চুনাওট এবং ইতোয়ারিন

চুনাওট এবং ইতোয়ারিন

ইতোয়ারিনকে দূর থেকে দেখতে পেয়েই খুব জোরে দৌড়ে যাচ্ছিল উদবিগ্ন মুঙ্গলি। তার মোটা সস্তা নোংরা লাল শাড়িটা ফুলে ফুলে উঠছিল জোলো হাওয়ায়। কালো মেঘে আকাশ আদিগন্ত ঢেকে ছিল। জুগগি পাহাড়ের ওপার থেকে বৃষ্টি-ভেজা হাওয়া ছুটে আসছিল দমকে দমকে দূরাগত বৃষ্টির ছাট বয়ে। একঝাঁক সাদা বক দূরের হোন্দা বাঁধের জলা থেকে উড়ে আসছিল সাদা কুন্দ ফুলের মালারই মতো দুলতে দুলতে।

এখানেও বৃষ্টি আসছে। মোরব্বা খেতের মধ্যে মাথা উঁচিয়ে পাটকিলেরঙা একটা ধাড়ি খরগোশ দ্রুত দৌড়ে গেল মুঙ্গলির পায়ে পায়ে। ভিজে হাওয়ায়, নিমের ফুলের গন্ধ ভাসছে। একটা মস্ত গহুমন সাপ ধীরে ধীরে ঢুকে গেল উইঢিবির পাশের ইঁদুরের গর্তে। একবার নাক তুলে গন্ধ নিল ষোড়শী মুঙ্গলি জোলো হাওয়ায়। নিম ফলের, খরগোশের এবং সাপের।

সুরাতিয়া দিদিদের ক্ষেত্রে বেড়ার এপাশের কদমবনে কদম ফুল ভরে রয়েছে। তার গন্ধও ছিল হাওয়াতে। নানারকম মিশ্র গন্ধ। ঝিম ধরে আসে তাতে।

একদিন ওই কদমবনের নীচে মুঙ্গলি কাড়ুয়া চাচার ব্যাটা পুনোয়ার সঙ্গে রাধা-কৃষ্ণ খেলেছিল গত বছরের আগের বছর। হঠাৎই মনে পড়ে গেল ওর। এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজাতে গিয়ে পুনোয়া পড়ে যাচ্ছিল বার বার। আর মুঙ্গলির কী হাসি!

সেই পুনোয়া গত বছর এমনই এক বর্ষার দিনে জুগগি পাহাড়ে মূল কুড়োতে গিয়ে গহুমন সাপের কামড়ে মারা গেছিল। মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়েছিল। নীল হয়ে গেছিল সারাশরীর। মনে পড়তেই, মনটা খারাপ হয়ে গেল মুঙ্গলির। ওদের জীবন এবং মরণ এমনই! কোনো জোয়ার-ভাটা নেই। মানুষ-মানুষীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গই আছে শুধু। একচল্লিশ বছর দেশ স্বাধীন হয়েছে অথচ দেশের অধিকাংশ মানুষই এই মুঙ্গলিদের মানুষের মর্যাদা দিল না।

অনেকদিন আসে না মুঙ্গলি এদিকটাতে। এই অবাধ্য অসভ্য ইতোয়ারিনটাই তাকে ছুটিয়ে নিয়ে এল ভুল করে, ভুল পথে; আজ এই ভেজা দুপুরে। এদিকে এলেই পুনোয়ার কথা মনে পড়ে যায়। আর মন খারাপ করে।

পিচের রাস্তা ধরে নিপাসিরা থেকে খুব জোরে পর পর তিন-চারটে ট্রাক ও একটা বাস সারি বেঁধে দৌড়ে আসছিল। ইতোয়ারিন তো কিছুই বোঝে না। বুদ্ধু একটা। যদি চাপা পড়ে মরে! সেই ভয়েই দিগবিদিক-জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চলেছে মুঙ্গলি। তার আঁচল এই দৌড়ে সরে যাওয়াতে তার নবীন পেলব মসৃণ স্তন দুটির বৃন্তে ভিজে হাওয়া সুড়সুড়ি দিচ্ছে। কিন্তু শাড়ি সামলাবার সময়ও আর নেই। ট্রাকগুলো আর বাসটা এসে পড়ল বলে! ইতোয়ারিনও উদোম টাঁড়টা পেরিয়ে গিয়ে প্রায় পিচ রাস্তায় ওঠার মুখে। সর্বনাশ হবে এখুনি।

প্রথম ট্রাকটার নীচে প্রায় পড়ে-পড়ে ইতোয়ারিন, ঠিক এমনই সময়ে রাস্তার পাশের চাপ চাপ নরম সবুজ ঘাসের ঢাল-এর মধ্যে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েই জাপটে ধরল ইতোয়ারিনকে। তারপর দু-জনে মিলে জড়ামড়ি করে গড়াতে গড়াতে ঢাল গড়িয়ে নেমে এল উদোম টাঁড়ে। হাঁটু গেড়ে বসে ইতোয়ারিনকে তার দু-ঊরুর মধ্যে চেপে ধরে দু-হাতে ওর দু-কান ধরে আচ্ছা করে মুলে দিয়ে বলল, ট্রাকোয়াকা নীচে যা কর অ্যাইসেহি এক রোজ মরেগি তু!

ইতোয়ারিন ঘুচুক ঘুচুক, ঘোঁৎঘোঁৎ করে আওয়াজ করল মুঙ্গলির কথার জবাবে। সোহাগ জানাল। মাদি শুয়োরের সোহাগের রকমই আলাদা।

বেলুনের মতো পটাং করে ফেটে যাবি একদিন, তা বলে দিলাম।

আবার স্বগতোক্তি করল মুঙ্গলি। রাগের ও অনুযোগের গলায়।

কোনো উত্তর না দিয়ে ইতোয়ারিন ওর হেঁড়ে মাথাটা মুঙ্গলির ঊরুতে শুধু একবার ঘষে দিল আদরে।

মুঙ্গলি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল হঠ।

বলে, বস্তির দিকে রওয়ানা হল। ইতোয়িরান চলতে লাগল ওর পায়ে পায়ে। বড়ো রাস্তা থেকে একটু ডান দিকেই লালমাটির কর্দমাক্ত কাঁচা রাস্তা বেয়ে কিছুটা গেলেই ভাঙ্গি বস্তি। মানে, ধাঙড়দের বস্তি। বস্তির লাগোয়া একটি তালাও। বর্ষার জল পেয়ে তিন ধার থেকে লালমাটি ধুয়ে এসে পড়েছে সেই তালাওতে। বছরের এই সময়টাতে যেই চান করুক সেখানে, মানুষ অথবা শুয়োর; তার গায়ের রং লাল হয়ে যায়। এই তালাওটিই ভাঙ্গি বস্তির প্রাণ।

তালাওর তিনপাশে জলের ওপরে ঝুঁকে পড়েছে ঝাঁটি জঙ্গল এবং পুটুসের ঝাড়। কটুগন্ধ গাঢ় কমলারঙা ফুল এসেছে পুটুসের ঝাড়ে ঝাড়ে। পাড়টা উঠে গেছে তিন দিকে, উঁচু হয়ে। তারপর জুগগি পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে মিশেছে সেই চড়াই।

একসময়ে ঘন শালের বন ছিল এই চড়াইয়ে। সে-বন গিয়ে মিশে গেছিল জুগগি পাহাড়ের বনের সঙ্গে। ওঁরাও মুণ্ডারা তখনকার দিনে জেঠশিকারের পরবে ভালুক কুটরা অথবা হরিণ শিকার করত। কখনো কখনো শিয়াল, সাপ অথবা খরগোশও। মুঙ্গলি তখন শিশু ছিল। তবু স্পষ্ট মনে আছে।

জঙ্গল এখন আর নেই। কেটে সব সাফ করে দিয়েছে ঠিকাদারেরা। ভাঙ্গি বস্তির কাছের দুই বস্তির লোকেরাও বাড়ি বানাবার জন্যে, জ্বালানি কাঠের জন্যে। মুঙ্গলিরা নিজেরাও কেটেছে কিছু। এখন কিছু বুনো পলাশ, যাদের প্রাণশক্তি আর বাড় এই ভাঙ্গি বস্তির শুয়োরদেরই মতো; ঝাঁটি জঙ্গল এবং পুটুসই শুধু আছে।

দু-একটি খরগোশ, বুড়ো শুয়োর এবং কিছু বটের তিতির ওরই মধ্যে ইতিউতি ঘোরাঘুরি করে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে অথবা বৃষ্টির ঠিক পরে এক আশ্চর্য নরম হলুদ আলোয় বনপ্রান্তর ভরে যায় এবং সূর্য পাহাড়ের ওপাশে ডুবে যাওয়ার ক্ষণটিতে, মাথা তুলে, গলার শির ঝুলিয়ে বার বার ডেকে তারা জানান দেয় যে, তারা এখনও আছে।

বড়ো রাস্তাটা পিচের। মাঝে মাঝেই গড়হির অথবা নিপাসিরার দিকে মার্সিডিস ট্রাক এবং সার্ভিসের বাস চলে যায় জেঠশিকারির তির-খাওয়া বড়কা দাঁতাল-শুয়োরের মতো প্রচন্ড জোরে গোঁ-গোঁ শব্দ করতে করতে।

রাস্তাটা ব্রিটিশদের আমলে বানানো। তখন অবশ্য পিচ ছিল না। লালমাটির রাস্তাই ছিল। কিন্তু পোক্ত ছিল। বর্ষায় ভাঙত না। চুরি হত না তখন সরকারি কাজে। মুঙ্গলি শুনেছিল, তার নানার কাছে।

রাস্তাটার দু-পাশে বড়ো বড়ো অনেক প্রাচীন গাছ ছিল। মেহগনি, শিশু, নানারকম কেসিয়া। কিছু জ্যাকারাণ্ডাও। সাহেবরাই লাগিয়ে গেছিল।

শুধু আশপাশের বনের পাহাড়ের গাছ কেটেই মানুষের খিদে মেটেনি। এখন পথপাশের বড়ো বড়ো গাছগুলোর গা থেকে পুরু ছালও তারা তুলে নিচ্ছে। তাই দিয়ে ফুলবাগ শহর আর গড়হির আর নিপাসিরা বাজারের হালুইকরেরা উনুন ধরায়। মানুষের মতো আগ্রাসী খিদে খুব কম জানোয়ারেরই আছে। শুয়োরের খিদেও হার মানে এই খিদের কাছে।

কোনোরকম বাছবিচার না করে শুয়োরগুলো সবকিছুই খায়। মানুষের ময়লা থেকে, যা-কিছুই মাটি কুড়িয়ে পায়। আর ওদের অন্য কাজ বংশবৃদ্ধি করা। রাক্ষসের মতো সর্বক্ষণ খাওয়া আর রমণ করাই হল শুয়োরদের একমাত্র কাজ।

বড়োরাস্তার বাঁ-দিকে মুসলমানদের মস্ত বস্তি আছে একটি। মাইল খানেক দূরে। ডান দিকেও আর একটি আছে। গিরিয়া পাহাড়ের নীচে।

ভাঙ্গি বস্তি থেকে পিচরাস্তায় উঠলেই কয়েকটি দোকান। একটি পুরোনো পিপ্পল গাছের নীচে দোকানগুলো গজিয়ে উঠেছে। একটি মুদিখানা, পানবিড়ির দোকান; একটি চায়ের দোকান। তার সামনে শালকাঠের তক্তা দিয়ে খুঁটি পুঁতে বেঞ্চিমতো বানানো। বৃষ্টিতে, রোদে ফেটে-ফুটে গেছে। তার ওপরে চা খেতে খেতে আড্ডা মারে ভাঙ্গি বস্তির মানুষে এবং ওই দুই বস্তির মানুষেও।

ওই দোকানগুলোরই উলটোদিকে টাঁড়ের মধ্যে দিয়ে লালমাটির পায়ে-চলা পথ চলে গেছে এঁকেবেঁকে। সেখানে কাহারদের বস্তি আছে। এই পিপ্পল গাছের উলটোদিকে কাহার বস্তিতে যাওয়ার পথেই শুক্কুরবারে শুক্কুরবারে হাট বসে। হাটের নাম জুগগি হাট। শুঁড়িখানা আছে। হাটের দিনে ঢালাও মহুয়া খায় মুঙ্গলিদের বস্তির সকলে শালপাতার দোনায়। সারা সপ্তাহের রোজগার ওখানেই চলে যায়।

আগে হাট বসত রবিবারে রবিবারে। তবে শুক্কুরবারে ‘জুম্মাবার’ বলে এবং এই এলাকা মুসলমানপ্রধান বলে গরিষ্ঠদের সুবিধার জন্যে রবিবারের বদলে আজকাল শুক্কুরবারেই হাট বসে। পঞ্চায়েত তাই ঠিক করে দিয়েছে।

ভাঙ্গি বস্তির ভগলু আর ফুলবাগের দিকের মুসলমান বস্তির গিয়াসুদ্দিনের বয়স হয়েছে প্রায় সত্তরের মতো। দু-জনেই ব্রিটিশের হয়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে লড়াই করেছিল। গিয়াসুদ্দিন লড়াই করেছিল বার্মাতে আর ভগলু মধ্যপ্রাচ্যে। যদিও তারা আলাদা আলাদা রেজিমেন্টে ছিল কিন্তু এখন অভিন্ন হৃদয়বন্ধু হয়ে গেছে। যুদ্ধে যখন যোগ দেয় তখন দু-জনেই কিছুদিন একসঙ্গে ছিল রানিখেত ক্যান্টনমেন্টে। শিকারের দোস্তি, যুদ্ধের দোস্তি, একবার হলে জীবনভর তা অটুটই থাকে।

চায়ের দোকানের আড্ডাতে বীরহানগরের প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারও সাইকেল নিয়ে আসে। থাকে বীরহানগরেই। ফুলবাগের পথে। এখান থেকে প্রায় পাঁচ মাইল পথ। বয়স হবে মাস্টারের কুড়ি-একুশ। সবে বি.এ. পাশ করেছে। অনেক খবরাখবর রাখে সে। চেহারাটিও ভারি সুন্দর। জাতে সে ভূমিহার। কিন্তু তার স্বভাবের জন্যে এ অঞ্চলের মুসলমান, ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, চামার, ভোগতা, কোলহো, ওঁরাও, মুণ্ডা সকলে ভালোবাসে তাকে। মুঙ্গলিও ভালোবাসে। মাস্টারকে দেখলেই মুঙ্গলির বুকটা ধক ধক করে ওঠে। সারাশরীরে একটা অনামা ব্যাখ্যাহীন রিকিঝিকি ওঠে। এমনি আর কাউকে দেখলেই হয় না। তেমন রিকিঝিকির কথা শুধু মুঙ্গলির বয়সি মেয়েরাই জানে।

সেদিন বিকেল বেলা বীরহানগরের নবীন মাস্টার, নাম তার সরজু, প্রবীণ ভগলু আর গিয়াসুদ্দিনের সঙ্গে বসে চায়ের দোকানের সামনে আড্ডা মারছিল। দুপুরে খুব বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর এখন আকাশ পরিষ্কার। সন্ধে হতে দেরি আছে এখনও ঘণ্টা খানেক। মাস্টার নবীন বলেই এমন অনেক কিছুর খোঁজ রাখে, যা প্রবীণেরা আদৌ জানে না। আবার এই দুই প্রবীণ তাদের অভিজ্ঞতার ভাঁড়ারে এত কিছুই জমিয়ে রেখেছে যে, নবীন মাস্টার হাঁ করে তাদের কথা শোনে। যৌবনের বিকল্প বার্ধক্য নয়। বার্ধক্যের বিকল্পও নয় যৌবন। যাদের শেখার ইচ্ছা ও মন আছে তারা একে অন্যের কাছে অনেকই শিখতে পারে।

সকলেই এক ভাঁড় করে চা খাওয়ার পর ভগলু বুড়ো গিয়াসুদ্দিন বুড়োকে বিড়ি এগিয়ে দিয়ে বলে, বোলো ইয়ার।

দুই

ইতোয়ারিন মুঙ্গলির বড়ো আদারের মাদি শুয়োর। রবিবারে জন্মেছিল তাই তার নাম দিয়েছিল মুঙ্গলি ইতোয়ারিন। ইতোয়ারিনের চার ভাই-বোন ছিল। তারা সবাই বিক্রি হয়ে গেছে জুগগির হাটে। এইবার পাল খাওয়াবে মুঙ্গলি ইতোয়ারিনকে। এক পাল বাচ্চা। সম্পত্তি বাড়বে মুঙ্গলির। বাচ্চগুলোকে বেচে দেবে জুগগির হাটিয়াতে, কিন্তু ইতোয়ারিনকে বেচবে না।

মুঙ্গলি রোজ দিনশেষের আবছা অন্ধকারে নিজে যখন তালাওতে চান করতে নামে, তখন ইতোয়ারিনকেও চান করায় নিজের হাতে। জলে নেমেই আশ্চর্য কায়দাতে সাঁতার কেটে তালাওর গভীরে চলে যায় ইতোয়ারিন। মুঙ্গলিও সাঁতরে গিয়ে তার পিঠে চড়ে। দুই অরমিতা কুমারীর এই এক খেলা। একজন নারী। একজন শুয়োরি। শুয়োরি হলেও ইতোয়ারিনকে সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে মুঙ্গলি। পোষাপাখির মতো। তারপর রাতে কাঁচামাটির সোঁদা-গন্ধ ঘরে ইতোয়ারিনকে কোলবালিশ করে মুঙ্গলি শুয়ে থাকে। মুঙ্গলির বাবা ঝড়ু, ওকে বকে খুব। কিন্তু শেষমেশ থেমে যায়। মা-মরা মেয়ে। তা ছাড়া মুঙ্গলিও-বা আর কতদিন থাকবে ঝড়ুর কাছে? মেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে। আগেকার দিন হলে তো আট-নবছরেই বিয়ে হত। তারপর গওনা হলে শ্বশুরবাড়ি যেত। দিন পালটে গেছে। প্রতিদিনই পালটাচ্ছে দিন। তবু এবারে তার বিয়ে-থার কথা ভাবতে হবে। ভাবে ঝড়ু।

মুঙ্গলিও কানাঘুষোয় এসব কথা শোনে। গা-শিরশর করে বিয়ের কথায়, অনামা ভালো লাগায়। জীবনের এখনও অনেকই বাকি আছে। অনেক ভালো লাগা বাকি আছে এখনও। দারিদ্র্যই শেষকথা নয়। দরিদ্রদেরও বড়োলোকি থাকে। এসব কথা শুনে মুঙ্গলির কেবলই সরজু মাস্টারের কথা মনে হয়। ওর বিয়ের কথা তাই উঠলে মনখারাপও লাগে। সরজুকেও তো মুঙ্গলি কোনোদিনও পাবে না।

মাইল সাতেক দূরে শহরের ফুলবাগ মিউনিসিপ্যালিটির জমাদার মতির ছেলেকে ঝড়ুর পছন্দ। মতি, ঝড়ুর বন্ধুও বটে। অনেকদিনেরই বন্ধু। মতির ছেলে জগনু, এবছরই মতি রিটায়ার করলে মতির জায়গায় চাকরি পাবে। কাজটা যদিও বাজে। এখনও খাটাপায়খানা আছে অনেকই ফুলবাগ শহরে। নামেই শহর। ব্রিটিশদের সময়ে যেমন ছিল তা থেকেও অনেক ঘনবসতিপূর্ণ এবং নোংরা হয়ে গেছে। উন্নতি কিছুই হয়নি। অবনতিই হয়েছে। তবু ঝড়ু ভাবে, মরদের কাজের আবার খারাপ-ভালো কী? যার যা কাজ। নিজেকে বোঝায় ওইসব বলে। তা ছাড়া ক-জন মানুষই-বা কাজ পায়? পাঁচ বছর বাদ বাদ ভোটের আগের বক্তৃতা তো অনেকই শুনল। লাশকাটা ঘরের ডোমেদের কাজের থেকে তো এ কাজ অনেকগুণই ভালো। সারাদিন খাটাখাটুনি করে দু-টি মকাই বা বজরার রুটি আর হিং দেওয়া খেসারির ডাল গরম গরম খেতে যদি পায় মুঙ্গলির ভাবী স্বামী এবং মুঙ্গলি, তাই তো অনেক পাওয়া। বেশি লোভ নেই ঝড়ুর। তার মেয়ে মুঙ্গলি যে রাজরানি হবে এমন আশা করে না সে।

তিন

দুপুর বেলা।

এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে।

মাটি থেকে সোঁদা সোঁদা গন্ধ উঠছে।

মুঙ্গলি ইতোয়ারিনকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে ইদগার দিকে চলে গেছিল। সারাবছর এই পুরো অঞ্চলটা ফাঁকাই পড়ে থাকে। দুই সম্প্রদায়েরই ভিখিরি, নেশা-ভাং করনেওয়ালারা হিন্দু এবং মুসলমানদের ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়ে, গোরু, ছাগল চরে বেড়ায়। তবে শিশুকাল থেকে মুঙ্গলি দেখে আসছে যে ইদের আগে ও জায়গাটার চেহারাই যেন পালটে যায়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়। ঝাঁট দেওয়া হয়। সাজানোও হয়। সাদা চাদর পাতা হয় তিনদিকে দেওয়াল-ঘেরা জায়গাতে। ইমাম সাহেব অথবা মোল্লা সাহেবের জন্যে উঁচু পাটাতন বাঁধা হয়। ভাঙ্গি বস্তির ডান দিক বাঁ-দিকের দুটি গাঁয়ের মুসলমানেরা নতুন জামা পরে টুপি মাথায় চড়িয়ে ইদের নামাজ পড়তে আসে ইদগাতে।

যখন ছোটো ছিল, একবার মুঙ্গলি তার বাবা ঝড়ুর সঙ্গে অনেকদিন আগে এসে বাবার হাত ধরে বড়ো রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখেছিল ইদের নামাজ পড়া। বড়ো হওয়ার পর আর এদিকে আসে না ইদের দিনে। বস্তির বড়ো মেয়েরা বারণ করে দিয়েছে। কোনো মেয়েরাই আসে না হিন্দু বস্তির। মুসলমান মেয়েরাও আসে না। ওদের ধর্মে মেয়েদের অন্যরকম চোখে দেখা হয়।

প্রতিবছরই ইদের দিনে সন্ধেবেলায় গিয়াসুদ্দিন—নানা টিফিন-ক্যারিয়ারে করে বিরিয়ানি-পোলাও, মুরগির চাপ আর ফিরনি নিয়ে আসে তার বন্ধু ভগলু নানার জন্যে। জাফরান দেওয়া বিরিয়ানির স্বাদ প্রতিবছরই পেয়ে আসছে মুঙ্গলি আর ঝড়ু, ভগলু নানার দয়ায়। বড়ো সোহাগভরে চেটেপুটে খায় ঝড়ু, ভগলু নানা আর ও। গিয়াসুদ্দিন নানাও ওদের আনন্দ দেখে খুশি হয় খুব। বিরিয়ানিতে যে জাফরান দেয় তা নাকি আসে কাশ্মীরের উপত্যকা থেকে।

ইদগার ওপাশে একটি ছোটো মসজিদ আছে। মোল্লা রামজান হাজি থাকেন সেখানে। প্রতিদিন কাক ডাকারও আগে মসজিদে নামাজ পড়েন রমজান হাজি। তারপর দিনে-রাতে, বিভিন্ন প্রহরে। ওদের নামাজের ভাষা বোঝে না মুঙ্গলি অথবা মুঙ্গলিদের বস্তির অন্য কেউই। ভাষাটা উর্দু বোধ হয় নয়। হিন্দুস্থানের ভাষা নয়। গিয়াসুদ্দিন চাচারাও পুরো বোঝে কি না তা জানে না। তবে শুনতে বেশ লাগে। আল্লার প্রশংসা থাকে কি সেইসব নামাজে? কে জানে? ইদানীং মসজিদের সবদিকে লাউডস্পিকারও লেগেছে। ফুলবাগ, নিপাসিয়া, গড়হি সব জায়গার মসজিদেই। আজানের সময় বহু দূর দূর থেকে শোনা যায় তা মাইকের জন্যে। জুগগি পাহাড়ের পাদদেশে ধাক্কা মেরে আওয়াজ হা-হা করে ফিরে আসে।

পিপ্পল গাছের নীচের চায়ের দোকানে সেদিনও আড্ডা হচ্ছিল। গিয়াসুদ্দিন চাচা আসেনি সেদিন। সরজু মাস্টার বলল, বুঝলে ভগলু নানা, শোনা যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের পয়সাওয়ালা সব দেশ থেকে নাকি প্রচুর টাকা আসছে ভারতবর্ষে। আরবদের স্বপ্ন নাকি সমস্ত পৃথিবীকেই একটিমাত্র ইসলামিক রাষ্ট্র করে তোলা। প্লেন যারা ছিনতাই করল সেদিন সেই গেরিলারা বলেছিল না!

পাকিস্তান কি এই অঢেল টাকার লোভেই ইসলামিক রাষ্ট্র হয়ে গেল? বাংলাদেশও কি তাই হবে?

ব্যাপারটা ভালো নয়। বলল, ভগলু নানা।

ভারতবর্ষকেও ইসলামিক রাষ্ট্র করে তোলার চক্রান্ত চলছে চারদিকে। বিদেশি রাষ্ট্রদের মদত তো আছেই। চোখ-কান খুলে না রাখলে একদিন বড়োই বিপদ হবে।

সরজু মাস্টার বলল।

তা কেন হবে। আর হবেই-বা কী করে? ভগলু চাচা বলেছিল অবিশ্বাসের গলায়। হিন্দুস্থানের মধ্যেই পাকিস্তান হবে?

মুঙ্গলির বাবা ঝড়ুও সেদিন চা খেতে গেছিল। তাই জিজ্ঞেসও করেছিল ভগলু নানাকে। ঝড়ু, গাঁওয়ার সোজা লোক। লেখাপড়াও জানে না ও, নিজেই বলল ধ্যাত। তাও কখনো হয়! যেমন এখন আছি সকলে মিলেমিশে তেমনই থাকব চিরদিন।

সরজু মাস্টার বলেছিল, সবই হতে পারে।

ছোকরা সরজু মাস্টারের কথাটা কারওরই ভালো লাগেনি।

চার

ইদগার চারপাশে বড়ো বড়ো গাছ। বেশিই তেঁতুল। পথের পাশে পিপ্পল ছাড়াও একটা বড়ো নিম গাছ আছে। কিন্তু ইদের নামাজ, গিয়াসুদ্দিন চাচারা কখনোই ছায়াতে পড়ে না। যেখানে একটুও ছায়া পড়ে না সেখানেই সার সার করে হাঁটু গেড়ে বসে সকলে নামাজ পড়ে। সাদা নতুন কাপড় বিছিয়ে নেয় নীচে।

নামাজ পড়তে কিন্তু হিন্দুদের পুজো-টুজোর মতো আদৌ সময় লাগে না বেশি। নামাজের তিনটি ভাগ আছে। মুঙ্গলি তো শুনেছেই, দেখেওছে দূর থেকে শিশুকালে। বড়ো বড়ো জায়গাতে ইমাম এবং ছোটো ছোটো জায়গাতে মোল্লা সাহেব কোরান থেকে কিছু পড়ে শোনান। তাকে বলে ‘খুটবা’। প্রত্যেকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা-সহকারে তা শোনেন। তাতে মিনিট পাঁচেক সময় যায় বড়োজোর। তারপরেই সকলে একসঙ্গে দু-হাত তুলে ‘দুয়া’ মাঙ্গেন। এক মিনিট কী দু-মিনিট! তারপর নামাজ শেষ হয়ে যায়।

তারপর হিন্দুদের দশেরার মতো প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। এই বিরাদরি দারুণই ভালো। হাসিমুখে একে অন্যকে বলে ‘ইদ মুবারক’। প্রত্যেকের বাড়িতেই সেদিন ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত থাকে। যার যেমন অবস্থা। কানে থাকে তুলোয়-মাখানো আতর।

মেয়েরা কেউই আসে না নামাজে। মেয়েরা সব কিছু থেকেই বাদ। এইটা ভেবেই ভারি খারাপ লাগে মুঙ্গলির। মুসলমানদের কাছে মেয়েরা মানুষ বলেই গণ্য নয়, নাকি? পর্দা আর বোরখার মধ্যেই থাকে কি আজীবন? দাসীবৃত্তি ছাড়া অন্য কোনো অধিকার কি মেয়েদের নেই? বাইরের পৃথিবী পুরোপুরিই বন্ধ কি ওদের কাছে? বেচারারা! যেহেতু ওই দু-বস্তির বড়োমেয়েরা বাইরে একেবারে আসে না, ওদের সুখ-দুঃখের কথা জানারও উপায় নেই কোনো মুঙ্গলিদের।

মুঙ্গলি ভাবে, ভাগ্যিস মুঙ্গলি ভাঙ্গি ছাড়া অন্য গাঁয়ে জন্মায়নি। জন্মালে ও আত্মহত্যা করত। ওর স্বাধীনতাকে বড়োই ভালোবাসে মুঙ্গলি। প্রাণ গেলেও এই স্বাধীনতা, এই ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ানো, এই বৃষ্টিতে ভেজা, জুগগি পাহাড়ের পায়ের কাছে বসে রোদ পোয়ানো, সেজেগুজে হাটে যাওয়া শুক্কুরবারে শুক্কুরবারে, দুর্গাপুজো দেখতে যাওয়া ফুলবাগ শহরে, ঝুমরিগিলাতে দশেরার মেলাতে গিয়ে গরম জিলাবি খাওয়া আর কাচের চুড়ি কেনা; এসব কিছুকেই ও কখনোই ছাড়বে না।

মেয়েদের পায়ের নীচে দাবিয়ে রেখে পুরুষদের যে ‘বিরাদরি’ তার প্রতি মুঙ্গলির অন্তত কোনো শ্রদ্ধা নেই। কোটি কোটি এমন সব মেয়েদের জন্যে দুঃখে মুঙ্গলির বুক ফেটে জল আসে।

এলোমেলো পায়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানো মুঙ্গলি হঠাৎ চোখ তুলে দেখল আকাশ আবারও কালো করে আসছে।

মুঙ্গলি বলল, ‘চল রে ইতোয়ারিন। ঘর লওট যাব।’

ইতোয়ারিন সায় দিল।

বলল, ঘোঁৎঘোঁৎ!

পাঁচ

আজ ইদ।

ট্রাকে করে বাসে করে, দলে দলে মানুষেরা আসছে দু-দিক থেকে ইদগাতে। অনেকগুলোমাইক লাগানো হয়েছে। পথের পাশে দোকান বসেছে অনেক। মেলার মতো দেখাচ্ছে দূর থেকে পুরো জায়গাটা। দোকানে নানারকম মিষ্টি বিক্রি হচ্ছে। ফল, মোরগা, আণ্ডা, বকরির বাজার বসেছিল গতকাল। গোরু কাটা হয়েছে দু-গ্রামেই। পিঁজরাপোলের গোরু নয়। নধর গোরু।

পুলিশ এসেছে এক ট্রাক। পাছে, নামাজ পড়ার সময়ে নামাজিদের কোনোরকম অসুবিধে হয় তাই। প্রতিবারই আসে নামাজ পড়ার ঘণ্টাখানেক আগে। নামাজ পড়া শেষ হলে আবার ফিরে যায় কোতোয়ালিতে। পথের দোকানে চা, পান খেয়ে চলে যাওয়া তাদের উঁচু গলার গালগল্প চলন্ত ট্রাক থেকে উড়ে আসে ভাঙ্গি বস্তির মানুষদের কানে।

মুঙ্গলির বাবা ঝড়ু সকালেই বলে গেছিল; বাড়িঘর সব পরিষ্কার করে রাখতে। ঝড়ু গেছে এক বোঝা শালপাতার দোনা নিয়ে ফুলবাগ শহরে বেচতে। ভাঙ্গি বস্তি নামেই ভাঙ্গি বস্তি। আজকাল ধাঙড়ের কাজ করে খুব কম মানুষই। সাহেবি ‘সিস্টেম’ ‘কমোড’ হয়ে গিয়ে ধাঙড়দের প্রয়োজন কমে গেছে। শহরের মানুষেরা নিজেরাই বা তাদের বাড়ির কাজের লোকেরাই কমোড পরিষ্কার করে নিতে পারে। অ্যাসিড পাওয়া যায় বোতলে। কমোড পরিষ্কার করার। বাজারে নানারকম ব্রাশ কিনতে পাওয়া যায় লম্বা-বেঁটে হাতলঅলা।

বাড়িঘর পরিষ্কার করতে বলে গেছে বাবা, কারণ কাল নাকি ফুলবাগ শহর থেকে মেহমান আসবে। তার ভাবী শ্বশুর।

শ্বশুর কেন? মুঙ্গলি নিজেকে শুধিয়েছিল। সেই মতি না ফতির ছেলে যে, সে নিজে আসবে না কেন? যার সঙ্গে মুঙ্গলির সারাজীবন দুঃখে-সুখে ঘর করতে হতে পারে তাকে একবার চোখের দেখাও দেখবে না পর্যন্ত নিজের বিয়ের আগে? মুঙ্গলির কি কোনো ইচ্ছে-অনিচ্ছে নেই? বাবা কি তাকেও পরাধীন করে দিল?

আর মাস্টার? সরজু মাস্টার। কত কী জানে শোনে সে! একদিন মাস্টারের সঙ্গে একাই আলাপ করবে মুঙ্গলি। ঠিক করেছে মনে মনে। অনেক কথা বলবে তাকে। পলাশ বনে বসন্তদিনে একা একা চড়াবেলায় ঘুরতে ঘুরতে কী বলবে তার মহড়াও দিয়েছে অনেকবার। কিন্তু বলা হয়নি কোনোদিনও। ধাঙড় বলে কি চিরদিন এই সমাজেই থাকতে হবে মুঙ্গলিকে? ভারি রাগ হয় মুঙ্গলির একথা ভেবেই। মাস্টারের মুখটা কেবলই বার বার মনে আসে। চান করার সময়ে, ঘুম আসবার আগে, স্বপ্নের মধ্যে, বৃষ্টির মধ্যে, জুগগি পাহাড়ের ঢালে ঝাঁটি-জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে কাক-ভেজা ভিজতে ভিজতে।

একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস পড়ে মুঙ্গলির। ও জানে যে এ স্বপ্নও ওর অনেক স্বপ্নরই মতো সত্যি হবে না। মুঙ্গলি এও জানে যে, প্রত্যেক মেয়ের মনের মধ্যে যে-মানুষ থাকে তার সঙ্গে ঘর করার বরাত ভারতের সাধারণ মেয়েদের হয় না। কী হিন্দুর! কী মুসলমানের!

বাবা বলেছে, শুয়োরের মাংস নিয়ে আসবে গামারিয়ার হাট থেকে। আর ছোলার ডাল। আটাও আনবে কলে-পেষা। কাল ভালো করে রাঁধতে হবে মুঙ্গলিকে। ফুলবাগের মতি না ফতি, হবু শ্বশুর না ফসুর; তার জন্যে।

ইতোয়ারিনকে মুঙ্গলি বস্তির অন্য শুয়োরের সঙ্গে কোনোদিনই মিশতে দেয়নি। সে যে তার পোষা প্রাণী। তার সখী। আজেবাজে জিনিসও খেতে দেয় না। ওরা যা খায়, তার থেকেই একটু দেয়। তা ছাড়া, জঙ্গল পাহাড়ে বা টাড়ে এইজন্যেই তো সঙ্গে করে নিয়ে ফেরে রোজই, যাতে ইতোয়ারিন মূল খুঁড়ে খেতে পারে। মহুয়ার সময় মহুয়া, আমলকীর সময়ে আমলকী, আমের সময় জংলি আম।

তেঁতুল একেবারেই খেতে পারে না বেটি। মুখে দিলেই মুখ যা ভ্যাটকায়! হেসে বাঁচে না মুঙ্গলি দেখে।

মোরব্বার দড়ি দিয়ে সামনের খোঁটাতে ইতোয়ারিনকে সকাল থেকে ভালো করে বেঁধে রেখে যত্ন করে উঠোন নিকোচ্ছিল মোষের গোবর দিয়ে মুঙ্গলি। ঠিক সেই সময়ই ইদগা থেকে মাইকগুলো সব একসঙ্গে গমগম করে উঠল। মোল্লা সাহেবের গলা! এ তো ‘খুটবা’ নয়। এ তো বড়ো উত্তেজিত ক্রুদ্ধ গলা। তার উপরে বিজাতীয় ভাষা। মরুভূমির গন্ধ আছে এই ভাষায়। কী ভাষা কে জানে? নামাজের এই অংশকেই তো ‘খুটবা’ বলে। এরপরেই ‘দুয়া’ মাঙ্গার কথা। তারপরই নামাজ শেষ।

মাইকের আওয়াজ গমগম করে চতুর্দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। ‘খুটবা’ শুনতে শুনতেই হঠাৎ মাইকে একটা প্রচন্ড শোরগোল উঠল। সেই শোরগোল, বিরক্ত ক্রুদ্ধ জনরব হয়ে অসংখ্য মাইকের মধ্যে দিয়ে অনেক জোরে ভেসে এল এদিকে।

পাশের ঘরের সুরাতিয়াদিদি চেঁচিয়ে বলল, ‘আররে। এ মুঙ্গলি! ইতনি হল্লাগুল্লা কওন চি কি?’

মুঙ্গলির উঠোন নিকোনোর সামান্যই তখনও বাকি ছিল। তার হাতে গোবর।

বিরক্তির গলায় বলল, ‘সে কওন জানে, কওন চি কি?’

সুরাতিয়া দিদি বোধ হয় ঘরের বাইরে গিয়ে শিমুল গাছটার নীচে কালো পাথরের স্তূপের ওপরে গিয়ে উঠে দাঁড়াল, ব্যাপার কী তা ভালো করে দেখবার জন্যে গলা লম্বা করে। তার গলার অপস্রিয়মাণ আওয়াজেই বুঝল মুঙ্গলি। শিমুলতলিটা উঁচু। ওখান থেকে পিচরাস্তা। মসজিদ আর ইদগা সবই দেখা যায়।

পরক্ষণেই, সুরাতিয়াদিদির আতঙ্কগ্রস্ত চিৎকার শোনা গেল, পুলিশোয়াকে মার দেল হো। পাত্থল ফেকতা হ্যায় ঢেরসা উনলোগোনে সব্বে মিলকর।

কাহে লা?

মুঙ্গলি শুধোল আরও বিরক্তি কিন্তু উদাসীনতারই সঙ্গে, ঘর নিকোনো শেষ করতে করতে।

ঘরের মধ্যে থেকেই শুধাল। সামান্য কাজ তখনও বাকি ছিল।

‘ম্যায় জানু ক্যায়সি?’ উত্তেজিত গলায় সুরাতিয়াদিদি বলল।

এবার গোবর-হাতেই মুঙ্গলি বাইরে এসে শিমুলতলিতে সুরাতিয়াদিদির পাশে দাঁড়াল। দেখল, নামাজিরা ফটাফট পাথর মারছে পুলিশদের। পুলিশদের মধ্যে দু-জন পড়ে গেল। অনেক পুলিশেরই মাথা ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। লাল রক্ত। ফিনকি দিয়ে। তখন একজন পুলিশ রাইফেল ভিড়ের দিকে তুলে গুলি করল। গুড়ুম করে শব্দ হল।

সুরাতিয়া দিদি অত্যন্ত ভীত এবং আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বলল, ‘ভাগ ভাগ। জলদি ঘর ভাগ যা, মুঙ্গলি।’

বলতে বলতেই সুরতিয়াদিদিও দৌড়োতে দৌড়োতে নামল নীচে। মুঙ্গলি কিন্তু তখনও দাঁড়িয়েই ছিল। পুলিশের সঙ্গে জনতার মারামারি কখনো দেখেনি আগে।

ততক্ষণে বস্তির মেয়েদের মধ্যে কান্নাকাটি পড়ে গেছে। মরদরা কেউই নেই এখন বস্তিতে। একমাত্র বুড়ো রিটায়ার্ড বউ-মরা নি:সন্তান ফৌজি ভগলু নানা তার ঘরের সামনে মাটির দাওয়াতে বসে তখন দাড়ি কামাচ্ছিল মুখের সামনে আয়না ধরে। সেও গুলির শব্দ শুনে দৌড়ে এসে মুঙ্গলির পাশে দাঁড়াল।

এমন সময় হঠাৎ মুঙ্গলি দেখল, ইতোয়ারিন ওই ভিড়ের মধ্যে থেকে ভীষণ ভয় পেয়ে দৌড়ে আসছে লাফাতে লাফাতে ভাঙ্গি বস্তির দিকে। ইতোয়ারিন যে কখন মোরব্বার দড়ি ছিঁড়ে ওদিকে চলে গেছিল, টেরই পায়নি মুঙ্গলি। অন্যেও না। ইদের নামাজের জন্যে অনেকই দোকানপাট বসেছিল ওখানে আজ। কিন্তু দড়িটা ছিঁড়েই-বা গেল কীকরে? মোরব্বা, মানে সিসাল-এর দড়ি।

মুঙ্গলি ভাবল, সাধে কি আর মুসলমানেরা শুয়োরকে হারাম বলে। শুধু হারামই নয়, ইতোয়ারিন একটি নিমকহারামও বটে। এত তাকে যত্ন করে রাখে তবুও খাবার লোভে গেল! হারামজাদি!

জলদি আ। জলদি আ। আ। আজ তোর টেংরি তোড়ব।

চরম বিরক্তিতে চেঁচিয়ে উঠল ক্রুদ্ধ হতচকিত মুঙ্গলি। যদি পুলিশের গুলি বা পাথর লাগে ইতোয়ারিনের গায়ে, এই ভয়ে ও সিঁটিয়ে ছিল।

টেংরি ভাঙার ভয়ের চেয়েও রাইফেলের গুলির শব্দে অনেক বেশি ভয় পেয়ে ইতোয়ারিন প্রাণপণে থপ থপ করে দৌড়ে আসছিল। পুলিশদের ওপরে শয়ে শয়ে পাথর পড়ছিল তখন। নামাজ বন্ধ হয়ে গেছিল। এবারে আবারও গুলির শব্দ হল পর পর কয়েকবার। পাথরবৃষ্টির মধ্যে প্রাণ বাঁচাবার জন্যে গুলি করছে পুলিশরা।

ইতোয়ারিন বস্তিতে না পৌঁছোনো অবধি মুঙ্গলি অপেক্ষা করছিল। এমন সময় নামাজিদের ভিড়ের মধ্যে থেকে কয়েক-জন আঙুল তুলে দেখাল ইতোয়ারিন আর মুঙ্গলির দিকে। এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই একদল মানুষ পাগলের মতো দৌড়ে এল ইতোয়ারিনের পিছু পিছু।

এক গালের দাড়ি কামানো, অন্য গালে সাবান নিয়ে ভগলু নানা আতঙ্কগ্রস্ত গলায় বলল, ‘ভাগ বেটি। ভাগ যা সব্বে বস্তি ছোড়কর। তুরন্ত। ভাগ সুরাতিয়া। ভাগ মুঙ্গলি। সব্বে ভাগ।’

কিন্তু অত তাড়াতাড়ি কি পালানো যায়?

যৎসামান্য সম্বল, তা সে যত সামান্যই হোক-না কেন, তা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া অত সোজা নয়। মেয়েদের পক্ষে তো নয়ই। মুঙ্গলি প্রথমে নিজেদের ঘরের দিকে দৌড়ে এল। কিন্তু নিজেদের ঘরে ঢুকতে-না-ঢুকতেই একটি তীব্র আর্তচিৎকার শুনল ভগলু নানার। কী হল দেখতে না পারলেও বুঝল যে, সাংঘাতিক কিছু ঘটে গেল। পরক্ষণেই রে-রে-রে করে শয়ে শয়ে নামাজিরা ভাঙ্গি বস্তির ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ল। পালাতে মেয়েরা একজনও পারল না।

মুঙ্গলির ওপরে অনেকগুলো দাড়ি-গোঁফঅলা পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ-ভরা রাগি, কামার্ত, কুৎসিত মুখ নেমে এল। নেমে এল অনেকগুলো হাত ওর সারাশরীরের আনাচে-কানাচে। সরজু মাস্টারের মুখটা হঠাৎ ভেসে উঠল একবার এক ঝলক চোখের সামনে। তারপর মুহূর্তেই তার শাড়িখানি ফালাফালা করে ছিঁড়ে তাকে মাটির মেঝেতে চিত করে শুইয়ে ফেলল মানুষগুলো।

সুরাতিয়াদিদি তীব্র চিৎকার করে ককিয়ে কেঁদে উঠল। বলল, হায় রাম!

সুরাতিয়াদিদির বয়স হবে তিরিশ। ছেলে-মেয়ে নেই কোনো। প্রতিঘর থেকেই বিভিন্নবয়সি নারীর আর্তচিৎকারে পুরো বস্তি খানখান হয়ে গেল। তালাও-এর জল ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। বাইরে থেকে শিশুর আর্তনাদ।

তীব্র, তীক্ষ্ণ যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে যেতে যেতে মুঙ্গলি শুনল একজন নামাজি ওকে বলছে, ‘হারাম ভেজিন থি নামাজ মে? শালি! হারামজাদি!’

দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে-যাওয়া একটি অবলা অবোধ যুবতী শুয়োরি ইতোয়ারিনের ওপরেই যে একটি বিশ্বব্যাপী-ব্যাপ্ত প্রাচীন ধর্মের পুরো সম্মান নির্ভরশীল ছিল, এই জটিল এবং অবিশ্বাস্য কথাটা মুঙ্গলির মোটা মাথায় কিছুতেই ঢুকছিল না।

হতভম্ব, স্তব্ধ হয়ে গেছিল ও।

ছয়

জ্ঞান যখন ফিরল মুঙ্গলির, তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। রাত নেমে এসেছে। তার বাবা তখনও ফেরেনি। বস্তির অন্য পুরুষেরা যদিও ফিরে এসেছে। বস্তির বেশিরভাগ ঘরই আগুনে পুড়ে গেছে। মুঙ্গলিদের ঘরও। তার ভাবী শ্বশুর না ফসুর, মতি না ফতির আসা হল না।

চোখ মেলে দেখল মুঙ্গলি যে, জুগগি পাহাড়ের নীচে ঝাঁটিজঙ্গল-ভরা জমিতে শুয়ে আছে সে আরও অনেকের সঙ্গে। দুই পা রক্তে ভেজা। ভেজা শাড়ি। গায়ে অনেক জ্বর, বড়ো ব্যথা। ধাইমা তাকে কীসব জড়ি-বুটি করছেন। ধাইমাকে মানুষগুলো ছোঁয়নি। সাদা চুলের অশীতিপর বুড়ি।

ভগলু নানার উদার বুকটা কসাই-এর গোরু-কাটা ছুরি দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে গেছে ওরা। তার ওপর অন্য একজন পেটে একটা ছুরি ঢুকিয়ে মোচড় দিয়ে নাড়িভুঁড়ি সব বের করে দিয়েছে। শিমুলতলিতে শকুন পড়েছে ভগলু নানার ওপরে। শেয়ালে-শকুনে ঠুকরে খাচ্ছে সেইসব মৃতদেহ।

পুরুষেরা ছিল না বলেই প্রাণে বেঁচে গেছে। যদিও মানে মরে গেছে মেয়েরা। চতুর্দশীর রাত আজ। আলো আছে। সদরে লাশকাটা ঘরে যখন ভগলু নানাকে নিয়ে যেতে আসবে পুলিশ তখন তার লাশের বোধ হয় আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। বস্তির ছোটো ছেলে-মেয়েদের মধ্যে দশ-বারো জনকে ওইভাবে কুপিয়ে কেটেছে ওরা।

শকুন বসে আছে চাঁদভাসি আকাশের পটভূমিতে জুগগি পাহাড়ের ঢালে পলাশবনের ডালেও। চারধারে কান্না, বিলাপ আর আর্তনাদ।

মুঙ্গলির বাবা ফিরল হাতে শুয়োরের মাংস আর ছোলার ডাল নিয়ে ফুলবাগ থেকে হেঁটে। যানবাহন সব বন্ধ।

মুঙ্গলি শুনতে পেল, সরজু মাস্টার কথা বলছে দূরে পুরুষদের জটলার মধ্যে বসে। তার গলা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে মুঙ্গলি। বড়ো কষ্ট হতে লাগল ওর। বড়ো কষ্ট। পুজোয় লাগার আগেই দলিত, পিষ্ট, গলিত হয়ে গেল ফুল।

দশরথ চাচা বলল, মুঙ্গলি শুনল, শুয়োর ওদের কাছে ‘হারাম’। মুঙ্গলির ইতোয়ারিন যদি ঘুরতে ঘুরতে ওখানে না যেত…।

শুয়োরও তো ঈশ্বরের সৃষ্টি! মুঙ্গলি তা ইতোয়ারিনকে ইচ্ছে করে পাঠায়নি। সে গেলেও তো লাথ মেরে তাকে তাড়িয়েও দিতে পারত ওরা। তা হলেই তো মামলা মিটে যেত।

সরজু মাস্টার বলল, না তা তাড়ায়নি। ওদের ধর্মে আঘাত লেগেছিল বলে…। হঠাৎ গিয়ে পড়া শুয়োরির মতো একটা বদবু, সুরতহারাম মাদি জানোয়ার অতগুলো সুস্থ স্বাভাবিক এবং অসংখ্য শিক্ষিত মানুষকেও পাগল করে দিল! পুলিশদের না মেরে, সকলে পাথর মেরে ইতোয়ারিনকেও নাহয় মেরেই ফেলত। মুঙ্গলি নাহয় কাঁদত খুবই। আর কী হত? তা ছাড়া পুলিশদেরই-বা মারল কেন?

কোনো যুক্তি…কোনো যুক্তি কি?

পুলিশদের মারল, পুলিশেরা শুয়োরটাকে অ্যারেস্ট করেনি বলে। আটকায়নি বলে। ওদের ধারণা, পুলিশেরা চক্রান্ত করেই নাকি সমাজের মধ্যে শুয়োর ঢুকিয়ে দিয়েছিল। এ চক্রান্তের মধ্যে ভাঙ্গি বস্তির মানুষেরাও ছিল।

দশরথ চাচা বলল।

সরজু মাস্টার বলল, ‘ক্যা বাত!’

দশরথ চাচা বলল, ইতোয়ারিনকে তো মুঙ্গলি বেঁধেই রেখেছিল। ইদের নামাজ তো আর ইদগাতে এই প্রথম বারই হল না! এত বছর ধরে হচ্ছে। কোনোদিনও এমন ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটেনি। ওরা ভাবল কী করে যে, চক্রান্ত ছিল এর পেছনে? এত বদমেজাজ কীসের ওদের? ভাবে কী ওরা নিজেদের? মানুষ এমন অন্ধও হতে পারে? গিয়াসুদ্দিন চাচার মতো মানুষও তো সেখানে ছিল। সেও কি বোঝাতে পারল না? এমন অবুঝপনা! ভাবা যায় না। সত্যিই ভাবা যায় না।

গিয়াসুদ্দিন চাচা পুলিশের গুলিতে মারা গেছে।

কে বলল?

সমস্বরে অনেকেই বলে উঠল অবিশ্বাসের গলায়।

সরজু মাস্টার বলল হ্যাঁ, তাই।

ইস! তাই?

স্তব্ধ হয়ে গেল সকলে।

হ্যাঁ। পুলিশেরা তো আর দেখে দেখে গুলি করেনি।

দশরথ চাচা বলল, নিজেদের প্রাণ বাঁচাতেই করেছিল।

সরজু মাস্টার বলল, ভগলু নানা যেমন ওদের ছুরিতে ফালাফালা হয়ে গেছে তেমন গিয়াসুদ্দিন চাচাও পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা কতগুলো মাথামোটা ধর্মান্ধ লোকই চিরদিন লাগিয়ে এসেছে। কী হিন্দু, কী মুসলমান! আর তাতে মারা গেছে চিরদিনই ভগলু নানা আর গিয়াসুদ্দিন চাচাদের মতো ভালো, বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ, যুক্তিসম্পন্ন, বুদ্ধিমান, হৃদয়বান মানুষেরাই। এই হচ্ছে এই সবের নতিজা।

ওরে! এসব আলোচনা আস্তে করো। কে শুনে ফেলবে। তারপর পুলিশ এসে আমাদেরই ধরবে। গরিবের সহায় তো কেউই নেই।

ওদের মধ্যে থেকেই কে একজন বলল। অন্ধকারে তাকে ঠিক ঠাহর হল না।

ঝড়ু বলল, আবার যদি ওরা আমাদের কোতল করার জন্যে ফিরে আসে? কী হবে?

দশরথ বলল, আবারও যদি আসে তবে আমরা তো আর মেয়ে নই, এসেই দেখুক-না। আসোয়া, তির-ধনুকগুলো? এসেই দেখুক। মেয়েদের একা পেয়ে যারা এমন করে যেতে পারে সেই মানুষগুলো কি মানুষ?

সব আছে হাতের কাছেই। আসোয়া বলল।

দোষটা তো আসলে এই ভোটের কাঙাল বদমাশগুলোরই। বেয়াল্লিশটা বছর চলে গেছে। এখনও মুখ বুজে থাকব? ফিরে এসেই দেখুক-না তারা!

সরজু মাস্টার বলল ঠিক বলেছ। স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে বাস করেও ন্যায্য কথা যদি না বলার সাহস থাকে তবে ওই শিমুল গাছে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলেই পড়ো ঝড়ু চাচা। প্রত্যেক অন্যায়েরই একটা সীমারেখা থাকে। সেই সীমান্তে অন্যায়কে যদি আটকাতে না পারি আমরা, তবে আর কোনোদিনও সেই অন্যায়কে আটকাতে পারবে না। এমনিতেই অনেকই দেরি হয়ে গেছে।

ঝড়ু বলল, রিলিফ আসবে না সদর থেকে? এই বস্তির জন্যে?

দশরথ বলল, এসেছে তো।

কে যেন বলল, এ বস্তির জন্যে কিছুই আসেনি। রিলিফ-টিলিফ ওই দুই বড়ো বস্তির জন্যে। পাঁচ ট্রাক খাবারদাবার। এয়ার কণ্ডিশণ্ড গাড়ি করে সামনে পিঁ-পিঁ পাঁ-পাঁ করে ঢেঁড়া বাজানো এসকর্ট কার নিয়ে কালোমতো বদবু এম.এল.এ. ধবধবে সাদা পোশাক পরে এসে ওই দুই বস্তিতেই ঘুরে গেছেন; আশ্বাস দিয়ে গেছেন যে, কোনো ব্যাপারেই কোনো চিন্তার দরকার নেই। পুলিশের যে কোতোয়াল ইদগাতে ডিউটিতে ছিল তাকে ইতিমধ্যেই বরখাস্ত করা হয়েছে এবং শুয়োরের যে মালিক, একটি মেয়ে, ধাঙ্গি বস্তির মুঙ্গলি, তার শুয়োরসুদ্ধু তাকে গ্রেফতার করা হবে। হাই কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত জজসাহেবকে দিয়ে এই শুয়োরঘটিত চক্রান্তর গোড়া ধরে টান দেওয়ার জন্যে বিচারবিভাগীয় তদন্তও করানো হবে। ট্রাক ট্রাক ওষুধও এসেছে। লঙ্গরখানাও খোলা হয়েছে। গুলিতে আহতদের অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে গিয়ে সদরের হাসপাতালে ভরতিও করা হয়ে গেছে। মারা গেছে ন-জন। তার মধ্যে ন-জনই পুলিশের। আহত দশ। তারমধ্যে পুলিশের ছ-জন আর চার-জন নামাজি।

মুঙ্গলিকে অ্যারেস্ট করবে। এম.এল.এ.-র মতে মুঙ্গলিই এই দাঙ্গা বাঁধাবার মূলে। সত্যিই এস.পি. নিজেই আসছেন অনেক ভ্যান পুলিশ সঙ্গে নিয়ে সদর থেকে। গাগারির পুলিশ চৌকি নামাজিরা ইতিমধ্যেই আক্রমণ করে পুড়িয়ে দিয়েছে। অনেক পুলিশ মরেছে নাকি সেখানে।

পুলিশ হাতে রাইফেল নিয়েও মরে গেল? রাইফেল হাতে নিয়ে পাথর খেয়ে কীকরে মানুষ মরে তা জানি না। এ আমাদের মহান ভারতবর্ষেই সম্ভব।

আররে! হিন্দুস্থানের পুলিশের রাইফেলের ট্রিগার থাকে রাজনৈতিক নেতাদের আঙুলে। পুলিশেরা সব পুতুল। বহুজন্মের অনেক পাপ থাকলে তবেই কোনো ভদ্রলোক মহান ভারতীয় গণতন্ত্রে পুলিশের চাকরি করতে আসেন। পুলিশের চাকরিতে ঢোকার পর অবশ্য অনেকেই আর ভদ্রলোক থাকেই না।

রিলিফ আসেনি।

কেন আসবে?

ওখানে এল আর এই গ্রাম কী দোষ করল?

আসোয়া শুধোল।

এত দুঃখেও সরজু মাস্টার হেসে ফেলে বলল, সেসব কোনো কারণই নয় আসোয়া। ওরাও মানুষ আমরাও মানুষ।

তবে?

ঝড়ু বলল হতবাক হয়ে, তবে এই তফাতটা কেন? কীসের জন্যে?

হা:! চুনাওট তো এসে গেল! আর কত দেরি? ওই দুটি বস্তি মিলিয়ে যে পুরো ছ-টি হাজার ভোট! আর ঝড়ু চাচা, তোমাদের এখানে মাত্র তিনশো ভোট। শুয়োরদেরও যদি ভোট থাকত তা ধরেও। আর সেই ভোটের প্রত্যেকটি তো তোষণনীতির কারণে গদিতে আসীন দলগুলোই পেয়ে আসছে। চিরদিনই। গদি রাখতে হলে কোনো গদিলোভীরই মুসলমানদের সলিড ভোটগুলি না পেলে চলে না এই কাঁরডারি জেলাতে। তোমাদের জন্য কাদের মাথাব্যথা আছে বলো? এখন ইতোয়ারিনের মতো শুয়োরিরাই এই দেশের দন্ডমুন্ডের কর্তা। তারাই এখানে দাঙ্গা বাঁধায়, ভোট আনে, অথবা ভাঙায়। রাজা-উজির বানায়।

মুঙ্গলি তার কানের কাছে ঘোঁৎঘোঁৎ শব্দ শুনল একটা। হাত বাড়িয়ে গা ছুঁল ইতোয়ারিনের।

ইতোয়ারিনও তো জাতে মেয়েই! বেইজ্জত হওয়ার ভয়ে, সেও বুঝি তখনও থরথর করে কাঁপছিল।

মুঙ্গলি তার হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরল ইতোয়ারিনের। মুঙ্গলির মাথার ওপরে কালো আকাশের পটভূমিতে বাজে-পোড়া একটা শিমুলের ডালে ডালে শকুনগুলো অন্ধকারে অন্ধকারতরো পিন্ডর মতো বসে ছিল সার সার সবুজ নীল তারাদের পটভূমিতে।

তাদের দেখে মনে হচ্ছিল যে, তারাই বোধ হয় এ দেশের হতভাগ্য মানুষদের শেষ অভিভাবক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *