বীজতলি

বীজতলি

এবারে গরমটা বেশ বেশিই পড়েছিল। বর্ষা না নামলে ফসল কী হবে-না-হবে, কিছুই বলা যায় না। জমি অবশ্য সামান্যই, কিন্তু তবু সেটুকুও সামলে-সুমলে না রাখলেও চলে না।

কমলার আত্মসম্মানজ্ঞানটা চিরদিনই টনটনে। সে কারণে তাঁর ছেলে-মেয়ের সংখ্যা নিতান্ত কম না হলেও তাদের কাছে নিজের পেটের কারণে হাত পাততে তাঁর সম্মানে লাগে। কেউ ভালোবেসে কিছু করলে, অন্য কথা।

অবশ্য নিজের প্রয়োজন বলতেও তো তেমন কিছুই নয়। এক চড়া খান। রাতে একটু খই-দুধ। সামান্য ফলমূল। থানকাপড় আর শায়া-ব্লাউজের খরচও তেমন কিছুই নয়। চলে যায় একরকম করে।

বড়োছেলে অকু প্রায়ই লেখে কটক থেকে : ‘মা এখানেই চলে এসো। মায়ে-ব্যাটায় কষ্টেসৃষ্টে চলে যাবে। জমি ও বাড়ি বেচেবুচে যা পাও তা নিয়ে চলে এসো। আমিও তো বুড়োই হয়ে গেলাম। রানি কেমন ডঙ্কা বাজিয়ে শাঁখা-সিঁদুর নিয়ে চলে গেল দেখলে তো! কে আগে যায়, কে পরে, তা কি কেউ বলতে পারে? পাঁচটা নয় দশটা নয় আমার একটাই মা, আমার দু-মুঠো জুটলে তোমারও জুটবে। চলে এসো আর দেরি না করে।’

মাটির দাওয়ায় মাদুর পেতে, হাতে অকুর লেখা খোলা চিঠি নিয়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে অনেক কিছু ভাবেন কমলা। কাঁঠাল গাছ থেকে কাঁঠাল পাতা ঝরে পড়ে। রঙ্গনের ডালে বুলবুলি শিস দেয়। মৌটুসকি পাখি টুসকি মেরে মেরে সারাবছর ধরে ফোটা, জবা ফুলে কাঁপন তুলে মধু খায়। উদাস হয়ে যান কমলা নানাকথা ভাবতে ভাবতে।

স্বামী মুকুন্দ দেশভাগ হওয়ার পর কলকাতায় কিছুদিন ভিখিরির মতো ঘুরে বেড়িয়ে শেষে আসামের এই গোয়ালপাড়া জেলার কুমারগঞ্জে এসেই আস্তানা গেড়েছিলেন। কলকাতা শহরের রুক্ষ স্বার্থপর হৃদয়হীনতার নোনাস্বাদ মুখে নিয়ে। তখন বড়োছেলে অকুর বয়স মাত্র দশ। এবং সবচেয়ে ছোটোসন্তান মেয়ে দিবার বয়স মাত্র দুই। কীভাবে যে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে এই দুটি মাটির ঘরে দিনগুজরান করেছিলেন তাঁরা, এখন ভাবলেও অবাক লাগে। নেহাত সস্তার দিন ছিল তাই।

মুকুন্দ ছিলেন জমিদারপুত্র। মুকুন্দ তো চলে গেলেন তিন দিনের জ্বরে। তখন অকুর বয়স মাত্র পনেরো। আসলে, যৌবনের প্রান্তভাগ পর্যন্ত অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে কাটিয়ে এসে দেশভাগের এই দুর্দৈব মুকুন্দ আর সহ্য করতে পারলেন না। এত গ্লানি, অপমান, নিজেদের বিনাদোষে স্বীকার করে নেওয়া ওঁর পক্ষে কষ্টকর ছিল। গান্ধি, জওহরলাল আর জিন্নার ওপরে বড়ো গভীর রাগ নিয়ে মারা গেছিলেন মুকুন্দ।

মুকুন্দের দোষ ছিল অনেকই। তারমধ্যে প্রধানতম দোষ এই যে, তাঁরা নিজেদের বদলাতে পারেননি। সময়ের সঙ্গে তাল রেখে নিজেদের শিকড় থেকে সম্পূর্ণ ছিন্ন করতে পারেননি নিজেদের। আফ্রিকান হাতির মতো, নিজেদের স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ছেড়ে এসে আর বাঁচতে পারেননি। পোষমানা স্বভাব থাকে না কিছু মানুষের। মুকুন্দ সেই জাতের মানুষ ছিলেন।

অকুটাই সবচেয়ে আদুরে ছেলে ছিল, কিন্তু সবচেয়ে বেশি কষ্ট করেছে ও-ই, কমলার সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই পুরো সংসারটাকে দুর্যোগের সাইক্লোনের মধ্যে আড়াল করা চারাগাছের প্ল্যান্টেশনের মতোই বাঁচিয়ে রাখতে। অথচ আজকে অকুকেই ভুলে গেছে সেইসব ভাই-বোন যাদের জন্যে সবচেয়ে বেশি করেছে সে-ই। কমলার মাঝে মাঝে মনে হয় অনেকগুলো গাধা মরে বড়ো পরিবারের বড়োছেলে জন্মায়।

সব বেচে-বুচে দিয়ে চলে যেতেন একদিন হয়তো কমলা কুমারগঞ্জ ছেড়ে। কিন্তু এই পড়ো-পড়ো পোড়োবাড়ির মধ্যেই মুকুন্দর স্মৃতি বেঁচে আছে। ঢেঁকিতে পা দিতে দিতে, কলাই-এর ডাল উঠোনে শুকোতে শুকোতে, মুগ আর অড়হড় ডালের বড়ি বসাতে বসাতে এবং আমলকী আর আমের আচার তেলে চারাতে চারাতে এখনও মুকুন্দর কথা মনে পড়ে প্রায়ই কমলার। তার ফোটোতে সকালে একটি করে মালা পরান, যেকোনো ফুলে গাঁথা। কখনো গরমে পূর্ণিমার রাতে, যখন নদীর দিক থেকে জোরে হাওয়া বয় তখন, অথবা ঘন বর্ষার ব্যাং আর ঝিঁঝির ডাকে ভারী শোঁ-শোঁ হাওয়ার গর্জন-তর্জনের মধ্যে বসে কমলা মুকুন্দর প্রিয় রামপ্রসাদি গান গুনগুন করে গান এখনও। মানুষ চলে যায়; তার স্মৃতি পড়ে থাকে। তীব্র আতরগন্ধী শরীরী কাম নি:শেষে উড়ে গেছে, কিন্তু প্রেম ঠিকই জড়িয়ে আছে যৌবনহীনা কমলার মনে। একদিন যেসব ইন্দ্রিয়ই পরিতৃপ্ত হয়েছিল পূর্ণতায়, তার স্মৃতি জেগে আছে, থাকবে, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। দরাজ হাতে রাঁধা ইলিশ মাছের গন্ধর মতো, ফুলশয্যার রাতে চুমু খাওয়ার উত্তেজনাময় অস্বস্তিকর স্বাদের মতো, প্রথম মৈথুনের আশ্চর্য নিবিড় পরিপ্লুতির সোঁদা সিঁধেল চুরির অবশ করা যুগলবন্দি অনুভূতির ঐশ্বর্যে অঙ্গাঙ্গি হয়ে। সব হারায় না; বাকি থাকে কিছু।

অনেকই থাকে হয়তো!

কমলার টিনের তোরঙ্গে একটি বংশলতিকা আছে।

অকু কটকের এক স-মিলে কাজ করত। ঢুকেছিল কুড়ি বছর বয়সে। সমস্ত মাইনে পাঠিয়ে দিত কমলাকে। নিজে না খেয়ে থেকে। ফলে যঞ্জা রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। কাজও চলে যায়। নতুন কাজ নেয় কটকের খুব নামি ঠিকাদার সুর বাবুদের কাঠের গোলায়। বিয়ে করে, পঁয়ত্রিশে।

রানি বড়ো ভালো মেয়ে ছিল। নিজেকে অমন করে বঞ্চিত করে কোনো বউ, দেওর-ননদ-শাশুড়ির ভালো দেখে না আজকাল। রানি মাত্র পাঁচ বছর চরম দারিদ্র্যের মধ্যে সংসার করে রানির পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। ওদের একমাত্র ছেলে, লংকা। লংকার বয়স এখন পনেরো।

বকু ডালটনগঞ্জে এক গালার ব্যাবসাদারের কাছে কাজ করে। বকু আর ছবির এক ছেলে, এক মেয়ে।

দকুকে মানুষ করে, বলতে গেলে অকুই। ও নিজেকে সবদিক দিয়ে বঞ্চিত করে যঞ্জা রোগাক্রান্ত হয়ে ছোটোভাইকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ না করলে, দকু আজকে পাঁচ হাজারি মাইনের চাকরি করতে পারত না দিল্লিতে। পড়াশুনায় দকু অবশ্য খুবই মেধাবী ছিল চিরদিনই। ও কিন্তু মুকুন্দর হৃদয় পায়নি। মা হিসেবে কমলা একথা জানেন যে, আজকে সবচেয়ে বড়োলোক হতে পারে দকু, কিন্তু ছেলে-মেয়েদের মধ্যে অমানুষ হয়েছে একমাত্র সে-ই। মেধা, সাচ্ছল্য, যশ কোনো কিছুর সঙ্গেই মনুষ্যত্বের কোনো সাযুজ্য নেই। কমলা নিজের জীবনেই অনেক মেধাবী, ধনী এবং যশস্বী অমানুষ দেখেছেন। দকুকে উনি মানুষ বলে গণ্যই করেন না। যে ছেলেকে নিয়ে তাঁর সবচেয়ে বেশি গর্বিত হওয়ার কথা ছিল, তাকেই তিনি অস্বীকার করেন। দকুও যে তাঁকে অস্বীকার করে শুধু সে-কারণেই নয়; দকু তাঁকে এবং অকুকে তাঁদের ন্যায্য মর্যাদা ও সম্মান যদি দিত তা হলেও তিনি স্বীকার করতেন না ওকে। ও যখন পেটে আসে তখন কমলা নিজেও বড়ো নীচ ও পশুসুলভ মানসিকতার শিকার হয়েছিলেন।

সেকথা যাক।

সেকথা একমাত্র তিনিই জানেন, আর জানে সেই পশু। সে এখন বেঁচে আছে কি না, এবং বেঁচে থাকলেও কোথায় আছে, সে খবর জানেন না কমলা। জানতেও চান না।

এ জীবনে নিজেকে তিনি একবারই ছোটো করেছিলেন, মিথ্যাচার করেছিলেন একটিমাত্র বার মুকুন্দর সঙ্গে। দকু তাঁর সেই পাপের ফল। পাপের গাছের ফলে পাপের গন্ধ লেগে থাকেই। পাপের ফুল ধরে তাতে। সে ফুল জুঁই-বেলি নয়, ধুতরা বা আকন্দ।

ওই একটিমাত্র সন্তানকেই মুকুন্দর সন্তান বলে মনে হয় না। সংগত কারণেই। মুকুন্দ কখনো মেধাবী ছিলেন না, বুদ্ধি এবং দুর্বুদ্ধি দুই-ই ছিল না তাঁর। তাঁর মস্তিষ্ক ছিল তাঁর নায়েব। দীর্ঘ অব্যবহারে মস্তিষ্কের ক্ষমতা লোপ পেয়েছিল। কিন্তু হৃদয় ছিল মানুষটার মস্তবড়ো। তাঁর সুদর্শন, সুঠাম শরীরের ছিঁটেফোঁটাও নায়েবের ছিল না। তার কাম ছিল প্রবল কিন্তু প্রেম কাকে বলে সে সম্বন্ধে তার ধারণা পর্যন্ত ছিল না।

কমলা মানুষ হিসেবে কখনো খারাপ ছিলেন না। অসতী ছিলেন না। কিন্তু ভগবতীও ছিলেন না; নেহাত একজন মানুষই ছিলেন। কোনো বিশেষ সময়ে জীবনের কোনো বিশেষ মুহূর্তে তাঁর কামভাব তাঁর ভালোত্বকে ছাপিয়ে উঠেছিল। আজকে জীবনে অনেক পথ চলে এসে, পড়ন্ত বেলার ফিকে রোদ্দুরে উঠোনের মাটির দাওয়ায় বসে, গ্রীষ্মশেষের নদী থেকে আসা হাওয়ার মধ্যে ঝরে-পড়া হলুদ-লাল কাঁঠাল পাতার মতো ভেসে যেতে যেতে কমলার মনে হয় যে, তাঁর জীবনটা এক মিশ্রবোধ, মিশ্র সততা, মিশ্র প্রেম, মিশ্র ভালো-মন্দের জীবন। হয়তো সকলের জীবনই তাই। অবিমিশ্রতা বোধ হয় মানুষের জীবনে একটি লক্ষ্য, একটি আদর্শ, কখনো কাম্য অথবা লভ্য হয়। সতীত্ব যে কখন গিয়ে গড়িয়ে যায় পরপুরুষের বাহুবন্ধনের উষ্ণতায়; সততা, অবিশ্বাস্য অসততাতে; প্রেম, তীব্র অনীহা ও বিরক্তির অপ্রেমে, ভালোত্ব, খারাপত্বর হোগল-রাদায় তা কোনো মানুষের পক্ষেই আগে বলা বা জানা অসম্ভব। এবং অসম্ভব বলেই আমরা মানুষ, ভগবান নই। এবং ভগবান নই বলেই এত সুখী আমরা। অথবা দুঃখীও।

ভাবেন কমলা। সপ্তাহ দুই পরে অকুর কাছে যাবেন বলে তৈরি হতে হবে কমলাকে। লংকাই আসত তাঁকে নিতে। কিন্তু পরীক্ষার কারণে আসতে পারবে না। এবারে কটক গেলে একেবারে রথযাত্রা অবধিই থেকে আসবেন। অকু পুরীতে নিয়ে যাবে বলেছে। সেইসঙ্গে ধবলগিরি, উদয়গিরি-খন্ডগিরি ইত্যাদিও দেখে আসবেন। নতুন কিছু দেখার উৎসাহ আর নেই। এখন শুধুই সময় কাটানো। সময় যত সুন্দরভাবে কাটানো যায়। জীবনের বেশিরভাগটিতেই মানুষের হাতে সময় থাকে না। সময় যখন দামি থাকে তখন সময় একেবারেই থাকে না। আর সময়ের দাম যখন থাকে না তখনই সময় থাকে অঢেল। কেউই কিনতে আসে না, এমনকী ধার বা দান দিতে পর্যন্ত আসে না। সময়ের রসদ জমতে থাকে, ভারী হতে থাকে, তারপর অবসরের স্বল্প অবকাশে তাকে আঁটানো পর্যন্ত মুশকিল হয়ে পড়ে। তারপর একসময় কমলার মতো বেশিরভাগ বিধবা নারী বা বিপত্নীক পুরুষ সেই জমা-সময়ের পাহাড়ের নীচে চাপা পড়ে যান, হারিয়ে যান চিরতরে।

অকু নিজে এসেছিল কটক স্টেশনে কমলাকে নিতে।

ট্রেনের কামরার ভেতরেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল মাকে। বছর দেড়েক পরে দেখলেন কমলা অকুকে। একেবারে বুড়ো বুড়ো দেখাচ্ছে ওকে। কপালের দু-পাশের চুলে পাক ধরেছে, সামনেটাতে টাক পড়েছে অনেকখানি। পান আর গুণ্ডি খেয়ে খেয়ে দাঁতগুলো কালো। গুড়াখু দিয়ে মাজতে মাজতে বোধ হয় আরও একটু বেশি কালো দেখাচ্ছে।

সাইকেল রিকশাতে মালপত্র চাপিয়ে নিয়ে, মাকে নিয়ে অকু চলল বাখরাবাদের দিকে। নদীর পাড় ছেড়ে ঢালু রাস্তা দিয়ে নেমে রিকশা এগিয়ে চলল। তারপর ‘দে’জ মেডিকেলের’ ওষুধের গুদোমের সামনে বাঁক নিয়ে চলল রিকশা ছায়াচ্ছন্ন শান্তির রাস্তা দিয়ে।

অকুর কাছে কটকে; বকুর কাছে ডালটনগঞ্জে অথবা নিশির কাছে কৃষ্ণনগরে যেতেও আর অত খারাপ লাগে না। কিন্তু যেতে ইচ্ছে করে না একেবারেই কলকাতাতে। দিবার কাছে। নিশ্বাস নেওয়া যায় না, পথে হাঁটা যায় না, ট্রামে-বাসে চড়া যায় না, বর্ষার ব্রহ্মপুত্রের স্রোতের মতো মানুষজন আর যানবাহনের স্রোত। দিবা আর রাজেনকে তিনি বলেন বদলি নিয়ে যেখানে হোক চলে যেতে। ছেলে-মেয়েগুলো তো অন্তত একটু খোলা হাওয়ায় নিশ্বাস নিয়ে বাঁচবে। এই কারণেই পুজোর সময় বা বড়োদিনের ছুটিতে আর কেউ আসুক আর না-আসুক দিবা আসে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কুমারগঞ্জে, ধুবড়ি হয়ে। রাজেনও আসে। যখন পারে না, ছেলে-মেয়েদের পাঠিয়ে দেয় দিবার সঙ্গে।

অকু মালপত্র সব নামিয়ে আনল। গন্ধরাজ লেবু দিয়ে আর চিনি দিয়ে মাকে নিজেহাতে শরবত করে খাওয়াল। বাইরি বলে একটি লোক আছে। সে-ই অকু আর লংকার রান্নাবান্না, দেখাশোনা করে। তবে, মোটামুটি রাঁধে। কমলা এলেই ভালোটা-মন্দটা রেঁধে খাওয়ান ছেলে-নাতিকে। ভালো-মন্দ মানে, ছেলের পছন্দের রান্না। লংকাটা তো একেবারে ওড়িয়াই হয়ে গেছে, বাংলাও বলে ওড়িয়া টানে। ওর বিশেষ বিশেষ বাঙালি রান্নার কোনো লোভ নেই। বরং দিদাকে লম্বা ফিরিস্তি শোনায়, কোন দোকানে ভালো বিড়িবড়া পাওয়া যায়, কোথায় ছানাপোড়া অথবা কোথায় এণ্ডুলি পিঠা!

কমলা, রানির ছবির সামনে এসে একবার দাঁড়ান। স্বগতোক্তির মতো বলেন, ছি! ছবিটাকে কী করেছিস বল তো? একটু পরিষ্কারও করতে পারিস না?

অকু বলে, তার ছেলেই ফিরে তাকায় না মায়ের ছবির দিকে দিনে একবারও। কিছু বললে বলে, আমার মাকে মনেই নেই।

কমলা ব্যথিত মুখে বলেন, তার মনে নাই-বা থাকল অকু, তোর তো আছে?

অকু ম্লান হাসে। বলে, আমারও মনে নেই মা! আটচল্লিশ বছর বয়স হল, তারমধ্যে পাঁচ বছর একজন ছিল আমার সঙ্গে। সত্যিই মনে নেই। রানি এখন একটি ছবিই হয়ে গেছে। শুধুই ছবি।

একটু চুপ করে থেকে আবার বলে, তোমরা অনেক কিছু মনে রাখতে মা। তখন হয়তো মনে রাখার সময়ও ছিল তোমাদের। আমাদের অত সময় নেই। আমার এক জানাশোনা ওড়িয়া ফিলম ডিরেক্টর একটি ছবি করেছেন। রথযাত্রা নাগাদ রিলিজ হবে। ছবির নাম ‘সময় বড্ড বল্ববান’। তোমাকে দেখিয়ে দেব ছবিটি। আমরা একেবারেই এক অন্য সময়ে বাস করছি।

—ওড়িয়া ছবি, আমি কী বুঝব?

না-বোঝার কী আছে? বাংলা আর ওড়িয়াতে তফাত আর কতটুকু? নব্বই ভাগ শিক্ষিত ওড়িয়ারাই বাংলা বলতে পারেন, পড়তে পারেন আর আমরা পারি না। এটা কি গর্বের কথা?

তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকল, এখন আমি আর গর্ব দিয়ে কী করব বল?

হাসিমুখে শরবতের গ্লাস নামিয়ে রেখে কমলা বললেন।

—ওড়িয়া না-হয় তুমি না-ই জানলে, এতদিন কুমারগঞ্জে থাকলে, গোয়ালপাড়ার ভাষা কী অহমিয়াও কি বলতে পারো?

—বলতে পারি না; বুঝতে পারি।

—এই তো! এইটেই বাঙালিরা বোঝে না। আমার ওড়িয়া বন্ধুরা কী বলে জানো মা? বলে, আমরা বাঙালিরা নিজেদের খুব বড়ো ভাবি। বলে, ‘বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ধুয়ে আর কতদিন খাবি তোরা?’ ঠিকই বলে। ওরা আমাদের সঙ্গে আমাদের ভাষায় কথা বলতে পারে আর আমরা কেন ওদের ভাষায় বলব না? না-বলাটা তো এক ধরনের অসম্মান দেখানো। যারা প্রতিবেশীদের ন্যায্য সম্মানটুকুও না-দেখায়, তারা এক ধরনের অশিক্ষা ও অসভ্যতাতে ভোগে বলেই আমার বিশ্বাস। লংকার সঙ্গে আমি তো ওড়িয়া মেয়ের বিয়ে দেব বলে ঠিক করেছি। ওড়িশার সংস্কৃতি, সভ্যতা, বাঙালিদের চেয়ে কোনো অংশে খাটো তো নয়ই বরং বড়োও হতে পারে বলেই আমার মনে হয়। তুমি কী বলো?

কমলা হাসেন। বলেন আমি কী বলব? যা তোরা ভালো বুঝবি তাই-ই করবি। আমি কি তোদের বেশি বুঝি? তবে লংকার বউকে আমার সঙ্গে অন্তত বাংলাতেই কথা বলতে বলিস। আমি এই বুড়োবয়সে আর কোন ভাষায় কথা বলব?

অকু বলে, আমি এখন কাজে যাচ্ছি। এবেলা তুমি আর রাঁধাবাড়ার ঝামেলা কোরো না। কাল সকালে বাজারে যাব। ভেটকি মাছের কাঁটা আনব। আর বড়ো ট্যাংরা মাছ। ভেটকি মাছের কাঁটাচচ্চড়ি কোরো আর বেগুন-আলু দিয়ে মাখা মাখা করে ট্যাংরার ঝাল। কতদিন তোমার হাতের রান্না খাই না।

—আনিস। ভালো করে রেঁধে দেব।

—তোমার জন্যে পনস আনব। আর ছানা।

—পনস কী রে অকু?

—ও, পনস মানে এঁচড়, কাঁঠাল যাই বলো।

—কাঁঠাল? সে তো আমিই এনেছি। ভালো চালও এনেছি। ওই বস্তাতে আছে। তোদের ফেনাভাত রেঁধে দেব। ননি গাইয়ের দুধের সর-তোলা ঘি এনেছি, তা দিয়ে খাস। এঁচড়ও রেঁধে দেব।

অকু চলে গেলে চান-টান করে, শাড়ি বদলে, বাইরিকে খবরের কাগজটা আনতে বললেন কমলা। এই একটিই বিলাসিতা আছে এখনও কমলার। আনন্দবাজার পড়া। এই বিলাসিতাটি ছাড়তে পারেননি।

বাইরি কাগজ নিয়ে এল।

কমলা বললেন, এ কী! এ তো ওড়িয়া কাগজ।

—হ্যাঁ। সমাজ। কটক থেকেই বেরোয়। এ ছাড়া অন্য কোনো কাগজ তো রাখে না বাবু।

—ও।

পথ দিয়ে ঘণ্টি বাজিয়ে সাইকেল রিকশা যাচ্ছে। এই শব্দ ছাড়া আর বিশেষ কোনো শব্দ নেই। জানলার পর্দা একটু ফাঁক করে বিছানাতে বসে পথের দিকে চেয়ে রইলেন কমলা।

ভাবছিলেন, তাঁর ছেলে ওড়িয়া হয়ে গেছে। অন্য ছেলে বিহারি। দকুরা দিল্লিওয়ালা। দকুর বউ রিনি বাংলা বলতে পারে, কিন্তু পড়তে পারে না। বাচ্চারা পাঞ্জাবিদের মতো সুন্দর চেহারার, সপ্রতিভ। অনর্গল পাঞ্জাবি বলতে পারে। রিনির বাবা পাঞ্জাব ক্যাডারের আই.এ.এস. অফিসার ছিলেন। অনেক পুরুষ তারা পাঞ্জাবে। ইংরেজি আর গুরুমুখী এবং উর্দু মেশানো হিন্দিতে কথা বলেন ওঁরা। বাড়িতে রবীন্দ্ররচনাবলি আছে বটে এক সেট, কিন্তু কেউ পড়েছেন বলে মনে হয় না।

এমনসময় দরজাতে হুড়ুম-দাড়ুম করে কে যেন ধাক্কা মারতে লাগল। বাইরি দরজার দিকে যেতে যেতে বলল, ‘যাউচি, যাউচি, দুয়ারটা ভাঙি পকাইবে পিলাটা।’

লংকা এসেই ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরল। হাতে রাবড়ির ভাঁড়। বলল, ‘টাইম হেল্লা আসিবাকু?’ বলেই, প্রণাম করল হাঁটু গেড়ে বসে, দুটি হাত কমলার দুটি পায়ে রেখে।

এমন করে বাঙালিরা প্রণাম করে না। ভারি নম্র প্রণামের ভঙ্গিটি। ভালো লাগল কমলার। বললেন, হয়েছে, হয়েছে।

বলেই, চিবুক ধরে নাতিকে ওঠালেন।

লংকা বলল, তম পাঁই রাবড়ি আনিছি। টিক্কে খাইকি দেখেরে?

—খাব রে খাব! তুই কি বাংলা ভুলেই গেলি?

—আউ কঁড় করিবি?

—বউ-টউ ঠিক করে রেখেছিস তো, দেখাস আমাকে একটু। কবে মরে যাব।

—হুঁ!

লজ্জা পেয়ে বলল, লংকা।

বলল, মু গুট্টে বারুংগা হেল্বা। মোর বাহাঘর হব্বনি। হেল্লেভি, মু পাঁই গুট্টে বাইয়ানি, মিলিব, আউ কঁর?

কমলা অবাকচোখে নাতির মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। ওর কথার কিছুই বুঝলেন না।

কমলার চোখ নরম হয়ে এল। তাল-সুপুরির বন, করচার গন্ধ, ভাটিয়ালি গানের সুর, হরিসভার মাঠে দোল, দুর্গোৎসব, যাত্রা সবকিছুর স্মৃতি একসঙ্গে ফিরে এল। মুকুন্দ খাস বাঙাল ভাষায় কথা বলতেন। দেশ ছেড়ে আসার পরও বলতেন, ‘আইস্যেন, বস্যেন’ বললে যতখানি অন্তরঙ্গতা ফোটে, আসুন-বসুনে কি তা হয়? আমার ভাষা ছাড়ব কেন আমি? পশ্চিমবাংলার ভাষা তো ‘করিচি, খেয়েচি, নুন, নঙ্কা, নেবু, নুচি।’ ওর মধ্যে আমি নেই। লেখ্য ভাষা সারাবাংলার একই ছিল। তা বলে কথ্য ভাষা ছাড়ব কেন?

দিন পালটেছে, দেশ পালটেছে, যুগ বদলে গেছে। ছিন্নমূল মানুষগুলো নানা জায়গায় ছড়িয়ে গিয়ে শিকড় পেয়েছে চারা ধানের মতো। তারপর তরতর করে বেড়ে উঠেছে। চারাগাছের গোড়ায় যে মাটিটুকু লেগেছিল একদিন, তার গন্ধটুকু পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই আর। সবই ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সত্যিই! সময় বড়ো বলবান।

বিকেলে অকু ফিরল হাতে একটি টেলিগ্রাম নিয়ে।

—কী করবে বলো? এইমাত্র টেলিগ্রাম এল কৃষ্ণনগর থেকে। ধ্রুবর নাকি হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, পরশু দিন। আমার ঠিকানায় তোমার নামে পাঠিয়েছে টেলিগ্রামটি নিশি। ও কি জানত?

—হ্যাঁ। পোস্টকার্ড সকলকেই দিয়েছিলাম, তোর এখানে আসছি জানিয়ে।

—কী করবে বলো?

—কী করব—তোর এখানে থাকি, তা ঠাকুর চান না। কলকাতার ট্রেন কখন?

—পুরী-হাওড়াও আছে। জগন্নাথেও যেতে পারো। তবে পুরী-হাওড়া তাড়াতাড়ি পৌঁছায়। বোধ হয় ভোর সাড়ে পাঁচটাতে। খবর নেব। কলকাতায় আমি দশ বছর যাইনি।

—তবে পুরী-হাওড়ার টিকিটই কেটে দে। কিন্তু ওদের খবর দিবি কী করে?

—ওদের খবর দেওয়া যাবে না, তবে কলকাতায় দিবা-রাজেনদের বাড়িওয়ালাকে ট্রাঙ্ক কল করতে হবে। যাতে রাজেন এসে তোমাকে নিয়ে যায় স্টেশন থেকে। কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগরে যাবে কী করে?

—অনেক লোকাল ট্রেন আছে। তা ছাড়া লালগোলা আছে সকাল আটটা কততে যেন।

—তাহলে রাজেনকে বলে দেব তোমাকে কিছু খাইয়ে-দাইয়ে সোজা হাওড়া থেকে শেয়ালদাতে নিয়ে গিয়ে লালগোলায় তুলে দেবে। কৃষ্ণনগরে খবর না দিলে তুমি সেখানেই-বা যাবে কী করে? রাজেন কি পৌঁছে দেবে?

—চলে যাব। অনেকবার তো গেছি। সাইকেল রিকশা নিয়ে নেদেরপাড়ার বাড়িতে পৌঁছে যেতে পারব। এখন গিয়ে যে কী দেখব, তা ঠাকুরই জানে!

—মদ খাওয়া কমিয়েছে ধ্রুব?

—কোথায়? প্রতি চিঠিতে তো নিশি দুঃখ করে লেখে। কথা শোনে কে?

—অত চিন্তার কিছু নেই। হার্ট অ্যাটাক হলেই মানুষ কিন্তু মরে না। বয়স এখন কত হবে ধ্রুবর? বেয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ হবে। কিছুই নয়! এত চিন্তা করার কিছু নেই তোমার।

* * * *

হাওড়া স্টেশনে রাজেন নিতে এসেছিল কমলাকে। সঙ্গে দিবাও এসেছিল মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। হাওড়া স্টেশনের রেস্টুরেন্টেই রুটি, টোস্ট, ভেজিটেবল কাটলেট এসব খাইয়ে দিল ওরা। সঙ্গে সন্দেশও এনেছিল।

কমলা কুমারগঞ্জে থাকলে বাছবিচার করেন। কিন্তু বাইরে এসে অতসব চলে না। তাঁর নিজের কারণে অন্যের অসুবিধা হোক, তা তিনি কখনোই চাননি। তা ছাড়া রাজেনের মাও বিধবা, কিন্তু মাছ-মাংস সবই খান। মুকুন্দও কমলাকে বলে গেছিলেন বার বার। কিন্তু মুকুন্দ মুকুন্দর কর্তব্য করেছেন, কমলাও কমলার কর্তব্য করেন। গরিব ঘরের বিধবাদের দায়ে পড়েই এক চড়া খেতে হয়। উপায় কী?

জামাইদের মধ্যে দিবার স্বামী এই রাজেনকে, কমলা একেবারেই পছন্দ করেন না। মানুষটার মন বড়ো ছোটো। ওদের বাড়ি ছিল কুমিল্লাতে। কট্টর বাঙাল। পরিবার অতিসাধারণ। ওরাও উদবাস্তু। কিন্তু কলকাতায় বসবাস করে, টালিগঞ্জের ভেতরের দিকে একটি বাড়ি করে ওরা মনে-প্রাণে কলকাতার লোক হয়ে গেছে। ওর সঙ্গে থেকে থেকে দিবাও। বাঙাল ভাষা বলে না, তা না-ই বলল, কিন্তু ওরা ‘করতুম, খেতুম, নুন, নঙ্কা, নুচি’ করে কথা বলে। কোনো বিশেষ হীনম্মন্যতায় না ভুগলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। এক ধরনের মানুষ থাকে এবং তারা সব সময়েই ছিল; সব দেশেই, যারা ভন্ড। তারা তাদের অতীতকে, বাঙাল ও গরিব আত্মীয়স্বজনকে অস্বীকার করতে চায়। যারা বাপ-ঠাকুরদার পরিচয় এবং নিজের নিজের মূল্যকে ছাইচাপা দিয়ে স্বয়ম্ভু হয়ে উঠতে চায়, মানুষ হিসেবে তাদের মধ্যে ঘৃণা করার মতো অনেক কিছুই দেখেন কমলা।

করতাম, খেতাম, যেতাম, বসুন বললেও কিছু বলার ছিল না। এরা নিজেদের জোর করে মূল কলকাতাইয়া প্রতিপন্ন করতে গিয়ে নিজেদের অন্যদের কাছে এবং অবশ্যই নিজেদের কাছে নীচু করেন। অথচ এই হীনম্মন্যতার কোনো সংগত কারণ কমলা অন্তত খুঁজে পান না।

রাজেনের অবস্থা ভালোই। গাড়ি কিনবে কিনবে শুনছিলেন বছর দুয়েক হল। কিনে যে ফেলেছে, তা এইবারে জানলেন মেয়ে-জামাইয়ের গাড়িতে চেপে। ওঁর খুশি হওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু খুশি হলেন না। কারণ এই জামাই-মেয়ের মনের পরিচয় তিনি বিয়ের পর থেকেই পেয়েছেন ও ক্রমাগত পাচ্ছেন। এক বছরও ভাইফোঁটার নেমন্তন্ন করে খাওয়ায়নি এরা অকু-বকুকে। অথচ অকু এবং বকুর দু-জনের অবস্থাই ওদের চেয়ে অনেক খারাপ হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবার পুজো এবং ভাইফোঁটাতে যেমন সামর্থ্যে কুলোয় তেমন একটি করে শাড়ি পাঠাতে দু-জনেই ভোলে না।

কমলার কাছে চিরদিনই মানুষের দাম, বিদ্যা-বুদ্ধি টাকা-পয়সাতে নয়। সে-মানুষ মানুষ হিসেবে কেমন, সেই বিচারে। সেই মাপকাঠিতে কমলা এদের বিচার করে মনে মনে দুঃখিত হন।

তাঁর নিজের দিন কোনোরকমে চলেই যায়, কিন্তু একবার ঝড়ে রান্নাঘরটি পড়ে যাওয়াতে দিবার কাছেই চিঠি লিখে বলেছিলেন সকলকে জানাতে। অকু পাঁচশো টাকা পাঠিয়েছিল টেলিগ্রাম মানি অর্ডারে। বকু তিনশো। লোক মারফত। কৃষ্ণনগর থেকে ধ্রুব হাজার টাকা পাঠিয়ে লিখেছিল ‘আরও দরকার হলে কোনো সংকোচ না করে জানাবেন কিন্তু মা।’

দকুকে তিনি ইচ্ছা করেই জানাননি। দকুর প্রকৃত পিতা যেহেতু মুকুন্দ নন, দকুকে তিনি অন্য সন্তানদের সঙ্গে কখনো একাসনে বসাতে পারেননি। দকু এই গোপন সত্য না জেনেও কখনো তাঁকে মায়ের মর্যাদা দেয়নি। নায়েব অনাথ সেনের মতোই সে ধূর্ত, ধান্দাবাজ, কামুক ও সফল একজন হৃদয়হীন পাশব মানুষ হয়েছে।

দিবা আর রাজেন শিয়ালদাতে এসে তাঁকে ট্রেন ধরিয়ে দিল। টিকিট কাটার সময় বলল, মা টাকাটা দিন। টিকিট কাটব।

অকু ওদের জন্যে ভালো করে প্যাক করে কিলো-দুই ছানাপোড়া সঙ্গে দিয়েছিল। আলাদা করে নিশিদের জন্যেও। কমলার হঠাৎ কী মনে হওয়ায় ওদেরটা ওদের দিলেন না। দিবা জিজ্ঞেস করায় বললেন, নিশি টাকা পাঠিয়েছিল অকুর কাছে, ছানাপোড়া নিয়ে আসার জন্যে।

অথচ এই মেয়ে-জামাই সবচেয়ে বেশি যায় কুমারগঞ্জে। তাঁর সীমিত সাধ্যে তিনি যতটুকু করতে পারেন, করেন। দু-তিন বার বন্ধুবান্ধবদেরও সঙ্গে করে নিয়ে গেছিল ওরা। প্রতিবারই ফেরার সময় খেতের চাল, ডাল, তরিতরকারি যতখানি আনতে পারে বস্তা বেঁধে নিয়ে আসে ওরা। ওদের ভাবভঙ্গির মধ্যে কেমন যেন একটা হাভাতে ভাব। যতখানি পারে ততখানি পরের কাছ থেকে কেড়ে নিতে চায়। সংসারে নিলে যে দিতেও হয়, একথাটা ওরা জেনেও না-বোঝার ভান করেই থাকে। ওরা বড়োলোক হবে না তো কারা হবে!

সকলেই যে টাকা দিয়ে প্রতিদান দিতে পারে তা নয়। কেউ ব্যবহার দিয়ে প্রতিদান দেয়, কেউ ভালোবাসা, আন্তরিকতা দিয়ে। কিন্তু ওদের কোনো প্রতিদানের কথাই মনে পড়ে না। চোখের চামড়া পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলেছে দিবা আর রাজেন। গায়ের চামড়া করেছে গণ্ডারের মতো।

কথায় বলে ‘জন, জামাই ভাগনা, কভু না হয় আপনা।’ জামাইকে আপন ভাবেনও না তিনি। কিন্তু নিজের মেয়ে? স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধ, সম্পর্কে বড়ো আশ্চর্য। একজনের চরিত্রকে রাহুর-কেতুর চন্দ্রগ্রাসের মতো কী করে যে অন্যজন ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলে তা দেখলেও বিশ্বাস হয় না। দম্পতির মধ্যে যার চরিত্র কম জোরালো, সে অজানিতে, অসাবধানে ধীরে ধীরে অন্যজনের মতোই হয়ে যায়।

মুকুন্দর কাছে কমলা শুনেছিলেন যে, উদ্ভিদজগতে ‘অ্যাকুয়ার্ড ক্যারেকটারিস্টিক্স’ বলে একটি কথা আছে। আনারসের বনে কলা গাছকে পুঁতে রাখলে নাকি কয়েক বছর পরে দেখা যায় কলা গাছের পাতাও চেরা-চেরা হয়ে গেছে। মনুষ্যজগতেও যে কথাটি কতখানি সত্যি, তা তিনি নিজের মেয়ে দিবাকে দেখেই শিখেছেন।

আগে এমন ছিল না। কিন্তু আজ হয়েছেন। রাজেন আর দিবার জন্যে দেওয়া ছানাপোড়া ওদের না দিয়ে সঙ্গে নিয়ে চলে যাওয়ার মধ্যে অদ্ভুত এক ন্যায়বোধ এবং আনন্দ উপলব্ধি করছেন তিনি। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে কমলা শিখতে বাধ্য হয়েছে যে, সংসারে যে যেমন ব্যবহার দেয় তাকে ঠিক সেই ব্যবহারই ফেরত দিতে হয়। খারাপের সঙ্গে ব্যবহার করার মধ্যে কোনোরকম মহত্ত্ব নেই, বরং এক রকমের চারিত্রিক দুর্বলতা আছে।

কমলা একসময় অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন। সংসার, জীবন, ঝড়ঝাপটা নানারকম ঘাত-প্রতিঘাত তাঁকে অনেক জোর দিয়েছে। এই জোরের শিকড় অন্তরের গভীরে প্রোথিত হয়ে আছে এখন। বাইরের নাড়া বা ঝড় তা উপড়াতে পারবে না।

নিশা-রাজেনরা নিজেদের খুবই বুদ্ধিমান বলে মনে করে এবং চিরদিনই করবে। কিন্তু তারা জানে না এবং কোনোদিনও জানবে না যে, অন্য লোকে তাদের সম্বন্ধে কী ভাবে এবং ভাববে। কমলা নিজে গর্ভধারিণী মা হয়েই যদি মেয়ে-জামাই সম্বন্ধে এতকথা ভাবেন তাহলে অন্যরা কে জানে কী ভাবে?

হঠাৎ বড়ো লজ্জা হল কমলার। ওদের জন্যে নিজের জন্যে। নিজের মনের দৈন্যর জন্যেও কি?

না, তা নয়। যারা সংসারে গাছেরটাও খেতে চায় এবং তলারটাও কুড়োতে চায় সেই ন্যায়-অন্যায় জ্ঞানহীন সুযোগসন্ধানীদের দলে ভেড়বার মতো শিক্ষা তাঁর স্বামীর কাছ থেকে তিনি পাননি। তাতে তাঁর ক্ষতি অনেকই হয়েছে এবং হবে তা তিনি জানেন, কারণ সংসারে রাজেন-দিবারাই দলে ভারী। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্রও এসে যায় না। যে মানুষ একা ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে জবাবদিহি করতে ভয় পায়, সে মানুষ মানুষ নয়। সে যত মানী, গুণী, ধনীই হোক-না কেন! না, কমলার আজ এসে যায় না কিছুই।

অনেকক্ষণ হল লালগোলা প্যাসেঞ্জার ছেড়ে দিয়েছে। এই পথে একটি নদী পড়ে। রানাঘাটের ঠিক পরে অথবা আগে। ভালো মনে পড়ছে না কমলার। তাঁদের পূর্ববঙ্গের বাপের বাড়ির পেছনে ঠিক এমনই একটি নদী ছিল। শৈশবে এবং কৈশোরে সখীদের সঙ্গে ওই নদীতে চান করতেন। গোরু চরত পাশের চাপ চাপ ঘাসে-ভরা সবুজ মাঠে। গোরুর পিঠে সাদা গো-বক বসে পোকা বেছে খেত। ময়রা পায়ে ঘুঙুর বেঁধে বাঁকে করে রসগোল্লার পাত্র নিয়ে ঝুনুর ঝুনুর করে যেত। তাঁর কচি, নিষ্পাপ, অনভিজ্ঞ কিশোরী বুকের মধ্যে তখন ঝুনুর ঝুনুর ধ্বনির এক অনামা বাদ্যযন্ত্রের রোল উঠত। আমের বোলের উড়ন্ত সুগন্ধে রক্তের মধ্যে মসৃণ চিকন উজ্জ্বল সাপের খেলা চলত। তেঁতুল গাছের আর কদম গাছের কালো ছায়া নামত গভীর হয়ে নদীর নীল নিটোল জলে। বড়ো ভালোবাসা ছিল নদীতে আর গাছে, গোরুতে আর বকে, সেই চিরন্তন কিশোরী মেয়েটি আর এই কমলার সঙ্গে।

তারপর?

তারপর …. …. ….

ধ্রুব কেমন আছে কে জানে? ঠাকুর যেন তাকে ভালো করে দেন। স্বামীর মৃত্যুর পর এত আদরযত্ন তাঁকে এই জামাইয়ের মতো আর কেউই করেনি।

আদর অকু আর বকুও করে। ওদের সম্বন্ধে তাঁর বলবার কিছুই নেই। কিন্তু জামাইয়ের আদরের মধ্যে কেমন যেন এক গা-শিরশিরানো ভালো লাগা আছে। যাঁরাই শাশুড়ি হয়েছেন, তাঁরাই তা জানেন। জামাইয়ের আদরের ভালো লাগার সঙ্গে ছেলের আদরের ভালো লাগার কোনো তুলনা চলে না। দুটি একেবারেই অন্যরকম ভালো লাগা। জামাই আদর করলে কেমন এক লজ্জামিশ্রিত গদগদ ভাব জাগে মনে। তাঁদের গাঁয়ের আনু চাটুজ্যের মাথাখারাপ ছেলেটা, কৃষ্ণ সেজে নদীর কদম গাছতলায় চান সেরে ফেরার পথে যখন কিশোরী, সিক্তাবসনা কমলাকে জাপটে ধরে ‘রাধা রাধা’ বলে চুমু খেয়েছিল, তখন যেমন লেগেছিল এ অনেকটা সেইরকম সুখানুভূতি। যা হিসেবের মধ্যে নয়, যা অভাবনীয়, তেমন কোনো মনোরম মনোহারী প্রশান্তি এ। সংসারে কিছু কিছু শারীরিক সুখানুভূতি, শিরশিরানি ও গভীর মানসিক আনন্দ থাকে, যা একমাত্র মেয়েদেরই জানার কথা। শুধুমাত্র মেয়েরাই তাঁর একথার মানে এবং গভীরতা বুঝতে পারবেন। কমলা জানেন।

ধ্রুব ও নিশির কাছে বেশ কিছুদিন থাকতে হবে। ধ্রুব যতদিন ভালো না হয়ে ওঠে, ততদিন তো বটেই। ধ্রুব র মাও ভারি চমৎকার মানুষ। এরকম পরিবার দেখেই তাঁর আদি পশ্চিমবঙ্গীয়দের সম্বন্ধে শ্রদ্ধা গাঢ় হয়েছে। রাজেন-দিবারা নকলবাজ। আর এঁরা খাঁটি। যেকোনো সংস্কৃতিই ভালো তেঁতুলের আচারের মতো অনেকখানি সময় নেয় ভালো হতে। রাতারাতি কোনো সংস্কৃতিতেই মিশে যাওয়া যায় না। যারা রাজেনদের মতো তা করতে চায়, তারা তেলে-জলে মিললে যেমন দেখায় তেমনভাবে প্রকট হয়ে ভেসে থাকে সকলের চোখের সামনে।

কৃষ্ণনগর থেকে যাবেন ডালটনগঞ্জ। বকু আর ছবির কাছে। পুজোর আগে অবধি থাকতেই হবে। ওই সময়ে স্বাস্থ্যও খুব ভালো। ডালটনগঞ্জের একটি জার্মান কোম্পানিতে কাজ করে বকু। জঙ্গল থেকে লাক্ষা সংগ্রহ করে কোম্পানির মুরহু আর রাঁচির কারখানায় সাপ্লাই দেয়। কোয়ার্টারটি বেশ। চারদিকে দেওয়াল তোলা। ইন্দারাটি ভারি ভালো। বকু তো উদলা গায়ে খাবলা খাবলা সরষের তেল মেখে ইন্দারার পাশে ঝুপুর-ঝুপুর করে বালতি বালতি জল ঢেলে চান করে। ক-টি পেয়ারা গাছ আছে। পেঁপে গাছ। ছবি, মাখনি রোটি আর লিট্টি করে খাওয়াবে ওঁকে। নাতি-নাতনিরা দাদি দাদি করে সর্বক্ষণ লাফাবে-ঝাঁপাবে। কটকে গেলে যেমন ওড়িয়া হতে হয়, ওখানে গিয়ে তেমনি হিন্দিতে বিশারদ হতে হবে তাঁকে।

বড়োনাতি হাত ধরে টেনে বলবে, ‘চলো দাদি! আজ বেতলা ঘুমকে আয়েঁ। বড়ো বড়ো দান্তাল হাথিথ নিকলা।

—হাথিথ কী রে? বল হাতি।

—হাতি? হাতি ক্যা চিজ?

ছোটোনাতনি মুখ হাঁ করে ইঁদুরের মতো ছোটো ছোটো দুধসাদা দাঁত বের করে মুখ হাঁ করা অবস্থাতেই বলবে, ইঁ-ইঁ-ইঁ—দান্তাল হাথিথকা দাঁথ।

ডালটনগঞ্জি কেকরো-মেকরো ভাষায় মহড়া চলবে বেশ কিছুদিন। কিছুটা শিখবেনও। তারপর ট্রেনে উঠেই ভুলে যাবেন। তাঁকে নিয়ে সমানে হাসিঠাট্টা চলবে নাতি-নাতনিদের। তারা বলবে, ‘বাঙ্গালি দাদি তুম একদম আনপড় হ্যায়।’

ছবি বকবে তাদের। বলবে, ‘ই ক্যা? বদতমিজি ঔর তামাশা! দাদি ক্যা তুমলোগোঁকো ইয়ার হোতি হ্যা ক্যা?’

ছবি, বাংলা বলে ভাঙা ভাঙা। বাংলা পড়তেও পারে না। চারপুরুষ বিহারে। বড়ো ভালো মেয়ে।

ট্রেনটা দাঁড়াল বীরনগরে। সেগুন গাছের বন। আগে আরও ঘন ছিল। এখন নেই বললেই চলে।

একসময় ছাড়ল ট্রেন। এখন জোরে ছুটছে গাড়ি। দু-ধারে ধানখেত। বৃষ্টি পেয়ে বীজতলি করেছে চাষি। সবুজ ধানের চারাগাছ হাওয়ায় দোলাদুলি করছে—ঘনসন্নিবদ্ধ, নিবিড়, প্রেমময়, একাত্ম হয়ে, চারাগাছগুলো জানে না চাষি কাকে তুলে কোন খেতে লাগাবে। অথবা আদৌ লাগাবে কি না। হয়তো হাটে নিয়ে গিয়ে বেচে দেবে বীজতলির সব চারাই। কোথায় কোথায় চলে যাবে তারা ছাড়াছাড়ি হয়ে। বিভিন্ন ক্রেতা সার দেবে বিভিন্নরকম। জল পাবে কম-বেশি। কোথাও ক্যানাল পাবে, কোথাও ডিজেলের পাম্পে করে জল দেবে কেউ তাদের গোড়ায়, কোথাও-বা শুধুই আকাশের ভরসা। তাদের গোড়া নিড়োবে কেউ! কারও-বা ধানের দুধ নষ্ট হবে জংলি আগাছা এবং পোকাতে।

জোর হাওয়া বইছিল। দিগন্তের সাঁই-বাবলা, ক্বচিৎ কলা ও আম গাছের দ্বীপের বৃষ্টিভেজা গন্ধ বয়ে নিয়ে জোরে ছুটে এসে বীজতলির ধানের ওপর এলোমেলো চিরুনি বুলোচ্ছিল হাওয়াটা। কমলা জানলা দিয়ে ওই দিকেই চেয়ে ছিলেন। চেয়ে থাকতে থাকতে বিধুর উদাস হয়ে এল চোখের দৃষ্টি। তারপর ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল তাঁর চোখ দুটি। বাইরের বৃষ্টিভেজা নরম ছলো-ছলো ধান খেতেরই মতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *