নবীন মুহুরি
সামনে খেরোর খাতাটা খোলা ছিল। খতিয়ান। জাবদা থেকে পোস্টিং দেখছিলেন নবীন মুহুরি। রেওয়া মিলছে না।
বেলা যায় যায়। পাটগুদামের পাশের প্রেসিং-মেশিনে পাটের বেল বাঁধাই হচ্ছিল। তার একটানা আওয়াজ ভেসে আসছিল। বয়েল গাড়ির ছেড়ে দেওয়া বলদেরা পটপট করে ঘাস ছিঁড়ে খাচ্ছিল। মাঝে মাঝে ওরা জানলার পাশে বসা নবীন মুহুরির দিকে বড়ো বড়ো কান পতপত করে নেড়ে, চোখ তুলে তাকাচ্ছিল।
গোরুগুলোর চোখের দিকে, কাছ থেকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নবীন মুহুরি হঠাৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। তাঁর দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী শৈলবালার গোরুর মতো চোখ। গোরুর মতো বড়ো বড়ো বোকা বোকা বিষণ্ণ চোখ। গায়েও একটা গোরু গোরু গন্ধ।
শৈলবালার সন্তানাদি নেই। শৈলবালা বন্ধ্যা।
অন্যমনস্কতার মধ্যে নবীন মুহুরি খাতা ছেড়ে উঠলেন, চটিটা পায়ে গলালেন, তারপর নস্যির কৌটোটা হাতে নিয়ে গদিঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটিপ নস্যি আবেশে নাসারন্ধে ভরতে ভরতে উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশ এ সময়ে পরিষ্কার থাকে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে, হিমালয়ের বরফাবৃত অবয়ব দেখা যায়।
দূরের অফিসঘরে নতুন ছোকরা চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট মাথা নীচু করে কাজ করছে। কলকাতা থেকে চালান এসেছে হরিপদ দাস। হরিপদ আসা ইস্তক নবীন মুহুরির কদর যেন রাতারাতি কমে গেছে। হঠাৎই যেন নগেন সাহার কাছে এতদিনের মুহুরির সমস্ত দাম ফুরিয়ে গেছে। নগেন সাহা এখন বড়োলোক। নগেন সাহা ভুলে গেছে, যখন সে সাইকেলের পেছনে ‘মেস্তা’ ও ‘তোষা’ পাটের নমুনা নিয়ে মহাজনদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াত, সেসব দিনগুলোর কথা। অকৃতজ্ঞ, বেইমান নগেন সাহা। আজ চল্লিশ বছর চাকরির পর তাঁর মাইনে বেড়ে হয়েছে একশো সাতানব্বুই টাকা। তাতেই কথা কত! তাতেই কথার তোড়ে বিস্তর বান। ‘বুড়োহাবড়া দিয়ে চলবে না। আমার ফি-মাসে রেওয়া মিল চাই,’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
কত বাঘা বাঘা মুহুরিকে এই নবীন মুহুরি একসময় ঘোল খাইয়েছে। একটিপ নস্যি নাকে গুঁজে, কলমটা দোয়াতে একবার চুবিয়ে নিয়ে খাতা খুলে বসেই নবীন মুহুরির মাথায় যাত্রার অর্কেস্ট্রা বেজে উঠেছে। যত কঠিন সমস্যাই হোক-না কেন, এক নিমিষে তার সমাধান হয়ে গেছে।
তাই আজ এই বুড়ো বয়সে এই ছোকরার হাতে হেনস্থা আর সহ্য হয় না।
দূর থেকে হরিপদ অ্যাকাউন্টেন্টের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে নবীন মুহুরির মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। হরিপদর ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলেন।
হরিপদ ছোকরা ওস্তাদ আছে। গিয়ে পৌঁছোতেই সকলের সামনে ঝাঁঝালো গলায় বলল, কী হল? মুহুরি মশাই? এ মাসের ট্রায়াল-ব্যালান্স, মানে আপনাদের রেওয়া মিলল?
নবীন উত্তরে কিছু না বলে দুর্বোধ্য বোবা চাউনিতে হরিপদর দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, মিলবে, সবই মিলবে। এতদিন, এতবছর এত রেওয়া মিলিয়ে এলাম, আর আজ হঠাৎ না মেলার তো কারণ দেখছি না। সময় হলেই মিলবে। এখনও সময় হয়নি।
তারপর একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে নবীন বললেন, আচ্ছা দাসবাবু, ‘নাজাই’ মানে কী বলুন তো?
হরিপদ কলম থামিয়ে চশমাটা খুলে বলল, নাজাই?
—আজ্ঞে হ্যাঁ, নাজাই। দাঁতে ঠোঁট কামড়ে বললেন নবীন মুহুরি।
হরিপদ বলল, আমি বড়ো ফার্মে আর্টিকেলড ছিলাম। আপনাদের এইসব বাংলা খাতার টার্মস আমি জানব কোত্থেকে? বাঙালিদের ব্যাবসা তো দু-পয়সার ব্যাবসা।
নবীন একটু হাসলেন। কারবারিদের মধ্যেও অনেকে নড়ে-চড়ে বসল। কেউ-বা কান খাড়া করে ওঁদের কথাবার্তা শুনতে লাগল।
হরিপদ চুপ করে থাকাতে, নবীন মুহুরি বললেন, তাহলে জানেন না বলছেন?
—এ আবার জানার কী আছে? আপনি সময় নষ্ট না করে আপনার বাংলা খাতার ট্রায়ালটা মিলিয়ে ফেলুন গিয়ে। সোমবারে ধুবড়ি থেকে অডিটরেরা আসবে।
আচ্ছা। যাই। বলে, নবীন মুহুরি হরিপদর দিকে একটি অর্থপূর্ণ দৃষ্টি হেনে আবার টায়ার সোলের চটি ফটফটিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে খোলা জাবদার সামনে বসে পড়লেন।
নিকেলের সরু ফ্রেমের চশমাটা তীক্ষ্ণ নাকের সামনের দিকে অনেকটা নেমে এল। নাকের পাটা দুটো ফুলে উঠল। নবীন মুহুরি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, শালার চার্টার অ্যাকাউন্ট।
ওদিকে নবীন চলে যেতেই, ও-ঘরে কারবারিদের মধ্যে ফিসফাস শুরু হল। কেউ কেউ নীচুগলায় বলল, বাবা, নবীনবাবু কী আজকের মুহুরি! ওর সঙ্গে আজকালকার বাবুরা পারবেন?
হরিপদ, যোগা সাহাকে শুধোল, জানেন নাকি সা মশায়? ‘নাজাই’ মানে?
নাজাই মানে জানব না কেন? ‘নাজাই’ মানে অনাদায়ী টাকা, যা আর ফেরত পাওয়া যাবে না, যা খরচার খাতায় লিখে দিতে হয়।
হরিপদ বলল, ও ব্যাড ডেট?
—তাই হবে। আপনাদের ব্যাড ডেট, আমাদের নাজাই।
—হোপলেস। এ জন্যেই বাঙালিদের ব্যাবসা হয় না। কতকগুলো অথর্ব পার্ট-টাইম মুহুরি রেখেছে বরাবর, যারা নিজেদের হাতের লেখার কায়দা আর এইসব টার্মিনোলজি নিয়ে ‘অ্যাকাউন্টস’ ব্যাপারটাকে একেবারে পার্সোনাল নলেজের ইডিয়টিক লেভেলে রেখে দিয়েছে এতদিন। নতুন কিছু জানার ইচ্ছা নেই, শেখার ইচ্ছা নেই। নতুন কিছু কেউ করতে গেলেই বড়ো বড়ো পা নিয়ে তার পথজুড়ে কী করে দাঁড়াতে হয় তাই শিখেছে শুধু।
সত্যিই হোপলেস এরা।
যোগা সা বলল, তা যাই বলুন, নবীনদা আমাদের মুহুরি ভালো। কত বড়ো বড়ো খতিয়ান আর জাবদা তিনি চোখের নিমেষে যোগ করে দিয়েছেন। কত বড়ো বড়ো গুন এবং ভাগ। খাতায় হাত ছোঁয়াতেন না। মুখে আওয়াজ করতেন না। চশমার ফাঁক দিয়ে একবার দেখতেন শুধু আর সঙ্গে সঙ্গে যোগফল লিখে ফেলতেন নীচে। তখন কত কাজ ছিল, সব তো একা হাতে সামলেছেন। আমি জানি, নগেন সাহার নতুন খাতায় দশ রিম করে কাগজ লাগত। গঙ্গাধর নদী বেয়ে পাকিস্তান থেকে তখন পাট আসত। তখন কী রবরবা! নতুন খাতায় শালুর মলাট লাগত। ‘শ্রীশ্রীশ্রী গণেশায় নমঃ’ লিখে পয়লা বৈশাখ গদিঘরে নবীন যখন খাতার সামনে জোড়াসনে বসে চশমা নাকে কলম হাতে হালখাতা করতেন তখন দেখার মতো জিনিস ছিল। আপনারা হয়তো অনেক লেখাপড়া করেছেন হরিপদবাবু কিন্তু তা বলে নবীন মুহুরিকে এমন হেলাফেলা করবেন না।
—আমাকে বাবু বলবেন না। সাহেব বলবেন।
কেন? আপনার বাবা ফেলু দাস আমাদেরই হাটে বরাবর কাটা—কাপড় বেচতে আসতেন। তখন তিনি লোহার কারবারে বড়োলোক হননি। তখন তাঁকে তো আমরা বাবুই বলতাম।
—তা হোক। তিনি বাবু হলেও আমাকে বাবু বলবেন না। দাস সাহেব বলবেন।
—দাস সাহেব আবার কী? তার চেয়ে হরিপদ সাহেব ভালো শোনায়। হরিপদ সাহেব বলব?
—বেশ! তাই বলবেন।
গুড়ের হাঁড়িতে পড়া কালো নেংটি ইঁদুরের মতো চেহারা। সোনার ফ্রেমের চশমাপরা। গোলাপি টেরিলিনের শার্ট গায়ে। পচা গরমেও টাই পরে থাকা হরিপদ দাস একবার নিষ্ঠুর হাসল। ওর চোখে-মুখে একটা নিষ্ঠুরভাব ছড়িয়ে গেল। তারপর, গলা খাঁকড়ে নিয়ে বলল, আপনি জানেন না সা মশায়, আপনাদের নবীন মুহুরিদের এখন সাড়ে সাতশো টাকায় কিনতে পাওয়া যায়। মাত্র সাড়ে সাতশো টাকা!
যোগেন সা বলল, হরিপদ সাহেব, কী যে বলেন বুঝি না।
বুঝিয়ে দিচ্ছি। বলে, হরিপদ চেয়ার ছেড়ে উঠে তার পাশের আলমারিটা খুলে একটা সবুজ বাক্সর মতো জিনিস বের করল, তারপর বাক্সটা তার টেবিলের ওপর রাখল। বলল, বুঝলেন সা মশাই, এটা আজ সকালেই এসেছে। হাতে যোগ করার কোনো দরকার নেই। এ মেশিন জার্মানিতে তৈরি। বলুন দেখি, মুখে মুখেই বলুন। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকার হিসেব, আমি টক্কাটরে, টরেটক্কা আপনাকে যোগফল বলে দিচ্ছি। এর নাম ‘অ্যাডিং মেশিন’। আজকের দিনে সামনের খেরোখাতা খুলে লম্বা লম্বা যোগ করার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। খালি অ্যাডিং মেশিন কেন? আরও কতরকম মেশিন বেরিয়েছে আজকাল।
যোগেন সা হঠাৎ ভয় পেয়ে গেল হরিপদর কথা শুনে।
বলল, আপনারা কি নবীনদাকে ছাড়িয়ে দেবেন নাকি?
হরিপদ হাসল, বলল, না না, ছাড়িয়ে দেওয়া হবে কেন? এতদিনের লোক। ওঁকে রেখে দেওয়া হবে পুরোনো, অব্যবহৃত আসবাবেরই মতো। ওঁরা অ্যান্টিক হয়ে গেছেন। ‘অ্যান্টিক’। তবে ওঁকে বলে দেবেন যে, আমার সঙ্গে যেন না লাগতে আসেন। আমি জানি, আপনার যাওয়া-আসা, মেলামেশা আছে ওঁর সঙ্গে।
দুই
যোগা সা কথাটা জানাতে বিন্দুমাত্র দেরি করেনি নবীন মুহুরিকে।
নবীন মুহুরি কুঁজো হয়ে খাতার সামনে বসেছিলেন। কথাটা শুনে সোজা হয়ে বসলেন।
বললেন, বলো কী যোগেন? এই কথা বলেছে, বলেছে আমার চটি-ধুতি-চশমা আমার ফতুয়া, আমার এত বছরের সমস্ত অভিজ্ঞতার যোগফল সুদ্ধু আমার দাম সাড়ে সাতশো টাকা? যন্ত্রটা তুমি নিজে চোখে দেখেছ? সত্যিই কি কোটি কোটি টাকার যোগ-বিয়োগ গুন-ভাগ সব আজকাল চাবি টিপে হয়ে যাচ্ছে? এও কি সম্ভব?
যোগেন বলল, আপনি আর ও-ছোকরার পিছনে ফুট কাটবেন না নবীনদা। যন্ত্রটা আজব বটে। এতটুকু একটা বাক্স। আপনার মতো হাজারটা মাথার অঙ্ক কষে ফেলেছে এক নিমিষে। ওকে সমীহ করবেন একটু। হরিপদ সাহেবকে।
নবীন মুহুরির গলায় হঠাৎ রাগের ভাব এল।
বললেন, কেন? আমার চাকরি খাবে?
—না না, চাকরি খাবে না। এতদিনের লোক, সে বলেছে আপনাকে রেখে দেওয়া হবে। ছাড়ানো হবে না। আপনার চ্যাটাং চ্যাটাং কথা একটু কম বলবেন। আপনার জন্যে সত্যি আমার ভয় করছে নবীনদা।
নবীন মুহুরি এক দুর্জ্ঞেয় হাসি হাসলেন।
চেয়ার ছেড়ে উঠে, চাদরটা কাঁধে ফেলে, ছাতাটা হাতে নিয়ে বললেন, চলো, বাড়ির দিকে যাবে তো?
যোগেন সা বলল, না নবীনদা, আমি একটু হাটে যাব। চলুন হাট অবধি একসঙ্গে যাই।
নবীন মুহুরি ছাতাটা বগলে নিয়ে, চাদরটা কাঁধে ফেলে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, চলো।
সন্ধে হতে দেরি নেই। হাট প্রায় ভাঙো-ভাঙো। খড়ের গন্ধ, গোবরের গন্ধ, পাঁঠা-মুরগির গায়ের গন্ধ, বাহেদের ঘামের গন্ধ আর ধুলো আর কড়া দিশি বিড়ির উগ্র গন্ধে হাটের হাওয়া ভারী হয়ে আছে। এখন হাটের গুঞ্জরণ প্রায় ক্ষীণ হয়ে এসেছে। পথের পাশে ঘুঘু ডাকছে। বেতবনে বিদায়ী রোদ্দুর। তার গায়ে লেগেছে কুঁচফলের মতো। কৃষ্ণচূড়ার নীচে একদল চড়াই ঝাঁপাঝাঁপি করছে ।
মুখ নীচু করে নবীন মুহুরি হেঁটে চলেছেন একা একা।
সামনের বাঁকটা ঘুরেই পাঠশালাটা চোখে পড়ল নবীনের।
মাটির বারান্দাটা ধসে গেছে। এখন পাঠশালায় কেউ পড়ে না। গঞ্জের ওদিকে হায়ার সেকেণ্ডারি স্কুল হয়েছে। মাটির বারান্দায় একটা লাল কুকুর পা দিয়ে মাটি খুঁড়ে একটা গর্ত বানাচ্ছে। রাতে শোবে বলে।
কুকুরটিকে দেখেই নবীনের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে ছাতার বাঁটের এক ঘা কষালেন কুকুরটার মাথায়।
কুকুরটা কেঁউ-কেঁউ-কেঁউ-উ উ করে ল্যাজ গুটিয়ে পালাল। নবীন পাঠশালার বারান্দায় একটা খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন একটু। খুঁটিগুলো নড়বড়ে হয়ে গেছে, উই লেগেছে, জানলাগুলো খোলা। হা-হা করছে। ঘরের মধ্যে টিনের চালের নীচে চামচিকেরা বাসা বেঁধেছে।
নবীন অনেকক্ষণ একা একা পাঠশালার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন। নবীন যেন শুনতে পেলেন, পন্ডিতমশায় নামতা শেখাচ্ছেন এক উনিশ উনিশ, দুই উনিশ আটত্রিশ, তিন উনিশ সাতান্ন, চার উনিশ ছিয়াত্তর।
পাঠশালার ঘর যেন গমগম করছে পোড়োদের সম্মিলিত গলার আওয়াজে।
এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল নবীন মুহুরির। যেদিন যোগ করতে শিখেছিলেন, যেদিন প্রথম ধারাপাত মুখস্থ করেছিলেন, যেদিন পড়েছিলেন শুভঙ্করের আর্যা, সেসব দিনের কথা।
ভাবতে ভাবতে নবীন মুহুরি কেমন আনমনা হয়ে পড়লেন।
হুঁশ হল যখন একটা শেয়াল পাঠশালার পাশ দিয়ে দৌড়ে গেল নদীর দিকে।
বারান্দা থেকে নেমে আবার বাড়িমুখো হাঁটতে লাগলেন। চতুর্দশীর চাঁদ উঠে গেছে। ঝিঁঝি ডাকছিল পাতায় পাতায়। আমবাগানে জোনাকির ঝাঁক প্রথম জ্যোৎস্নায় জ্বলছে-নিবছে। হাঁটতে হাঁটতে নবীন মুহুরির মনে পড়ল, হরিপদ দাস বলেছে, তাঁকে রেখে দেওয়া হবে। তিনি পুরোনো লোক। পুরোনো হাতল-ভাঙা চেয়ারের মতো, চাবি হারিয়ে যাওয়া পুরোনো সিন্দুকের মতো, তাঁর সব প্রয়োজনীয়তাই ফুরিয়ে গেছে, তবু তাকে দয়াপরবশে রেখে দেওয়া হবে।
নিজের মনে একবার হাসলেন নবীন।
বাড়ি পৌঁছোতেই শৈলবালা বললেন, শরীর খারাপ?
নবীন বললেন, না।
তিন
সেরাতে নবীন মুহুরি একেবারেই ঘুমোতে পারলেন না। সারারাত মাথার মধ্যে সেই অদেখা সবুজ মেশিনের টক্কাটরে-টরেটক্কা শব্দ শুনতে লাগলেন। সেই অদেখা ছোটো সবুজ যন্ত্রটা নবীন মুহুরির সমস্ত জীবনের গর্ব একেবারে ধূলিসাৎ করে দিল।
খাটের ওপরে জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছিল। শৈলবালা নবীনের পাশে শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। শৈল বন্ধ্যা। তার বুকে চাপা কষ্ট। শৈলর মুখের ওপর চাঁদের আলো এসে পড়েছে। বাইরের মাঠে বনতুলসী ঝোপের কাছে রাতচরা পাখিটা চিরিপ চিরিপ চিরিপ করে জ্যোৎস্নায় ভেসে বেড়াচ্ছে।
শৈলবালার ঘুমন্ত মুখের দিকে কাছ থেকে চাইলেন নবীন মুহুরি। হঠাৎ তার মনে হল, এতদিন যেন তিনি ছোটোবউয়ের বুকের কষ্টটা কখনো বুঝতে পারেননি, আজ এই নির্জন নিঝুম রাতে ছোটোবউয়ের কষ্টটা এসে এই প্রথম নবীন মুহুরির বুকে বাসা বাঁধল।
নিজের মধ্যে নিজে নি:শেষে ফুরিয়ে গেলে কেমন লাগে, জানলেন।
নবীন মুহুরি অনেকক্ষণ খাটের ওপর জোড়াসনে বসে বাইরের জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাতে চেয়ে রইলেন। বসে বসে ঝিঁঝিদের ‘ঝিঁঝির-ঝিঁঝির’ একটানা সুর শুনতে লাগলেন। নবীন মুহুরির মনে হল, রাতের ঝিঁঝিরা যেন পৃথিবীতে এই শেষবারের মতো শুভঙ্করের আর্যা মুখস্থ বলছে। শেষবারের মতো তাঁকে ছোটোবেলার সব নামতা শোনাচ্ছে।
ধীরে ধীরে খাট থেকে নেমে, জানলায় এসে দাঁড়ালেন। এই জানলাতে দাঁড়িয়ে অন্ধকার রাতেও হিমালয়ের সাদা উত্তুঙ্গ মাথাগুলো দেখা যায়। আশ্চর্য! আজ এই জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাতে নবীন মুহুরি ভালো করে তাকিয়েও কিছুতেই হিমালয়কে দেখতে পেলেন না।
নবীন ভাবলেন, হিমালয় খুব বড়ো হয়ে গেছে বলে বোধ হয় কোনো হরিপদ দাস তাঁকেও নাজাই খাতে লিখে দিয়েছে।