চরিতখেকো অ্যাণ্ড কোম্পানি
টেবিলের ওপরে কাচের পেপারওয়েটটা শব্দ করে রেখে হীরেন বলল, আর কী হবে। একেই বলে, ঘোর কলি।
সোমেশ বলল, যা বলেছিস। ঠাকমা কালই রাতে ‘চন্ডীমঙ্গল’ পড়ছিল শুয়ে শুয়ে। কলি যুগের কী বর্ণনা রে! যেন কলকাতারই বিজ্ঞাপন।
কীরকম? বল-না শুনি।
নেপেন শুধোল।
হীরেন, সুর করে আবৃত্তি করল—
মহাঘোর কলিকাল নীচ হব মহীপাল
সর্বভোগ নীচের সাধন
সঙ্গদোষে পাবে দুঃখ লোক ধর্মে পরাঙ্খুখ
কলিযুগে বেদের নিন্দন।
অন্ধ আদি যত জন রাজধর্মে পরায়ণ
সম্ভাষ ছাড়িব সর্বজন
কৃতঘ্ন হইবে নর পরপীড়া নিরন্তর
বেদনিন্দা করিবে ব্রাহ্মণ।
আরও অনেকখানি আছে। বলেই, হীরেন থেমে গেল।
নেপেন বলল, ‘কৃতঘ্ন’ মানে কী রে?
অকৃতজ্ঞ আর কী। আরও স্ট্রংগার টার্ম।
তাই বল। একেবারে কারেক্ট বর্ণনা। এই সময়ের। এই দেশের। কলকাতার। গজানন সোন্থালিয়া শেয়ার মার্কেটের খবর পড়ছিল মনোযোগ দিয়ে একটা দেশলাই কাঠি দিয়ে কান খুঁচোতে খুঁচোতে। কাগজটা নামিয়ে রেখে বলল, সন্ত তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’-এও কিছু কলি বর্ণনা আছে। কী বলব তোমাদের। বর্ণে বর্ণে মিলে যায় আজকের অবস্থার সঙ্গে।
বুঝতেই পারি। নইলে তুমি শালা হয়েছ আমাদের ফিনানসিয়ার। সিনিয়র পার্টনার! পৈতৃক বাড়িতে আপিসটা করেছি, কোনদিন বাড়িটা পর্যন্ত হাতিয়ে নেবে। পুরো কলকাতা শহরটাই তো তুমি আর তোমার ভাই-ভাতিজা মিলে হাতিয়ে নিয়েছ। কলি যে ঘোর, তাতে আর সন্দেহ কী?
সোমেশ বলল।
গজানন কখনো রাগে না। পয়সা রোজগার করতে অনেকই গুণ লাগে। ওকে যাই বলা হোক যত কিছু কটুকাটব্যই করা হোক ও শুধুই হাসে। আর সেই হাসি দেখে সোমেশের বুক কাঁপে। মিরজাফরের হাসি।
নেপেন বলল, তা চন্ডীমঙ্গল না কী তা তো শোনা গেল। এবার গজানন তোমার সন্ত তুলসীদাসও শুনি একটু।
বলেই হীরেনের দিকে ফিরে বলল, চন্ডীমঙ্গল কার লেখা রে? মা-চন্ডীর?
হীরেন দুঃখমিশ্রিত আক্ষেপের সঙ্গে হেসে ফেলল নেপেনের কথা শুনে।
বলল, যা: শালা! ভালো পার্টনারের সঙ্গেই বিজনেস করছি যা হোক। হাঁদা রে। কবিকঙ্কণ মুকুন্দর লেখা। সে কি আজকের?
চন্ডীমঙ্গল কে নেদেছে তা জেনে তো পয়সা রোজগার হয় না। তোর জ্ঞান তোর কাছে রাখ।
একটুও লজ্জিত না হয়ে ক্যাঁটক্যাঁট করে বলল নেপেন।
মন-মেজাজ ভালো নেই। দিশি ডিটেকটিভ কোম্পানিকে লাটে তুলে এখন নতুন কী যে ধান্দা করা যায় তাই ঠিক কর। তোদের এই ফালতু কথাবার্তা আর ভালো লাগছে না।
সোমেশ বিরক্তি ও চিন্তার গলায় বলল।
হীরেন বলল, সেই গিলিগান ডিটেকটিভ এজেন্সি যখন ডিজলভ করা হয়েই গেছে, ডিসিশন নিয়ে ফেলাই হয়েছে; ও নিয়ে আর আলোচনা না করাই ভালো। তা ছাড়া দিনকালও খারাপ। দেখলি তো কোম্পানি চালিয়ে। দুস। আরে, সি.আই.এ., কে.জি.বি.রাও ডবল এজেন্ট আর কাউন্টার এসপায়োনেজ-এর জন্যে লাটে উঠতে বসেছে, আর আমাদের এজেন্সি! তা ছাড়া বড়ো বড়ো কোম্পানিদের তো নিজেদেরই ডিপার্টমেন্ট থাকে। তাদের দরকারই-বা কী আমাদের হেল্প নেবার?
নেপেন বলল, হ্যাপার কথা না বলাই ভালো। দেখলি না! মিসেস সেন আমাদের লাগাল মিস্টার সেন তার সেক্রেটারির সঙ্গে প্রেম করছে কি না তা দেখার জন্যে, আর মিস্টার সেন অন্য কোম্পানিকে লাগিয়ে দিল আমাদের পেছনে। এমনই ব্যাবসা যে, শালা সামনেই এগোব না নিজের পেছন সামলাব তাই ঠিক করতেই লবেদম। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে! আজই ডিসকাশন করে নতুন লাইনের ব্যাপারটা ফয়সালা করে ফেলতে হবে।
সোমেশ বলল, গজাননকে; শুভ কাজে নামার আগে তোমার ওই সন্ত তুলসীদাস বাবাজি কলিযুগ সম্বন্ধে কী বলেন তা একটু শুনিয়ে দাও তো দেখি। তা থেকেই নতুন ব্যাবসার কোনো আইডিয়া মাথায় এসে যেতে পারে হয়তো! কে বলতে পারে?
গজানন সোন্থালিয়া দু-হাত কপালে ঠেকিয়ে সন্ত তুলসীদাসের উদ্দেশে ভক্তিভরে প্রণাম করল।
নেপেন বলল, অতিভক্তি চোরের লক্ষণ।
গজানন শুরু করল:
‘মারগ সোই কহুঁ জোই ভারা পন্ডিত স্যেই জো গাল বজারা
মিথ্যারম্ভ দম্ভ রত জোই তো কহুঁ সন্ত কহই সব কোই।’
দুস শালা। কী ভাষা রে এ! এর চেয়ে তো চাইনিজ বোঝা সোজা! মানেটা কী?
মানে হল, যার যা ভালো লাগে তাই তার পথ। মানে বিবেক-টিবেক কিছু নেই! কলিকালে তাকেই পন্ডিত বলবে সকলে, যে অহংকারী। যে মিথ্যাচারী আর ভন্ড তাকেই সকলে ভালো লোক বলবে। বলবে আহা। অমন লোক হয় না!
বা:। ঠিক। বিবেক একটি হারামজাদা। সে হারামজাদাকে গলা টিপে না মারতে পারলে আজকাল অর্থ, মান, যশ কিছুই পাবার উপায় নেই।
হক কথা। নইলে কলি কী। আরও শোনাও গজানন—
‘সোই সয়ান জো পরধন হারী জো কর দম্ভ সো বড়ো আচারী।
জো কহ ঝুঁঠ মসখরি জানা কলিযুগ সোখ গুণবন্ত বাখানা।’
আরে, মানেটা বলো না পার্টনার। তোমার শ্রাদ্ধর মন্ত্র কে শুনতে চায়?
মানে হল, এই যুগে তাকেই বুদ্ধিমান বলে, যে পরের ধন চুরি করে। অর্থাৎ চোরেদেরই বাজার এখন। যে এখন যত বড়ো ভন্ড সে তত বড়ো নিষ্ঠাবান। যে মিথ্যাবাদী এবং ফিচেল সেই কলিযুগে দারুণ গুণবান বলে পরিচিত। আরও অনেক আছে।
অনেক দরকার নেই। আর একটা শোনাও। জাস্ট একটা।
‘জে অপকারী চার, তিহ্ন কর গৌরব মান্য তেই।
মন ক্রম বচন লবার, তেই বকতা কলিকাল মহুঁ।’
অর্থাৎ যারাই এখন পরের অপকার করে তাদেরই রবরবা, গৌরব। তারাই এখন মান্য-গণ্য কেউকেটা। মনে, কথাতে এবং কাজেও যারা মিথ্যাবাদী তাদেরই কলিযুগে বক্তা বলে মানে সকলে।
নেপেন বলল, আমাদের জন্যে আইডিয়াল কণ্ডিশান মাইরি। এই বেলা টু-পাইস কামিয়ে নেওয়ার ধান্দা ঠিক করে ফ্যাল।
তারপর বলল, গজানন ভাই, তোমার ব্রেনের তুলনা নাই। সরষের তেলে শেয়ালকাঁটা থেকে মাখনে কচুবাটা এসব তো তোমারই মাথা থেকে বেরিয়েছিল একদিন।
কেন? চার ভাগ তিসির তেলের সঙ্গে একভাগ ইতালিয়ান অলিভ অয়েল মিশিয়ে ‘হুইলে ডি অলিভ’ করে বেচে গঙ্গা চাটুজ্যের ব্যাবসাটা কিনে নিল না? আমাদেরও অবশ্য টু-পাইস হয়েছিল। মিথ্যে বলব না। তবে ব্রেন তো গজাননেরই! তোমার ঝুনঝুনুর ঘিয়ে কী আছে বাওয়া? বুদ্ধি যা বেরোয় এক-একখানা! নেপেন বলল।
এবার একটা বুদ্ধি নিকলাও ইয়ার। এই সামারে ওয়াইফকে নিয়ে আমেরিকা যেতে হবে। বড়োশালি চিঠি লিখে লাইফ হেল করে দিল। মাল চাই। কুইক মাল। আজকাল বাগবাজারে একজন লোকও বের করা মুশকিল বোধ হয় যে আমেরিকা যায়নি। সবাই এত বড়োলোক হয়ে গেছে যে, বলার নয়। আমারই পেস্টিজ পাংচার একেবারে।
গজানন আবারও কিছুক্ষণ কান খোঁচাল। বলল, ডিটেকটিভ এজেন্সিটা করার ডিসিশনটা ঠিকই হয়েছিল। তবে লাইনটা বেশ কমপিটিটিভ হয়ে গেছে কিছুদিন হল। তা ছাড়া বড়ো গ্রূপ থাকলে তার একটা ইউনিট হিসেবে ওই ব্যাবসা চালাতে সুবিধা। একমাত্র ব্যাবসা হিসেবে….
একটা কথা। বিজনেস করতে হলে ক্যাপিটাল ইনপুট বেশি। ইণ্ডাস্ট্রি তো করতে চাই-ই না আমরা। কনসালটেন্সি-মেন্সি করাই আজকাল ভালো। খাটনি নেই, ক্যাপিটাল নেই; ফোকটাই টাকা। রডন স্কোয়ার, সল্টলেক স্টেডিয়ামের কথা সব পড়লি না কাগজে? গভর্নমেন্টের সঙ্গে লাইন করতে পারলেই পটাপট কাজ। তারপর লাগা লুঠ। ‘কোম্পানিকা মাল, দরিয়ামে ডাল।’
আজকাল শুধু মিনিস্টার পাকড়ালেই হবে না। অ্যাডমিনিস্ট্রেশনও হাতে থাকা চাই। জমানা খারাপ।
এবং অপোজিশনও।
একটা ইণ্ডাস্ট্রির কথা আমার মাথায় এসেছে অনেকদিন হল। এই বাজারেই ভালো চলবে প্রডাক্টটা। গজানন বলল।
কী?
গোরুর চোনার কনসেনট্রেট। কেমিক্যাল ইণ্ডাস্ট্রি। বড়ো প্ল্যান্টের দরকার নেই। সিড ক্যাপিটাল যদি পাঁচ লাখ দেখাই তো ব্যাংক আর ফিনান্সিয়াল অর্গানাইজেশনগুলো চারগুণ দেবে। কারখানা বলে একটা বাগানবাড়ি করব ব্যাকওয়ার্ড এরিয়াতে। মাঝেমধ্যে বাইজির গানটান শোনা যাবে। মেশিন তো কিনবই না। পাঁচ হাজার টাকার কমদামি ইউনিট কিনছি এইরকম দেখিয়ে সিধা প্রফিট অ্যাণ্ড লস অ্যাকাউন্টে ডেবিট করে দিয়ে পুরো ডিপ্রিসিয়েশন দিয়ে বেরিয়ে যাব। তার ওপরে সেকশন এইট্টির লুঠমার ডিডাকশন। শালার গভর্নমেন্টের এদিকও মারা হবে। ওদিকও।
সেটা বাড়াবাড়ি হবে না? আজকাল ইনকামট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট খুব কড়া হয়ে গেছে। শেষে অতিলোভ করতে গিয়ে জেলে-না যেতে হয়! সোমেশ বলল।
কলকাতার তোমরাই শালা বুদ্ধু রয়ে গেলে। দিল্লি-বোম্বে-বাঙ্গালোরে যে ফুটুনি দ্যাখো, ইম্পোর্টেড গাড়ির সারি, ফাইভ স্টার হোটেলে মোচ্ছব, তার অনেক পার্সেন্টই যে ব্যাংক মারা টাকাতে আর ভুজুংভাজুং-এ তা কি জানো? গজানন বলল।
কথাটা অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে। প্রডাক্টটা ঠিক কী? প্রডাক্টটার প্রসপেক্ট কী?
হীরেন বলল।
তোমরা কীরকম বাঙালি জানি না! কথায় বলে না, এক গামলা দুধে এক ফোঁটা চোনা! ঝুনঝুনুর লোক কি তোমাদের বাংলাও শেখাবে?
তা তো হল। কিন্তু মানে বুঝলাম না।
এখনকার মানুষের টেনডেনসিই হচ্ছে অন্যের অপকার করা। বিশেষ করে বাঙালিদের। কিছু মনে কোরো না। কারও উপকার নয়। সন্ত তুলসীদাস-এর শ্লোক শুনলে না?
হ্যাঁ। কিন্তু এখনও বুঝলাম না। খোলসা করে বলো।
চোনা থেকে, চোনার গুণাগুণ, মানে দোষাদোষ ইনট্যাক্ট রেখে আমরা একটি কালার- লেস লিকুইড তৈরি করব। ছোটো ছোটো বায়োকেমিক ওষুধের শিশিতে তা ভরে, ইয়া-বড়ো প্লাস্টিকের কেসিং করে দাম করব পঞ্চাশ টাকা। কষ্ট পড়বে হয়তো পনেরো পয়সা।
তা তো হল। লোকে কিনবে কেন?
অন্যের কর্ম ভন্ডুল করতে, আবার কেন? মনে করো তোমার জিজার বা সাড়ুভাই-এর খুব তেল বেড়েছে, খুব টাকার গরম হয়েছে, তা তার বাড়ির নেমন্তন্নে গিয়ে ডালে ফেলে দাও এক ফোঁটা। ডাল সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার মুত হয়ে যাবে। রসগোল্লা হচ্ছে কোথাও, গিয়ে ফেলে দাও এক ফোঁটা কড়াইয়ে, কেলোমোল্লা হয়ে যাবে।
কিন্তু এই প্রডাক্টের বিজ্ঞাপনই-বা দেবে কী করে গজানন? এ প্রডাক্ট তো অ্যাডভার্টাইজ করতে পারবে না।
গুলি মারো তো! আজকাল যেসব অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সি হয়েছে না! সব উইজার্ডস। নর্দমার জল বেচতে বলো তাও বেচে দেবে। এখন বিজনেসের আসলি কথা হচ্ছে প্যাকেজিং আর অ্যাডভার্টাইজমেন্ট। প্রোপাগাণ্ডা আর মলাটই সার কথা। মধ্যে যে মালই থাকুক। আরে—আমার বড়োশালার বড়োশালার ছেলে ছারপোকা মারার ওষুধ বের করেছে। ছোটো ছোটো হোমিয়োপ্যাথিক ওষুধের পুঁচকে পুঁচকে শিশিতে লাল-নীল-সবুজ নানারঙা ওষুধ ভরা থাকে। দাম পাঁচ টাকা। এজেন্সি টিভি-তে যা অ্যাড করল তা কী বলব? সেই পঁচিশ বছরে ছোকরা কোটিপতি হয়ে গেছে ছ-মাসে।
ছারপোকা নিশ্চয়ই মরে তাহলে। নইলে কী আর…
হ্যাঁ মরে বই কী। গজানন বলল, হেসে। ওষুধের নাম ‘খটমি।’ হিন্দিতে ছারপোকাকে তো ‘খটমল’ বলে। তা থেকেই ‘খটমি’। ওষুধের গায়ে দারুণ কাগজে ব্যবহারবিধি লেখা থাকে। ‘সাবধানে ছারপোকা ধরে, সযতনে মুখ হাঁ করিয়ে, এক ফোঁটা গিলিয়ে দেবেন। মৃত্যু অনিবার্য।’
হীরেন হো-হো করে হেসে উঠল। গজাননের কথা শুনে হাসল অন্যরাও।
হাসবার কী আছে? এইটাও তোমাদের বেঙ্গলি পোয়েট সুনির্মল বসুর কোনো গল্প থেকে নেওয়া। এখন তো মারামারিরই দিন! কিন্তু এজেন্সি একটি ল্যাজোয়াব সুন্দর মডেলকে দিয়ে গ্রামের মাটির ঘরে ব্যাকগ্রাউণ্ডে দড়ির খাটিয়ার সামনে নাচিয়ে নাচিয়ে গান গাওয়াল। দারুণ সুরে।
‘হাই! খটমল! খটমল।
খটমি লেতে আও।
জলদি লেতে আও।
ঔর চৌপাইমে ওরওয়াক্ত
বিবিকি গোড় দাবাও।’
আহা! আর কী মিউজিক! মডেলের কী দারুণ লো-কাট ব্লাউজ। একটু একটু দেখা যাচ্ছে। খটমল-এর বাপের সাধ্য কী তারপরও বাঁচে। জাতে পুংলিঙ্গ হলে তো কথাই নেই।
কই টিভি-তে ওই অ্যাড দেখিনি! ন্যাশনাল নেটওয়ার্কে দেখায় বুঝি?
না না। শুনেছি বিহার আর উত্তরপ্রদেশে দেখায়। লোকালি এই ‘খটমি’ নাকি ক্যান্টার করে দিয়েছে।
ওই অ্যাড এজেন্সির নাম কী? নেপেন শুধোল।
‘দা ইমপসিবল (প্রা.) লিমিটেড।’ এলাহাবাদের সিভিল লাইনস-এ অফিস।
হীরেন ভুরু কুঁচকে ভাবছিল।
বলল, গজানন আজ তুমি তোমার আত্মীয়স্বজনের বিজনেস এবং ইণ্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাচিভমেন্ট নিয়েই অত্যন্ত ওভারহোয়েলমড হয়ে আছ। আমাদের নতুন ভেঞ্চার যে কী হবে সে বিষয়ে একটুও এগোনো যাচ্ছে না।
বলেই, নেপেন আর সোমেশের দিকে চেয়ে বলল, তোরাও কিছু সাজেস্ট কর। ব্যাবসাটা তো গজাননের একারই নয়! ওর ওপরেই যদি সব দায়িত্ব চাপিয়ে বসে থাকিস তবে আমরা কী করব? টাকার সিংহভাগ দেবে ও, ব্যাংক লোন জোগাড় করবে ও; গভর্নমেন্ট লেভেল-এ সকলকে ম্যানেজ করবেও ও; তো আমরা করবটা কী? ঘণ্টা?
সোমেশ রেগে বলল ছাড় তো! যেন এমনি এমনিই করে! ওর তিন নম্বর রোজগারও তেমন কত তা কি তুই জানিস?
তিন নম্বর?
গজানন অবাক গলায় প্রতিবাদ করে উঠল।
ইয়েস। তিন নম্বর।
মানে?
দু-নম্বরের একটা পার্ট ও মারে না? দু-নম্বর মারলে তা কত নম্বর হয়? হয় না তিন নম্বর?
গজানন বলল, শাব্বাশ সোমেশ! এই নইলে বাঙালির ব্রেইন। তা লাইন একটা বাতলাও-না নতুন। ব্রেইনের তারিফ করব আরও।
সোমেশ বলল, তোমার ওই গোরুর চোনার কনসেনট্রেট ব্যাপারটা আমাকে অ্যাপিল করছে না। অন্য কিছু বলো।
আমি ভাবছি। তোমরাও ভাবো। তবে আমি তোমাদের সঙ্গে একমত। বিজনেস বা ইণ্ডাস্ট্রির চেয়ে কনসালটেন্সি লাইনই ভালো। আজকাল ওইসবেরই দিন। কম্পিউটার টেকনোলজি, ইনভেস্টমেন্ট এজেন্সি, ল্যাণ্ড বিল্ডিং-এর কনসালটেন্সি। ছিমছাম অফিস করব। কুড়ি-জনের কম স্টাফ। প্রভিডেন্ট ফাণ্ড নেই, ই.এস.আই নেই, ইউনিয়নের ঝুটঝামেলা নেই। এয়ার-কণ্ডিশণ্ড অফিস। স্মার্ট সুন্দরী রিসেপসনিস্ট।
হীরেন বলল, দুস শালা! গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল।
হঠাৎ নেপেন বলল, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। চলবে?
কী? কনসালটেন্সি?
হ্যাঁ রে।
বল। বল। চুপ করে আছিস কেন?
নেপেন দ্রুত হাতে সিগারেটের প্যাকেট বের করল পকেট থেকে।
ছেড়ে দিয়েছিস বললি না সেদিন।
সত্যিই দিয়েছি। কিন্তু এইরকম এমার্জেন্সি থিংকিং-এর সময়ে—বুঝতেই পারছিস।
বুঝেছি। বল এবার।
নেপেনের সিগারেটে আগুন ধরিয়ে দিয়ে দিল সোমেশ এমনই যত্নে যেন বাপেরই মুখাগ্নি করছে।
নেপেন সিগারেটে একটা মস্ত টান লাগিয়ে বলল, আজকের সবচেয়ে বড়ো আধুনিক অস্ত্র কী বল তো শত্রুনিধনের? মানে শত্রুকে শেষ করার বেস্ট উপায় কী?
কী? নিউক্লিয়ার বম? গজানন বলল।
ইডিয়ট।
সেলফ-লোডিং রাইফেল। এস.এল.আর.? হীরেন বলল।
স্টুপিড!
বোমা। লেটার-বম্ব।
যাচ্ছেতাই!
অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে সিগারেটে আর এক টান দিয়ে বলল, নেপেন। কী তবে?
ক্যারেকটার-অ্যাসাসিনেশন। চরিত্র হনন। এই হত্যা এমনই এক জিনিস যে, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট বা বুলেটপ্রুফ বক্স বা গাড়ি বা কম্যাণ্ডো কোনোকিছুর সাহায্যেই এই মৃত্যুর হাত থেকে কেউ বাঁচতে পারে না।
সকলেই হো-ও-ও-ও করে চেঁচিয়ে উঠল নেপেনকে কনগ্র্যাচুলেট করে।
গজানন বলল, এইজন্যেই বলি! আমার দাদামশাই সাঙ্গেনারিয়াজি বার বার বলতেন ব্যাবসা করবে বাঙালিদের বুদ্ধি নিয়ে। ওরা জিনিয়াস। ‘কম খাঁই কিন্তু বুদ্ধিতে দুসরা নাই।’
নেপেন বলল, কথা বোলো না এখন গজানন। আমার কনসেনট্রেশন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তোমরা সকলেই লক্ষ করে থাকবে যে, প্রতিমুহূর্তে আমাদের চারপাশে, স্বামী-স্ত্রী, উকিল-জজ, ব্যাবসাদার, ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, সম্পাদক-সাংবাদিক-সাহিত্যিক, খেলোয়াড়, ম্যানেজার, ক্যাপ্টেইন, বোলার, ব্যাটসম্যান, গুরু-শিষ্য, উপাচার্য, অধ্যাপক, মাস্টারমশাই-ছাত্র সমানে একে অন্যের চরিত্র হননের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই অপচেষ্টা চলেছে একই পেশার লক্ষ লক্ষ মানুষেরও মধ্যে। প্রতিমুহূর্তে।
আর বলতে হবে না তোকে। বুঝেছি আমরা। চতুর্দিকে এভরি মিনিট যে রেটে মানুষের চরিত্রের মৃত্যু ঘটানো হচ্ছে, মানে চরিত্রকে খুন করা হচ্ছে অথবা খুনের চেষ্টা করা হচ্ছে সেই রেটে ভারতবর্ষ বা চায়নার মেয়েরা কনসিভও করছে না। অনেক সময়ে এই হত্যা কীভাবে করা হবে তার বিরুদ্ধ পক্ষ ঠিক করেই উঠতে পারে না। ইচ্ছে থাকলেও শক্তি থাকে না। স্ট্র্যাটেজিতে গোলমাল করে। অনেক জায়গায় অত্যন্ত ক্রুড ওয়েতে চরিত্রের মৃত্যু ঘটানো হয়, অনেকটা ভারী হাতুড়ি দিয়ে মানুষের শারীরিক মৃত্যু ঘটানোরই মতো। ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেশন আজকে একটা আর্টের পর্যায়েই পৌঁছেছে। অন্তত পৌঁছোনো উচিত। এবং এই লাইনে যদি আমরা স্পেশালাইজ করি তো কোনো শালার ব্যাটা শালার সাধ্য নেই যে আমাদের রোখে। আমরাই এই আর্টকে পারফেক্ট করব। পরে, সারাদেশে এবং পৃথিবীতে ব্রাঞ্চ খুলব।
গজানন উত্তেজিত হলেই ‘ক’ কে ‘খ’ উচ্চারণ করে চিরদিনই।
ও বলল, কিন্তু খি করে খি হবে? মোডাস অপারেণ্ডি ঠিখ খরা….
নেপেন বলল, আমরা কনট্রাক্ট নেব ক্যারেকটার অ্যাসাসিনেশনের। মিনিমাম রেট পাঁচ হাজার টাকা। তারপর পার্টি বুঝে পাঁচ লাখও নিতে পারি। তুই কিন্তু পলিটিক্যাল লাইনের লোকদের কথা ভুলে যাসনি। ওই এরিয়াতেও আমাদের ব্যাবসার প্রচন্ড পোটেনশিয়ালিটি আছে। বিশেষ করে ইলেকশনের আগে।
হীরেন বলল।
হ্যাঁ। সেইসব ক্ষেত্রে কিন্তু মিলিয়নে হাঁকব আমাদের ফিস। পার্টিদের টাকার অভাব কী?
সোমেশ বলল, ওরে গজা! আমাদের নেপেনের ব্রেইন দেখলি! ও চলেই যাক আগামী সামারে ওর ওয়াইফকে নিয়ে সিস্টার ইন ল-এর কাছে। আমেরিকাতে। অন দ্যা হাউস। দা কোম্পানি উইল বেয়ার অল এক্সপেনসেস। ক্লাব-ক্লাসের টিকিট কেটে দেব আমরা তোকে নেপেন।
সকলে সমস্বরে বলল, নিশ্চয়ই। একশোবার।
গজানন বলল, কিন্তু নাম কী হবে কোম্পানির? ক্যারেকটার অ্যাসাসিনেশন প্রা. লি.?
যা:। লোকে ধরে ফেলবে না! কাজটা তো গোপনীয় এবং ডেঞ্জারাস। একটা ডিসক্রিট নাম দিতে হবে।
আমরাও একটা আর্মড-উয়িং রাখব। টাকা রোজগার করতে ভয় পেলে চলে?
একটা দিশি-দিশি গন্ধের নাম দে। ওই নামটা চলবে না। এমন একটা নাম যে, দিশি-বিদিশি সকলেই ইনকুইজিটিভ হবে।
তাহলে কী? চরিত্রহনন প্রা. লিমিটেড? হীরেন বলল।
আজ সকালে সন্ত তুলসীদাসের রামচরিতমানসের শ্লোক বলেছিলাম তো, চরিত্রর বদল চরিত দিলে কেমন হয়?
নেপেন আর একটা সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিল, গজানন ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, বাজে সিগারেট খেয়ো না ভাই। আমি ক্লাসিকস আনিয়ে দিচ্ছি। রাম সিং….
তা আনাও। ততক্ষণে একটা খেয়ে নিই। ভীষণ টেনশনে আছি।
বলেই, নতুন সিগারেট ধরিয়ে একটা কলকে-ফাটানো টান দিয়েই নেপেন বলল, পেয়েছি নাম।
কী?
চরিতখেকো অ্যাণ্ড কোং। ‘খেকো’ কথাটাতে বেশ ম্যান ইটার ম্যান ইটার একটা গন্ধও থাকবে। আর ইংরেজিতে সাইনবোর্ড ও লেটারহেড হলে নামটাকে ইনোসেন্টও দেখাবে।
বলেই বলল, লেখ তো সোমেশ। দেখা যাক, লিখিতভাবে কেমন দেখায়?
সোমেশ লিখল, charit-kheko and co.
হীরনে বলল, বা:।
গজানন বলল, ওয়াহ। ওয়াহ। জয় সন্ত তুলসীদাসকি জয়। খি খারবার!