ব্যাংডাকির মেয়ে
কীহল অরোরা? আমার রেসিডেন্সের ফোনের লাইন পাওয়া গেল না এখনও? একটু উষ্মার সঙ্গেই বলল শ্রাবণ।
অরোরা ঘাবড়ে গিয়ে টেলিফোন অপারেটর মিস মালপানিকে রাগের গলায় বলল, সংগীতা রায় সাহাবকো রেসিডেন্সকা লাইন কি ক্যা হুয়া?
—আই অ্যাম ট্রাইং স্যার।
—হোয়াট ট্রাইং? গেট ইট বাই অল মিনস গেট ইট অন ডিম্যাণ্ড অর লাইকিং।
—তুমহারা দেল্লি, কলকাত্তাকি বরাবর হো গায়ি। টেলিফোনকি বারেমে।
শ্রাবণ বলল।
—নেহি সাব। মিল তো যাতা লাইন। ইয়ে সংগীতাকি বদনসিবি।
এবারে ফোনটা বাজল।
অরোরা রিসিভার তুলেই বলল, লিজিয়ে সাব। মিলা।
—হ্যালো। কে?
—আমি। ভাতি।
—বাড়িতে আর কেউ নেই?
—বাড়িতে আর কেউই নাই!
—শ্যাম কোথায়?
—শ্যাম কাইল চইল্যা গেছেগিয়া। বউদি চইল্যা যাইতে কইছিল।
—কেন?
—আমার সাথে খুবই ঝগড়া করতাছিল। জলের বোতল নিয়া মারতে আইছিল আমারে। ডাকাইত একডা! বুড়া, তায় আবার কলপ কইর্যা হিরো বনবার চায়!
—থাক ওসব কথা। বউদি কোথায়?
—বউদি বাইরাইছে। কইতাছিল বুনের বাড়ি যাইব।
—বুনটা কে?
—আঃ। বুইন।
—কী যে বলিস তুই!
—আরে! চাঁপাদিদি। বুন না?
—ও চাঁপা। বোন বলবি তো। কী বুন-বুইন করছিস! বউদি এলে বলিস যে, ফোন করেছিলাম।
—তুমি আসবা কবে দিল্লি থিক্যা?
শনিবার। বলে দিস। ছোটোদাদাবাবু আর বউদি কোথায়?
—ও মা! অফিসে আর স্কুলে। জানো না য্যান তুমি?
—জানি।
—আর কী কইবা, কও।
—তোরা সকলে ভালো আছিস তো?
—হ।
—বউদিকে বলিস। ওদেরও।
—শনিবার কখন আসবা?
—দুপুরে।
—কী মাছ খাবা কও। বউদিরে কমু। ভালো কইর্যা রাইধ্যা রাখুম।
—যা খুশি।
—কও-না। না জাইন্যা নিলে বউদি আবার রাগ করব। বাড়িতে তো খাও না কত্তদিন।
—ঠিক আছে, ছাড়ছি। বলে দিস ফোন করেছিলাম।
বলেই, শ্রাবণ ফোনটা ছেড়ে দিল।
—ইজ ইট ওভার স্যার?
মিস মালপানি শুধোলেন।
—ইয়েস। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।
ফোন ছেড়ে দিয়েই ওর চিন্তা হচ্ছিল। ভাতি, ওদের বাড়ির রান্নার মেয়েটি ন-তলার মালহোত্রার ফ্ল্যাটের চাকর পাঁচুর সঙ্গে প্রেম করছে। উনিশ-কুড়ি বছরের মেয়ে। সুযোগ পেলেই সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে চলে যায়। কখন যে কী ঘটে যাবে!
যূথী বলেছিল, আজকাল অল্পবয়সি কাজের মেয়ে ফ্ল্যাটবাড়িতে রাখার অনেকই নাকি বিপদ। তা ছাড়া, একদল নাকি বাবুদের ব্ল্যাকমেইল করতেই আসে। নিজের প্রেমিকের বা স্বামীর সঙ্গে শুয়ে প্রেগন্যান্ট হয়ে, বাবুদের নামে দোষ চাপিয়ে টাকা আদায় করে, স্ক্যাণ্ডাল রটানোর ভয় দেখিয়ে।
বন্ধ জানলার কাচ দিয়ে বাইরে চেয়ে দেখল শ্রাবণ। আঁধি বইছে দুপুরের দিল্লির বুকে। ঘোড়দৌড়ের দলবদ্ধ মেটে-লালরঙা ঘোড়াদের মতো হু-হু করে দৌড়ে যাচ্ছে মেটেরঙা ধুলো তাড়িয়ে দিয়ে হাওয়াটা। তারপর আকাশ, গাছপালা সব লাল ধুলোর মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে।
ভাতি বাড়িতে একলা আছে একথাটা ভেবেই আতঙ্ক উপস্থিত হল শ্রাবণের। শ্যামটা অনেকই পুরোনো লোক ছিল। কিন্তু যতই পুরোনো হচ্ছে ততই ছিঁচকে চোর আর লোভী হচ্ছে। তা ছাড়া প্রচন্ড চিৎকার চেঁচামেচিও করে। চরম উক্ত্যক্ত হয়েই হয়তো ছাড়িয়ে দিয়েছে যূথী।
কিন্তু…
দুই
দিল্লি থেকে কলকাতায় আসার সকালের ফ্লাইটটা দশটা দশ-এ। কিন্তু ছাড়ল এক ঘণ্টা দেরিতে। দমদমে নামল সাড়ে বারোটা নাগাদ।
লিফটে উঠে ফ্ল্যাটের দরজাতে পৌঁছেই কলিংবেল টিপে টিপে হাত ব্যথা হয়ে গেল কিন্তু কেউই খুলল না। বিরক্ত, ক্রুদ্ধ এবং অবাক হয়ে পাশের ফ্ল্যাটে খোঁজ নেবে কি না ভাবছে এমন সময় একমুখ হেসে দরজা খুলল ভাতি।
রাগের গলায় শ্রাবণ বলল, ছিলি কোথায়?
—আর কন ক্যান দাদা? একটা পাগল কোকিল কাল রাত থিক্যা এমনই ডাকতাছে যে কী কমু!
—কোকিল?
আকাশ থেকে পড়ে বলল শ্রাবণ। এগারোতলার ফ্ল্যাটে কোকিল!
—হ্যাঁ। কোকিলের ডাক, গাছে গাছে নতুন চিকন পাতা। রোদ পইড়া কী দারুণ চমকাইতেছে তারা। বারান্দায় দাঁড়াইয়াছিলাম আর ওই বাঁ-দিকের ভাঙা বাড়িটায় একটা কাঞ্চন গাছ আছে, দ্যাখছ দাদাবাবু? কী ফুলই-না ফুটছে! আইসো আইসো, দেইখ্যা যাও একবার!
হাতের ওভারনাইটারটা নামিয়ে রেখে শ্রাবণ ওর কথাতে ওর সঙ্গে হেঁটে গিয়ে বারান্দাতে দাঁড়াল। ওরই ঘরের বারান্দাতে। কলকাতায় এগারো-তলা ফ্ল্যাটবাড়িতে থেকে, সারাদিন কী কলকাতা, কী দিল্লি, কী বোম্বে সবসময়ই এয়ার-কণ্ডিশনড অফিসে কাজ করে, কোকিল, গাছেদের নতুন কচি কলাপাতারঙা পাতা, আর কাঞ্চন ফুলের জগৎ যে এখনও আছে তা সে ভুলেই বসেছিল। বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে ভাতিকে বকতেই ভুলে গেল। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দুপুর একটার সময় আবহাওয়া বদলে-যাওয়া পৃথিবীর এককোণে এগারো তলার বারান্দাতে দাঁড়িয়ে ভাতির চোখ দিয়ে কলকাতারই এই অঞ্চলকে সে একেবারে নতুন চোখে দেখল।
বারান্দায় এসে দাঁড়ালে সত্যিই তো ভেতরের কোনো শব্দই কানে আসে না! মনের বারান্দাতে দাঁড়ানোরই মতো। কলিংবেল-এর আওয়াজ না-শোনাতে ভাতির কোনো দোষ ছিল না সেকথাও বুঝল।
—ওই দ্যাখো। দ্যাখছ? কী ফুলই-না আইছে কাঞ্চন গাছটায়!
—হুঁ।
বলল, শ্রাবণ।
তারপরই ভাবল, ফুলের গাছ নিয়ে ভাতির সঙ্গে কাব্য করেছে জানলে যূথী ভীষণ রেগে যাবে। পুরুষ হয়ে জন্মেছে। ষোলো বছরের বেশিবয়সি নারীমাত্রকেই লোডেড রিভলবারের মতো হ্যাণ্ডল করতে হয় যে, তা-ও শিখেছে। বড়ো বিপদ!
—চান করবা না?
—করব। বউদি কোথায়?
—নি মার্কেটে।
নিউ মার্কেট। বুঝল শ্রাবণ।
—কখন আসবে?
—আইস্যা যাইবেন। খাবার কি গরম করুম?
—না। বউদি আসুক। আমি চান করতে যাচ্ছি বউদি বেল দিলে খুলিস যেন—আমি তো দশ মিনিট দাঁড়িয়েছিলাম।
—খুলুম, খুলুম। বসন্তকাল আইল তো! সেই লগ্যে তো! মনটা হুড়দুম-দুরগুম করে।
চান করতে করতে শ্রাবণ ভাবছিল, ভাতি যে চোখ দিয়ে এই পৃথিবীকে দেখে বা শোনে, সেই চোখ দিয়ে ও কেন দেখতে পারে না! শহরে শহরে ঘুরে, জীবিকার ঘানিতে নিরুপায়ভাবে জুড়ে গিয়ে ওর মনের মধ্যের অনেক ভালো জিনিসই মরে গেছে। নষ্ট হয়েছে কিছু অঙ্কুর; কিছু বীজ। যেসব বীজ আর কোনোদিনও অঙ্কুরিত হবে না।
ভাতিদের বাড়ি কোচবিহারে। শহরে নয়, গ্রামে। ওর নাকি মা-বাবা কেউই নেই। দাদারা আছে। কিন্তু বউদিরা একদিন খারাপ ব্যবহার করাতে ও বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসে। শ্রাবণের বেকার খুড়তুতো ভাই কমলের শ্বশুরবাড়ি কোচবিহারে। কাজের লোকজনের বড়ো অসুবিধা একথা যূথীর কাছে শুনেছিল কমল। শ্বশুরবাড়ি থেকে আসার সময় সোজা স্টেশন থেকে নেমে ভাতিকে এক রবিবারের দুপুরে শ্রাবণদের বাড়িতে তুলে দিয়ে চলে যায়। তারপরই কমল চাকরি পেয়ে চলে যায় পারাদ্বীপে।
শ্রাবণ খুব রাগ করেছিল, কমলের কাছ থেকে যূথী ভাতির দেশের বাড়ির ঠিকানাও রাখেনি বলে। কমলকে চিঠি লেখা হয়েছে পারাদ্বীপে। কিন্তু উত্তর আসেনি। কমলের বউ ধানি বলেছে, তেমন কিছু হলে ওকে জানালেই হবে। কুচবিহারে ভাতিকে পৌঁছে দেবার লোকের অভাব হবে না। কিন্তু শ্রাবণ চিন্তায় মরে যায়। যদি কিছু ঘটে যায়।
যূথীর সঙ্গে মনোমালিন্য হলে, টি.ভি. দেখতে না দিলে; ভাতি এমন জংলি পশুর মতো রেগে ওঠে যে, ভয় হয় কোনদিন-না দশ-তলার বারান্দা থেকে লাফিয়েই পড়ে। পাঁচুর সঙ্গে প্রেমটাও ওর পাশবিক। তোরসা নদীর গন্ধ এখনও ভাতির গায়ে লেগে আছে। তোরসারই মতো ওর চালচলন। ব্যাংডাকি জঙ্গলের কটুগন্ধি ফুলেরা ওর মস্তিষ্ক প্রভাবিত করে রেখেছে। পুরোপুরিই জংলি মেয়ে এই ভাতি। এই মালটিস্টোরিড বাড়ির ছোট্ট ফ্ল্যাটের সীমার মধ্যে ওর দম বন্ধ হয়ে আসে। বুঝতে পারে শ্রাবণ। গ্রামবাংলার ছেলে ও। ওরও প্রথম প্রথম দম বন্ধ হয়ে আসত। কিন্তু যূথী কলকাতার মেয়ে। এসব কথা ও বোঝে না। যারা গ্রাম দেখেনি, গ্রামে থাকেনি, তাদের এসব কথা বলাও মিছিমিছি। দিগন্তমেলা আকাশ, তোরসার বান, ব্যাংডাকি জঙ্গলের আলোছায়ার, গাছপালার গভীর রহস্য ভাতির চোখের মণিতে যেন মালটিকালারড বৈদ্যুতিক বালব-এর মতো খেলা করে। বুঝতে পারে শ্রাবণ। কিন্তু ও একা। ওই প্রবলযৌবনা বাড়ন্ত গড়নের জংলি মেয়েকে, তার চাপল্য ও দুঃখকে বোঝে, এমন আর কেউ এই ফ্ল্যাটে ছিল না।
তাই ভারি ভয় করে ভাতির জন্যে।
যূথী অনেক দিন বুঝিয়েছে ওকে। ফ্ল্যাটবাড়িতে পঞ্চাশটি ফ্ল্যাট। কতরকম লোক বাস করে এই ফ্ল্যাটে। তোর মতো অল্পবয়সি মেয়েদের পক্ষে নষ্ট হয়ে যাওয়াটা কোনো ব্যাপারই নয়। তারপর কোনো নরকে নিয়ে গিয়ে তুলবে তোকে। তখন আমাদের দোষ দিস না।
ভাতি রাগে বেড়ালনির মতো ফুলে ওঠে এসব কথা শুনল। বলে, ইসস। অত্ত সোজা। চুল ছিঁইড়া দিমু না। নাক কামড়াইয়া দিমু।
যূথী হতাশ হয়ে দু-হাতের পাতা উপরে তুলে, মেলে, কিছু বলতে চায় ওকে, এই মহানগরীর ভয়াবহতা সম্বন্ধে বোঝাতে চায়; কিন্তু নিরুপায়ে চেয়ে থাকে ওর মুখের দিকে।
চান সেরে উঠে শ্রাবণ বলল, খাবার লাগা ভাতি। দিতে দিতে বউদি এসে যাবে।
—ওমা! দাঁড়াও। আমি চান কইরা লই। এক মিনিট।
এই চান করা নিয়েও অনেকই সমস্যা।
সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের যে বাথরুম, তার দরজাতে অনেক ফুটো। নীচটাও ফাঁকা। বিহারি, উত্তরপ্রদেশীয় হিন্দু, কাজের লোকেরা ও দক্ষিণ বাংলার কিছু নানা পেশার মুসলমানের বাস এইসব সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে। অনেকের আত্মীয়স্বজনও এসে থাকে। প্রতিতলার মেজানিন ফ্লোরে ওদের কোয়ার্টার। প্রথম দিন ভাতি চান করতে গিয়ে কেঁদে ফিরে এসে বলেছিল, মেলা চোখ। দরজার ফুটার মধ্য দিয়া চক্ষুগুলান আমারে গিল্যা ফ্যালাইতে চায়। বাঁদর কতগুলান।
তারপর থেকে যূথী বলেছিল, রান্নাঘরের লাগোয়া কাভারড বারান্দাতে চান করতে।
প্রথম দিনই ভাতি রান্নাঘরের লাগোয়া বারান্দা ভেতর থেকে বন্ধ করে চান করে এসে বলল, সামনের আর পাশের বাড়ির দারোয়ানগুলা আমারে হাতছানি দিয়া ডাকতাছিল বউদি। আমিও লাথথি দেখাইয়া দিছি!
—করিস কী ভাতি?
যূথী বলেছিল! আতঙ্কিত গলায়।
—তা, এতদূর থিক্যা আর কী করুম? কাছে পাইলে তো কান কামড়াইয়া ছিঁড়্যা থুইতামনে।
যূথী বারান্দাটা এখন কাচ দিয়ে পুরো ঢেকে দিয়েছে ওর চানের জন্যে। যাতে আব্রু রক্ষা হয়।
কিছুক্ষণ পর ভাতি চান করে এল। শ্রাবণ ‘দেশ’-এর পাতা উলটোচ্ছিল বসবার ঘরে বসে বসে।
একটা কচি কলাপাতারঙা সস্তা পুরোনো তাঁতের শাড়ি পরেছে ভাতি। তেল দিয়েছে মাথায়। যত্ন করে চুল আঁচড়েছে। মুগ্ধ চোখে তাকাল শ্রাবণ। এ মুগ্ধতা প্রেমের মুগ্ধতা নয়, কামের মুগ্ধতাও নয়। মুগ্ধতার অনেক রকম হয়!
ভাতি শ্রাবণের চোখ পড়ে বলল, কী? বলবা কিছু বুঝি আমারে?
—না:।
—তবে? তাকাইয়া আছো ক্যান?
শ্রাবণ হেসে বলল, এমনিই!
এই হীন, কুচক্রী, নীচ, কংক্রিটের জঙ্গলের মধ্যে ভাতি শ্রাবণদের জন্যে এক দারুণ পৃথিবী নিয়ে এসে এই এগারো-তলার ছোট্ট ফ্ল্যাটে ছেড়ে দিয়েছে। ফ্ল্যাটের মধ্যে দিয়ে তোরসা বয়ে যাচ্ছে। দূরের রায়ডাক আর তিস্তার গন্ধ আসছে নাকে। কাঞ্চন ফুলের নরম বেগুনি আলো আর কোকিলের ডাক, ব্যাংডাকি জঙ্গলের অপার সব রংবেরঙা-রহস্য বন্দি হয়েছে এখানে ভাতিরই কল্যাণে। শ্রাবণ একথা জেনে খুবই কৃতজ্ঞ বোধ করে। তাই….
—দিমু খাবার?
—দাঁড়া।
—তাইলে আমি বারান্দায় যাই? কোকিলে ডাক শুনি গিয়া?
—যা।
—দরজাটা খুইল্যা দিয়ো বউদি আইলে, নইলে আমি বকা খামু।
—দেব।
ভাতি বসবার ঘরে কচি কলাপাতারং ছড়িয়ে ওর চুলের তেলের গন্ধ উড়িয়ে বারান্দায় চলে গেল।
যূথী এবং শ্রাবণের ছোটোভাই ভাদ্রর স্ত্রী জিনি, মাথায় কখনোই কোনো তেল দেয় না। শ্যাম্পু করার দিন ছাড়া। সিঁদুর পরে না সিঁথিতে। ভাতি এই ফ্ল্যাটের জীবনে এক অন্য জীবনকে মিশিয়ে দিয়েছে। সেই মিশ্রণ ক্রমশই ঘন হচ্ছে। শ্রাবণ বুঝতে পারে। শ্রাবণ ভাবে, কোনোদিন একটি কাঞ্চন ফুলের গাছের জন্য, কাঞ্চন ফুলের জন্যে; ওদের এই মেকি অভ্যেসের জীবনে, ক্লান্তিকর জীবনে, ভাঙন না-ধরে যায়! আস্ত ব্যাংডাকি জঙ্গলটাই উঠে এসে বসতে পারে ফ্ল্যাটের মধ্যে কোনোদিন। তোরসা নদীর জলও বয়ে যেতে পারে।
শ্রাবণ একথাটা মনে করেই ভীত হয়ে ওঠে।
যূথী আর জিনি ভাতিকে ‘বাঙাল’ বলে খ্যাপায়।
ভাতিকে ওরা আণ্ডার এস্টিমেট করছে। ভাতিকে এখান থেকে তাড়াতে হবে এমন কথা যূথী আর জিনি প্রায়ই বলে।
মেয়েরা তাদের ঘরের মধ্যে তাদের মনোনীত গন্ধ ছাড়া অন্য কোনো গন্ধই পছন্দ করে না। তাদের যুক্তি মানে না শ্রাবণ। কিন্তু তা নিয়ে কিছু বলেও না। ভাতি সত্যিই হয়তো চলে যাবে কোনোদিন। যূথী আর জিনিই ছাড়িয়ে দেবে। তাড়িয়ে দেবে। তখন এই ফ্ল্যাটে কোকিলের ডাক, কাঞ্চন ফুলের শোভা, তোরসার জলের গন্ধ আর ব্যাংডাকি জঙ্গলের মিশ্র শব্দ; বনজ্যোৎস্নার আর সবুজ অন্ধকারের আভাস কিছুই আর থাকবে না।
শ্রাবণ জানে, ভাতিকে ওরা শিগগিরই ছাড়িয়ে দেবে। পাঁচুর সঙ্গে প্রেম করছে বলে নয়। সম্পূর্ণ অন্য এক মেয়েলি কারণে।
ভাতি বলল; খাবা, আইসো!
শ্রাবণ বলল, হুঁ।