অন্যরকম
সুমিত্রা ফোন করেছিল।
বলল, নির্মলদা, অলকাদি এসেছে।
কবে?
আসলে অলকার নামটাও যেন নির্মলের স্মৃতির অন্ধকার লফট খুঁজে খুবই কষ্ট করে বের করতে হল, কারণ সেখানে এখন অনেকই ঝুল, ধুলো-ময়লা এবং পুরোনো সবকিছুকে নির্মমভাবে কুচিয়ে-কাটা নেংটি ইঁদুরের ভিড়।
অন্যমনস্কতা কাটিয়ে উঠে, বলল, কোথায় আছে ও এখন?
সুমিত্রা বলল, মিডেক্স-এ।
কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু সুমিত্রা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, অলকাদি একটু দোকানে বেরিয়েছে। ফিরে এলেই ও আপনাকে ফোন করবে, আপনি সকালে আছেন তো? না বেরিয়ে যাবেন?
আছি। রাত সাতটার আগে বেরোব না।
সুমিত্রা বলল, ঠিক আছে। রাখছি তাহলে। অলকাদি খবরটা আপনাকে দিতে বলেছিল তাই-ই…। ছাড়ছি।
আচ্ছা। বলে ফোন ছেড়ে দিল নির্মল।
ফোন ছেড়ে দেবার পরই ওর দুপুরের খাওয়ার সময় হল। আজকাল বাড়ি থেকেই খাবার নিয়ে আসে। নির্মল মিত্তির আর আগের নির্মল মিত্তির নেই। ডায়াবেটিস হয়েছে। গতবছর হৃদয়ঘটিত গোলমালে মাস দুয়েক নার্সিং হোমে শুয়েও ছিল। কুড়িবছর হয়ে গেল বিয়ে হয়ে গেছে। মেয়ের বয়স আঠারো হল। কপালের দু-পাশের চুল পাকা। ওঠেনি যে এখনও এই-ই যথেষ্ট। এখন প্রতিরবিবার সকালে রিলিজিয়াসলি থলে-হাতে বাজারে যায়। শনি-রবি দু-দিনই সস্ত্রীক। বসবার ঘরে স্ত্রীর সঙ্গে বসে আদর্শ স্বামীর মতো গাঁক-গাঁক আজওয়াজ আর ঝুম-ঝাম গানের সিনেমা দেখে টি-ভি তে। এই নির্মল মিত্তির আগের নির্মল মিত্তিরকে চেনে না। আজ আর চেষ্টা করেও চিনতে পারে না। কোনো মিলই নেই পঞ্চাশ শতকের মানুষটার সঙ্গে এই মানুষটার। না চেহারার, না মানসিকতার, না অবস্থার। কোনো কিছুই আর আগের মতো নেই। তাই হঠাৎ এতদিন পর অলকার নামটা শুনে প্রথমে তাকে চিনতে পর্যন্ত পারেনি।
খাওয়ার পর ডাক্তারের নির্দেশে অফিসের ঘরের ইজিচেয়ারে আধঘণ্টা শুয়ে থাকতে হয়। না শুলে বুকে ব্যথা করে। তখন ফোন ধরা মানা, কারও সঙ্গে দেখা করাও মানা। বেশির ভাগ দিনই আধখানা ক্যাম্পোজ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আধঘণ্টা বিশ্রামও কাজ দেয়। বিকেলে কাজ করতে অত ক্লান্ত লাগে না। কিন্তু আজ আর ক্যাম্পোজ খেল না। মনে মনে অনেক দিনের মাঠ অনেক বছরের ফেলে-আসা পাহাড়-নদী মাড়িয়ে ফিরে এলো পঞ্চাশের ক-টি বছরে।
সত্যি! কী বোকাই ছিল। বোকা এখনও আছে এবং যেদিন চিতায় পুড়ে ছাই হয়ে যাবে সেদিনও বোকাই যে থাকবে একথাও নির্মল জানে। বোকারা চিরদিন বোকাই থাকে বোকামি শুধু কমে হয়তো সামান্য মাত্রায়, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে, চালাকদের যেমন চালাকি বাড়ে ক্রমান্বয়ে।
অলকার বাবা, ব্যানার্জিজেঠু অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। নির্মলের বাবার অফিসের ডাকসাইটে এবং অনেক বড়ো ওপরওয়ালা। কিন্তু নির্মলের বাবাকে তিনি খুবই স্নেহ করতেন। মানুষটি ছিলেন ছোট্টখাটো। কিন্তু পুরো সাহেব। ডায়নামিক। নির্মলের জীবনে, এমন ফোর-ডাইমেনশানাল মানুষ আর সে একজনও দেখেনি। তাঁর যে কোনো কথারই কম করে চার রকম মানে হতই। যাঁকে বলা হত সে কথা, তিনি একরকম মানে বুঝতেন, এবং অন্যরা অন্যরকম। যাঁর যেমন বুদ্ধি তিনি তেমন বুঝতেন। এমন হিরের মতো কথা চমকাতে খুব কম লোকই জানতেন। নির্মল নিজে খুব বোকা ছিল, তাই কম বুঝত এবং কখনো কখনো আদৌ বুঝত না। ওঁর কথা নির্মলের মাথার ওপর দিয়ে বাম্পার বল-এর মতো বেরিয়ে যেত। ভাগ্যিস যেত!
অলকা, ব্যানার্জিজেঠুর ছোটো মেয়ে ছিল। ওরা দু-বোন। অলকার দিদি ছিল বলাকা। নির্মলের চেয়ে বছর দুয়েকের বড়ো। দু-বোনই কনভেন্টে পড়া। নির্মল অতিসাদামাটা এক অকুলীন বাংলা-স্কুলে লেখাপড়া শিখেছিল। যদিও অবশ্য অনেক পরে একটি কুলীন সাদা-চামড়া মিশনারিদের কলেজে পড়ে নির্মলের নির্ভেজাল অপ্রতিভ বাঙালিয়ানা সামান্য একটু পালিশ পেয়েছিল। সেটা নির্মলের প্রকৃত ভালো করেছিল কি খারাপ, তা অন্যরাই জানেন। আর যখন-তখন নির্মলের ইংরিজি উচ্চারণের খুঁত ধরত ওরা দু-বোন। অক্সেনিয়ান উচ্চারণে ইংরিজি বলতে না পারলে একজন মানুষের মনুষ্যত্বই প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায়! অলকা ছিল নির্মলের চেয়ে বছর দুয়েকের ছোটো। ওরা ওকে খ্যাপাত, নির্মলকে নিয়ে রসিকতা করত; কিন্তু কোনো দুর্বোধ্য কারণে খুব পছন্দও করত। তাতে নির্মলের কোনো কৃতিত্ব ছিলো না। ওদের স্বাভাবিক ভালত্ব ও মহত্বেই বোধ হয় ওরা তাকে পছন্দ করত। যাই-ই হোক, মেয়েরা যে কেন কী করে, তা তখনও বুঝত না নির্মল। এখনও যে পুরোপুরি বোঝে এমনও নয়।
লোকে বলত, নির্মলের চেহারাটা তখন ভালোই ছিল। ভালো গান গাইত তখন ; কবিতা লিখত, খুব মজার গল্প করতে পারত, শিকারও করত। মেয়েদের কাছে পুরুষের কোন কোন গুণ কতখানি প্রিয় তা নিয়ে কখনো মাথা ঘামায়নি যদিও। কিন্তু জেনে ওর ভালো লাগত এক অনাবিল ছেলেমানুষি ভালোলাগা যে, মেয়েরা ওকে সাধারণত পছন্দ করে। ওরা দু-বোনও করত।
একবার গারো পাহাড়ে শিকারে গেল ওরা সকলে মিলে। গারো হিলসের রাজধানী তুরাতে গিয়ে পৌঁছোল তিনটি জিপে করে এক এপ্রিলের শেষে। গৌহাটি থেকে। কেন্দ্রীয় সরকারের মস্ত অফিসার ব্যানার্জিসাহেবের জন্যে সার্কিট হাউস রিজার্ভড ছিল। এবং অন্য একটি ডাকবাংলোও। প্রত্যেক সফল ভারসাম্যসম্পন্ন মানুষেরও কিছু কিছু ইডিওসীনক্রেসী থাকেই। ব্যানার্জিজেঠু নির্মলের বাবার ওপরওয়ালা। ভদ্রলোকের প্রেম সম্বন্ধে খুব ভীতি ছিল। এবং ওঁর জাত-পাতের বিচারও ছিল। অত শিক্ষিত মানুষের মধ্যে ওই দৈন্য নির্মলের প্রত্যাশার ছিল না।
বলাকা তখন একটি দক্ষিণ-ভারতীয় ক্রিকেটারের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছিল। সে খবর ব্যানার্জি সাহেবের অগোচর ছিল না। এবং সে কারণেই পাছে অলকাও ওই সাংঘাতিক ছোঁয়াচে অসুখের কবলিত হয় সেই ভয়ে ব্যানার্জিসাহেবের সাবধানতার অন্ত ছিল না।
ওঁরা সকলেই উঠলেন সার্কিট হাউসে। নির্মলের বাবা পর্যন্ত। শুধু নির্মলকে ওঁদের অন্যান্য অধস্তন কর্মচারীদের সঙ্গে ডাকবাংলোতে যেতে বলা হল। কিন্তু দু-বেলা খেতে আসতে হবে সার্কিট হাউসেই।
প্রথম রাতেই কালবৈশাখী ঝড়-বৃষ্টি নামল। ঘন ঘন বাজ পড়ার শব্দের পর এবং ঝড়ের পর বৃষ্টি থামল।
রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর গারো পাহাড়ের রাজধানী তুরা শহরের সার্কিট হাউসের চওড়া বারান্দাতে ওরা বসেছিল। অলকা পীড়াপীড়ি করতে লাগল ওকে, নিমুদা একটা গান গাও। প্লীজ।
অনুরোধ শিরোধার্য করে ঝরঝরানি বৃষ্টির মধ্যে গারো পাহাড়ের বাঁশ আর হরজাই জঙ্গল আর মাটির সোঁদা গন্ধের মধ্যে বসে নির্মল গান গাইছিল। একটার পর একটা। দুটি গানের কথা, আশ্চর্য! আজ এত বছর পরও ওর মনে পড়ে গেল। ‘বৃষ্টি শেষের এই হাওয়া কিসের খোঁজে বেড়ায় ফিরে ফিরে’ এবং ‘‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা নিশীথ যামিনী রে।’’ তখন ভানুসিংহের পদাবলীর সব গান নির্মলের কন্ঠস্থই ছিল। কেউ অনুরোধ করলেই কলের গানের মতো ওর গান বেরোত। যখন গান গাইছিল অন্ধকারে বসে, তখন অলকা তার দিদিকে সরিয়ে দিয়ে পাশে এসে বসল। অন্ধকারে ওর মুখ দেখতে পাচ্ছিল না নির্মল কিন্তু ওর প্রতি অলকার ভালোলাগার গন্ধ বৃষ্টির ও ভিজেমাটির গন্ধের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে এসে নির্মলের উনিশ-কুড়ি বছরের টাটকা মনের বনে বড়ো সুগন্ধি সব নি:শব্দ ফুল ফুটিয়ে যাচ্ছিল। হয়তো অলকার মনেও। অলকা নির্মলের হাতটা টেনে নিয়ে ওর লাল-কালো খোপ-খোপ স্কার্টের ওপরে ওর কোলে রেখে বসেছিল। কারও ভালবাসার হাতে হাত রাখতে যে কত ভাল লাগে তা এখন মনে হলে সারাগায়ে শিরশিরানি জাগে নির্মলের। গান শেষ হলে বলেছিল, নিমুদা, তুমি যে, কত ভালো তা তুমি জানো না।
ওর কথা শেষ হবার আগেই ব্যানার্জিসাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, নিমু, জি-উ-এন গান আর এই গান ডু নট গো হ্যাণ্ড ইন হ্যাণ্ড। সে-এ গুডনাইট টু ওল অ্যাণ্ড গেট ব্যাক টু ইওর বাংলো। কালকে সকাল পাঁচটাতে আমাদের বেরোতে হবে শিকারে। বীটিং হবে। জানো তো?
বাবা বললেন, নিমু রাত হয়েছে, বৃষ্টি থেমেছে, এবারে গিয়ে শুয়ে পড়ো। চারটেতে উঠে রাইফেল দুটো ক্লীন করে তৈরি হয়ে থেকো!
নির্মল জানে যে, কাল ভোর আসবে। শিকারে বেরোবে। ছুলোয়া শিকার হবে। অলকা আর বলাকারও সঙ্গে শিকারে যাবার খুবই ইচ্ছে। ব্যানার্জীসাহেব নারাজ। বাবার উমেদারিতে অবশেষে রাজি হয়েছিলেন।
নির্মল ‘‘গুডনাইট’’ করে চলে গেল। অলকা সার্কিট হাউসের কম্পাউণ্ডের গেট অবধি পৌঁছে দিয়ে গেল নির্মলকে।
গেটে দাঁড়িয়ে বলল, রাতে ঘুমোতে পারবে? তুমি?
নির্মল বলল এত মাইল জিপে এলাম, এতগুলো গান গাইলাম গলা ছেড়ে, ভীষণই টায়ার্ড। পড়ব আর ঘুমোব।
অলকা অবাক চোখে নির্মলের চোখে তাকিয়ে বলল, ঘুমুবে? পারবে? আমার কিন্তু ঘুম হবে না আজ রাতে।
সে কী! ঘুম পায়নি তোমার? কেন ঘুম হবে না?
অলকা বলল, তুমি একটি বোকারাম!
তারপর হঠাৎই নির্মলের হাত দুটি ওর দু-হাতে নিয়ে বুকের কাছে জড়ো করে বলল, উ্য আর আ সুইটী পাঈ। ইওর সুইটনেস লাইজ ইন ইওর ইনোসেন্স।
যে-কোনো মেয়েই তার চেয়ে বয়সে বড়ো যে-কোনো ছেলের চেয়ে যে অনেকই বেশি জানে সেদিনই নির্মল তা বুঝেছিল।
ডাকবাংলোয় ফিরে আসতে আসতে ও ভাবছিল, অলকা কী ভালো! ‘তুমি একটি হাঁদারাম!’ এই সহজ সরল বাংলা বাক্যটি ইংরজিতে কত সুন্দর করে, মিষ্টি করে বলতে পারল ও!
এমন সময় ফোনটা বাজল। নির্মলের সেক্রেটারি বলল, স্যার মিসেস অলকা মুখার্জি ফোন করেছেন, বলছেন আপনাকে দিতে। আপনি রেস্ট নিচ্ছেন বলেছি, তবুও উনি বললেন যে, আপনি বিরক্ত হবেন না। নাম বললেই হবে। লাইনটা দিতেই হবে।
নির্মল একটু চুপ করে থেকে বলল, দাও।
নিমুদা। চিনতে পারছ?
ওর কথার উত্তর না দিয়ে নির্মল বলল, তুমি কেমন আছ?
আমি? আছি। আছি এই পর্যন্ত। তুমি কেমন আছ বলো?
কী ভালো লাগছে যে লাগছে তোমার গলা শুনে।
কবে এসেছ?
এসেছি পরশু কিন্তু এই শনিবারেই চলে যাব দার্জিলিং। দার্জিলিং থেকে ফিরেই দিল্লি, দিল্লিতে তিনদিন থেকে দিল্লি থেকেই ফ্লাইট ধরব ভারতবর্ষে এসেছি প্রায় কুড়িদিন হল। আমার মেয়েদের নিয়ে এসেছি ভারতবর্ষ দেখাতে। কোনারক-টোনারক ঘুরে এই এলাম।
মেয়েরা কত বড়ো হল? ক-মেয়ে তোমার?
দু-মেয়ে। বড়োর বয়স কুড়ি। ছোটোর আঠারো।
তারপরই বলল, একবার আসবে? তোমাকে কত বছর দেখিনি। তুমি কি দেখতে সেরকমই আছ? রবার্ট টেইলরের মতো?
নির্মল হাসল। এখন হঠাৎ কেউ এরকম কিছু বললে হাসিই পায়। চকিতে মনে পড়ে গেল একদিন অলকা বলেছিল জানো, রবার্ট টেইলরের বই এলেই আমি কলেজ পালিয়ে ম্যাটিনি শো’তে দেখে আসি। তোমার সঙ্গে খুব মিল আছে। হাঁটার, চলার, কথা বলার।
নির্মল তখন হাসত ওর কথা শুনে। মনে মনে যে খুব গর্বিত হত একথাও অস্বীকার করবে না। বলত পাগলি! তুমি একটি আস্ত পাগলি।
নির্মল দম নিয়ে বলল, এখন আমাকে না দেখাই ভালো। রবার্ট টেইলরের ভূত দেখে আর কী করবে?
ও বলল, ‘আহা! আমিও তো একেবারে বুড়ি হয়ে গেছি। কিন্তু মানুষের চেহারাই কি সব? তুমি রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতাটি ভুলে গেছ? সেই ‘হঠাৎ দেখা’। কবিতাটি! কী যেন প্রথম লাইনটি? —রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা। তাই না? ‘আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে? কিছুই কি নেই বাকি?’ আর এর জবাবে উত্তরের সেই লাইনটি? ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।’ আছে নিমুদা, রাতের সব তারারা সত্যিই থাকে দিনের আলোর গভীরে। নইলে পঁচিশ বছর পর দেশে ফিরে তোমায় ফোন করি? তোমায় এত দেখতে ইচ্ছে হয়?
নির্মল ভাবছিল অলকার চিঠির কথা। বছর দশেক আগে হঠাৎ-চিঠির জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছিল ও। একটি চিঠি নির্মলের স্ত্রীর হাতে পড়েছিল। তখন থেকেই ‘তোমার ওল্ড ফ্লেমের খবর কী’ বলে সে নির্মলকে প্রায়ই ঠাট্টা করত। চিঠির উত্তর না-পেতে-পেতে ও ক্লান্ত, বিরক্ত অপমানিত হয়ে চিঠি দেওয়া বন্ধ করেছিল। নির্মলদের সময় নারী ও পুরুষ এতখানি আধুনিক হয়ে ওঠেনি। আজকের মতন।
অলকা বলল, ‘তোমার ছেলেমেয়ে কী? বউদির নাম কী? কেমন দেখতে?
‘এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে এঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষা দেবে এবার। মেয়ে ডাক্তারিতে ভরতি হয়েছে।’
আর বউদি?
বউদিরা যেমন হয়।
বউদির নামই বৌদি।?
কথা ঘুরিয়ে নির্মল বলল, তোমার স্বামী? তিনি কেমন আছেন?
ভালোই। বিয়ের সময়েই তো মস্ত টাক ছিল। এখন টাকের দু-পাশে ঘাড়ের কাছের চুল সব সাদা হয়ে গেছে। হাটুতে আরথ্রাইটিস। ইসিনোফিলিয়ার রুগি। মানুষটা খারাপ নয়। ভালোই। আমার চেয়ে তেরো বছরের বড়ো। চিরদিনই একঘেয়ে। ইন ফ্যাক্ট ভালো মানুষেরা, স্ট্রেইট লাইনেরই মতো বড়ো আনইন্টারেস্টিং হয়। জামাই হিসেবে তারা ভালো। স্বামী হিসেবে নয়। ঝগড়া করে সুখ নেই। ভালোবেসে সুখ নেই। পুরোপুরিই একজন ম্যাটার-অফ ফ্যাক্ট কেরিয়ারিস্ট। আসলে, এত বছর একসঙ্গে থেকে, একখাটে শুয়ে মানুষটাকে আজকে আর খতিয়ে দেখার উপায় পর্যন্ত নই। এ্যাকসেপ্ট করে নিয়েছি আর কী। যেমন বিয়েটাও একদিন এ্যাকসেপ্ট করে নিয়েছিলাম। ও নিয়ে আর ভাবি না। ও আমার মেয়েদের বাবা। মাস্টার অফ দ্যা হাউস। দ্যাটস ওল।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে অলি বলল, আসলে, দূরে না গেলে, দূর থেকে না দেখলে, কিছুই দেখা হয় না। আবিষ্কৃত হয় না। বাবার জেদেই আমাকে বিয়ে করতে হল এবং বিয়ে করে সঙ্গে সঙ্গে ইংল্যাণ্ডে চলে না গেলে হয়তো তোমাকে ভুলেও যেতাম। দূরে ছিলাম, আছি বলেই, তোমাকে মনে না করে পারি না। তুমি কিন্তু এক দারুণ ইন্টারেস্টিং, রেমান্টিক ইণ্ডিভিজুয়াল ছিলে। আমার সুইটী পাঈ। প্রিন্স চার্মিং। জানো, আমার মেয়েরা তোমার কথা নিয়ে সব সময় আমাকে ঠাট্টা করে, খেপায়, হাসে। আমি তবুও এখনও সব সময় তোমার কথাই বলি, ভাবি।
তারপর হঠাৎ বলল, বউদি কী বলে? শী মাস্ট বী ভেরী ভেরী প্রাউড অফ উ্য ! ইজন্ট শী?
নির্মল হাসল।
বলল, তোমার বউদিও বলেন আমার মতো একঘেয়ে ম্যাটার-অফ-ফ্যাক্ট কে রিয়ারিস্ট—রস-কষ-হীন পুরুষমানুষ আর নাকি দেখেননি। তার জীবনটাই মাটি হয়েছে আমাকে বিয়ে করে।
অলি বলল, আই ডোন্ট বিলিভ আ সিংগল ওয়ার্ড অফ ইট। আই জাস্ট ডোন্ট। টেল হার টু সোয়াপ হাসব্যাণ্ডস! উইল শী?
নির্মল হাসল, বলল, আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে হলেও আজ তুমিও হয়তো তোমার বউদি যা বলে, ঠিক তাই-ই বলতে। ফ্যামিলিয়ারিটি ব্রীডস কনটেমপ্ট।
আই ডোন্নো। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু বিলিভ ইট। ফ্যামিলিয়াটির সৌভাগ্য যার জীবনে এলোই না, অমন করে এ্যারোগ্যান্টলি ওকথা সে মানুষ বলতে পারে না। কী করে বলি তা বলো!
তারপর বলল, শোনো, শুক্রবারের মধ্যে যে-কোনো দিন এসো। প্লীজ, আই বেগ-অফ উ্য। ফর ওল্ড টাইমস সেক। আমার কথাটা রেখো। প্লীজ। কত্তদিন তোমাকে দেখিনি। …কী? আসবে তো? তুমি না এলে আমার মেয়েরা কিন্তু ভাববে, তুমি একটি মীথ। মিয়ার মীথ। ওদের কাছে আমার মুখ থাকবে না।
নির্মল বলল মীথকে মীথ করে রাখাই ভালো অলি। মীথ যখন এক্সপ্লোডেড হয়, তখন তা হাইড্রোজেন-বম্ব এক্সপ্লোশানের চেয়েও মারাত্মক হয়। মীথ; মীথই থাকুক।
অলকা বলল, আমি কিন্তু ভীষণ রেগে যাব। আমি কিন্তু ছোটোবেলার মতো কাঁদব; তুমি না এলে। তুমি জানো, আমি সুমিত্রার বাড়িতে প্রাইভেসি নেই বলে টেলিফোন বুথ-এ এসে তোমাকে ফোন করছি। অ্যাজ আই ইউজড টু ডু ইন দ্যা ওল্ড টাইমস। বাবার ভয়ে। প্লীজ এসো। বাড়িতে না থাকলে, পাছে তোমার সঙ্গে দেখা না হয়, তাই আমি সমস্ত নেমন্তন্ন ক্যানসেল করেছি। এ ক-দিন প্রত্যেক দিনই সন্ধেতে বাড়ি থাকব। প্লীজ ড্রপ ইন অন ইওর ওয়ে ব্যাক ফ্রম দ্যা অফিস। প্লীজ ডু কাম।
নির্মল বলল, আচ্ছা।
ও বলল, ছাড়ছি নিমুদা। বাঈ। এসো কিন্তু। প্রমিস?
প্রমিস বলেই ফোনটা ছেড়ে দিল নির্মল।
ছেড়ে দিয়ে…
সেই সব পুরোনো কথা, অন্ধকার ঘরের চেয়ারে বসে পা ছড়িয়ে ভাবতে লাগল নির্মল। ভাবছিল সেই তুরার কথা। পরদিন সকালে ছুলোয়া শিকারে নির্মল একটি লেপার্ড মেরেছিল। উঃ! অলকা আর বলাকার সে কী উত্তেজনা! রাতে যাকে দূর-বাংলোয় নির্বাসন দিয়েছিলেন ব্যানার্জিজেঠু, সকালে তাকেই হিরোর মর্যাদা দিয়েছিলেন। ব্যানার্জিজেঠুর শিকারে খুব উৎসাহ থাকলেও, বাঘ, সবরকম বাঘকেই ভীষণ ভয় পেতেন। এবং বাঘ দেখলেই নার্ভাস হয়ে যেতেন।
কিন্তু বাঘের চেয়েও ভয় পেতেন প্রেমকে। ব্যানার্জিজেঠু জানতেন না যে লখিন্দরের লোহার বাসর ঘরে ঢোকা সাপেরই মতো, সূক্ষ্ম শরীরে প্রেম কোন মনে যে কখন প্রবেশ করে আর কোন মনে যে করে না, তা খুব কম লোকই বলতে পারেন। নির্মলের প্রেমে পড়া থেকে অলকাকে বাঁচাতে তিনি পারেননি। অলকা, ব্যানার্জিজেঠুর সঙ্গে যেদিন তার বিয়ের নেমতন্ন করতে এসেছিল নির্মলদের ভবানীপুরের বাড়িতে, সেদিন অলকা নির্মলের ঘরে এসেছিল একা একা। এসে, দরজাতে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে হেসে বলেছিল, নিমুদা! আমার বিয়ে। তুমি এসো কিন্তু।
কিন্তু মেঘ যেমন দেখতে দেখতে বৃষ্টি হয়, মুভি ক্যামেরার ছবি যেমন ফেডআউট করে যায়, ডিফিউজড হয়ে যায়, তেমন করে ওর হাসিটা নি:শব্দে কান্না হয়ে সেই মুহূর্তে গলে গেছিল।
নির্মলের ঘর ছেড়ে চলে যাবার সময় হঠাৎই বলেছিল, তুমি একটা বোকা! সত্যিই হাঁদারাম তুমি!
নির্মল তখনও ছাত্র। নিজের পায়ে দাঁড়ায়নি। তা ছাড়া, সত্যি কথা বলতে কী ওর বাবার ওপরওয়ালার মেয়ে যে সত্যিই ওকে ভালোবাসতে পারে এমন ভাবার সাহসও ওর ছিল না। আসলে সবদিক দিয়েই বোকা ছিল ও। এখনও আছে। অনেকরকম হীনমন্যতাও ছিল।
ডাইরিটা তুলে নিয়ে দেখল নির্মল। আজ সোমবার। একমাত্র বৃহস্পতিবারে রাতে একটা পার্টি ছাড়া সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে সন্ধেবেলাতে কোনোই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই। কিন্তু ডাইরিটা নামিয়ে রেখেই ও ঠিক করল যে, যাবে না। অলিকে একদিন অস্পষ্ট, অনভিজ্ঞ এক নরম ভীরু ভালোবাসাতে ভালোবেসেছিল বলেই যাবে না। অলির ভালোবাসা ছিল ওর নিজের কাছে স্পষ্ট। হয়তো আজও আছে। কিন্তু নির্মলের ভালোবাসা ভীরু-রাতের তারাদেরই মতো দিনের আলোর গভীরে মুখ-লুকানো ছিল।
ওরা যখন ছোটো ছিল তখন ওদের ভালোবাসা ওইরকমই ছিল। যাকে আধুনিক ছেলেমেয়েরা ঠাট্টা করে বলে ‘‘কাফ-লাভ’’। হয়তো তাই-ই। কিন্তু শুধু বাছুররাই জানত, জানে, বাছুরদের আনন্দ। আজকের ওদের ভালোবাসার রকম আলাদা। ভালোবাসা ছিল অন্যরকম। কিন্তু ওদের ভালোবাসার চেয়ে তা কোনো অংশেই নিকৃষ্ট ছিল না। অলিটা বোকা। ওর মেয়েদের পক্ষে সম্ভব নয় কখনোই ওর ভালোবাসার স্বরূপকে বোঝা। নির্মল ওর কাছে গিয়ে আজ নিজেকে ও অলিকে এবং ওদের আর ভিক্টোরিয়ান আমলের ফার্নিচারের মতো কারুকার্যময় অ্যান্টিক ভালোবাসাকে অপমানিত করতে পারে না। কোনো মতেই পারে না। আজকের প্রৌঢ় নির্মল আর প্রৌঢ়া অলকাকে নিয়ে তরুণী মডার্ন মেয়েরা হাসাহাসি করুক, এ চায় না নির্মল।
দিল্লি থেকে প্লেনে উঠে অলি নির্মলের ওপর খুবই অভিমান করবে, ও জানে তা। কিন্তু অলি জানে না, ভালবাসার পাখিকে সব সময় দূরের অজানা জঙ্গলের, অনামা গাছের, অদৃশ্য ডালে বসেই ডাকতে দিতে হয়। সব পাখিকেই দেখতে নেই। সব পাখি দেখতে যে হয় না, বা দেখতে যে চাইতে পর্যন্ত নেই, একথা বার্ড-ওয়াচারদের অজানা। ভালোবাসার পাখি অন্ধকার বনে অ-দেখা থাকলেই, দূরে থাকলেই, ভালোবাসা বেঁচে থাকে। আলোয় তাকে টেনে আনলে, বড়ো কাছ থেকে দেখতে গেলে, সেই বড়ো নরম অভিমানী সুন্দর পাখি আর বাঁচে না।