বাড়ি
খোকন দুম করে দরজাটা বন্ধ করে খেলতে চলে গেল। সারাবাড়িটা কেঁপে উঠল। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দোতলার বারান্দা থেকে সতীশবাবু খ্যাঁক খ্যাঁক করে স্বগতোক্তি করলেন।
প্রথম প্রথম রিনা ও আমার অসহ্য লাগত। কখনো কখনো এ নিয়ে দু-চারবার প্রচন্ড মনোমালিন্যও হয়েছে। কিন্তু সতীশবাবু বদলাননি।
আমাদের বাড়িওয়ালা সতীশবাবু। পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ছিলেন। রিটায়ার করেছেন। তাও বছর দশেক হল। তাঁর বাড়ির পুরো একতলা নিয়ে থাকি আমরা। গত একযুগ ধরে আছি। ভাড়া তখন অত্যন্ত কম ছিল। যদিও টাকার দাম ছিল বেশি। কিন্তু তবুও উনি অনেকবার বলা সত্ত্বেও ভাড়া বাড়াইনি। কোন ভাড়াটে বাড়ায়? একবার ঢুকে পড়তে পারলে ভাড়া বাড়ানোর কথা এবং ছাড়ার কথা মনে আনতেও ইচ্ছে করে না।
আসলে অন্যদের কথা জানি না। আমার রোজগার যে এ ক-বছরে বাড়েনি তা নয়, কিন্তু যে হারে বেড়েছে সে অনুপাতে প্রয়োজনও বেড়ে গেছে। টাকার দাম পড়ে গেছে হু-হু করে। খোকন বড়ো হয়েছে, মুশকিল হয়েছে ইতিমধ্যে, ওদের লেখাপড়ার খরচ, বড়ো করে তোলার খরচ, যেটুকু সঞ্চয় না করলে একান্তই নয়, তো এসব মিলে ভাড়া বাড়ানো সত্যিই সম্ভব হয়নি।
রিনা আর আমি কখনো যে এ ব্যাপারে আলোচনা করিনি তা নয়। সতীশবাবুরই বা কী করে চলবে? প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা দিয়ে বাড়ি করেছিলেন। সে টাকাটা থাকলে ব্যাঙ্কে সুদ পেতেন। তাঁরও এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে বড়ো, বিয়ে দিয়েছেন ভালো একটি ছেলের সঙ্গে। জামাই-মেয়ে থাকে বোম্বেতে। কখনো কখনো আসে। তাদের অবস্থা ভালো হলেও, সতীশবাবু ও গিরিজা মাসিমাকে দেখে মনে হয় না যে, মেয়ে-জামাই ওঁদের জন্যে খুব একটা ভাবে বা করে বলে। আর ওদের ছেলে তো থেকেও নেই। বড়ো বড়ো চুল রেখে ঘুরে বেড়ায়, লিটল ম্যাগাজিন বের করে, সাংগুভ্যালির চায়ের দোকান কি কফিহাউসে আড্ডা মারে, রাজা-উজির বধ করে। সাধারণ ছাত্র ছিল। কোনোক্রমে বি.এ. টা পাশ করেছিল। টাই পরে হাতে ব্রিককেস নিয়ে ফেরিওয়ালার চাকরি করাই তার জীবনের মূল উদ্দেশ্য ছিল। হয়নি বলে, সাহিত্যের কল্যাণে লেগেছে। সে মা-বাবাকে সাহায্য করা দূরের কথা, উলটে সতীশবাবু আর গিরিজা মাসিমাকেই তার সিগারেট, সিনেমা ও সাহিত্যানুরাগের খরচ দিতে হয়।
আমি একদিন বলেছিলাম ওকে যে, নীচে গ্যারাজটা খালি পড়ে আছে, ওখানে একটা স্টেশনারি দোকান দাও না, কি যে-কোনো দোকান? তাতে ও ভীষণ রেগে গেছিল। বাঙালি আত্মাভিমানে খুব লেগেছিল ওর। যে অভিমানে এই জাত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দিনে দিনে নিশিচহ্ন হয়ে যাচ্ছে।
অথচ ওরই এক বন্ধু ওই গ্যারাজ ভাড়া নিয়ে ডিম, আলু, পেঁয়াজের দোকান করল। তারপর ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিয়ে কোল্ড স্টোরেজ করে তাতে মুরগি, হ্যাম, বেকন রাখতে লাগল। এখন কিছু না কিছু মাসে তিন-চার হাজার টাকা রোজগার করে ছেলেটা।
যাকগে, কী কথায় কী কথা এসে গেল। হচ্ছিল বাড়ি-ভাড়া বাড়ানোর কথা। আগে আমরা ভাড়া বাড়ানোর কথা বহুবার ভেবেছি কিন্তু গত বারোবছরে যে ভাবে খরচের ক্ষেত্র বেড়েছে এবং টাকার দাম কমেছে তাতে এখন একেবারে হিমসিম খাচ্ছি। জানি যে, বৃদ্ধ রিটায়ার্ড সতীশবাবুর অবস্থাও আমারই মতো। কিন্তু ওঁর প্রতি নীরব সহানুভূতি ছাড়া আমার আর কিছুই করণীয় নেই।
মনে পড়ে প্রথম প্রথম সম্পর্কটা কত ভালো ছিল। রিনা মাংস রান্না করে পাঠাত ওদের। গিরিজা মাসিমা খোকার জন্মদিনে পায়েস রেঁধে পাঠাতেন। মুমলি হবে এ খবরটা পাওয়ামাত্র গিরিজা মাসিমা আচার করে, এটা ওটা রেঁধে রিনাকে পাঠাতেন। সেই সময়ের স্বচ্ছল, সুন্দরী গিরিজা মাসিমার মুখটা মনে পড়ে। জানি না, তখন হয়তো আমার মুখটাও সুন্দর ছিল, এত রুক্ষ হয়ে ওঠেনি নিজের অজানতে।
ছেলে-মেয়ে যদি ভালো না হয়, যদি বাবা-মাকে না দেখে, তাহলে আমাদের প্রজন্মের মা-বাবাদের বড়োই কষ্ট। ভবিষ্যতে হয়তো বাবা-মায়েরাও আলগা হয়ে যাবেন প্রথম থেকে, তাঁরাও তাঁদের ভবিষ্যৎ ভাববেন আলাদা করে। ছেলে-মেয়েরা ছাড়াও যে ভবিষ্যৎ বলে পৃথক কিছু তাঁদের থাকার কথা সেকথা তাঁরা প্রত্যেকে ভাববেন যৌবনেই। তখন আর এত দুঃখ হবে না। এত কষ্ট পাবেন না বৃদ্ধ মা-বাবারা ছেলে-মেয়েরা না দেখলে তাঁদের, তারা যোগ্য না হলে।
কিন্তু রিনা তাই বলে। বলে, আমরা পারলাম না। ওদের বড়ো করে তোলার পর নিজেদের ভবিষৎ বলে আলাদা কিছু আর আমাদের থাকবে না। রইল না। ওরা ফেলে দিলে, দাঁড়াবার জায়গা হবে না কোথাও।
সতীশবাবু চেঁচামেচি করতেন দরজা-জানালা দুমদাম করে বন্ধ করা নিয়ে। আমাদের বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের সম্পর্কর মাধুর্যর সুগারকোটিংটা উঠে যেতেই নানারকম বিপত্তি দেখা দিতে লাগল। দরজা-জানালা জোরে বন্ধ করলেই অথবা ঝড়ে বা জোর বাতাসে দমাদ্দম করে আছড়ে পড়লেই বলতেন, ‘বুঝবা, বুঝবা; নিজেরা যদি কখনো বাড়ি বানাও ত বুঝবা। বুকে কেমন লাগে তহন’।
আমরা বাড়ি বানাইওনি, বানাবার সম্ভাবনাও নেই কখনো, অতএব আমাদের পক্ষে সতীশবাবুর এই উক্তির সত্যাসত্য যাচাই করা সম্ভব হল না এ জীবনে। উনিও যে আরেকজন খিটখিটে, বদমেজাজি, ভগ্ন-চিত্ত, অসহযোগী রিটায়ার্ড ভদ্রলোক, একথাই আমরা মেনে নিয়েছিলাম।
মাঝে মাঝেই সতীশবাবুকে দেখে আমার রিটায়ার্ড জীবনের ভবিষ্যৎ-ছবি ভাসে আমার চোখে।
রিনা চান সেরে, কাপড়-চোপড় পরে বসবার ঘরে এলো। আমাকে তাড়া দিয়ে বলল, কী করছ তুমি? তাড়াতাড়ি করো। গগনদাদাদের বাড়িতে যাবে না? আমার দাদা বাড়ি করেছে, তাই বুঝি গা নেই।
আমি বললাম আঃ। যাব। যাব।
কখন যাবে? সল্টলেক কি কাছে না কি? যেতেই তো কতক্ষণ লেগে যাবে। তারপর কাল মুমলির অঙ্কের টেস্ট। আজ তো হবে না। কাল সেই ভোরে উঠে ওকে পড়াতে বসতে হবে। তা ছাড়া একটু আগে গেলে বাড়িটা ফাঁকায় ফাঁকায় ঘুরে দেখতে পারব। নিজের বাড়ি তো এ জন্মে হবে না।
একটু চুপ করে থেকে রিনা বলল, যদি হত, তাহলে একটা দারুণ বাথরুম আর একটা রান্নাঘর বানাতাম, জানো।
আমি রিনার চোখের দিকে তাকালাম। কেন জানি না, যা কখনো হবে না ; পারব না বলে নিশ্চিত জানি, সেই একটি ছোটো বাড়ির, নিজের বাড়ির কথা ভেবে এবং রিনার মিষ্টি, লক্ষ্মী, হাসিভরা মুখের দিকে চেয়ে আমার বুকের মধ্যেটা যেন কেমন করে উঠল।
হঠাৎ আমার মনে হল স্বামীরা কত অসহায়। স্ত্রীকে ছেলে-মেয়েকে যা-কিছুই আমরা দিতে পারি না তার সবকিছুর কষ্ট যে কী গভীরভাবে আমাদের বুকে বাজে তা যাদের না-দিতে পারার কারণে কষ্ট তারা কি কখনো বোঝে?
কিছুক্ষণের মধ্যে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। খোকা যাবে না। কোনো কথাই শুনবে না আমাদের। এখনও ওর ষোলো হয়নি। ওর এখন সময় নেই, সময় নষ্ট করবার।
মুমলিকে যথাসাধ্য সাজিয়েছে রিনা। আমার পাঁচ বছরের মেয়েকে আমি বড়ো সুন্দর দেখি। ওকে যখন বলি যে, পৃথিবীতে এমন সুন্দর মুখ আর দেখলাম না একটাও। তখন ও খুব খুশি হয়, হাসে। বলে, বাবা, আবার বলো।
মোড় থেকে একটা মিনিবাস পেয়ে গেলাম। রিনা মুমলিকে নিয়ে বসল। আমি একটু দাঁড়াবার পরই পেয়ে গেলাম জায়গা।
গড়িয়াহাটের মোড়ে খুব ভিড়। পুজোর হাওয়া লেগেছে। পুজোর আর বেশি দিন বাকি নেই। গাড়ির সারি, হাজার হাজার লোক পথে। এই তো কেনার সময়, দেওয়ার সময় মানুষকে। পাওয়ার সময় আসে, থাকে, দেওয়ার সময় বড়ো তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। কাউকে উৎসবের দিনে কিছু দিতে যে কী আনন্দ! আমার সামর্থ্য যে বড়ো কম। যদি তেমন সামর্থ্য থাকত তবে সেই আনন্দ পুরোপুরি পেতে পারতাম হয়তো। অথবা, কী জানি, সামর্থ্য থাকলে তখন হয়তো কাউকে আর কিছুই দিতে চাইত না মন। মনে হত সবই একা খাই, একা পরি, একা ভোগ করি।
গগনদাদা ডিরেকশান ভালোই দিয়েছিলেন। মৌলালিতে একবার বাস পালটে সল্টলেকে যখন পৌঁছোলাম তখন আকাশ মেঘে কালো হয়ে এসেছে।
নাম্বার দেখে বাড়ি চিনতে অসুবিধে হল না। বাড়ির সামনে তখনই চার-পাঁচটা গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। চমৎকার বাড়ি। ছোটো ছিমছাম সুরুচিসম্পন্ন। রিনা নিশ্চয়ই স্বপ্নে ঠিক এরকমই একটা বাড়ি দেখে মাঝে মাঝেই। আমার বউ রিনা।
হঠাৎ প্রচন্ড ঝড় উঠল। আমরা মুমলির হাত ধরে রিনার মামাতো দাদা গগন সেনের বাড়ির দিকে দৌড়োতে লাগলাম। যখন বাড়ির মধ্যে ঢুকছি তখনই হুড়ুম দাড়ুম করে হাওয়ায় দরজা-জানালাগুলো পড়ছিল। একসঙ্গে সব জানালা-দরজা বন্ধ তো করা যায় না।
আমরা বসবার ঘরে গিয়ে বসেছি এমন সময় গগনদাদা হাঁপাতে হাঁপাতে দোতলা থেকে দৌড়ে নামলেন। দেখলাম তাঁর কাছার একটা দিক খুলে গেছে। নিজে হাতে জানালার পাল্লা বন্ধ করতে করতে রুক্ষস্বরে বললেন, এই রিনা, ওই দিকের জানালাগুলো বন্ধ কর না। রিয়্যাল সি-পি টিকের দরজা জানালা। এরা ধাঁই ধাঁই করে পড়লে মনে হয়, বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ি পড়ছে। এই বাড়ি বানাতে ফতুর হয়ে গেছি রে। বাড়িটার জানালা দরজাগুলোই আমার হাত-পা। বুকের পাঁজর।
রিনা জানালা বন্ধ করতে করতে আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল।
আমি ওর দিকে তাকিয়েই মুখ নামিয়ে নিলাম।
আমাদের বাড়িওয়ালা। বৃদ্ধ, অবসরপ্রাপ্ত, ভাড়ার টাকায় সংসার-চালানো সতীশবাবুর ক্লান্ত চিন্তিত মুখটা মনে পড়ল আমার।
ফেরবার সময়ে মিনিবাসের জানালার পাশে বসে রিনা বলল, বাড়িভাড়াটা কিন্তু আমাদের বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।
হুঁ।
আমি বললাম।