওনি।

তোমার মনে মনে একটা ভুল ধারণা ছিল যে, মেয়েদের ভালোবাসা পাওয়াও একটা মেয়েলি ব্যাপার। চাওয়াটা তো একটা ঘৃণার বিষয়। যার জন্যে তুমি, বেচারি কবিকে কত হেনস্থা করেছ। বেচারি কবি! ওর আমার প্রতি ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না তা আমি জানি। ওকে আমার ভালো লাগত। কিন্তু ওকে আমি ভালোবাসিনি কোনোদিন। মেয়েদের ভালোবাসা কেবল পুরুষদের জন্যে। পুরুষের সংজ্ঞা কী তা ঠিক করার সময় ও অভিলাষ দুইয়ের কোনোটাই আমার এখন নেই।

তবুও, সেদিন আদিত্য মুখার্জি তোমায় যে অপমান করেছিলেন এবং আমি তোমায় যে অপমানের ভাগী করেছিলাম, তারজন্যে আমায় ক্ষমা কোরো। যাই করে থাকি-না কেন, সবই তোমাকে পাবার জন্যে। সে তুমি বুঝবে না। যদি কোনোদিন সুযোগ আসে তবে পাপের প্রায়শ্চিত্ত কী করে করতে হয় তা করে দেখাব তোমায়।

একটা কথা এইবেলা তোমাকে বলে ফেলি। কুমাণ্ডির ব্যাপারটা, মানে আদ্যোপান্ত ঘটনার বিবরণ এবং কার প্ররোচনায় ঘটনাটা ঘটেছিল তা মুখার্জি সাহেবের খাস বেয়ারা কৃষ্ণচূড়া গাছের আড়াল থেকে দেখেছিল। সাহেবের আগের স্ত্রীদেরও অনেক কীর্তিকলাপ নাকি তার জানা ছিল। অত্যন্ত অভিজ্ঞ লোক। তাই সে আমার মতলব বুঝতে পেরে, আগে থাকতে কৃষ্ণচূড়া গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। এই ক-বছর আমাকে অনেক উপায়ে ব্ল্যাকমেইল করেছে এ খবরটা সাহেবের কানে দেবার ভয় দেখিয়ে। অনেক কিছু তাকে দিয়েছি। এখন সে এমন কিছু চাইছে যা দেওয়া সম্ভব নয়। কথাটা সাহেবের কানে গেলে সাহেব নিজেই আমাকে ‘ড্রাগ’ করতেন। তাই সে সম্মানের অধিকার তাঁকে না দিয়ে আমি নিজেই বিষ খাচ্ছি। এ চিঠি যখন তুমি পাবে তখন আমি আর থাকব না এই আনন্দে-ভরা পৃথিবীতে।

আমি বাঁচতে বড়ো ভালোবাসতাম সৌমেন। তুমি আমায় বাঁচতে দিলে না।

মি. মুখার্জিকে কেন বিয়ে করেছিলাম সেকথা জিজ্ঞেস কোরো না। টাকার জন্যে নিশ্চয় নয়। আমার নিজের যা টাকা ছিল, আমার সে-প্রয়োজন ছিল না।— তোমার অপমানটা চূড়ান্ত হবে। জানি না। ঠিক জানি না। তবু বললাম।

আমি ব্রাহ্ম। জন্মান্তরবাদ মানি না। তোমাদের হিন্দুধর্ম যদি সত্যি হয়, মরে যদি আবার জন্মায়; তবে তার কাছে প্রার্থনা কোরো যেন পরের জন্মে তোমাকে ভালোবেসে পাই। তা যদি না—পুনর্জন্মে আমার প্রয়োজন আমার জন্মজন্মান্তরের ভালোবাসা।

ইতি

তোমার শর্মিলা

এতবড়ো একটা দুঃখের জন্যে তৈরি ছিলাম না। এক বোতল হুইস্কির খুশি এক নিমেষে বিনিয়ে দিল।

সৌমেন বলল, পড়লি?

জবাবে বললাম, হুঁ।

—কিছু বলবি?

বললাম, না।

অনেকক্ষণ দু-জনে চুপচাপ।

সৌমেন বলল, বুঝলি কবি, ভেবে দেখলাম, জীবনে যাঁরা হাঁটুগেড়ে বসে চায়, অন্তত ভালোবাসার ব্যাপারে গর্ব নিয়ে মাথা উঁচু করে বেড়ায় না, তারাই বুদ্ধিমান। এই যেমন ধর তুই। তোর জীবনটা কমেডি হয়ে ওঠেনি সত্যি কথা, কিন্তু ট্র্যাজেডিও তো নয়। তুই আন্তরিক তাকে চেয়েছিলি; তুই পাসনি। আমি মনে মনে কাঙালপনা করে বেড়িয়েছিলাম, বাইরে রাজরাজেশ্বর হয়ে বড়াই করেছিলাম। তার ফল কী হল? তোকে এতদিন বোকা ভাবতাম, বুঝলি কবি, তুই দেখছি আমার চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান।

আমার ভালো লাগল না। সৌমেনের কথা বলা, সৌমেনের চোখের চাউনি। সৌমেনের মতো আত্মবিশ্বাসী ছেলের জন্যেও শেষে কিনা আমার মতো নার্ভাস লোকের অনুকম্পা দেখাতে হবে। না; এই সৌমেনটা আমার জীবনের শনি। কেবল গোলমালই করে দিল সব। ভালো করতে পারল না কিছুই। অথচ মায়াও হচ্ছে বেচারার জন্যে। আর—আহা! শর্মিলা শেষে আত্মহত্যা করল! আর ভাবা যায় না।

বোতলটায় তখনও কিছু তলানি পড়ে ছিল। সৌমেনের গ্লাসে একটু ঢেলে আমার গ্লাসে বাকিটা ঢেলে নিলাম। তবু কিছুই হচ্ছে না। সৌমেনকে বললাম, আর বোতল নেই? সৌমেন আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল। তারপর একটু হাসল। অদ্ভুত হাসি। ওর মতো প্রচন্ড ছেলের পক্ষে ওরকম হেঁয়ালির হাসি আশ্চর্যজনক। তারপর বলল, আছে, এটাই শেষ কর, আনছি। এক চুমুকে গ্লাসটা শেষ করে সৌমেন আর এক বোতল আনতে গেল। আমি সেই বিরাট সর্বপ্রকাশী হলদে চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আমার গ্লাসে চুমুক দিতে লাগলাম। শেষ চুমুক দিতে যাব এমন সময় বাংলো থেকে একটা বন্দুকের আওয়াজ হল। হাত থেকে সবটুকু খুশি চলকে পড়ল। কোনোরকমে বাংলোয় পৌঁছে দেখি সৌমেন মেঝেতে পড়ে আছে। মুখটাকে চেনা যাচ্ছে না। গলায় নল ঠেকিয়ে পা দিয়ে ঘোড়া টিপেছিল।

কী আর বলব। তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়ে, বাইরে বারান্দায় এসে দেখি, হলুদ চাঁদটা নীল হয়ে গেছে। হাতটা কাঁপছিল, পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করার চেষ্টা করতে লাগলাম। ছেলেটা আমার শনি। সারাজীবন জ্বালিয়ে গেল, মরবার সময়ও ভদ্রভাবে মরতে পারল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *