পালসা

পালসা

হুস করে একটি হলুদ বসন্ত পাখি কেঁদ গাছটার সরু ডালে কাঁপন তুলে উড়ে গেল টুটিলাওয়ার দিকে।

পাখিটি ফিসফিসে বৃষ্টিতে ভিজছিল এতক্ষণ। ঠোঁট দিয়ে ভিজে পালক পরিষ্কার করছিল। একটি পাহাড়ে-বাজ কোথা থেকে এসে তার খুব কাছ দিয়ে উড়ে গেল। তরঙ্গিত হাওয়ায় তার ডানার আঁশটে গন্ধ পেল হলুদ বসন্ত পাখিটা। ছটফট করে উঠল ও ভয়ে। তারপরই উড়ে গেল হুস করে!

লাওয়ালঙের পুরোনো ভাঙা বাংলোর চৌপাইয়ে শুয়ে শুয়ে জানলা দিয়ে শ্রাবণের বৃষ্টিভেজা সকালের সুবাস নিচ্ছিলাম। আজকাল এ সমস্ত জায়গা ন্যাশনাল পার্ক হয়ে গেছে। চোরাশিকারিরা ছাড়া, এ জঙ্গলে-পাহাড়ে কেউ ঢোকে না। মাঝে মাঝে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের জিপ গুবরেপোকার মতো দূর দিয়ে গুড়গুড়িয়ে চলে যায়।

গুরবা এবং আমি চুরি করে এখানে এসেছি। ধরা পড়লে নির্ঘাত জেল এবং রাইফেলের লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত হবে। চুরি করে শিকার করা যে নিতান্তই খারাপ তা আমরা জানি। তবু জেনেশুনেই নিরুপায় হয়ে এসেছি। প্রকাশ্যে পারমিট নিয়ে দাবানলের জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে কিছু পাওয়া যায় না জেনেই চুরি করতে হয়। এখন অবশ্য সর্বত্রই ক্লোজড সিজন। ধরা পড়লে আর রক্ষা নেই।

কাল রাতে আমার জ্বর হয়েছিল! এখনও একটু একটু জ্বর আছে।

এখন এই জঙ্গলে-পাহাড়ে হাজারিবাগ জেলায় শ্রাবণ মাসে রীতিমতো ঠাণ্ডা। পরশু মাচায় বসে বৃষ্টিতে খুব ভিজেছি। প্রায় তিন-চার ঘণ্টা। তাতেই জ্বর হয়েছে। গুরবা ভোর পাঁচটায় উঠে আদা দিয়ে আমাকে এক মগ চা করে দিয়ে পালসা শিকারে বেরিয়েছে। বলেছে, চুপ করে শুয়ে থাকতে। শাসিয়েছে, বাংলোর বাইরে বেরোলে পয়েন্ট টু টু রাইফেল দিয়ে চুতর চিরে দেবে। ও বলে গেছে যে, বেলা হলে মুন্নি এসে আমাকে বার্লি খাইয়ে যাবে। মুন্নির বাবা এই জঙ্গলের কেঁদ পাতার ইজারাদার। জঙ্গলের মধ্যেই কিছুটা জায়গা পরিষ্কার করে মাটির দোতলা বাড়ি বানিয়ে সে থাকে। মুন্নির নাম শুনেছি আমি গুরবার কাছে। এখনও চোখে দেখিনি।

গুরবার বয়স তিরিশ হবে। রাঁচিতে একটি মার্চেন্ট অফিসের কেরানি। যে-লোকটা সুগঠিত কাঁধের ওপর রাইফেল ফেলে সকাল থেকে রাত অবধি বনে-পাহাড়ে অবলীলাক্রমে ঘুরে বেড়ায়, তাকে প্রায়ান্ধকার অফিসের ডেস্কে, ঘাড় নীচু করে বসে লেজার যোগ দিতে দেখলে কষ্ট হয়। তখন ওকে যত বিমর্ষ দেখায়, সার্কাসের বাঘকেও তত বিমর্ষ দেখায় না। জঙ্গলে-পাহাড়ে এলেই ডিজেল লোকোমোটিভের মতো ওর ভেতরে একটি বহু অশ্বশক্তিসম্পন্ন জেনারেটর গোঁ-গোঁ করতে থাকে। ও যত বেগ সইতে পারে না, তার চেয়েও অনেক বেশি বেগ ও বয়ে বেড়ায় তখন। লাল গা কালো মুখ বুনো কুকুরের মতো ও হন্যে হয়ে ওঠে। নগ্ন হয়ে ঝরনায় চান করে। মহুয়া কুড়োনো ওঁরাও কিশোরীকে জোর করে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়; পাহাড়ের ওপরের চিতার গুহায় বন্দুক বগলে বিনা দ্বিধায় ঢুকে পড়ে। মানে, নিজের সবগুলি অবদমিত ইচ্ছাকে অনেকগুলি বেগনি ললিপপের মতো নির্লজ্জ ছেলেমানুষ হয়ে একসঙ্গে চুষে চুষে খায়।

গুরবার একটি অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। যেখানেই ওর সঙ্গে গেছি, দেখেছি মুহূর্তের মধ্যে খিদমদগারির লোক জোগাড় হয়ে গেছে। মাথা রাখার ঠাঁই জুটেছে, মোরগা আণ্ডা জুটেছে, যত্ন-আত্তি হয়েছে, কোনোরকম অসুবিধাই হয়নি। শহরে ইনকামট্যাক্স অফিসার এবং গ্রামে দারোগাসাহেবের যা প্রতিপত্তি, এই ছেলেটার এই বনে-পাহাড়ে তার চেয়েও অনেক বেশি প্রতিপত্তি আছে।

দেখতে গুরবা ভালো নয়! মানে, বেশ খারাপ। অনেকটা মাঝারি সাইজের ভাল্লুকের মতো। কালো, গাঁট্টাগোট্টা, সামনের পাটির দুটো দাঁত ভাঙা। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। একমাথা এলোমেলো কোঁকড়া চুল। কোনোরকম নেশা নেই ওর। পান সিগারেট কিছু খায় না।

বাংলোটা বন বিভাগের নয়। কাঠের এক বড়ো ঠিকাদার বহুদিন আগে একসময় বানিয়েছিলেন। এখন ভেঙে পড়েছে। বন বিভাগের বাংলোয় থেকে চুরি করে শিকার করা যায় না। এ বাংলোর চারদিকে ঘন শালবন। হাতায়, বড়ো বড়ো ঘাস গজিয়েছে। এদিকে-ওদিকে কেলাউন্দা ও পুটুসের ঝোপ।

মংলুর বড়ো খয়েরি-সাদাতে মেশানো কুকুরটা ইট-ওঠা বারান্দায় শুয়ে শুয়ে মাঝে মাঝে খচ-খচ-খচ আওয়াজ করে গা চুলকাচ্ছে। আঠালি লেগেছে মনে হয়। চৌপাইটাতেও বড়ো খটমল। কুটুস কুটুস করে কামড়াচ্ছে। নড়াচড়া করলেই ক্যাঁচ-কোঁচ করে উঠছে। ঘরটা ছুঁচোয় ভরতি। রাতে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা সত্ত্বেও বাস্কেটবলের মতো ছুঁচোগুলো আমাদের কম্বলাবৃত্ত শরীরের ওপর লাফালাফি করে বেড়িয়েছে।

জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকলাম। তারপর ঘরের ভেতরে তাকালাম।

এককোনায় গর্ত করে উনুন বানিয়েছে গুরবা। অন্য পাশে ওর চারপাই। কাল বিকেলে দুটো মোরগ মেরেছিলাম আমরা। একগাছা দড়িতে ঝুলিয়ে রেখেছে সে-দুটোকে ওপর থেকে! মোরগ দুটোর ঠোঁট চুঁইয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়েছে মেঝেতে। রক্ত জমে রয়েছে। ছুঁচো চুপি চুপি এসে সেই রক্ত চাটছে।

আমি শুয়ে শুয়েই ধমকে বললাম, এই!

একটি অতর্কিত চিঁক আওয়াজ করে ছুঁচোটি দৌড়ে গুরবার চৌপাইর মেঝের গর্তে ঢুকে গেল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রুপোর গয়নার রিনঠিন আওয়াজ শুনলাম বারান্দায়। মেঘলা আকাশেও যে আলোর আভা থাকে, সেই আলোয় দরজার পাশে একটি সুরেলা ছায়াকে সরে যেতে দেখলাম।

মাথা উঁচু করে বললাম, কওন?

মৌটুসি পাখির মতো একটি গলা বাইরের বৃষ্টির সঙ্গে গলা মিলিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ম্যায় মুন্নি হুঁ।’

উঠে বসে বললাম, আও অন্দর আও, শরমাতা কিউ।

মুন্নি এসে চৌকাঠে দাঁড়াল।

জল-পাওয়া বোগেনভেলিয়া লতার মতো ঋজু, কমনীয় চেহারা। মাজা-মাজা রং, মুখ-নাক যে খুব সুন্দর এমন নয়। ঠোঁটের গড়নটাও কেমন অস্বাভাবিক। কিন্তু চোখ দু-টিতে ভারি একটি দুষ্টমি ভরা বুদ্ধিদীপ্ত চঞ্চলতা। দু-হাতে ধরে আছে বার্লির এনামেলের গ্লাসটি। একটি সতেজ রুক্ষ বেণি কাঁধ বেয়ে সামনে ঊরু অবধি পৌঁছেছে। মনে হল, বেণিটির যেন একটি নিজস্ব ব্যক্তিত্ব আছে। তার মধ্যে জঙ্গলের গেরুয়া পথের মতো একটি গতি আছে। যৌবন ও কৈশোরের দুই আঙিনার মাঝের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে মুন্নি।

মুন্নি কথা খুব কম বলে। তাও বেশিরভাগ হুঁ-হাঁ দিয়ে সারে। কথা যা বলার তা চোখ দিয়েই বলে।

মুন্নি উবু হয়ে বসে, বেণিটাকে পিঠে ছড়িয়ে দিয়ে উনুনটা জ্বালল। সসপ্যানে বার্লিটা ঢালল। গরম করল। গরম হলে, আবার গেলাসে ঢেলে চোখ তুলে আমায় শুধুল, নিম্বু?

এ জঙ্গলে কে আমাকে লেবু এনে দেবে?

বললাম, নিম্বু কাঁহা হিঁয়া?

অমনি মুন্নি ডান হাতটি ওর হাটিয়াতে কেনা সস্তা ছিটের ব্লাউজের মধ্যে সটান ঢুকিয়ে ঠিক ওর গায়ের রঙের একটি ছোট্ট সুডৌল লেবু বের করল। তারপর গুরবার ছুরিতে কেটে বার্লির গেলাসে নিংড়ে দিল। আমি যখন গেলাসটি হাতে নিলাম তখন মনে হল মুন্নি বুকের সুগন্ধ ও উষ্ণতার সবটুকু এই পানীয় শুষে নিয়েছে। অত ভালোবেসে কেউ বার্লি খায় তা আমি নিজে না খেলে জানতাম না।

গেলাসটিকে ফেরত দিলাম। মুন্নি হাত বাড়িয়ে নিল। বারান্দার কুকুরটাকে মুন্নির বিবেক দরজায় পাহারা দিতে ডাকল। একা ঘরে সুয়াতিয়া মেয়ে কী করছে চোরাশিকারির সঙ্গে?

কুকুরটা ঘরের হাওয়া শুঁকে অপবিত্রতার গন্ধ না পেয়ে দরজার সামনে জোড়া পায়ে বসল। মুন্নি যেন লজ্জা পেয়ে চুড়ি রিনঠিনিয়ে, বেণি ইনবিনিয়ে হাতের এক ঝটকায় কুকুরটাকে যেতে ইশারা করল। বলল, চল। হঠ।

কুকুরটা হিংসুক প্রতিবেশীর মতো দুঃখিত মুখে ফিরে গেল।

বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছিল।

মুন্নি শুধাল, আপ আভি ক্যায়সি হ্যায়?

আমি বললাম, খাস কুছ খরাব নহি।

মুরুব্বিয়ানার সঙ্গে মুন্নি বলল, শিকার খেলনে আজ বাহার মত যাইয়ে।

তারপর আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলল, ম্যায় অব চলে।

তারপর ফিসফিসে বৃষ্টিতে শালবনের ঝরা ফুল পাতা বিছানো গেরুয়া পথের বাঁকে মুন্নির হলুদ শাড়ি মিলিয়ে গেল।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। এই বনে-পাহাড়ে বর্ষণসিক্ত আষাঢ়-শ্রাবণের দুপুরের যে আমেজ, সে আমেজের তুলনা করি এমন কিছু আমার অভিধানে নেই। এ আমেজ যদি বিক্রি করা যেত, তাহলে প্রতি পল হাজার হাজার টাকায় বিকোত।

সুরেলা দুপুর কাঁপতে কাঁপতে কখন যে ম্লান বর্ষাবিধুর বিকেলে পৌঁছে গেছে টেরও পাইনি। ঘুম দিয়ে শরীরটা বেশ ঝরঝরে ও সুস্থ মনে হচ্ছে। শুয়ে শুয়েই অনেক লোকের গলা এবং তারসঙ্গে গুরবার গলাও শুনতে পেলাম। ওরা বট গাছের নীচ দিয়ে বনদেওতার থান ঘুরে এদিকে আসছে। শালটা জড়িয়ে বারান্দায় বেরিয়ে দেখি এক প্রকান্ড শিঙ্গাল শম্বরকে ডালের সঙ্গে বেঁধে কাঁধে তুলে প্রায় দশ-বারো জন লোক নিয়ে আসছে, আর গুরবা রাইফেল কাঁধে আগে আগে আসছে।

ওরা কাছে আসতেই গুরবা বলল, কেয়া ইয়ার? দেখা? একদম বিলকুল নরপাঠঠা। একদম মস্তিমে হ্যায়।

আমি বললাম, এত বড়ো জানোয়ার মারলে কেন? জানাজানি হয়ে গেলে যে বিপদ হবে।

গুরবা ধমকে বলল, ছোড়ো। যো হোগা সো হোগা। দিল তো খুশ হো গ্যয়া।

সারাদিন খায়নি গুরবা। রাতে মুরগি রান্নার কথা। মংলুকে ডেকে, বেশি করে চায়ের জল চাপাতে বলল, সবাই খাবে।

বোধ হয় হঠাৎ মনে পড়ল ওর। শুধোল, মুন্নি এসেছিল?

আমি বললাম, এসেছিল। আমায় বুকে রাখা লেবু চিপে বার্লি খাইয়ে গেছে।

গুরবার চোখ দুটো জ্বলে উঠল। সার্চলাইটের আলোয় রাতে ভাল্লুকের চোখ যেমন জ্বলে। ফিসফিস করে বলল, মুন্নির বুক তো নয়! যেন একটি আসকল পাখি, নরম, উষ্ণ আবেশে ধুকপুক করছে। ওই পাখিকে একবার মুঠিতে ধরবার জন্যে আমি হাজার বার পৃথিবীতে আসতে পারি। তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘নিগাহ যায়ে কাঁহা সিনেসে উঠ কর। হুয়া তো হুসন কি দৌলত গড়ি হ্যায়।’ অর্থাৎ চোখ যে সরাতে পারি না ইয়ার, সুন্দরীদের সমস্ত দৌলত তো খুদা ওইখানেই গড়ে রেখেছেন।

মংলু মুরগিটা ভালো রাঁধতে পারল না।

গুরবা রাত দশটা অবধি শম্বরের শরীরে থকথকে রক্তে, নাড়িভুঁড়ির বদবুতে, প্যাতপেতে রক্তমাখা চামড়ায় হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াল। হাতে একটি ধারালো ছুরি, পরনে ছোটো কালো শর্টস, খালি গা, মাথা ভরা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, চওড়া চওড়া থাবা। মনে হল একটা কালো বাঘ মাচার নীচে, মাটিতে বসে মাংস চিবোচ্ছে। একজন অনুচর ধুঁয়ো ছড়ানো হ্যারিকেনটা নিয়ে ওর সঙ্গে সঙ্গে এগোচ্ছে পিছোচ্ছে।

শম্বরের পিলেটা গুরবা টেনে বার করে দু-হাতে বেলুনের মতো জোরে টিপল। ভস শব্দ করে একটা তীব্র দুর্গন্ধ বেরোল। মংলু শম্বরের দাঁত দুটো ফাঁক করে দেখাল, সবুজ সবুজ জাবর কাটা ঘাসে মুখ ভরা রয়েছে। মংলুর কুকুরটা মংলুর ধমক খেয়ে উদার ও নির্লিপ্ত চোখে অন্যদিকে চেয়ে বসে রইল। কিন্তু উত্তেজনায়, লোভে, অসংযমে ওর ল্যাজটা কাঁপতে থাকল থরথর করে, মুখ দিয়ে অসংযত একটি ‘কুঁই-কুঁই’ আওয়াজ বেরোতে লাগল। শম্বরের চামড়া ছাড়ানো হল টাঙ্গি দিয়ে। কুপিয়ে কুপিয়ে টেংরি ফাড়া হল। পুরো গাঁয়ের লোক শালপাতা মুড়িয়ে শিকার নিয়ে গেল। মংলুও ছুটি নিয়ে চলে গেল আজকের মতো গাঁয়ে। এই বছরে আবার কবে ওরা মাংস খাবে কে জানে! বড়ো গরিব তো ওরা!

