সাঁঝবেলাতে
তোমার হাসিটি কিন্তু ঠিক সেরকমই আছে।
তাই?
হুবহু।
রুবি বলল। বাজে কথা, মুখের পেশির সঞ্চালন আর দাঁতের সারি একইরকম আছে।
হাসি মরে গেছে কবে।
কী জানি! আমি তো দেখছি তুমি দাঁড়িয়ে আছ দোতলার বারান্দাতে। মুখ ঝুঁকিয়ে দেখছ পথের দিকে। মুখের দু-পাশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তোমার কোমর ছাপানো চুল। আর তুমি হাসছ।
কত বছর আগের কথা?
ত্রিশ বছর তো হল।
ত্রিশ বছর?
তাইতো। এবং তোমার হাসিটি বদলায়নি একটুও। তুমি আগের থেকে আরও সুন্দরী হয়েছ।
ছাই।
বলেই রুবি আবারও হাসল। সেই হাসি।
তোমার ছেলেমেয়ে কী?
আমার এক ছেলে, এক মেয়ে।
কত বড়ো হল।
বড়ো ছেলে তো চাকরিতে ঢুকেছে।
কোথায়?
ডি সি পি এল এ।
ইঞ্জিনিয়ার?
হ্যাঁ।
আর মেয়ে?
মেয়ে ক্লাস নাইনে পড়ে।
কোথায়?
ব্রাবোর্নএ।
আর আপনার?
আমারও এক ছেলে এক মেয়ে।
কত বড়ো হল?
বড়োমেয়ে। একটি স্কুলে পড়াচ্ছে বাংলায় এম এ করে।
আর ছেলে?
সে বকে গেছে। ড্রাগ-অ্যাডিক্ট। কিছুই করে না।
আপনার তো কোনো নেশা ছিল না। সেসব ছিল সুপ্রতীপের। নেশাতেই তা সর্বস্বান্ত হল।
কী?
কী না তাই বলুন।
মদ, সিগারেট, ড্রাগ। নইলে কেউ এত অল্পবয়সে চলে যায়?
চলে যাওয়ার কোনো বয়স নেই রুবি।
তা ঠিক।
যে যায়, সে বেঁচে যায়। এই পৃথিবীতে বাঁচা বড়ো কঠিন কাজ। বিশেষ করে সুপ্রতীপের মতো ছেলের পক্ষে। ও বড়ো সোজা সরল ছেলে ছিল।
জানি।
তবু নেশা করে মরার কোনো মানে নেই। ছেলেও তখনও পায়ে দাঁড়ায়নি। মেয়ের কথা তো ছেড়েই দিলাম।
অনেক নেশা আছে তাতে মানুষ প্রাণে মরে না। মনে মরে।
সে কী নেশা?
আছে।
যেমন?
যেমন তুমি।
রুবি আবার হাসল। ওর চোয়ালটি চওড়া এবং সুন্দর দু-পাটি ঝকঝকে দাঁত। এখনও তেমনই সুন্দর দেখায় হাসলে।
বলল, বাজে কথা। আপনি এখনও সেরকমই আছেন।
বললে তো আর হল না। জুলপি আর মাথার দুপাশ সাদা। রিটায়ার করব আর চার বছর বাদে।
সে তো বাইরেটা। ভেতরে একই মানুষ। সেই কলেজে পড়ার দিনের মতো।
সেইটাই তো অসুখ। মনের বয়স এখনও সতেরোই রয়ে গেছে। আয়নার সামনে দাঁড়াই না তাই। আমার বহিরঙ্গ রূপের সঙ্গে অন্তরঙ্গ রূপের কোনো মিলই নেই। এর চেয়ে বেশি কষ্টর কোনো অসুখ নেই।
তারপর বললাম, তোমার একটা লাইলাক রঙের শাড়ি ছিল। মনে আছে? তোমার স্কুল ফাইনাল পাশের পর মেসোমশাই খুব বড়োপার্টি দিয়েছিলেন। তখন তুমি সেই শাড়িটা পরেছিলে, চুলে দিয়েছিলে লাইলাক রঙা ফুল।
আশ্চর্য। মনে আছে আজও আপনার?
আছে। তোমার ওই শাড়িপরা মূর্তি এই সেদিনও স্বপ্ন দেখেছি।
ছেলেরা তো শুনেছি স্বপ্নে শাড়িপরা অবস্থায় কাউকেই দেখে না।
তা ঠিক। কিন্তু তোমাকে তাই দেখেছি আমি। যে বয়সে এসে পৌঁছেছি তাতে শাড়ি না-পরার চেয়ে শাড়ি পরা চেহারাটাই ভালো লাগে।
আপনি যে আমাকে….। কোনোদিনও তো বলেননি। অবশ্য একটা চিঠি। একটাই অবশ্য।
আমাদের সময়টা তো অন্যরকম ছিল। তুমিও তো বলোনি কখনো। অথচ আজ সুপ্রতীপ নেই, ত্রিশটা বছর চলে গেছে মাঝে, অথচ এই বিয়েবাড়িতে এসে তোমাকে হঠাৎ দেখে মনে হচ্ছে সেদিন কিছু না বলেই বোধ হয় ভালো করেছিলাম। মানে, বলতে যে পারিনি……
কেন?
আমাদের সময়ে মোহটাকেই প্রেম বলে জানতাম আমরা।
প্রেমের সঙ্গে মোহর কী ঝগড়া?
আবার হাসল রুবি।
আমার বড়োশালি এসে বললেন, খাওয়া হয়েছে সুপ্রকাশ?
না দিদি।
তুমি রুবিকে চিনলে কী করে?
বলতে পারেন বিনা চেষ্টাতেই। আমাদের উলটোদিকের বাড়িতে থাকত ওরা। রুবির বাবার মস্ত ব্যবসা ছিল ওষুধের।
তাই?
হ্যাঁ। আমার সঙ্গে রুবির বিয়ে হলেও হতে পারত।
অ্যাই! বলে, রুবি আবারও হাসল।
দিদি হেসে বললেন, এসব কথা চামেলি কি জানে?
আমি বললাম,—না। দয়া করে আপনার ছোটোবোনটিকে আজ আর ওসব বলবেন না। কাল থেকে মেয়ের স্কুলের পরীক্ষা আরম্ভ। অত্যন্ত টেনশানে আছে।
তোমার মেয়ের! কীসের পরীক্ষা?
আহা মিলির নয়। মিলি যে স্কুলে পড়ায় সেই স্কুলের মেয়েদের পরীক্ষা শুরু।
দিদি হেসে উঠলেন।
রুবি আবার হাসল।
বউদির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবেন না?
থাক না। তুমিও তো কখনো সুপ্রতীপের সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দাওনি। কিছু সম্পর্ক সংসারে থাকা উচিত যা শুধুমাত্রই দু-জনের। আর কোনো দাবিদার না থাকাই ভালো সে সম্পর্কে।
রুবি হাসল।
বলল, সত্যি এই বয়সেও আপনার মতো এত রোমান্টিক মানুষ দেখা যায় না।
ভুল। বয়স আমার হয়েছে। তোমারও হয়েছে। যদিও তুমি আমার চেয়ে অনেকই ছোটো। কিন্তু আমার সতেরো বছরের যে প্রথম প্রেম তার গায়ে তো আঁচড়টিও পড়েনি। সে তো এই তিরিশটি বছরে আরও চিকন আরও সবুজ আরও নবীন হয়েছে। কোনো প্রেমেরই বয়স হয় না রুবি, যদি সে প্রেম আসল প্রেম হয়।
নকল প্রেমও আছে বুঝি?
রুবি হাসল।
নেই?
জানি না।
জানো। স্বীকার করছ না। যে প্রেম ব্যবহারে, প্রয়োজনে, গ্যাস সিলিণ্ডারের চিন্তা, ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যতের ভাবনায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তা আর প্রেম থাকে না।
তবে তা কী?
অভ্যেস।
অভ্যেস?
আবার হাসল রুবি। বলল, সত্যিই তেমন পাগলই আছেন আপনি।
প্রার্থনা কোরো, যেন থাকি। এই তো একমাসে গোপালকাকু আর বাঘাকে ইলেকট্রিক ফারনেসে ঢুকিয়ে দিয়ে এলাম। সেই লাল আভাটা চোখে লেগে আছে এখনও। আঁচ লেগে আছে কপালে। এই তো পরিণতি আমাদের। আমার তোমার সকলের। প্রার্থনা কোরো যেন, যে কটা দিন আর আছি এমন সেকালের মতোই বাঁচি।
গম্ভীর হয়ে গেল রুবি।
বলল, মেয়ের বিয়ে দেবেন না?
আমি? আমি কে? মেয়ের বিয়ে মেয়েই দেবে। তাদেরই পছন্দমতো। আমাদের দিন তো আর নেই। বোকা বোকা দিন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে তুমি আমার আসা যাওয়ার সময়ে। বাথরুমের জানালাটা একটুখানি ফাঁক করে রেখে জোরে গান গাইতাম আমি, যাতে তোমার শোয়ার ঘর অবধি সে-গান পৌঁছোয়। আমাদের প্রেমের প্রকাশ তো ওরকমই ছিল। বাছুরের প্রেম ছিল আমাদের। পৃথিবী আর নাবালক নেই। সাবালকদের দিন এখন। আমাদের ছেলে-মেয়েরা যে কত বড়ো দায় থেকে বাঁচিয়েছে আমাদের তা কী বলল! হালকা লাগে না তোমার?
তা লাগে?
রুবি বলল।
চামেলির দিদি টগরদি এসে বললেন, অ্যাই সুপ্রকাশ তোমরা বসে পড়ো। লাস্টব্যাচ। চলো রুবি।
আমার তো খাওয়া হয়ে গেছে সুদা।
সত্যি?
সত্যি।
বহরমপুরের কোন পাড়ায় থাকো তোমরা? চলে যাব একটা উইক-এণ্ডে।
গ্রান্ট হল রোডে। লালগোলার হাইওয়ে দিয়ে ঢুকতে যে রাস্তা সে রাস্তাতে।
গেলে, একাই যাব। একা গেলে ভয়?
ভয়? রুবি আবার হাসল। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, না। ভয় নয়। সব ভয়কেই মাড়িয়ে এসেছি। ঠিক আছে। তাই আসবেন।
বহরমপুর শহরটা অনেক বদলে গেছে। রাস্তাঘাট বিরাট চওড়া হয়েছে। চেনা যায় না। আগে গাড়ি ছিল কটা হাতে গুনে বলা যেত। এখন ট্রাক বাস গাড়ির জন্যে পথচলা দায়।
রুবির স্বামী সুপ্রতীপকে সকলেই চেনে। তবে সেই চেনাটা শ্রদ্ধার চেনা নয়। মাতাল, দেনায়-ডোবা, সর্বস্বান্ত সুপ্রতীপকে লোকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই মনে করে।
বহরমপুরে একবার ফুটবল খেলতে এসেছিলাম। বছর পঁচিশেক আগে। তখন সুপ্রতীপের বাবা বেঁচে। জমজমাট পসার ছিল। বিরাট উকিল। উনি আমার জন্যে ব্যুইক গাড়ি পাঠিয়েছিলেন ওঁর বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে। রুবির চিঠি নিয়ে এসেছিল ড্রাইভার আর চাপরাশি। আমি যাইনি। রুবিকে অন্য কারও স্ত্রী হিসেবে দেখতে আমার ইচ্ছে করেনি। খুব রাগ হয়েছিল আমার। জ্বর হয়েছে বলে, মিথ্যা বলে তাদের বিদায় করেছিলাম।
রুবির বিয়েতেও আমি যাইনি। একবার ভেবেছিলাম পিঁড়ি ঘোড়াতে গিয়ে ফেলে দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেব বড়োলোকের মেয়ের। তারপর, ঘর অন্ধকার করে শুয়েছিলাম। সানাই-এর শব্দ, হাজার লোকের হাসি শুনছিলাম শুয়ে শুয়ে। কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজে গেছিল। প্রেম যে একধরনের অসুখ, বড়ো মারাত্মক অসুখ; তা জেনেছিলাম সেই রাতে। অসুখটা সেরে গেছিল রুবি পরদিন বহরমপুরে চলে যাওয়াতে। কিন্তু আসল—বসন্তর মতো অসুখ চলে গেলেও তার দাগ রয়ে গেছিল গভীর হয়ে মনময়। এত বছর!
সাইকেল রিকশাটা যখন ভাঙা পাঁচিলের পাশের মরচে পড়া গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল দীন বাড়িটার, তখন মনটা খারাপ হয়ে গেল। যাকে ভালোবাসে মানুষ, তাকে খুশি না দেখলে যে বড়ো কষ্ট হয় এই কথা পশ্চাশবছরের সুপ্রকাশ আগে কখনো জানেনি।
একটি ছাগল চড়ছিল ন্যাড়া মাঠে। আগে বোধ হয় এইখানেই সবুজ লন ছিল। অনেক ফুল। যারা চিরদিনই দরিদ্র তাদের দারিদ্র্য যে কী তা বোধ হয় প্রতীয়মান হয় না যারা একদিন ধনী ছিল তাদের কাছে যেমন হয়। খাকি-রঙা ছেঁড়া হাফপ্যান্ট পরা বছর দশেকের একটি ছেলে একটি সাদা ছাগলছানার কানের মধ্যে মুখ ঠেকিয়ে ফুঁ দিচ্ছিল।
ছেলেটি নৈর্ব্যক্তিক ও অভদ্র গলায় বলল, কাকে চাই?
রুবি আছেন?
কে রুবি?
সুপ্রতীপবাবুর স্ত্রী?
ও। বড়োকাকিমা? দাঁড়াও। ডেকে দিচ্ছি। বলেই বলল, তুমি হাবলাকে ধরো তো!
কে হাবলা?
ধ্যাত ধরো না।
বলেই ছাগলচানার জিম্মা আমায় দিয়ে ভিতের চলে গেল।
রুবি ছেলেটির সঙ্গে এল ভেতর থেকে।
অন্দরমহলটা অন্ধকার। রুবি সেই মহল আলো করে এল। আমাকে দেখেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। একমুহূর্ত মুখ কালো করেই হাসল। সেই হাসি।
বলল, সুদা। একটা পোস্টকার্ড ফেলে আসতে পারলেন না?
চলে যাই তবে?
না, না।
বলে, এগিয়ে এসে আমার হাত ধরল। সারাশরীরে আমার শিহরন খেলে গেল।
কোনোদিন আমরা কাউকে স্পর্শ করিনি গত তিরিশ বছরে।
বলল, আসুন। ভেতরে আসুন।
আমার মন বলল, ভেতরেই তো আসতে চেয়েছিলাম। সেই উনিশশো পঞ্চাশ থেকে। তখন তুমি বিকেলবেলার আলোয় রাঙা একটি স্থলপদ্মর মতো ছিলে।
যে সালংকারা রুবিকে সেদিন চুমকির বিয়েতে দেখেছিলাম এ রুবি সে রুবি নয়। একটি ফলসা-রঙা শাড়ি। অর্জুনগাছের ছালের মতো রঙের পাড়। অফ-হোয়াইট একটি রঙিন ব্লাউজ। বাঁদিকের বগলের কাছে ছিঁড়ে গেছে সেটা। পদ্মফুলের মতো দেখাচ্ছে জায়গাটা।
ভাঙা ও মলিন সোফায় এনে বসাল আমাকে রুবি।
বলল, এক মিনিটে আসছি।
দু-মিনিট পরে শাড়ি জামা বদলে, হাতের রেকাবিতে একটি সন্দেশ ও এক গ্লাস লেবু চিনির শরবত এনে দাঁড়াল রুবি।
আমাকে ঘরের চারদিকে তাকাতে দেখে বলল, এজমালি সম্পত্তি। ভাগের মা গঙ্গা পায় না। শ্বশুরমশাই তো শয্যাশায়ী। কিন্তু উইল করেছেন।
আমার সামর্থ্য নেই। দেওরেরা উইলে কী লেখা আছে, জানতে না পারায় কেউই আর গাঁটের কড়ি খরচ করে না। আমার জন্যে বরাদ্দ হয়েছে একতলার একটি ঘর। চলুন, সেখানে গিয়েই বসি।
দেওরদের কাউকে তো দেখছি না।
তারা চলে গেছে। লালদিঘিতে বাড়ি করেছে এক-জন। অন্যজন ধুলিয়ানে। ভালো ব্যাবসা তাদের।
শ্বশুরমশাইকে দেখে কে?
আমি। আর ওই ভ্যাবলা।
ভ্যাবলা কে?
যে ছেলেটি খবর দিল। ওর বাবা ছিল শ্বশুরমশায়ের খাস চাকর। সেও মারা গেছে পাঁচ বছর হল। তার স্ত্রী আগেই মারা গেছিল। বাড়ি ছিল জলঙ্গিতে। সেই থেকে ভ্যাবলা এখানেই আছে।
একা থাকো, তোমার ভয় করে না?
ভয়? না:। চলুন।
রুবির ঘরটি বেশ বড়ো। ওই ঘরেরই এক কোণায় রান্না করে জনতা-স্টোভে। অন্যকোণে কালিমায়ের মূর্তি। জবাফুল দেওয়া আছে টাটকা। খাটটি বিরাট। লেজারাস কোম্পানির। রাজা মহারাজারা যেমন খাটে পত্নী উপপত্নীদের আদর করতেন। ইলেকট্রিসিটি নেই। হাওয়াও নেই। গুমোট গরম।
রুবি বলল, হাত পা ধুয়ে এসে খাটেই বসুন।
তাই করলাম। ঘরের সঙ্গেই লাগোয়া বিরাট বাথরুম। মার্বেলের। নোংরা হয়ে কালো হয়ে গেছে।
একটি তালপাতা নিয়ে রুবি হাঁটু মুড়ে বসল খাটের বাজুতে হেলান দিয়ে। হাওয়া করতে লাগল আমাকে। কিছুক্ষণ আগেই চান করেছে। আমলা তেলের গন্ধ বেরোচ্ছে ভিজে চুল থেকে। রুবি ঠিক তেমনই সুন্দরী আছে। সরু কোমর, সুন্দর বুক, মরালী গ্রীবা, বিলিতি ডল-এর মতো দুটি নীলাভ চোখ। ঝাঁপানো চুল। আর হাসি।
স্বগতোক্তির মতো বলল, আপনি আসতে চাইলেন, না করতে পারলাম না। কিন্তু……
না করতে কেন? আমি তো তোমার বৈভব দেখতে আসিনি। তোমাকে দেখতে এসেছি।
তাই?
রুবি বলল।
সত্যি বলুন তো কেন এসেছেন এই গরমে এত কষ্ট করে?
সত্যি কথাটা বলতে পারলাম না। বলতে পারলাম না যে, গত ত্রিশ বছর তোমার জন্যে অনেকই কষ্ট পেয়েছি অথচ একথা জেনেই যে সেই কষ্টের কোনো পরিণতি নেই। আজকের কষ্ট সে কষ্টর তুলনায় কিছুমাত্রই নয়।
রুবির একটি ফোটো আছে আমার কাছে।
চামেলি বা আমার ছেলেমেয়েরা কেউই তো জানে না। রুবি আমারই একার। ওদের কোনো দাবি বা অধিকার নেই রুবির ওপরে।
মুখে বললাম, তুমি জানো না?
রুবি বলল, জানি, আবার জানিয়ো না।
একদৃষ্টে ওর দু-চোখে চেয়ে থাকতে ও বলল, কী দেখছেন অমন করে?
তোমাকে।
অস্বস্তি পেল রুবি। ওই গরমেও বুকের কাপড় টানল ভালো করে।
আমি বললাম, কী খাওয়াবে আমাকে?
আমি যা খাব। আমি যে গরিব সে কথা আপনার কাছে লুকোতে চাই না। লাভও নেই।
কে বলে তুমি গরিব?
আমি জানি। হাওয়া পাচ্ছেন? ইস ঘামে মুখটা লাল হয়ে গেছে।
আমি কিছু বললাম না।
আধঘণ্টা গল্প করার পর ও বলল বাবাকে দেখে আসি একটু। দীর্ঘজীবন বড়ো অভিশাপের। জানেন সুদা।
জানছি।
নীচে নেমে এসে রুবি বলল এবার আপনাকে খেতে দিই? তার আগে ভ্যাবলাকে দিয়ে দিই। আমরা গল্প করতে করতে খেতে পারব তাহলে।
ভ্যাবলাকে ডেকে এনামেলের থালায় অনেকখানি ভালো ডাল আর তরকারি দিল।
তারপর শাড়ির পাড় দিয়ে বানানো আসন পেতে পেতলের মস্ত থালা গেলাস দেরাজ থেকে বার করে পেতে দিয়ে বলল, আসুন। ভাত বেড়েই বলল, দাঁড়ান। ভালো ঘি আছে একটু। আপনাকে দি। ঘিও বের করল দেরাজ থেকেই।
কাঁচাকলাই-এর ডাল, আলুপোস্ত আর চালতার টক। তার আগে ঘি।
আমি বললাম, তুমি কী খাবে? সব ভাতই তো দিয়ে দিলে?
আজ আমার উপোস।
কীসের উপোস?
দেব—দর্শনের।
আমার বুকের মধ্যেটা যেন মুচড়ে উঠল। বাইরের মাঠে ছাগল-মা কাঁদছিল। শালিক ডাকছিল কিচির-মিচির। বড়োরাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া ট্রাক, গাড়ি আর সাইকেল-রিকশার সম্মিলিত আওয়াজ মাথার মধ্যে ধাক্কা দিচ্ছিল। আমার চোখ জলে ভিজে এল। বড়োলেকের মেয়ে, বড়োলোকের বউ রুবির অবস্থা দেখে।
আমি বললাম, তুমি না খেলে আমি খাব না। আমি এক্ষুনি চলে যাব।
ও বলল, আপনার পায়ে পড়ি। অমন করবেন না।
আমি ভাত মাখছি। তুমি আমার সঙ্গে খাবে। বলে, ঘি দিয়ে ভাত মেখে আমি এক গরাস রুবির মুখে দিলাম। সারাশরীরে শিহরন খেলে গেল আমার। হয়তো রুবিরও। রুবির গাল বেয়ে টপ টপ করে জল পড়তে লাগল। নিজেকে সামলে নিয়ে ও বলল আমার মা ছাড়া কেউ আমাকে……
দু-জনে মিলে খেতে খেতে বললাম, তোমার বড়ো কষ্ট, না রুবি? অনেকরকম কষ্ট।
কষ্ট? না তো। কীসের কষ্ট? এক একজন মানুষ এক একরকম কপাল করে আসে। কী করা যাবে? আমার চেয়েও অনেক বেশি কষ্টেও তো আছে অনেক মানুষ।
তা আছে। তুমি ছেলের কাছে গিয়ে থাকো না কেন?
রুবি উত্তর দিল না।
কী?
ও যে বাড়িতে পেয়িং গেস্ট ছিল সেই বাড়ির মেয়ের সঙ্গেই ওর ভালোবাসা হয়েছে। তাকেই বিয়ে করবে। সেখানে, মানে ছেলের শ্বশুরবাড়িতে থাকি কী করে? তা ছাড়া আমার শ্বশুরমশাইকে তো এ অবস্থায় ফেলে যেতে পারি না। উনি যতদিন আছেন আমার এখানে না থেকে উপায় নেই।
ছেলে তোমাকে টাকা পয়সা পাঠায় না?
জিজ্ঞেস করছি বলে কিছু মনে কোরো না।
রুবি চুপ করে থেকে বলল, পুজোয় আর পয়লা বৈশাখে শাড়ি দেয়। আর কী দেবে? সকলেরই খরচ আছে তো! তা ছাড়া চাকরি তো বিরাট কিছু করে না…..।
ও।
খাওয়া দাওয়ার পর অনেক গল্প হল। আমরা একবার হাড়োয়াতে পিকনিক-এ গেছিলাম। সমুদ্রর মতো ঝিল। কত পাখি। জলজ আঁশটে গন্ধ। রুবি সেদিন অনেকক্ষণ আমার পাশে বসেছিল। সূর্য ডুবেছিল আমাদের চোখের সামনে। সেই লালিমা এখনও যেন ওর মুখে মাখানো আছে।
সে কথা বলতে ও হেসে উঠল। রুবির হাসি।
চা করল, ট্রেনের সময়ের আগে। কুচো নিমকি দিল দেরাজ খুলে কাঁচের বয়াম থেকে। তারপর বলল, পান খাবেন? ভ্যাবলাকে দিয়ে পান আনাল।
তুমি?
ও চলে যাবার পর খাইনি। তবে খাই আপনার সঙ্গে একটা। জর্দা দিন আমায়।
রুবির মেয়ে কলকাতায় তার দাদার বাড়িতে থেকে পড়ে।
বলল, কাছে রাখতে পারলে খুশি হতাম। মেয়ে তো। ছেলেটা তো পর হয়েই গেল এখন মেয়েটা…..
ভ্যাবলা সাইকেল রিকশা ডেকে দিল। রুবি ওদের ভাঙা ফটক অবধি এল। বেলা পড়ে এসেছিল। আমি রিকশায় ওঠার আগে বললাম, আমি কী তোমার জন্যে কিছুই করতে পারি না রুবি?
রুবি দুদিকে মাথা হেলাল। পানে ওর ঠোঁট রাঙা হয়ে উঠেছিল। হেসে বলল না, কিছু না।
আমার ভালোলাগাটা কি কিছুই নয়?
নিশ্চয়ই! এই যে এলেন কত ভালো লাগল। এই তো মস্ত পাওয়া। কোনোদিন কী ভেবেছিলাম। অমন হবে? পঁচিশ-তিরিশ বছর পরে? ভালোলাগায় মরে যাচ্ছি আমি। রাতে আমার ঘুম হবে না আজ। স্বপ্ন বলে মনে হবে।
তোমাকে আমি কিছুই কী দিতে পারি না রুবি?
অনেকই তো দিয়েছেন। আপনি জানেন না?
তবু, কিছু চাও তুমি আমার কাছ থেকে। তখন আমরা গরিব ছিলাম, তোমরা বড়োলোক। এখন আমি বড়োলোক। নেবে না কিছুই আমার কাছ থেকে?
রুবি হাসল। বলল, নেব। সেই যে একটি চিঠি দিয়েছিলেন আমাকে হাড়োয়া থেকে ফিরে! মমতাঝি-এর হাত দিয়ে লুকিয়ে পাঠিয়েছিলেন, মনে আছে? তা আজও আছে আমার কাছে। চিঠিই দেবেন মাঝে মাঝে আমায়। যখনই মনে পড়বে। তার চেয়ে বড়ো পাওয়া তো আর কিছুই হতে পারে না।
আমি রিকশাতে উঠলাম। বললাম, যাই রুবি।
যাওয়া নেই। আসুন। ভালো থাকবেন।
তুমি ভালো থেকো।
আমি সবসময়ই ভালো থাকি। বলেই, রুবি হাসল।
সাইকেল রিকশা এগিয়ে চলল। সামনে আলো, ভিড় আওয়াজ। পেছনে অন্ধকার, নির্জনতা, খসখসে নিস্তব্ধতা।
একবার মুখ ঘুরিয়ে চাইলাম। দেখলাম, মরা আলোয় বিকেলের স্থলপদ্মর মতো জ্বলজ্বল করছে রুবি, মরচে-পড়া গেটটা ধরে দাঁড়িয়ে। হাসছে।
আমার হারিয়ে যাওয়া, কুড়িয়ে পাওয়া রুবি।