বাবা হওয়া
ডাকবাংলোটা থেকে নদীটা দেখা যাচ্ছিল।
সামনে একটা খোয়ার পথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে। পথের দু-পাশে সারি করে লাগানো আকাশমণি গাছ। মার্চের প্রথমে অগ্নিশিখার মতো ফুটেছে ফুলগুলো। আকাশপানে মুখ তুলে আছে। বাংলোর হাতায় পনসাটিয়ার ঝাড়। লাল পাতিয়া বলে মালি। পাতাগুলোর লালে এক পশলা বৃষ্টির পর জেল্লা ঠিকরোচ্ছে। কয়েক জন আদিবাসী মেয়ে-পুরুষ খোয়ার রাস্তাটা মেরামত করছে সামনেই।
আমার ছেলে রাকেশ আর মেয়ে রাই নদীর সবুজ মাঠটুকুতে দৌড়াদৌড়ি করে খেলছে। রাকেশ যথেষ্ট বড়ো হয়েছে। ক্লাস এইটে পড়ে সে। তা ছাড়া বয়স অনুপাতে সে অনেক বেশি জানে বোঝে। কত বিষয়ে সে যে পড়াশুনো করে, তা বলার নয়। পড়াশুনাতে খুব ভালো সে তো বটেই, কিন্তু শুধু স্কুলের পড়াশুনাতেই নয়।
নিজের ছেলে বলেই শুধু নয়, তার ভালোত্বে আমি সত্যিই গর্ব বোধ করে থাকি।
এই গর্বের কোনো সংগত কারণ আমার থাকার কথা নয়। কারণ ছেলে ও মেয়ের যা কিছু ভালো, তা আমার স্ত্রী শ্রীমতীরই জন্যে। বাবার কর্তব্য হিসেবে একমাত্র টাকা রোজগার ছাড়া আর কিছুই প্রায় করার সময় পাইনি আমি। আমি আমার দোষ স্বীকার করি। আমি অত্যন্ত উদার মানুষ বলেই আমার বিশ্বাস। তবুও খারাপটুকুর দায় শ্রীমতীর ওপর অবহেলায় চাপিয়ে আমার ছেলে-মেয়ের ভালোত্বের কৃতিত্বটুকু আমি এই মুহূর্তে এই বাংলোর চওড়া বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে তাকিয়ে তাকিয়ে উপভোগ করছিলাম।
শ্রীমতী ঘরে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। ড্রাইভে আমার কালোরঙা, সদ্য-কেনা ঝকঝকে গাড়িটা সাদা সিট কভার পরে কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
আমি একজন সেলফ মেড মানুষ। লেখাপড়া বিশেষ করিনি, মানে ইন্টারমিডিয়েট অবধি পড়েছিলাম। ইংরেজিতে বেশ কাঁচা ছিলাম। পড়াশুনা ছেড়ে দিতে হয় আর্থিক কারণেই। কিন্তু ফিরিওয়ালা এবং নানারকম চাকর থেকে জীবন শুরু করে আমি এখন একটা কারখানার মালিক। স্মল স্কেল ইণ্ডাস্ট্রি হিসেবে রেজিস্টার্ড। লোহার ঢালাই-করা জিনিস নানা দেশে এক্সপোর্টও করি। আমার ব্যাবসাও যে ভালো সে-সম্পর্কেও ছেলে সম্পর্কিত গর্বের মতো গর্ব আছে আমার।
হাওড়াতে আমার কারখানা। সল্টলেকে হালফিল ডিজাইনের বাড়ি। সুন্দরী স্ত্রী। আর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি। বেশকিছু লোক আমাকে স্যার স্যার করে। ভালো লাগে। কলকাতার একটি বড়োক্লাবে আমি বছরখানেক হল মেম্বার হয়েছি। ইদানীং ক্লাবে এবং ব্যাবসার জগতে আমি আকছার ইংরেজি বলে থাকি। আমি এখন জানি যে, এ-সংসারে টাকা থাকলে ইংরেজি-বাংলা কিছুই না জানলেও চলে যায়। টাকার মতো ভালো ও এফেক্টিভ ভাষা আর কিছুই নেই। তা ছাড়া টাকা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সব বিদ্যাই আপনাআপনিই বাড়ে।
লঞ্জীর মতো সরস্বতী আর দুটি নেই।
ক্লাবে আমাকে লোকে ‘ম্যাক চ্যাটার্জি’ বলে জানে। আমার আসল নাম মকরক্রান্তি। ছোটোবেলায় পাড়ার ছেলেদের কাছে, আমার বাবার কাছে, চাকরি জীবনের বিভিন্ন মালিকদের কাছে আমার নাম ছিল ‘মকরা’। সে ডাকটা এখন ভুলেই গেছি। কেউ ডাকে না সে-নামে। ডাকলে আমি রেগেও যাব।
এই মুহূর্তে আমি একজন সুখী লোক। সংসারে সুখী হতে হলে যা-যা থাকতে হয়, থাকা উচিত, আমার তার প্রায় সবই আছে। আমি একজন কপিবুক সুখী লোক। কিন্তু নদীর সামনে; দূরে খেলে-বেড়ানো আমার ছেলে রাকেশ এবং মেয়ে রাই-এর কারণে আমি ঠিক যতটা সুখী, তেমন সুখী অন্য কিছুরই জন্যে নই।
ছেলে-মেয়ে ভালো হওয়ার সুখ, কৃতী হওয়ার সুখ বাবাকে যে আনন্দ এনে দেয়, তা তার ব্যাবসা, অর্থ, মানসম্মান কিছুই এনে দিতে পারে না। অবশ্য ছেলে-মেয়েকে তাদের জীবনে অনেক কিছু দিয়েছি আমি, আমাকে যা আমার মা-বাবা দিতে পারেননি।
আমি একজন কৃতী কেউকেটা যোগ্য বাবা। ভাবছিলাম আমি। বড়োলোক হওয়া সোজা। পন্ডিত হওয়া সোজা, সবকিছু হওয়াই সোজা, কিন্তু ভালো বাবা হওয়া বড়ো কঠিন। এই শান্ত দুপুরে, আলস্যে কবুতরের ডাকের একটানা ঘুমপাড়ানি শব্দে, ছায়ায় স্নিগ্ধ হাওয়াতে, আদিবাসী কুলিকামিনদের রাস্তা সারানোর ছন্দবদ্ধ খট-খট আওয়াজের মধ্যে বসে আমি ভাবছিলাম, আমি একজন সার্থক বাবা।
দুই
বোধ হয় একটু তন্দ্রা এসেছিল। চোখের পাতা বুজে গেছিল, এমন সময় একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দে আচমকা তন্দ্রা ভেঙে গেল।
চোখ মেলে দেখি, আমার কারখানার ওভারড্রাফট অ্যাকাউন্ট যে ব্যাংকে, সেই ব্যাংকেরই ম্যানেজার এসে হাজির।
মি. রায়। হঠাৎ? এখানে? উনি বললেন।
ওঁকে দেখেই আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম।
বললাম, আরে? আপনি কোত্থেকে স্যার?
সব স্যারেরই স্যার বলার লোক থাকে? বাবারও বাবা থাকে। লিমিট বাড়ানো নিয়ে গত তিন মাস ধরে বড়ো রমদারমদি চলছে। কানাঘুসোয় শুনেছি, সোজা রাস্তায় হবে না। কিন্তু তেমন জানাশোনা হয় এমন সুযোগও হয় না। এ একেবারে গড-সেন্ট ব্যাপার!
রায় সাহেব ন্যাশনালাইজড ব্যাংকের বিরাট এয়ার কণ্ডিশণ্ড অফিসে সবসময়ই এমন একটা ‘এয়ার’ নিয়ে বসে থাকেন যে, মন খুলে কথাই বলা যায় না।
আমি রায় সাহেবকে ইম্প্রেস করার জন্যে ইংরেজিতে কথাবার্তা চালু করলাম। আমি যে হাওড়ার একজন সামান্য ঢালাইওয়ালা নই, ডাবু ধরাই যে আমার শেষ গন্তব্য নয়, টাকা যে নোংরা আর পাঁকের মধ্যেই জন্মায় না, পদ্মফুলের মধ্যেও জন্মায়, একথাটা এহেন আপনগন্ধে কস্তুরিমৃগসম পাগল ব্যাংকারকে বোঝানো দরকার।
এমন সময় রাকেশ ও রাই ফিরে এল।
আমি আমার ছেলে-মেয়ের সঙ্গে রায় সাহেবের আলাপ করিয়ে দিয়ে রায় সাহেবদের সবাইকে মহাসমারোহে বসালাম। রাইকে বললাম শ্রীমতীকে দিবানিদ্রা থেকে তুলতে। টিফিন-ক্যারিয়ারে কিছু খাবার আছে কী নেই কে জানে? চৌকিদারকে ডেকে চা করতে বললাম।
রায় সাহেব বললেন, রাঁচি যাচ্ছি। বাংলোটা দেখে ভাবলাম একটু রেস্ট করে যাই। আমার স্ত্রী ও শালি সঙ্গে আছেন। ওঁরা একটু…যাবেন।
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই! বলে আমি রাইকে বললাম, রাই, মাসিমাদের বাথরুমে নিয়ে যাও।
রায় সাহেব ইমপোর্টেড সিগারেটের প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরালেন। আমাকেও একটা দিলেন। আমি কৃতার্থ হলাম। কিন্তু ওভারড্রাফট-এর লিমিটটা বাড়লে আরও বেশি কৃতার্থ হতাম।
তারপর বাংলোর সামনে কাজ-করা কুলিকামিনদের দিকে আঙুল তুলে বললে, দিজ পিপল আর ভেরি অনেস্ট অ্যাণ্ড নাইস ইণ্ডিড। আই মিন দিজ জাংগলি লেবারার্স।
তারপরেই বললেন, বাট দে আর রিয়্যালি নেভ।
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, ইয়েস। রাইট ইউ আর। দে আর রিয়্যালি নেভ।
রাকেশ সিঁড়িতে বসেছিল। হঠাৎ উঠে এসে বলল, কাদের কথা বলছ বাবা?
আমি একটু হেসে বিদগ্ধ কৃতী বাবার মতো মুখ করে ওই কুলিকামিনদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ইংরেজিতেই বললাম, উই আর টকিং অ্যাবাউট দেম। দে আর নেভ।
রাকেশ তার ক্লাসের সেরা ছাত্র। তার স্কুলও শহরের সেরা স্কুল।
সে অবাক গলায় বলল, নেভ?
রায় সাহেব সিগারেটের ধোঁয়া চেড়ে কৌতুকের স্বরে বললেন, হোয়াই, সান?
রাকেশ বলল, ওরা অনেস্ট কিন্তু নেভ, দুটোই একসঙ্গে কী করে হবে? তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে আমাকে বলল, আই ডোন্ট নো হোয়াই ইউ কল দেম নেভ।
রায় সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, নেভ বানান জানো?
রাকেশ অপমানিত হল।
আমি, মানে রাকেশের বাবা, নেভ বানান এবং মানে দুটোর একটাও জানতাম না। রায় সাহেব বলেছিলেন বলেই ওঁর কথায় সায় দিয়ে বলেছিলাম! তাই রাকেশের দিকে তাকিয়ে রইলাম, সে বাবার সম্মান রাখতে পারে কি না দেখার জন্য।
রাকেশ কেটে কেটে বলল, Knave। আপনি আর বাবা এই knave-এর কথাই বলছিলেন তো? অন্য নেইভও আছে। তার বানান আলাদা। উচ্চারণও।
এগজাক্টলি! বললেন মি. রায়।
রাকেশ বলল, আমি তো তাই-ই ভাবছি। তাহলে ঠিকই বলেছি। knave-এর মানে তো অন্য। অনেস্ট আর নেভ একই সঙ্গে হতে পারে না।
মি. রায় আমার দিকে চেয়ে বললেন, তাহলে আমিই ভুল বলেছি, কি বলেন মি. চ্যাটার্জি?
আমি বললাম, কী যে বলেন স্যার? আপনি কখনো ভুল বলতে পারেন! আজকালকার ছেলেদের কথা ছেড়ে দিন। সব অসভ্য। অভদ্র।
রাকেশ হঠাৎ আমার দিকে একবার তাকাল। এমন চোখে! যে নবজাত ছেলেকে আমি নার্সিং হোমে উলঙ্গ অবস্থায় দেখেছি! দু-পা একসঙ্গে করে ধরে গামলায় চান করিয়ে নার্স যাকে তুলে ধরে বলেছিলেন, এই যে মকরাবাবু, দ্যাখেন আপনার ছাওয়াল। বাবা হইলেন গিয়া আপনে।
সেই ছেলে এমন ঘৃণা ও হতাশা মেশা অবাক হওয়া চোখে কখনো আমার দিকে তাকায়নি। কখনো তাকাবে বলে ভাবিয়োনি।
একটুক্ষণ তাকিয়ে রইল রাকেশ। তারপর মি. রায়ের দিকে মাথা নীচু করে বলল, আই অ্যাম সরি।
আমি বললাম, সরি শুধু নয় রাকেশ, ইনি কে জানো? কত বড়ো পন্ডিত তা তুমি জানো?
বলেই ভাবলাম, ও কী করে জানবে? স্টুপিড, ইনোসেন্ট, ইডিয়ট। স্কুলের পরীক্ষাই তো পাশ করেছে। জীবনের পরীক্ষায় তো বসতে হয়নি। ও জানবে কী করে? ব্যাংকের লিমিট না বাড়লে যে ব্যাবসা বাড়ে না, গাড়ি চড়া যায় না, আরও ভালো থাকা যায় না, ভালো স্কুলে পড়ানো যায় না ছেলে-মেয়েকে; তা ও কী করে জানবে। গাধা!
আমি বললাম, স্বীকার করো ওঁর কাছে যে তুমি অন্যায় করেছ। বলো যে, তুমি ভুল বলেছ। ক্ষমা চাও, তর্ক করেছ বলে।
আমি…
বলেই, রাকেশ আমার দিকে চেয়ে রইল।
ইতিমধ্যে রায় সাহেবের স্ত্রী ও শালি বারান্দায় চলে এলেন।
আমি আবহাওয়া লঘু করে বললাম, বসুন বসুন, এক্ষুনি চা আসছে।
ওঁরা বসতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু রায় সাহেব রুক্ষ গলাতেই বললেন, চায়ের ঝামেলার দরকার নেই, রাস্তায় অনেক পাঞ্জাবি ধাবা আছে। সেখানেই খেয়ে নেব।
বলেই অত্যন্ত অভদ্রভাবে বললেন, চলি মি. চ্যাটার্জি।
শ্রীমতীও ঘর থেকে বাইরে এসেছিল। ওর সঙ্গে মহিলারা ভালোই ব্যবহার করেছিলেন। তাই মি. রায়ের এইরকম হঠাৎ চলে যাওয়ার কারণ ও বুঝতে পারল না।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে আমি গিয়ে মি. রায়ের গাড়ির দরজা খুলে দিলাম। মি. রায় সামনের সিটে উঠতে উঠতে বললেন, আপনার ছেলেটি ভালো। কিন্তু ওকে ভালো করে ম্যানারস শেখান। এখনই যদি সবকিছু জেনে ফেলে তবে পরে কী জানবে আর?
আমি হাতজোড় করে বললাম, ওর হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি। অপরাধ নেবেন না।
মি. রায় সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, অপরাধের কী আছে!
তারপর একটু থেমে, আমার চোখের দিকে চেয়ে বললেন, অপরাধ ক্ষমা করাই তো আমাদের কাজ।
গাড়িটা চলে গেল।
আমি ডাকলাম, রাকেশ। রাকেশ।
আমার ম্যাক চ্যাটার্জির মধ্যে থেকে মুন্ডিতলা বাই-লেনের মকরা বেরিয়ে এল বহুদিন পর। আমি হুংকার দিলাম, কোথায় তুই ছোকরা! তোর পিঠের চামড়া তুলব আজ।
রাকেশ যেন মাটি ফুঁড়ে উঠল। একটুও উত্তেজনা নেই। শান্ত ধীর পদক্ষেপে আমার দিকে এগিয়ে এল। আমার চোখে চোখ রাখল।
ওকে দেখে আমার মনে হল, এ আমার ছেলে নয়। এ আমার শত্রু। আমার ধ্বংসকারী। বিষবৃক্ষ।
আমি বললাম, তুমি ভেবেছটা কী?
রেগে গেলে ছেলে-মেয়েদের আমি তুমি করে বলি!
রাকেশ শান্ত গলায় বলল, কী বাবা?
আবার কী বাবা? বলে চটাস করে এক চড় মারলাম ওকে।
বললাম, বাবার মুখে কথা বলা, তুমি বাবার চেয়েও বেশি জানো? তুমি জানো মি. রায় কত বড়ো অফিসার? আমাদের ব্যাবসার ভাগ্যবিধাতা উনি। আর তুমি তাঁর চেয়েও বেশি জানো? বড়োদের মুখের উপর কথা! মুখে মুখে কথা।
শ্রীমতী দৌড়ে এল।
আমি বললাম, তুমি সরে যাও। আমি ওকে আজ মেরেই ফেলব। আমার আজ মাথার ঠিক নেই।
শ্রীমতী রাকেশকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে গেল। কিন্তু রাকেশ নড়ল না। দৃঢ় পায়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু মুখের ভাব শান্ত; নিরুত্তাপ।
আমি কী করে ওর মনের দৃঢ়তা ভাঙব বুঝতে না পেরে ওর নরম গালে আর এক চড় মারলাম।
ওর গাল বেয়ে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে গেল।
ওর চোখের দিকে চেয়ে হঠাৎ এই প্রথমবার আমার মনে হল এ সাংঘাতিক ছেলে। বড়ো হলে এ বোধ হয় নকশাল হবে। অথবা ওইরকমই কিছু। নিজের বাবাকেই খুন করবে। একসময়ে রাকেশের মতো পড়াশোনায় ভালো ছেলেরাই তো ওইসব করেছিল।
আমি ভাবলাম, ওকে চন্ডীমাতা প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা করালেই ভালো করতাম। ঢালাইওয়ালা মকরার ছেলেকে ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট করার স্বপ্ন দেখতে গিয়েই এই বিপত্তি!
শ্রীমতী নিরুত্তাপ, উদাসীন গলায় বলল, অনেক বেড়ানো হয়েছে, পিকনিক হয়েছে; এবার ফিরে চলো। রাতটা মামাবাড়িতে খড়্গপুরে কাটিয়ে কালই কলকাতা যাব।
তিন
বাইরে থেকে ফিরে এসেছি দিন দশেক হল। এসে অবধি ভারি খাটুনি যাচ্ছে। লোডশেডিং-এর জন্যে রাতে ঢালাই প্রায় বন্ধ। একটা জেনারেটর কেনা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে হয়রান হয়ে গেলাম।
সল্টলেকে বড়ো মশা। শুয়েছি মশারির মধ্যেই। তবু এখনও ঘুম আসছে না। কেন জানি না, বারে বারে রাকেশের কথাই মনে হচ্ছে।
রাকেশ যখন ছোটো ছিল, যখন আমার অবস্থা এত ভালো ছিল না; তখন আমাদের আমহার্স্ট স্ট্রিটের ভাড়াবাড়িতে শ্রীমতীর সঙ্গে মেঝেতে মাদুর পেতে বসে ও পড়ত। আমি অফিস থেকে ফিরলেই, বাবা বাবা বলে দৌড়ে এসে আমার কোলে উঠত। ওই বয়সটাই ভালো ছিল।
নীচের তলায় রাকেশের পড়ার ঘর। আমরা কি ছোটোবেলায় এত সুযোগসুবিধা পেয়েছি? কত কষ্ট করে পড়েছি, বাজে স্কুলে; বইপত্র ছাড়া। এরা এত কিছু পেয়েই কি এত উদ্ধত হয়ে গেল? অমানুষ হয়ে উঠল কি?
ঘুম আসছিল না।
বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে। ছেলে-মেয়েরা বড়ো হয়ে যাওয়ার পর আমি আলাদা ঘরে শুই। শ্রীমতী রাইকে নিয়ে অন্য ঘরে। রাকেশ আলাদা ঘরে। সারাবাড়ির আলো নিবোনো। নীচের পর্চে শুধু একটা আলো জ্বলছে, গ্যারেজের সামনে।
ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিলাম। পায়চারি করতে করতে কখন যে আমি দরজা খুলে সিঁড়ি ভেঙে রাকেশের পড়ার ঘরে চলে গেছি, আলো জ্বালিয়েছি, জানিও না।
ঘরের এপাশ-ওপাশ সব ঘুরে বেড়ালাম। ড্রয়ারে চাবি দেওয়া। ড্রয়ারে কী আছে কে জানে? ড্রয়ার খুলে আবার কী নতুন আতঙ্ক হবে তা তো জানা নেই, ড্রয়ার বন্ধ থাকাই ভালো।
রাকেশের লেখার টেবিলে একটা খাতা। বুক-র্যাকে অনেক বই। মাস্টার মশাইয়ের বসার জন্যে টেবিলের উলটো দিকে একটা চেয়ার। দেওয়ালে ব্রুস লি-র বড়ো পোস্টার।
যা খুঁজছিলাম, দেখলাম আছে। দুটি ডিকশনারি আছে।
প্রথমটি কনসাইজ অক্সফোর্ড ডিকশনারি। পাতা উলটে উলটে knave কথাটি বের করলাম। লেখা আছে: আনপ্রিন্সিপলড ম্যান, রোগ, সারভেন্ট।
রাগে আমার গা জ্বলে গেল। ওই লেবারদের যদি মি. রায় ভেরি নেভ বলে থাকেন এবং ভালো চাকরবাকর বলে থাকেন ভুল কী বলেছেন?
অন্য ডিকশনারিটি টেনে নিলাম। জুনিয়র স্কুল ডিকশনারি, ফার্স্ট এডিশন, ১৯৬৯। তাতে শুধুই লেখা: এ পার্সন হু লিভস বাই চিটিং, আ ডিসঅনেস্ট ক্যারেকটার।
এ ছাড়া আর কিছুই লেখা নেই।
আমি রাকেশের চেয়ারে বসলাম। দু-হাতের পাতায় মুখ রেখে ভাবতে লাগলাম।
ভেরি নেভ-এর সঙ্গে এই মানেটা খাপ খায় না। কিন্তু মি. রায় এতবড়ো একজন অফিসার ও লেখাপড়া জানা লোক হয়ে কখনো ভুল করতে পারেন না।
বড্ড মশা কামড়াতে লাগল। গিয়ে ফ্যানটা খুলে দিলাম। হঠাৎ রাকেশের টেবিলে রাখা খাতাটার ওপর চোখ পড়ল আমার। মলাটে রাকেশের নাম, ক্লাস, রোল নাম্বার সব লেখা। এটা পুরোনো ক্লাসের খাতা। আজেবাজে লেখার জন্যে ব্যবহার করে নিশ্চয়ই।
প্রথম পাতাটা ওলটাতে দেখি রাকেশ লিখেছে, ‘নেভার স্টপ লার্নিং।’ এই কথাটাই বার বার লিখেছে। লিখে নীচে আণ্ডার লাইন করেছে। আর সেই পাতারই নীচের দিকে লিখেছে, ‘ইউ মাস্ট হ্যাভ দা কারেজ অফ ইয়োর কনভিকশন।’
এর নীচে সে লাইন টেনেছে বার বার, তা এত জোরে চাপ দিয়ে টেনেছে যে, কাগজ নিবের চাপে ছিঁড়ে ছিঁড়ে গেছে।
খাতাটার দিকে তাকিয়ে আছি, এমন সময় আমার মাথায় কার হাতের স্পর্শে চমকে উঠলাম ভয় পেয়ে। এত রাতে কে? রাকেশ?
কে? বলে উঠলাম আমি।
আমি। বলল, শ্রীমতী।
আমি শুধোলাম, রাকেশ ঘুমোচ্ছে?
হ্যাঁ।
আমি বললাম, আমাকে তুমি কিছু বলবে?
শ্রীমতী বলল, না।
বলেই, ঘরে যেমন নি:শব্দে এসেছিল, তেমনই নি:শব্দে চলে গেল।
একটু পর সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে আমি অনেক কিছু ভাবতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম আমার ব্যাবসা, আমার টাকাপয়সা, আমার সামাজিক প্রতিষ্ঠা, আমার বাড়ি-গাড়ি সবই তো রাকেশ আর রাই-এরই জন্যে। যদি ওরাই….। যদি আমি…। ওরাই যদি…।
কী লাভ? কেন এত খাটুনি, এত দৌড়াদৌড়ি, হাওড়ার বাঁশবনে শেয়াল রাজা হওয়ার এই তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমার? কেন? কাদের জন্যে?
আমার একার জন্যেই কি?
চার
সকাল বেলাটা যে কী করে কেটে যায় বুঝতে পারি না। মোল্ড নিয়ে আজ মহা-গোলমাল হল। লয়েডস ইন্সপেকশনের একজন লোক কেবলই পাসিং-এর সময় বায়নাক্কা লাগাচ্ছে। এই রেটে রিজেকশান হলে আর ব্যাবসা করতে হবে না। ঘোষালের নতুন-হওয়া বাচ্চাটা নার্সিং হোম থেকে আসতে-না-আসতেই মারা গেছে। কারখানায় আসতেই পারছে না সে। সব ঝক্কি আমার একারই সামলাতে হচ্ছে ক-দিন থেকে।
দুপুরের দিকে একবার কলকাতা আসি রোজই। কোনোদিন ক্লাবে খাই, কোনোদিন বা শ্রীমতী বাড়ি থেকে হট-বক্সে কিছু দিয়ে দেয়।
ক্লাবে গেলাম, কিন্তু খেতে ইচ্ছে করল না। শরীরটা ভালো লাগছে না। সুগারটা চেক করতে হবে। বেড়েছে বোধ হয়। একটা ই.সি.জি.-ও করা দরকার। এই বয়সে ইসকিমিয়া হতেই পারে। বাঁ-দিকের বুকেও মাঝে মাঝে ব্যথা করে।
ক্লাব থেকে বেরিয়ে ড্রাইভারকে বললাম, কলেজস্ট্রিট যেতে। রাকেশের খাতায় লেখা কথাগুলো কাল থেকে আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। কী বলতে চেয়েছে ও? রাকেশের বাবা কি আমি? না, আমি ওর শত্রু?
সেইদিন দুপুর থেকে ছেলেটা স্তব্ধ হয়ে আছে। ছেলের মুখের দিকে তাকাবার সময় গত কয়েক বছরে বেশি পাইনি আমি। কিন্তু যে মুখে তাকিয়েছি সে মুখ এ মুখ নয়।
একটা বড়ো বইয়ের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করাতে বললাম ড্রাইভারকে।
ঢুকে বললাম, ভালো ডিকশনারি কি আছে?
দোকানদার দুটি বের করে দিলেন। ওয়েবস্টারস নিউ ওয়ার্ল্ড ডিকশনারি, সেকেণ্ড এডিশন, রিপ্রিন্ট ১৯৭৬।
তাড়াতাড়ি পাতা ওলটাতে লাগলাম। ৪১৪ পাতা। (১) knave মানে, (ক) এ মেল সার্ভেন্ট, (খ) এ ম্যান অফ হাম্বল স্ট্যাটাস (২) এ ট্রিকি রাসকাল, রোগ। (৩) এ জ্যাক (প্লেইং কার্ড)।
আমার মনে হল রাকেশকে শাসন করে ঠিকই করেছি। মি. রায় নিশ্চয়ই ১ (খ) বুঝিয়েছিলেন। ওখানকার সরল ভালো লোকেরা তো men of humble status-এরই। কিন্তু মি. রায় মধ্যে একটা but ব্যবহার করেছিলেন। এই but-টাই সমস্ত গুলিয়ে দিচ্ছে।
অন্য ডিকশনারি দেখলাম। শর্টার অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি ১৯৭০, ১০৮৯ পাতা। (ক) এ মেল চাইল্ড বয়। ১৪৬০ (খ) এ বয় এমপ্লয়েড অ্যাজ সার্ভেন্ট, মিনিয়াল, ওয়ান অফ লো কণ্ডিশন, (গ) অ্যান আনপ্রিন্সিপলড ম্যান, এ বেজ অ্যাণ্ড ক্রাফটি রোগ (1) JOC-১৫৬৩ (ঘ) কার্ডস।
One of low condition-এর অর্থে মি. রায় কথাটাকে নিশ্চয়ই ব্যবহার করেছিলেন বলে মনে হল আমার।
আমি তবুও পাশের দোকানে গেলাম। সেখানে লিটল অক্সফোর্ড ডিকশনারি, ফোর্থ এডিশন, ১৯৬৯, ২৯৪ পাতাতে বলছে, আনপ্রিন্সিপলড ম্যান, রোগ, লোয়েস্ট কোর্ট (অরিজিনালি নয়—সার্ভেন্ট)।
আমার মাথা ভোঁভোঁ করতে লাগল। কফি হাউসে উঠে গিয়ে এক কাপ কফি আর একপ্লেট পকৌড়া নিয়ে বসলাম। বহুবছর পর কফি হাউসে এলাম। কফিতে চুমুক দিয়েছি, দেখি শরৎ এসে হাজির। শরৎ আমার ছোটোবেলার বন্ধু হেমন্তের একেবারে ছোটোভাই। শুনেছি পড়াশোনায় খুব ভালো হয়েছে? প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ে।
আমাকে দেখে বলল, কী মকরদা? কেমন আছেন?
আমি অন্যমনস্কর মতো বললাম, ভালো।
তারপর বললাম Knave মানে জানো?
ও চমকে উঠল, বলল, আমাকে বললেন?
আমি বললাম, না। কফি খাবে?
ও বলল, কফি খাব না। কিন্তু আমি তো ফিজিক্সের ছাত্র। ইংরেজিতে তো অত ভালো নই।
আমি বললাম, এখানে তোমার ইংরেজির বন্ধুবান্ধব কেউ আছে! সামওয়ান হু ইজ রিয়্যালি গুড।
শরৎ বলল, ইউনিভার্সিটির বেস্ট ছেলেকে নিয়ে আসছি। ও নির্ঘাত ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হবে এবার ইংরেজিতে।
বলেই, শরৎ চলে গেল।
একটু পরে লাজুক লাজুক দেখতে ফর্সা রোগা একটি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এল শরৎ। বলল, এই যে!
আমি কোনো ভূমিকা না করেই বললাম, আমাকে Knave কথাটার মানে বলতে পারেন? বানান করে শব্দটা বললাম।
ছেলেটি বসে পড়ে আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল।
আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, কী খাবেন?
ছেলেটি বলল, বিষ ছাড়া যা খাওয়াবেন। খিদেও পেয়েছে।
ছেলেটি বেশ পাকা। ভালো ছেলেরা আজকাল বুঝি পাকাই হয়। রাকেশেরই মতো।
আমি ওদের দু-জনের জন্যেই খাওয়ার অর্ডার করলাম।
ছেলেটি হাসল।—একটা কথার তো অনেক মানে হয়।
না, যে মানেটা সবচেয়ে বেশি মানে। আমি বললাম। সেটাই বলুন।
ছেলেটি হেসে ফেলল।
বলল, তার মানে?
বললাম, যদি কথাটার একটাই মানে হত আজকে, তবে সেই মানেটা কী হত?
ছেলেটি হাসল, একফালি। ওর কপালে স্কাইলাইট দিয়ে রোদ এসে পড়েছিল।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘চিটিংবাজ’। এককথায় বললাম।
আমি অনেকক্ষণ চুপ করে রইলাম। বললাম। আপনি শিয়োর?
ছেলেটি সিগারেটের প্যাকেট বের করে বলল, অ্যাবসলিউটলি।
আজকালকার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে দ্বিধা বড়ো কম।
‘শিয়োর’ শব্দটি ছেলেটি যেমন করে বলল, তাতে ভালো লাগল আমার খুব। ওদের চরিত্রে একটি সোজা ব্যাপার আছে। ভালো হোক, মন্দ হোক, ওদের মধ্যে সংশয়-দ্বিধা ব্যাপারটা কম। আমাদের ছোটোবেলায়, ছাত্রাবস্থায় আমরা ওইরকম ছিলাম না।
তারপর বলল, অন্য অনেক মানে আছে। কিন্তু সব চেয়ে বেশ প্রচলিত ও প্রযোজ্য মানে নেই।
আমি উঠে পড়লাম। শরৎ-এর হাতে একটা দশ টাকার নোট দিয়ে বললাম, তুই দামটা দিয়ে দিস শরৎ। আমার বিশেষ তাড়া আছে। কিছু মনে করিস না।
যাওয়ার সময় ছেলেটিকে বললাম, থ্যাংক ইউ।
যেতে যেতে শুনলাম, ছেলেটি শরৎকে বলছে, কে রে? এ যে মেন্টাল কেস।
আমি তাড়াতাড়ি কারখানাতে ফিরে এলাম। এসেই অ্যাকাউন্টেন্টকে ডেকে পাঠালাম। বিমলবাবু আমার বহুপুরোনো অ্যাকাউন্টেন্ট। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পরীক্ষার একটা গ্রূপ ফেল। কিন্তু কাজে অনেক পাশ-করা অ্যাকাউন্টেন্টের চেয়েই ভালো।
বিমলবাবু এসে বললেন, বলুন স্যার।
বিমলবাবুর চোখ দুটো চিরদিনই স্বপ্নময়। এরকম কবি-কবি ভাবের মানুষ অথচ এফিসিয়েন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট খুব কমই দেখা যায়।
বললাম, বিমলবাবু এক্ষুনি একটা ক্যাশ-ফ্লো স্টেটমেন্ট তৈরি করুন। আমাদের ব্যাংকের ওভারড্রাফট আমি এক্ষুনি শোধ করতে চাই। কী অবস্থা জানান আমাকে। ইমিডিয়েটলি। সব কাজ ফেলে রেখে।
বিমলবাবু হাতের বলপেনটা নাড়াতে নাড়াতে বললেন, স্যারের মাথায় গন্ডগোল হল? অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার কথা ছেড়েই দিন। এক্ষুনি লাখ খানেক টাকার বিল ডিসকাউন্টিং ফেসিলিটি বাড়িয়ে আনতে না-পারলেই নয়।
আমি দৃঢ় গলায় বললাম, যা বলছি তাই করুন বিমলবাবু।
বিমলবাবু বললেন, কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে স্যার তা হলে।
হলে হবে। আমি বললাম।
আমিই কি বললাম?
মকরা বলল? না ম্যাক চ্যাটার্জি? না রাকেশের বাবা?
জানি না, কে বলল।
বিমলবাবু চলে যাওয়ার আগে আবারও বললাম যে, কত স্টক আছে দেখুন। সমস্ত স্টক ক্র্যাশ-সেল করব।
কী হয়েছে স্যার?
বিমলবাবুর চোখে-মুখে ভয়ের ছায়া নেমে এল।
বললেন, ব্যাবসা কি সত্যিই বন্ধ করে দেবেন। আমরা এতগুলো লোক কোথায় যাব এই বয়েসে। কী হল, একটু জানতে পেতাম? বড়োই চিন্তা হচ্ছে আপনার কথা শুনে।
আমি হাসলাম।
আমি বোধ হয় অনেক বছর পরে হাসলাম। এমন নির্মল হাসি।
বললাম, না, বন্ধ করব না। শুধু ব্যাংক বদলাব। তাতে যা ক্ষতি হয় হবে। অন্য ব্যাংকে চলে যাব লক স্টক অ্যাণ্ড ব্যারেল। এই চেঞ্জওভার পিরিয়ডে যা ক্ষতি হবার হবেই। কিছুই করার নেই।
ক্যাপিটাল লস্ট হয়ে যাবে স্যার অনেক। এমন তাড়াহুড়ো করলে।
আমি এবার শক্ত হয়ে বললাম, হলে হবে। বললামই তো।
তারপর বললাম যে, আমি চলে যাচ্ছি এখন। আজই সবকিছু কমপ্লিট করে রাখবেন। রাজেন আর রামকেও ডেকে নিন। কাল আমি সকাল ন-টায় এসে কাগজপত্র নিয়ে ব্যাংকে যাব মি. রায়ের কাছে। কাগজপত্র সব রেডি করে টাইপ করে রাখুন। দরকার হলে রাতেও থেকে যান। বাড়িতে খবর পাঠাবেন তাহলে। ভালো করে খাওয়াদাওয়া করবেন সকলে।
কাগজ রেডি করলেও সব শোধ করবেন কী করে? স্টক ক্র্যাশ-সেল করলেও হবে না।
বিমলবাবু চিন্তান্বিত গলায় বললেন।
আমি বললাম, অন্য সম্পত্তি, এক বসতবাড়িটা ছাড়া বিক্রি বা মর্টগেজ করে দেব। যা হোক করে হয়ে যাবে। আর কথা বলার সময় নেই আমার আজকে।
পাঁচ
বহু বহুদিন, বহুবছর পর আমি দিনের আলো থাকতে থাকতে কারখানা থেকে বেরোলাম। এত সময় হাতে নিয়ে আজ কী করব জানি না। নিউ মার্কেটে গিয়ে কেক কিনলাম। রাকেশ কেক খেতে ভালোবাসে। চকোলেট-কেক।
তারপর কলেজস্ট্রিটের দিকে গাড়ি চালাতে বললাম। পথে যে নার্সিং হোমে রাকেশ হয়েছিল, সেই নার্সিং হোমটা পড়ল। এখন কত বদলে গেছে সব। রাকেশ, আমার সেই ছোট্ট উলঙ্গ দুগ্ধপোষ্য ছেলেও কত বদলে গেছে।
কত বদলে গেছি আমি।
কলেজস্ট্রিটে নেমে অক্সফোর্ডের সব চেয়ে ভালো যে ডিকশনারি, ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে যার মাক্রোস্কোপিক অক্ষর দেখতে হয়; তা কিনলাম একটা। তারপর বাড়ির দিকে চললাম।
গাড়িতে বসে বসে ভাবছিলাম যে, কালকে মি. রায়কে কী বলব। বাবা হয়ে অন্যায়ভাবে চড় মেরেছিলাম রাকেশকে, সেই চড় দুটো ওঁর গালে ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল। ছোটোবেলায় বহু মারামারি করেছি, পাড়ায় ‘মকরা গুণ্ডা’ বলত অনেকে। কিন্তু আজকে তা আর হয় না। আজকে রাকেশের বাবা আমি। আমার নিজের পরিচয়টাই আমার একমাত্র পরিচয় নয়।
কাল কেমন করে ধীরে-সুস্থে মি. রায়কে বলব যে, মি. রায় আপনি ইংরেজিটা আমার ছেলের চেয়ে খারাপই জানেন। যেই উনি ভুরু কুঁচকে আমার অ্যাকাউন্ট সম্বন্ধে কথা বলতে যাবেন আমি সঙ্গের টাইপ-করা, সই-করা চিঠিটা এগিয়ে দেব! আর…
বাড়িতে যখন পৌঁছোলাম, তখন লোডশেডিং। শ্রীমতী রাইকে নিয়ে পাশের বাড়িতে গেছিল। পর্চ-এর সামনে ল্যাণ্ডিংয়ে একটা মোমবাতি জ্বলছে। তাতেই সিঁড়িটা আলো হয়েছে একটু।
দেখলাম, রাকেশের ঘরেও মোমবাতি জ্বলছে।
আমার হাত থেকে নগেন বইয়ের আর কেকের প্যাকেটটা নিতে যাচ্ছিল। আমিই বাধা দিলাম। বললাম, থাক।
রাকেশ দরজার দিকে পেছন ফিরে চেয়ারে বসে পড়ছিল। মোমবাতির আলোতে। এপ্রিলে ওর পরীক্ষা। এর আগে কখনো আমি জানিনি বা জিজ্ঞেস করিনি লোডশেডিং-এর মধ্যে আমার ছেলে-মেয়েরা কীভাবে পড়াশুনা করে। কারখানায় দেড় লক্ষ টাকা খরচ করে জেনারেটর লাগিয়ে ফেললাম, কিন্তু বাড়িতে পেট্রোম্যাক্সও কিনিনি একটা ওদের জন্য।
টেবিলের পাশের দেওয়ালে সেই বড়ো পোস্টারটা। ব্রুস লির। মোমবাতির আলোটা নাচছে পোস্টারটার ওপরে। কুংফু-র রাজা এই হতভাগ্য দেশের হতভাগা মানুষদের প্রতিভূ হয়ে যেন এদেশীয় ন্যক্কারজনক রাজনীতিকদের নির্লজ্জ আরশোলাসুলভ অস্তিত্বকে জুডোর প্যাঁচে গুঁড়িয়ে দেবে বলে ঠিক করেছে। আমি দেখলাম, আমার রক্তজাত, আমার যৌবনের স্বপ্নের, আমার বার্ধক্যের অভিভাবক রাকেশ, হাতকাটা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে মনোযোগ সহকারে পড়াশুনো করছে। মোমের সঙ্গে ওর চোখও জ্বলছে এবং গলছে।
দরজায় দাঁড়িয়ে বই বগলে করে আমি ভাবছিলাম, কী হবে? এত পড়াশুনা করে, ভালো হয়ে, সত্যবাদী হয়ে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে কী হবে এই দেশে?
মনে মনে বলছিলাম, তুই যে ধনে-প্রাণে মরবি রে বাবা!
চমকে উঠে, রাকেশ মুখ ফেরাল। দেওয়ালে ওর সুন্দর গ্রীবা আর মাথাভরা চুলের ছায়া পড়ল।
রাকেশ বলল, কে?
আমি। বললাম, আমি।
রাকেশ উঠে দাঁড়াল।
বলল, বাবা; কিন্তু মুখ নীচু করে রইল।
আমি বইয়ের দুই খন্ড ওর টেবিলে নামিয়ে রাখলাম। বললাম, তোর জন্যে এনেছি রে।
কেন বাবা?
রাকেশ অবাক হয়ে শুধোল। মাথা নীচু করেই।
আমার হঠাৎ মনে পড়ল এ পর্যন্ত হাতে করে আমি নিজে আমার ছেলের জন্যে কিছুই আনিনি। সময় হয়নি। মনেও হয়নি।
আমি অস্ফুটে বললাম, তুই…
তারপর গলা পরিষ্কার করে বললাম, রাকেশ, তুই-ই ঠিক বলেছিলি।
কী বাবা? রাকেশ আবারও বলল, অস্ফুটে।
সেদিন মিস্টার রায় ও আমি দু-জনেই তোর প্রতি অন্যায় করেছিলাম।
তারপর হঠাৎ আমিই বললাম, তুই আমাকে ক্ষমা করিস। আমার অন্যায় হয়েছিল রে।
রাকেশ আবারও বলল, বাবা!
আমি রাকেশের দু-কাঁধে আমার দুটি হাত রাখলাম।
ভাগ্যিস লোডশেডিং ছিল। নইলে রাকেশ দেখত আমার দু-চোখের দু-কোনায় জল চিকচিক করছে।
রাকেশ কিছু বলার আগেই বললাম, ওপরে আয়। তোর জন্যে কেক এনেছি। চকোলেট কেক। তোর মা একদিন বলেছিল, তুই ভালোবাসিস। তোর মা ও রাই আসার আগেই চল আমরা দু-জনেই এটাকে শেষ করে দিই।
রাকেশের মুখে সেদিন ডাকবাংলোয় যে হঠাৎ অপরিচিত রং লেগেছিল, তা আস্তে আস্তে ধুয়ে এল। ওর সুন্দর মুখটা মিষ্টি, সপ্রতিভ, বুদ্ধিদীপ্ত হাসিতে ভরে এল। ও বলল, তোমার-না ডায়াবেটিস।
তাতে কী? একদিন খেলে কিছু হবে না। চান করে নিচ্ছি আমি। তুই ওপরে আয়।
আসলে মা আর রাই-ও চকোলেটকেক খুব ভালোবাসে বাবা। মা আর রাই ফিরুক, তারপর একসঙ্গে খাব।
ওপরে চলে এলাম। জামাকাপড় ছাড়লাম মোমের আলোয়। নগেনকে বললাম, মোমবাতিটা নিয়ে যেতে। মোমবাতিটা নিয়ে গেলে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলাম।
এদিকটা বেশ ফাঁকা। সল্টলেকে এখনও সব জমিতে বাড়ি হয়নি। দু-দিন বাদে দোল, তাই চাঁদ উঠেছে সন্ধে হতে-না-হতেই। ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে চারদিক। আমি বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে বাইরে চেয়ে রইলাম। গেটের দু-পাশে লাগানো হাসনুহানার ঝোপ থেকে গন্ধ উড়ছে। হু-হু করে ঝড়ের মতো হাওয়া আসছিল দক্ষিণ থেকে। মনে হচ্ছিল, ধ্রুব তারাটা কাঁপছে বুঝি হাওয়ায়। বারান্দায় বসে থাকতে থাকতে বাইরের আলো-ছায়ার রাতের দিকে চেয়ে আমার মনে হল, যেদিন নার্সিং হোমে রাকেশ জন্মেছিল, সেদিন আমি শুধু ওর জন্মদাতাই ছিলাম। এতদিন, এত বছর পরে, আজ এক দুর্লভ ধ্রুব সত্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠে আমি ওর বাবা হয়ে উঠলাম।