বোঁদেদা
বোঁদেদার সঙ্গে প্রথম দিন দেখা হওয়ার কথাটি পরিষ্কার মনে আছে। বোঁদেদাকে একবার যিনি দেখেছেন তাঁর পক্ষে কখনোই ওঁকে ভোলা সম্ভব নয়। অবশ্য তাঁর সার্কেলও ছিল বিরাট। কলকাতা তো বটেই, ভারতবর্ষের এবং বিদেশেরও সব জায়গাতেই তাঁর জানাশোনা মানুষের কমতি ছিল না।
আলিপুরের উডল্যাণ্ডস এস্টেটে একটি বহুজাতীয় সংস্থার ডিরেক্টরের ফ্ল্যাটে পার্টি। উডল্যাণ্ডস নার্সিং হোমের উলটোদিকে। অফিসে অনেক ঝামেলা ছিল তাই যেতে দেরি হয়ে গেছিল। পৌঁছে দেখি পার্টি বেশ জমে উঠেছে। বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে লনের শোভা দেখতে দেখতে প্রিমিয়াস স্কচ-এর গ্লাসে সবে প্রথম চুমুক দিয়েছি, ঠিক এমন সময় একজন লম্বা-চওড়া ভুঁড়িঅলা ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন আমার দিকে।
ভদ্রলোককে আগে দেখিনি। তবে মুখ দেখে মনে হল বেশ তূরীয় অবস্থায় আছেন। উনি এসেই সম্পূর্ণ অপরিচিত আমাকে বললেন, বোকাটা! বসে বসে কেউ মাল খায়?
অতজন সুন্দরী মহিলার সামনে সম্পূর্ণ অপরিচিত কেউ হঠাৎ বোকা বললে বুদ্ধিমানেরও খারাপ লাগার কথা। তবে ভদ্রলোক যে মানুষ ভালো সেকথা তাঁর মুখেই লেখা ছিল।
আমি আমতা আমতা করতেই উনি বললেন, হ্যাঁ রে। সায়েবরা কী বলেচে জানিস না?
—কী?
আমি এবারে যথার্থ বোকারই মতো বললাম।
বোঁদেদা বললেন, সায়েবরা বলেচে, ‘হাউ মেনি ড্রিঙ্কস ক্যান ইউ স্ট্যাণ্ড?’ তাঁরা কি একথাও বলেছিল ‘হাউ মেনি ড্রিঙ্কস ক্যান ইউ সিট?’
আমি হেসে ফেললাম ওঁর কথায়।
তারপরই কে যেন ওঁকে ডাকলেন ড্রইংরুমের ভেতর থেকে। উনি চলে গেলেন। এবং উনি চলে যেতেই হোস্ট কুটুদা আমার কাছে তাড়াতাড়ি এসে বললেন, আপসেট হওনি তো জিবু?
হেসে বললাম আপসেট হব কেন? চমৎকার রসিক মানুষ। খুব ইন্টারেস্টিংও।
ইতিমধ্যেই আবার ওঁকে আমারই দিকে ফিরে আসতে দেখা গেল। রায় সাহেব বললেন, এই যে বোঁদেদা, তোমার কথাই হচ্ছিল। আলাপ আছে?
—নেই কিন্তু হতে কতক্ষণ?
—এ হচ্ছে পুরোনো বন্ধু আমার। লেখে।
—লেকে? কী লেকে? জাবেদা না প্রেমপত্র?
আমরা দু-জনেই হেসে উঠলাম ওঁর কথাতে। এবং কথা বলার ধরনেও।
—বলতে পারো দুই-ই। পেশাতে ও ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট কিন্তু নেশাতে লেখক।
—ডেঞ্জারাস কম্বিনেশন।
মন্তব্য করলেন, বোঁদেদা।
বলেই বললেন, নামটা তো বললে না হে।
—ওর নাম জীবনানন্দ।
—ও তাই বলো। জীবনানন্দ দাশ তো।
অস্বস্তি এবং বিড়ম্বনায় আমার কান লাল হয়ে উঠল।
একজন মহিলা প্রতিবাদের গলায় বলে উঠলেন, সাহিত্যর কত খবরই আপনি রাখেন বোঁদেদা! জীবনানন্দ দাশ তো অনেক দিনই গত হয়েছেন।
আরে ওই হল! পোয়েটরা আসলে কোনোদিনই গত হন না। তাঁরা হচ্চেন গিয়ে ইমমরটাল। সব পোয়েটই। কবিতা সম্বন্ধে আমারও একসময় একটু উইকনেস ছিল। বুয়েচিস বোকা। আমিও একসময় কিছু লেকালেকি করেচিলাম।
—কবিতা? আপনি?
ভদ্রমহিলা, মিসেস সুন্টু সেন, চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করলেন।
—ইয়েস ম্যাম, আমি। এই বোঁদে বাঁড়ুজ্যে। কেন? বিশ্বেস হচ্ছে না? অবশ্য হোল লাইফে মাত্র দুটোই লিকেছিলাম। মানে কবিতা।
বললাম, মাত্র দুটোই যখন লিখেছিলেন তখন মনে নিশ্চয়ই আছে।
—বিলক্ষণ!
—তবে শোনানই নাহয়।
—শোন তবে বোকাটা! তোকে তুইতোকারি কচ্চি বলে চটিসনি তো? বিধান রায়ের মতো আমিও কাউকে আপনি বলতে পারি না। হ্যাঁ যা বলচিলুম, প্রথমটা হচ্ছে গিয়ে—
‘এক ঠোঙা খাবার নিয়ে যায় মতিলাল।
তাই দেখে দূর থেকে মারলে ছোঁ চিল।’
কাছাকাছি যারাই ছিলেন সকলেই তো বোঁদেদার কবিতা শুনে থ।
মিসেস সুন্টু সেন বললেন, এ কীরকম কবিতা হল?
—কেন? তোমাদের আধুনিক কবিতার চেয়ে এই প্রাচীন কবিতা কোনদিক দিয়ে খারাপ? তোমরা তো লিকে ফ্যালো চাঁদমুখ করে—‘প্রিয়তমা, আমার সঙ্গে তোমার দেখা হবে গতকাল।’ আমার কবিতায় মতিলালের ‘ল’-এর সঙ্গে চিলের ‘ল’-এর মিল কি নেই?
—তা আছে। আমি বললাম।
তারপর বললাম, আর দ্বিতীয় কবিতাটি? মাত্র দুটিই যখন লিখেছিলেন, মনে আছে নিশ্চয়ই।
—মনে আর থাকবে না? সেটি অবশ্য ছিল দেশাত্মবোধক কবিতা। কিন্তু আমার স্কুলের বাংলার মাস্টের অশ্লীল বলিয়া বিবেচনা করত আমার কবিদশা অতঃপর নাশ হয়। এখন অবশ্য দেশসেবা এবং অশ্লীলতা প্রায় সিনোনিমাসই হয়ে উঠেচে। কী বলচিস?
—কবিতাটা বলুন।
মিসেস সুন্টু সেন বললেন।
—তখন ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বুয়েচিস। কলকাতার ফুটপাথে ফুটপাথে মানুষ মরে পড়ে আছে। তা দেখে আমার শিশুবুক দুঃকে উতলে উঠত। একদিন গলে-যাওয়া হৃদয় নিংড়ে লিখলাম:
‘দুর্ভিক্ষে সারাটা বঙ্গ করে হাহাকার
লোক নেই, পড়ে আছে ল্যাঙোট তাহার।’
সকলেই হেসে উঠলেন।
—তোমরা তো হাসবেই অর্বাচীনের দল। নইলে বাঙালির এমন অবস্থা হয় আজ?
মিসেস সুন্টু সেন গম্ভীর হয়ে বললেন, তা নয়, মানেটা ঠিক বুঝতে পারিনি তো তাই-ই।
মানেটা বোঝা কঠিন কী হল? মানুষটা না খেয়ে মরে গেচে। কর্পোরেশনের গাড়ি বডি তুলে নিয়ে গেচে। কিন্তু বেচারির ল্যাঙোটটি রাস্তায় পড়ে আচে। তোমাদের আধুনিক কবিরা হলে এই কবিতাই লিখে তার নাম দিয়ে দিত ‘এপিটাফ’। হইহই পড়ে যেত কবিমহলে। সাধু! সাধু! বলত সকলেই।
কুটুদা ইন্টারাপ্ট করে বললেন, এই দুটি কবিতাও কিন্তু তোমার লেখা নয় বোঁদেদা। এ দুটোই আমাদের রঘুদার কবিতা। রঘু ব্যানার্জির। কলকাতার অনেক মানুষই এই কবিতার কথা জানেন। রঘুদার নিজের মুখ থেকেই তাঁরা শুনেছেন অনেক বার।
বোঁদেদা বললেন, শোনেননি এমনও অনেকে আচেন। তোরা এই মিসম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্টের দল বুদ্ধি একটু কম ধরিস। সকলেই জানে যে দু-দুটো রঘুদার কবিতা। তবে তোদের কারও শুনতে কি খারাপ লেগেচে? নাম বলেই যদি শালা আবরিত্তি করব তো রঘু বাঁড়ুজ্যের কবিতা কোন দুঃখে র্যা? রবেঠাকুর কী দোষ করে? পরের জিনিস নিজের বলে মনে করাকে চুরি করা বলে না। মনটা যদি খুঁতখুঁত করে তবেই সেটা চৌর্যবৃত্তি।
আমি যেহেতু দেরি করে গেছিলাম কুটুদা কিছুতেই তাড়াতাড়ি ছাড়লেন না। সকলেই একে-একে চলে যেতে লাগলেন বুফেতে খাওয়া সেরে। তখন বুঝিনি যে আমাকে বোঁদেদার লাশ সামলাবার জন্যেই আটকে রাখছেন উনি। বোঁদেদাকে কুটুদা বিলক্ষণ চিনতেন। আমার সঙ্গেই এই প্রথম আলাপ।
খাওয়াদাওয়ার পর কুটুদা বললেন, ‘বোঁদেদা আপনি কি গাড়ি এনেছেন?
নিশ্চয়ই। কেন? কাউকে লিফট দিতে হবে নাকি? বোকাকে? কী রে বোকা?
এই রে। এই অবস্থায় নিজে গাড়ি চালাবেন কী করে?
আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে নীচু গলায় কুটুদা বললেন।
তোমার ড্রাইভার আছে জিবু?
আবারও নীচু গলায় কুটুদা শুধোলেন।
না। কিন্তু এ তো আর বাইসাইকেল নয় যে একাই দু-হাতে জোড়া-সাইকেল চালিয়ে চলে গেলাম কিরিং-কিরিং করে!
একটু পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে কুটুদা বললেন, ঝামেলি হবে। গ্রেট ঝামেলি। মাঝে মাঝেই বোঁদেদা এমন করেন। সবসময় কিন্তু নয়। ইচ্ছে করেই আমাকে হয়রানি করার জন্যে করছেন কি না কে জানে। একটা ব্যাপারে আমার উপরে খুব রেগে রয়েছেন। এমন গুগলি-মার্কা লোক কমই দেখেছি।
লিফট অবধি আমি আর কুটুদা বোঁদেদাকে ধরে তো নিয়ে গেলাম। গন্ধমাদন পর্বত বইতেও পবননন্দনের এত ঝক্কি পোয়াতে হয়নি। মনে হচ্ছিল ভূমিকম্প হচ্ছে। একবার পর্বত আমার গায়ে ভর করছেন, আর একবার কুটুদার গায়ে। তবে বাঁচোয়া এই যে ভূমিকম্পই ছিল তখনও, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়নি। কিন্তু চিত্তির হল লিফট থেকে নীচের ল্যাণ্ডিং-এ নামতেই। বড়ো বড়ো কোম্পানির বড়ো বড়ো সাহেবরা থাকেন এখানে। এবাড়িতে পার্টি লেগেই থাকে, কিন্তু মাতাল দেখা যায় না বড়ো। দাঁড়িয়ে থাকা পর্বতপ্রমাণ মানুষটি অদৃশ্য করাতে কেটে গিয়ে গদ্দাম আওয়াজ করে চোখ বুজে ফ্ল্যাট হয়ে পড়ে গেলেন ওই রেসপেক্টেবল পরিবেশের শ্রাদ্ধ করে দিয়ে।
কুটুদা নিজেকে অভিশাপ দিয়ে বললেন, দেকেচো! ভালো স্কচ-এর এই-ই দোষ। কখন যে ধস নামাবে তা সেই-ই জানে। যেন, ডিলেড অ্যাকশন টাইম বম্ব।
আমি বললাম, এবার থেকে আপনার বাড়ির পার্টিতে বিশুদ্ধ বাংলাই খাওয়াবেন। সঙ্গে খিচুড়ি আর প্যাঁজের চাট। বেয়ারা-বাবুর্চি, ভেটকি-মেয়োনিজ, চিকেন-আ-লা-কিয়েভ এসবের বাহুল্য আদৌ দরকার নেই। যা হবার, তা ছোটা ব্রিস্টলের মতো তড়িৎঘড়িই হয়ে যাবে।
বোঁদেদা ফ্ল্যাট হয়ে তখনও পপাতধরণিতলে শুয়ে আছেন। মরেই গেলেন কি না বোঝা যাচ্ছে না। ঠিক সেই সময়ই একটি ঝকঝকে কালো মার্সিডিস গাড়ি থেকে নেমে ডিনার জ্যাকেটপরা, বো-লাগানো একজন সাহেব ল্যাণ্ডিং-এ ল্যাণ্ড করলেন। খয়েরি গোঁফ জোড়া। কুচুটে চোখ জোড়া। চেহারা দেখে মনে হয় আয়ারল্যাণ্ডে বাড়ি।
কুটুদা লজ্জিত গলায় অধোবদনে বললেন, গুড নাইট এরিক। এরিক নামক সেই গুঁফো সাহেব পাইপের গোল্ড ব্লক টোবাকোর ধোঁয়া ছেড়ে, আড়চোখে হাতঘড়ির দিকে চেয়েই সাঁতরাগাছির ওলের মতো ছিটেল মুখ ফাঁক করে বললেন, গুড মর্নিং কুটু! ভেরি গুড মর্নিং ইনডিড।
ঘড়িতে দেখলাম সোয়া একটা বাজে।
সাহেব বললেন, নিড এনি হেল্প? ইউ লুক ভেরি পারটার্বড।
কুটুদা বললেন, নো, নো। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ এরিক। বাট হি উইল বি নর্ম্যাল, আই মিন, সোবার। সুন।
এরিক লিফট-এ উঠে ওপরে চলে গেলেন।
কুটুদাকে শুধোলাম কে?
আমাদের কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। কুটুদা এমবারাসড গলায় বললেন।
দারোয়ানদের ডেকে তাদের সাহায্যে তো বোঁদেদাকে প্রথমে বসানো হল। তারপর দাঁড়ও করানো হল সোজা করে। কুও ডেডিস সিনেমাতে দেখা গলিয়াথ-এর মতো উঠে দাঁড়ালেন বোঁদেদা। কুটুদার প্রেস্টিজ তো পাংচারড হয়ে গেল দারোয়ানদের সামনে। কাঁদো-কাঁদো গলায় আমাকে বললেন, জিবু, বোঁদেদার গাড়িটা রেখে দিচ্ছি এখানে। তুমি ওঁকে একটু পৌঁছে দাও।
কথাটা ওভার হিয়ার করে বোঁদেদা বললেন, আমি জীবনে পরের গাড়িতে চাপিনি। যতদিন বাঁচি, চাপবও না।
কুটুদার কুচুটে মুখে আমি চেয়ে রইলাম। বিপদে বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছেন। গলিয়াথ-এর দু-হাত দু-জনে ধরে হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে পার্কিং লিট-এ গিয়েই দেখি, খাইছে! এ যে বেন্টলি গাড়ি। সাদারঙা। আজকালকার লিমুজিনের মতো লম্বা প্রায়। লাট্টু গিয়ার। কুটুদা বোঁদেদাকে কাচের বাসনের মতো সাবধানে তুলে দিয়েই আমাকে বললেন কানে কানে স্লাম্বারে আছে জিবু। ডিসটার্ব না করে স্ট্রেট চালিয়ে চলে যাও। এই বেলা।
অসহায়ের মতো আমি বললাম, আমার গাড়ি।
সে-দায়িত্ব আমার। কাল সকাল আটটার মধ্যে তোমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবে আমার ড্রাইভার। আর কথা বাড়িয়ো না। স্ট্রেট চলে যাও।
কী বিপদ! যাবটা কোথায়? মানুষটার পুরো নাম পর্যন্ত যে জানি না। ঠিকানাও জানি না। বোঁদে বলেছে বলেই তো যেকোনো মিষ্টির দোকানে গিয়ে সেঁটে দিয়ে আসতে পারি না! এই প্রাগৈতিহাসিক মডেলের বেন্টলি গাড়ি জীবনে চোখে দেখিনি, চাপা তো দূরের কথা। কোন ফুটোতে গাড়ির চাবি গলাব সেটা পর্যন্ত জানা নেই। কিন্তু আমার এতসব প্রশ্নর জবাব দেওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে আমার গাড়ির চাবিটা আমারই পকেট থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তিন লাফে ডেঞ্জার এরিয়া ক্লিয়ার করে লিফটের গর্তে ঢুকে গেলেন। ভাবলাম এমন স্ট্র্যাটেজিস্ট না হলে কি উন্নতি করা যায়?
সামনে চেয়ে দেখলাম উর্দিপরা দারোয়ানেরা বিরক্ত হয়ে অপেক্ষা করছে আপদেরা কখন বিদায় হবে। ঘড়িতে দেখলাম রাত দেড়টা।
বোঁদেদা ঘাড় এলিয়েই স্বগতোক্তি করলেন, ঘড়ি দেকিসনি রে বোকাটা! নাইট ইজ ভেরি ইয়াং। সে সোমথথ বেটি লজ্জা পাবে যে র্যা!
চাবিটা ডেসপারেট হয়ে র্যানডম ফুটোময় ড্যাশবোর্ডের ফুটোতে ঢুকোতে চেষ্টা করতে লাগলাম। একটা ফুটোতে এঁটেও গেল। চাপ দিতেই গাড়ির ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল।
বোঁদেদা চোখ বন্ধ করেই বললেন, কেমন বলচে শুনেচিস? যেন মৌজুদ্দিনের গলা। শালা! এই নইলে ব্যাটাচেলের গাড়ি!
সম্বন্ধ করে বিয়ে করেছে এমন নববিবাহিত স্বামী যেমন অতি ভয়ে ভয়ে নববিবাহিতা স্ত্রীর অঙ্গ এবং প্রত্যঙ্গ স্পর্শ করে তেমনই দ্বিধাকম্পিত হাতে, থুরি পায়ে; আমি অ্যাক্সিলারেটরে চাপ দিলাম, লাট্টু গিয়ারকে ফার্স্ট গিয়ারে ফেলেই। খানদানি গাড়ি বলে ব্যাপার! গাড়ি আনাড়ি ড্রাইভারের ভয় অগ্রাহ্য করে স্মুথলি এগিয়ে চলল। দু-কদম এগোতেই বোঁদেদার নাক ডাকতে লাগল। একেবারে কুম্ভকর্ণ পারসোরনিফায়েড।
বিপদটা ঘটল গেট থেকে বেরুতেই। ডান দিকে ঘুরতে হবে এবারে। ব্রেকে পা দিতেই দেখি ফুসস-স-স। উডল্যাণ্ড নার্সিং হোমের দেওয়ালে প্রায় ধাক্কাই লাগাবার উপক্রম হল। নার্সিং হোমের দারোয়ানরা তো তেড়েই এল। একজন ঘাড় নীচু করে অন্য-জনকে বলল, পিয়ে হুয়ে হ্যায় ক্যা?
এদিকে কুটুদার বিল্ডিং কমপ্লেক্স-এর দারোয়ানেরা আমাদের রেসকিউ-এ ছুটে এল। বড়োলোকদের চেয়ে তাদের দারোয়ানদের ইজ্জতজ্ঞান অনেকই বেশি। আফটার অল আমরা উডল্যাণ্ডস এস্টেটসের মেহমান।
তিন পাক ফলস স্টিয়ারিংটা বনবন করে অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে গাড়িটাকে ডান দিকে একটু ঘুরোতেই দেখি বোঁদেদা আমাকে ধমকে বললে গাড়ি ঠিকসে চালা রামদীন। নইলে তোর মেয়ের বিয়েতে যে কুড়ি হাজার টাকা দেব বলেছিলাম তার একটি পয়সাও দোব না।
এই রে! নেশার ঝোঁকে আমাকে বোধ হয় ড্রাইভার ভাবছেন। স্কচ হুইস্কির ব্যাপারই আলাদা। এই ঘুম পাড়ায়, এই জাগায়।
এদিকে ব্রেক ফুসস করায় গাড়ি প্রায় উডল্যাণ্ডস নার্সিং হোমের দেওয়ালেই গিয়ে ধাক্কা মারে আর কী! সেই গভীর রাতে গাবলু-গুবলু বাচ্চা প্রসব-করা সারে সারে শুয়ে-থাকা বড়োলোকের বউয়েদের গর্বমাখা সুখে বিঘ্ন ঘটিয়ে দারোয়ানদের চাপা দিতে দিতেও না দিয়ে গাড়ি গোঁ গোঁ করে এগিয়ে চলল। বড়ো রাস্তায় পড়ে আন্দাজেই বাঁ-দিকে আবার বনবন করে স্টিয়ারিং কাটালাম। দু-পাক ঘোরালে এক ইঞ্চি কাটার এফেক্ট হয়। কিন্তু যাবটা কোথায়? কাতর গলায় ঘুমন্ত বোঁদেদাকে প্রশ্ন করলাম।
বোঁদেদা বললেন, চোপ শালা নিমকহারাম। তোর গাঁয়ের সব ক-টা লোকই নেমকহারাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা আশ্চর্য কান্ড ঘটছে লক্ষ করলাম। চোখ না খুলেই বোঁদেদা গাড়ি কোনো মোড়ে এলেই বলতে লাগলেন বাঁয়ে, ডাইনে, সোজা ইত্যাদি। কিছুক্ষণের মধ্যেই উত্তর কলকাতার কেনিয়ান সাফারি র্যালির রাস্তায় পৌঁছে গেলাম। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ।
হঠাৎই বোঁদেদা বললেন সোনাগাছি পেরিয়ে এলাম, না রে? চোখ বন্ধ করেই বললেন।
হ্যাঁ। বোধ হয়।
বোদয় মানে কী রে শালা? নেকুপুসু আমার। যাসনি কখনো?
বিরক্তির গলায় বললাম, না।
কেন?
গুরু পাইনি।
তাই? আমি নে যাব তোকে। গুরুর অভাব কী? গুরু মিলে লাখ লাখ, চেলা মিলে এক।
এবার ডানদিকে চল। তোকে মিদের দোকানের পান খাওয়াব। বেনারস থেকে মঘি আনে। এ কী রে! এই সন্দেবেলায় দোকান বন্ধ করে শালা বাড়ি চলে গেল। দ্বিতীয় পক্ষর বউ তো! কিন্তু এগারোটা পর্যন্ত তো খোলা রাকেই।
বললাম, এখন দুটো বেজেছে।
বেলা দুটো? বলিস কী রে? অথচ রোদ নেই মাইরি একটুও। শালা একেই বলে ঘোর কলি।
আস্তে। আস্তে। ওই সামনে বাঁয়ের গেট। বোঁদেদা বললেন। ব্রেক চাপলাম শরীরের সমস্ত ওজন দিয়ে। ফুসস-সস। স্টিয়ারিং ঘোরালাম বাঁইবাঁই করে। ক্যালামিটি না ঘটিয়ে টায়েটায়ে গেটে ঢুকে থামালাম গাড়ি এক বিরাট প্রাসাদের ভেতরের পর্চ-এ।
গাড়ি থামতেই আমি বললাম, আমি এবার যাব বোঁদেদা।
যাবি? কোতায় যাবি রে বোকা খোকা? আমার সুন্টুপুটুং ঘুচুংপুচু? বাঁড়ুজ্যে বাড়িতে ঢোকা সহজ কিন্তু বেরুনো সহজ নয়। সে তওয়ায়েফ, ওয়াইফ অথবা পোঁদ-লাল বাঁদর কী ঠোঁট লাল টিয়া যেই হোক-না কেন!
ঘু-ঘুচু। বলে ডাকলেন বোঁদেদা। একজন লোক এসে দাঁড়াল। তাকে দেখে মনে হল সে দিনে ঘুমোয় রাতে জাগে। চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই বাড়ি পানাগড়ে না পানাজিতে।
বোঁদেদা বললেন, ড্রাম্বুই আর সিগার আন।
অবাক হয়ে আমি বললাম, রাত আড়াইটের সময়?
না তো কী? তুই শালা আমার আসলি দোস্ত। তুই যা করলি, জবাব নেই। কুটুকে কেমন কুটুস দিলুম এককানা? তুই যা করলি, রামপেয়ারিও করত না আমার জন্যে।
সে কে?
সে বেনারসে থাকে। কী ডেডিকেশন। বেনারসের জিনিসই আলাদা। সে রাবড়িই বল, সিদ্ধিই বল, আর মেয়েচেলেই বল।
আমি বললাম, আপনার কোনো ছোটোগাড়ি নেই। অ্যাম্বাসাডর অথবা ফিয়াট? আমি বাড়ি যাব।
না রে বোকা। বোকাটা। বাঁড়ুজ্যেরা ছোটোগাড়ি চাপে না, ছোটোপেগ খায় না।
আমি বাড়ি যাব। আবার বললাম আমি।
তুই কি কিণ্ডারগার্টেনের বাচ্চা নাকি রে? থেকে থেকে কেবলই বলচিস মিস হিসি করব, মিস হিসি করব। ঝিকে ডেকে দেব তোকে হিসি করিয়ে দেবে। তুই কি শালা ঝৈন নাকি?
ঝৈন মানে?
আরে বোকা স্ত্রীতে যে আসক্ত সে স্ত্রৈণ, আর ঝিতে যে সে ঝৈন।
ড্রাম্বুই আর সিগার এল। বোঁদেদা বললেন, খা খা। এই ড্রাম্বুই আর সিগার দিয়েই উইনস্টন চার্চিল হিটলারের সঙ্গে যুদ্ধে জিতেছিল। তোরা কি ভাবিস অরেটরি দিয়ে? নেভার ইন দা হিস্ট্রি অফ ম্যানকাইণ্ড সো মেনি হ্যাভ ওড সো মাচ, টু সো ফিউ। না রে বোকা! অরেটরি দিয়েই যুদ্ধ জেতা গেলে নেহরুর অরেটরিতে এতদিন দেশের লোকের দুঃকু ঘুচে যেত। আসল হচ্ছে এই ড্রাম্বুই আর সিগার।
একবার আমাদের কয়েক-জনকে বোঁদেদা তাঁর বাগানবাড়িতে নিয়ে গেছিলেন। সাঁওতাল পরগনাতে। মাছের সঙ্গে ফ্রেঞ্চ বোঁর্দে ওয়াইন, মাংসের সঙ্গে স্প্যানিশ বুলস-ব্লাড রেড ওয়াইন। প্রন ককটেলের সঙ্গে সাদা অস্ট্রিয়ান স্নাপস। গরম করে সার্ভ করা জাপানিজ ‘সাকে’ রাইস ওয়াইন। তারপর ছ-কোর্স ডিনার। খাসির চৌরি, চাব, লাব্বা, পায়া, কবুরা। সঙ্গে তক্কর। তারই মাঝে মাঝে নিম্বুপানি, হজমি।
একদিন রাতে নিজেই মহুয়া ডক্টর করলেন। চারগাছা করে পুরুষ্টু লবঙ্গ আর এক চামচে চিনি তাওয়াতে লাল করে তেল ছাড়া ভেজে মহুয়ার বোতলে ফেলে ভালো করে ঝেঁকে যখন গ্লাসে সার্ভ করলেন, দেখতে হল একদম রাম-এর মতো। বললেন, দ্যাখ মহুয়ার গন্ধ চলে গেছে। কোথায় লাগে এর কাছে জ্যামাইকান বিকার্ডি রাম।
বড়োলোক, রাজা-মহারাজা, ইণ্ডাস্ট্রিয়াল টাইকুন্স অনেকই দেখেছি জীবনে, বোঁদেদার মতো এমন ‘রইসি’ কারও মধ্যেই দেখিনি। আমাদের জিপে করে রাতে শিকারে নিয়ে গেলেন। বড়ো বড়ো চোখ দেখে টাইগার টাইগার বার্নিং ব্রাইট বলে জঙ্গলের মধ্যের এক বাথানের মোষ মেরে দিলেন রাইফেল দিয়ে। কোনো বিকার নেই। বললেন, গুলিটা বিঁধেছে দ্যাখ একেবারে দু-চোখের মধ্যে। একেই বলে বোঁদের কপাল। ব্যাটা যদি শুধু ভাইষা না হয়ে বাঘোয়া হত তো জমে যেত। তাঁর অনুচরেরা গিয়ে গেঁজে থেকে টাকা বের করে মোষের দাম প্লাস হাজার টাকা কম্পেনসেশান দিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে দিল।
দুই
আমার লণ্ডনপ্রবাসী বন্ধু ছুটু এসেছে অনেক দিন পর। ওকে নিয়ে গেছি গ্র্যাণ্ডের চৌরঙ্গি বার-এ। পরে পলিনেশিয়াতে ডিনার খাওয়াব। সবে একটা করে হুইস্কির অর্ডার করেছি, হঠাৎ বোঁদেদার আবির্ভাব। আবির্ভাব বলাই ভালো প্রবেশ না বলে। যেকোনো ক্লাবে বা বার-এ বোঁদেদা ঢোকামাত্র বেয়ারা থেকে শুরু করে স্টুয়ার্ডরা পর্যন্ত ফটাফট সেলামের আর গুড ইভনিং-এর ঝড় তুলত।
বোঁদেদা বললেন, কী রে বোকা। সঙ্গে এই চালাকটি কে?
ছুটুর পরিচয় দিয়ে বললাম আমার বাল্যবন্ধু। আমরা একসঙ্গে ইংল্যাণ্ডে ছিলাম। ও রয়েই গেছে।
বেশ করেছিস রে চালাক। এই দেশ আর ভদ্দরলোকদের জায়গা নেই। পলিটিশিয়ানগুলোর বুজরুকিতে সর্বনাশ হল। কিন্তু তোর বাল্যবন্ধুকে তো একটা ভালো ট্রিট দিতে হয়। কী বলিস? তবে দুস শালা ফিরপোই নেই। কলকাতাটা কানা হয়ে গেছে। তা এক কাজ কর। আমার শরীরটা সকাল থেকেই খারাপ। বুকে একটা ব্যথা বোধ করছি। একটু চাঙ্গা হওয়া দরকার। ভালোই হয়েছে তোদের সঙ্গে দেখা হয়ে।
ই.সি.জি করিয়েছ?
দুস শালা। ওই র্যাকেটে আমি নেই। ই.সি.জি, ই.ই.জি ব্লাড কোলেস্ট্রেরল, ব্লাড-সুগার, ব্লাড প্রেসার, নিকুচি করিচি। ভগবান এত মানুষ গড়েছেন কেউ বেঁটে কেউ লম্বা, কেউ ফর্সা কেউ কালো, কেউ মোটা কেউ রোগা, আর কোন বাইবেলে লিখেছিল শুনি যে প্রত্যেকের ওইসব গুণাগুণ এক হবে? আমার বাবার ওজন ছিল সাড়ে তিন মন। অথচ এমন এনার্জিটিক মানুষ আর দেখলাম না। মদের মোচ্ছব করতেন। আর….না-ই বা বললাম। তেরানব্বুই বছর বয়সে মায়ের কোলে মাথা রেখে গহরজান বাইজির রেকর্ড শুনতে শুনতে—চললুম বলে, চলে গেলেন! যকনই এয়েচো এখানে ম্যানুফ্যাকচারিং ডেট আর এক্সপায়ারি ডেট লিখে পাঠিয়েচেন ব্রম্বা। যেদিন সে ডেট আসবে কান্তি বক্সি। সুনীল সেনেরা ঘেমে গিয়েও বাঁচাতে পারবে না রে বোকা!
বলেই বললেন, চল, আজ অ্যান্টিকুয়ারিয়ান হুইস্কি দিয়ে শুরু হোক। এখানে একটা করে মেরে দিয়েই চল আজ বার-ক্রলিং করব। কলকাতার সব ক্লাবে।
বোঁদেদা কলকাতার সব ক্লাবেরই মেম্বার। ওখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া হল সুইমিং ক্লাবে। মানু বোঁদেদাকে দেখে সেলাম ঠুকল। এলমোর মরিস আর পি. টি. বাসু বললে, হোয়াট বোঁদে? লং টাইম নো সি?
ওখান থেকে বেরিয়ে অর্ডিনান্স ক্লাবে। স্কচ ছিল তবে জনি-ওয়াকার। দুস শালা, জিভটাই যাবে অ্যান্টিকুয়ারিয়ানের পর। চল পালাই। বোঁদেদা বললেন।
সেখান থেকে বেঙ্গল ক্লাবে। অ্যান্টিকুয়ারিয়ান ছিল না, সিভাস রিগ্যাল খাওয়া হল। সেখান থেকে ইন্টারন্যাশনাল ক্লাবে। রবার্ট ডিপেনিং আর জর্জ ট্রব বিলিয়ার্ড খেলছিল। বিলু বর্মনও ছিল। হইহই করে উঠল সকলে বোঁদেদাকে দেখে। ওখানেও সিভাস মেরে একটা করে, যাওয়া হল সি.সি.এফ.সি-তে। সালিম লজ্জা পেয়ে বলল, স্কচ নেই। বোঁদেদা বললেন, ‘কমিটি মেম্বারদের বলিস এনে রাখতে’। সি.সি.এফ.সি. থেকে বেরিয়ে বেঙ্গল রোয়িং ক্লাব। পথে ডালহৌসি ইনস্টিটিউট-এও একবার ঢুঁ মেরে একটা করে খাওয়া হল। ছুটু নার্ভাস হয়ে গেল। বলল সাহেবরাও এতরকম হুইস্কি চোখে দেখেনি।
বোঁদেদা বললেন তোদের সায়েবরা দেকেচেটা কী? রামপেয়ারিকে দেকেচে। এমন ঘুঘুর-সই ঘুঘুর-সই করে দেবে না যে, মনে হবে টাকা মাটি, মাটি টাকা। ফিলজফির হাইট জানবি ওই-ই!
চালাক ছুটু বোকার মতো চেয়ে থাকল।
আমি বললাম, পরে বলব। বিস্তারিত।
ক্যালাকাটা রোয়িং ক্লাবে হোয়াইট লেবেল খাওয়া হল। তখন নেশা চড়েছে। বাছবিচারের বিলাস নেই। তারপর লেক ক্লাব। সুক্কুর খাতির করল খুব। কিন্তু স্কচ নেই। প্রীতিরঞ্জন রায়, প্রেসিডেন্ট অ্যাপোলজেটিক হলেন। সেখানে একটা করে পিটার স্কট মেরে সোজা ক্যালকাটা ক্লাবে। মন্টু, গভর্নরের মতো মর্যাদায় রিসিভ করল বোঁদেদাকে। খোকাদা দৌড়ে এলেন। সেখানে পর পর দুটো সিভাস মেরেই বললেন, চল গ্র্যাণ্ডে ফিরে যাই।
আমি বললাম, ডিনার কিন্তু আমি খাওয়াব। ‘পলিনেশিয়া’তে।
চুপ। বড়দা থাকতে ছোড়দারা কথা বলে না। পাক্কি-বিরিয়ানি খাব মুগল রুমে। তারপর পিংক এলিফ্যান্টে নেচে, গার্ডেন কাফেতে ড্রাম্বুই আর সিগার খেয়ে বাড়ি।
ক্যালকাটা ক্লাবের সিঁড়িতে এসেই বোঁদেদা বললেন, বোকা। তোর গাড়ির চাবিটা রামদীনকে দিয়ে দে। তোরা চল আমার সঙ্গে। সেদিন একটি রুপোলি সানবিম-ট্যালবট গাড়ি এনেছিলেন বোঁদেদা। রুপোলি ভেলভেট বডির কুশান।
বুঝলাম মাথায় কিছু-একটা খেলেছে।
ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়িটা ব্যাক করেই জোরে একপাক মেরেই শচীন ব্যাণ্ডো মশায়ের গাড়িকে প্রায় ধাক্কা দিতে দিতে না-দিয়েই গাঁ-গাঁ করে ব্যাক করে এগজিট গেট দিয়ে বেরোলেন। দারোয়ানেরা ভয়ে লাফিয়ে উঠে সরে গিয়ে প্রাণ বাঁচাল। সার্কুলার রোডের মোড়ে আসতেই পুলিশ বুঝতে পারল না উনি এগোচ্ছেন কী পেছোচ্ছেন। আলো সবুজ হতেই একেবারে ক্যান্টার করে চল্লিশ কিমি-তে গাড়ি পেছোতে লাগল।
প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে উঠলাম আমরা। বললাম, এ কী?
বোঁদেদা বললেন, আজ শালার সব মিনিবাসের হারামজাদা ড্রাইভারদের পিন্ডি চটকে দেব। কালঘাম ছুটিয়ে দেব স্টেট বাস, প্রাইভেট বাসেরও। শালারা দিনে পাঁচটা করে মানুষ মারচে আর কীরকম অ্যানআবেটেড চলেচে বল! শালার দেশে তো অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নেই-ই, মানুষও কি কুকুরের বাচ্চা হয়ে গেছে। সব কিছুই সহ্য করে নেয়। নিজে যতক্ষণ না চাপা পড়ছে ততক্ষণ সব ঠিক হ্যায় এমনই একটা ভাব! দ্যাখ-না বোকা! আজ কী করি!
আর দেখা! আমাদের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল। মিনিবাস, প্রাইভেট বাস, স্টেট বাস সব দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে এদিক-ওদিক দৌড়োতে গিয়ে সেমসাইড করে ফেলার অবস্থা। প্রচন্ড বেগে একটা হুড খোলা রুপোলি গাড়িতে একজন স্থিরচিত্ত এবং দু-জন অস্থিরচিত্ত মানুষকে লাফাতে লাফাতে যেতে দেখে বাস-ট্রামের জানলা দিয়ে মুখ বের করে মানুষজন সব চেয়ে রইল।
আর পেছনে যেতে-থাকা বোঁদেদার গাড়ির মুখোমুখি অথবা পেছন পেছন আমার নিজের গাড়িতে বোঁদেদার ড্রাইভার রামদীন তারস্বরে চ্যাচাতে চ্যাঁচাতে লাফাতে লাফাতে ডান হাত বের করে বারণ করতে করতে আসতে লাগল। ট্র্যাফিক পুলিশেরা চ্যাঁচাতে আর লাফাতে লাগল দাড়ি-না-কামানো মুখে ফার্স্ট ইয়ারে পড়া জোর করে চুমু-দেওয়া প্রেমিকার মতো। তাদের সাদা-কালো ইউনিফর্মগুলোকেমনে হতে লাগল মেয়েদের স্কুলের ইউনিফর্ম।
বোঁদেদা হাসতে হাসতে বললেন, বেড়ে লাগছে র্যা! প্রতি হপ্তায় একবার এরকম করতে পারলে মিনিবাসওয়ালারা সব ঠাণ্ডা হয়ে যেত। জানত যে বাবাদেরও বাবা থাকে।
—আপনাকে ধরতে আসছে বোঁদেদা।
ছুটু ভয়ার্ত গলায় বলল।
—আমাকে কে ধরবে র্যা?
—টিকিট দেবে পুলিশ।
আমি বললাম, এখানে তোদের লানডানের মতো টিকিট-ফিকিট দেয় না। হয় কিসসুই করে না, নয় থানায় নিয়ে গিয়ে প্যাঁদায়।
লিণ্ডসে স্ট্রিটের মোড় পেরিয়ে ওকে বোঁদেদা বললেন, বুকের ব্যথা-ফ্যাথা সব গায়েব। দারুণ চাঙ্গা লাগছে এখন।
ছুটু বলল, এবারে দেশে আসা যথার্থ সার্থক।
দু-জন সার্জেন্ট এবং একটি পুলিশ ভ্যান আমাদের ফলো করছিল। মানে মুখোমুখি আসছিল। ওরা এগোচ্ছিলেন। আমরা পেছোচ্ছিলাম।
—থানায় নিয়ে যাবে। ভয়ার্ত গলায় বলল ছুটু।
—ছাড় তো। ড্রাইভিং-এর জন্যে থানায় নিয়ে গেলে আগে ওই পুলিশ ভ্যানের সব ক-টি ড্রাইভার, দুধের গাড়ি, কর্পোরেশনের গাড়ি আর মিনিবাসের ড্রাইভারদের থানায় নিক। পেঁয়াজি মারার জায়গা পায়নি।
—ধরবে এবার কিন্তু—
ছুটু আরও ভয় পেয়ে বলল। আমি চুপ করেই ছিলাম।
বোঁদেদা বললেন, আমি নিজে ধরা না-দিলে কোনো শালার সাধ্য নেই যে আমায় ধরে। বলেই অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে ব্যাক করেই গ্র্যাণ্ডের সামনে গাড়িটা লাগিয়ে দিলেন। আমার গাড়ি বন্ধ করে রামদীন দৌড়ে এল। সার্জেন্ট দু-জনও মোটর সাইকেল থেকে নেমে এগিয়ে এলেন। পুলিশ ভ্যানটা দাঁড়িয়ে রইল।
—ধরবে এবারে।
ভীষণ ভয় পেয়ে ছুটু বলল।
দরজা খুলে নামলেন বোঁদেদা। দু-জন ভিখিরি দু-হাত তুলে এবং একটা ল্যাজ-নাড়ানো ময়লা-খোঁটা নেড়িকুত্তা তার রুখু ল্যাজের ফ্ল্যাগ হয়েস্ট করে স্যালুট জানাল।
একজন সার্জেন্ট বললেন, ইউ আর আণ্ডার অ্যারেস্ট।
—ধরো-না!
বলেই, বোঁদেদা ওই নোংরার মধ্যে ফ্ল্যাট হয়ে পড়ে গেলেন।
আমি হেসে ফেললাম। কেউ তো জানে না বোঁদেদাকে। কুটুদার ফ্ল্যাটে লিফট-এর সামনে যে খেলা খেলেছিলেন, এও সেই খেলা।
সার্জেন্ট বললেন, উঠুন উঠুন।
বোঁদেটা নট নড়নচড়ন নট কিছু। আজকের অভিনয়ের তুলনা নেই কোনো। শম্ভু মিত্রও লজ্জা পেতেন দেখলে। বোঁদেদা যেন সত্যি সত্যিই মরে গেছেন এমন করে পড়ে রইলেন ওই ধুলোর মধ্যে নির্বিকারে। ভিড় জমে গেল। সার্জেন্টরা বললেন, পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে যাব। এমন চালাকি আমাদের দেখা আছে।
আমি বললাম, আগে হোটেলে নিয়ে যাই। তারপরে যা করবার করবেন। সার্জেন্টরাও হাত লাগালেন। লবি ম্যানেজার তো দেখেই ছুটে এসে ডাক্তারকে ফোন করলেন। রেসিডেন্টদের মধ্যেও ডাক্তার ছিলেন কয়েক-জন। কী একটা মেডিক্যাল কনফারেন্স অ্যাটেণ্ড করতে এসেছিলেন তাঁরা। রিসেপশন থেকে ফোনে একজন ডেকে আনল ওঁদের দু-জনকে। চার-জন ডাক্তারই দেখলেন। আমি ভাবছিলাম কখন বোঁদেদা বলবেন, কী রে বোকাটা? কিন্তু বোঁদেদা আর উঠলেন না। একজন ডাক্তার বললেন, হি ইজ ডেড। অন্যরাও মাথা নাড়লেন।
বোঁদেদা বলতেন, বুঝলি রে বোকা। বাঁচার অনেক রকম হয়। এক, মিনমিন করে বাঁচা, আর গমগম করে বাঁচা। তুই ভুলেও ভাবিসনি যে, আমি কোনোদিন উডল্যাণ্ডস বা বেলভিউতে খাট আলো করে কারও সিমপ্যাথির জন্যে শুয়ে থাকব একটি দিনও। দেখিস।
কথার খেলাপ করেননি মানুষটি।