সব সারতে সারতে রাত এগারোটা হল। বিকেল থেকেই আমি খুব ভালো আছি। জ্বর একেবারে নেই। এমনকী গুরবার সঙ্গে মুরগির ঝোল দিয়ে একটি হাত-রুটিও খেয়েছি। আমরা দু-জন বাংলোর বারান্দার হাতল ভাঙা চেয়ার দুটোতে বসে আছি। শালটা জড়িয়েই বসেছি। পাছে আবার ঠাণ্ডা লাগে! খালি গায়ে বসে আছে গুরবা। নির্বিকার। ওর গা দিয়ে শম্বরের রক্তের গন্ধ বেরোচ্ছে।

এখন আকাশটা পরিষ্কার হয়েছে। একফালি চাঁদ উঠেছে সীমারিয়ার দিকে আকাশে। বর্ষণসিক্ত বন-পাহাড় চাঁদের ঘোলাটে আলোয় ভূতুড়ে ভূতুড়ে দেখাচ্ছে।

আমাদের বাংলো থেকে প্রায় একশো গজ দূর দিয়ে লাওয়ালঙের পুরোনো ভাঙা রাস্তাটি চলে গেছে বাংলোর তিন-চার পাশ ঘুরে। এপথে গাড়ি চলে না। তবে মংলু বলেছিল, আজকাল শহুরে শৌখিন বাহাদুর শিকারিরা রাতের শিকারের জন্যে জিপ নিয়ে এই রাস্তায় প্রায়ই ঘোরাঘুরি করে। জিপের যান্ত্রিক গোঙানিতে ওদের ঘুম ভেঙে যায়। তারা নাকি এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। সেদিন কার মোষের গায়ে গুলি লেগেছিল। জানোয়ার বিচার করে না, মদ্দা-মাদি বিচার করে না, আলোতে চোখ জ্বলে উঠলেই গুলি চালায়। হিংস্র জানোয়ারদের গুলি করে আহত অবস্থায় ফেলে পালায়, খুঁজে বের করে মারবার সাহস রাখে না! গর্ভবতী মাদি হরিণের পেটে গুলি করে জঙ্গলে ফেলে রেখে যায়।

গুরবার ভারি রাগ এই শিকারিদের ওপর। গুরবা এদের বলে, ভিখারি। বাহাদুরির ভিখারি। বাহাদুরি অর্জন করার মতো বল ওদের বাহুতে নেই। তবু ওরা বাহাদুরি কুড়োবার জন্যে জিপে করে রাতের পর রাত বন-পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়। ড্রয়িংরুমে শিং ও মাথা টাঙাবে বলে যেনতেনপ্রকারেণ কিছু-না-কিছু জানোয়ার মারতে চায়। খটাশ মেরে বলে, বাঘ মেরেছি। যেখানে-সেখানে দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো বিপজ্জনক জানোয়ারদের আহত করে দেয়। যার দন্ড দিতে হয় জঙ্গলের নিরীহ বাসিন্দাদের। গতবছর একটা চিতা এই জঙ্গলে আহত হবার পর থেকে নরখাদক হয়ে গেছে। তখন থেকে এ জায়গায় একটা ত্রাসের রাজত্ব চলছে।

আসলে আমরা সেই চিতাটির খোঁজেই এই জঙ্গলে এসেছি।

চুপচাপ বসে আছি। দূর থেকে খাপু পাখি ডাকছে ‘খাপু-খাপু-খাপু-খাপু’! বাংলোর পেছনের ঝরণার শব্দ এই অপার্থিব রাতের ভয়াবহতায় আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ঝরঝর ঝরঝর করে বয়ে চলেছে ঝরনাটা। টুটিলাওয়ার দিক থেকে কতকগুলো চিতল হরিণ থেকে থেকেই ডেকে উঠছে, টাঁউ-টাঁউ-টাঁউ। সমস্ত সিক্ত বনে-পাহাড়ে সে শব্দ ছড়িয়ে যাচ্ছে কোথায় কোথায়। রাস্তাটা একটি ঘুমন্ত সরীসৃপের মতো শুয়ে রয়েছে নির্জীব হয়ে। মাঝে মাঝে এলোমেলো হাওয়া উঠছে বনে। কত দীর্ঘশ্বাস, কত ফিসফিসানি। এইরকম হাওয়া-বওয়া রাতেই যত কাটনেওয়ালা জানোয়ার শিকারে বের হয়। কারণ, হরিণ ইত্যাদি জানোয়ারেরা তখন তাদের পায়ের শব্দ ও গায়ের গন্ধ বুঝতে পারে না। সময় সময় পাতায় হিসহিস ফিসফিস শব্দ ওঠে। সেই শব্দের পটভূমিতে সাবধানি পা ফেলে হিংস্র জানোয়ারেরা শিকার ধরে।

আমাদের বাংলোর ঘরের দরজাটা ভাঙা, একটা পাল্লা নেই। তাই দু-জনেই সজাগ হয়ে ঘুমোই ঘুমোবার সময়। হাতের কাছে, গুলিভরা রাইফেল নিয়ে। কাঁটা গাছের বড়ো বড়ো ক-টি ডাল কেটে হাঁ-করা দরজার মুখে দিয়ে রাখি শোয়ার সময়।

গুরবাকে শুধোলাম, আর কোনো জানোয়ার দেখলে আজ?

ও বলল, না, শুধু শম্বর। ঝুণ্ডকে ঝুণ্ড। তবে সবই মাদি। তাই মারতে পারলাম না। শেষে ঘুরতে ঘুরতে পাহাড়ের মাথায় এই শিঙ্গালটার সঙ্গে দেখা। বেশ দূরে ছিল। নিশানা নিয়ে মারলাম। শালা একদম গোলি অন্দর—জান বাহার। সাথে-সাথ।

গুরবার হাত সত্যি ভালো। আমরা যা শিকার করি তা সবই পালসা। জঙ্গলে জঙ্গলে পায়ে হেঁটে শিকারকেই পালসা বলে! পালসা শিকারে দিনে কী রাতে, গুরবার জানোয়ার চেনার দক্ষতা দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যেতাম। জানোয়ার কত দূরে, কোন ভঙ্গিতে আছে এবং তাকে কোথায় গুলি করলে মোক্ষম মার হবে তা ও একনজরে দেখে বলতে পারত। পালসা শিকার গুরবার জান, পায়ে হেঁটে হেঁটে বনে-পাহাড়ে, রাইফেল কাঁধে বেড়াতে পারলে ও আর কিছু চায় না। বেসুরো গলায় মাঝে মাঝে ও গুনগুন করে গায়, চলতে চলতে গুরবা প্রায়ই বলে, ‘জঙ্গল মেরি মঞ্জিল বন গয়ি—।’

চারিদিকে এখন এমন একটা আদিগন্ত নিস্তব্ধ ভয়াবহতা যে, চুপ করে থাকলে মনে হয় এক্ষুনি হয়তো কোনো ভয়াবহ ব্যাপার ঘটতে পারে। এখনই হয়তো নরখাদক চিতাটা এসে আমাদের একজনকে নিয়ে যেতে পারে। গতকাল সকালে আমরা বাংলো থেকে দু-মাইল পুবে গাড়গুলুয়া নালায় চিতাটার পায়ের দাগ আবিষ্কার করেছি ভিজে বালিতে। পেছনের বাঁ পা-টা বেশ টেনে টেনে হাঁটে। নিশ্চয়ই আগে গুলি খেয়ে থাকবে।

আচমকা গুরবা বলল, তোমার একটুতেই জ্বরজারি হচ্ছে তুমি কি বুড়ো হয়ে গেলে দোস্ত? তাহলে এই বেলা একটা বিয়েশাদি করে ফেলো।

আমি বললাম, আমায় বিয়ে কচ্ছে কে? তার চেয়ে তুমি বরঞ্চ ঝুলে পড়ো।

ও বলল, মাথা খারাপ? আমায় তো কেউ বিয়ে করবেই না। তা ছাড়া এই বন-পাহাড়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেছে অনেকদিন আগে।

মুন্নিকে তুমি ভালোবাসো না বুঝি?

গুরবা চমকে উঠল।

তারপর ধরা-পড়া ময়নার মতো বলল, ভীষণ, ভীষণ ভালোবাসি। মুন্নিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকার স্বপ্ন দেখি কতদিন।

আমি বললুম, বুক তো নয়, বুক কম্বল। তোমার ওই রোমশ বদবু বুকের কাছাকাছি কোনো মেয়ে ঘেঁষবে না।

গুরবা কোনো উত্তর দিল না। একটুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, আমার ইচ্ছা করে এমনই জায়গায় একটি কাঠের ছোটো দোতলা বাংলো বানাই, সারাজীবন, সারাটাজীবন এখানে থাকি। সকাল-সন্ধ্যা রাইফেল কাঁধে পালসা শিকার করি। খরগোশের সঙ্গে ধানিঘাসের বনে বনে দৌড়োই, প্রজাপতিদের সঙ্গে উড়ি। খাপু পাখিকে নকল করে ডাকাডাকি করি। তারপর দিনশেষে বাংলোয় ফিরে বারান্দায় চুপ করে বসে থেকে রাতের অন্ধকারে জোনাকি গুনি।

একলা থাকতে ভালো লাগবে না সারাজীবন। আমি বললাম।

একেবারে একা তো থাকব না। যখন শরীরের মধ্যে কখনো-সখনো কাঁকড়াগুলো কিলবিল করবে, বড়ো বড়ো দাঁড়ায় আমাকে ঠুকরে ঠুকরে ব্যথিয়ে তুলবে, তখন নিশ্চয়ই কেউ আসবে মুন্নির মতো। মুন্নির চুলের গন্ধ আমি ফোটা-কার্তুজের বারুদের গন্ধের মতো ভালোবাসি। কোনো হিমেল শীতের রাতে যখন আর শীত মানবে না, তখন তাকে আমার বুককম্বলে শুইয়ে রাখব। আসকল পাখির মতো তার উষ্ণ সুগন্ধিতে শরীর নাড়ব, চাড়ব, তাকে সারেঙ্গির মতো বাজাব, তারপর দু-জনের খুশি শেষ হলে তাকে দু-হাতে আকাশে উড়িয়ে দেব। সেও মুক্ত থাকবে, আমিও মুক্ত। কোনোদিন কারও কাছে বোঝার মতো ভারী হব না; কাউকে বোঝার মতো বইবও না।

আমি বললাম, তাহলে মুন্নিকে জোর করে ধরে আনতে হবে।

গুরবা ছি ছি করে উঠল।

বলল, মুজাক্কর হয়ে তুমি এমন কথা বলছ দোস্ত? জোর করে ধরে আনার মজা কোথায়! তেমন ভালোবাসা তো কড়ি ফেলেই পাওয়া যায়। যেদিন সময় হবে, মুন্নি এমনিই আসবে। চৈত্র মাসে শুকনো শালপাতার আড়ালে আড়ালে মসৃণ চিকন বাদামি শরীরিণী সর্পিণী যেমন আনন্দে হিলহিল করে সাপের কাছে যায়, তেমনি নি:শব্দে মুন্নি আসবে, এসে আমার খাটে উঠবে, আমার গলা জড়িয়ে ধরবে। তারজন্যে আমি আজীবন অপেক্ষা করে থাকব। যদি তাকে সত্যিকারের ঐকান্তিকতায় চেয়ে থাকি, তবে একদিন-না-একদিন আমার আসকল পাখিকে জড়িয়ে ধরে আমি ঘুমোবই ঘুমোব।

চাঁদনি রাতে আমি একা একা পালসা শিকার করে বেড়াব, হায়নার হাসি নকল করব, ঘুমন্ত ময়ূরকে তালি দিয়ে উড়িয়ে দেব, বাঘ যেমন করে শম্বরের পিছু নেয় তেমন করে তার পিছু নিয়ে তাকে ভীষণরকম চমকে দেব। গভীর রাতের চাঁদ মাখা টিলার ওপরে দাঁড়িয়ে আমি একা একা হাসব। হাসব প্রাণ খুলে, আগল খুলে হাসব। উই ঢিপির পাশে রাতজাগা ক্ষুধার্ত ভাল্লুক অন্ধকারে আমাকে আর একটা ভালুক ভেবে বিরক্ত হয়ে ফিরে যাবে।

এই অবধি বলে চুপ করে গেল গুরবা, তারপর কেমন ধরাগলায় আমায় ফিসফিসিয়ে বলল, আমি বড়োই খারাপ দেখতে, না দোস্ত? আমি জানি মুন্নি কোনোদিনই আমার মতো ভালুককে ভালোবাসবে না।

এমনভাবে ও বলল কথাটা, আমার মনে হল এই হতাশ গুরবাকে আমি কোনোদিন চিনি না, জানি না।

ধমকে বললাম, ক্যা ফালতু বকবকাতা হ্যায়?

গুরবা বলল, তুমি আমার বন্ধু, আমাকে ভালোবাসো বলে সত্যি কথাটা বলছ না। কিন্তু আমি জানি, ভালুকের মতো কেলাউন্দা ঝোপে ঝোপে ও মহুয়ার নীচে নীচে ঘুরে বেড়ালেই আমাকে মানায়। তোমাদের শহরের ফ্লুরোসেন্ট আলো আর সুবেশ সুন্দর পরিবেশে আমি শীতের দিনের কুনোব্যাঙের মতো কুঁকড়ে থাকি। যদি কেউ ছোটোভাইটার হোস্টেলের খরচ চালাবার ভার নিত, তাহলে আমি আর রাঁচি ফিরতাম না দোস্ত। এখানেই থেকে যেতাম পালসা খেলতাম। শুধু পালসা খেলতাম।

তারপর অনেকক্ষণ দু-জনে চুপ করে বসে রইলাম।

আমি বললাম, রাত কাফি হোগ্যায়া ইয়ার, চলো, শো যাও।

গুরবা বলল, তুম যাকে শোও ইয়ার। ম্যায় থোড়ি দের তক হিঁয়া বৈঠেগা। ইয়ে রাতসে বড়ি খুশবু নিকল রহি হ্যায়।

কাঁটার বেড়া সরিয়ে নিজের চৌপাইতে শুয়ে শুতে ভাবলাম, দোস্ত আমার বড়ো রসিক। ওর নিজের গায়ে বোঁটকা শম্বরের রক্তের গন্ধে আমার বমি উঠছে, আর ও নিজে এই রাতের সুগন্ধে বুঁদ। ব্যাটা ভালুক কোথাকার!

ছুঁচোগুলো সংক্ষিপ্ত চিঁক চিঁক আওয়াজ করে ঘরময় ঘুরে বেড়াতে লাগল। বাইরের নিস্তব্ধ রাতে শুধু ঝরনার ঝরঝরানি আর খাপু পাখির ডাক।

আমি জানি না, কেন সভ্যতা, সংস্কৃতি, ভদ্রতা এসব কথাগুলো শুনলেই গুরবা হিক্কাতোলা কুমিরের মতো আঁতকে আঁতকে ওঠে। ও মনে-প্রাণে জংলি! ওর মতে সভ্য মানুষ মানেই ভন্ড মানুষ। ওর সব কিছুতেই এমন একটা নগ্ন উচ্ছ্বাস, এমন একটা অনন্ত প্রাচুর্য যে, শহুরে জীবনের মাপা হাসি, মাপা চলা, আর পদে পদে বাধানিষেধ বরদাস্ত করতে পারে না। বিশেষ করে এই শহুরে শিকারিদের। যারা ভন্ডামির পরাকাষ্ঠা দেখায়। ওদের দেখলে গুরবা একটা উপবাসী হায়নার মতো দাঁত কড়মড় করে, খালি হাতেই ছিঁড়ে ফেলতে চায়। এই ব্যাপারে গুরবা বুনোকুকুরের মতো নিষ্ঠুর। অথচ এমন বড়োমনের অন্য কোনো মানুষ আছে বলে আমি জানি না। কাচপোকার কষ্টে যে গলে যায়, হরিণেরা খাবারের জন্য, পাহাড়ের ঢালে ঢালে নিজের পয়সা খরচ করে কুলথি লাগায়, সরগুজা লাগায়; ঝরনার পাশে একটি একটি করে দূর্বা পোঁতে। সেইসব খেতে গুরবা কিন্তু কখনো শিকার করে না। ও বলে, তা বেইমানির শামিল। কিন্তু একটি শিঙ্গাল হরিণের পেছনে সারাদিন ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যার মুখে যদি সে তাকে রাইফেলের পাল্লায় পায় তবে তার মতো খুশি কেউ হয় না। ও একটা পাগল। যে বাঘ মারতে তার বেগ পেতে হয় না, সেই মৃত বাঘের পেটে সে লাথি মারে। থুথু ফেলে, বলে, ‘শালা বাঘোয়া নেহি, চুহা হ্যায়!’ ওর ভেতরে যতখানি উন্মত্ত শক্তি ও সাহস আছে ওর প্রতিপক্ষর কাছ থেকে ও ঠিক ততখানি শক্তি ও সাহস আশা করে। আর সেই একই কারণে হান্টিং-বুট পরা, সুসজ্জিত জিপারোহী শিকারি দেখলে ও বকলেস ছেঁড়া বুল টেরিয়ারের মতো লাফালাফি করে! জানি না ওর কপালে কী আছে। কোনোদিন যে ও এই পাগলামির বলি হবে, ওর ভালোবাসার চরিতার্থতায় এই বনে-পাহাড়ে বুড়ো হরিণের মতো প্রচারহীন মৃত্যুর কবলিত হবে, তা আমি সত্যিই জানি না। ওকে নিয়ে আমার বড়ো ভয়। কারণ ওকে আমি ভালোবাসি! ওর জন্যে আমার দুঃখও হয়! কারণ কোনোদিনই কোনো সুগন্ধি মেয়ে গুরবাকে ভালোবাসবে না। এমনকী মুন্নিও বাসে না। আমি বাজি ফেলে বলতে পারি। মেয়েরা খোঁটায়-বাঁধা শান্তশিষ্ট পাউডার-মাখা ছেলে চায়। গুরবার মতো দুর্দম, দুর্গন্ধ, দুর্বার ছেলেকে ওরা দূর থেকে শক্তিরূপে পুজো করতে পারে কিন্তু কখনো তাদের কাছে ঘেঁষতে দেয় না। ঘরের সঙ্গে যার বিরোধ, সভ্যতার সঙ্গে যার সংঘর্ষ, স্থবিরতার সঙ্গে যার দুশমনি সে কোনো মেয়ের ভালোবাসা পায় না। মেয়েরা ওই শহুরে শিকারিদের মতো ভন্ড। মুন্নি কোনো ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু গুরবা মুন্নিকে যেমন করে ভালোবাসে, তেমন করে আমারা কাউকে কোনোদিনই ভালোবাসতে পারব না।

অনেকক্ষণ পর একবার ঘুম ভাঙল।

বাইরে তখনও একটানা ঝিঁঝির ডাক। চাঁদটা মেঘে ঢেকে গেছে আবার। দেখলাম, গুরবা শুতে আসেনি তখনও। ঝরনার শব্দ আর ঝিঁঝির শব্দে উতোরচাপান চলছে।

শুয়েই শুয়েই বললাম, নেহি শোওগে কেয়া?

গুরবা বলল, আয়া ইয়ার, আবভি আয়া। কই শিকারি আয়া হ্যায়, জিপকা আওয়াজ মিল রহা হ্যায়, দূরসে। পাহাড়ি-পাহাড়িমে চক্কর লাগা রহা হ্যায় সায়েদ উনলোগোনে।

আবারও বলল, আয়া আয়া। আবভি আয়া।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, মনে নেই।

রাত কত হবে জানি না! হঠাৎ খুব কাছে একটি শর্টগানের আওয়াজে আচমকা ঘুম ভেঙে গেল।

ধড়মড়িয়ে চৌপাইয়ে উঠে বসে দেখলাম, গুরবা নেই। এবং দরজার কাঁটার বেড়াটা আমি শোয়ার সময় যেমনভাবে সরিয়ে রেখেছিলাম, তেমনভাবেই সরানো রয়েছে।

তার মানে ও ঘরে ঢোকেইনি শুতে।

কম্বলটা চৌপাইতে ফেলে রাইফেলটা হাতে নিয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বেরোলাম।

বেরিয়েই দেখি পুরোনো লাওয়ালঙের রাস্তার ওপর হেডলাইটটা জ্বালিয়ে একটি জিপ দাঁড়িয়ে আছে। ইঞ্জিনের একটানা ধক ধক ধক ধক আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। জিপটার স্টার্ট বন্ধ করা হয়নি। এবং গুরবা নীচু হয়ে রাইফেল হাতে ওইদিকে এগিয়ে চলেছে।

কিছু-একটা ব্যাপার ঘটেছে বুঝলাম কিন্তু সেটা কী ব্যাপার হতে পারে সে সম্বন্ধে কোনো ধারণাই মাথায় এল না। আমিও গুরবাকে ধাওয়া করে ওর পিছু পিছু ওইভাবে এগিয়ে গেলাম। যেখানে শম্বরটার ছাল ছাড়ানো হয়েছিল এবং কাটাকুটি করা হয়েছিল সেখানে গিয়ে একটি কেলাউন্দা ঝোপের আড়ালে শুয়ে পড়ল গুরবা।

আমিও ওর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে পড়ে কানে কানে বললাম, ‘ক্যা হুয়া?’

গুরবা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, শহরকা শিকারি শিকার খেলনে আঁয়ে হেঁ!

সামনে তাকাতেই দেখি, মংলুর কুকুরটি শম্বরের রক্তে-ভেজা মাটিতে পড়ে রয়েছে। তার ওপরে জিপ থেকে ফেলা স্পট-লাইটের আলো এসে পড়েছে। লোভী কুকুরটা নিরিবিলিতে নিশ্চয়ই শম্বরের নাড়িভুঁড়ি খাচ্ছিল এমন সময় ওরা জিপ থেকে গুলি করেছে। কুকুরটির কান দিয়ে গরম তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। জিভটা দাঁতে কামড়ে আছে। মরে গেছে।

গুরবা আমাকে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘শিখলায়গা শালালোগোকো।’

আমি ওর হাত টেনে বারণ করলাম।

কিন্তু ও শুনল না।

আলোতে যাতে ওকে দেখা না যায়, এমনিভাবে আলো থেকে সরে বুকে হেঁটে জিপের কাছে এগিয়ে যেতে লাগল ও।

কী করি? আমিও ওর পিছু নিলাম।

আমরা জিপটির কাছে প্রায় পঁচিশ গজের মধ্যে এসে গেছি! এতক্ষণ জিপের আরোহীরা কী করছে জিপে বসে কে জানে! কাছাকাছি পৌঁছে একটা ঘন পুটুসের ঝোপে আমরা চুপ করে বসে থাকলাম। এদিকটা অন্ধকার। ওরা আলো ফেলে আছে তখনও কুকুরটার ওপরে। যেদিকে আলো, ওদের সকলের মনোযোগ তো সেদিকেই।

ঝোপের ফাঁকে ফাঁকে যতখানি দেখা যায়, মাথা উঁচু করে দেখতে পেলাম যে, ড্রাইভার নয় একজন চাপরাশি স্পটলাইট ফেলে আছে। জিপের হুড নামানো—উইণ্ডস্ক্রিন, বনেটের ওপর শোয়ানো। সামনে ড্রাইভারের পাশে একটি ফর্সা লম্বা গ্রে-হাউণ্ডের মতো ছেলে এবং তার পাশে আঁটসাঁট করে শাড়িপরা, চুড়ো করে চুল বাঁধা একটি লেগহর্ন মুরগির মতো মেয়ে। পেছনে ককার-স্প্যানিয়েলের মতো ঠোঁট মোটা এলোমেলো চুলের চোখ-ঢাকা কালো একটি ছেলে। মেয়েটি ফ্লাস্ক থেকে কফি ঢেলে দিচ্ছে ছেলে দু-টিকে।

গ্রে-হাউণ্ড ককার স্প্যানিয়েলকে বলল, ‘আই ডিড নেভার নো দ্যাট ইউ ওয়্যার সাচ আ গুড শট।’

ককার-স্প্যানিয়েল বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘ওঃ শিট! ডোন্ট মেনশান।’

মেয়েটি, ডিমে-বসা লেগহর্নের মতো কঁকককিয়ে, বাংলায় বলল, তোমরা যাই বলো, চিতাটা কিন্তু বিরাট বড়ো ছিল।

গ্রে-হাউণ্ড তোষামুদি গলায় বলল, নিশ্চয়ই!

মেয়েটি আবার বলল, আচ্ছা কীরকম একটা ব্যাড স্মেল পাচ্ছ না তোমরা?

গ্রে-হাউণ্ড বলল, নিশ্চয়ই ব্যাটা কোনো হরিণ-ফরিন মেরে পচিয়ে রেখেছে।

আসলে গন্ধটা শম্বরের নাড়িভুঁড়ির। আমরাও পাচ্ছিলাম। হাওয়াটা এদিক থেকেই যাচ্ছিল। মংলুর দিশি কুকুরটার মুখ মনে পড়েছিল আমার।

হঠাৎ আমাকে হতবাক করে দিয়ে গুরবা পুটুস ঠেলে উঠে দাঁড়াতে গেল। ওর খালি গায়ে বোধ হয় কোনো পোকামাকড় কামড়ে থাকবে। এ ছাড়া উঠে দাঁড়াবার আর কোনো কারণই আমি খুঁজে পেলাম না। কিন্তু এক লহমার মধ্যে যা হওয়ার তা হয়ে গেল।

অত কাছে পাতার খসখসানির শব্দ শোনামাত্র চাপরাশিটি আলো ঘুরিয়ে এদিকে ফেলল। মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, ভালুক! ভালুক! এবং আলোর সঙ্গে সঙ্গে ককার-স্প্যানিয়েলের শটগানও ঘুরল। মাজল থেকে আগুনের হলকা বেরুতে দেখলাম। এবং তক্ষুনি কী একটা চাপা সংক্ষিপ্ত আওয়াজ করে গুরবা প্রায় আমার ঘাড়ের উপরেই পুটুসের ডাঁটা-পাতা ভেঙে পড়ে গেল।

গুরবাকে চিত করে দিতেই দেখি একেবারে বুকে গুলি লেগেছে। অত কাছ থেকে। ডান বুকে।

ইতিমধ্যে গুলি করার সঙ্গে সঙ্গে জিপ থেকে গ্রে-হাউণ্ড চেঁচিয়ে উঠল, উণ্ডেড ভালুক। ডেঞ্জারাস! ডেঞ্জারাস! পালাও। পালাও। ড্রাইভার তেজ চলো। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জিপ এগিয়ে গেল। দেখলাম নাম্বার প্লেটের ওপর কাদা লেপা দেওয়া হয়েছে।

যত তাড়াতাড়ি পারি রাইফেল তুলে জিপের টায়ার লক্ষ্য করে গুলি করলাম। কিন্তু বুঝলাম গুলি লাগল না। কারণ জিপটা চলতেই থাকল। কেবল মেয়েটির চিৎকার শুনতে পেলাম। ‘ডাকাত! ডাকাত! জোরে, জোরে চলো!’

মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু শেষ হয়ে গেল।

গুরবার মুখের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলাম, মংলুর কুকুরের মতো ওর জিভটাও বেরিয়ে এসেছে। দাঁতে জিভটা কামড়ে আছে। কুচকুচে কালো লোমে ভরা বুকে গরম ঘন রক্ত থকথক করছে।

মানুষের রক্তে শম্বরের রক্তের চেয়েও বেশি বদবু আগে জানিনি।

এখন কী হবে জানি না, আমি কী করব জানি না। মংলু কখন গাঁ থেকে ফিরবে জানি না। তারপর পুলিশ আসবে, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কর্তারা আসবে। আমরাও চোরাশিকারি, ওরাও তাই। ওরা মানুষ মেরে পালিয়ে গেল, ওদের কিছু হবে না। আমাদের শম্বর মেরে জেল হবে! কিন্তু হবে। কেউ বাঁচাতে পারবে না।

আমার সেই মনে হল গুরবা মানুষ না হয়ে যদি সত্যি ভালুক হত তাহলে ভালো হত।

শম্বরের মতো ওর চামড়া ছাড়িয়ে ওকে টুকরো টুকরো করে টাঙ্গি দিয়ে কেটে কাল দুপুরের আগে শকুন দিয়ে খাইয়ে দিতাম নিশ্চিহ্ন করে। কিন্তু তা হওয়ার নয়। প্রত্যেক মানুষেরই ঠিকানা আছে, অতীত আছে। মরে গেলেও তাকে সেই ঠিকানায় ফিরে যেতে হবেই।

গুরবার তপ্ত রক্তের গন্ধের সঙ্গে পুটুসের উদগ্র গন্ধ মিশে গেল! কোথা থেকে একটি টিটি পাখি এসে ‘টিটিরটি—টিটিরটি—টিটিরটি’ করে মাথার ওপর চক্কর মেরে বেড়াতে লাগল।

গুরবা পালসা শিকার বড়ো ভালোবাসত। হাঁটতে ভালোবাসত। সেই নিস্তব্ধ ভূতুড়ে রাতে টিটিপাখির ডাকে আমার মনে হল যে, হাজার জন্ম ভিজেরাতের খুশবুতে দিলখুশ করার জন্যে, তার মুন্নির উষ্ণ, বাদামি, আসকল পাখির মতো বুক, মুঠি ভরে ধরবার জন্যে, এই বনে বনে পালসা খেলার জন্যে গুরবা আবার আসবে, আসবে, আসবে। বারে বারে, ফিরে ফিরে আসবেই জন্মজন্মান্তরে সে তার ভালোবাসার বনে বনে পালসা খেলে বেড়াতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *