কুচিলা-খাঁই

কুচিলা-খাঁই

জিপের স্টিয়ারিং ধরা বাঁ হাতের কবজির দিকে তাকালাম।

ঘড়ির রেডিয়ামে রাত আড়াইটা চকচক করছে।

সেই দুপুর দুটোয় কটক শহর ছেড়েছি। তারপর মহানদী আর বিরুপার এ্যানিকাট পেরিয়ে ঢেনকানলের ওপর দিয়ে এসে, হিন্দোল পেরিয়ে অঙ্গুলে এসে পৌঁছেচি। সেখানে খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার রওয়ানা হয়ে পূর্ণাকোর্টের মোড়ে এসে বাঁয়ে ঘুরেছি। তারপরও চলছি—পাহাড়ে জঙ্গলে, চড়াইয়ে উতরাইয়ে! পথের রাঙাধুলোয় গা-মাথা সব একাকার হয়ে গেছে। জার্কিনের জলপাই রংটার ওপর ধুলোর আস্তরণ এমনভাবে পড়েছে যে, ড্যাশবোর্ডের মৃদু আলোয় রংটাকে খয়েরি বলে মনে হচ্ছে।

জিপের হেডলাইটে দেখলাম, সামনেই একটা শালের খুঁটির গায়ে সাদা এক ফালি তক্তার ওপর কালোতে লেখা ‘টুলকা ফরেস্ট রেস্টহাউস।’

একটি প্রায় সমকৌণিক বাঁকে চাকাগুলো আপত্তি জানিয়ে কিচ কিচ করে উঠল—ঢুকে পড়লাম টুলকার বাংলোর হাতায়। সামনে পড়ে রইল হিমেভেজা, সাদা ধুলোয় ঢাকা ভূরান্ডির রাস্তা; গাঢ় অন্ধকারে, একটা ফ্যাকাশে স্বপ্নের মতো।

তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই।

ভোর হয়েছে।

কুচিলা-খাঁই ডাকছে পাহাড়ের ওপরের কুচিলা গাছ থেকে। হঁক্ক হঁক্ক হঁক্ক, হঁ ক্ক, হঁ কঁক্ক, কঁ হ্যাঁক হ্যাঁক।

দিল ঘুমটার বারোটা বাজিয়ে।

এমন অসভ্য অভদ্র পাখি ভারতবর্ষের পাহাড় জঙ্গলে আর দুটি নেই। অন্য অনেক পাখি ডাকে বটে, তবে তাদের ডাক এমন শ্রুতিকটু কিংবা অপ্রয়োজনীয় নয়। কোটরার বাচ্চা যেমন বিনা কারণে লাফায়, এরা তেমনি বিনা কারণে ডাকে। সব সময় খাই খাই করছে, আর বিরাট বিরাট ডানা আর বিশ্বলোভী ঠোঁট দিয়ে যা পাচ্ছে তাই ঠোকরাচ্ছে। এমন লম্ফঝম্ফমান পাখির তেলে বাত সারবে না, তো বাত সারবে কীসে?

ভেবেছিলাম অনেকক্ষণ ঘুমুব। হল না তা।

জানালা দিয়ে ডিসেম্বরের সুনীল আকাশ দেখা যাচ্ছে।

এমন আশাবাদী আকাশ বহুদিন দেখিনি। ঝক-ঝকে রোদ্দুর হাওয়ায় উড়ছে ছুটি ছুটি—ছুটি। কম্বলটা সরিয়ে উঠে বসলাম চৌপায়াতে। উঠে বসতেই দেখলাম, বাংলোর পাশের ফাঁকা জায়গাটাতে, কুয়োতলির কাছে, কাপড় শুকনোর দড়িতে কী একটা গোলাপি পদার্থ ঝুলছে।

চোখ কচলে ভালো করে দেখলাম। প্রথমে বিশ্বাস হল না। ভাবলাম, কাল রাতের নেশা কাটেনি। কিন্তু আবার ভালো করে চাইতেই ইচ্ছা না করলেও পদার্থটির উপস্থিতি বিশ্বাস করতেই হল। একটি গোলাপি-রঙা নাইলন প্যান্টি। এই নিবিড় জঙ্গলে, হাতি-বাইসন-বাঘ অধ্যুষিত পাহাড়ে, এ-কোন মেমসাহেব যে এই ভেঙে পড়া, ছুচোভরা বাংলোয় এসে রয়েছে?

ঘরের বাইরে যেতে সাহসে কুলোল না। ঘর থেকেই হাঁক দিলাম ‘চৌকিদার’।

‘কহন্তু আইজ্ঞা’, বলে চৌকিদার এসে দাঁড়াল।

সে আমাকে আগেও দেখেছে অনেকবার। আঙুল দিয়ে রমণী-বাসটি দেখাতেই, সে কাছে এসে বলল, ছিন্তিয়া মেম্বসাহেব। কাল রাতির আইলা, আউ মত্তে কহিলা সাত্বদিন রহিব।

মনে মনে ভাবলাম জ্বালালে দেখছি।

কোথায় একটু নিরিবিলি খেয়ালখুশি-মতো দিন কাটাব না কোত্থেকে ছিন্তিয়া মেম্বসাহেব এসে জুটল!

হাত-মুখ-ধুয়ে, জামাকাপড় পরে বারান্দায় আসতেই দেখলাম, বারান্দার সামনের ঝাঁকড়া চেরিগাছটার পাশে, যেমন অসম্ভব উদার একরাশ রোদ আর এক ঝাঁক ছাতার পাখি লুটোপুটি কচ্ছে, ঠিক সেইখানটিতে বেতের চেয়ার পেতে একটি বিদেশি মেয়ে বসে আছে, বাংলোর সামনের পাহাড়টার দিকে চেয়ে। পাহাড়টি বলতে গেলে একেবারে বাঁলোর গেটের গা ঘেঁষেই উঠেছে। অনেকগুলো কুচিলা-খাঁই, হঁক্ক হঁক্ক করছে, কুচিলা গাছগুলোতে পাখা ঝাপটাচ্ছে, উড়ছে, বসছে। এক কথায় এই সুন্দর শান্ত শীতের সকালের সবটুকু সৌকুমার্য ওদের কদর্য সশব্দতায়, চিরে ফালা ফালা করে দিচ্ছে।

মেয়েটি কুচিলা-খাঁইগুলোকে দেখছিল; একদৃষ্টে চেয়েছিল। আমি অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে তাকে দেখলাম। ছিন্তিয়া মেমসাহেবকে দেখে নাস্তিকের মতিভ্রম হল।

এমন স্নিগ্ধ, শান্ত, সমাহিত সৌন্দর্য আগে আমি আর দেখিনি। মেমসাহেবের যে এমন বাঙালি মেয়ের কমনীয়তা থাকতে পারে আমার ধারণার বাইরে ছিল। একটি কচি-কলাপাতা রঙের গরম পোশাকে সে বসেছিল। পায়ের ওপর পা দিয়ে। তার গ্রীবাহেলনের মনোরম ভঙ্গি, তার বসার ভদ্রভাব, তার আত্মতন্ময়তা; সমস্ত মিলেমিশে আমার একটি চমক লাগল। এই সুস্নাতা, সুগন্ধি, বিদেশি মেয়েটি প্রকৃতির অন্য অনেক সুন্দরী ফুলের মতোই এখানে এই টুলকার জঙ্গলে আমার চোখকে তৃপ্ত করবে বলে কাল রাতেও ভাবতে পারিনি।

ভাবলাম, ওকে ‘ডোন্ট-কেয়ার’ করে বন্দুক-কাঁধে বেরিয়ে পড়ি। আজকের খাওয়ার সংস্থান তো করতে হবে।

এই ভেবে সিঁড়ি দিয়ে নেমে, চেরিগাছটাকে বাঁয়ে ফেলে হনহনিয়ে এগিয়ে গেলাম।

কিন্তু মেমসাহেব পেছন থেকেই ‘সুপ্রভাত’ জানাল।

অতএব ভদ্রতার খাতিরে ফিরতে হল।

মেমসাহেব অহেতুক ফর্মালিটি এড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা ওই যে পাখিগুলো চেঁচামেচি করছে ওগুলোর নাম কী? চৌকিদার বলছিল ‘কুলা-খাঁই’।

আমি হেসে বললাম কুলা-খাঁই নয়, কুচিলা-খাঁই। বাংলায় আমরা বলি ধনেশ পাখি ইংরিজি নাম ‘The Great Indian Hopnbill!’

মেমসাহেব শুনে বলল, They are a nuisence to this scerenity।

তক্ষুনি বেরোনো হল না।

ওখানে বসে আর একবার কফি খেতে হল।

সিন্থিয়া জোনস বলল, আমি এসে পড়তে—নাকি খুব ভালো হল। এক ধরনের বিশেষ লতা সম্বন্ধে গবেষণা করছে ও।

আমি শিকারে প্রায়ই এখানে আসি শুনে ও বলল, তাহলে তো খুব ভালোই হল, আপনার এখানের জঙ্গল পাহাড় সব চেনা আছে। তা ছাড়া কাল তো আমি বিকেলে হাতির তাড়া খেয়ে পালিয়ে বেঁচেছি, শিকার তো প্রত্যেকবারই করেন, এবার একটু অবলার সহায় হোন! নইলে, আমায় শূন্যহাতে ফিরতে হবে। লতা সংগ্রহ হোক আর না হোক ভয় মুক্ত হয়ে জঙ্গলে পাহাড়ে বেরিয়ে বেড়ানোটাও তো একটা আনন্দের মতো আনন্দ।

আমি বললাম, তথাস্তু। তবে একটু আধটু শিকার তো করতেই হবে—পট-হান্টিং। নইলে খাবেন কী?

সিন্থিয়া বলল কেন? টিনের খাবার? সব সঙ্গে আছে।

আমি বললাম, টিনের খাবারে আমার অরুচি। এখন উঠি, গোটা দুই মুরগি মেরে আনি।

কিন্তু তক্ষুনি ওঠা হল না। সিন্থিয়া উঠতে দিল না—বলল, বসুন না একটু। এমন সুন্দর সকাল, গল্প করা যাক।

সিন্থিয়া অনেক জিজ্ঞেস করল। আমার নাম কী, কী পেশা, শিকার করতে ভালোবাসি কেন, আর কোনো নেশা আছে কি না, কী কী জানোয়ার মেরেছি? ইত্যাদি ইত্যাদি প্রচুর ছেলেমানুষি প্রশ্ন।

অন্য জায়গা এবং অন্য লোক হলে হয়তো সবকথার উত্তর দিতাম না। কিন্তু লোকে যখন আমার মতো ছুটি কাটাতে আসে তখন বড়োমানুষি করতেই চায় না মন।

শেষকালে আড্ডার মায়া কাটিয়ে উঠলাম। বন্দুকটা নিয়ে বাংলোর হাতা পেরিয়ে পাহাড়ের নীচের সুঁড়িপথে হারিয়ে গেলাম।

আসবার সময় সিন্থিয়া বলল, তাহলে মারবেনই মুরগি, ছাড়বেন না?

আমি বললাম, আগে মারিই! বাঁধা তো নেই।

ও বলল, তবে মারুন। রান্না কিন্তু আমি করব।

ভাবলাম, আরে এ যে গৌরীপুরি বউদি আমার। কোথায়, কোন থালায়, কার হাতে যে কার ভাত বাড়া থাকে তা কি কেউ জানতে পায়?

পরদিন বিকেলে চা খাওয়ার পর সিন্থিয়াকে বললাম, চলুন মাছ ধরে আসি।

—কোত্থেকে?

—কেন? ভুরান্ডির পথে যে জলপ্রপাতটা আছে, সেখান থেকে।

—আছে বুঝি জলপ্রপাত?

—নেই নাকি। দেখিননি এখনও?

—না তো।

—চলুন নিয়ে যাচ্ছি। বাংলো থেকে বড়োজোর দু-ফার্লং হবে।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা গিয়ে পৌঁছোলাম লালমাটির রাস্তার ওপরের সেই জলপ্রপাতে। বেশ উঁচু থেকে জল পড়ছে, ঝরঝরিয়ে। নীচে বেশ গভীর জল। একটা পুকুরের মতো হয়েছে সেখানে। সেখান থেকে জল তিনটি ধারায় বিভক্ত হয়ে চলে গেছে জঙ্গলের গভীরে। জলটা ওপর থেকে যেখানে পড়ছে সেখানে হাজার হাজার শ্বেতসাপের মতো ফেনা কিলবিল কচ্ছে। আর বড়ো বড়ো পাহাড়ি মাছ লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে জলের স্বচ্ছ ফোয়ারায়।

সিন্থিয়া তো দেখে অবাক। বাংলোর এতকাছে এমন সুন্দর জায়গা অথচ আগে আসেনি।

আমি বললাম, একা একা বেশি না আশাই ভালো।

বলে, ওকে সঙ্গে করে, যেখানে ঝরনাটা বিভিন্ন ধারায় ভাগ হয়ে গড়িয়ে গেছে উপত্যকায় সেখানে নিয়ে গিয়ে জলের ধারে শম্বরের পায়ের দাগের সঙ্গে বাঘের পায়ের দাগও দেখালাম।

সিন্থিয়া একটুও ভয় না পেয়ে বলল, আমাকে একদিন বাঘ দেখাবেন?

