ফটকে
ফটকে সারারাত আলা পাহারা দিয়েছিল। এই আলায়, এই ভেড়িতে, মাঝে মাঝেই সড়কি, পাইপগান নিয়ে মাছ চুরি করতে আসে কারা যেন।
একটা বুড়ো কাক কচুরিপানার নালার পাশে নলবনের গভীরে এই সাতসকালে কী করতে যেন নেমেছিল, ফটকেকে আসতে দেখেই সে সপ সপ করে হাওয়া কেটে বড়ো বড়ো ডানা মেলে ঘোষেদের আলার দিকে উড়ে গেল।
লম্বা গলা কাকটা যেখানে বসে ছিল তার পাশেই আলার লোকেদের পুঁতে-রাখা বাঁশের ওপরে একটা পুরোনো পানকৌড়ি চুপ করে বসেছিল পুবে পিঠ দিয়ে, যাতে রোদ পোয়াতে পারে। ও চোখটা বন্ধ করে বসেছিল। ফটকের রাহান-সাহান, খাল-খরিয়ত সব ওর জানা! তাই তার বংশরূঢ় আসনের বেশ কাছে ফটকের উপস্থিতি সত্ত্বেও কোনোরকম উত্তেজনা না দেখিয়ে ও চুপ করে বসে রইল। ও জানে যে ফটকে ওর কোনো ক্ষতি করবে না।
আলার ঘরের পাশে, একটা বাতাবিলেবুর গাছের নীচে নরম ঝুরঝুরে মাটিতে, পুবদিকে মুখ করে ফটকে শুয়ে পড়ল সামনে পা দুটো বুকের নীচে গুটিয়ে। ল্যাজটা পাকিয়ে।
কাল রাতে বড়ো শীত ছিল। আবাদের ওপর দিয়ে যেন উত্তুরে হাওয়ার ঝড় বয়ে গেছে। আলার লোকেরা সকলেই দক্ষিণের, তাই বোধ হয় উত্তুরে হাওয়ার সঙ্গে এদের কারও বনিবনা নেই।
ফটকে নিজে কোথাকার তা নিয়ে ফটকে কখনো মাথা ঘামায়নি। ফটকে এখানের, এই মাটির, এই জলের। ফটকের বলবার মতো কোনো জন্মবৃত্তান্ত নেই। বাবুদের আলার মদ্দা কুকুরের সঙ্গে ঘোষেদের আলার ছিপছিপে ছাইরঙা মাদি কুকুরের দেখা হয়ে গেছিল। এই আলা, এই হোগলা, নল, কচুরিপানা, এই ঢোঁড়া সাপ, পানকৌড়ি, কামপাখির গায়ের গন্ধ তাই মাখামাখি হয়ে আছে ফটকের গায়ে। মাঝে মাঝে ফটকের মনে হয় ওর গায়ে লোম না থেকে আঁশ থাকা উচিত ছিল, তাহলে ও জলের তলায় চলে গিয়ে ফাতনা নেড়ে পানার গুঁতো মেরে মেরে ঠুকরে খেয়ে বেঁচে থাকত নিজের স্বাধীনতায়।
কিন্তু ফটকেকে এ-জন্মে নিজের খাবারের জন্য চিরদিনই পরের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। পরের এঁটো খেয়েই সে বড়ো হয়ে উঠেছে। যতদিন বেঁচে থাকবে, খেতে হবে। মাঝে মাঝে ফটকের বড়ো খারাপ লাগে, বুকের মধ্যেটা যেন কেমন কেমন করে। কিন্তু ফটকে কী করবে? ফটকে কী করতে পারে? যখন ওর বুকে এমনি কষ্ট হয় তখন সামনে দু-পা লম্বা করে দিয়ে তার ওপর মুখ নামিয়ে সে নিজে শুয়ে থাকে বাবুদের ঘরের বারান্দায়। মাঝে মাঝে তার বুক থেকে জোর দীর্ঘশ্বাস বেরোয়। ফটকে সেই শ্বাসকে বুকের মধ্যে রাখতে চায়, কিন্তু বাঁধ-ভাঙা নোনা জলের মতো সে-শ্বাস বেরিয়ে আসে। নাকের সামনে থেকে একটু ধুলো উড়ে যায়, শুধু দুটো মাছি উড়ে যায়। এ ছাড়া ফটকের দীর্ঘশ্বাসে আর কারও কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না।
কামপাখিগুলো কচুরিপানার গালের মধ্যে কাঁকড়া-কাঁকড়ি করছে। কঁকা-কঁকা-কঁকা আওয়াজ এই সকালের জলের ওপরে যে একটা আশ্চর্য ঠাণ্ডা শান্তি থাকে, তাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। একটা সাপ উলটোদিকের নল ঝোপ থেকে বেরিয়ে জলের ওপর দিয়ে সোজা সাঁতরে আসছে এ পাড়ের দিকে। সাপটা জল- কেউটে, সাপটার পুরো শরীরটাই প্রায় জলের ওপর ভেসে আছে। গায়ের সাদা বুটি দেখা যাচ্ছে, সাপের মাথাটা নিস্তরঙ্গ আয়নার মতো জলের ক্যানভাসকে ছুরির ফলার মতো কেটে দু-ভাগ করে দিয়েছে। জলের মধ্যে একটা মস্ত বড়ো ত্রিকোণ জেগে উঠেছে। ক্ষুদে টেউয়ের। আর সেই ত্রিকোণের সামনে তিরের ফলার মতো সাপের মুখটা এগিয়ে আসছে।
ফটকে চোখ মেলে একবার দেখল, তারপর সূর্যকে মনে মনে গালাগাল করল এখনও ওঠেনি বলে।
আলার বাবুদের যে রান্নাবান্না করে সেই লোকটা হাঁসের ঘর খুলে দিল। হাঁসগুলো মোটা গোলগাল কোমর দুলিয়ে প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে জলের দিকে দৌড়ে চলল, কমলা ঠোঁট, আর কমলা রঙা পা ফেলে। চারটে বাচ্চা দিয়েছে হাঁসিরা। গোলগাল তুলতুলে উলের বলের মতো হলুদ আর নরম। ফটকের মাঝে মাঝে ভারি লোভ হয় যে, গোটা দুই বাচ্চা এক ঝটকায় ধরে মুখে করে নিয়ে গিয়ে ভর দুককুরে হোগলার ছায়ায় বসে খায়। কিন্তু সাহস হয় না ফটকের। সারাদিন না খেয়ে থাকলেও সাহস হয় না। কারণ ঘরের মধ্যে বেত আছে, লাঠি আছে, সড়কি আছে। হাঁসের বাচ্চা খাওয়ার যে আনন্দ তার সবটাই মাটি হবে। বলা যায় না—বাবুরা শুনতে পেলে হয়তো তাকে গাড়ির পেছনে করে নিয়ে কোনো না কোনো ভিন দেশে ছেড়ে দেবে। এখানে তবু তো ফটকে বেঁচে আছে, সেখানে গেলে হয়তো মরেই যাবে।
শুয়ে শুয়ে ফটকে ভাবছিল যে, কয়েক বছর আগে এখানে কীসব হয়েছিল। অনেক লোক একসঙ্গে এসে বাবুদের ঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল, বাগানের সব ফুল ছিঁড়ে ফেলেছিল, গোরুগুলো খুলে নিয়ে গেছিল। নিয়ে গেছিল নৌকাগুলো, ভেড়ির সব মাছ ধরে ফেলেছিল দু-তিন দিনের মধ্যে। অত মাছ কেউ খেতে পারেনি, অত অল্প সময়ের মধ্যে কোথাওই বিক্রি হয়নি। মাছের পাহাড় পচে গিয়েছিল চতুর্দিকে। চিলেরা খুব খেয়েছিল, ফটকেও খুব খেয়েছিল দু-দিন। ফটকের গায়ে তখন মাছের গন্ধ হয়ে গেছিল। মাইলের পর মাইল জুড়ে পচা মাছের গন্ধ ভেসেছিল হাওয়ায়। ফটকের খুব মনে পড়ে সে সময়ের কথা।
ফটকের তখন মনে হয়েছিল যে, এ লোকগুলো ভালো, এরা ফটকের বাবুদের মতো না। ফটকেকে অনেক খাইয়েছিল লোকগুলো দু-দিন। কিন্তু দু-দিন পরই লোকগুলো বাবুদের মতো হয়ে গেছিল। সব ভালোবাসা উবে গেছিল। ফটকে কাছে গেলেই ক্যাঁক করে লাথি মারত তারা। তাদের খাওয়ার সময় কাছে ঘুর-ঘুর করলেই জুঁতো ছুড়ে মারত। ফটকের তখন খুব মনে হয়েছিল, এই বাদার আগের বাবুরা আর পরের বাবুরা সকলেই সমান। ওই ঘরে এলেই ওই তক্তপোশে বসলেই সবাই একরকম হয়ে যায়। ফটকের কথা বা ফটকেদের কথা এই বাবুরা ওই বাবুরা কেউই ভাবে না, ভাবেনি কোনোদিন, হয়তো ভাববেও না।
সূর্যটা এখনও ওঠেনি। ফটকের পেটে বড়ো খিদে, ফটকের গায়ে বড়ো শীত। কখন বাবুদের সকালের জলখাবার রুটি আর তরকারি তৈরি হবে, ফটকে জানে না।
বাবুদের খাওয়া হয়ে গেলে আধখানা রুটি পাবে ফটকে।
ফটকে সূর্যের ভরসায়, বাবুদের দয়ার ভরসায় বেঁচে আছে। এই শীতের মধ্যে, আলোর মধ্যে, এই অন্ধকার জলার মধ্যে।
ফটকে কি বেঁচে আছে?
ফটকে ভাবে।
পুবের দিকে মুখ করে চুপ করে শুয়ে নাকে বাদার গন্ধ পায় ফটকে, ওর নেতিয়ে পড়া কানে কামপাখির কোঁকানি শোনে, আর ভাবে, ফটকে ভাবে, সূর্য কি উঠবে?
সূর্য কি সত্যিই উঠবে?