খাট
আলো আসছে কোথা থেকে?
আলো?
হ্যাঁ। আলো নয়?
ও। ওই আলো? ও তো রোজই আসে। তুমি যখন শুতে আসো তখন তো পর্দা টানা থাকে। বেড-সাইডের টেবল ল্যাম্পটা জ্বালানো থাকে। তুমি ঘুমিয়ে পড়ার পরে আমিই পর্দা সরিয়ে দিই মাথার দিকের জানালার। তবে মনে হচ্ছে, আর কদিন বাদে পর্দা আর সরানোই যাবে না বোধ হয়।
কেন?
পাশের মালটিস্টোরিড বাড়িটা তো শেষই হয়ে এলো। দশতলা বাড়ির প্ল্যান স্যাংশান হল কী ভাবে বলো তো? আমাদের কো-অপারেটিভের বেলা তো পাঁচতলার বেশি করতেই দিল না করপোরেশন।
সে হয়তো অনেক আগেই ও বাড়ির প্ল্যান স্যাংশন করে রেখেছিল। হয়তো বাড়ি শুরু করেছে তার অনেকই পরে।
কলকাতাতে কী না হয়! তা ছাড়া আমাদের অফিসের ক্যাশিয়ার রামপূজন-বাবু বলেন, কোট করে : ‘‘সকল পদারথ হ্যায় জগমাহী, কর্মহীন নর পাওয়াত নাহি।’’
মানে?
মানে হচ্ছে সংসারে সব বস্তুই আছে কিন্তু সেসব শুধু কর্মবীরদেরই জন্যে, কর্মহীনদের জন্যে নয়।
বা: কার লেখা এটা?
তুলসীদাস। রামচরিত মানসে আছে নাকি। রামপূজনবাবু প্রতিকথাতেই তুলসীদাস কোট করেন।
ওবাড়ির ফ্ল্যাটে লোক এসে গেলে আমাদের ফ্ল্যাটে প্রাইভেসি বলে আর কিছুই থাকবে না। রাতে তখন নিজেদের শোবার ঘরে কোনোরকম প্রয়োজনের জন্যেই আলো না জ্বালালেও চলবে।
তাই? যখন ফ্ল্যাট বুক করি কত কি-ই না ভেবেছিলাম। আওয়াজ কম হবে, ধুলো কম হবে, মশা-মাছি উড়ে আসতে পারবে না। আর এখন?
উঁচুতেই যে আওয়াজ সবচেয়ে বেশি আসে তা কী করে জানব আগে বলো? তখন তুমিও কি জানতে?
তা ঠিক। তবে আমি আর কতটুকুই বা জানি। অবলা জীব।
হ্যাঁ অবলাই বটে। কোন মহামূর্খ যে মেয়েদের অবলা ভাবে, তা জানতে ইচ্ছে করে।
তবে পাশের ওই অত বড়ো বাগানওয়ালা বাঁশঝাড়ওয়ালা একতলা বাংলো বাড়িটা ভেঙে যে আমাদের পাখির ডাক আর সবুজ থেকে একেবারেই বঞ্চিত করে এ বিরাট বাড়িটা হবে, তা-ই বা কে ভেবেছিল বলো? কলকাতাতে সবুজ আর রইল না কোথাও।
কী করবে বলো? ম্যান প্রোপোজেস, গড ডিসপোজেস। কিন্তু লোকই যখন আসেনি এখনও তখন ওবাড়িতে রাতে আলো জ্বলে কেন? এ তো আর সিঁড়ির বা বাইরের আলো নয়।
ওমা। ও কি আমাদের বাড়ির মতো সাদামাটা মানুষদের বাড়ি নাকি সব? সাড়ে সাতশো থেকে এগারোশো স্কোয়্যার ফিটের ফ্ল্যাট? আমাদের মতন? ওবাড়িতে সবচেয়ে বড়ো ফ্ল্যাটই শুনেছি দু-হাজার স্কোয়ার ফিটের।
দু-হাজার স্কোয়্যার ফিটের? বলো কী? কৃষ্ণ বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠল।
যেন, বিছে কামড়াল।
কী হল?
না! ভাবছি, দাম কত হবে। মার্বল মোজায়েক দিয়েই তো তৈরি। মানে, বুকিং-এর দর নয়, শেষ হলে বাজার দর।
ধরো, পনেরোশো করে স্কোয়্যার ফিট। আমাদের বাড়ির কেয়ারটেকার বলছিলেন। মোজায়েকও নয়, শুধুই মার্বেল।
তার মানে কত টাকা? প্রায় তিরিশ লক্ষ টাকা? ইশশ। বেলো না বোলো না। আজ আমার প্রেশারটা এমনিতেই বেড়ে রয়েছে। এম ডি-র সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছে। চাকরিই না চলে যায়। আজ আর উত্তেজিত কোরো না। রাতেই স্ট্রোক হবে।
তারপর বলল, এই সব ফ্ল্যাটে যাঁরা থাকবেন তাঁদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গও কি মানুষেরই মতো? তাঁরাও কি ভাত-রুটিই খাবেন আমাদের মতো? তাঁরাও কি আমাদের মতো স্বামী-স্ত্রীর মতনই…। ভাবা যায় না।
হেসে উঠল স্মৃতি কৃষ্ণর কথা শুনে।
আহা! ঢং কোরো না। যাঁরা ওবাড়িতে আসছেন তাঁরা মানুষ না তো কি দেবতা?
শুধু দেবতাই বা কেন? জন্তুজানোয়ারও হতে পারেন। ওঁরা কারা? এত টাকা ওঁরা পান কোথা থেকে?
তা জানব কোথা থেকে। কোনো বিরাট মালটিন্যাশনাল কোম্পানির অফিসারদের কো-অপারেটিভ শুনছি। জমিটা সস্তাতে বাগিয়েছিল নাকি কোনো বেচারাম বাঙালির কাছ থেকে। নইলে লেকের কাছে এমন…
এমন সময় খটাখট শব্দ হতে লাগল, যেদিক থেকে আলো আসছে, সেদিক থেকে।
ও আবার কী? কীসের শব্দ? কৃষ্ণ বিরক্ত গলাতে বলল।
তারপর স্বগতোক্তির মতো বলল, স্টার টিভির প্রোগ্রাম শেষ হয়ে গেল, সাড়ে দশটার বাংলা খবরও শেষ হয়ে গেল দুরদর্শনের, আর এখনও কীসের শব্দ এ?
ও মা। ওই জন্যেই তো শব্দ। যে জন্যে শব্দ সে জন্যেই তো আলো। তুমি তো ফ্ল্যাটের দাম কল্পনা করেই অজ্ঞান হয়ে গেলে। এবারে ফার্নিচারের দাম কষো। একটি ফ্ল্যাটে বেডরুমের খাট হচ্ছে স্যার। একটিমাত্র খাট হচ্ছে স্যার। খাট।
খাট? শুধু খাট? মারোয়ারি নাকি ভদ্রলোক? গদি-টদি-করবেন নাকি?
না-গো না। গদি-টদি নয়। তবে মালিক মারোয়ারি কি না জানি না। আজ একমাস ধরে দিনে-রাতে চারজন মিস্ত্রি কাজ করছে, দু-জন লুঙ্গি-পরা, খালি-গা আর দু-জন পায়জামা-পরা হাতকাটা গেঞ্জি গায়ে। রাত-দিন।
ওই খাটের জন্যে? একটা খাট? বাজে কথা বলছ তুমি।
কৃষ্ণ বিরক্তির সঙ্গে কোলবালিশটা সরিয়ে রেখে, উঠে বসে; বেডসাইড ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, তোমার সবকিছুই বাড়িয়ে বলা অভ্যেস।
বিশ্বাস না হয়তো নিজের চোখে দেখো একবার, উঠে বসে। আসলে, খাটও নয়, খাটের মাথাটা, দেওয়ালের সঙ্গে ফিক্স করা। মজুমদার কোম্পানি আছে না? নেক্সাস? ইন্টিরিয়র ডেকরেটর? তাঁরা কনট্রাক্ট নিয়ে বানাচ্ছেন। আমিও কি ছাই প্রথম প্রথম বুঝতে পারতাম ব্যাপারটা কী হচ্ছে? মাসখানেক পরে খাটের ফ্রেমটা দেখে বুঝতে পারছি যে, যা তৈরি হতে চলেছে সেটা একটা খাটই।
সিগারেট মুখে দাঁড়িয়ে উঠে পর্দা-সরানো জানালা দিয়ে ভালো করে দেখল কৃষ্ণ। বলল, সত্যিই তো একটা খাটের মাথার দিকটাই। বলছ, চারজন মিস্ত্রি রাত-দিন কাজ করে এই অবস্থাতে পৌঁছেছে? কবে শেষ হবে তারও ঠিক নেই?
স্মৃতি বলল, ইয়েস স্যার। দিনের বেলাতে ভালো করে দেখো। বিকেলে যখন পশ্চিমের আলো এসে পড়ে ওই ঘরে তখন আরও ভালো করে দেখতে পাবে। আমি নিজে তো জানালাতে দাঁড়াতে পারি না বেশিক্ষণ। মিস্ত্রিগুলো অসভ্যতা করে। তুমি নিজে দেখো কাল।
কী অসভ্যতা করে?
ওই। অঙ্গভঙ্গি, আর কী। দূর থেকে আর কী করবে?
ওঃ। তোমাকে দেখলে, আর ওদের মতো বয়সে বউ বা প্রেমিকা ছেড়ে একমাস ধরে পরের বউ-এর আদর করার জন্যে কোমর বেঁধে খাট বানাতে হলে আমিও করতাম। অত সামান্য ব্যাপারে বিরক্ত হতে নেই. তুমি পরমাসুন্দরী নারী বলেই না করছে। আমি জানালায় দাঁড়ালে কি আর করবে? হয়তো আমাকে দেখিয়ে বগল চুলকাবে।
তুমি ভীষণ অসভ্য।
সত্যি! তোমাকে নিয়ে পারি না। বগলও অসভ্য। অসভ্য, তা বলতে পারো। তুমি স্লিভলেস ব্লাউজ পরলেই আমার অসভ্যতা করতে ইচ্ছে হয়, তোমার বগলতলিতে চুমু খেতে ইচ্ছে হয়।
ইশশ। তুমি একটা যা-তা। দু-বছর বিয়ে হয়ে গেল এখনও আদিখ্যেতা গেল না।
তুমি প্রি-হিস্টরিক। আজকাল বিয়ের সঙ্গে অসভ্যতার অথবা সভ্যতারও কোনো সম্পর্ক নেই। আমার আদিখ্যেতা গেলে তুমি কি খুশি হবে? চিন্তাতে চুলে পাক ধরতে শুরু করবে। তোমার বুদ্ধদেব গুহর লেখাতে কি পড়োনি? আমাদের, পুরুষদের যেটা দুর্বলতা, সেটাই তোমাদের বল?
ও। এই বেলা বেচারি বুদ্ধদেবদা! খারাপ ব্যাপারে গুরু মানা। কই? ভালো ব্যাপারে তো গুরু মানো না?
গরুকে গুরু মানি কী করে?
এই! ভালো হবে না বলছি। অ্যাকাউন্ট্যান্ট আছ তাই থাকো। সাহিত্যের তুমি কী বোঝো?
দেখি, তোমার বুদ্ধদেবদার লেখার মধ্যে ভালো ব্যাপারটা কোথায় সেটা খুঁজে দেখব এই পুজোর ছুটিতে সিমলাতে গিয়ে। সীরিয়াসলি বলছি। পুজো-সংখ্যাতে তো উনি উপন্যাস লেখেন না, দেখেছি কয়েক বছরই হল। তাই; তোমার কাছে যেসব বই আছে তারই দু-একটা পড়বার চেষ্টা করব সীরিয়াসলি। অবশ্য জানি না, কতদূর এগোতে পারব। সঙ্গে নিতে ভুলো না কিন্তু।
শুনছ? স্মৃতি। কোথায় গেলে?
এই যে! কোট আর টাইটা রাখো। বলল কৃষ্ণ। অফিস থেকে রাতে ফিরে।
আজ এত দেরিতে ফিরলে? এখন কি চা খাবে? না চান-টান করে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়বে? কাল সকালে দিল্লির ফ্লাইট ক-টাতে?
ওই তো। ছটা-টটা হবে। এখন বোধহয় সাড়ে ছটা করেছে। বহুদিন তো দিল্লি যাইনি। টিকিটটা দেখে সময়টা দেখে রেখো তো। ব্রিফ কেসে আছে। এসব সেক্রেটারিরই কাজ। মিস নায়ারের দিন দিনই অবনতি হচ্ছে।
তা ঠিক। ব্যাঙ্গালোর, হায়দরাবাদ, ম্যাড্রাস আর বম্বেই তো করে বেড়াচ্ছ গত ছ-মাস। দিল্লির ফ্লাইটের সময় ভুলে যাবারই কথা।
আলমারি খুলে হ্যাঙ্গর-এ স্যুটটা তুলে রাখতে রাখতে স্মৃতি বলল। এই স্যুটটা নিশ্চয়ই কাল পরে যাবে না?
না। নেভি-ব্লুটা দিও। সঙ্গে ম্যাচিং টাই পরে যাব। আর ব্রাউনটাও দিয়ে দিও। সঙ্গে চারটে শার্ট দেবে। ফুল স্লিভস। একজোড়া পায়জামা-পাঞ্জাবি দিও আর একটা চটিও। রবি-ঝুমকিদের বিয়ের তারিখ পরশু। রবি ফোন করেছিল দিল্লি থেকে। না গেলেই চলবে না। দিল্লিতে থাকব যে সেদিন তা জানতে পেরেই ফোন করেছিল। কলিগ। না গেলে খারাপ দেখাবে। আমার তারিখ-টারিখ মনে থাকে না।
কী দেবে?
ভাবছি।
আমার কাছে একটা শাড়ি আছে। তোমার সেজদি দিয়েছিলেন। জন্মদিনে। পরা যায় না। নিজে এমন শাড়ি পরেন কখনো যে অন্যকে দেন? আমি তো চাঁপাকেও এমন শাড়ি দিতে পারতাম না। ঝুমকিকে দিয়ে দেব।
বা: কী বুদ্ধি! যা নিজেই পরতে পারো না তা ঝুমকিকে দেবে কী করে? ওটা চাঁপাকেই দিয়ে দিও। আর সেজদির কথা ছাড়ো। টাকা থাকলেই তো মন থাকে না মানুষের। নজরটাই ভিখিরির। অবস্থা রাজার মতো হলে কী হয়। জামাইবাবুর জন্যেই হয়েছে অমন। ছেলেবেলাতে দিদি অমন ছিল না। নিজের জামাইবাবু, নেহাৎ বাইরের লোকের কাছে চুপ করেই থাকতে হয়, নইলে আপাদমস্তক অমন ফোরটোয়েন্টি, মিথ্যেবাদী, ছোটোলোক, ধান্দাবাজ মানুষ আমি তো আর দেখিনি। তোমার কিছু দিতে হবে না। ঝুমকিকে আমি কোনো রুপোর গয়না কিনে দেব। জনপথ-এ আমাদের অফিসের কাছে ভালো জুয়েলারের দোকান আছে।
তা তো দেবেই। তোমার ওল্ড-ফ্লেম তো ঝুমকি।
কৃষ্ণ এক ঝটকায় হাত বাড়িয়ে স্মৃতিকে ধরে ফেলে গলায় চুমু খেয়ে বলল, আর তুমি যে আমার ব্লাস্ট-ফার্নেস। ওল্ড ফ্লেমরা সকলেই নিষ্প্রভ তোমার কাছে।
ছাড়ো। ঢং করতে হবে না। পুরুষের ভালোবাসা, মুসলমানদের মুর্গি পোষা। আমার ঠাকুমা বলতেন।
বলল, খুশিতে ডগমগ হয়ে, স্মৃতি। মুখে, বিরক্তি ফুটিয়ে।
শনিবার রাতে প্লেন ফেরার সঠিক সময়ের একটু পরে ফিরল কৃষ্ণ। স্মৃতির মনে পড়ে না, দিল্লির রাতের ফ্লাইট কলকাতাতে একদিনও সময়ে পৌঁছেছে বলে। সময়ে পৌঁছোলেও কৃষ্ণর বাড়ি পৌঁছোতে পৌঁছোতে এগারোটা হয়ে যায়ই। দেরি হলে তো কথাই নেই!
স্মৃতি গিজারটা চালিয়েই রেখেছিল। জল গরম হয়ে গেলে বন্ধও করে দিয়েছিল। কৃষ্ণ ফিরতেই, স্মৃতি বলল, তুমি চানে যাও, আমি খাবার গরম করতে বলছি চাঁপাকে।
কৃষ্ণ বলল, দারুণ খবর আছে আজ। তোমাকে দেবার মতো। চান করে আসি, খেতে খেতেই বলব। তুমি খেয়েছ তো?
না।
এইতো! এসব অত্যন্ত অন্যায়। আমার ফেরার সঙ্গে তোমার খাওয়ার কী সম্পর্ক? আমি তো চাকরি করি। নিরুপায়ে দেরি করে ফিরি। আমার কিন্তু একদম ভালোলাগে না এসব। নিজেরা খেয়ে আমার খাবার ক্যাসারোলে রেখে দেবে। কতদিন তো বলেছি তোমাকে।
আমিও তো চাকরি করি। স্মৃতি বলল।
কোন চাকরি? তুমি? অবাক গলাতে বলল, কৃষ্ণ।
কেন? তোমার চাকরি। তোমার দেখাশুনো করাই তো আমার চাকরি। আমার কী এমন কাজ আছে যে, তোমার জন্যে বসে থাকতে পারি না মাঝেমধ্যে। তা ছাড়া আমার ভালোলাগে। খুব ভালোলাগে। নিজের সংসারের, নিজের স্বামীর, নিজের সন্তানের, যখন হবে, দেখাশুনো করার চেয়ে বড়ো কাজ আর কী আছে?
হুঁ।
এমন আনন্দর কাজ আর কী থাকতে পারে? সংসার যদি একজনের আয়েই চলে যায় তবে এত আনন্দর চাকরি আর হতে পারে বলে তো আমি জানি না। পড়াশুনো করলেই যে চাকরি করতেই হবে এই ফানী ব্যক্তি-স্বাধীনতাতে আমার বিশ্বাস নেই।
বা:! আমার নিজের বুদ্ধিতে আমি নিজেই চমকে উঠি। বুদ্ধিমান না হলে তোমার মতো বউ পেতাম। তোমার সঙ্গে আমার মত হান্ড্রেড পার্সেন্ট মিলে যায়। যদিও আজকাল আমাকে-তোমাকে লোকে প্রাচীনপন্থী বলতে পারে।
বললে বলুক। তারা তো আমার-তোমার সুখ কেড়ে নিতে পারবে না।
উত্তরে কিছু না বলে, জামাকাপড় ছেড়ে চানে গেল কৃষ্ণ। শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে ভাবছিল কৃষ্ণ কত ভাগ্যবান ও সুখী। ওর অনেক সহকর্মীর মুখে শোনে যে, রাতের ফ্লাইটে ফিরলে তাঁদের স্ত্রীরা না খেয়ে বসে থাকা দূরের কথা, ঘুম-চোখে দরজা খুলতেও বিরক্ত হন। বলেন, চাবি নিয়ে যাবে। এমনই বিরক্ত হন, যেন কাজ করে এলো না দিল্লি বা অন্য কোথা থেকে; যেন বাঈজি-বাড়ি থেকেই এলো। সত্যিই দারুণ ভাগ্যবান ও।
খেতে বসতেই স্মৃতি বলল, কী দারুণ খবর তোমার? ঝুমকির কোনো খবর? কনসিভ করেছে না কি?
না, না ঝুমকির খবর নয়। তোমার খাটের খবর।
আমার খাটের মানে?
মানে, পাশের নতুন বাড়ির ছ-তলার ফ্যাটের খাটের।
মানে?
মানে, যিনি ওই ফ্ল্যাটের মালিক তাঁর সঙ্গে দিল্লি থেকে ফেরার পথে আজ আলাপ হয়ে গেল। এই দেখো, তাঁর কার্ড। কী কান্ড।
কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখল স্মৃতি।
গোপেন চৌধুরী? বাঙালি?
বাঙালি। তবে চৌধুরী এমনি পদবি। আসলে ওঁরা সেনগুপ্ত। বদ্যি।
কী করেন ভদ্রলোক? ওই কোম্পানিতেই চাকরি করেন?
না। চাকরি করেন না। ব্যবসা করেন। বিরাট ব্যবসা। তবে আভাসে-ইঙ্গিতে মনে হল যে ওই কোম্পানির সঙ্গেও লেন-দেন আছে। মনে হল, টাকার মা-বাবা নেই। তবে মানুষটি ভালো, ভদ্র, বিনয়ী। অসৎ বলেও মনে হল না। কথায় কথায় বললেন, এখন থাকেন টালিগঞ্জে, লেকের কাছে। বললেন, উঠে আসছেন শিগগিরি নতুন ফ্ল্যাটে।
তারপর?
তারপর আর কী? কোথায়? জিজ্ঞেস করতেই বেরিয়ে পড়ল।
খাটের কথাও জিজ্ঞেস করলে? এ মা:!
হ্যাঁ। কেন করব না। খাটের জন্যেই তো ইনকুইজিটিভনেস।
উত্তেজিত দেখাল স্মৃতির চোখ-মুখ। বলল, অল্পবয়স বুঝি ভদ্রলোকের? খুব হ্যাণ্ডসাম?
না, না। পয়সাওয়ালা মানুষদের মধ্যে হ্যাণ্ডসাম খুব কমই হন। কম বয়সিও। কেন জানি না। বাপ-ঠাকুর্দার রোজগার অথবা স্মাগলার-টাগলার হলে অন্য কথা। নিজে রোজগার করে বড়োলোক হতে গেলে অনেকই মূল্য দিতে হয়।
হানিমুন করবেন ওই ফ্ল্যাটে? ওই খাটে?
কৃষ্ণ হেসে ফেলল, স্মৃতির কথার ধরনে। বলল, আরে না, না। পঞ্চাশের ওপরে বয়স হবে। প্রকান্ড ভুঁড়ি। হাত-পা সব ফোলা। বহু কষ্টেসৃষ্টে এয়ারবাসের সিঁড়ি বেয়ে নামলেন। বললেন, আরথ্রাইটিস-এ খুবই কষ্ট পান। ডায়াবিটিসও আছে।
তা, খাটটার বিশেষত্ব কী?
বললেন, জানেন, ছেলেবেলায় একখাটে সাতভায়ে শুতাম পাশাপাশি। খুড়তুতো, জাঠতুতো সব মিলে। তাই খুব শখ ছিল নিজের বাড়ি হলে বেডরুমে একটা মনের মতো খাট বানাব। প্রথম যৌবন অবধি খাটে একটু পাশ পর্যন্ত ফিরতে পারতাম না মশায়।
তাই? হতাশ গলায় বলল, স্মৃতি।
তা, নতুন ফ্ল্যাটের খাটে কি মণিমুক্তো লাগাবেন উনি? আর কত দিন লাগবে ওঁর খাটটি হতে? তারপরে তো সব অন্য ফার্নিচার। সেগুলো কবে হবে? স্মৃতি শুধোল।
বললেন, অন্য সব ফার্নিচারই দিল্লি থেকে ট্রান্সপোর্টে আসবে। দিল্লির ফার্নিচার নাকি খুব ভালো। পয়সা তো দিল্লি-বম্বেতেই। পয়সাই হচ্ছে আসল। পয়সা থাকলে কোনোই অসুবিধে নেই। বললেন যে, শুধু বেডরুমের খাটটিই কলকাতাতে বানাচ্ছেন। সস্তাও হচ্ছে, মনোমতোও বটে।
ওই খাটেও তো ছ-সাত জনে শুতে পারবেন স্বচ্ছন্দে।
কৃষ্ণ হাসল। বলল, শোবেন দুজনেই। হয়তো সাতরকমের আসন করবেন। নয়তো ছ-বউ নিয়েও শুতে পারেন। আমি কী করে জানব?
আবার অসভ্যতা! কপট ধমক দিল স্মৃতি কৃষ্ণকে।
কৃষ্ণ বলল, দেখে শেখো। এরকম বাঙালি দম্পতিও আছেন। বয়সে বয়স হয় না, শরীরের বৈকল্যতেও নয়। বয়স হয় মনে।
মনটাকে তরুণ রাখাটাই আসল কথা। বুঝেছ? এই কথাটা মনে রেখো।
জানি না বাবা! দুজনের জন্যে এমন খাটের কী দরকার? প্রিন্স চার্লস আর ডায়ানার খাটও বোধ হয় এত ভালো নয়।
কে বলতে পারে। হয়তো ভালো না বলেই বিয়েটা ধসে গেল। খাট একটা মস্ত ব্যাপার। খাট নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করাটা ঠিক নয়। বিপজ্জনকও বটে।
শোবার সময়ে ঘরের আলো নেভাবার পরে আবার পাশের বাড়ির ফ্ল্যাটের আলোটা এসে পড়ল ওদের ঘরের মেঝেয়। মিস্ত্রিরা জোরে জোরে কথা বলছে, কাশছে, বিড়ি খাচ্ছে, ফ্ল্যাটটা এতই কাছে যে, বিড়ির গন্ধও যেন নাকে আসছে।
পর্দাটা টেনে দাও তো। স্মৃতি বলল। খাটটাকে বানাতে দেখে মনে মনে অনেক কিছুই কল্পনা করেছিলাম। কেমন না-জানি হবেন ফ্যামিলিটি? দারুণ সুন্দর-সুন্দরী, অল্পবয়েসি, মেড ফর ইচ আদার।
স্মৃতিকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে কৃষ্ণ বলল, সে তো আমরা! দামি খাট থাকলেই কি আর মেড ফর ইচ আদার হয়? ডায়না আর প্রিন্স চার্লস-এরও ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল! আসলে হল…বলেই…
গভীর আনন্দর মধ্যে ডুবে গিয়ে স্মৃতি বলল, কিন্তু অমন একটি খাট কি সত্যিই কারও দরকার হয়? কথায়ই বলে, ‘যদি হয় সুজন, তেঁতুলপাতায় ন-জন।’
এখন তোমার তেঁতুলপাতাতে একটু শুতে দাও তো ঘন হয়ে। রাত অনেক হল। যত আজেবাজে বাইরের লোকের কথা!
পরদিন কৃষ্ণর সেক্রেটারি মিস নায়ার বিকেল চারটে নাগাদ ফোন করলেন বাড়িতে। স্মৃতিকে। বললেন যে, কৃষ্ণর বাড়ি ফিরতে দেরি হবে, কারণ উনি বার্নিং-ঘাট ঘুরে যাবেন। কম্পানির এক বড়ো কাস্টোমার মারা গেছেন।
কে কাস্টোমার?
নাম তো বলেনি আমাকে ম্যাডাম।
মনে মনে বিরক্ত হল স্মৃতি।
আসলে এই শ্মশান ব্যাপারটাই আদৌ পছন্দ নয় ওর। তার চেয়ে কবর দেওয়া ব্যাপারটা অনেকই ছিমছাম। স্মৃতি থাকে। ফুল নিয়ে যেতে পারে মানুষ প্রিয়জনের কাছে—যত দিন প্রিয়জন বেঁচে থাকেন। তা নয়, ধুঁয়ো, ধুলো, আগুন, মানুষের মাংস পোড়া চিমসে গন্ধ, ভাড়া-করা মাস্তানদের ‘‘বলোহরি হরিবোল’’ চিৎকার। এসবের কথা ভাবলেই গা গুলিয়ে ওঠে স্মৃতির। স্মৃতি ভাবছিল, এমনই হঠাৎ মারা গেলেন ভদ্রলোক যে স্মৃতিকেও একটা ফোন করে জানাবার সময় পেল না কৃষ্ণ যাবার আগে?
কৃষ্ণ এখনও ফেরেনি। ভীষণ রাগ হয়েছিল স্মৃতির। কোনোদিনও যা করে না, তা করল। নিজে খেয়ে-দেয়ে, চাঁপাকেও খেতে বলে, ক্যাসারোলে খাবার ঢাকা রাখতে বলে শুয়ে পড়ল। শুলে, হবে কী? ঘুমুবার জো কি আছে? খটাং খটাং শব্দ হচ্ছে, পাঁচশো পাওয়ারের বালবে তীব্র আলো, খাট তৈরি হচ্ছে। চিত্তির!
কৃষ্ণ ফিরল রাত প্রায় পৌনে একটার সময়ে। উদভ্রান্তর মতো।
চাঁপা দরজা খুলল। ট্রাউজার আর হাওয়াইয়ান শার্ট ডার্টিলিনেন-বক্সে ফেলে দিয়ে চান করতে ঢুকল ও। সে স্মৃতিকে কিছুই বলল না, হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবেই। স্মৃতিও কিছু জিজ্ঞেস করল না। মটকা-মেরে শুয়েছিল সে।
চান করে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে এসে ড্রেসিং-টেবলের সামনে দাঁড়িয়ে অন্ধকারেই মাথা আঁচড়াল কৃষ্ণ। স্মৃতি দেখল। তারপর, চোখ পিটপিট করে চেয়ে দেখল, ঘুমের ভাণ করে শুয়ে থেকেই যে, কৃষ্ণ গিয়ে খোলা জানালাটার সামনে দাঁড়াল। দাঁড়িয়েই রইল। অনেকক্ষণ। শুনতে পেল, চাঁপা বলছে কিচেনের সামনে থেকে, খাবার কি বেড়ে দেব দাদা?
না। না। তুমি শুয়ে পড়ো। আমি নিজে নিয়ে নেব।
মটকা-মেরে পড়ে-থাকা স্মৃতি তখন উঠে বসে বলল, খুব কনসিডারেট তো তুমি! নিজে একটা ফোন করতে পারলে না? রাত একটাতে বাড়ি ফিরলে।
সময়ই পেলাম না। আসলে ঘটনাটা জানলে…এমন হঠাৎ…
কী হয়েছে? স্মৃতি বলল, খাট থেকে নেমে এগিয়ে এসে কৃষ্ণর পাশে দাঁড়িয়ে। তারপর বলল, চলো খেতে খেতে বলবে।
খাওয়ার ঠিক ইচ্ছে নেই।
কেন? কী হল? কে গেলেন? কোনো বন্ধু তোমার? শ্যামল নয় তো? সেদিন বলছিলে, সাড়েচারশো হয়ে গেছে ব্লাডসুগার। কোমা সেট করে গেছে।
না, না। শ্যামল ভালো আছে।
তবে?
গোপেন চৌধুরী।
সে কী!
তা তোমার সঙ্গে তো প্লেনে আলাপ। মাত্র গতরাতে!
হ্যাঁ। আজই সকালে ওঁর সেক্রেটারিকে আমার কার্ডটা দিয়েছিলেন হয়তো উনি। সেইজন্যেই তো! বড়ো শক পেয়েছি। ওঁর সেক্রেটারিই আমাকে ফোন করে জানালেন। অফিসেই। সকালে এসে সাড়ে দশটাতে টেবলের ওপরেই মাথা রেখে…হার্ট অ্যাটাক হয়। নিজের কাজের টেবলেই মাথা রেখে চলে যান। চমৎকার মৃত্যু। উইথ হিজ বুটস অন।
তা এমন কী নিকটাত্মীয় উনি! তোমার শ্মশানে যাবার কী হল?
বলেছ ঠিকই। প্রত্যেক ফ্লাইটেই তো প্লেনে কত মানুষের সঙ্গেই আলাপ হয়। কিন্তু মিস্টার চৌধুরী তো প্রতিবেশী, মানে, হতেন, তা ছাড়া ঠিক সে জন্যেও নয়, বলতে পারো তো ওই খাটটির জন্যেই।
অন্য পালঙ্কে করে গেলেন বুঝি? সেটাও দামি খাট?
না। আসলে…
কী?
খাটে শুয়ে পড়ে কৃষ্ণ পাশ ফিরে বলল, দাঁড়াও একটা সিগারেট খেয়ে নিই, তারপরে ড্রয়িং-কাম ডাইনিং রুমের বাতিটা নিবিয়ে দেব, আসলে…। স্মৃতি খাটের ওপর জোড়াসনে বসে ছিল নাইটি পরে। বলল, আবার খাচ্ছ সিগারেট? বলেই বলল, তোমাকে খুব আপসেট দেখাচ্ছে।
আসলে, বহুদিন পরে গেলাম তো শ্মশানে! মিস্টার চৌধুরী…মানে, এত সময় লাগল, কারণ লম্বা লাইন ছিল ইলেকট্রিক ফার্নেসে। মিস্টার চৌধুরী গেলেন কোনো পালঙ্কে তো নয়ই, গেলেন একটি কাঁচাবাঁশের নড়বড়ে চালায়, উলঙ্গ শরীরে। ওপরে একটি সাদা চাদর, নতুন চাদর। সস্তা চাদর, অতিসস্তা।
তাতে কী হল! সবাই-ই তো…তা-ই
তা হয়তো যায়। আমি বাবার মৃত্যুর পরে আর শ্মশানে যাইনি। বাবার মৃত্যুর সময়ে আমি এতই ছোটো ছিলাম যে, কিছু মনেও নেই…বুঝতে পারলাম যে, মানুষ, কোনো মানুষই, কিছুই নিয়ে যায় না সঙ্গে করে, সবই রেখে যায়; সবকিছুই। খাট-পালঙ্ক, জামা-কাপড়, জুতো, চশমা, কলম, টাকা-পয়সা সবই থেকে যায় যেমন থাকার, শুধু…অথচ এই জন্যে…।
সেকথা বোধহয় ঠিক নয়। মানুষ রেখেও যায় কিছু। কিছুই রাখে না, এমন নয়। রেখে যায় শুধু তার কীর্তি। তার ব্যবহার, তার হাসি, তার সততা, তার আঁকাছবি, তার গানের রেকর্ড তার লেখা বই, তার অভিনীত ছবি, পরিচালিত ছবি, এইসবই।
স্মৃতি বলল। নি:শ্বাস ফেলে।
আর আমার মতো, মিস্টার চৌধুরীর মতো যাঁরা, তাঁরা এই খাটের মতোই অসার, নিতান্ত অপ্রয়োজনীয়, আড়ম্বরের কিছু কিছু রেখে যাই হয়তো। আসলে যেসবের কোনোই দাম নেই, বিন্দুমাত্রও নয়, কিছু টাকা, ছেলে-মেয়েকে নষ্ট করার জন্যে, ভায়ে-বোনে সম্পর্ক নষ্ট করার জন্যে রেখে যাই।
আঃ। মিস্ত্রিরা আজ বড়োই শব্দ করছে। আর কী হবে? তুমি কি বারণ করবে ওদের? ভদ্রলোকই তো চলে গেলেন। কী হবে আর?
কী হবে তা কী করে বলব? মিসেস চৌধুরী, যদি তিনি আদৌ থেকে থাকেন, যে অন্য কারও সঙ্গে সে খাটে শোবেন না, বা তাঁর ছেলে, ছেলের বউ বা মেয়ে-জামাই শোবে না, তা আমি-তুমি কী করে জানব?
দেখলে তাঁদের? কে কে আছেন ভদ্রলোকের?
কে জানে! খোঁজও করিনি। আমি শুধু বাঁশের চালাটা আর এই খাটটার তুলনা করছিলাম। মনে মনে। শ্মশানে দাঁড়িয়ে। বুঝলে স্মৃতি, আমাদের প্রত্যেকেরই মাসে অন্তত একদিন শ্মশানে যাওয়া উচিত। অথবা কবরখানায়। আমাদের শেষগন্তব্যর বয়স ও প্রকৃতিটা দেখা থাকলে, জন্ম আর মৃত্যুর মধ্যে আমাদের মতো সাধারণেরা এত কোলাহল, বাদ-বিসম্বাদ, কাজিয়া করতাম না। কেরিয়ার নিয়ে এত প্রতিযোতিয় কাঁকড়াদের মতো দাঁড়ায় দাঁড়া লাগিয়ে প্রতিমুহূর্তে লড়তাম না। শ্মশানে আজ না গেলে একটা বড়ো এডুকেশান…রিভিলেশান…বুঝলে স্মৃতি।
মিস্ত্রিদের বারণ করল হত না? স্মৃতি ফিসফিস করে বলল। আবারও।
থাক না। থাক। কে বলতে পারে? মিস্টার চৌধুরী হয়তো এসে ওই খাটেই শোবেন। কে বলতে পারে? অত শখ, অত সাধ…এত কামনা-বাসনা। হয়তো আজ রাতেই…
আমার ভয় করছে গো। জানালাটা বন্ধ করে, পর্দাটা টেনে দাও আজ।
তা দিচ্ছি। অস্ফুটে বলল, কৃষ্ণ।
মনে মনে বলল, কিন্তু খাটটা আর ওই বাঁশের চালাটা যে আমার মাথার মধ্যে…
স্মৃতি বলল, আমাকে খুব জোরে জড়িয়ে ধরো তো। আমার বড়ো ভয় করছে।
কৃষ্ণ বলল, ভয় কীসের? দাঁড়াও, আলোগুলো নিভিয়ে আসি। পিপাসা পেয়েছে বড়ো।
তারপর ফিসফিস করে বলল, যে চলে গেল, সে তো খাট-পালঙ্ক কামনা-বাসনা, সাধ-আহ্লাদ সব সঙ্গে নিয়েই গেল। তাকে ভয় কী?
তবে?
ভয় আমাদেরই। মানে আমরা, যারা রইলাম, তাদের জন্যেই ভয়, মৃত্যুকে নয়।
তার মানে কী হল?
মানে, ভয় মৃত্যুকে নয়, ভয় জীবনকেই। জীবনের রকমকেই!
তবু মানে বুঝলাম না।
একথার মানে একটি নয়। যে যেমন বোঝে। যে যে যার যার মতো মানে করে নেবে। এর মানে, ব্যাখ্যা করে বোঝানোর নয় স্মৃতি।
কথাটার মানে স্মৃতি বুঝল কি না তা বোঝা গেল না। কৃষ্ণর লোমশ বুকের ওপরে ডান হাতের তর্জনীটি রেখে, স্মৃতি চুপ করে শুয়ে রইল।