হেসে বললাম, বাঘ দেখাব কি না হলপ করে বলতে পারি না। তবে দেখতে চাইলে, বাইসন-চরুয়া মাঠে নিয়ে গিয়ে বাইসন দেখাতে পারি।

বাচ্চামেয়ের মতো ভুরু নাচিয়ে বলল, তবে তো আরও ভালো হয়।

আমি বললাম, বেশ তো, দেখব বাইসন। পুরো দলটাকে—নিশ্চয়ই দেখাব।

একটা বড়ো পাথরের ওপর বসে আমরা ছিপ ফেলছিলাম। হাত-ছিপ। তবে সুতো মজবুত। আস্তে আস্তে বেলা পড়ে আসছিল। শীতের বনে, জঙ্গল-পাহাড়ে, আসন্ন সন্ধ্যায় কী যে সে এক করুণ রাগিণী বাজতে থাকে, তা কী বলব। ঘরের মানুষকে সে সুর ঘরে ডাকে, প্রিয়জনকে সে সুর কাছে টানে; আর আমার মতো খোদার—ষাঁড়কে আরও বাউণ্ডুলে করে তোলে।

জলপ্রপাতের ওপরের পাথরগুলো শুয়ে শুয়ে আদিবাসী ছেলের বুকের চেটোর মতো বুক চিতিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে কখন সন্ধ্যাতারা উঠবে সেই ক্ষণ গুনছে। সেখান থেকে একটি ময়ূর বার বার ডেকে উঠছে ‘কেঁয়া, কেঁয়া’। একটা কোটরা হরণিও জলপ্রপাতের ডানদিক থেকে ডাকছে ‘ব্বাক, ব্বাক, ব্বাক।’ রাইফেলটাকে হাতের কাছে টেনে রাখলাম।

এই টানছে, টানছে; ফাতনা ডুবল—চেঁচিয়ে উঠল সিন্থিয়া।

আমি বললাম, টানো টানো, এক হ্যাঁচকা টান মারল সিন্থিয়া। মাছটা শেষ সূর্যের আলো আর জলপ্রপাতের জলের ছটায় মুক্তির জন্যে শেষবারের মতো ঝিকমিক করে উঠল। তারপরই সঙ্গের বেতের ঝুড়িতে তাকে পুরে ফেলা হল।

সিন্থিয়া আনন্দে লাফাচ্ছিল। একটা আকাশি নীল-রঙা স্কার্ট আর ফিকে গোলাপি হাতওয়ালা উলের সোয়েটার পরেছে ও। ওর নরম, স্বপ্নিল সোনালি চুলে জলের গুঁড়ি হাওয়ায় এসে জমছে। তার ওপরে ক্লান্ত পৌষের বিষণ্ণ রোদের চুমু লেগেছে মনে হচ্ছে, সিন্থিয়া জোন্স নয়; যেন এক প্রাচীন আর্যকন্যা তার উদ্ধত কোমল গ্রীবাভঙ্গিতে, এই জলপ্রপাতের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ কেন জানি না আমার ওকে ভীষণ পেতে ইচ্ছা করল। ওর মতো সুগন্ধি, সুহাসিনী, স্বচ্ছতোয়া নারী আমার জীবনে এলে, ভাবলাম, হয়তো আমার রুক্ষ পৌরুষের দুর্গন্ধময় জ্বালা আর থাকবে না।

এই ভাবনাটা মনে ব্যাপ্ত হতে না হতে কোথা থেকে একঝাঁক ছাতারে পাখি, ‘ছ্যা: ছ্যা: ছ্যা: ছ্যা:’ করতে করতে কোনাকুনি মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল।

আমার ছিপেও একটা মাছ উঠল। বেশ বড়োমাছ।

এদিকে সন্ধ্যা এসে জলপ্রপাতের মাথায় তার কালোচুল মেলে দাঁড়িয়েছে দেখলাম। কৃষ্ণপক্ষের রাত। সন্ধ্যাতারাটি পিদিম হাতে পথ দেখাতে এল। বনের পাতায় শিরশিরানি তুলে তার পিছু পিছু একটা হাওয়াও এল।

আমি আর সিন্থিয়া বাংলোর দিকে চললাম।

চলতে চলতে সিন্থিয়া বলল, গোটাম, চলো আমরা এখানে সাঁতার কাটব। আপত্তি আছে তোমার?

আমি বললাম, আপত্তি কিছু নেই। তবে সাঁতার কাটার চেয়ে শুধু স্নান করাটাই ভালো হবে। ওখানের পাথরগুলো ভারী অসমান আর জলের তলায় কোথায় যে উঁচু আর কোথায় নীচু তা তো তুমি দেখতে পাবে না। গতবার আমার এক পাইলট বন্ধু এইখানে এসে সাঁতার কাটতে গিয়ে কলারবোন ভেঙে ফিরেছিল। বেচারার কেরিয়ারটাই খতম হয়েছিল একটু হলে।

সিন্থিয়া ওর ডানহাতের পাতায় আমার বাঁহাতের পাতাটি নিয়ে বলল, আমাকে ভয় দেখিয়ো না—তা ছাড়া তুমি তো আছ। তুমি থাকতে আমার ভয় কী?

এমনভাবে সিন্থিয়া কথাটা বলল, আমার ওপর ভরসা করেই এই অবলা নারী এইরকম জায়গায় লতা খুঁজতে এসেছিল। তবু, যাকে ভালো লাগে, যার সঙ্গ ভালো লাগে; যার হাতে হাত ছোঁয়ালে শিশুবয়সে মার স্তনে হাত ছোঁয়ানোর মতো স্বস্তি বোধ হয়, সে যদি এমন করে বলে যে, আমি আছি জেনে সে নিশ্চিন্ত; তবে তার চেয়ে বড়ো কিছু প্রাপ্তি আছে বলে তো আমি জানি না। যাকে ভালো লাগে কিংবা যাকে ভালোবাসি, তার সবটুকু বিশ্বাস যদি আমার ওপর ন্যস্ত হয়, তাহলে আমি তার জন্যে কী না করতে পারি। হয়তো প্রাণও দিতে পারি। তা ছাড়া, একটা প্রাণের জন্ম তো একটা জৈব দুর্ঘটনা বই নয়। কিন্তু ভালোবাসা তো দুর্ঘটনা নয়, সে যে এক স্বেচ্ছারোপিত ব্যথার ফুল। যার অবয়ব নেই। তবু নড়লে-চড়লেই সে ঝুমঝুমিয়ে বাজে।

সিন্থিয়াকে দেখে যে আমার ভারতীয় বলে মনে হয়েছিল, তার কারণ ছিল। ওর মা ভারতীয়, বাবা ইতালীয়। পরে অবশ্য বিচ্ছেদ হয়ে গেছিল দু-জনের। তার বেশি কথা ওর সম্বন্ধে জানতে পারিনি এবং জানতে চাইওনি। তা ছাড়া, ও নিজের থেকে খুশিমনে নিজের সম্বন্ধে যা বলেছিল, তাই শুনেছিলাম।

গতকাল সকালে ওর সঙ্গে পাহাড়ে গেছিলাম। এই পাহাড়-জঙ্গলে একা একা ঘোরা ওর পক্ষে সত্যিই সম্ভব হত না। হাতি প্রচুর আছে। বাইসন এবং ভাল্লুকও আছে। এদের কাছ থেকে অতর্কিত আক্রমণের সম্ভাবনা বেশি।

কালকেই তো প্রায় আমাদের গায়ের ওপর দিয়ে একটা ভাল্লুকের বাচ্চা ডিগবাজি খেয়ে চলে গেছিল। সিন্থিয়া খিলখিলিয়ে হেসে বলেছিল, দ্যাখো দ্যাখো গোটাম, একটা ভাল্লুক-খাঁই।

আমি ওর কথার ধরন দেখে হাসি চাপতে পারিনি।

কুঁচিলা-খাঁই নাম শুনে, সব জানোয়ারের পেছনেই ও খাঁই জুড়তে শুরু করেছে।

জঙ্গলে পাহাড়ে চৈতন্য হবার পর থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছি। অনেক গাছ দেখেছি, অনেক ফুল দেখেছি, অনেক লতা দেখেছি অথচ তাদের সকলের বৈজ্ঞানিক নাম কখনও জানিনি। তাদের স্থানীয় নাম জেনেছি; তাদের ভালেবেসেছি, এই পর্যন্ত। এই যে জঙ্গল, এতে আসন, শাল, পিয়াশাল, সেগুন, কুচিলা, মহুয়া এবং নানারকম বাঁশ ভরা।

একরকম মোটা-সোটা, গাঁট্টা-গোঁট্টা বাঁশ দেখিয়ে সিন্থিয়া বলেছিল, এদের নাম কী জান? Bamboosa Robusta। আর ওটা কী বলো তো? Bamboosa Ardensia। যখন ফুল ধরতে শুরু করবে, তখনই এদের মরবার পালা শুরু হবে। শুকিয়ে যাবে ধীরে ধীরে।

আমি বললাম, চমৎকার নিয়ম তো। মানুষদের জীবনেও এরকম হওয়া উচিত। ফুল ধরবার পরেও বেঁচে থাকবার কী মানে জানি না। মৃত্যু, সার্থকতার অনুগামী হওয়াই উচিত, সার্থক হবার পরও বাঁচবার মতো কোনো যথেষ্ট অনুপ্রেরণা আমাদের নেই। সার্থক হবার চেষ্টাই তো জীবন। তুমি কী বলো?

সিন্থিয়া নীল-রঙা একগুচ্ছ ফুল হাতে দোলাতে দোলাতে বলল, মৃত্যু যদি সার্থকতার অগ্রগামী হয়, তা হলে?

আমি কিছু বলি না। আমি শুধু শুনি।

গাছপালার মসৃণ গা বেয়ে উদার সূর্যের সহস্র সোনালি আঙুল সমস্ত বনভূমির শরীরে আদর ছোঁওয়াচ্ছিল। আমরা হাঁটছিলাম। শিশির-ভেজা ঘাস, লতাপাতা থেকে একটা অদ্ভুত গন্ধ বেরোচ্ছিল। তার সঙ্গে কত শত নাম-না জানা ফুলের গন্ধ মিশে মন্থর শীতার্ত হাওয়ায় রোদের আঙুলে কাঁপছিল। নানারকম হাইবিসকাস-এর মুখে সকালের মুখের ছবি দেখছিলাম।

সিন্থিয়া আপনমনে এক-একটা বিরাট উদ্ভিদবিজ্ঞানের নাম বলছিল প্রায় স্বগতোক্তির মতো, আর সেই নামের বহর শুনে যে লতা, যে ফুলকে ছেলেবেলা থেকে দেখেছি, তাদের হঠাৎই খুব রাশভারী বলে মনে হচ্ছিল।

আমি বললাম Emerson-এর কবিতাটা পড়েছ?

কোন কবিতা?

সিন্থিয়া শুধোল।

যতটুকু মনে ছিল, আমি তাই আবৃত্তি করলাম—

……‘But these young scholars, who invade our hills

Bold as the engineer who fells the wood,

Love not the flower they pluck and know it not,

And all their Botany is Latin names—’

সিন্থিয়া বলল, Superb! Superb!

আচ্ছা গোটাম, তুমি এই জঙ্গল-পাহাড়কে খুব ভালোবাসো, না? যদি তোমার মতো করে ভালোবাসতে পারতাম।

আমি বললাম, তোমার ভালোবাসা জঙ্গল-পাহাড়ের মতো নির্জীব বস্তুতে অপচয় করবে কেন? ভালো যদি বাসতে চাও, তো তোমার কি পাত্রের অভাব?

সিন্থিয়া কথাটার জবাব দিল না। এড়িয়ে গেল। এবং কেমন ব্যথিত হয়ে আমার দিকে ওর নিভৃত চোখ তুলে চাইল।

আমার সিন্থিয়া মেমসাহেবকে ভীষণ ভালো লাগছিল। জীবনে যা আমি বরাবর ভয় করে এসেছি, সরবে যার বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছি, সেই নীড় বাঁধার মতো লজ্জাকর ও স্থাবর মনোবৃত্তিটা আমারও মনের কোণে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। মনে মনে তাকে অনেকবার বন্দুক উঁচোলাম কিন্তু সে কিছুতেই ভয় পেল না।

রাত আটটা হবে। বারান্দায় বসেছিলাম। বাংলোর সামনে কিছু চোখে পড়ে না! জমাটবাঁধা কালো অন্ধকার চোখের সামনে মনের জমাটবাঁধা ভাবনারই মতো ভারী হয়ে বসে আছে। পাহাড়টাই বেশি ভারী, না অন্ধকারটাই বেশি; ঠাহর করতে পাচ্ছি না। পাহাড়ের নীচের সেগুন গাছের জঙ্গলে জোনাকির ঝাঁক জ্বলছে আর নিবছে। অমাবস্যার রাতের ঢেউয়ের বুকের ফসফরাসের মতো। এই ঘনান্ধকার ভয়গর্ভ রাতের একটা সুপুরুষ ব্যক্তিত্ব আছে। এই অন্ধকার রাতে, বন পাহাড় যেমন ভাবে অদৃশ্য ও অসাধারণভাবে ব্যক্ত হয়; তেমন আর কোনো সময়েই নয়। প্রকৃতির বুকের কোরকে যে শক্তিমান পুরুষ বাস করেন, সেই পুরুষ এই অন্ধকারেই প্রতীয়মান হন। যাঁদের চোখ আছে তাঁরাই তাঁকে দেখতে পান।

বাংলোর পেছনে সারি সারি আলপনা দেওয়া ছোটো ছোটো মেটে ঘর। ছোটো উঠোন। পাতকুয়ো, দু-একটি শান্ত, বিজ্ঞ গোরু। গুটিকয় চঞ্চল পোষা মুরগি। এবং অনেক নগ্ন, অসুস্থ অথচ সদাহাস্যময় শিশু। এই নিয়ে টুলকা গ্রাম। এখন রাত নেমেছে। কালোরঙের তুলির আঁচড়ে সব মুছে গেছে। নিস্পন্দ হয়ে রয়েছে। গ্রামের পেছনের ধানখেতে হাতি নেমেছে। মাচায় বসে ক্যানেস্তারা বাজাচ্ছে ছেলেরা। শীতের রাতে, পায়ের নীচে সরায় কাঠের আগুন নিয়ে। শালকাঠের মশাল করে তাতে আগুন জ্বেলে আন্দোলিত করছে। হাতির দল বৃংহন করতে করতে আবার পাহাড়ে ফিরে যাচ্ছে।

সিন্থিয়া চৌকিদারের হাতে বাসনপত্র দিয়ে বাবুর্চিখানা থেকে বারান্দায় এসে উঠল।

বলল, শিগগিরি শীগগিরি এসো, সব ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

নড়বড়ে কাঠের টেবলে খাবার সাজিয়ে, কম্পমান লন্ঠনের আলোয় আমার উলটোদিকের চেয়ারে বসে, আমার জঙ্গলে প্রেমিকা বলল, ‘খাও, গোটাম, শুরু করো!’

মুসুরির ডালের স্যুপ, ফ্রায়েড রাইস এবং মুরগির রোস্ট। এ জঙ্গলে রোজ রোজ এমন খাবার খাব, আর শুধু তাই নয়, এমনভাবে খাব; কে ভেবেছিল?

খেতে খেতে আমি বললাম, তুমি আমার অভ্যেস খারাপ করে দিচ্ছ। আর চারদিন পরে যে চলে যাবে, তখন কী খাব?

সিন্থিয়া বলল, কেন? এবেলা খিচুড়ি, ওবেলা খিচুড়ি, তা ছাড়া তোমার ঘোড়া মার্কা রাম তো আছেই। তোমার মতো লোক মানুষ না হয়ে ঘোড়া হয়ে জন্মালেই পারত।

বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।

তারপরই গম্ভীর এবং নীচুগলায় আমাকে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল, তুমি খুব মজার ছেলে। তোমার মধ্যে খুব প্রাণ আছে। যে মেয়ে তোমাকে বিয়ে করবে সে খুব সুখী হবে।

মুরগির ঠ্যাং চিবোতে চিবোতে বললাম, দ্যাখো এই জ্ঞানের ভয়েই লোকালয় ছেড়ে থাকি। জঙ্গলেও যদি জ্ঞান দাও, তো পালাবার জায়গা দেখি না।

সিন্থিয়া বলল, আমি ঠাট্টা করছি না, যা বলছি তা সত্যি কিনা দ্যাখো।

ভাবলাম, এও তো আর এক জ্বালা। যাকে মনে মনে ভালো লাগতে আরম্ভ করেছে, যাকে প্রেয়সী বলে ভেবে আকাশকুসুম কল্পনা করছি, সে হঠাৎ পিসিমা বনে উপদেশ দিতে আরম্ভ করল। পড়াশুনাটা করলে, কী করে কথা গুছিয়ে বলতে হয় তা শিখতে পারতাম। একে তো কাউকে আমার আদপে কিছু বলারই থাকে না, যদি বা বলার মতো কোনো কথা জমে, তাও মনে মনে হাঁড়ির মধ্যে খিচুড়ির মতো টগবগ করে। বলা আর হয় না।

কিছু, বললাম না। উত্তরে চুপ করেই রইলাম। কারণ, আমি জানতাম, বলার সময় এখনও আসেনি। জীবনে একটা ভীষণরকম প্রয়োজনীয় কথা বলবার জন্যে একটু মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। অন্তত আমার।

আমরা চুপচাপ খাচ্ছিলাম। সিন্থিয়া, চামচে করে একটু ফ্রায়েড রাইস আলতো করে মুখে তুলেছিল। তারপর নি:শব্দে চিবোচ্ছিল। ওর হাঁটায়, কথা বলায়, চোখের চাউনিতে, এমনকী খাওয়াতেও এমন একটা শান্তশ্রী, এমন একটা সহজিয়া রেশ আছে যে, ওকে দেখে আমার মনে হত ওর জীবনে বোধ হয় কোনোদিন ওকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলতে হয়নি। নিজে যা ভালো বলে মনে করেছে সেই শুভবুদ্ধি থেকে নড়তে হয়নি। তাই ও পাহাড় থেকে প্রথম বেরোনো ঝর্নারই মতো পবিত্র, স্বচ্ছতোয়া। কোনো বাঁধ বাধা হয়নি এপর্যন্ত ওর ইচ্ছা বা রুচির বিরুদ্ধে। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগত ও যখন হাসত। প্রথমে চোখের তারায় একটু বিদ্যুতের ছটা দেখা যেত, তারপর সেই ছটা ছড়িয়ে যেত সমস্ত মুখময়, পাতলা দুটি জিনিয়া ফুলের পাপড়ির মতো ঠোঁঠে, দু-সারি সুচারু দাঁতে, সুকুমারী চিবুকে।

ভাবতাম, এমন করে কী হাসতে পারে! কিংবা কোনো মেয়ের হাসি এমন ভাবে কোনোদিন দেখিনি বা দেখবার চেষ্টাও করিনি কোনোদিন হয়তো বা আগে।

সিন্থিয়া যতক্ষণ কাছে থাকত ততক্ষণ আমার সমস্ত সত্তা ঘিরে একটি সুগন্ধ উঠত অনুক্ষণ। ওর সান্নিধ্যে কোনো জ্বালা ছিল না। কোনো কামনার ধারালো ছুরি কখনো আমাকে ফালা ফালা করত না। ওর সান্নিধ্য, আমার অনেক নৈরাশ্যের অতল গহ্বর আলোকিত করে রাখত। আমার অনেক ভালোলাগাকে মৌসুমি ফুলের মতো সমস্ত সত্তা জুড়ে ফুটিয়ে তুলত। মনে মনে, আমি নিজে যা নই; তাই মনে হত। মনে হত, আমিও ওর মতো শুচি, পবিত্র। ওর মতো সরল। মাঝে মাঝে এমন হত যে, আমার ওকে নিয়ে নীড় বাঁধবার সম্পূর্ণ যোগ্যতা আছে এমন ধারণাও আমার মনের মধ্যে শিকড় গাড়বার চেষ্টা করত। তখন সত্যিকারের ভালোবাসার সন্তান যে ‘বিনয়’, সেই বিনয় এসে আমাকে তুড়ে বলত ‘তুই একটা অপদার্থ’। অমনি ‘মুই অতি ছার’ ভাব নিয়ে নিজের নৈরাশ্যের খনির ভেজা, পিছল সিঁড়ি বেয়ে অন্ধকারে, অনিশ্চয়তায় আবারও নেমে যেতাম।

আর যাই হোক, আমি কোনোদিনই বোকা ছিলাম না। আমি জানতাম, আমি বুঝতে পারতাম যে, সিন্থিয়া যে-কোনো কারণেই হোক, আমাকে পছন্দ করে। মানে, নিছক পছন্দ করার জন্য নয়। আমাকে ওর বিশেষ একভাবে ভালো লাগে।

বুঝতে পারতাম।

ওর চাউনি, ওর কথার সুর, আমার সামান্য সুখের জন্য ওর উৎকন্ঠাতেই বুঝতে পারতাম। বুঝতে পারতাম, আর অবাক হয়ে যেতাম যে, এই ছাত্রীটির পড়াশুনার চেয়ে আমার প্রতি আগ্রহ বেশি বলে। ওর মধ্যে কোনো সস্তা জিনিস ছিল না, কোনো ন্যাকাপনা ছিল না। আমার এই উদ্দাম জংলিপনা ওকে আকৃষ্ট করেছিল। ওর দু-চোখে আমি এই আলো হাওয়া বন পাহাড়ের জীবনকে শুষে নেওয়ার জন্যে আকুতি দেখতে পেতাম। ভারী ভালো লাগাত এত ভালো আমার কোনোদিন লাগেনি।

খাওয়ার পর বারান্দায় বসে আর একটু গল্প করা হল।

সিন্থিয়া বলল, তুমি রোজ আমাকে ঠকাচ্ছ। কাল আমাকে চান করতে নিয়ে যেতেই হবে সেই জলপ্রপাতে।

আমি বললাম, হবেখন, রাত তো পোয়াক।

তারপর যে যার ঘরে শুতে গেলাম।

শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, সিন্থিয়া প্রায়ই আমাকে বলে you are a darling! you are so sweet! ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ এমন করে বলে, যেন পাশের বাড়ির মহিলা তার পাশের বাড়ির মহিলার ছেলে বলছেন।

ওকে আমি বুঝতে পারি না। ওকে আমার ভীষণ ভালো লাগে! বলতে গেলে, পাগলের মতো ভালো লাগে। ওরও যে আমাকে ভালোলাগে তা বুঝতে পারি। অথচ কথাবার্তায় এমন একটা সম্মানজনক ও সম্ভ্রান্ত দূরত্ব ও বজায় রাখতে চায় যে, আমার ভালো লাগে না।

ও বোধ হয় ভয় পায়। পাছে এই জঙ্গল পাহাড়ে দুরন্ত বেপরোয়া ছেলে, এমন কিছু আবদার করে বসে, যা ওর দেবার সাধ্য নেই। জানি না; জানি না।

কুচিলা খাঁই-এর ডাকের জন্যে কোনোদিন ভালো করে ঘুমুনোর জো-টি নেই। রোজ সকালে, আর শুধু সকালে কেন? সমস্ত সময়েই তো হঁক্ক হঁক্ক, হঁক্ক, হ্যাঁক হ্যাঁক করছে।

ঘুম থেকে উঠতেই, সিন্থিয়া বাইরে থেকে আমায় ডেকে বলল, গোটাম you better shoot a couple of these noisy filthy birds. They are telling on my nerves.

চৌপায়েতে বসে বসেই বললাম, কেন? তোমার কি বাত হয়েছে নাকি?

সিন্থিয়া রেগে বলল, না না সত্যি বলছি। এই পাখিগুলোকে আমি আসা অবধি সহ্য করতে পারছি না।

প্রাতরাশ খেয়ে, সিন্থিয়ার সাদা স্ট্যাণ্ডার্ড হেরাণ্ডে চেপে আমরা ঝরণাটায় গিয়ে পৌঁছোলাম।

তখনও জল বেশ ঠাণ্ডা আমি বললাম, আর একটু পরে নেমো, অসুখ করে যাবে। সিন্থিয়া বলল, বেশ। তবে আগে চলো, জলপ্রপাতের মাথায় যে সুন্দর জায়গাটা দেখা যাচ্ছে, সেখানে উঠি। জলটা কোথা থেকে আসছে দেখব।

আমি বললাম, চল, ঝোঁক যখন হয়েছে, তখন তো আর বাধা শুনবে না।

জলপ্রপ্রাতটা বেশ উঁচু, মাথা থেকে নীচের পুকুর প্রায় একশো ফিট হবে। তবে সেখানে তিন-চারটে প্রপাত। কম বেশি পনেরো কুড়ি ফিট উঁচু, একের মাথায় আর এক। পাকদন্ডী ঘুরে ওপরে উঠতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। আমিও কোনোদিন ওপরে উঠিনি। গভীর জঙ্গল আর লতাগুল্মর আড়াল থেকে চওড়া পাথরের খয়েরি আর কালো চাতাল বেয়ে জলধারা কুল কুল করে বেয়ে আসছে। এসে, শীতের সকালে ক্রীড়াচ্ছলে, রামধনু-চুল উড়িয়ে ঝাঁপ দিচ্ছে নীচে। ওপরে দু-ধারে লতাপাতা ঝুঁকে পড়েছে। দু-ধারে চমৎকার ছায়া-শীতল। রোদে পাথর যতটুকু গরম হয়েছে, তাতে তার ওপর শুয়ে থাকতে ভারী আরাম। জলধারার দু-ধারে থোকা থোকা কী একটা জংলি লতায় ফিকে নীল ফুল ফুটে আছে। পাথরের কালোতে খয়েরিতে, জলের ফেনিল সাদাতে, আর এই নীল লতার নীলে এমন একটা অপার্থিব ছবি হয়েছে যে কী বলব!

সিন্থিয়া লতাগুলোর কাছে গেল, তারপর বলল, এগুলোর নাম কী জান? ‘প্যাশানফ্লাওয়ার’। এগুলো জংলি লতা মোটেই নয়। নিশ্চয়ই কোনো শৌখিন লোক এখানে এনে কোনোদিন লাগিয়ে গেছিল।

সিন্থিয়া বলল, আমি এমন জায়গা ছেড়ে নীচে যাচ্ছি না।

সেই জলধারা ধরে সামান্য এগোলেই বেশ গভীর দু-তিনটি জায়গা আছে। যেখানে জল এক কোমর থেকে বুক অবধি। সবচেয়ে মজা হচ্ছে, এখানে জল একেবারে ফটিক স্বচ্ছ। মন হারালে, মন কুড়িয়ে নেওয়া যায়।

সিন্থিয়া ফ্লাক্সে করে কফি বানিয়ে এনেছিল।

বললাম, তুমি চান করো, আমি কফি খাই।

তুমি চান করবে নাকি?

করব। জল একটু গরম হোক।

হালকা গোলাপি রঙের একটা সাঁতারের পোশাক পরেছিল সিন্থিয়া। ঝকঝকে জলের মধ্যে একটা গোলাপি হাঁসের মতো মনে হচ্ছিল ওকে। বাদামিকে শ্বেতাকে মেশানো ওর আশ্রয়কুল হাত দু-খানি জলের মধ্যে ফোয়ারা ওঠাচ্ছিল। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে বলেছিল, সব কফি খেয়ো না কিন্তু!

আমি কফিতে চুমুক দিচ্ছিলাম, আর ভাবছিলাম; এ কদিন শিকারে আমি প্রায় গেলামই না, অথচ কী করে যে কটা দিন কেটে গেল টেরই পেলাম না। সিন্থিয়া তো আর দু-দিন বাদেই চলে যাবে। তারপর সময়টা সকাল বেলার কুয়াশার মতো একেবারে আমার ওপর চেপে বসবে। তবু বেশ কাটল এ কটা দিন। এত কাছে থেকে এত দূরে কী করে থাকতে হয় সিন্থিয়ার কাছে তা শেখার আছে।

হঠাৎই আমাকে চমকে দিয়ে সিন্থিয়া চিৎকার করে উঠল, হেল্প! হেল্প!

তাকিয়ে দেখি, জলের তোড়ে সিন্থিয়া নীচে প্রপাতের দিকে ভেসে চলেছে আর প্রাণপণে হাত পা দিয়ে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে। সেখান থেকে প্রথম প্রপাতটি বড়োজোর তিরিশ চল্লিশ ফিট হবে।

কান্ডজ্ঞান রহিত হয়ে লাফিয়ে পড়লাম জলে! জল তো সেখানে সামান্য, হাঁটুও নয়; কিন্তু কী পিছল! লাফাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রচন্ড আছাড় খেলাম। হাঁটুতে এমন একটা চোট লাগল পাথরের ওপর পড়ে যে, মনে হল অজ্ঞান হয়ে যাব। অজ্ঞান যে কেন হলাম না জানি না, কিন্তু সিন্থিয়া বেঁচে গেল। আমার পাশ দিয়ে ভেসে যাওয়ার সময় ওর হাত আমার হাতে লাগল, এবং আমি প্রায় শোয়া অবস্থাতেই হ্যাঁচকা টান দিয়ে একটা বড়ো পাথরে দু-পায়ে ভর রেখে, ওকে আমার কাছে টেনে আনলাম। ভয়ে বেচারির মুখ-চোখ শুকিয়ে গেলেও, ওর ঠোঁটে সেই আশ্চর্য হাসিটি লেগেই ছিল। কিছুটা অভাবনীয়তায়, কিছুটা প্রাণ—প্রাপ্তির আনন্দে ও অস্ফুটে কী যেন বলে উঠল। বুঝলাম না।

সিন্থিয়াকে বাঁচাতে পেরে যে আনন্দ না হল তা নয়, কিন্তু হাঁটুটাকে বোধ হয় আর কোনোদিন সোজা করতে পারব না।

আমরা দুজনে কোনো রকমে গড়িয়ে গড়িয়ে কিনারায় এসে পৌঁছোলোম। তারপর সিন্থিয়া নিজে প্রথমে উঠে, আমাকে উঠতে সাহায্য করল! কোনোরকমে পাথরে পৌঁছেই চিত হয়ে শুয়ে পড়লাম। হাঁটুটার মাংস একেবারে থেঁতলে গেছিল। তার ওপর রক্ত চোঁয়াতে শুরু করেছিল।

সিন্থিয়া কী করবে বুঝতে পারছিল না। প্রথমে হাত দিয়ে রক্তটা মোছবার চেষ্টা করল। তারপর হঠাৎ অভাবনীয় ভাবে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার কপালে চুমু খেল। তারপর অনেকক্ষণ আমার ভিজে বুকে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

ওরকম চাপামেয়ে যে কী করে এমন বেহিসাবি হল, ভাবতে পাচ্ছিলাম না। আমি কনুইতে ভর দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করে বললাম, তুমি কি পাগল হলে বোকা মেয়ে! আমার কিছুই হয়নি।

সিন্থিয়া তবু শুনল না। আমার পাশে অসহায়ের মতো বসে, আমার দিকে চেয়ে থাকল।

সোনালিচুলে মোড়া ওর জলভেজা শ্বেতা—গ্রীবার দিকে তাকিয়ে একটি রাজহাঁসের কথা আমার মনে হল! যাকে আমি গুলি করেছিলাম, তারপর বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলাম; কিন্তু বাঁচাতে পারিনি।

ভোর হয়েছে অনেকক্ষণ। সকালে চা খাওয়া হয়ে গেছে। বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে আছি, হাঁটুতে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে। লোকজন জোগাড় করে বাঁশ দিয়ে স্ট্রেচার বানিয়ে সিন্থিয়া ঝরণার ওপর থেকে আমাকে কাল নামিয়ে নিয়ে এসেছিল। নিজে গাড়ি চালিয়ে পূর্ণাকোট থেকে ডাক্তার এনেছিল। ডাক্তার ব্যাণ্ডেজ করে দিয়ে গেছেন আর বলেছেন যে, হাড় ভাঙেনি। তবে বিশ্রামের প্রয়োজন।

সমস্ত বন-পাহাড় রোদে ঝলমল করছে। বারান্দার থামগুলোর ছায়ার সঙ্গে রোদটা কাটাকুটি খেলছে। সিন্থিয়া বাংলোর সামনের নুড়ি-বিছানো ড্রাইভে পাইচারি করছে। প্রথম যেদিন আমরা ঝরণায় যাই মাছ ধরতে, সেদিনকার সেই পোশাকটি পরেছে সিন্থিয়া। ফিকে নীল স্কার্ট আর আধ-ফিকে গোলাপি সোয়েটার।

সিন্থিয়াকে দেখছি, চুপ করে বসে যেতে-আসতে চোখাচোখি হলেই ও চোখ নামিয়ে নিচ্ছে। কী যেন ভাবছে ও। বোধ হয় কালকের কথা। বোধহয়, ভেবে লজ্জা পাচ্ছে। আমিও ভাবছি। ভাবছি, ওকে দু-একদিনের মধ্যেই বলব সেই কথাটা। বুলবুলি পাখির সঙ্গে বাসা বাঁধার কথা!

এমন সময় দুটো কুচিলা খাঁই পাখি পাহাড় থেকে উড়ে এসে চেরিগাছটার ডালে বসে কুৎসিত গলায় ডাকতে লাগল হ্যাঁক হ্যাঁক হ্যাঁক। সিন্থিয়া যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। পাখিদুটো প্রকান্ড ঠোঁটদুটো দিয়ে ডালে ঘষতে লাগল আর বিরাট বিরাট ডানাদুটো ঝাপটাতে লাগল।

সিন্থিয়া দৌড়ে আমার ঘরে ঢুকে শটগানটা নিয়ে এসে বলল, মা রো তো গোটাম, মারো তো! এগুলো সবসময় আমাকে ভয় দেখায়।

ইজিচেয়ারে বসে বসেই গুলি করলাম। পাখিটা মরে গিয়ে ডালেই লটকে রইল, মগডালে। অন্যটা হঁক হঁক করতে করতে উড়ে গেল।

কিছুক্ষণ আগে থেকেই জঙ্গলের মধ্যে একটা দূরাগত গাড়ির এঞ্জিনের গুনগুনানি শুনতে পাচ্ছিলাম। এখন গাড়িটা দেখা যাচ্ছে। একটা কালো গাড়ি। কাছে এল গাড়িটা। পূর্ণাকোটের দিক থেকে আসছে তারপরই বাংলোর হাতায় ঢুকে পড়ল। দেখলাম, একটা কালো রোলসরয়েস গাড়ি। সামনে কোনো দেশীয় রাজ্যের পতাকা উড়ছে পতপতিয়ে।

গাড়িটা এসে বাংলোর সামনে দাঁড়াল। উর্দিপরা সোফার এসে পেছনের দরজা খুলে ধরল। একজন মোটাসোটা ছোটোখাটো ভদ্রলোক নামলেন, পরনে দামি স্যুট। মাথায় স্ট্র হ্যাট। বয়স কম করে পঞ্চাশ হবে।

হঠাৎ সিন্থিয়ার দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম।

ওর চোখ দেখে মনে হল এ ওর চোখ নয়। ছুলোয়া শিকারে তাড়া খেয়ে শিকারির সামনে পড়া কোনো চিতল হরিণীর চোখ!

যার বাঁচা হল না। হবে না!

লোকটি চিবিয়ে চিবিয়ে সিন্থিয়াকে বলল, what’s all these about? Why am I paying that old bitch for?

আমি কিছু বোঝা বা বলার আগেই, সিন্থিয়া প্রায় আমার হাত থেকে বন্দুকটা ছিনিয়ে নিল, নিয়ে একবার লোকটার দিকে তুলল তারপরই আমার ঘরে রেখে এল।

রেখে এসে, আমার ইজিচেয়ারের পাশে আমার কাঁধে হাত রেখে, সিন্থিয়া বলল, গোটাম, আমি যাচ্ছি।

ওর হাত চেপে ধরে আমি বললাম, কোথায় যাচ্ছ?

ও বলল আমার অতীতে ফিরে যাচ্ছি। আমি খারাপ, আমি খারাপ, আমি মিথ্যাবাদী, আমি খারাপ।

ওকে কাছে টেনে আমি বললাম, তুমি ভালো, তুমি ভালো তোমার অতীত নেই। তোমার কেবল ভবিষ্যৎ আছে।

সিন্থিয়া আমার মুখের দিকে চেয়ে একমুহূর্ত যেন কী ভাবল, তারপর লোকটার দিকে আঙুল দেখিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ওইটা আর একটা কুচিলা-খাঁই।

একমুহূর্ত চুপ করে থেকে সিন্থিয়া বলল, চললাম গোটাম। বলল, ‘তোমাকে মনে থাকবে। আমাকে ভুলে যেয়ো তুমি।’

বলতে বলতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠল।

আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, সিন্থিয়া, সিন্থিয়া!

কিন্তু উত্থান শক্তিরহিত আমার চিৎকার ডুবিয়ে দিয়ে মহারাজার গাড়ির আওয়াজ বাংলোর হাতা পেরিয়ে গেল।

পেছনে পেছনে সোফায় সিন্থিয়া স্ট্যাণ্ডার্ড হেরাল্ড চালিয়ে নিয়ে গেল।

সেই ভাঙা সকালের রাঙা আলোয় আমি একা একা বসে রইলাম টুলকার বাংলোয় বারান্দায়।

হাওয়ার দোলায় মরা কুচিলা-খাঁই পাখিটার পালকগুলো আন্দোলিত হচ্ছিল। একবারের জোর হাওয়ায় মরা—পাখিটা ধপ করে নীচে পড়ল।

পাখিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, আমার বড়োই কষ্ট হল সিন্থিয়ার জন্যে।

ওর জীবনময়ই কুচিলা-খাঁই।

কটা কুচিলা-খাঁই আর ও মারতে পারবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *