চন্দ্রভাগা যাত্রা
সাধারণত আমার যাতায়াত যেখানে, সেখানে অন্য মানুষের পা পড়ে না। মানুষের, বিশেষ করে দলবদ্ধ মানুষের, ভালোলাগার সমস্ত জায়গাই আমি সভয়ে এড়িয়ে চলি। এড়িয়ে চলি মানুষকেও, কারণ মানুষ আমার কাছে হিংস্র বন্যপ্রাণীর চেয়েও অনেক বেশি ভয়াবহ।
আমি ঘুরি, জঙ্গলে জঙ্গলে। এমন সব জায়গায় তো ঘুরি না যে, এসে সগর্বে বলতে পারি কাউকে, অমুক পীঠে গেছিলাম অথবা অমুক তীর্থে ঘুরে এলাম। আমার জঙ্গল-তীর্থের কোনো কৌলীন্য নেই। তাই চুপ করেই থাকি। জঙ্গলের কথা বলে আপনাদের বিরক্তির সঞ্চার করব না।
আপনারা অনেকেই যেখানে যান, বা গেছেন সেরকমই একটি তীর্থর নাম করছি শুধু। যাঁরা যাননি বা জানেন না, তাঁদেরই জন্যে। যাঁরা জানেন এবং গেছেন, তাঁরা আমরা জ্ঞানের সামান্যতম ক্ষমা করবেন। জ্ঞান প্রদর্শনের জন্য কলম ধরিনি; ধরেছি আপনাদের সকলের সঙ্গে পথের ও প্রবাসের আনন্দ, সমানভাবে ভাগ করে নেওয়ার আশায়।
কোনার্ক আপনাদের সকলেরই হয়তো দেখা। বেশিরভাগ ট্যুরিস্টদের কাছেই কোনার্ক শুধুমাত্র রতি-কলার সুন্দর অথবা বিকৃত একটি উদাহরণ। ওই আশ্চর্য, ঝাউবন-মর্মরিত, বালি-সিরসির, দূরের অনুপস্থিত সমুদ্রের উপস্থিতির আভাসে উদ্ভাসিত স্থবির অথচ চিরউড্ডীন জীবনের, যৌবনের জয়গানে মুখর ভারতীয় ভাস্কর্যর এই গরিমার গভীরতা তাঁদের অনেকেরই হয়তো চোখেই পড়ে না। গাঁয়ের যোগীকে চিরদিনই আমরা ভিক্ষা থেকে বঞ্চিতই করে থাকি। পরিচিত মহৎজনের মহত্ত্ব চোখে পড়ে না, প্রতিভাবান আত্মীয়র দোষগুলি সম্বন্ধেই চিরদিন সোচ্চার আমরা। এই ভারতীয় ঐতিহ্য ও ট্রাডিশন আজও সামনে চলেছে। তাই কোনার্কের মতো ভারতীয় গর্ব, গরিমা পায় বিদেশিদেরই প্রশংসার আঁচে। বড়োই হীনম্মন্য আমরা।
যাইই হোক, কেউ কেউ বলেন কৃষ্ণপুত্র শাম্বা চন্দ্রভাগা নদীতে চান করে কুষ্ঠরোগ মুক্ত হয়েছিলেন যে শুধু তাইই নয়, ওই নদীর বুক থেকে যে সূর্যমূর্তি কুড়িয়ে পেয়েছিলেন, সেই মূর্তি নদীতীরে একটি মন্দির গড়ে তাতে প্রতিষ্ঠাও করেছিলেন। শাম্বর পরও, নবম শতাব্দীতে পুরন্দর কেশরী, কেশরী যুগের ত্রিশতম রাজাও চন্দ্রভাগার তীরে আর একটি সূর্যমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অর্কক্ষেত্রের মধ্যে এই চন্দ্রভাগাও পড়ে।
বারোশো চল্লিশ থেকে বারোশো সত্তর খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গঙ্গাযুগের রাজা নরসিংহদেব (লাঙুল নরসিংহদেব) এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন সম্ভবত।
আর আজ উনিশশো বিরাশি শ্রাবণ শেষের এক মেঘ-মেদুর দিনে যখন আমি চন্দ্রভাগা নদীর এককালীন খাতের পাশে এবং কোনার্ক থেকে দূরে সরে-আসা সমুদ্রের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালাম এই হব-হব সন্ধ্যায়, তখন অনেক পুরোনো কথাই মনে পড়ে গেল।
হঠাৎ এও মনে পড়ল যে, আপনি আপনাদের ট্যুরিজম-এর কাগজের জন্যে কিছু লেখার সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছিলেন। মনে পড়ে যাওয়াতেই, আপনাদের খুশির যাত্রীদের একবার চন্দ্রভাগা যাত্রায় আসতে অনুরোধ করার কথাও মনে হল।
কোনার্ক নিয়ে কখনো বড়ো কিছু, ভালোবাসার কিছু লিখব বলে ইচ্ছে আছে। কোনার্ক মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়, নিজেকে ভালোবাসতে শেখায়, নিজের প্রিয় নারীদের ভালোবাসতে শেখায় এবং সবচেয়ে বড়োকথা প্রাণের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রাণের পরশ ছোঁয়ায়। প্রাণের প্রাণ সূর্যদেবতার মন্দিরের চত্বরে দাঁড়িয়ে সূর্যস্নান করে শরীর, সমস্ত শীতার্ত সংস্কার ও জড়তা কাটিয়ে উঠে সৃষ্টির আদি থেকে সমুদ্র, ঝাউবনে, বালিয়াড়ির তপ্ত বালিতে যত উষ্ণতা পুঞ্জীভূত ছিল সমস্ত উষ্ণতা হঠাৎ একমুহূর্তে তার ধমনিতে কোনো অদৃশ্য সিরিঞ্জে ইনজেকটেড হল বলে বোধ করে।
কোনার্ক-এর কথা এখন বলতে বসিনি। তাই চন্দ্রভাগা যাত্রার কথাতেই ফিরে আসি।
পদ্ম-পুরাণে অর্কতীর্থের একটি বর্ণনা আছে। অর্ক তীর্থকেই চন্দ্রভাগা তীর্থ বলা হয় আজকাল। কারণ প্রাচীন অর্কতীর্থের অনেকখানিই আজ নিশ্চিহ্ন এবং বিস্মৃত। শাম্বাই তো ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব উনিশশো শতাব্দীতে। তাহলে চন্দ্রভাগা নদী তারও অনেক আগে থেকে বইছিল এখানে। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তম দিনে এই নদীতে যদি কেউ চান করেন তাহলে তাঁর সব পাপ এবং অসুখ ধুয়ে যায় এবং সেরে যায়। আমরা শুনেছি যে, শাম্বর কুষ্ঠও সেরেছিল। তবে শাম্বও মাঘী শুক্লাপক্ষের সপ্তম দিনে চান করেছিলেন কীনা বলতে পারব না। আমাদের দেশে অনেকানেক পাপ ধোওয়া নদী ছিল বলেই মনে হয় পাপ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। পাপ করো আর পাপ ধোও। সকলেই এক এক ডুবে পাপ সাফাই করছে এবং দ্বিগুণ উদ্যমে পাপ করে যাচ্ছে।
চন্দ্রভাগা নদী একসময়ে খুব বড়োনদী ছিল, তা আগেই বলেছি। নদীর পারেই ছিল সূর্য মন্দির। তখনকার দিনে চন্দ্রভাগার তীরে এই অঞ্চলেই চিত্রোৎপলা নামে একটি বন্দর ছিল। আহা কী সুন্দর নাম! সেই সময় আমি থাকলে ওই চন্দ্রভাগার খেয়া নৌকোর মাঝি হতাম। হিউয়েন সাঙও নাকি ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দে এই বন্দরের বর্ণনা দিয়ে গেছেন। তবে চৈনিক উচ্চারণের কারণে অথবা ভুল শুনেছিলেন বলে উনি ‘চিত্রোৎপলাকে’ লিখেছিলেন ‘চে-লি-টালো’। যেকোনো চিনদেশীয় ‘চিত্রোৎপলা’ উচ্চারণ করতে পারলে, অবিলম্বে আমি তাকে আমার প্রিয়তম বন্ধুর স্ত্রী এবং একজোড়া যুবতী দুধেল গাভী উপহার দিতাম। হিউয়েন সাঙ পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন কিন্তু ‘চিত্রোৎপলের’ সঠিক উচ্চারণের পক্ষে যথেষ্ট পন্ডিত ছিলেন না। জেনে ভালো লাগে যে, পন্ডিতদেরও বাধাবিপত্তি থাকে।
চন্দ্রভাগা যাত্রার আগের রাতে অর্থাৎ শুক্লাষষ্ঠীতে, দলে দলে যাত্রা করে লোক এসে এখানে। চন্দ্রভাগা এখন মজে গেছে। এখন শুধু একটি নীলদহ, জার্মান মেয়ের উজ্জ্বল নীল চোখের মণির মতো জ্বলজ্বল করে। ওইদিন বেশ বড়োমেলাও বসে বেলাভূমি জুড়ে। আগেকার দিনে ঈশানেশ্বর, দক্ষিণেশ্বর, ত্রিবেণীশ্বরের সঙ্গে সূর্য ও চাঁদের প্রক্সি দিতে আসতেন কোনার্ক-এর সূর্য মন্দিরের সূর্য ও চন্দ্রর মূর্তি দুটি, যে দুটি এখন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে রাখা আছে। সকলে মিলে যাত্রা করে চন্দ্রভাগা নদীতে আসতেন বলেই এই উৎসবের নাম চন্দ্রভাগা যাত্রা। দেবতাদের চান করানো হত, তারপর তীর্থযাত্রীরা চান করতেন।
প্রচন্ড শীত থাকে তখন। তবুও খোলা সমুদ্র তীরে হু হু হাওয়ায় অগণিত তীর্থযাত্রীরা এবং আমার মতো পুণ্য অপ্রত্যাশী নিছক উৎসুক মানুষেরাও এসে ভিড় করেন। শেষরাতে যাত্রীরা চন্দ্রভাগা নদীতে বরফ-ঠাণ্ডা জলে চান করেন তারপর সূর্যোদয় দেখতে আসেন সমুদ্রের পারে। সাতরঙা সাতটি ঘোড়ায়-টানা রথে চড়ে সূর্যদেব যখন জল ছেড়ে ওঠেন তখন সকলে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকেন।
পারলে এ বছরই, পুজোর পরের মাঘী শুক্লা সপ্তমীতে চন্দ্রভাগা যাত্রার যাত্রী হোন।
যৌবনহীনা নারীর মতোই জলহীনা নদী চন্দ্রভাগার কাছে এই মুহূর্তে কেউই নেই। আসন্ন সন্ধ্যার সমুদ্রতীরেও কেউই নেই। দুর্যোগময় আবহাওয়া। আজ নৌকো বেরোয়নি একটিও। চন্ডাইয়া তার ভাইকে নিয়ে একটা মস্ত কোলবালিশের আকৃতির ‘কন্টেলা’ জাল নিয়ে ভাঙা-ঢেউয়ের সামনে পাততে পাততে দৌড়ে যাচ্ছে, যদি কিছু কুচো মাছ পায়। পেছনে পেছনে তার আট বছরের মেয়ে আর চার বছরের ছেলে। মাছ পেলে, তারা তো ছোটোজালে তুলে রাখবে। একজোড়া সমুদ্রচড়াই চিড়িক চিড়িক করে চমকে বেড়াচ্ছে ভেজাবালিতে। তাদের ব্যথাতুর ডাক বেলাভূমির বিষণ্ণতা তীব্রতর করছে।
বাতিঘরে বাতি জ্বলে উঠল। আলো ঘুরবে এবার সারারাত। অন্ধকারের বুক চিরে দেখতে চাইবে সারারাত, পুরুষ যেমন নারীর নগ্নতা চিরে দেখতে চায় তার রহস্যটা কোথায়? কিন্তু সারারাত মিছিমিছি মাথা ঘুরে, মাথা খুঁড়ে মরবে—জানতে পারবে না কিছুই। নারীর রহস্য নারীই জানে, অন্ধকারের রহস্য অন্ধকার। লুকোনো থাকে বলেই তা প্রকাশিত হয় না। সবকিছু প্রকাশের নয়। প্রকাশিত হলে তা আনন্দের হয় না। এইটাই সত্যি। কিন্তু বাতিঘর, আদিম পুরুষের মতোই বোকা ও জেদি। তার সমস্ত জীবনীশক্তি নি:শোষিত হবে জেনেও তবুও সে হাল ছাড়ে না। আর হাল ছাড়ে না বলেই তো সে পুরুষ।
মেরিন ড্রাইভ দিয়ে প্রচন্ড গতিতে সামুদ্রিক ঝড়ের মতো মার্সিডিস ট্রাক ছুটে গেল। চায়ের দোকানের ঝাঁপ আধখোলা। ছানা-পোড় আর ঠাণ্ডা ফুলুরি। ঘোলা -চা, প্রমত্ত সমুদ্রেরই রঙের মতো। খোলা-মন আশ্চর্য নির্জন, মলিন, বিষণ্ণ আজকের সন্ধে। কিন্তু এখানেই প্রাণ জাগবে, সূর্য, চন্দ্র, কৃষ্ণপুত্র শাম্ব, কেশরী যুগের রাজা পুরন্দর কেশরী, গঙ্গাযুগের লাঙুলা নরসিংহদেব, তাঁর প্রেমিকা শিশুপালগড়ের সুন্দরী রাজকুমারী মায়া দেবী সকলেই আসবেন মাঘী শুক্লা সপ্তমীর উৎসবে। আপনিও আসতে পারেন ইচ্ছে করলে। ঝাউবনের মর্মর ধ্বনির মাধ্যমে এই উৎসবের নিমন্ত্রণ পাঠালাম আপনাদের সব্বাইকে।