আখরিগঞ্জ

আখরিগঞ্জ

এই জন্যেই আজকাল ভালো লাগে না তোমাকে।

মেহগনি বলল।

কেন?

অন্যমনস্ক গলাতে বলল, উজলা।

কেন আবার কী? এতক্ষণ ধরে একটা গান গাইতে বলছি আর তোমার গ্রাহ্যই হচ্ছে না। আমি যদি গাইতে জানতাম তবে এতক্ষণে…

জারুল বলল, তুমি যদি গান জানতে দাদা তবে আমরা যে দুঃসাহস করে তা শুনতে চাইতামই এমন কথা নিশ্চয় করে বলা যেত কি! পম্পলাল বৈদ-এর বেতোঘোড়ার বাত একবার ভালো হয়ে গেছিল না তোমার গান শুনে?

উজলা তবুও নিরুত্তরই রইল।

কিন্তু আঁধার আর নৈঋত খুব জোরে হেসে উঠল।

কী জানি বাবা! আমি যে গায়ক নই, তা তো সকলেই জানে। আর নই বলেই তো ভালো গান শুনতে এত ভালবাসি। গাধা নিজে গাইতে পারে না বলে তো গান শুনতে তার বাধা নেই। নাকি আছে?

ফরমাস করামাত্রই গান গাইতে পারি না আমি। তা ছাড়া, সব জায়গায় যখন তখন কি গান হয়!

তুমি গায়িকা কি না, সে সম্বন্ধে আমার সত্যিই সন্দেহ হয়। যার ভিতরে গান আছে, এমন শ্রাবণের সকালেও তার বুকের মধ্যে গান যে গুমরে ওঠে না কেন, তা আমার সব বুদ্ধির বাইরে। এমন শ্রাবণে আমার মতো বেরসিকও শ্রাবণাহত হয়ে যাই আর তুমি…। গান মানেই কি মাইক, হারমনিয়াম, তবলা, এস্রাজ, মঞ্চ, অনেক আলো? অনেক শ্রোতা? যিনি গায়ক বা গায়িকা তিনি তো এমন দিনে নিজে থেকেই গুনগুনিয়ে উঠবেন, বিশেষ করে, রবীন্দ্রনাথের গান যিনি শিখেছেন।

উজলা বলল, গাড়ির জানালা দিয়ে আসা হু-হু হাওয়াতে বুকের আঁচল ঠিক করতে করতে, স্বভাব-গায়কের কথা বলছ তুমি মেহগনিদাদা! আমি স্বভাব গায়ক নই।

কেন?

সঠিক বলতে পারব না তবে হয়তো স্বভাব-কবি আর স্বভাব-গায়ক এই দুই-ই একই পাড়ার বাসিন্দা বলেই, আমি স্বভাব-গায়ক নই।

উজলার ছোটো ভাই আঁধার বলল, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আর চলেও না। তোমরা যা-ই বল। রবীন্দ্রনাথ ব্যাপারটাই একটা ‘ক্লিশে’ হয়ে গেছে।

না চললেই তো আনন্দের কথা হত, কিন্তু সত্যিই যে চলে না আজও তাঁকে ছাড়া। কী করা যায় বলো আঁধার।

মেহগনি বলল।

জারুল বলল, তা ছাড়া তুমি চালাবার চেষ্টাই বা করলে কবে? জানিনি তো!

সেকথার জবাব না দিয়ে আঁধার বলল, সুমনের গান! ছাঁচ ভেঙে ফেলো। নতুন কিছু করো।

পুরোনো ছাঁচ ভাঙার আগে তো নতুন ছাঁচ বানিয়ে নেওয়ারও দরকার আছে। না কি নেই? সুমনের গানকে খারাপ বলছি না কিন্তু তোর যে তুলনাতত্ত্ব সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র জ্ঞানও নেই তা আমি সেদিনই নিশ্চিত বুঝেছিলাম যেদিন তুই আর্জেন্টিনার খেলা দেখতে দেখতে মাঝরাতে মারাদোনার সঙ্গে উচ্চিংড়ের তুলনা করেছিলি।

মেহগনি বলল।

গাড়িসুদ্ধ সকলেই হেসে উঠল। এমনকী স্টিয়ারিং-হাতে বসা, সরু পথ দিয়ে সাবধানে, মনোযোগের পরাকাষ্ঠা করে গাড়ি চালানো নৈঋতও।

মেহগনি বলল, মারাদোনার সঙ্গে উচ্চিংড়ের তুলনার হেতুটা কী ছিল?

তুলনাতত্ত্ব যদি সকলেই বুঝত!

ছাগল।

কে?

তুই।

ছাগল না বলে গাড়ল বলো।

আচ্ছা, এই গাড়ল শব্দটির সঠিক মানে কি কেউই জানিস?

না। বাংলা বানান অথবা বাংলা শব্দের সঠিক মানে যদি জানতে চাও তাহলে বহরমপুরে ফিরেই হরিষদাকে শুধোতে হবে।

এই হরিষদাটি কে?

আঁধার শুধোল।

ইরিগেশান ডিপার্টের ওভারশিয়ার।

মেহগনি বলল।

ইরিগেশান ডিপার্টের সঙ্গে বানানের কী সম্পর্ক বা শব্দর মানের? আশ্চর্য! তিনি কি আধুনিক কবি? না আমাদের কলকাতার সর্বজ্ঞ সেন-এর মতো চকচকে বৈয়াকরণ?

আঁধার বলল।

তা কেন? উনি বহরমপুরের ইরিগেশান ডিপার্টেই কাজ করেন। বললাম তো ওভারশিয়ার। হরিষ পালিত।

বিষাদ, বিষাদ পালিতের কেউ কি হন?

কোন বিষাদ পালিত?

আরে যাকে নটেরা ইয়ার্কি করে নাম দিয়েছে কনস্টিপেশান পালিত।

তা ঠিক জানি না। তুই তো বল নিয়ে মাঠে এগোতেই দিস না, অদ্ভুত স্বভাব।

আসলে তুই একটা জিনিসও কি ঠিক জানিস?

উনি কাজ করেন পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টে। সেটা ঠিকই জানি।

পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্ট মানে? যাঁরা প্রতিবছরই ঠিকাদারদের বাঁ-হাতে হাত রেখে সেতু বানান। আর বাঁধ। পরের বছরের গোড়াতেই সব ধুয়ে যাবে বলে? ধোওয়া-ধুয়িতে অভ্যস্ত এমন শুচিবাইগ্রস্ত ডিপার্ট কিন্তু আর একটিও নেই। কিন্তু তোদের হরিষ পালিতের সঙ্গেই বা বাংলা বানানের সম্পর্ক কী?

বাংলা বানানের ক্ষেত্রে বঙ্গভূমে বর্তমানে যা নৈরাজ্য চলেছে তাতে পান্ডিত্যের পিটপিটানি এবং বৈয়াকরণদের ব্যায়াম থেকে বাঁচতে বাঁধ বা সেতুরই দরকার এখন।

কেন?

কেন কী! যা অবস্থা হয়েছে এখন, ‘‘বাবা’’ বানান লিখতেই কনফিউজড হয়ে যাব কিছুদিনের মধ্যেই। ‘‘ব্যা ব্যা’’ বা ‘‘বা: বা:’’-ই লিখে ফেলব হয়তো।

সকলে আবারও একসঙ্গে হেসে উঠল। এমনকী নৈঋতও।

নৈঋত বলল, সত্যি। তোর, আঁধার নামটি কাকাবাবু মিথ্যে রাখেননি।

‘‘বাবা’’ বানান ভুললেও ক্ষতি নেই। বাবার নামটি যেন ভুলিস না।

মেহগনি বলল, হাসতে হাসতে।

আবারও সকলে একসঙ্গে হেসে উঠল মেহগনির কথাতে।

আসলে আজ সকালের মিছিমিছি ঝগড়ার বা হাসির বা নীরবতার কোনোই বিশেষ কারণ নেই, মানে নেই।

কলকাতা থেকে তিনদিনের ছুটিতে আঁধার আর উজলা দু-ভাইবোনে এসেছে ওদের পিতৃবন্ধু জ্যোতির্ময়কাকার কাছে, বহরমপুরের পিলখানা রোডে। নৈঋত নন্দী জ্যোতিকাকারই ছেলে। এখানে তাঁদের লব্ধপ্রতিষ্ঠ পৈতৃক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছে নৈঋত। মেহগনি আর জারুল নৈঋতদের প্রতিবেশী। খুবই মাখামাখি আছে। জারুলের ছেলেবেলাটা কিন্তু কেটেছে উজলা আর আঁধারদের প্রতিবেশী হিসেবেই। কলকাতার চেতলাতে। বহরমপুরে নয়, জারুল মামাবাড়িতেই থাকত, চেতলাতে, বাবার মৃত্যুর পরে। বড়োমামা অধ্যাপক ছিলেন। তাই মা জোর করেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ওকে কলকাতাতে মানুষ হওয়ার জন্য। হয়তো মানুষ হয়েছেও। কিন্তু আজকাল যে ধান্দাবাজ নয়, পয়সা কামানো জানে না, তাকে তো আর মানুষ বলে মানে না কেউই! পয়সা, নাম এবং ক্ষমতাই হচ্ছে এখন মনুষ্যত্বের পরাকাষ্ঠা।

শৈশব থেকে যৌবনের প্রথম অবধি জারুল উজলাকে খুবই কাছ থেকে জেনেছিল। কালো, সাধারণ চেহারার কিন্তু ভারি উজ্জ্বল একটি মেয়ে। ওর মা-বাবার দেওয়া উজলা নামটি শুধু আনকমোনই ছিল না, ওর স্বভাব ও চেহারার সঙ্গে আশ্চর্য মানিয়েও গেছিল। অত্যন্ত সুরুচিসম্পন্ন, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, সভ্য, ভদ্র মেয়ে ছিল ও। পড়াশোনাতে যদিও সাধারণ ছিল তখন উজলা, জারুলেরই মতো। সেই জন্যে তো বটেই, মানসিকতার মিলের জন্যেও এক ধরনের বিশেষ নৈকট্য, আত্মীয়তা অনুভব করত জারুল ওর সঙ্গে। কতখানি অনুভব করত তখন ঠিক বোঝেনি। তবে, উজলা হঠাৎ বেগবতী-হওয়া প্রপাত-পাওয়া নদীরই মতো গ্র্যাজুয়েশনের সময়ে খুবই মেধাবী হয়ে যায়। সেকথা, জারুল বহরমপুরে বসেই শুনেছে। মানুষের জীবনের গতি নদীরই মতো। কে কোথায় কখন যে বাঁক নেয়, প্রপাত পায়, বা মরা সোঁতায় মিলিয়ে যায়, তা আগে থেকে বলা ভারি মুশকিল। কলকাতাতে থাকাকালীন সেই যে নৈকট্যবোধ ছিল, উষ্ণতা, আজ প্রায় একযুগ পরে ভরন্ত, আরও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পূর্ণযুবতী উজলাকে হঠাৎ দেখে সেই উষ্ণতার গভীরতা নতুন করেই আবিষ্কার করেছে জারুল। এবং করে, চমকে গেছে।

জারুল শিশুকাল থেকেই একটু কবি-কবি স্বভাবের। বহরমপুর থেকে খুব ভালো কয়েকটি লিটল-ম্যাগ বেরোয়। ও নিয়মিত লেখালেখি করে সেসবে। সাধারণভাবে বি. এ. পাস করে চাকরি-বাকরি পায়ওনি, তাই আপন দাদারই মতো, প্রতিবেশী নৈঋতদা, তাকে তাঁর ব্যবসায়ে সহকারী হিসেবে নিয়ে নিয়েছেন। জারুলের দাদা মেহগনি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করে। সততা ছাড়া জারুলের মধ্যে অন্য কোনো গুণ বা যোগ্যতাই ছিল না উল্লেখ করার মতো। তবে নৈঋতদা বলেছিল, সততার যোগ্যতাই যথেষ্ট যোগ্যতা আজকাল। এবং অবশ্যই দুষ্প্রাপ্যও বটে। তোমাকে আমার দরকার।

অনেকই বদলে গেছে এই একযুগে উজলা। জীবনের এই সময়ের বারোটি বছর সাংঘাতিক। সব দিক দিয়েই সাংঘাতিক। উজলা, মেয়ে বলেই, জল পাওয়া রাবার গাছের মতো বেড়ে উঠেছে শরীরে, ঘন হয়েছে তার মনের পাতার ঘের, গাঢ় হয়েছে তার গলার স্বর, ব্যক্তিত্ব।

বদলেছে জারুলও। তবে কলকাতা থেকে মফস্বল শহরে এসে ওর বাড়টার রকমটা একটু ভিন্ন হয়ে গেছে। উজলা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পড়াশুনোতে ভালো যেমন হয়েছে, তেমন ওর মনের ডালপালাগুলি নানাদিকে ছড়িয়েও গেছে, আলো-চাওয়া শাখা-প্রশাখারা যেমন যায়। পুনে ফিল্ম ইনস্টিট্যুটে চান্স পেয়ে গেছে উজলা। চলে যাবে সেখানে ক-দিন পরেই। প্রফেশনাল অভিনেত্রী হবে। কলকাতাতে বাংলাতে এবং গানে বি. এ. করে শান্তিনিকেতনে চলে যায় ও। নৃত্যগীতের শিক্ষা শান্তিনিকেতন থেকেও শেষ করে এসেছে। সেখানের প্রকৃতি তার ব্যক্তিত্বকে অন্য এক মাত্রা দিয়েছে। লক্ষ করে আবিষ্ট হয়ে গেছে জারুল।

অভিনেত্রী হয়তো উজলা ছিলই। হয়তো অধিকাংশ মেয়েই ভালো বা খারাপ অভিনেত্রী। কিন্তু আজকের উজলার চরিত্র এবং চলন-বলন এমনই হয়ে উঠেছে যে, তার কোনটুকু যে অভিনয় আর কোনটুকু প্রকৃতি তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না জারুল। আর পারছে না বলেই তা বোঝার জন্যে ভারি একটা জেদ চেপে গেছে যেন। যে ভ্রমর, ফুলের রেণুতে একদিন চুমু খেয়েছিল, সে যেমন অচেনা ফলের দিকে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকে, তার ফুলটি কেমন ছিল তা মনে করার আপ্রাণ চেষ্টা করে, জারুলও তেমনি অবাক বিস্ময়ে আর অক্টোপাসি মনের অসংখ্য হাত মেলে উজলাকে মনের কাছে পাওয়ার অনুক্ষণ চেষ্টা করছে। এই বারো বছরে জারুলের বাড়টা হয়েছে ভেতরের দিকে। বাইরে সেই বাড়-এর সাড় বিশেষ পাওয়াই যায় না। অথবা, অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, ওর বাড়টা ওর স্বনামের গাছ জারুলের মতো আদৌ হয়নি, হয়েছে বাওবারের মতো। দা আপসাইড ডাউন ট্রি! আর উজলা বেড়েছে পাতাবাহারের মতো অথবা পনসটিয়ার মতো। উচ্ছল, উদ্বেল, চাকচিক্য পেয়েছে অনেকই। এতই বেশি যে, মনের ছায়াচ্ছন্ন গভীর জঙ্গলের ছায়ার সঙ্গে একীভূত হয়ে-যাওয়া, মিশে-থাকা জারুল যেন শৌখিন বড়োলোকের বাড়ির কেয়ারি-করা রৌদ্রোজ্জ্বল বাগানের মধ্যের রোদ-ঝলমল উজলার বেড়ে-ওঠা ঝাড়ের দিকে ভালো করে তাকাতেও লজ্জা পাচ্ছে। চোখ ঝলসে যাচ্ছে যেন উজলার ঔজ্জ্বল্যে।

কাল সকালে বহরমপুরে প্রথমবার দেখা হওয়ার পরেই সপ্রতিভ, সজীব, কৃতী উজলা সকালবেলার আলোর মধ্যে জ্যোর্তিময়কাকাদের বাড়ির একতলার মস্ত খোলামেলা, বাগান-সংলগ্ন বারান্দাতে দাঁড়িয়ে বলেছিল, তুমি আগের থেকেও অনেক বেশি ইনট্রোভার্ট হয়ে গেছ জারুল।

জারুল, না-বলে, মনে মনে বলেছিল, তুমিও হয়েছ। কিন্তু রাবার গাছের গাঢ় সবুজের ছায়ার অন্তর্মুখীনতা ঢাকা পড়ে গেছে পনসাটিয়ার বহির্মুখীনতাতে। যে তোমাকে তেমন করে বুঝছে, শুধু সে-ই একথা বুঝবে। তা ছাড়া, তুমি যে অভিনেত্রী! অপেশাদারিত্ব, পেশাদারিত্বর দিকে ছুটে চলেছে বর্ষার নদীরই মতো। এই পদ্মারই মতো। যে-নদী দেখতে চলেছি আমরা আজ সকালে, আখরিগঞ্জে। তুমি আসলে যে কী, তোমার মনের গভীরে ছায়া আছে না রোদ, রাবার না পনসাটিয়া; তা লুকিয়ে রাখাই তো তোমার অভীষ্ট। আগে-যা শখ ছিল, এখন সেই শখকেই পেশা করে তুলতে চলেছ।

শখকে পেশা করা কি ভালো হবে উজলা?

না না, চলিতার্থে কোনো প্রেম-ট্রেম ছিল না ওদের মধ্যে। এখন এই বয়সে পৌঁছে, প্রেম কাকে বলে সে সম্বন্ধে জানার আভাস পাওয়ার পর সেই প্রাপ্তি যে খুব কম মানুষই জীবনে পায়, একথা জারুল বোঝে। তাই, তা পাওয়ার জন্যে কোনোরকম কাঙালপনাই নেই। আজকাল ছেলে-মেয়েরা ‘ইচ্ছে’ হলেই প্রেম করে। কিন্তু প্রেম কখনো কখনো ‘হয়ে যায়’ বলেই জারুলের বিশ্বাস।

ও হয়তো অন্যরকম।

জারুলের সমসাময়িক যুবক-যুবতীরা ‘কেরিয়ার’ বোঝে ‘ভালো থাকা’ ‘ভালো খাওয়া’ ‘সচ্ছল জীবনযাত্রা’র কথা বোঝে, ‘জীবিকার জন্যে’ বিদ্যা, পান্ডিত্য, চাকরিতে উৎকর্ষর কথা বোঝে ; এইসব নিয়েই স্বপ্ন দেখে তারা কিন্তু প্রেম নিয়ে কোনো ‘বোকা বোকা সেন্টিমেন্ট’ তাদের মধ্যে অধিকাংশরই নেই. কিন্তু অধিকাংশর দলে কোনোদিনও ভিড়তে চায়নি জারুল। জীবনটা, কী যুবকের, কী যুবতীর অনেকই বেশি প্রয়োজনের, চাহিদার এবং প্র্যাগম্যাটিজম-এর হয়ে গেছে। এই আবর্তের মধ্যে প্রেম বলে নির্ভেজাল কোনো অকাজের বোধকে বাঁচিয়ে রাখার আশা, দুরাশা ছাড়া বোধহয় আর কিছুই নয়। এখন সব নারী-পুরুষের মনের মধ্যেই পাওয়ার-টিলার দিয়ে চাষ করা হয়। প্রত্যন্ত প্রদেশের ঘাস বা ফুলও উপড়ে যায় তাতে। লজ্জাবতী লতারা যে, কোনো ছায়াচ্ছন্ন কোণে নিশ্চিন্তে বেঁচে থাকবে এমন সম্ভাবনাই আর নেই! এখন ভুট্টা আর গাজর, পাট আর ধান চাষের যুগ, ‘ক্যাশ ক্রপস’দের। লজ্জাবতী লতাদের, ঘাসফুলের অন্তর্মুখী, শান্ত, স্নিগ্ধ জীবন তামাদি হয়ে গেছে পুরোপুরিই এখন।

কী রে বাবা! তুমি যে একেবরে চুপ মেরেই রইলে সেই তখন থেকে। কী হল জারুলদা? দাঁতে ব্যথা নাকি?

ফাজিল আঁধার বলল, জারুলের চিন্তার জাল ছিঁড়ে দিয়ে।

উজলার সহোদর আঁধার, সিটি কলেজে বি. কম পড়ছে, পার্ট টু পাস করার পরে, এম. বি. এ. করার ইচ্ছে আছে। আহমেদাবাদে যেতে চায়। এখন সকলেই কোথাও না কোথাও যেতে চায় পড়তে, আগে যেমন সকলে কলকাতাতেই আসত সারাভারত থেকে। পড়াশুনোর পরিবেশই নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে নিজরাজ্যে! ভাবলেও ভারি দুঃখ হয় জারুলের।

কী! জারুলদা?

ভাবছি।

কী ভাবছ অত!

উজলা বলল।

জারুল বলল, কী যে ভাবব, তাই ভাবছি।

ভাবো তুমি! ততক্ষণে আমি আরেকটা সিঙাড়া খাই। সত্যি বলতে কী, এত ভালো মাংসের সিঙাড়া কোনোদিনও খাইনি। আমি এমন কোনো মেয়েকেই বিয়ে করতে চাই যে, জ্যোতিকাকিমার মতো রান্না করতে পারে।

বাবা! তোর মতো মিথ্যেবাদী দুটো হয় না।

ঝলসে উঠে উজলা বলল।

আঁধার বলল, মিথ্যে কথায় তুই আমার চেয়ে অনেকই বড়ো দিদি। কিন্তু যেহেতু তুই অভিনয় করিস তাই আমরা তোর সত্যি-মিথ্যাটা বুঝতে পারি না। আমি অভিনেতা নই বলেই তুই আমার মিথ্যেটা সহজে ধরে ফেলতে পারিস। তা, মিথ্যেবাদী বলার কারণটা কী?

রোশনি তো চা করতেও জানে না। বলে, পাঁউরুটি আর মাখন খেয়ে থাকবে।

তা না-ই বা জানল, রোশনির সঙ্গে আমার কী?

বাবা:। তা, আমি কী করে জানব। লোকে তো বলে সে-ই তোর প্রিয়তম বান্ধবী। মা বলেন, তুই কার্নিক খেয়েছিস ওই দিকেই।

হা:। কত রোশনি জীবনে আসবে, কত যাবে এই রওনাকের জীবনে! আমার নামই যে আঁধার। বিয়ে-ফিয়ের টার্মস-এ বুড়োরা ভাবে। এখনই সেসব কী।

এখন তাহলে কী?

নৈঋত বলল।

তোমাদের দিন তো নেই নৈঋতদা। তা ছাড়া আমার তো আর ফ্যামিলি বিজনেস নেই তোমার মতো! এখন শুধু একটাই চিন্তা। পায়ে দাঁড়ানো। কেরিয়ার। সেটা হলে বিয়ের মতো মাচ লেস ইম্পর্ট্যান্ট ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে পরেই ভাবা যাবে। আমরা পায়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বিয়ে-ফিয়ের মতো প্রি-হিস্টরিক কনসেপ্টটার কথাই হয়তো ভুলে যাবে মানুষে। ডিসকার্ডেড হয়ে যাবে। সেদিন দেখলে না, বৃহস্পতি কেমন গোঁত্তা খেল? কে কখন পৃথিবীকে গোঁত্তা মারে দেখো! অতদূর অবধি ভাবার দিনকাল আর নেই। দিনকাল বদলে গেছে নৈঋতদা। এখন আগামী দিনটিই ভবিষ্যৎ, ভাবীকাল। তার চেয়ে বেশি দূর অবধি দেখার বা জানার উপায়ই নেই কোনো।

জারুল বলল, ঠিকই বলেছে আঁধার। সত্যিই বদলে গেছে দিনকাল। বড়ো তাড়াতাড়িই বদলে গেল।

আঁধার বলল, তাড়াতাড়ি বদলায়নি। আসলে তোমরা খুবই আস্তে হেঁটেছ হয়তো, ক্যুডনট কীপ-আপ উইথ দ্যা পেস, তাই মনে হচ্ছে, তাড়াতাড়ি বদলেছে। সময়ের সঙ্গে সমান তালে পা ফেলে হাঁটারই আরেক নাম হচ্ছে আধুনিকতা, বুঝেছ জারুলদা!

কলকাতার ছেলেরা বড়ো পাকা আর সবজান্তা হয়। এবং তাদের মধ্যে গভীরতাও ক্রমশই কমে আসছে। তবে আঁধার ছেলেটার মধ্যে গভীরতা আছে।

ভাবল, জারুল।

এই! কোনদিকে মোড় নিল নৈঋত। গাড়ি ব্যাক কর। সোজা চল। ঘুরলি কেন?

সে কী রে!

এ তো জিয়াগঞ্জের রাস্তা. আসিসনি বুঝি অনেকদিন এপথে?

নৈঋত গাড়িটা ব্যাক গিয়ারে ফেলে আয়নাটাতে চোখ রেখে হর্ন দিতে দিতে ব্যাক করতে লাগল গাড়ি।

মুখে বলল, তুই কি মনে করিস, আখরিগঞ্জে রোজ আসাটা ভালো! জায়গাটার এমন নাম বলেই এখানে আসতে চাই না আমি।

নামটা আসলে আখেরিগঞ্জ। মুখে মুখে এরকম হয়ে গেছে।

কীরকম?

আখরিগঞ্জ!

ও।

আবারও মাইল দশেক পরে একটা মোড় পাবি ভগবানগোলার। সেখানে বাঁ-দিকে ঘুরে যাবি। আখরিগঞ্জ সেখান থেকে দশ কিমি।

জারুল বলল, বহরমপুরের ছেলে হলে কী হয়। আমি কিন্তু কোনোদিনও আসিনি এর আগে। উজলা আর আঁধারের জন্যেই দেখা হয়ে গেল।

হয়নি এখনও, হবে।

আঁধার বলল।

কী আছে ওখানে?

উজলা বলল।

নৈঋত বলল, আছে না, মানে নেই। বল, ছিল।

তার মানে?

তার মানে আখরিগঞ্জ এখন পদ্মাগর্ভে লীন হয়ে গেছে। প্রতিবছরই রাক্ষুসি পদ্মা কয়েক কিলোমিটার করে গ্রাস করে নিচ্ছে। এখন মানুষে ভাঙন দেখতে আসে এখানে।

আঁধার বলল, অ্যাজ ইফ ভাঙন যেন দেখতে পায় না মানুষে!

সিলী! গড়া আর সৃষ্টি দেখতে এলেও না হয় কোনো মানে হত। দিদির সঙ্গে আমার অ্যাটিচুড-এর এইটাই তফাত। সবটাতেই একটা নেগেটিভ আপ্রোচ, একটা মরবিডিটি। অতীতে, ভাঙনে, পাস্ট-টেন্স-এ আমার কোনোই ইন্টাররেস্ট নেই! দুসস। আমি গাড়ি থেকে নামবই না। এই দেখতে আসছি জানালে আমি আসতামই না।

না-ই বা নামলি। চল তো আগে। পদ্মাও কি দেখবি না?

সেটা অবশ্য দেখা চলতে পারে।

মেহগনি বলল, দু-পুরুষ আগে আমাদের আদিবাড়িও ছিল, শুনেছি, ফরিদপুরের লক্ষ্মীপুরে। জমিদার ছিলাম না কি আমরা! পদ্মার ভাঙনে তলিয়ে গেছিল সব।

জারুল চুপ করেই ছিল। ওদের কথোপকথন শুনছিল। রবীন্দ্রনাথের কথা এবং পদ্মার কথাতেই ওর মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথের বর্ষাকালের পদ্মার ওপরে বর্ষার প্রসঙ্গে লেখা কয়েকটি লাইন। এই ওর দোষ। এখনও কল্লোলযুগ বা কৃত্তিবাসের যুগের একজন কবিকেও কবি বলে মানতেই পারল না. রবীন্দ্রনাথ তার পাঁজরে রাবীন্দ্রিক অশ্বত্থ গাছ গজিয়ে দিয়েছেন, কারও কারও হাড়ে যেমন দুব্বো গজায়।

‘‘যতবার পদ্মার ওপরে বর্ষা হয়, ততবারই মনে করি মেঘমল্লারে, নতুন বর্ষার গান রচনা করি, কিন্তু ক্ষমতা কই? এবং শ্রোতাদের সম্মুখে তো এই বর্ষার নিত্যমোহ নেই, তাদের কাছে একঘেয়ে ঠেকবে। কারণ, কথা তো ওই একই—বৃষ্টি পড়ছে, মেঘ করছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কিন্তু তার ভিতকার নিত্য-নূতন অনাদি-অনন্ত বিরহ-বেদনা কেবল গানের সুরে প্রকাশ পায়।’’

জারুল ভাবছিল, শুধু কি পদ্মার ওপরে আজকের শ্রাবণের বর্ষাদিনের এই সকাল বা পদ্মার ওপরে বৃষ্টিই নিত্য? মোহ অনির্ভর? নিত্য-মোহর ফাঁদে পড়ে না কোন মানুষে? কোন বয়সে? এই নিত্য-মোহর বা নিত্যতার আকাঙ্ক্ষা সব যার মিটে গেছে সে-ই তো বেঁচে গেছে। এ জীবনে প্রত্যেক মানুষেরই নিত্যমোহর প্রতি বড়োই দুর্বার আকর্ষণ। জারুল কিন্তু তার গহন ঘন শ্রাবণ মেঘের উড়াল চুলের চাঁদোয়ার নীচের ছায়াচ্ছন্নতার মনের এক অপাংক্তেয় জারুল হয়েও একেবারে সাধারণ হয়নি। ওর মনটিকে এই মানবমনের নিত্য চাহিদাভরা ভীষণ বনের রৌরবের মধ্যে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে ও। বেঁচে গেছে ও।

এ কি কম বাঁচা!

উজলার বুকের আঁচল আবারও খসিয়ে দিয়েছে জানালা দিয়ে-আসা অসভ্য হাওয়া। ফলসা-রঙা স্তনসন্ধির গন্ধ উড়ছে এই মেঘলা শ্রাবণের কদম্বগন্ধি উদলা সকালে. জারুলের চোখ দুটি এক মুহূর্ত স্তির হয়ে রইল। তারপরেই মধুপ যেমন গোলাপ ছুঁয়েই উড়ে যায়, তেমনি করেই চোখ তুলে নিল চোখ যাওয়ার আগেই। ওর বুকের মধ্যে উজ্জ্বল হলুদ একটা ‘‘চোখ গেল’’ পাখি যে এমনভাবে লুকিয়ে ছিল, তা একটু আগেও জানেনি। কিছু একটা ঘটে গেছে ওর মধ্যে পিলখানা রোড থেকে গাড়িতে আখরিগঞ্জের দিকে রওয়ানা হওয়ার পরে পরেই। এই অ্যালকেমি সম্বন্ধে ওর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, বুঝিয়ে বা ব্যাখ্যা করে বলতেও পারবে না। কিন্তু ওর মন বলছে, মানে বলতে চাইছে উজলাকে, যেও না। যেও না। কী হবে পুনেতে গিয়ে! অত দূরে! বম্বের ফিল্মি-জগৎ। কত প্রলোভন। গ্ল্যামার, লোভ, সহজ-টাকা, উচ্চাশা, এসব পুরোপুরি নষ্ট করে দেয় মানুষের মনুষ্যত্ব, গভীরতা, গাঢ় স্বভাব। উচ্চাশা, থাকা ভালো কিন্তু সেটা কনজ্যুমারিজমজাত উচ্চাশা নয়। তুমি বরং বাংলা স্টেজকেই পুনরুজ্জীবিত করো না! কী ভালো গান গাইতে তুমি। গানই গাও বরং ভালো করে। রবীন্দ্রসংগীত গায়িকাদের এক প্রজন্ম তো শেষই হয়ে এলো। মোহরদি, বাচ্চুদি, কমলা বসু, সুচিত্রাদি। মালতী ঘোষাল, রাজেশ্বরী দত্তরা তো নেই-ই। পরের প্রজন্মের সবচেয়ে ভালো গায়িকা হও না তুমি! উজলা! তোমাকে কি যেতেই হবে? তোমার শিকড় ছিঁড়েও যাবে তুমি? কী হবে গিয়ে? কত বেশি পাবে? শিকড় ছিঁড়লেই যে সাফল্যের উচ্চশিখরে উঠবে এমন কোনো মানে নেই। যত জন শিকড় ছিঁড়ে যায়, তার মধ্যে কতজনে শিখরে পৌঁছোন?

হঠাৎই নিজের মোড়কের মধ্যে থেকে বাইরে এসে স্বগতোক্তিরই মতো বলল জারুল, বাওবাব গাছের ভরাটত্ব গলাতে এনে, ‘‘আবার শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে’’ গানটি শোনাবে, উজলা?

চমকে উঠল উজলা।

বলল, কেন? হঠাৎ ওই গানটিই কেন?

একদিন গেয়েছিলে।

কবে? কোথায়?

উলটোরথের দিন।

উলটোরথের দিন! তাই? কোথায়?

চেতলা পার্কের বেঞ্চিতে বসে। তোমার পরনে একটা আষাঢ়ের নীলরঙা শাড়ি ছিল। শ্রাবণ-নীল ব্লাউজের হাতের কাছে আর গলার কাছে সাদা লেসের কুঁচি দেওয়া। তুমি একটি নীল চামড়ার চটি পরেছিলে। তোমার বড়োমেসো হংকং, না ব্যাংকক কোথা থেকে যেন এনেছিলেন সেই চটি। সেই মেঘলা আকাশের পটভূমিতে বৃষ্টিস্নাত শ্রাবণের দুপুবেলার তোমার সেই ছবিটি মনের ফ্রেমে বাঁধানো আছে। তখন পার্কে অন্য একজনমাত্র লোক ছিল। সে বসে তার কান পরিষ্কার করছিল। আর ছ-টা কাক, চারটে শালিক আর আমরা ছিলাম। একদল লাল ফড়িং উড়ছিল, বৃষ্টির পরে। মনে আছে।

আমরা মানে?

আমরা মানে, আমি আর তুমি। ভারি ভালো গেয়েছিলে গানটি। প্রতিশ্রাবণে এই গানটি তোমাকেই যেন ফিরিয়ে আনে, আমার মনে।

এইখানে?

সবখানেই। যেখানেই আমি থাকি।

মেহগনি বলল, আরে, আমরা কি পুনের ফিল্ম ইনস্টিট্যুটে অলরেডি পৌঁছে গেছি? এমন ডায়ালগ তো ফারুখ শেখও দেবে না পল্লবী যোশীকে! উজলা না গিয়ে তো জারুলেরই যাওয়া উচিত দেখছি পুনেতে।

ওরা হেসে উঠল। কিন্তু উজলা আর জারুল হাসল না।

জারুলের দিকে একঝলক চেয়ে মনে মনে উজলা বলল, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? আশ্চর্য!

মুখে বলল, তুমি এখনও অভিনয় করো, পুজোর সময়ে?

না:।

জারুল এমনভাবে বলল, যেন করে তো নাই-ই। করতে চায়ও না।

বহরমপুরে তোমাদের কোনো অ্যামেচার দল নেই? পুজো-টুজোর আগে, হয় না থিয়েটার?

হবে না কেন? অনেকই হয়। খুবই ভালো ভালো দল আছে একাধিক এখানে।

বহরমপুর পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা-সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান। কী ভেবেছ তুমি!

নৈঋত চার্জ করল উজলাকে।

আমার বাবা অবশ্য তা-ই বলতেন।

উজলা বলল।

কী বলতেন?

এই কথাই বলতেন। আর বলতেন, বহরমপুরের মানুষেরা খুব ভালো। উনি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন তো ওখানে কিছুদিন।

তব্বে!

মেহগনি বলল।

উজলা আবার ফিরে গেল জারুলের কাছে। বলল, করো না কেন, জারুল? তুমি তো খুব সুন্দর অভিনয় করতে। গানও তো ভালোই গাইতে। মনে আছে, রমেনদার নির্দেশনাতে তোমরা ‘ফাল্গুনী’ করেছিলে একবার। তাই না?

আর ‘রক্তকরবী’তে তুমি নন্দিনী করেছিলে? মনে আছে? জারুল বলল, ওঃ! সে কী দারুণ অভিনয় তোমার। সেদিন আমার খুব বিশু পাগল হতে ইচ্ছে করেছিল। আসলে তা নয়, খুবই ঈর্ষা হয়েছিল তাকে।

ঈর্ষা?

অবাক হওয়া গলাতে বলল উজলা।

হা:। তুই একটা মেন্টাল কেস জারুল। পাগল তো তুই আছিসই! জারুল পাগলা আবার বিশু বা বিশু পাগলা হতে যাবে কোন দুঃখে। অ্যাজ ইফ, জারুল পাগলা ইজ নট সাফিশিয়েন্ট।

নৈঋত বলল।

এখনও মনে আছে তোমার?

উজলা বলল, গাঢ় গলাতে, অতীতে ফিরে গিয়ে।

গাড়িতে আর কারা আছে বা নেই তা যেন পুরোপুরি ভুলেই গেল দু-জনে।

নিশ্চয়ই! থাকবে না মনে?

হঠাৎ জারুলকে এত কথা বলতে দেখে নৈঋত একটু অবাক হয়ে মুখ ঘুরিয়ে দেখল ওর দিকে একবার। গাড়ি চালাতে চালাতেই ওর যেন মনে হল উজলার ঔজ্জ্বল্য ধার নিয়েছে ঘনান্ধকার বনের জারুল। অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে।

তবে? অভিনয় করো না কেন তুমি? জারুল?

নায়িকা কই?

আশ্চর্য! বহরমপুরে নায়িকা নেই? যেদিকে চাইছি, সেদিকেই তো সুন্দরী, সপ্রতিভ সব মেয়ে দেখি। এখানে তো চাঁদের হাট।

এলা তো নেই।

কে?

এলা।

ও ‘চার অধ্যায়ে’র কথা বলছ?

হুঁ।

‘‘প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস।

তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।’’

আরিব্বাস কী দিলে জারুলদা মাইরি! কার নাটক থেকে ঝাড়লে? হাবিব তানবীর না বিভাস চক্রবর্তী?

জারুল চুপ করেই রইল। আঁধারদের বলে কী লাভ? ওরা রবীন্দ্রনাথ না-পড়া প্রজন্ম। ওদের জন্যে অনুকম্পা হয়।

হঠাৎ উজলা বলল, তখন তো রবীন্দ্রনাথ পড়তাম, রবীন্দ্রনাথের গান গাইতাম, নাটক করতাম, কিন্তু মানে বুঝতাম না। এখন, যখন…

তারপরেই বলল, করলে মন্দ হয় না কিন্তু একবার, না? নতুন করে। মানে বুঝে?

হ্যাঁ।

হেসে ফেলে, বলল, জারুল।

‘সব্বোবাঁশে’র মানে বুঝতে এত বছর লাগল তোমাদের। আশ্চর্য!

আঁধার বলল।

সকলেই হেসে উঠল। উজলা ছাড়া।

জারুলের মনে হল আঁধার আর উজলা বোধ হয় আসল ভাই-বোন নয়। এক বাবা-মায়ের কতরকমের ছেলে-মেয়েই না হয়!

মেহগনি বলল, পৌঁছে গেলাম। এই যে। দেখো। আখরিগঞ্জ। সামনেই।

এ-ই আখরিগঞ্জ? সত্যি?

আঁধার বলল।

হোয়াট আ ডিসঅ্যাপয়েন্টমেন্ট। কী আছে ওখানে দেখার?

নৈঋত বলল, ইয়েস। অ্যাপারেন্টলি তা-ই মনে হয়।

গাড়ীটা একেবারে ভাঙনের মুখ অবধি নিয়ে চল নৈঋত। ওখানে একটা চায়ের দোকানও আছে।

মেহগনি বলল।

কত কিমি এলাম আমরা বহরমপুর থেকে?

আঁধার শুধোল।

প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার। উনপঞ্চাশ, টু বি এগজ্যাক্ট!

তাই?

দাঁড়াও, দাঁড়াও। এখন নেমো না। গাড়িটা লাগাই আগে। কাদাও আছে ওখানে। আঁধার বলল, তুমি যেন ঘাটে তরী ভিড়াচ্ছ এমনই ভাব করছ নৈঋতদা! তারপরই একসাইটেড হয়ে বলল, মাছ উঠেছে কত্ত। দেখছিস দিদি।

বহরমপুরের বাজারে সবরকমের মাছই পাওয়া যায়। এ কি তোমাদের কলকাতা! এখান থেকে কিছুই নিতে হবে না।

নৈঋত বলল।

আমি থোড়াই খরচ করছি ওয়ান পাইস, তোমরা থাকতে! তা ছাড়া, আমার একটা অ্যালিবাই তো আছেই। আমি তো রোজগার করি না।

চলো, নামো।

এ-ই পদ্মা!

বলেই, গম্ভীর হয়ে গেল উজলা।

হ্যাঁ। ওপারে বাংলাদেশ। এ-ই পদ্মা!

মেহগনি বলল।

আর, দেখো, শিলাইদহ। ওই যে, ওই দিকে! রবীন্দ্রনাথের জমিদারি।

বলেই, মেহগনি আঙুল দিয়ে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের একটা দিক নির্দেশ করল।

ওদের দেখে বেশ কয়েকজন অসময়বয়সি মানুষ এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়াল পেছনে। সেলফ-অ্যাপয়েন্টেড ভলান্টিয়ারেরা। গাইড।

একজন বলল, থানা ছিল, স্কুল ছিল, পোস্ট অফিসও ওই যে ওই-ই-ই-ই দিকে—। সবই এখন জলের তলায়।

জলের দিকে চেয়ে দেখল জারুল। ভাবল, তাই-ই। গরু-বাছুরের হাম্বা-আ ডাক, দুপুরবেলার ঘুঘুর ডাক, নদীর ঘাটে মেয়েদের গল্প চান করতে করতে, সবই নদীর তলায়!

ইলিশমাছের মতো গায়ের রং এই শ্রাবণের পদ্মার। তবে নারীর মনেরই মতো, জলেরও কোনো আলাদা রং তো নেই! তার ভালবাসার পুরুষের মনের ছায়াতে যেমন নারীর মনের রং ঘনঘন বদলায়, নদীর রং-ও বদলায় আকাশের মেঘের রং বদলের সঙ্গে সঙ্গে।

দেখছ! দেখো। আকাশটা নেমে এসেছে নদীর ওপরে। মাঝে নদীর চর। ওদিকে যদি চরই ফেলবে তাহলে এদিকে এত ভাঙা কেন?

নৈঋত বলল, ফিলসফাইজ করে।

দ্যাট ইজ দা কোয়েশ্চেন!

আঁধার বলল।

এক সার বিধবা থানকাপড় পরে এসে দাঁড়াল চায়ের দোকানটার সামনে। কারও মুখে একটিও কথা নেই। মাথায় ঘোমটা। বার্গম্যানের ছবির একটি দৃশ্য যেন। চায়ের দোকানি তাদের প্রত্যেকেরই হাতে একটা করে দশ পয়সা ধরিয়ে দিল।

দান নয়। দান না-দিতে পারার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা।

এরা কারা?

উজলা প্রশ্ন করল বিষণ্ণ গলায়।

এরা আখরিগঞ্জের প্রেতিনী।

নৈঋত বলল।

এদের সবই গেছে ভাঙনে। অথচ একদিন সবই ছিল। ওইখানে। ওই যে! স্তব্ধ হয়ে সেদিকে চেয়ে রইল উজলা।

মেহগনি বলল, চা খাবে তো সকলে?

আঁধার বলল, শিওর!

নদীর ওপর দিয়ে একটা হাওয়া বইছিল। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন বলেই গুমোট করেছে। চায়ের দোকানের উলটো দিকে মস্ত একটা অশ্বত্থ গাছে অনেকগুলো গাঙশালিক কিচিরমিচির করছে। নদীপারের উদাস-সকালে গাঙশালিকের ডাক সকলেরই মনের মধ্যে থেকে উদাসীকে টেনে বের করে, যে-উদাসী, অন্যসময়ে অদৃশ্যই থাকে। অবশ্য মন বলে যাদের কোনো পদার্থ আছে, তাদেরই মনে।

ভাবছিল, উজলা।

ক-টি টিয়াও আছে। মাঝে মাঝে তারা কর্কশ চাবুকের মতো হাওয়াকে চাবকাচ্ছে তাদের সংক্ষিপ্ত কিন্তু ক্ষিপ্ত ডাকে। পার্থেনিয়াম ফুটেছে অগণ্য। ঝাড় হয়ে গেছে এখানে-ওখানে। ভাঙনের পাড়ের ওপরে সব জায়গাতেই ফুটেছে। প্রকৃতির এ-ই বোধ হয় একধরনের প্রায়শ্চিত্ত। কে জানে!

হাওয়াটা আসছে বাংলাদেশ থেকে, আসছে নদীগর্ভের শুয়ে-থাকা আখরিগঞ্জকে ঢেকে রাখা জলরাশির গা ছুঁয়ে অতীতের খন্ড-স্মৃতির, খন্ড-দেশের, খন্ড-নীড়ের, খন্ড-ভালোবাসার, খন্ড-বাঙালিত্বর অখন্ড অস্তিত্বর কথা মনে করিয়ে দিয়ে। হাওয়াটা আসছে। না-আসারই মতো। মৃদু কাঁপন উঠছে নদীর জলে। চোখে না পড়ারই মতো।

উজলা, পদ্মার ওপরে তার দৃষ্টিকে দূরে দূরে ইলিশমাছের জালের মতো ছড়িয়ে দিয়ে জারুলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রায়, গা-ঘেঁষেই। হাওয়াতে জারুলের বুকের চুলে মাখামাখি হওয়া পাউডার আর পুরুষের ঘামের গন্ধ পাচ্ছিল ও।

পুরুষের ঘামের গন্ধ।

নির্জন ছায়াচ্ছন্ন ঘনসন্নিবিষ্ট বনের জারুল যেন হঠাৎই এই উদোম নদীপারের আব্রুহীন আলো-হাওয়ার মধ্যে এসে পড়ে বড়োই অস্বস্তি বোধ করছিল।

উজলা ভাবছিল, যেন শুধু আখরিগঞ্জকেই নয়, জারুলকেও হঠাৎই আবিষ্কার করেছে ও সামান্য আগে। কিন্তু আখরিগঞ্জকে যেমন আর পুনরুজ্জীবিত করা যাবে না. তাদের অতীতকেও নয়। করা যায় না। অধিকাংশ অতীতই যেন শবেরই মতো।

স্বগতোক্তি করল উজলা, খুব মন খারাপ হয়ে যায়, না?

জারুল অস্ফুটে বলল, হুঁ। বলল, নদীর দিকে চেয়ে।

তারপরে উজলা মনে মনে বলল, না হলে, এই ভাঙন দেখতে, খারাপ, সরু পথ দিয়ে ঝাঁকতে ঝাঁকতে এই গুমোট গরমে এতদূরে আসার প্রয়োজনটা কি আদৌ ছিল? আখরিগঞ্জ তো প্রত্যেক পুরুষ এবং নারীর বুকের মধ্যেই আছে, থাকে। আমার, তোমার,…কার নয়? বলো জারুল! যে-আখরিগঞ্জকে সারাজীবন আমাদের বুকের মধ্যেই নিভৃতে নিরুচ্চারে লালন করতে হবে। কারণ, আমরা তো গাঙশালিক নই, আমরা যে মানুষ!

প্রত্যেকেই, বড়ো, দুঃখীমানুষ আমরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *