সগর রাজা
দিদি! জামাইবাবু গেলেন কোথায়? এখনও এলেন না তো! তিনটে বাজতে চলল। শরীর ভেঙে যাবে যে! খাবেন কখন?
প্রথমা বললেন, তোর জামাইবাবুর শরীর পাথরে তৈরি। যম ভাঙলেও ভাঙতে পারে, সে ভাঙার পাত্র নয়।
রিটায়ার্ড মানুষ, সারাদিন করেন কী? বলছিলে তো বেরিয়েছেন সেই সকাল পাঁচটাতে!
—হ্যাঁ। একটা ডিম-এর পোচ আর এক কাপ চা খেয়ে বেরিয়ে যান। আর ফেরার কোনোই ঠিক নেই।
—কী করবেন এত টাকা? এখন প্রয়োজনটা কী?
—টাকার জন্যে করেন না, যা করেন বরং গাঁটের কড়ি খরচ করেই করেন।
—সোশ্যাল ওয়ার্ক? মিশনারিজ অব চ্যারিটিজ-এর ব্রাঞ্চ আছে বুঝি?
—না। তা নয়। তবে অন্য কিছু। ওয়ান ম্যান ট্রাস্ট। ওয়ানম্যান মিশন।
—কী যে হেঁয়ালি করো দিদি! বুঝি না আমি! তুমি বলো না কিছু? ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো বলে।
—বলে কী হবে! চিরদিনই তো ওইরকমই।
—মনে হচ্ছে, তোমার খুব রাগ।
—কার ওপরে?
—জামাইবাবুর ওপরে।
—অনুরাগ তো কোনোদিনও ছিল না।
—তা বলে, বিরাগ ছিল বলেও তো জানিনি।
—না। তাও বলতে পারি না।
—তবে? দ্বিতীয়া বলল।
বলব, এক ধরনের উদাসীনতা ছিল। না-ছিল অনুরাগ; না বিরাগ। প্রথমা বলল।
—তবে? রিটায়ার্ড করেছেন সাত বছর হল। শালিক এত ভালো হয়েছে, স্টেটস-এ এত বড়ো চাকরি করছে। ফিঙের বিয়ে দিলে জামশেদপুরে। ব্রিলিয়ান্ট জামাই। তোমাদের তো এখন ইটারনাল হানিমুনই করার কথা।
—হানিমুন যারা করে তারা বিয়ের পরদিন থেকেই করে। তোদেরই মতো। সময়ে শুরু না করলে আর হানিমুন করা যায় না।
—বিয়ের পর পূর্ণচন্দ্রে বেড়াতে গেলেই কি আর মধুচন্দ্রিমা হয় দিদি! বিয়ের পরে ও বলত, ‘মানিব্যাগে মানি নেই, হানিমুনে হানি।’
—ক-বছর যেন হল তোদের?
—দেখতে দেখতে ন-বছর।
—দশ বছরে পার্টি দিবি না?
—কীসের পার্টি? মারামারির? ভুল বোঝাবুঝির?
—আহা! সকলেই যেন তোর জামাইবাবুর মতো বেরসিক?
—সকলেই সমান দিদি। কারও রাগ দেখা যায়, আর কারও রাগ অন্তঃসলিলা, এই যা!
—বলিস কী রে! বিজনকে দেখে তো বোঝা যায় না। এমন ভালোমানুষ ছেলে। মুখে রা-টি নেই।
—পরের বরকে কে আর কবে বুঝেছে বলো দিদি।
—গুর্জরি তো অন্য কথা বলে।
—কে গুর্জরি?
—পাশের বাড়ির। আমাদের নেবার। তোরই মতো বয়সি হবে।
—কী বলেন তিনি?
—সে বলে, পরের বরকে বোঝা যত সোজা, নিজের বরকে বোঝা তার চেয়ে অনেকই বেশ কঠিন।
—ম্যাদামারা, অফিস করেই ফুরিয়ে-যাওয়া স্বামী হলে অন্য কথা। তবে রিয়্যাল এনার্জেটিক, সাকসেসফুল পুরুষ হলে, সে অন্যের স্বামীই হোক, কী ব্যাচেলর, তাদের বোঝার চেষ্টাতেও আলাদা উন্মাদনা আছে।
দ্বিতীয়া বলল, যা বলেছ দিদি!
—বাবা! দিতু, তোর মধ্যে যে এমন আগ্নেয়গিরি ছিল, তা তো আগে আদৌ জানতে পারিনি আমরা কেউই।
—জানবে কী করে। আগ্নেয়গিরি মাত্রই হাজার হাজার বছর ঘুমোয়। কুম্ভকর্ণের বাবা সব। তার জ্বালামুখের জ্বালা যখন চরমে ওঠে তখনই-না সে জেগে উঠে ভেতরের লোহা পাথর সব গলিয়ে উৎসারিত, উৎক্ষিপ্ত করে।
—তোমাদের এই চিত্তরঞ্জন জায়গাটি কিন্তু ভারি সুন্দর হয়ে গেছে। দেখলেও ভালো লাগে। কী করে এমনটি হল বলো তো?
—ভালো করে চোখ চেয়ে দেখেছিস কি সৌন্দর্যের কারণটা কী?
—চোখ না চেয়েও বলতে পারি। আগে ছোট্ট ‘ডি’ টাইপ না ‘ই’ টাইপ কোয়ার্টারে থাকতে তোমরা। এখন নিজেদের কী সুন্দর বাংলো।
—সেটা তো হল শুধু আমাদের বাংলোর কথা। তুই তো পুরো চিত্তরঞ্জনের সৌন্দর্যের কথাই বলেছিস। তাই তো?
—বোধ হয় তাই-ই! আজ সকালে ট্রেন থেকে নেমেই মনে হল তোমাদের এখানে যেন কোনো বিপ্লব ঘটে গেছে। নীরব কোনো বিপ্লব। লাল শালুর ব্যানার নিয়ে শোভাযাত্রা হয়নি, অন্য কোনো ব্যানার নিয়েও নয়; লাঠি বা গুলিও চলেনি। অথচ এখানে অবশ্যই ঘটেছে কিছু।
বলেই বলল, আমি কিন্তু খুব রাগ করেছি, জামাইবাবু তার একমাত্র শালিকে স্টেশানে নিতে আসেননি বলে।
দ্বিতীয়া বলল, হুঁ। রাগ তো হওয়ারই কথা। তবে একমাত্র শালি বলেই হয়তো যায়নি!
প্রথমা হাসছিলেন।
বললেন, বলেছিস ঠিকই। বিপ্লব একটা ঘটেছে। কিন্তু সেটা কী তা বল দেখি। কীসের বিপ্লব?
—দাঁড়াও। এখুনি বলতে পারব না। ভাবতে দাও। একদিন সময় দাও, ভেবে বলব।
—বিশ্রাম করবি না? ঘুমুবি নাকি একটু? খাওয়ার পরে গড়াস না একটু ছুটির দিনে?
—দুপুরে? না: বাবা। মুটিয়ে যাব। তুমি কি দুপুরে ঘুমোও নাকি আজকাল?
—আমি? হ্যাঁ ঘুমোই।
—সত্যি! তোমার কী সুন্দর ফিগার ছিল দিদি। যখন গীতবিতান থেকে ফিরতে, পাড়ার মোড়ে রতনদাদারা ধপাধপ পড়ে যেত তোমাকে দেখে।
—আমাদের সময়টাই অন্যরকম ছিল। কত ভদ্র-সভ্য ছিল মানুষ। রূপ-গুণের অ্যাডমিরেশানের রকমটাও অনেক আলাদা ছিল। অন্যকে ‘পেড়ে’ না ফেলে নিজেরাই পড়ে যেত! বল?
—যাই বলো, তুমি সত্যিই কিন্তু ভীষণ মুটিয়ে যাচ্ছ। হচ্ছিল তোমার ফিগারের কথা। কোন কথাতে চলে এলে।
হেসে ফেললেন প্রথমা।
বললেন, হ্যাঁ। বলতে চেয়েছিলাম যে, যতদিন দেখার লোক থাকে; তোর দিকে অ্যাডমায়ারিং চোখে চেয়ে দেখার লোক; আশা থাকে, ভবিষ্যৎ থাকে, ততদিন ফিগার-টিগারের মতো এইসব বাহুল্য নিয়ে মেতে থাকাটা শোভা পায়। এখন আমার ফিগার কেমন তার চেয়েও অনেক বড়ো কথা আমার কাছে, আমার বাত আছে কি নেই? আর্থরাইটিস, রিউম্যাটিজম; ডায়াবেটিস আছে কি নেই? ব্লাড প্রেসার ফ্রাকচুয়েট করে কি করে না! তা ছাড়া, আমার শরীরের দিকে আর কোনো পুরুষই তো উৎসুক চোখে তাকায় না, ফিগার ভালো রেখে লাভ কী?
—তোমার সঙ্গে কথা বলাই মুশকিল। পুরুষেরা তো অধিকাংশই শুয়োর, নয়তো গাধা। ওরা আবার সৌন্দর্যর আসল পূজারি কবে থেকে হল!
—তুই তাহলে আসল পুরুষ দেখিসনি।
—নকলের সঙ্গে দিন কাটাই, নক্কালদের ভিড়ে আসল দেখার সময় হল কোথায়?
—তোর সঙ্গে কথা বলাই মুশকিল। আমার বয়সে এসে পৌঁছোলে, আমার কথা বুঝবি। কেমন ফালতু ফালতু লাগবে নিজেকে। আর কারওরই কোনো প্রয়োজনে তো লাগবি না। ছেলের তোকে দরকার হবে না, বউমাই তার সব। মেয়েরও তোকে দরকার হবে না, জামাই-ই তার সব হবে। তাদের ভবিষ্যৎ, তাদের Spouse-এর কেরিয়ার, তাদের উন্নতি, তাদের ছেলে-মেয়ের স্কুলিং, তাদের সেকেণ্ড জেনারেশনের ভবিষ্যৎ নিয়েই তারা চব্বিশ ঘণ্টা ব্যতিব্যস্ত থাকবে। একটা সময়ে, আমাদের জীবনে যে ওদের চিন্তাটাই আমাদের সবকিছু ছিল; সর্বস্ব, ওরা ছাড়া আমাদের অন্য কোনো অস্তিত্ব ছিল না, এই কথাটা যখন ছেলে-মেয়েরা অবলীলায় ভুলে যাবে, তখন খুবই রাগ হবে নিজেদের ওপরে। মূর্খ বলে মনে হবে।
কিন্তু এখন করার আর কী আছে বলো? ওদের ভালোই তো আমাদের ভালো। এই কথা বুঝিয়ে মনকে চোখ ঠারি। কিন্তু ওদের ভালোটা যে আমাদের ভালো নয়, সেকথাটাও প্রাঞ্জলভাবে বুঝতে পারি।
—দুপুরে ঘুমোও তুমি? রোজ?
—রাতে সে ঘুম হয় না!
—কেন?
আমার বয়সে পৌঁছো, জানবি। সারারাতই প্রায় জেগে থাকি। হাই তুলি। নানা কথা ভাবি। শালিক আর ফিঙের ছেলেবেলার কথা মনে হয়। তোর জামাইবাবুর প্রথম যৌবনের কথা। মানুষটার আমাকে ছাড়া একমুহূর্ত চলত না। এখন ওর আমাকে শারীরিকভাবে তো নয়ই, মানসিকভাবেও আর কোনো প্রয়োজন নেই। নিজের জগতে বুঁদ হয়ে থাকে।
—আমার কিন্তু এবারে রাগ হয়ে যাচ্ছে দিদি!
—হঠাৎ? কেন? কার ওপরে?
—জামাইবাবুর ওপরে! এসেছি প্রায় আধঘণ্টা। তিনি তো জানেন যে, আমি আসব।
জানে বই কী। সেই তো স্টেশনে পাঠাল আমাকে। নিজে বাজার করেছে সাতসকালে উঠে। আশ্চর্য! তুই কী কী খেতে ভালোবাসিস সব এতবছর পরেও মনে করে রেখেছে কিন্তু। আমি ভুলে গেছি যদিও।
—সত্যি? যেমন?
—খেলি তো! যেমন চিংড়ি মাছ, যেমন ভেটকি মাছের কাঁটাচচ্চড়ি, যেমন ধোকার ডালনা, যেমন ছানার পায়েস।
—সত্যি! মনে রেখেছেন জামাইবাবু!
—দেখলাম তো যে, রেখেছে।
—কিন্তু গেছেন কোথায় তাও কি বলে যাননি? তোমাকে কোনোদিনও কি বলে যান না?
—না:। তবে সম্ভবত কচি ব্যানার্জির বাড়িতে গেছে। বন-মহোৎসবের পরে।
—ও হ্যাঁ, এখন তো অরণ্য সপ্তাহ, না কী যে চলছে কলকাতায়। মোড়ে মোড়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হোর্ডিং দেখি।
—শহরের মোড়ের হোর্ডিং-এ অরণ্য সপ্তাহ?
হ্যাঁ। নইলে ভোটাররা জানবেন কেমন করে?
কিন্তু কচি ব্যানার্জির বাড়িতে কী? কে তিনি?
তাঁর স্ত্রীর বয়স কম। শরীরের বাঁধুনি ভালো। লাস্যময়ী। চাইনিজ রাঁধেন ভালো।
জামাইবাবু কী চাইনিজ খাবেন ওঁর বাড়িতে? হেসে বলল, দ্বিতীয়া।
কী কী খাবেন অথবা খাবেন না তা আমি কী করে বলব! কিছুমাত্র নাও খেতে পারেন। চোখে দেখার সুখও তো একটা মস্তবড়ো সুখ, নাকি? দর্শনের সুখও কী বড়ো কম হল এই বয়সে! একটু কথা বলার, একটু কাছে থাকার…
আহা! সে সুখ তো সব বয়সেরই।
মনের মতো মানুষ যে সবসময়েই অন্য মন খুঁজে বেড়ায়।
কিন্তু তুমি মানা করো না?
মানা? কেন, মানা করব কেন?
আমার মধ্যে, আমার শরীর-মনে কত অপূর্ণতা। তা নিয়েই তো মানুষটা চাঁদমুখ করে জীবন কাটিয়ে গেল। বিধাতা যদি আমাদের ‘পূর্ণা’ করেই সৃষ্টি করতেন তবেও তো না-হয় অন্যকথা ছিল। অপূর্ণতাই তো নারী ও পুরুষের জীবনের সারকথা; অমোঘ নিয়ম। পরিপূরক হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টাই তো সারাজীবনের সাধনা। পূর্ণতা তো ব্যতিক্রম! একটা concept মাত্র। কথার কথা। বাংলাতে বললে ‘সংজ্ঞা’ বা ‘আদর্শও’ বলা যেতে পারে।
সুন্দর বলেছ দিদি। এমন করে তো ভাবিনি কখনো।
দুই
ওদের খাওয়া হয়ে গেছিল অনেকক্ষণ। প্রথমা এবারে একটু শোবেন। প্রতি রবিবার দুপুরে রেডিয়োর নাটক শোনেন। ভালো বাংলা ছবি থাকলে বিকেলে দেখেন। উত্তমকুমারের ছবি থাকলে তো দেখেনই।
একটা হাই তুলে প্রথমা বললেন, আমি তাহলে গিয়ে শুই একটু?
—শোও।
—তুই কী করবি?
—ভাবছি। যা গরম!
তোদের এয়ার-কণ্ডিশনড ঘরে থাকা অভ্যেস। পুজো থেকে দোল অবধিই এখানে ভালো সময়। তবে এখন গুমোট হয়ে আছে তাই। বৃষ্টি হলেই দেখবি প্লেজেন্ট হয়ে যাবে।
—ওটা কী গাছ দিদি?
—কোনটা?
—ওই যে।
—ওটা, কেসিয়া নডুসা।
—একটি বইয়ে পড়েছিলাম কেসিয়া নডুলাস।
জানি না। লেখক নুডলস খেতে খেতে লিখেছিলেন হয়তো। অমন নাম তো শুনিনি। নিশ্চয়ই ভুলে লিখেছিলেন। সর্বজ্ঞ তো কেউই নন। তবে আমার তো সবই শোনা বিদ্যে। তোর জামাইবাবু এলে ঠিক বলতে পারবেন।
—তোমার ইন্টারেস্ট নেই গাছগাছালিতে?
—আছে। অত বড়ো বড়ো গাছ নয়। আমার শ্রাবস, ফার্নস, অর্কিডস, সাকুলেন্টস, ব্রমেলিয়াডস এসব ভালো লাগে।
এমন সময়ে কাঁকুড়ের পথে একটি সাইকেলের টায়ারের কিররররর, আওয়াজ শোনা গেল। তারপর গেটটা খোলার আওয়াজ। সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে জামাইবাবু ঢুকলেন।
দ্বিতীয়াকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন গিরিজাপ্রসন্ন, এই যে অদ্বিতীয়া। কী খুশি যে হলাম। তোমার ওল্ড ফ্লেমকে মনে পড়ল তাহলে! বাবা:, আমার একটামাত্র শালি। দু-দিন না দেখতে পেলেই বুকের মধ্যেটা কেমন করে ওঠে।
—ঢং করবেন না। ন-বছর পরে। তাও আমাকেই আসতে হল।
—বুড়ো মানুষকে ক্ষমা করে দিয়ো।
দ্বিতীয়া দাঁড়িয়ে উঠে বলল, বুড়ো বলে তো মনে হচ্ছে না একটুও। দিদিই বরং বুড়িয়ে গেছে।
আহা বেচারা! ওর যে কত স্যাক্রিফাইস। ছেলে-মেয়েকে শরীরের সৌন্দর্য দিয়েছে, রক্ত-মাংস; মনের ভালোবাসা; এমন হনুমানের মতো স্বামীর অত্যাচার সহ্য করেছে সারাটা জীবন। কিন্তু কই? আমি তো আমার বউকে ইয়াংই দেখি। সেই ফুলশয্যার রাতেরই মতো। আসলে সেই সালংকারা চেহারাটা, সেই সুগন্ধি স্মৃতিটাই জ্বলজ্বল করে কিনা।
সাইকেলটা রেখে এসে প্রেমের কথাগুলো বললে হত না। যত্ত ঢং। প্রথমা বললেন।
গিরিজাপ্রসন্ন গ্যারাজের মধ্যে সাইকেলটা ঢুকিয়ে রাখলেন।
দ্বিতীয়া দেখেছিল যে একটা স্কুটারও আছে। গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন সম্ভবত ফিঙের বিয়ের সময়ে। অবস্থা পড়ে গেলে, রিটায়ার করলে, অধিকাংশ মানুষেরই মনে নানারকম কমপ্লেক্স জাগে। দিদি-জামাইবাবুকে ব্যতিক্রম বলে মনে হল দ্বিতীয়ার।
—খাবে তো? নাকি, মণি খাইয়ে দিয়েছে?
—কোন মণি? নয়নমণি? না ফণী রায়ের মণি?
—ঢং। যেন জানো না!
—ও…বাঁড়ুজ্যের বউয়ের কথা বলছ? পরশমণি?
—আজ্ঞে।
—কিন্তু আমার যে ছোঁয়াবার মতো আজ কিছুমাত্রই নেই যে সোনা করব ছুঁইয়ে! তা কী আর খাওয়াবে সে?
—আপনি নাটকের দলে নাম লেখান না কেন জামাইবাবু?
—কেউ যে ডাকল না। সারাটা জীবন তো মহড়াই দিয়ে চলেছি।
কী খেয়ে এসেছ তার বাড়িতে? প্রথমা জিজ্ঞেস করলেন।
কেন? ডাল-ভাত, রুটি-মাংস।
দেখেছ ডার্লিং অদ্বিতীয়া? তোমার দিদির কী রসজ্ঞান! যদি খাওয়াবেই, পরশমণি, নয়নমণিই; তবে ওইসব সাদামাটা ডাল-ভাত-মাংসের ছাঁট কোন দুঃখে খেতে যাব। আমি কি ডালমেশিয়ান কুকুর? না স্পিৎজ? খাওয়াবেই যদি তো…
তুমি কী বলো, ডার্লিং?
তুমি যদি কোনোদিন কোনো পরপুরুষকে কিছু খাওয়াবে বলে মনস্থই করো, তবে কি তুমি ডাল-ভাত ছাড়া অন্য কিছু খাওয়াবার কথা ভাববে, না ভাববে না?
দ্বিতীয়া হেসে ফেলল।
বলল, চলুন হাত ধুয়ে নিন। আমি আগে খেতে চাইনি। দিদিই বলল যে, আপনার ফেরার কোনোই ঠিক নেই।
যথার্থই যে পুরুষ, তার ফেরার কোনোদিনই ঠিক থাকে না। উলিসিস থেকে শক্তি চাটুজ্যে থেকে গিরিজাপ্রসন্ন সেন পর্যন্ত। তবে তোমার মতো কেউ যদি রোজ বসে থাকত তবে যখনই ফিরতে বলতে, কাঁটায় কাঁটায় ঠিক তখনই ফিরে আসতাম।
শুনছ। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। সম্ভবত প্রেসারটা বেড়েছে। প্রথমা বললেন।
—শালি জামাইবাবু একসঙ্গে হলে দিদিমাত্ররই প্রেসার বাড়ে। ওষুধটা খেয়েছ তো?
—হ্যাঁ।
—আজকে ডাবল-ডোজ খেলে পারতে।
—দ্বিতীয়া, আমি শুতে চললাম রে। তোর জামাইবাবুকে খাওয়াস।
তিন
বিকেলে গিরিজাপ্রসন্ন দ্বিতীয়াকে নিয়ে হাঁটতে বেরোলেন।
দুপুরে জোর একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। আবহাওয়া সত্যিই প্লেজেন্ট হয়ে গেছে। জামাইবাবুর লম্বা-চওড়া শক্তসমর্থ চেহারা এখনও সেরকমই আছে। ষাট বছর বয়স অবধিও টেনিস খেলেছেন। শুনেছে অনেকেরই কাছে যে, টেনিস এমনই একটা খেলা, যা মৃত্যুদিন অবধিও খেলা যায়। কেন ছেড়ে দিলেন, কে জানে! গিরিজাপ্রসন্নর সবই ভালো, শুধু নামটি ছাড়া। বড়ো সেকেলে নাম।
দ্বিতীয়া বলল, জামাইবাবু, সত্যিই বলুন তো ওই মণি বা মণিদের, যাদেরকার কথা বলছিল দিদি, তিনি বা তাঁরা কি সত্যিই আপনার হার্টথ্রব। পুরুষেরা পঁয়ষট্টিতে কেমন হন, মানে কেমন আকার ধারণ করেন সেটা জেনে রাখলে, আমার বরকে ওই বয়সে বোঝা সহজ হয়ে যেত।
ডার্লিং পুরুষেরা তো কুকুর নয় যে, সবাই একইরকম হবে। একইরকম হয় কুকুর, শুয়োর, গাধা এইসব প্রাণী। তাদের মধ্যে আবার এক এক প্রজাতি এক একরকম। ল্যাব্রাডর গান-ডগ আর ডালমেশিয়ান যেমন একইরকম হবে না, তেমন রামচন্দ্র যে শিকার করা বন্য বরাহর মাংস খেতেন, সেই ফলমূল-খাওয়া বরাহ আর বস্তির নোংরা-খেকো শুয়োরে তফাত অবশ্যই ছিল। এবং থাকবে।
—আঃ! বলুন, সত্যিই মণি বলে কেউ আছেন? আপনার?
—একজন নয় গো ডার্লিং। আমার অনেক মণি। আমি মণিময়। এই দ্যাখো সামনেই তিন-তিনটে আকাশমণি। এ ওর মুখে চেয়ে আছে।
দ্বিতীয়া চোখ তুলে দেখল, তিনটি সুন্দর গাছ। বড়ো গাছ।
—বা:। এদের নাম বুঝি আকাশমণি?
—হ্যাঁ। অন্য নামও আছে। রবীন্দ্রনাথ নাম দিয়েছিলেন অগ্নিশিখা। আফ্রিকাতে বলে—আফ্রিকান টিউলিপ।
দ্বিতীয়া লক্ষ করছিল যে, গিরিজাপ্রসন্ন হেঁটে যাচ্ছেন আর দু-পাশের অগণ্য মানুষ তাঁকে নমস্কার করছে। কেউ বলছে, নমস্তে সেন সাব, কেউ বলছে, নমস্কার স্যার, কেউ বলছে, ভালো তো গিরিজাদা? কেউবা সাইকেল, স্কুটার, মোটরসাইকেল অথবা গাড়িও থামিয়ে হাত বাড়িয়ে হাতে হাত রেখে কথা বলছেন। কেউ হ্যাণ্ডশেক করছেন। এই যে এত মানুষের, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের ভালোবাসা, এটা কিন্তু ভয়মিশ্রিত ভালোবাসা নয়। নিখাদ ভালোবাসা। সম্পূর্ণই স্বার্থহীন। এক ধরনের সম্ভ্রম মেশানো আছে এই ভালোবাসাতে তা বুঝতে পারছিল দ্বিতীয়া, কিন্তু সেটা কী কারণে যে, তা বুঝতে পারছিল না।
—আপনি কি ইলেকশানে দাঁড়াবেন? জামাইবাবু?
গিরিজাপ্রসন্ন হাসলেন।
বললেন, দাঁড়ালে তো আমিই বত্রিশ-পাটি বিগলিত করে সকলের কাছে ভোট ভিক্ষা চাইতাম! আমাকে দেখে কি তাই মনে হচ্ছে? মনে হচ্ছে নাকি যে, আমি অলরেডি ইলেক্টেড।
—তা অবশ্য ঠিক।
পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, পায়ে কাবুলি জুতো। ধুতি পরা তো ভুলেই গেছে বাঙালিরা!
ভারি সুন্দর দেখছিল দ্বিতীয়া তার জামাইবাবুকে। এই বয়সেও লম্বা-চওড়া, ঋজু চেহারা, চওড়া কবজি, একমাথা কোঁকড়া চুল, সল্ট অ্যাণ্ড পেপার; কবজিতে বাঁধা একটি চমৎকার ঘড়ি। বাবা দিদির বিয়ের সময়ে এক মক্কেলকে দিয়ে সুইজারল্যাণ্ড থেকে আনিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এটা…
—এটা সেই ঘড়ি?
—না গো শালি। শ্বশুরমশায়ের দেওয়া ঘড়ি আমি নিজে শ্বশুর হওয়ার পর জামাইকে দিয়ে দিয়েছি।
—এটা কী ঘড়ি?
—এটা টাইটান। আমাদের দেশেই এতসব ভালো জিনিস হচ্ছে এখন, মিছিমিছি বিদেশির প্রয়োজনই-বা কী?
একজন মিস্ত্রিগোছের মানুষ উলটোদিক থেকে আসছিলেন সাইকেল চড়ে। সাইকেল থেকে নেমেই ভক্তিভরে মাথা নীচু করে প্রণাম করে তিনি খুশির হাসি হেসে বললেন, নমস্কার গাছবাবু। দশটার মধ্যে আটটাই বেঁচেছে। বড়োও হয়েছে অনেক। তিন বছরের মধ্যে ছায়া দেবে। একদিন গিয়ে দেখে আসবেন। সেদিন দু-মুঠো ডালভাতও খেয়ে আসবেন আমাদের বাড়ি। গাঁয়ের সকলের অনুরোধ।
—যেমনভাবে লাগিয়েছিলাম, তেমন গোল করেই লাগানো আছে তো! নাকি তুলে এদিক-ওদিক করেছ?
—না না। কী যে বলেন। এক বছরের মধ্যেই এমন চেহারা হবে কেউ ভাবেনি। এ গাছের বাড় তো মেয়েছেলের বাড়ের চেয়েও বেশি। কী সুন্দর যে দেখতে লাগে। কী বলব! বড়োবাবু একটা নামও দিয়ে দিয়েছেন।
—বা:। চমৎকার। কিন্তু বড়োবাবু মানে?
—লেদ-শপ এর বড়োবাবু। তাঁরও বাড়ি তো আমাদের গ্রামেই।
—তা কীসের নাম দিয়েছেন উনি?
—কেন? ওই গাছেদের কুঞ্জর। নাম দিয়েছেন ‘গিরিজা-কুঞ্জ’। আমরা প্ল্যান্টে সকলে মিলে চাঁদা তোলা আরম্ভ করেছি যে যেমন দিতে পারে।
—কীসের জন্য?
‘গিরিজা-কুঞ্জে’ পার্কের মতো বেঞ্চ লাগাব গোল করে ন-খানি। লোহার ফ্রেমের উপরে মোটা কাঠের তক্তা লাগানো থাকবে। বিজা কিংবা শালকাঠেরও। শক্তও হবে, রোদ-বৃষ্টিতে নষ্টও হবে না শিগগিরি।
বিজা কাঠ কী? দ্বিতীয়া শুধাল।
—হ্যাঁ রে বাবু। ওই গাছের কাঠ দিয়েই গোরুর গাড়ির চাকা হয়। তবেই বোঝো!
—যখন করব, আপনার সঙ্গে পরামর্শ করেই করব। সাদা রং করে দেব সব বেঞ্চে।
মানুষটি চলে গেলে দ্বিতীয়া বলল, কী গাছ জামাইবাবু?
সোনাঝুরি। তবে সোনাঝুরি লাগাবার আমার আদৌ ইচ্ছা ছিল না। সোনাঝুরি দেখতে ভালো যদিও, কিন্তু ইউক্যালিপটাস, সোনাঝুরি এসবে মাটি খারাপ করে দেয়। তা ছাড়া একোলজির পক্ষেও ভালো নয়। গাছে কীটপতঙ্গ হয় না, পাখি বসে না, বাসা করে না, পাখির সঙ্গে আরও অনেক কিছুরই যোগাযোগ আছে। যদি জঙ্গলে হত তো তোমাকে বোঝাতে পারতাম। এই শহরে তো সাপ নেই, ময়ূর নেই, ইগল নেই, বেজি নেই, অনেক কিছু নেই। তবু, যেখানে যেটুকু পারি, করি। কী ভালো যে লাগে শালি, তোমাকে কী বলব!
দিদি আজই দুপুর বেলাতে বলছিল, গাছ, মেয়েদের কাছে পুরুষেরই মতো।
হয়তো। আর পুরুষের কাছে; মায়ের মতো। আমার এই ইডিপাস কমপ্লেক্সটি কিন্তু আছে। এবং এর জন্যে গর্বিত। গাছই আমার প্রাণ; আমার প্রেমিকা। বাঁড়ুজ্যের বউমণি আমাকে কী খাওয়াবে কতটুকু খাওয়াবে, আমি যে মণিময় দ্বিতীয়া! প্রতি পথের পাশে পাশে আমার মণিরা দিনে-রাতে আমার প্রতীক্ষাতে থাকে। কোনো কোনোদিন শ্রাবণের প্রবল বর্ষণের মধ্যে টোকা মাথায় দিয়ে সাইকেলে চেপে আমি ওদের দেখতে বেরোই। আঃ! কতরকমের সাবানই যে আছে ওদের স্টকে! এক একজনের গায়ে এক একরকম গন্ধ। আর বৃষ্টির পরে তো যেন খোলতাই হয় আরও।
কখনো আবার মাঝরাতে বেরোই। চৈত্র-পূর্ণিমাতে বা দোল-পূর্ণিমাতে। মাঘী পূর্ণিমাতেও আসি। কখনো ঘোর অমাবস্যাতে। প্রেমিকার কোনো রূপই তো আর ফ্যালনা নয়। বলো?
হুঁ। দ্বিতীয়া বলল, অস্ফুটে।
—ওদের মধ্যে অধিকাংশই আমার চেয়ে বয়সে বড়ো, কেউ-বা ছোটো, অনেকই ছোটো। কারও সঙ্গে আমার মা-মাসির সম্পর্ক, কারও সঙ্গে শাশুড়ির, কারও সঙ্গে স্ত্রীর, কারও সঙ্গে শালির, কারও সঙ্গে ছেলের; কারও সঙ্গে মেয়ের।
বলেই বললেন, ভেটকু আর সল্লিকে সঙ্গে নিয়ে এলে না কেন দ্বিতীয়া? ওদের গাছ চেনাতাম। গাছ যারা শিশুবয়স থেকে চিনতে শেখে, ভালোবাসতে শেখে, তাদের ভালোবাসা ডাইহার্ড হয়। এখন আমাদের বাঁচা-মরার সঙ্গে, পৃথিবীর বাঁচা-মরার সঙ্গে, গাছেদের বাঁচা-মরার প্রশ্ন জড়িয়ে-মড়িয়ে গেছে। মানে, ওরা বাঁচলে, তবেই আমরা বাঁচব; এই পৃথিবী বাঁচবে।
বা:! কী সুন্দর গন্ধ। কী উঁচু গাছ রে বাবা। দ্বিতীয়া বলল।
—হ্যাঁ।
—কী গাছ এটা?
হাসতে হাসতে শিশুর মতো বললেন গিরিজাপ্রসন্ন, আরে! কনকচাঁপা। ছেলেবেলাতে পড়েছ মনে নেই, ‘তার গোঁফ জোড়াটি পাকা, মাথায় কনকচাঁপা।’ সেই কনকচাঁপা। বেচারি একা একাই কাটিয়ে দিল সারাটা জীবন নির্মলকাকুর মতো। কিছুদিন হল আর একটিকে এনে লাগিয়েছি আমি। তবে বড়ো অসমবয়সি হয়ে যাবে এ প্রেম। তবু তো হবে। প্রেম প্রেমই! শেষবেলাতে এলেও এল। তুমি নবোকভ-এর ‘ললিতা’ পড়েছ?
—ওঃ। পড়েছি। সিকেনিং।
আর এক বার পোড়ো। তুমি বলছ কী! ইংরেজির ছাত্রী ছিলে তুমি! আমি তো রেলগাড়ির ইঞ্জিন বানানো ইঞ্জিনিয়ার। নিখিল ব্যানার্জি যেমন করে সেতার বাজাতেন, ইংরেজি ভাষাটাকে নিয়ে, তেমনই করেই বাজিয়েছেন নবোকভ। আমার অবশ্যই বইটির কথা মনে এল অসমবয়সি প্রেমেরই কথাতেই। শারীরিক প্রেম।
—প্রেমের পরিণতি কি শরীরই? জামাইবাবু?
—নির্ভর করে। হতেও পারে, নাও হতে পারে। পাত্র-পাত্রীর ওপরেই সব নির্ভর করে। আমার যে এই গাছেদের সঙ্গে প্রেম, এরমধ্যেও শরীর আছে কিন্তু।
হেসে ফেলল দ্বিতীয়া, গিরিজাপ্রসন্নর কথা শুনে।
বলল, গাছেদের শরীর?
—হ্যাঁ। তাকিয়ে দ্যাখো। যেকোনো গাছেদের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো। দ্যাখো যেখানে, দুটি ডাল বাইফার্কেট করেছে সেখানে নজর করে দ্যাখো, কী দেখছ?
—কী?
দুটি ঊরু নয় কি? ঊরুসন্ধি আর জঘন? উলটো দিক দিয়ে দ্যাখো, মানে, আপসাইড ডাউন করে। কি? নয় কি?
—সত্যিই তো!
স্তম্ভিত হয়ে বলল দ্বিতীয়া, আশ্চর্য! কত হাজার গাছ দেখলাম, কখনো নজর করে দেখিনি। সত্যি! আপনি হয় পারভার্ট নয় জিনিয়াস।
—জিনিয়াস-এর সঙ্গে পারভার্সিটির মিল অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়। তবে, আমি দুটোর একটিও নই।
চোখে যা পড়ে, তাই কি আমরা দেখি, না দেখতে শিখেছি? চোখ তো সকলকেই দিয়েছেন বিধাতা, দেখবার চোখ ক-জনকে দিয়েছেন বলো?
—তা ঠিক।
এদিকে-ওদিকে চেয়ে নিজের মনে স্বগতোক্তির মতো বলল দ্বিতীয়া।
তারপর বলল, আপনি কিন্তু বেশ অসভ্য আছেন।
মেয়েরা যে পুরুষকে ভালোবাসে তাকে পাগল বলে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন। আর আমি বলছি, অসভ্যও বলে। গিরিজাপ্রসন্ন বললেন।
অসভ্য! বলল দ্বিতীয়া। দ্বিতীয় বার।
—এটা কী গাছ?
—কুর্চি। আমার নাতনি হলে তার নাম রাখব কুর্চি।
—আর নাতি হলে?
—শিমুল।
—আর ছেলের ঘরে নাতি হলে? শালিক তো শুনেছি আমেরিকার মেয়ে বিয়ে করবে।
তাতে কী? করুক-না। যার যা খুশি করুক। যার যার জীবন তার তার। যে যাতে খুশি হয়।
মেমসাহেব রাগ করবে না দিশি নাম রাখলে?
বিদেশি নামই রাখব। ছেলে হলে রাখব জ্যাকারাণ্ডা। জ্যাকারাণ্ডার ফুল দেখেছ কখনো। এই ক-দিন আগেই ফোটা শেষ হল। গরমের শুরু থেকে ফুটবে আবার। ফিকে বেগুনি। আমার বিয়ের সময়ে তোমার কী বয়স ছিল? ক্লাস নাইনে পড়তে না তখন তুমি?
হুঁ।
ঠিক সেই বয়সি মেয়েদের শেষরাতের স্বপ্নর মতো হালকা, নরম আলতো বেগুনিরঙা হয় জ্যাকারাণ্ডার ফুল।
দ্বিতীয়ার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, গিরিজাপ্রসন্নর রোমান্টিকতায়।
ভাবল, এমন জামাইবাবুর সঙ্গ থেকে যে বঞ্চিত হয়ে রয়েছে এতটা কাল, সেটা তারই মন্দভাগ্য।
আর মেয়ে হলে?
মেয়ে হলে তার নাম রাখব, পনসাটিয়া।
ইসস। নামগুলো শুনে আমারই ইচ্ছে করছে আমার আরও একটি ছেলে বা মেয়ে হোক।
এক্কেবারে না। দুটিই যথেষ্ট। আমার এই সুন্দর দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে শুধুমাত্র গাছ বাড়ানো আর সন্তান কমানোর ওপরেই। সবাইকে বলবে, বুঝেছ? শিক্ষিত-অশিক্ষিত গরিব বড়োলোক, সব্বাইকে। বুঝিয়ে বলবে। টাইম ইজ রানিং-আউট।
যে গাছেদের ঊরু ও জঙঘ আছে, তাদের শরীরের গড়ন তো মেয়েদের শরীরেরই মতো। গাছেরা কি সকলেই মেয়ে?
না, তা কেন। অনেক গাছ আছে, তাদের শরীরের গড়ন অমন নয়।
যেমন?
একটা বই-এর কথা পড়েছি, ‘দা সিক্রেট লাইফ অফ প্ল্যান্টস’। অসাধারণ বই।
কোথায় পাব?
তা জানি না।
তারপর বললেন ডালপালা সমান্তরাল ছড়ায় কিন্তু নীচের দিকে, অথচ যারা ঊর্ধ্ববাহু সন্ন্যিসির মতো, যেমন শিমুল, বাওবাব, শাল, পপলার, পাইন, স্ত্রুস, সিডার। অধিকাংশ কনিফারাস গাছই বোধ হয় পুরুষ। শীতে জমে-যাওয়া পুরুষের কাছে মেয়েরা কীসের জন্যে যাবে? তাই বোধ হয় শীতের দেশের পুরুষ গাছেরা বরফের গোঁফদাড়ি নিয়ে শীতে ঠকঠক করে কাঁপে।
—আমার এই থিয়োরি কাউকে বোলো না কিন্তু। বটানিস্টরা শুনলে ঠাট্টা করবেন আমাকে নিয়ে। ভালোবাসা ছাড়া, আমার আর তো কোনো গুণ নেই। বটানির কিছুই জানি না আমি।
হাসল দ্বিতীয়া, গিরিজাপ্রসন্নর কথা শুনে।
গিরিজাপ্রসন্ন দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, ওই যে চারটে অমলতাস গাছ দেখছ….
—অমলতাস? কী সুন্দর নাম।
—হ্যাঁ। সংস্কৃত সাহিত্যে ওই নামেই আছে এই গাছ? হলুদ হলুদ ফুল ফোটে, মেয়েদের কানের ঝুমকোর মতো। বুঝলে শালি, আমরা ইংরেজিই শিখেছি, কিন্তু শিক্ষিত হইনি। তুমি যেকোনো শিক্ষিত মানুষকে একটি গাছ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করো, এটা কী গাছ? উত্তরে কী বলবেন তিনি জানো?
—কী?
—বলবেন গাছ। কী গাছ আবার কী? গাছ! কী পাখি আবার কী? পাখি!
শহরের মানুষ, কী করে গাছ চিনবেন? দ্বিতীয়া বলল।
—এটা বাজে কথা।
গ্রামের মানুষও অনেকেই চেনেন না, আবার শহরের মানুষের মধ্যে কেউ কেউ চেনেন। আমাদের শিক্ষাটাতে ম্যাট-ফিনিশ লেগেছে। গ্লসি করতে হবে তাকে। দীপ্তিমান করতে হবে শিক্ষাকে।
—বলুন, কী বলছিলেন অমলতাসের কথা?
—ওইখানে একটা ছাইয়ের গাদা ছিল আগে, জানো? ওই যে বস্তিটা দেখছ, বস্তির যত ছাইপাঁশ সব ওখানেই ফেলত এনে ওরা। আমি চারটি অমলতাস এনে লাগালাম। দ্যাখো, পাঁচ বছরে কত বড়ো হয়েছে। ওদের বাড়তে দেখে নিজেরাই জঞ্জাল আর ছাই ফেলা বন্ধ করল। এখন ওই গাছগুলিরই নীচে বস্তির যুবক-যুবতীরা একে অন্যকে প্রেম নিবেদন করছে। শিশুরা বিকেলে খেলে। বৃদ্ধরা সন্ধের পরে এসে স্মৃতিমন্থন করে।
বলেই বললেন, আমাদের শ্মশানগুলোকে গাছে গাছে সবুজ করে দিতে ইচ্ছে হয় আমার।
গিরিজাপ্রসন্ন যেন ঋগবেদে বর্ণিত সেই অরণ্যস্তবের মধ্যে সশরীরে প্রবেশ করে গেলেন।
স্তব্ধ হয়ে লক্ষ করল দ্বিতীয়া।
—বাড়ি যাবেন না?
—চলো। আমি ভাবি, আমার তো মোটে এক ছেলে এক মেয়ে। আমি যেদিন মরব, সেদিন এই চিত্তরঞ্জনের কত গাছই যে কাঁদবে আমার জন্যে। যে হাজার হাজার শিশু-যুবক-বৃদ্ধর মধ্যে গাছেদের জন্যে এই ভালোবাসা, আমাদের পৃথিবীর জন্যে এই দরদ সঞ্চারিত করতে পেরেছি, তারাও কাঁদবে। ভাবতেও যে কী ভালো লাগে শালি, তোমাকে কী বলব।
একটু চুপ করে থেকে বললেন, এ কিন্তু নার্সিসিজম নয়, এ ভালোবাসা আমাকে নয়, এই এদের সকলকে, যারা এমন মণিহার পরিয়েছে আমায়। এই ভালোবাসাই আমার একমাত্র উত্তরাধিকার! আমার যে সহস্র সহস্র সন্তান। সগর রাজা আমি!
এখন চাঁদ উঠেছে বৃষ্টি-ধোয়া আকাশে। পশ্চিমাকাশে সন্ধ্যাতারা জ্বলজ্বল করছে। সমানে মানুষজন নমস্কার করতে করতে, উইশ করতে করতে চলেছেন দু-পাশ থেকে, গিরিজাপ্রসন্নকে। স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসায়।
দ্বিতীয়ার খুবই গর্ব হচ্ছিল ওর একমাত্র জামাইবাবুর পাশে পাশে হাঁটতে।
কত মানুষ, কতরকমের উত্তরাধিকার রেখে যান। কিন্তু কী দারুণভাবে বাঁচছেন, বাঁচলেন জামাইবাবু। কী গভীর আত্মতৃপ্তিতে, স্বার্থগন্ধহীন আনন্দে। পরের, পরের, পরের, তারও পরের প্রজন্মের জন্যে, তাঁর অগণ্য সন্তানদের জন্যে, এই পৃথিবীকে সুন্দর করার জন্যে।
আশ্চর্য!