ছিমছিমা

ছিমছিমা

আজ শ্রাবণী পূর্ণিমা। রাত নেমে গেছে বহুক্ষণ। জিম ক্যালান, বেন জনসন আর আমি হরিশ রান্ধাওয়ার সঙ্গে বসেছিলাম ফুলকাফুলি পাহাড়ের মাথায় ছিমছাম বনবাংলোর বারান্দাতে।

হরিশ এই অঞ্চলের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। নাগপুরে ও আমার সঙ্গে কলেজে পড়ত। এখন ওর পোস্টিং হয়ে গেছে বোম্বের মন্ত্রণালয়ে, সেক্রেটারি হিসেবে। আজ রবিবার। আগামী শনিবার চলে যাবে ও নাগপুর হয়ে বোম্বে। ওরই সনির্বন্ধ অনুরোধে আমরা এখানে এসেছি একটি রহস্য উন্মোচনে। রহস্য একটিমাত্র তাও বলা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, একাধিক রহস্য উন্মোচন করতে হবে আমাদের।

যখনকার কথা বলছি তা ষাটের দশকের গোড়ার দিকের। এ পর্যন্ত আমার বনবিহারের নানা ঘটনাই লিখেছি, কিন্তু ফুলকাফুলি পাহাড়ের ওপরের ছিমছিমার বাংলো, এবং পাতকানি ও ফুলন নালা, আর নীচের মারিয়া বস্তিকে ঘিরে যে-অলৌকিক রহস্য তার কথা কখনোই লিখিনি গত পঞ্চাশ বছরে কোথাওই। কারণ, ওই অভিজ্ঞতার কথা বলে শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষদের কাছে হাস্যাস্পদ হয়ে উঠতে চাইনি। ব্যাপারটা অনেকটা ঈশ্বরবোধ থাকা-না-থাকারই মতো। যার নেই, অথবা যে ঈশ্বরে বা ভূতপ্রেতেও ঘোর অবিশ্বাসী, তার কাছে এইসব গল্প করতে যাওয়াটা বাতুলতা। ভূতপ্রেতের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা জানি না, তবে এটুকু জানি যে, ঈশ্বরবোধ ব্যাপারটা একজন্মে দানা বাঁধে না। গত জন্মে অথবা পাঁচ-দশ জন্ম আগেও যদি কেউ তেলাপোকা বা ছুঁচোর জন্ম পেয়ে থাকেন, তবে তো তাঁর মানুষ জন্ম পাওয়ার জন্যে অনেক-ই দিন তপস্যা করতেই হবে। তার আগে তাঁর মধ্যে ঈশ্বরবোধ জন্মানোর আশা কম বলেই মনে হয়।

আমি নিজেও ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করি না। আজও করি না। আগেও করতাম না। কিন্তু গত ষাট বছর হল ভারতের এবং পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন বনজঙ্গল নদী-নালাতে ঘুরে এমন অনেক অভিজ্ঞতার শরিক হয়েছি, বুদ্ধি বা যুক্তি দিয়ে যার ব্যাখ্যা করা যায়নি কোনোক্রমেই। অথচ সেইসব অভিজ্ঞতার একটিকেও মিথ্যে বলতে পারি না। এখন এইরকম অভিজ্ঞতার কথা বলতে ‘টাইমস অফ ইণ্ডিয়ার’ বব রায়ের দ্বারা অনুরুদ্ধ হয়েছি বলেই তারমধ্যে একটির কথা আজ সাহস করে স্মৃতির আলো-আঁধারি থেকে বের করে ধুলো ঝেড়ে বলতে বসেছি।

ছিমছিমার বাংলোটি ফুলকাফুলি পাহাড়ের কাঁধের ওপরে। সামনেই খাড়া নেমে গেছে পাহাড়। একটি গিরিখাতের মধ্যে, যে গিরিখাতে নিবিড় হরজাই জঙ্গল। আর সেই জঙ্গলের বুক চিরে চলে গেছে পাতকানি নালা বড়ো বড়ো কালো অগণ্য প্রস্তরখন্ডর ওপর দিয়ে। আর ফুলকাফুলি পাহাড়ের পেছন দিক থেকে পাতকানি নালার চেয়েও অনেক চওড়া এবং গভীর নালা, যার নাম ফুলন, বয়ে এসে পাতকানি নালার সঙ্গে মিলিত হয়ে তৃতীয় ধারায় মিশে গিয়েছে ওয়াইনগঙ্গা নদীতে। যে ওয়াইনগঙ্গা মধ্যপ্রদেশে এবং মহারাষ্ট্রের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গিয়ে বয়ে গেছে মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের মধ্যের পেঞ্চ নদীরই মতো।

আগেই বলেছি যে, সেই রাত ছিল শ্রাবণী পূর্ণিমার রাত। সারাদিন অঝোর ঝরে বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সন্ধের পরই আকাশ পরিষ্কার হয়ে চাঁদের আলো পাহাড়-নদী-জঙ্গল সব একেবারে ডাইনি জ্যোৎস্নায় ভরে দিয়েছে। ভরা শ্রাবণে পাতকানি নালা গর্জন তুলে পাথর টপকাতে টপকাতে ছুটে চলেছে দুরন্ত বেগে ফুলন নালার সঙ্গে মিলিত হবে বলে।

ছিমছিমা বাংলোর সামনের উঁচু পাহাড়ের গা নেমে গেছে নীচু গিরিখাতে প্রায় হাজার ফিট। একেবারে খাড়া। হরিশ বলছিল যে, এর আগে ও শিকারে এসে এই ছিমছিমার বাংলোতে থাকাকালীন এ পাহাড়ের উলটোদিকের খাড়া গায়ে আলো জ্বলতে-নিভতে দেখেছে। অনেকসময় পাহাড়-পর্বতে মুনিঋষিরা ধুনি জ্বালিয়ে আস্তানা গেড়ে থাকেন, কিন্তু ওই পাহাড়ের গা এমন খাড়া যে, পাখিও পা রাখার জায়গা পায় না। দিনমানে একটি পাখিকেও দেখা যায় না পাহাড়ের ওই গায়ে, অথচ পাখি এখানে আছে অগণ্য রকমের।

হরিশের ওই কথা শুনে বেন আমাদের সকলকেই জিম করবেটের একটি কথা মনে করাল। করবেট সাহেব এক রাতের বেলা শার্দা নদীর গিরিখাতের ওপর তাঁবু ফেলেছেন। এমন সময়ে তাঁর অনুচরদের উত্তেজিত আলোচনা শুনে তাঁবুর বাইরে এসে দেখেন তারা উলটোদিকের খাড়া পাহাড়ের গায়ে যে আলো জ্বলছে আর নিভছে তা দেখছে এবং বিস্ময়ের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে এই বলে যে, যে-পাহাড় এতই খাড়া যে, পাখিও পা রাখতে পারে না, সেখানে আলো জ্বালাচ্ছে নিভোচ্ছে কারা?

আমাদের সকলেরই মনে পড়ে গেল জিম করবেটের সেই লেখার কথা। আমি সিমলিপালের জোরাণ্ডা বাংলোর সামনেও এরকম আলো জ্বলতে-নিভতে দেখেছি এক এপ্রিলের রাতে। বললাম সেকথা ওদের।

জিম বলল, কেন? থক ম্যান-ইটারের কাহিনিতে মানুষখেকো বাঘের ভয়ে উদবাস্তু হয়ে অন্যত্র চলে-যাওয়া গ্রামবাসীদের সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত গ্রামে রাতের বেলা যে আর্তচিৎকার শোনার কথা জিম করবেট লিখেছিলেন, তাঁর ‘দা থক ম্যানইটা’-এ তার কথাও ভুলে গেলে চলবে কেন?

হরিশ বলল, জিম করবেট সাহেবের ‘টেম্পল টাইগার’-এর কথা? দেবতার আশীর্বাদধন্য যে বাঘকে কোনোক্রমেই কেউ মারতে পারেননি। করবেট সাহেবও অনেক চেষ্টা করেও পারেননি। তার গায়ে গুলি লেগেও লাগত না, মন্দিরের দেবী যেন তাকে রক্ষাকবচ পরিয়ে রেখেছিলেন। তবে সেই বাঘ মানুষখেকো ছিল না।

বললাম, সেই বাঘের কথা ‘দা টেম্পল টাইগার’-এ আছে। সব ম্যান ইটারের কথাই তো আছে ‘ম্যান ইটারস অফ কুমায়ুনেই’।

হরিশ বলল, গত এপ্রিলেই সে এই ছিমছিমা বনবাংলোতেই এক রাত কাটিয়েছিল। পাহাড়তলির মারিয়া বস্তিতে এক হঠাৎ দাঙ্গাতে দশ-জন লোক মারা গেছিল। তারই তদন্তে অল্পবয়সি এস.পি.-কে সঙ্গে করে এসে তদন্ত সেরে রাত কাটাবার জন্যে জিপ নিয়ে এসে উঠেছিল এই বাংলোতে।

তারপর?

আমি বললাম।

হরিশ বলল, সেই রাতে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। যা বুদ্ধিতে ব্যাখা করা যায় না। আমার অল্পবয়সি এস.পি. একটি ধর্মভীরু আই.পি.এস. জৈন ছেলে। নাম বিদ্যাধর জৈন। সূর্য ডোবার আগেই সে খাবার খেয়ে নেয়। মাছ-মাংস দারু-ফারু কিছুই ছোঁয় পর্যন্ত না। সারাদিন আমাদের খুবই ধকল গেছিল। সে আমাকে বলে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছিল তাড়াতাড়ি। বেশ গরম ছিল। আমি ভালো করে ঠাণ্ডা জলে চান-টান করে বারান্দার বাইরে ওই জ্যাকারাণ্ডা গাছগুলোর নীচে বেতের চেয়ারে বসে বিয়ার খাচ্ছিলাম। আমার জন্যে মুরগি বানাচ্ছিল বাবুর্চি, আর পরোটা। খানা তৈরি হয়ে গেলে আমিও খেয়ে শুয়ে পড়ব, কারণ কাল ভোরে উঠেই আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে চন্দ্রপুরের দিকে। অনেকখানি পথ।

তারপর একটু চুপ থেকে হরিশ বলল, তোমরা দেখতেই পাচ্ছ যে, এই বাংলোর জানলাগুলো কীরকম বড়ো বড়ো এবং তাতে কোনো শিক নেই। কাঠের পাল্লা। বন্ধ করলে শীতের দিনে উত্তুরে বাতাস আটকায় কিন্তু গরমের দিনে অসহ্য গরম লাগে। তার কাঠের পাল্লাতে পাখি বসানো আছে। প্রয়োজনে পাখি খোলা-বন্ধ করা যায়। তবে প্রাইভেসির কোনো আয়োজন হয় না এখানে। বাংলোর সামনে ও পেছনে গাছে-ভরা হাতাতে কোনো আগন্তুকই আসে না। এ বাংলোতে কেউ স্ত্রী নিয়েও আসেন না। মেয়েরা এমনিতে আসেনই না। বাংলোটার নানা বদনাম আছে এবং সেই বদনামের কথা এখানের তিনশো বর্গমাইলের মধ্যে বসবাসকারী সব মানুষই জানেন। নিতান্ত দায়ে না পড়লে সরকারি চাকুরেও এই অঞ্চলে সরকারি কাজে এসেও রাত কাটান না।

বার্মাতে জাপানিদের সঙ্গে যুদ্ধ করে আসা ক্যাপ্টেন বেন জনসন বলল একটু বিদ্রূপের সঙ্গেই, ভয়টা কীসের?

অবভিয়াসলি ভূতপ্রেতের।

আমি বললাম।

বেন তাচ্ছিল্যভরে বলল, মাই ফুট!

জিম ক্যালান বলল, আমরা তো এসেছি ম্যান ইটারের অত্যাচারের থেকে এই অঞ্চলকে, মারিয়া গোন্দদের বাঁচাবার জন্যে। তাই তো তুমি বলেছিলে। নাকি?

হ্যাঁ, তাই তো বলেছিলাম কলকাতাতে। কিন্তু এখানে আমি কী বলব? বলবে তো হরিশ। ও-ই তো এ অঞ্চলের দন্ডমুন্ডের কর্তা। ওরই ডাকে তো এসেছি আমরা সব কাজ ফেলে।

হরিশ বলল, ভূত-পেতনি এখানের পার্মানেন্ট ফিচার। মানুষখেকো প্রাণী হচ্ছে নবতম আপদ।

প্রাণী বলছ কেন? বাঘ নয় কি?

আমি বললাম।

বাঘই যে, তা প্রত্যয়ের সঙ্গে বলা যায় না। মানুষ এখানে মরছে। বনের গভীরে পাহাড়ি নালার ধারে, নালার বুকে পাথরের ওপরে। এবং মরছে বীভৎসভাবে। তবে বাঘই যে মারছে তাদের এমন প্রমাণ এখনও কেউই পায়নি।

হরিশ বলল, আমিও তো শুধু শুনেছি। এই মড়কের খবরই পেয়েছি শুধু আমার হেডকোয়ার্টার্স চন্দ্রপুরে বসে। এদিকে ইদানীং আসা হয়নি আমারও। নাগপুর এয়ারপোর্টে তোমাদের রিসিভ করে তোমাদের সঙ্গে এই তো এলাম। একে মড়ক বা মারি বলা হয়তো উচিত নয়। শুরু হয়েছে বছর খানেক হল। গত এক বছরে তেরো-জন মানুষ এই অপ্রাকৃতিক কারণে মারা গেছে। এখন এই নরখাদক বাঘ, লেপার্ড, হায়না, নেকড়ে না বুনোকুকুরের দল তা তোমরাই আবিষ্কার করো এবং এই অপবাদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করো। এক-জন করে মানুষ মরে আর অ্যাসেম্বলিতে হইচই হয়। মহারাষ্ট্রের কিছু লোকসভার সদস্য লোকসভাতেও এ নিয়ে দু-একবার হইচই করেছেন।

হরিশ একটু চুপ করে থেকে বলল, প্রায় ষাট বছর হল দেশ স্বাধীন হলে কী হয়, এখনও সাদা চামড়ার সাহেবদের ওপরে ভয় এবং ভক্তি সাধারণ ভারতীয়র মনে, বিশেষ করে গ্রামীণ মানুষের মনে অটুট আছে বলেই মনে হয়। নইলে পাহাড়তলির মারিয়া বস্তি কুসুমবনির মুকাদ্দর এবং অন্য সব মানুষ, নারী-পুরুষনির্বিশেষে তোমাদের যা আপ্যায়ন করল, তেমন অন্য কারওকেই করতে আমি তো আগে কখনোই দেখিনি।

আমি বললাম, তুমি বড়ো এলোমেলো কথা বলো। এপ্রিলে যে এখানে এসেছিলে শেষবার তোমার তখন তো সেই রাতে কী ঘটেছিল তা বলতে গিয়েও বললে না।

হরিশ বলল, সরি সরি। ইয়েস, আই ওয়াজ ডিস্ট্রাক্টেড।

বলো।

বলছি। কিন্তু কী বলছিলাম আমি?

তুমি জ্যাকারাণ্ডা গাছের নীচে বসে বিয়ার খাচ্ছিলে।

বলছি। হ্যাঁ। হঠাৎ একটি আর্তচিৎকার করে জৈন আণ্ডারওয়্যার আর গেঞ্জিপরা অবস্থাতেই আমার দিকে উদ্ভ্রান্তর মতো দৌড়ে এল তার ঘর থেকে। আমি বিয়ার-মগ সামনে তেপায়াতে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘হুয়া ক্যা? হোয়াটস আপ?’

জৈন মুখে কথা বলতে পারছিল না, আঙুল দিয়ে ও ওর ঘরের দিকে দেখাল। আমি সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে ওই ঘরের দিকে গিয়ে বারান্দা পেরিয়ে ওর ঘরে ঢুকলাম। বাংলোর পেছন দিকেও বারান্দা আছে, তোমরা তো দেখেইছ, সেই বারান্দার পরে একসারি আকাশমণি গাছ, দু-টি ম্যাগনোলিয়া গ্রাণ্ডিফ্লোরার বড়ো গাছ—বারান্দার কাছেই। আর বেশ প্রাচীন দু-টি বটল ব্রাশ-এর গাছ। শুক্লাপক্ষর রাত ছিল। হয় পূর্ণিমা, নয় পূর্ণিমার কাছাকাছি, ফুটফুট করছিল জ্যোৎস্না। বহূদূর অবধি চোখ যায় কিন্তু আমি কিছুই দেখতে পেলাম না। নিস্তরঙ্গ পরিবেশে হঠাৎই একটা জোর হাওয়া উঠল। গাছগুলোর পাতাগুলো দুলতে লাগল। অরণ্যমর্মরে ভরে গেল পরিবেশ। কিন্তু কয়েক মিনিটের জন্যে। তারপরই সব শান্ত হয়ে গেল। হাওয়াটা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলোর পেছনে হাতার বাইরে যেখানে গভীর শাল জঙ্গল সেখান থেকে কোনো তরুণী যেন খিলখিল করে হেসে উঠল। তিনবার। তিন বার হয়েই সেই হাসি বন্ধ হয়ে গেল।

বেন শুধোল, কোন ভাষাতে সে হেসেছিল?

হরিশ বলল, ডোন্ট বি ফানি। হাসির কোনো ভাষা নেই, যদিও কান্নার ভাষা থাকতেও পারে।

গরমের জন্য সামনের এবং পেছনের সব দরজা-জানলাই খোলা ছিল।

ভাবলাম, কোনো চোর এসেছিল কি? তারপর ভাবলাম, ডি.এম. আর.পি.-র ঘরে ঢুকবে এমন বোকা মেয়ে কিংবা চোর দুনিয়াতেই নেই। আমার এবং জৈনের জিপের ড্রাইভার এবং আমাদের সিকিউরিটিরা নীচের পিচরাস্তাতেই তখন একটি ধাবাতে খাবার জন্যে চলে গেছিল। মারিয়া বস্তি থেকে যে আদিবাসী বাবুর্চিকে আমরা জিপে তুলে নিয়ে এসেছিলাম, সে আর তার হেল্পার বাবুর্চিখানাতে লন্ঠনের আলোতে রান্না করছিল। তারাই এসেছে এবারও। ঘুসু বাবুর্চি আর রঘুবীর। জৈনের জন্যে নিরামিষ রান্না রেঁধে তাকে দিনমানেই খাওয়ানোর পর আমার জন্যে আমিষ রান্না করছিল। এ বাংলোতে কোনো পার্মানেন্ট বাবুর্চি নেই। চৌকিদারও যে আছে সে সকাল বেলা নীচের বস্তি থেকে আসে, ঘর খুলে ঝাড়পোঁছ করে এবং যা হয় রেঁধে দেয় ক্বচিৎ অতিথি থাকলে। এবং বিকেল বিকেল নীচে নেমে যায়। গত এক বছর হল, অতিথি না থাকলে চৌকিদার অথবা বস্তি থেকে আসা বাবুর্চি কেউই এখানে থাকে না।

তারপর হরিশ বলল, আমি দেখলাম জৈনের ঘরে টেবিলের ওপরে ওর রিভলবারটা রাখা আছে হলস্টার সুদ্ধ। তার পাশে তার হাতঘড়ি, পার্স ইত্যাদি। খোলা ওয়ার্ডরোবে ওর পুলিশের উর্দি, হ্যাঙার থেকে টাঙানো।

আমি ওর ঘর থেকে বেরিয়ে সামনের বারান্দাতে পৌঁছোনোমাত্র জৈন দৌড়ে এসে আমাকে জাপটে ধরল, জলে ডুবে-যাওয়া সাঁতার না-জানা মানুষ যেমন করে। ও এমনই ভয় পেয়েছিল যে, কথা বলতে পারছিল না। মানুষকে ঘুমের মধ্যে বোবায় ধরলে যেমন করে কথা বলে মানুষ, তেমন করেই কথা বলার চেষ্টা করছিল জৈন, কিন্তু কিছু বোঝা যাচ্ছিল না কী বলতে চাইছে। একটি বাক্যও নয়।

তারপর? বেন শুধোল।

আধঘণ্টার মধ্যেই ওর খুব জ্বর এসে গেল। আমি ওকে বিছানাতে শুইয়ে দিলাম। কিন্তু ও আমাকে বার বার জড়িয়ে ধরছিল, ছাড়ছিল না কিছুতেই, তাই যতই গরম লাগুক আমি ওর খাটের পাশে চেয়ার টেনে বসলাম। আমার কাছে সিডেটিভস ছিল। নিজেই ওস্তাদি করে দু-টি ট্যাবলেট ওকে খাইয়ে দিলাম—অ্যালজোলাম, পাঁচ মিলিগ্রামের। কিন্তু তাতেও ওর ঘুম এল না।

আমাদের গার্ড ও ড্রাইভারেরা খেয়েদেয়ে ফিরল, আমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে তৈরি হয়ে নিলাম। জৈনকেও তার অর্ডারলি জামাকাপড় পরিয়ে দিল। তারপর বাবুর্চি, তার হেল্পার এবং চৌকিদারকেও জিপে তুলে নিলাম। দু-টি জিপ তো ছিলই। তারা সকলে মিলে ছিমছিমার বাংলোর সব জানলা-দরজা বন্ধ করে, বাসনপত্র ধুয়ে-টুয়ে উদবৃত্ত খাবার একটা পুঁটলিতে বেঁধে দরজাতে তালা লাগিয়ে জিপে উঠে বসল। আমার জিপে আমার ড্রাইভার আর আমার মধ্যে জৈনকে বসিয়ে নিয়ে রাতারাতিই আমরা রওয়ানা দিলাম চন্দ্রপুরের দিকে। পেছনে জৈনের জিপটা অন্য সকলকে নিয়ে আসতে লাগল। সারারাত জিপ চালিয়ে ব্রেকফাস্টের সময়ে চন্দ্রপুরে পৌঁছে জৈনকে হসপিটালাইজ করতে হল। সাতদিন ও অপ্রকৃতিস্থ ছিল। ওর মা-বাবাকে খবর দিয়ে আনানো হল দুধিয়াড়া থেকে ও ব্যাচেলার।

জিম বলল, এইসব ইরেলিভেন্ট ডিটেইলস জেনে আমাদের কী দরকার? হোয়াই আর ইউ বোরিং আস? তোমার জৈন কী দেখেছিল? কেন অমন ভয় পেয়েছিল? সেই রাতে সে কী দেখে অমন ভয় পেয়েছিল, তা কি পরে সে তোমাকে জানিয়েছিল?

হরিশ বলল, সেটাই তো কথা। ওই প্রসঙ্গে ওঠালেই ও বোবা ধরার মতো করত। কিছুই বলেনি। ইনফ্যাক্ট এই কারণেই ওর মা-বাবা ওর বিয়ে পর্যন্ত দিতে পারছেন না। এই ছিমছিমা বাংলোর ঘটনার কথা মানুষের মুখে মুখে এই অঞ্চলের সব জায়গাতেই রাষ্ট্র হয়ে গেছিল। আমাদের ড্রাইভার, গার্ড, বাবুর্চি, তার হেল্পার এবং চৌকিদারের মারফত পুরো কুসুমবনি বস্তিতেই বিদ্যাধর জৈন-এর অপ্রাকৃতিক অভিজ্ঞতার কথা রটে গেছিল। সেই থেকে এই ফুলকাফুলি পাহাড়ের ওপরের এই ছিমছিমার বাংলো এবং পাহাড়ের উপত্যকা এবং গিরিখাদকে সকলেই এড়িয়ে চলে। এখন দেখা যাক তোমার তিন তালেবর এই রহস্য ভেদ করতে পারে কি না আর আরও মৃত্যু যাতে না হয় তার বন্দোবস্ত করতে পারে কি না।

হরিশ বলল।

বেন একটু চুপ করে থেকে বলল, বাই দা ওয়ে, মৃত মানুষদের ডেডবডি দেখার সুযোগ কি কারওরই হয়েছিল? না সেই মানুষখেকো তাদের নিশ্চিহ্ন করে খেয়ে গেছিল? কোনো মৃতদেহের কোনো অংশই কি উদ্ধার করা যায়নি, ক্রিমেশান বা বেরিয়ালের জন্যে?

হরিশ বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।

তারপর বলল, কতগুলো স্ট্রেঞ্জ ব্যাপার আছে। অ্যাজ ভেরি রেলেভেন্ট ইনফরমেশন। তোমাদের তা-ও জানা উচিত।

কীরকম?

আমি বললাম।

একজন ভিক্টিমও মেয়ে নয়। সকলেই পুরুষ এবং সকলের বয়সই পঁচিশ থেকে পঁয়তিরিশের মধ্যে—ইন দা প্রাইম অফ ইউথ।

আর কী?

মৃতদেহ প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই উদ্ধার করা গেছে। যে এক বা একাধিক জানোয়ার এই তেরো-জন মানুষকে মেরেছে, সে বা তারা কখনোই শরীরের পুরোটা খায়নি। সামান্যই খেয়েছে।

সে কী? তাহলে মারল কেন?

হরিশ বলল, তাদের দেখা মিললে এই প্রশ্ন কোরো।

বেন বেশ ভেবেচিন্তেই বলল, সম্ভবত জানোয়ারটির ক্যানাইন টিথে কোনো প্রবলেম আছে।

জিম বলল, প্রথম অ্যাটাকটা শরীরের কোন জায়গাতে করে বলে দেখা গেছে? নিশ্চয়ই ঘাড়ে। এবং বাঁ-দিক দিয়ে লাফিয়ে ঘাড় কামড়ে ভিক্টিমকে ভূতলশায়ী করে ঘাড় মটকেছে। বাঘেদের যা অভ্যেস। কাগজে পড়ো না? সুন্দরবনের ম্যান ইটারদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে, জঙ্গলে যারা যায় তাদের উলটো করে মুখোশ পরানো হচ্ছে বাঘেদের কনফিউজ করার জন্যে।

হরিশ বলল।

তারপর বলল, আমি যা রিপোর্ট পেয়েছি অভিজ্ঞ শহুরে শিকারি এবং বুনো শিকারিদেরও কাছ থেকে, তা হচ্ছে আরও স্ট্রেঞ্জ।

কীরকম?

আমি এবারে শুধোলাম।

হরিশ বলল, মৃতদেহ দেখলে নাকি মনে হয় যে, প্রত্যেক ভিক্টিমই শকেই মারা গেছে। ঘাড়ে কোনো কামড়ের দাগ ছিল না নাকি।

শকে?

আশ্চর্য হয়ে সমস্বরে বললাম আমরা তিন-জনেই।

হ্যাঁ। এ ছাড়া অন্য কোনো এক্সপ্লানেশন তো আমার মাথায় আসছে না। অনেকই ভেবেছি এ নিয়ে।

বেন বলল, এ কোন জানোয়ার হতে পারে যে, বনজঙ্গলেই যারা জন্ম থেকে লালিতপালিত তারাও তাকে দেখামাত্রই শকে মারা যায়? তাদের অদেখা কোনো জানোয়ার বা সরীসৃপ তো এই দিককার বনজঙ্গলে নেই।

তারপর হরিশকে জিজ্ঞেস করল বেন, কী? ভাবছ কী?

জানি না।

হরিশ বলল।

সরীসৃপ তো আর মানুষের মাংস খাবে না। এইসব বনে অ্যানাকোণ্ডা কিংবা অজগরও নেই। কিন্তু থাকলেও তো তাদের মারণ-পদ্ধতি অন্য। আরও একটা স্ট্রেঞ্জ ফেনোমেনন আছে। ভেরি স্ট্রেঞ্জ। ইনডিড।

হরিশ বলল।

আরও? মাই গুডনেস! কী? ও যে দেখছি প্যাণ্ডোরাস বক্স খোলার মতো করছ তুমি হরিশ।

যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে অধিকাংশই কিন্তু জঙ্গলের মানুষ বা নীচের কুসুমবনির মারিয়া গ্রামের মানুষও নয়। মাইণ্ড দ্যাট। তবে জঙ্গলে জঙ্গলেই তাদের ঘোরাফেরা, রুজিরোজগার। তবে অধিকাংশই শহুরে যুবক, বহিরাগত। কেউ ট্রাক ড্রাইভার, কেউ ঠিকাদার, কেউ ছোটোখাটো ব্যাবসাদার, ওভারসিয়ার, শিকারি এইসব মানুষ।

আমরা সকলেই চুপ করে এই তথ্যটি জানলাম হরিশের কাছ থেকে।

একটু পরে জিম বলল, থ্যাঙ্ক গড! আমাদের সকলের বয়সই তিরিশের অনেক বেশি। বাই দা ওয়ে, তোমার এস.পি. বিদ্যাধর জৈনের বয়স কত ছিল?

ছাব্বিশ।

বেন বলল, আই সি। তোমার উল্লেখিত রেঞ্জের মধ্যেই পড়ে।

হরিশ বলল, চার-জন মিলে এক বোতল হুইস্কি শেষ করতে পারলে না। তোমরা কি এই শ্বাপদকে মারতে পারবে? আমার সন্দেহ আছে। চলো, বটমস আপ করো। আমাকে তো কাল সকালেই ফিরতে হবে।

আমি বললাম, জিম তো জলচর জীব। জলেই থাকে। ব্রিটিশ কনস্যুলেটের সাহেব। দু-কেস হোয়াইট হর্স হুইস্কি এনেছে আর বেকস বিয়ারের দু-ডজনের কার্টন।

হরিশ বলল, দ্যাখো, একে অন্যকে গুলি কোরো না, আমি মুশকিলে পড়ব কিছু একটা কেলো হলে। অ্যাজ ইট ইজ, মাই হ্যাণ্ডস আর ফুল উইথ ট্রাবল। প্লিজ হেল্প মি আউট ইফ ইউ ক্যান। আই শ্যাল বি ডিপলি গ্রেটফুল টু অল অফ ইউ।

দুই

রাতের খাওয়াদাওয়ার পর আমরা শুয়েছিলাম। রাত এখন প্রায় এগারোটা বাজে। হরিশ বিছানাতে পড়েছে কী মরেছে। আমি আর হরিশ একঘরে শুয়েছি আর জিম আর বেন দুই সাহেব অন্য ঘরে। আগামীকাল থেকে আমি একা ঘরেই শোব।

আমার ঘুম আসছিল না। বৃষ্টিশেষে নির্মেঘ আকাশে শ্রাবণী পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। এখন একটু গুমোটও করেছে। সামান্য গরমও লাগছে হাওয়াটা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে। তাই উঠে পেছনের দরজা খুলে চওড়া বারান্দার বেতের চেয়ারে বসলাম।

সমস্ত প্রকৃতি, পাহাড়, গাছগাছালি সব রুপোঝুরি হয়ে উঠেছে ডাইনি জ্যোৎস্নায়। ম্যাগনোলিয়া গ্র্যাণ্ডিফ্লোরাদের গন্ধে পুরো পরিবেশ ম-ম করছে। এই সৌন্দর্যের মোড়কের ভেতরেই আছে সেই আশ্চর্য ঘাতক, যার হাতে ইতিমধ্যেই তেরো-জন মানুষের, মানে পুরুষ মানুষের প্রাণ গেছে। একে খুঁজে বের করা এবং নিধন করাই আমাদের কাজ। আমাদের সাফল্যের ওপরেই হরিশের মানসম্মান এবং অনেকের প্রাণও নির্ভর করবে। কিন্তু এই ফুলকাফুলি পাহাড়ের চুড়োয় ছিমছিমার বাংলো, নীচে প্রবলবেগে সগর্জনে বয়ে-যাওয়া পাতকানি নালা আর ফুলন নালা আর গিরিখাদের মধ্যের এবং পাহাড়ের গায়ের ঘন হরজাই জঙ্গলের মধ্যে কীভাবে খুঁজে বের করব আমাদের সন্ধানের বস্তু?

কুসুমবনি মারিয়া বস্তি থেকে এক-জন শিকারিকে দেওয়া হয়েছে আমাদের গাইড হিসেবে। তার নাম বাটু মারিয়া। তবে একটি একনলা গাদাবন্দুক আছে। তাই দিয়েই সে সবরকম শিকার করেছে। প্রচন্ড সাহসী এবং এই অঞ্চলের বন-পাহাড়কে সে নাকি চেনে নিজের হাতের তালুর মতো। অন্য সময়ে প্রশাসনের চক্ষুশূল হলেও এই দুঃসময়ে তারই শরণাপন্ন হতে হয়েছে প্রশাসন এবং বনবিভাগকেও। বেঁটেখাটো মানুষটি। মুখে বলিরেখা পড়েছে এবং মাথার চুল পেকে গেছে। পৃথিবীর সব জায়গার ভালো শিকারিদেরই মতো সে-ও কথা খুব কম বলে, এবং স্বভাব বিনয়ী। বাটু বিকেলে বলছিল যে শবের ওপরে মাচায় বসে ও দেখেছে তিন-তিন বার যে সেই ঘাতক আর মড়ি বা কিল-এ ফিরে আসে না। হয়তো আগে মাচা থেকে কখনো তার ওপরে গুলি চলেছে। অভিজ্ঞ জানোয়ার। তাই ঝুঁকি নেয় না কোনো।

ভাবছিলাম, তাহলে কি হাঁকোয়া করার বন্দোবস্ত করব? এ ব্যাপারে কাল বিস্তারে কথা বলব বাটু মারিয়ার সঙ্গে।

বাটু মারিয়া বলেছে যে, কাল ওয়াইনগঙ্গা নদীতে কারওকে পাঠাবে মাছের জন্যে। গরমের সময়ে ওই নদীতে দারুণ চিংড়ি মাছ ওঠে। চিংড়ি মাছের সময় এখন নয়। তবে যা মাছ পাবে, তাই আনাবে।

আপাতত এই ঠিক হয়েছে যে, সকালে হেভি ব্রেকফাস্ট করে আমি আর বেন বাটুকে নিয়ে নেমে যাব পাহাড় থেকে নীচের উপত্যকায় এবং গিরিখাদে ‘টু হ্যাভ আ ফিল অফ দা প্লেস’। কোনো টেল-টেল সাইনস চোখে পড়ে কি না তাও দেখার জন্যে। নিজে চোখে না দেখলে শুধুই পরের মুখের কথা শুনে সব বোঝা যায় না। জিম ক্যালানকে বাংলোতে থাকতে বলেছি জিপের ড্রাইভার, চৌকিদার, বাবুর্চি ও বেয়ারার নিরাপত্তার জন্যে। নিরাপত্তাটা মানসিক কারণেই বেশি প্রয়োজন, কারণ ওরা ভয় পেয়ে যদি বেগড়বাই করে তবে আমাদের মুশকিলে পড়তে হবে। জায়গাটি এমন নয় যে ফোন করে বা লোক পাঠিয়ে খাবারদাবার আনানো যাবে। রসদ সব আমরা চন্দ্রপুরা থেকেই নিয়ে এসেছি দু-জিপ বোঝাই করে। ফুরিয়ে গেলে তখন দেখা যাবে। কাল থেকে অবশ্য হরিশের জিপ থাকবে না। তবে সত্যিই কোনো বিপদ হলে জিম যে কতখানি উপকারে আসবে ওদের তা বলা যায় না, কারণ শিকারের উৎসাহ জিমের যতটা, ততটা অভিজ্ঞতা আদৌ নেই। স্কটল্যাণ্ড থেকে সে সবে এসেছে। কলকাতার ব্রিটিশ হাইকমিশনের সে সেকেণ্ড সেক্রেটারি। গত শীতে আমাদের ওর বাড়িতে ‘হ্যাগেস’ দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। স্কটল্যাণ্ড অথবা ইংল্যাণ্ড অথবা এখানেও ও খেঁকশিয়ালও শিকার করেনি আগে। ওকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে আসার প্রধান কারণ ও বেন জনসনের খুবই বন্ধু হয়ে গেছে কলকাতাতে আসা ইস্তক।

বেন জনসনেরও বাঘ মারার খুব শখ, কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলে যে, এ পর্যন্ত যতবারই সে বাঘের মুখোমুখি হয়েছে ততবারই তাকে এতটাই উত্তেজিত ও ভীত দেখেছি যে, মনে মনে ঠিকই করেছিলাম যে, ওকে আর বাঘের জঙ্গলে নিয়ে আসব না। ওর হঠকারিতার কারণে আমার তো তিনবার প্রাণও সংশয় হয়েছিল। কিন্তু সে-ও নাছোড়বান্দা, তবু ওর প্রবল উচ্চাশা যে, একদিন সে তার জড়তা কাটিয়ে বাঘ শিকারির শিরোপা মাথায় পরবেই। বাঘ যারা কোনোদিন জঙ্গলে দেখেননি বা মারেননি তাঁরাই বাঘ শিকারকে অতিসহজ কাজ বলে মনে করতে পারেন। বাঘ এসে সামনে দাঁড়ালেই যে মনুষ্যশরীরের তাবৎ ফিজিক্স-কেমিস্ট্রিতে ভূমিকম্প ঘটে একথা তাঁদের জানা নেই।

এইসব কারণেই বেনের জিগিরদোস্ত জিমকে কষ্ট দিতে চাইনি আমি। আর, একজন ‘সাহেব শিকারি’ তাদের পাহারা দেওয়ার জন্যে বাংলোতে রয়ে গেলেন একথা জেনে তাবৎ দিশি ব্যক্তির মনে যে বিপুল শান্তি ও নিরাপত্তা বোধ বিরাজ করবে, সে বিষয়েও আমার সন্দেহ ছিল না কোনো। সেই জানোয়ার যদি বাঘ হয় তবে সে যে বাংলোতে জিমকে ‘হ্যালো’ বলতে আসবে না সে বিষয়েও আমি নি:সন্দেহ ছিলাম।

তবে ঘাতক যে বাঘ নয়, চিতাও নয়, তা-ও মনে হচ্ছিল। কারণ অতটুকু মাংসে তো তার খিদে মেটার কথা নয়। আর সে যদি তার স্বাভাবিক খাদ্য হরিণ, শুয়োর, নীলগাই ইত্যাদি মারতেই পারে তবে খামোখা মানুষ মারার দরকারটাই-বা কী? যদি তার প্রয়োজনেই মানুষ সে মেরে থাকে তবে সে পুরো না হলেও, অনেকখানি মাংস খেত। সে-যে কেন মানবশরীরের সামান্য অংশ খেয়েই প্রতিবারে তৃপ্ত হয় এই ব্যাপারটারও কোনো ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। তার কাছে মানুষ, বিশেষ করে পুরুষ মানুষ হয়তো চাটনির মতো। মাঝে মাঝে মুখ বদলাবার জন্যে খায়।

বাটু আর একটা কথা বলছিল, যা রহস্যকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছে। বাটু মারিয়ার মতো পোড়খাওয়া শিকারিও যে, এই জানোয়ারের মারা তিনটি মড়ির ওপরে বসেছিল সেই তিনটি মড়ির ধারে-কাছে কোনো বাঘ বা অন্য মাংসাশী জানোয়ারের থাবার দাগ নাকি সে পায়নি অনেক খুঁজেও। নয়, এক জায়গাতেও নয়।

অনেক ভেবেও আমি কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না। হরিশও কাল সকালে চলে যাবে। বেন আর জিমের কথা তো বললামই। একজন রংরুট শিকারি, অন্য-জন শিকারিই নয়, শিকার-সঙ্গী। বাকি থাকলাম বাটু মারিয়া আর আমি। আসল ঝক্কিটা আমাদেরই পোয়াতে হবে। শত্রুর স্বরূপ জানলে তবে তাকে দমনের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করা যায়, কিন্তু শত্রুর স্বরূপ সম্বন্ধে কোনো ধারণাই না থাকলে স্ট্র্যাটেজি ঠিক করা যাবে কী করে!

পেছনের বারান্দাতে বসে থাকতে থাকতে আমার দু-চোখ জুড়ে এসেছিল। গুমোট ভাবটা হঠাৎই কেটে গিয়ে আবার আস্তে আস্তে হাওয়া দিতে শুরু করেছিল। মনে হয়, পাহাড়তলিতে বৃষ্টি হচ্ছে, তাই হাওয়াটাতে ঠাণ্ডার আমেজও ছিল, নইলে আমার দু-চোখ জুড়ে আসবে কেন?

হঠাৎ আমার চটকা ভেঙে গেল। কে যেন পেছন থেকে দু-হাতের পাতা দিয়ে আমার দু-কাঁধে হাত রাখল। মনে হল রাখল, কিন্তু রাখল না আসলে। এবং সেই হাতের নৈকট্য আদৌ কর্কশ নয়। আমি চমকে চোখ চাইতেই হুড়মুড় করে ঝড় সৃষ্টি করে একটা ঝোড়ো হাওয়া উঠল, সিনেমার শুটিংয়ে ফ্লোরে ব্লোয়ারের হাওয়া দিয়ে যেমন ঝড় সৃষ্টি করা হয় তেমন তাৎক্ষণিক ঝোড়ো হাওয়া, আর সঙ্গে সঙ্গে যুবতী কন্ঠের এক দমক উচ্ছল হাসির শব্দ। শব্দটা স্থায়ী হল না। এ হঠাৎ ঝড়ের ফুৎকারে এবং ম্যাগনোলিয়ার গন্ধের সঙ্গে একমুহূর্ত মিশেই মিলিয়ে গেল পরমুহূর্তেই। আমার হঠাৎই খুব ভয় করতে লাগল। হরিশের তরুণ এস.পি. জৈন সাহেবের কথা মনে এল। তবুও আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে বারান্দা থেকে নেমে জঙ্গলের শুরু যেখানে সেখান অবধি গেলাম। কিন্তু না, চোখে কিছুই পড়ল না। আমি যখন ফিরে আসছি বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকব বলে, ঠিক তখনই পেছন থেকে সেই হাসিটা আর এক বার শুনলাম।

আমি তাড়াতাড়ি প্রায় দৌড়ে গিয়ে ঘরে ঢুকে গেলাম। বুঝলাম যে, আমি ভয় পেয়েছি।

ঘরে ঢুকে দেখি হরিশ খাটের পাশের সাইড-টেবিলে রাখা জলের গেলাস তুলে জল খাচ্ছে।

আধো-ঘুমেই বলল, কাঁহা গ্যয়াথা, ইতনা রাতমে?

আমি বললাম, তুম দিখা কুছ?

ক্যা দিখা?

শুনাথা কুছ?

ক্যা পাগলপন্থি বাত কর রহা হ্যায় তু। নেহি, ম্যায় কুছ দিখা অর শুনা নেহি। কাল সুব্বে উঠকার চলনা পড়েগি হামকো। চলো, শো যাও।

ঘরের জানলা সব খোলাই থাকবে। দরজাটা বন্ধ করে টেবিলের ওপর রাখা লন্ঠনের ফিতেটা একদম কমিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম।

তিন

সকালে উঠে তাড়াতাড়ি ছোটা-হাজরি সেরে হরিশ রান্ধাওয়া চন্দ্রপুরের দিকে রওয়ানা হয়ে গেল। আটটা নাগাদ আমরা হেভি ব্রেকফাস্ট করে নেওয়ার পর বেন, আমি আর বাটু মারিয়া পাকদন্ডী বেয়ে নীচে নামতে লাগলাম। জিম রয়ে গেল বাংলোতে বাংলোর বাসিন্দাদের মনের জোর দেওয়ার জন্য। তবে বেন আর আমি জানতাম যে, দশটা বেজে গেলেই সে বারান্দার ছায়াতে বসে বেগুনি বোগেনভোলিয়ার ঝাড়ের সামনে টেবিল ফিট করে বিয়ার সেশন শুরু করবে নিজের মনের জোর করার জন্যে। সঙ্গে বেকন আর সসেজ, আর ইতালিয়ান মাস্টার্ড দিয়ে। আমি ওকে একটা বড়ো শিশি দিয়েছি ঢাকার বিক্রমপুরের কাসুন্দির। ঢাকা জেলার বিক্রমপুর কবে ছেড়ে এসেছেন বাবা-ঠাকুরদারা কিন্তু নস্টালজিয়া যায়নি। বাংলাদেশের অনেক মানুষই ঘৃণার সঙ্গে বলেন ‘ইণ্ডিয়া’— যে-ইণ্ডিয়া হস্তক্ষেপ না করলে তাদের খান সেনাদের পদানত হয়েই থাকতে হত হয়তো চিরটাকাল। কিন্তু বাঙালি হিন্দুরা বাংলাদেশিমাত্রকেই পরমআহ্লাদে বুকে জুড়িয়ে ধরে ‘আমাগো দ্যাশের মানুষ’ বলে গর্বিত বোধ করে, যে-দেশ থেকে একদিন পরম অপমান ও অসম্মানের সঙ্গে বিতাড়িত হয়েছিল একবস্ত্রে। তাকে এখনও দেশ বলে। সত্যিই বাঙালি হিন্দুরা এক আশ্চর্য জাত। সারা-পৃথিবীতে এই জাতের কোনো তুলনা আছে বলে জানি না আমি। সম্ভবত কোনো অসম্মান অপমানই গায়ে লাগে না আমাদের। যাই হোক বৈষ্ণবঘাটা পাটুলিতে বানানো ‘বিক্রমপুরের’ কাসুন্দি জিমকে একেবারে ফ্ল্যাট করে দিয়েছে। সে সার্টিফিকেট দিয়েছে ‘মাচ বেটার দ্যান ইটালিয়ান মাস্টার্ড’।

পাহাড়ের গায়ে মাঝ বরাবর নেমেছি আমরা, এমন সময়ে দেখা গেল একটি মারিয়া যুবক খুব জোরে দৌড়ে ওপরে উঠে আসছে ওই পাকদন্ডী ধরেই। ওকে দেখেই আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম। বাটু মারিয়াকে গোন্দি ভাষাতে উত্তেজিত হয়ে কী যেন সে বলল। তাতে বাটু মারিয়াও উত্তেজিত হয়ে আমাদের দিকে ফিরে বলল, এক্ষুনি একজন মানুষকে মেরেছে জানোয়ারটা। তাড়াতাড়ি চলুন সাহেব।

ওই লোকটিই আমাদের নিয়ে যাবে পথ দেখিয়ে। বলেই, বাটু লাফিয়ে নীচে নামতে লাগল ওই লোকটার পেছনে পেছনে এবং তার পেছনে পেছনে আমি আর বেন।

নামতে নামতেই ফিসফিস করে বললাম, দিনের বেলাতেই কিল করে নাকি? তাহলে তো বোধ হয় এ জানোয়ার বড়োবাঘ বা চিতা নয়। বড়োবাঘের নাম শুনেই বাঘ শিকারি হওয়ার যার পরমআকাঙ্ক্ষা তারমধ্যে কিছু স্বভাবসুলভ বৈকল্য দেখা গেল।

আমার প্রগলভতাতে বাটু বিরক্ত হল। ওর চওড়া চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে গেল।

লোকটি আমাদের নিয়ে উপত্যকার গভীরে নামল। হরজাই জঙ্গলই যে এখানে আছে তা আগেই বলেছি। শাল, সেগুন, বিজা, কেঁদ, প্রাচীন জংলি আম, নলি বাঁশ, মহুয়া, কুসুম, আমলকী, চিলবিল, শিমুল, পলাশ ইত্যাদি গাছের গভীর জঙ্গল। আমরা পাতকানি নালার পাশে পাশে ওই লোকটিকে অনুসরণ করে পাথরের পাড় ধরে খুব সাবধানে এগোতে লাগলাম বর্ষার ঘন আণ্ডারগ্রোথের মধ্য দিয়ে। সচরাচর দিনমানে কিল করার পর স্বাভাবিক বাঘ খুবই অভুক্ত না থাকলে কিল থেকে দূরে সরে যায়। কিন্তু এই বাঘ কিংবা অন্য জানোয়ার তো স্বাভাবিক আদৌ নয়। এর সমস্ত হরকতই অস্বাভাবিক। এর মোডাস অপারাণ্ডি কী তা জানা নেই আদৌ আমাদের।

কিছুটা গিয়েই লোকটি আঙুল দিয়ে সামনে দেখাল। তারপরই আঙুলটি ঠোঁটে চেপে একেবারে চুপ করে এগোতে বলল। আমার ফোর ফিফটি ফোর হানড্রেড ডাবল ব্যারেল রাইফেলটি রেডি পজিশনে ধরে কিছুটা এগোতেই দেখলাম একটা মারিয়া ছেলে পাথরের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে, তার ডান পা-টি ডুবে রয়েছে প্রবহমাণ জলে। আর একটু বেশি ডুবে থাকলে পাতকানি নালার প্রচন্ড স্রোত দেহটা ভাসিয়ে নিয়ে যেত। পাশেই একটি কনকচাঁপার গাছ। তা থেকে ফুল ঝরে পড়েছে এবং পড়ছে চারপাশে এবং নদীর মধ্যেও। নদীতে পড়তেই সেই ফুল ভেসে যাচ্ছে তীব্র গতিতে। কনকচাঁপার তীব্র গন্ধে ম ম করছে সমস্ত জায়গাটা।

কনকচাঁপা গাছ ভারতীয় বনের গাছেদের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু হয়। একথা অনেকেরই জানা নেই। আমারও জানা ছিল না, হরিশই বলেছে কথাটা আমাকে গতকাল। সে বটানিতে পন্ডিত।

লোকটির রক্তাক্ত ধুতি ও ফতুয়াটি ছিঁড়ে-খুঁড়ে পড়ে আছে পাথরের ওপরে আর উপুড় হওয়া নগ্ন সুগঠিত শরীরের নীচ থেকে রক্তস্রোত বেরিয়ে পাথর বেয়ে এসে পাতকানি নালাতে পড়ে নালার স্রোতে বাহিত হয়ে ছুটে যাচ্ছে নালার দিকে। রক্ত, মুহূর্তের মধ্যে জলের স্রোতে মিশে গিয়ে বসন্তকালের কুসুম গাছের নতুন পাতার মতো লালরঙা হয়ে যাচ্ছে জল। শুধু জলের শব্দ আর একজোড়া কপারস্মিথ পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। একটা পাখি নদীর ওপার থেকে ডাকছে আর ওপার থেকে তার দোসরা সাড়া দিচ্ছে। নদীর একস্কেলে বাঁধা গর্জন, কপারস্মিথদের নৈ:শব্দ্য ছিদ্রিত করা ওই ডাক আর মৃত মানুষটির নিথর অস্তিত্বে জায়গাটা অত্যন্ত আধিভৌতিক হয়ে উঠেছে।

মৃত মানুষমাত্ররই একটা অন্য সত্তা আছে, তা পুরো পরিবেশ এবং প্রতিবেশকে প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত করে—একথা হয়তো এই কাহিনির পাঠকমাত্রই জীবনে একাধিক বার উপলব্ধি করেছেন।

আমি মুখে কথা না বলে ইঙ্গিতে বাটুকে বললাম উপুড় হওয়া মৃতদেহটিকে উলটে দিতে, যাতে দেখা যায় বাঘ শরীরের কোন জায়গাতে তাকে জখম করেছে এবং শরীরের কোন অংশ খেয়েছে, যদি আদৌ খেয়ে থাকে। আমার ইঙ্গিত বুঝে বাটু ওর বন্দুকটাকে আমার হাতে দিয়ে এগিয়ে সঙ্গী ছেলেটির সাহায্যে মৃতদেহটিকে উলটে দিল। উলটে দিতেই সেই বীভৎস দৃশ্যে আঁতকে উঠলাম আমরা। দেখলাম, বাঘ বা চিতা শরীরের যেখানে আক্রমণ করে তাদের খাদ্যকে হত্যা করে, আক্রান্ত মানুষের সেই ঘাড়ে কোনো আঘাতের চিহ্নমাত্র নেই। কন্ঠনালিতে কামড় দিয়ে অথবা তীক্ষ্ণ নখের আঘাতে লোকটির কন্ঠনালি ছিঁড়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এবং তার যৌনাঙ্গ, সাধনদন্ড এবং অন্ডকোষ দু-টি সম্পূর্ণ উপড়েও নেওয়া হয়েছে এবং দুই বুকের কাছ থেকে মাংস তুলে নেওয়া হয়েছে দু-টি স্তনবৃন্ত সুদ্ধু। বুকের ওই জায়গাতে দুটি দগদগে ক্ষত। এবং রক্ত বইছে কন্ঠনালি, দুই বুক এবং ঊরুসন্ধি থেকে। আমি মৃতদেহের কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে বৃষ্টিভেজা নরম মাটিতে বাঘের বা লেপার্ডের পায়ের থাবার কোনো দাগ দেখতে পাওয়া যায় কি না খুঁজতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু না, কোনো থাবারই দাগ নেই।

লোকটি মাছ ধরছিল। শুনলাম বাটুর কাছে যে, বর্ষাকালে এইসব নদীতে একরকম ছোটো মাছ পাওয়া যায়, যার নাম ‘মিছি’। বুঝলাম উত্তরবঙ্গের মূর্তিনদীর পাথর চাটা মাছ বা রায়ডাক নদীর বোরোলি মাছের মতো। পাশে একটি বাঁশের তৈরি খালোই আর একটা খেপলা জাল। খালোইয়ের মধ্যে কিছু মাছ ছটফট করছে।

পায়ের থাবার দাগ যখন নেই তখন ভাবলাম বাঘটি বা চিতাটি কি নদী সাঁতরে ওপার থেকে এসেছিল? তাই নদীর পাশের কাদা হয়তো মাড়াতে হয়নি। নদী সাঁতরে এসে পাথরে পাথরে গুড়ি মেরে এগিয়ে পেছন ফিরে বসে থাকা লোকটিকে আক্রমণ করেছিল হয়তো।

আমি ধারেকাছের কোন গাছে মাচা বাঁধা যায় তাই দেখছিলাম। ওই জায়গাটাতে গাছে গাছে নদীর ওপরে চন্ডতাপের সৃষ্টি হয়েছিল। দিনমানেও সূর্যের আলো প্রায় ঢোকেই না। রাতের বেলা চাঁদের আলো কি আর ঢুকতে পারবে? যদিও গতকাল পূর্ণিমা গেছে তবুও ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ থাকবে আজ। তা-ও সন্ধের বেশ পরেই উঠবে। গাছের খোঁজ করছি দেখে বাটু মাথা নাড়ল।

বললাম, কী?

গাছে বসে লাভ নেই সাহাব। আমি তিন-তিন বার বসেছি কিন্তু একবারও আসেনি কিলে। তা ছাড়া নানারকম ভূতুড়ে কান্ড ঘটেছে, তা আপনাকে বলতেও আমার ভয় করছে। এই লাশের কাছে থাকাটাই বিপদের।

হাতে ডাবল ব্যারেল ফোর ফিফটি ফোর হানড্রেড রাইফেল থাকা সত্ত্বেও বিপদের?

আমি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললাম।

হ্যাঁ সাহাব। তা সত্ত্বেও।

তারপর বলল, যতক্ষণ-না ওর আত্মীয়স্বজনরা এসে লাশ নিয়ে যায় ততক্ষণই ওইসব কান্ড-মান্ড ঘটতে পারে। রাতের বেলা হলে তো কথাই নেই।

আমি বললাম, বিপদকে ভয় পেতে তো আমরা আসিনি। বিপদের সূত্র খুঁজে বের করে তাকে উৎপাটিত করতেই তো আমাদের আসা। ভয় পেলে তো আমাদের চলবে না বাটু।

সাহাব, এই উপদ্রবকে যদি রাইফেল বন্দুক দিয়ে গুলি করেই মারা যেত তবে তো আমি এতদিনে মেরেই দিতাম। আমার কাছে বিলেত-আমেরিকার বন্দুক নেই বটে কিন্তু আমি আমার এই বন্দুক দিয়েই বাঘ ও বাইসনও মেরেছি অনেক।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, শুধু আমি একাই-বা কেন? এই অঞ্চলের অনেক বাঘা বাঘা শিকারি এই উপদ্রবের সমাধান করতে এসে বিফল হয়েছে। শুধু বিফলই হয়নি, অনেকে ভয়ে মারা গেছে, অনেকে বোবা হয়ে গেছে, অনেকে পাগল হয়ে গেছে। আমি তিন-তিন বার বসেছি মাচাতে রাতের বেলায়। কোনো জানোয়ারই আসেনি ‘কিল’-এ, কিন্তু যে, এসেছে তার মোকাবিলা আপনাদের না করতে যাওয়াই ভালো।

এই বলেই যে লোকটি আমাদের খরব দেওয়ার জন্যে দৌড়ে পাকদন্ডী দিয়ে ওপরে উঠছিল তাকে বলল জক, তুই যা, গ্রামে গিয়ে খবর দে, যাতে তাড়াতাড়ি ওর দেহ নিয়ে যায়।

দেহ কোথায় নিয়ে গিয়ে দাহ করবে?

দাহ করবে না। এ তো অপঘাতে মৃত্যু। সাসানডিরিতে নিয়ে গিয়ে কবর দেবে।

ও।

আমি বললাম।

বেনের পক্ষে এই উৎকন্ঠা সহ্য করা আর সম্ভব হচ্ছিল না। সে একটা বড়ো পাথরে বসে তার বড়ো বোলের ডানহিল পাইপটি বের করে নিবিষ্টমনে তামাক ভরতে লাগল। সে তো এ কথাবার্তার কিছু বুঝতেও পারছিল না, তাতে তার বিরক্তি ও ফ্রাস্টেশন দুই-ই বেড়েই চলেছিল। তবে আমাদের হাবেভাবে ও বুঝেছিল যে, প্রাণীটা বাঘ নয়, আর যাই হোক স্কটল্যাণ্ডের লেক লেমণ্ডের প্রাণী অথবা ইয়েতি হলেও ভীত হত না কিন্তু যে বাঘ মারার বড়ো সাধ ওর সেই বাঘ কাছাকাছি এলেও ও বড়োই ভীত হয় এবং মনে মনে বলে ‘ছেড়ে দে মা! কেঁদে বাঁচি।’ তাই মনে মনে সে খুশিই হয়েছিল হয়তো।

ছেলেটি চলে গেলে আমিও আমার পাইপটা ধরালাম।

আমি বাটুকে চেপে ধরলাম, তুমি তাকে দেখেছ বাটু?

কাকে?

যে বা যারা এই তেরোটি, থুরি এই লোকটিকে নিয়ে চোদ্দো হবে—এই চোদ্দো জনকে মেরেছে।

না।

তবে?

তাকে দেখা যায় না। নানা বোধ দিয়ে অনুভব করতে হয়।

তুমি কখনোই কি দেখোনি তাকে?

মিথ্যে বলব না, একবার মাত্র দেখেছিলাম। কিন্তু সেই দেখার কথা আমি মনেও করতে চাই না। তাকে দেখার পরেও যে কেন ভয়ে মরে গেলাম না তা মারুতি দেবতাই জানেন। তাঁর মন্দির আছে পাহাড়ের পায়ের কাছে। চলুন, এই লাশকে নিয়ে গেলে আপনারাও পুজো দিয়ে ফেলুন যদি বাঁচতে চান তার হাত থেকে।

তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তাকে খুঁজতে বনে-পাহাড়ে ঘুরে কী হবে সাহাব। সে যে ছিমছিমা বাংলোতেই থাকে। কখনো আপনাদের ঘরে, আপনাদের খাটে, আপনাদের পাশেই শুয়ে থাকে, কখনো চানঘরে জলের কল খুলে দিয়ে চান করে গান গাইতে গাইতে, কখনো সামনের বা পেছনের বারান্দাতে বসে আপনাদের গল্প শোনে।

তাকে দেখতে কেমন বলবে না?

না সাহাব। আগে চলুন পুজোটা সারি। প্রার্থনা করি, যেন তার সঙ্গে আপনাদের দেখা না হয়। আপনি জৈন সাহাব এস. পি.-র গল্পটা শোনেননি?

সব শুনিনি।

আপনাদের দোস্ত ডি.এম. সাহেব কুছ ভি নেহি বোলা আপলোগোকো?

নেহি তো?

অজিব বাত। কেন জৈন সাহেব বোবার মতো হয়ে গেছিলেন, কী দেখে, তার কিছুই উনি বলেননি আপনাদের?

বললামই তো কিছু বলেছেন। সব বলেননি।

কুসুমকলি বস্তি থেকে চার-পাঁচ জন মানুষ ফিরে এল সেই মছিমারের সঙ্গীর সঙ্গে। তারা বাঁশ কেটে স্ট্রেচারমতো বানিয়ে মৃতদেহটি তার ওপরে তুলে নিয়ে চলে গেল। ততক্ষণে আমরা অকুস্থলে পৌঁছোবার পরে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় কেটে গেছে।

ওরা চলে গেলে বাটু মারিয়া আমাকে আর বেনকে নিয়ে মারুতি মন্দিরের দিকে চলল। মন্দিরটি কাছেই ছিল। একটা বাঁক নিতেই দেখলাম একদল হনুমান সেই মারুতি মন্দিরের চাতালে বসে আছে। কেউ কেউ ঘোরাফেরাও করছে।

তোমাদের মারিয়া গোন্দদের দেব-দেবী তো আলাদা। তোমরা মারুতিদেবকে পুজো করো নাকি?

ঠেকায় পড়লে সবই করতে হয় সাহাব। যখনই এদিকে আসি তখনই এই মন্দিরে পুজো চড়াই বলেই-না আজও প্রাণে বেঁচে আছি।

এই মন্দিরের কোনো পূজারি নেই?

আছে সাহাব কিন্তু গত এপ্রিল থেকে এখানে মানুষ মারা আরম্ভ হবার পর থেকেই সেই বৃদ্ধ পূজারি এই জঙ্গলের মধ্যে আর থাকেন না। বহুনিয়া বস্তিতে তাঁর গ্রামেই থাকেন। তবে মহাবীর জয়ন্তীতে যখন এই মন্দিরে মহা ধুমধামে পুজো হয়, এই জঙ্গলে মেলা বসে, তখন এসে সাতদিন থাকেন। কিন্তু এই ভয়ের কারণে এই বছর মেলাও বসেনি, ধুমধামের সঙ্গে পুজোও হয়নি। মানুষ যে আসতেই চায় না এদিকে।

দেখলাম, মন্দিরের চাতাল এবং ভেতরটাও কিন্তু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।

কেউ ঝাড়পোঁছ করে নাকি?

আমি শুধোলাম বাটু মারিয়াকে।

না। কেউই থাকে না এখানে, তবে অমাবস্যা-পূর্ণিমাতে নদীর জল বেড়ে গিয়ে যখন বানের মতো হয় তখন নালার সেই জলই মন্দির ধোয়া-মোছার কাজ করে।

আর নদী যা ফেলে যায়?

তা পরিষ্কার করে এই পবন নন্দনেরা। খাবার থাকলে কিছু খুঁটে খায়, বাকিটা পরিষ্কার করে দেয়। নদী যা ফেলে তা নদীতেই ফেলে দেয় ছুড়ে।

পুজো আর আমরা কী দেব। মারুতির সিঁদুরচর্চিতা মূর্তির সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ, এমনকী ক্যাথলিক বেন জনসনও। সকলেই মনে মনে বললাম, এই অশুভ শক্তির হাত থেকে বাঁচিয়ো আমাদের।

এবার কী হবে?

এবারে আমরা বাংলোতে ফিরে যাব। আপনারা খাওয়াদাওয়া করবেন। আমিও বিকেলে বেরিয়ে পড়ব বস্তির দিকে।

সে কী? রাতে যেতে তোমার ভয় করবে না?

না সাহাব। আর কোনো ভয় নেই। আজ যে মরল সে চোদ্দো নম্বর ছিল। সেই পেতনির খোয়াইশ পুরো হয়ে গেছে। আর সে কারও প্রাণ নেবে না, কারওকে বিরক্ত করবে না। সম্ভবত আজ রাত থেকেই আপনাদের ছিমছিমা বাংলোতেও আর কোনো ভৌতিক উপদ্রব থাকবে না।

পাহাড়ে চড়তে চড়তে অবাক হয়ে বললাম, সে কী কথা! সবই তো হেঁয়ালি বলে মনে হচ্ছে।

না সাহাব, হেঁয়ালি নয়। কুসুমবনির মুকাদ্দরও তা জানত। অথচ সে-ও কথাটা চেপে গেছে আপনাদের। তবে আসল ঘটনাটা জানে ঘুসু বাবুর্চি। তার কাছ থেকেই সব শুনবেন। তবে আপনাদের এখানে অন্তত আরও ক-টা দিন থেকে যাওয়া উচিত। যদি এখানে থাকতে আপনাদের কোনো অসুবিধা না হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে ওই পেতিনের উপদ্রবও বন্ধ হয়ে যাবে। তার প্রতিহিংসা সে নিয়ে নিয়েছে। তাই তার আর দরকার নেই এখানে থাকার।

পাকদন্ডী দিয়ে পাহাড় চড়তে চড়তে ভাবছিলাম, আমরা যারা আলো ঝলমল বড়ো শহরে থাকি তারা খোঁজও রাখি না আমাদের দেশের প্রত্যন্ত প্রদেশে বনে, পাহাড়ে, নদী-বাদাতে কত অবিশ্বাস্য ঘটনা আজও ঘটে। আমার এসবে আদৌ বিশ্বাস নেই কিন্তু গত অভিজ্ঞতাটা তো মিথ্যে নয়।

লাঞ্চের সময়ে আমি বাটু মারিয়াকে অনুরোধ করলাম যে, আজ রাতটা আমাদের সঙ্গে থেকে যাও। ঘুসু বাওয়ার্চি তো বলছে আমাদের ডিনার খাইয়ে নিজেরাও খেয়েদেয়ে তারপরই বলবে ও যা জানে।

তার অনুমান তো মিথ্যেও হতে পারে।

বেন মন্তব্য করল, তাকে ইংরেজিতে সবকিছু আদ্যোপান্ত বলবার জন্য।

জিম বলল, নো ওয়াণ্ডার, মাই গ্র্যাণ্ডমা হ্যাড কশানড মি ইন নো আনসার্টেন ওয়ার্ডস দ্যাট ইণ্ডিয়া ইজ আ স্ট্রেঞ্জ অ্যাণ্ড ডেঞ্জারাস প্লেস। সেইড সো, বিকজ শি স্পেন্ট মেনি ইয়ারস ইন ভ্যারিয়াস টি গার্ডেনস ইন ডুয়ার্স অ্যাণ্ড আসাম উইথ মাই গ্র্যাণ্ডপা।

চার

লাঞ্চের পর একটা লম্বা ঘুম লাগালাম। গত রাতের ওই আশ্চর্য অভিজ্ঞতা তো ছিলই তার ওপরে ওই খাড়া পাকদন্ডী দিয়ে গিরিখাদে নামা, ওই অদ্ভুতভাবে খেয়ে যাওয়া মৃতদেহটি দেখা, তারপর আবার খাড়া পাকদন্ডী দিয়ে অতখানি ওঠা। এসবের অভিঘাত তো ছিলই, তারও পর জিমের সঙ্গে আকন্ঠ বেকস বিয়ার পান। ঘুম যখন ভাঙল তখন বেলা যেতে দেরি নেই।

কুসুমবনি গ্রাম থেকে বাচ্চা শুয়োর জোগাড় করেছিল ঘুসু বাবুর্চি। বাংলোর সামনের হাতাতে জ্যাকারাণ্ডা গাছগুলো থেকে একটু দূরে আগুন জ্বেলে বাঁশের ট্রাইপডের সঙ্গে ছুঁচোলো বাঁশের মধ্যে শুয়োরের বাচ্চাকে গেঁথে ঘুসু বাবুর্চির চ্যালারা হাতা হাতা দিশি ঘি ঢেলে বারবিকিউ করছিল। বেশ ঝোড়ো একটা জল-ভেজা হাওয়া বইছিল। পাহাড়তলিতে বৃষ্টি হয়ে থাকবে।

সন্ধের কিছুক্ষণ পরেই কৃষ্ণা প্রথমার চাঁদ উঠল আকাশে। গাছে গাছে পাতায় পাতায় বনমর্মর উঠছিল। আমরা জ্যাকারাণ্ডা গাছগুলোর তলাতে বসে হুইস্কি খাচ্ছিলাম। বাটু মারিয়া আমাদের গায়ের কাছে উবু হয়ে বসেছিল যেমন করে গ্রামীণ ভারতীয়রা বসে। আমি সঙ্গে রাম আর ব্রাণ্ডি নিয়ে গেছিলাম। বাটুকে রাম দিয়েছিলাম খেতে। ওরা সিপ করতে জানে না। চিরতার রস যেমন ঘেন্নার সঙ্গে এক ঢোক গেলে মানুষে, সেইভাবেই এক গ্লাস নিট রাম চোঁ-চোঁ করে খেয়ে ফেলেছিল বাটু। তাই বোতলটাই এনে ওকে দিলাম। আধঘণ্টার মধ্যে এক বোতল রাম খেয়ে ফেলা কোনো ব্যাপার না ওদের কাছে। বোতলটা শেষ হয়ে যাওয়াতে আরও একটা বোতল এনে দিলাম ওকে। আমাদের পেগ চারেক হুইস্কি খাওয়া হতে হতে বাটুর দু-বোতল রাম খাওয়া হয়ে গেছিল। আমি আর বেন জল দিয়েই খাচ্ছিলাম কিন্তু জলে বাস করলেও জিম জলে অবিশ্বাসী। গ্লাসে পৌনে এক গ্লাস নিট হুইস্কি ঢেলে সে খায়। এ ব্যাপারে সে বাটুকে টেক্কা দিতে পারে। বাটুর জন্যে তৃতীয় বোতল রাম যখন আনলাম তখন একটি বোতল পাঠিয়ে দিলাম বাবুর্চিখানাতে—ঘুসুর জন্যে। এমনিতে যদি কথা বলতে না চায় তাই তার জিভের আড়ষ্টতা কাটাবার অগ্রিম ব্যবস্থা এটি। তৃতীয় বোতল থেকে যখন রাম ঢালল বাটু আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার সঙ্গে সেই নরখাদকের কি একবারও সামনাসামনি দেখা হয়নি বাটু? হয়ে থাকলে আমাদের বলো, কেমন দেখতে তাকে।

এই প্রশ্নতেই বাটুর মুখ ভয়ার্ত হয়ে উঠল। কিন্তু তখনও তার মুখে কুলুপ আঁটা।

আবারও অনুরোধ করলাম ওকে।

ও একটু কেশে নিয়ে বলল, আপনাদের কালীমূর্তি তো দেখেছেন আপনি।

হ্যাঁ। তা তো দেখেছি। আমাদের দেশের বাড়িতে কালীমায়ের পুজোও হত।

এই প্রেতিনি কালীমায়ের মতো নগ্নিকা কিন্তু খুব সুন্দরী। সরু কোমর, দুটি ভরা বুক, গলাতে একটি গিলটি করা সোনার হার। দু-কানে দু-টি ঝুমকো দুল। মাথার চুল এলোমেলো কিন্তু সেই চুল কোমর ছাপানো।

তারপর?

তার মুখ রক্তমাখা এবং ঊরুসন্ধিও রক্তাক্ত। তার মুখে এক আশ্চর্য হাসি—যার মানে, দুর্বোধ্য। তার দুটি চোখ আগুনের গোলা। সে এই শ্রাবণের হাওয়ার মতো ছুটে চলে। কাছে আসে, পরমুহূর্তেই দূরে চলে যায় অথচ শব্দ হয় না কোনো। শুধু ওর সামনে-পেছনে ঝড়ের মতো হাওয়া বয়, যেন হাওয়াটা তার পাহারাদার। মাঝে মাঝে সে খিলখিল করে হেসে ওঠে। তাকে দেখলে যত বড়ো সাহসী পুরুষই হোক-না-কেন মুহূর্তে মূর্ছা যাবে আর সে যদি কারওকে ছুঁয়ে দেয় সে বোবা হয়ে যাবে ভয়ে। তার আগে-পিছের হাওয়ার সঙ্গে আতরের গন্ধ ওঠে।

জিম আর বেনকে অনুবাদ করে শোনাতে হল বাটুর কথা।

বেন বলল, ট্র্যাশ!

জিম বলল, মাই গ্র্যাণ্ডমা ওজ অ্যাবসল্যুটলি রাইট।

আমি বললাম, তুমি তাকে দেখে কী করেছিলে?

আমি আমার বন্দুক তুলে গুলি করেছিলাম।

কত দূর থেকে?

এই পনেরো-কুড়ি হাত দূর থেকে।

কী হল?

নিজের চোখে দেখলাম, গুলিটা দু-বুকের মধ্যিখানে লাগল কিন্তু সে দারুণ উল্লাসে ঝরঝর করে হেসে উঠেই অদৃশ্য হয়ে গেল। মস্তবড়ো বাঘ হলেও সেই গুলি খেয়ে ওখানে সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যেত। এত বড়ো সিসার তাল ঠুসেছিলাম তিন আঙুল বারুদ গেদে তার সামনে। কিন্তু তার কিছুমাত্রও হল না সেই গুলিতে। জানি না, আমি হয়তো কিছুক্ষণ অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম মস্ত একটা শিমুল গাছতলাতে। জ্ঞান ফিরলে বুঝেছিলাম সে লাফিয়ে লাফিয়ে পাকদন্ডী উঠে এই ছিমছিমার বাংলোতেই ঢুকেছিল। বাংলো তখন ফাঁকা। এপ্রিল মাসের গোড়াতে আর শেষ ছ-টি মানুষ তার হাতে মরার পরে এই বাংলোর স্টাফ পালিয়ে গেছিল তার নানা উপদ্রবে। আর কোনো মানুষই আসে না এই বাংলোতে তারপর থেকে। অশরীরীকে কি মারা যায় সাহাব? বন্দুক দিয়ে তাদের কী করা যাবে।

তোমার ডি.এম. সাহেব তাহলে আমাদের কলকাতা থেকে আনলেন কেন? মানুষখেকো বাঘের কথা বলে?

তা জানি না। তবে তিনি যদি আমার অভিজ্ঞতার কথা বলতেন তাহলে কি তাঁর উপরওয়ালারা বিশ্বাস করতেন? তা ছাড়া আপনাদের কাছে লক্ষ লক্ষ টাকা দামের বন্দুক-রাইফেল আছে। গাদা বন্দুকধারী আমি যা করতে পারিনি এবং অন্য অনেক স্থানীয় শিকারিরাই, তা আপনারা করতে পারবেন, মনে ভেবেছিলেন হয়তো। তা ছাড়া আপনাদের যা বললাম তা তো ওঁকে বলিনি সাহাব।

কেন বলোনি?

আমাকে পাগল বলে পাগলাগারদে ভরে দিতেন। ডি.এম. সাহাব বলে কথা।

পুরুষ মানুষ মেরে তার যৌনাঙ্গ ও বুকের দু-পাশের সামান্য অংশ আর স্তনবৃন্ত দুটিই সে খেয়ে যেত কেন?

আমি জিজ্ঞেস করলাম বাটুকে।

খেয়ে যেত বলে আমার মনে হয় না। কামড়ে ছিঁড়ে নিয়ে বা নখে উপড়ে দিয়ে সে হয়তো থু-থু করে ফেলে দিত। কিন্তু ওভাবেই সে মেরেছে প্রত্যেক পুরুষ মানুষকে। এক জন মেয়েকেও সে মারেনি। আর যাদের সে মেরেছে তাদের প্রত্যেকের বয়সই পঁচিশ থেকে পঁয়তিরিশের মধ্যে।

একথা জিম আর বেনকে বলাতে জিম বলল, বাঁচা গেল। আমাদের সকলের বয়সই পঁয়ত্রিশের বেশি। থ্যাঙ্ক গড। আওয়ার মোস্ট কভেটেড অর্গানস আর সেফ।

বেন বলল, ইউ দিজ আর লস্ট, ইউ উইল নট গেট এনি স্পেয়ারস এনি হোয়্যার।

ওই অবস্থাতেও ওদের এই ইয়ার্কিতে হাসি পেল আমার।

ডিনারের পরে সামনের বারান্দায় আমরা চেয়ারে বসে পাইপ খাচ্ছিলাম। আমি আর বেন। জিম সিগার খাচ্ছিল ড্রাম্বুইয়ের সঙ্গে। ও ড্রাম্বুইয়ের খুবই ভক্ত। ও বলে উইনস্টন চার্চিল উড হ্যাভ লস্ট দা ওয়ার হ্যাড দা সাপই অফ হিজ হুইস্কি, ড্রাম্বুই অ্যাণ্ড সিগার বিন ডিসরাপ্টেড।

আমি ঘুসুকে বললাম, ঘুসু এবারে তুমি বলো কী জানো। এবং বাটু যে বলছে যে, এরপরে সে আর মানুষ মারবে না সেই পেতিন এই ধারণার কারণই-বা কী?

ঘুসু আর বাটুকে আর এক বোতল রাম এনে দিয়েছিলাম। ওরা চুট্টা খায়। তাদের জিম দু-টি হাভানা সিগার এনে দেওয়াতে তা ধরিয়ে তাতে সুখটান লাগাবার পরে তারা দু-জনেই রীতিমতো তুরীয় অবস্থাতে।

বলো ঘুসু। আমি আবারও বললাম।

ঘুসু বলল, মার্চ মাসের মাঝামাঝি। সন্ধে নাগাদ তিনটি গাড়ি করে চোদ্দো জন অতিথি এসে পৌঁছোল। সঙ্গে একটি কালো কিন্তু খুব সুন্দরী মেয়ে। সঙ্গে ড্রাইভার ছিল না। নিজেরাই চালিয়ে এসেছিল। তারা প্রত্যেকেই নেশাগ্রস্ত ছিল। সম্ভবত মেয়েটিও। সঙ্গে রসদ নিয়ে এসেছিল। বুট খুলে ঝুড়ি বের করে দিয়ে বলল, খিচুড়ি, আলুভাজা আর ডিমের ওমলেট বানিয়ে দাও আমাদের।

আমি বললাম, আপনাদের রিজার্ভেশন আছে? থাকলেও দু-টি মাত্র ঘরে ১৫ জনকে তো থাকতে দেওয়া যায় না।

একজন একটি পাঁচশো টাকার নোট বের করে আমাকে দিল।

বলল, এইটিই রিজার্ভেশন। আর যখন ফিরে যাব এক হাজার টাকা দিয়ে যাব। রেজিস্টার-ফেজিস্টার এনো না, আমরা সই করব না। আমাদের নাম নেই, ঠিকানা নেই।

তারপর?

আমি গরিব মানুষ সাহাব। এই ফুলকাফুলি পাহাড়ের চুড়োতে ছিমছিমার বাংলোতে এমনিতে কেউই আসে না। কালেভদ্রে কেউ আসলেও আসে সরকারি অফিসারেরা। তাঁরা দু-টাকাও বকশিশ দিয়ে যান না। তাই আমার কাছে ও-টাকা অনেক টাকা। আমি ভাবলাম, ফুর্তি করতে এসেছে, রাত পোয়ালেই বিদেয় হবে। দিই থাকতে। না থাকতে দিলে ওরা হয়তো জোর করেই থাকত। ওদের সঙ্গে বন্দুকও ছিল। আমাকে মেরে রেখে গেলেও জানতে পারত না।

তারপর?

ওরা হইহুল্লোড় করছিল। মেয়েটিকে একটি বাথরুমে নিয়ে গিয়ে ড্রেসিংরুমের কার্পেটের উপরে শুইয়ে এক এক-জন করে সেই বাথরুমে ঢুকছিল। আমি এক ঘণ্টার মধ্যে খাবার দিয়ে দিলাম টেবিলে। তখন ওদের মধ্যে অনেকেরই খাবারের মতো অবস্থা ছিল না। মেয়েটি কোনোক্রমে শাড়ি জড়ানো অবস্থাতে এসে সামান্য একটু খিচুড়ি মুখে দিল। সে-ও মদ খেয়েছিল কিন্তু তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে, সে বড়ো যন্ত্রণাতে আছে। তারপর আমি আর আমার হেল্পার রঘুবীর বাসনপত্র সব বের করে নিলাম ড্রইং কাম ডাইনিং রুম থেকে। ওদের ঘরে বেশি করে জল দিয়ে দিলাম। রাতে জলের জন্যে যাতে আমাদের আবারও বিরক্ত না করে। ওরা অবশ্য অধিকাংশ নিট খাচ্ছিল। বাজে বিচ্ছিরি গন্ধের মদ। কী মদ জানি না সাহাব।

আমরা তো কোয়ার্টারে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ওরা বলল, কাল সকালে আটটাতে আমাদের চা দেবে। চা খেয়েই আমরা চলে যাব।

আমি বললাম, সব মদই খারাপ। আমরা যে মদ খাচ্ছি এ কি ভালো কাজ? মদ খাওয়া মানে বাঘের পিঠে চড়া। কখন যে গা-ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিয়ে বাঘ খেয়ে নেবে তা কেউই বলতে পারে না।

সারারাত আমরা মেয়েটার গোঙানি শুনলাম কিন্তু আমরা কীই-বা করতে পারতাম? ঘুসু বলল। গাড়িওয়ালা লোক, তায় মাতাল, আবার তায় বন্দুকধারী। আমাদের গুলি করে মেরে দিলেই-বা কে জানতে পারত।

শেষরাতে আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

তারপর?

ওরা আটটার অনেক আগে, প্রায় পাঁচটার সময় আমাদের দরজা ধাক্কিয়ে তুলে বলল, ‘চা করো। আমরা চলে যাব।’

তাই করলাম। ওরা আগে-পরে উঠে চা খেল। কারও কারও তখনও চলবার শক্তি ছিল না। যাই হোক, চা খেয়ে আমাকে হাজার টাকা দিয়ে বলল, যা সামান রইল তুমি নিয়ে নিয়ো।

ওরা যখন গাড়িতে উঠছে এক-এক করে তখনই প্রথম লক্ষ করলাম যে, মেয়েটি নেই।

আমার চেলা রঘুবীর বলল, মেমসাহেব কাঁহা?

বলতেই, দলের যে নেতা গোছের, সে ওর গালে একটা বিরাশি শিক্কার চড় কষাল।

তারপরই রঘুবীরকেও একটি পাঁচশো টাকার নোট ধরিয়ে দিল। রঘুবীর আমার চেয়েও গরিব, ওর মুখ হাসিতে ভরে গেল, যদিও তার গাল সেই চড়ে তখনও জ্বলছিল। টাকার মতো উকিল, ডাক্তার, মোক্তার কিছুই নেই সাহাব। শোকসন্তাপও টাকা হরণ করে। সর্বরোগহারী দাওয়াই। এ দিয়ে কেনা যায় না এমন জিনিস ভূ-ভারতে নেই।

তারপর?

তারপর গাড়ি তিনটি এক-এক করে চলে গেলে মেয়েটির খোঁজে ঘরে ও বাথরুমে গিয়ে মেয়েটির শাড়ি-শায়া-ব্লাউজ এবং অন্যান্য অন্তর্বাস স্তূপীকৃত পড়ে আছে দেখতে পেলাম। চেঞ্জ রুমটি লন্ডভন্ড হয়ে রয়েছে। কার্পেট একপাশে গুটিয়ে গেছে।

মেয়েটির একটি হ্যাণ্ডব্যাগও দেখতে পেলাম। বাথরুমেই এককোণে কার্পেটের ওপরে। সেই খোলা ব্যাগের ভেতর থেকে একশো আর পাঁচশো টাকার নোট, অনেকগুলো নোট উঁকি মারছিল। ওই টাকাতে মেয়েটির আর কোনোই প্রয়োজন ছিল না।

আমি বুঝলাম, মেয়েটি নিশ্চয়ই আমাদের চেয়েও গরিব। নইলে নিজেকে এমন করে বিকোয়। নিজেকে বিকোনোর কতই-না রকম হয়। আমরা মানে, আমি আর রঘুবীর বিকোলাম একরকম করে আর সে নিজেকে বিকিয়ে গেল অন্যরকম ভাবে।

পাঁচ

তারপরে ঘুসু বাবুর্চিও নীরব হয়ে গেল।

আমরা তো নীরব ছিলামই।

ঘটনার ভয়াবহতাতে আমরা সকলেই স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। একসময়ে ঘোর কাটিয়ে উঠে আমি বললাম, মেয়েটির কী হল? সে কি কর্পূরের মতো উবে গেল?

বেশ অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ঘুসু বলল, একটু পরে রঘুবীর চেঁচিয়ে ডাকল আমাকে। আমি বাইরে গিয়ে দেখি বাংলোর হাতার শেষে যেখানে পাহাড়টি খাড়া নীচু হয়ে নেমে গেছে পাতকানি নালার উপত্যকা এবং গিরিখাদে, সেইখানে দু-পাটি মেয়েদের চটি পড়ে আছে।

আমি আর রঘুবীর চটি দুটিকে যত জোরে পারি ছুড়ে দিলাম নীচের খাদে। তারপর মেয়েটির হাতব্যাগের সব টাকাগুলোও আমরা নিয়ে নিলাম পরে, সমান ভাগে ভাগ করে নেব বলে। বড়োই কামিনা আমরা!

তারপর?

আমরা তো বুঝলাম যে মরে যাওয়া মেয়েটিকে ওরা ছুড়ে ফেলেছে নীচে। যদি ওর প্রাণ অবশিষ্ট থেকে থাকে আর যদি পাতকানি নালাতে পড়ে থাকে তবে তো অত ওপর থেকে পড়াতে তক্ষুনি মরে গিয়ে ভেসেই গেছে জলের তোড়ে। তারপর ফুলন নালার স্রোতের সঙ্গে মিশে তৃতীয় ধারাতে বয়ে চলে গেছে ওয়াইনগঙ্গা নদীতে।

এপ্রিলের প্রথমে যখন প্রথম ঘটনাটি ঘটল এবং জানতে পেলাম যে নরখাদক বা ঘাতক পুরুষের যৌনাঙ্গ এবং স্তনবৃন্তই শুধু খেয়ে গেছে, শরীরের অন্যান্য অংশ স্পর্শই না করে, তখনই আমার বুক ধক করে উঠল। তারপর যখন একে একে এইরকম মৃত্যু ঘটতে লাগল এবং সেইসব মৃত্যুর কথা নিজের গ্রামে বসেই শুনতে লাগলাম তখনই মনে মনে একটা অনুমান গড়ে উঠেছিল।

তারপর মে মাসের শেষে ঝিরানিয়ার হাটে একদিন দেখা হতেই বাটুদাদার কাছে যখন সেই পেতিনের সঙ্গে তার মোলাকাতের কথা শুনলাম তখনই আমার মন বলল যে, মেয়েটিই প্রতিশোধ নিচ্ছে। তার চেহারার যা বর্ণনা দিল বাটুদাদা, তার সঙ্গে আমার আর রঘুবীরের দেখা মেয়েটির চেহারা মিলে গেল। এমনকী সেই গিলটি করা গয়না পর্যন্ত। বুঝতে পারলাম যে, সমস্ত পুরুষ জাতেরই ওপরে সে প্রতিশোধ নিচ্ছে। একে একে যখন বারো-জন মারা গেল এমনিভাবে এবং নানা শিকারির ব্যর্থতাতে যখন বোঝাই গেল যে এই অশরীরী কোনো রক্ত-মাংসের প্রাণী নয়, যে, শিকারিদের বন্দুক-রাইফেলের গুলিতে মরবে। তখনই আমার মন বলল যে, চোদ্দো-জনকে মেরে ওই চোদ্দো-জনের ওপরেই প্রতিশোধ সে নেবে। যারা আসল দুষ্কৃতি তাদের সে পায়নি বলেই যেকোনো যুবককেই সে তার লক্ষ্য করেছিল। তার ওপরে সেই রাতে যে অমানুষিক অত্যাচার হয়েছিল এবং পয়সাঅলা ঘরের মদ্যপ ছেলেরা তাকে ধর্ষণ করে করে শেষপর্যন্ত প্রাণেও মেরে ফেলে প্রমাণ লোপাট করার জন্যে তার মৃতদেহ পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল একথা তো আমি আর আমার হেল্পার রঘুবীর তাদের দেওয়া টাকা এবং মেয়েটির ব্যাগের টাকা পেয়ে যাওয়ায় কারওকেই জানাইনি। তাই প্রশাসন জানতেও পারেনি।

তারপর সিগারেটটা শেষ করে বলল, প্রশাসন জানলেও কী করতে পারত কে জানে? আমরা তো গাড়ির নাম্বার রাখিনি, তারা কোথা থেকে এসেছিল সে খোঁজও জানা ছিল না, আর মেয়েটিকে কোথা থেকে তুলে নিয়ে এসেছিল তাও। সেই কি ভদ্রঘরের মেয়ে না রান্ডি? এসবেরও কিছু তো জানা ছিল না আমাদের। তা ছাড়া, জানালেও আমাদেরই হাতকড়ি পরাত পুলিশ। এই দেশে আইনের যত প্রকোপ সবই তো গরিবের ওপরে, অসহায়ের ওপরে। স্বাধীনতার আগে সাহেবদের আমলে তাও কিছু ভয় ছিল আইনের। বিচার হত। এখন সবই গেছে। তাই ওই ঘটনাতে অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে এবং টাকাগুলো হজম করার অপরাধবোধে আমরা কারওকেই কিছু বলতে পারিনি। এক গভীর অপরাধবোধ আমাদের পীড়িত করেছিল, করে রাখবে, যতদিন বাঁচব ততদিন।

তারপর বলল, কী বলব সাহাব, আমার নাতনিকে যখন আমি বুকে নিই তখন আমার ওই মেয়েটার কথা মনে হয়। আমাদের দেশের মেয়েরা বড়ো অভাগী। আজও অভাগী। জানি না, ভবিষ্যতে কী হবে।

আমার কাছ থেকে অনূদিত ভার্সান শুনে জিম বলল আমাকে, চোদ্দো-জনের পরে যে আরও কোনো পুরুষের ওপর হামলা করবে না পেতিন, তার কোনো গ্যারান্টি আছে?

বললাম, কোনো গ্যারান্টি নেই। তবে আমি ঠিক করেই ফেলেছি যে, কাল সকালেই আমরা মানে মানে পাততাড়ি গোটাব এখান থেকে।

ছুটি নিয়ে এলাম যে দশ দিনের কলকাতা থেকে। কনসুলেট থেকে ছুটি পাওয়া কি সোজা কথা? এখন বাকি ছুটির কী হবে? জিম বলল।

বেন বলল, চলো আমরা আন্ধারি তড়োবাতে গিয়ে থাকব। নীতিন পোপোডকার ডি.এফ.ও. আছেন। থাকার কোনো অসুবিধা হবে না।

আমি বললাম, তবে হরিশ রান্ধাওয়াকে কড়কে দিয়ে যেতে হবে। আমাদের ম্যান ইটার বাঘ মারতে ডেকে এনে এইরকম বিপজ্জনক আধাভৌতিক একটা ঘটনার মধ্যে জেনেশুনে জড়িয়ে দেবে, এ কেমন বন্ধু?

বেন বলল, আহা! ও হয়তো জানত না। কেই-বা জানত! ঘুসু, রঘুবীর আর বাটু মারিয়া ছাড়া আর কেউই তো জানত না।

কিন্তু প্রত্যেকটি ‘কিল’ই যে পুরুষ এবং তাদের যৌনাঙ্গ ও স্তনবৃন্তই শুধু খাচ্ছে নরখাদক এই ইম্পর্ট্যান্ট ইনফর্মেশনটা তো আমাদের জানানো উচিত ছিল।

এই ইনফর্মেশন তো পাবলিক হয়ে গেছে। নইলে অ্যাসেমব্লিতে কোয়েশ্চেন ওঠে।

বেন বলল।

আমরা তো জানতাম না। এ অঞ্চলের মানুষ জানলেও জানতে পারে।

পাঠক, আপনাদের মধ্যে যাঁরা বয়স্ক তাঁদের মনে থাকতে পারে ষাটের দশকে গোড়ার দিকে সারাদেশের মিডিয়াতে এই নিয়ে খুব হইচই হয়েছিল। আমিও কাগজে পড়েছিলাম কিন্তু ঠিক কোন জায়গাটাতে ব্যাপারটা ঘটছে সেটা পিন-পয়েন্ট করতে পারিনি। আর আমাদের হরিশ ওই মিস্ট্রিই সলভ করতে ডেকেছে তা-ও বুঝতে পারিনি। হরিশ যতটুকু জানে তাই আমাদের জানিয়েছিল, যা জানত না তা কী করে জানাবে?

আকাশ কালো করে এসেছিল। মেঘে ঢেকে গেছিল চাঁদ। জোর বৃষ্টি আসছে।

বাটু বলল, এইরকম রাতেই পেতিন পুরুষ মারে।

বেন বলল, কী বলল?

ওকে তর্জমা করে বললাম।

ও বলল, বুলশিট।

আমি বললাম, আজকে তোমার পালা পনেরো নম্বর। ওই প্রত্যঙ্গ হারানোর চেয়ে যেকোনো পুরুষের প্রাণ যাওয়াও ভালো।

জিমি বলল, সঙ্গে প্রাণও তো যাবে। আই অ্যাম নট গেম। কালই চলো সকালে আমরা বেরিয়ে পড়ি এখান থেকে।

বেন বলল, তুমি এইসব বুলশিট বিশ্বাস করলে জিম?

জিম, পাইপটা ধরিয়ে বলল, ‘There are more things in Heaven and Earth, Horatio. Than are dreampt of in your philosophy.’

হ্যামলেট!

আমার কিছু বলার ছিল না। জিমের কথা শুনে আমারও শেক্সপিয়র মনে পড়ল। রবীন্দ্রনাথেরই মতো শেক্সপিয়রও খুবই ছোঁয়াচে।

আমি ভাবছিলাম ‘To be, or not to be, that is the question.’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *