‘জে’ ফর জেলাসি
দেরিটা নেরুলকারের সঙ্গে মিটিং-এর জন্যেই হল। বৃষ্টিও আর একটা কারণ।
গৌতম গাড়ি থেকে নেমে রেবেলোকে দশটা টাকা বকশিশ দিল, তারপর ওভারনাইট ব্যাগটা নিয়ে দৌড়ে ঢুকল সান্টাক্রুজ এয়ারপোর্টের ভেতরে। একে চান্স-টিকিট তায় এত দেরি। এই ফ্লাইটে যদি যেতে না পারে তা হলে মিষ্টির কাছে মুখ দেখাতে পারবে না। পিয়া বলবে মুখবিকৃত করে, বাবা হওয়ার কী দরকার ছিল তোমার?
চান্স টিকিট-হোল্ডারদের যখন ডাক পড়ে কাউন্টার থেকে তখন এমনই হুড়োহুড়ি আর ধাক্কাধাক্কি লেগে যায় যে, বিচ্ছিরি লাগে। দূরপাল্লার আনরিজার্ভড সেকেণ্ড ক্লাসে ওঠার জন্যে হাওড়া স্টেশনে মজঃফরপুর অথবা কাটিহারের যাত্রীরা যেমন ধস্তাধস্তি করেন, যেন তেমনই অবস্থা। সুটেড-বুটেড হলে কী হয়, প্রকৃত ভদ্রলোক আর এদেশে দেখাই যায় না বোধ হয়। মানসিকতায় সকলেই সমান। এই ব্যাপাটা ওর রুচিতে বড়ো লাগে বলেই গৌতম চান্স-টিকিট নিয়ে এয়ারপোর্টে আসতেই চায় না।
স্টিফেন বলেওছিল যে, ‘থেকে যাও আমার বাড়িতে, আজকে ছোট্ট পার্টি আছে। স্মিতা পাতিল আর নাসিরুদ্দিন শাহকেও বলেছি। কাল সকালেই যেয়ো।’ কিন্তু মেয়েটার জন্মদিনের জন্যেই আজই ফিরতে চেয়েছিল গৌতম। পরশু এসেই শ্রীধরনকে বলেও দিয়েছিল ফেরার টিকিটের কথা। সেও গা না-করে আজ সকালেই মাত্র ট্র্যাভেল এজেন্টকে বলেছে। ইণ্ডিয়ান এয়ারলাইন্স কম্পিউটার ইনট্রোডিউস করার পর থেকে টিকিট যথেষ্ট আগে না কাটলে অসুবিধা সত্যিই হচ্ছে।
একটাই হ্যাণ্ডব্যাগ ছিল। তা ছাড়া চান্স নাম্বার সেভেন। এয়ারবাসের ফ্লাইট। পেয়েও গেল বোর্ডিং কার্ড।
ব্যাগেজ চেক তো অনেকক্ষণ আগেই অ্যানাউন্সড হয়ে গেছে, ফ্লাইটও অ্যানাউন্সড হয়ে যাবে এক্ষুনি। তাই ও তাড়াতাড়ি ভেতরের দিকে এগোল। এমনসময় পেছন থেকে কে যেন ডাকল নাম ধরে ওকে। দাঁড়িয়ে পড়ে, পেছনে তাকাতেই দেখল স্নিগ্ধ। ছাইরঙের দামি সাফারি-সুটের বুকপকেট থেকে এগজিকিউটিভ ক্লাসের চওড়া লাল আর সাদারঙা বোর্ডিং-পাস উঁচিয়ে রয়েছে সাম্প্রতিক বড়োলোক স্নিগ্ধর উঁচু হয়ে থাকা দম্ভেরই মতো।
গৌতম দাঁড়িয়ে পড়ল।
অনেকখানি সময় নিয়ে আঙুলের ফাঁকে ধরা ‘ফাইভ ফাইভ ফাইভ’ সিগারেটের প্রায় পুরোটাই অ্যাশট্রেতে গুঁজতে গুঁজতে বলল, ‘অত তাড়া কীসের? চেক-ইন যখন করেছ তখন প্লেন তো তোমাকে ফেলে যেতে পারবে না।’
গৌতমের রাগ হল একটু। কিন্তু চেপে গেল। রাগটা কেন হল তা তক্ষুনি ও বুঝল না। হয়তো স্নিগ্ধর বুকপকেট থেকে মাথা জাগিয়ে-থাকা এগজিকিউটিভ ক্লাসের বোর্ডিং পাসটাই ওর মনে ঈর্ষা জাগাল।
স্নিগ্ধ ওর কাছে এলে দু-জনে একই সঙ্গে সিকিয়োরিটি এনক্লোজারে ঢুকল। বোম্বে এয়ারপোর্টে হ্যাণ্ডব্যাগেজ চেক করে না। এইটুকু সুবিধে। বডি-চেক করিয়ে দু-জনেই ভেতরে ঢুকে পাশাপাশি দুটি চেয়ারে বসল, ল্যাভেটরিগুলো যেদিকে; সেইদিকে। অন্যদিকে জায়গাও ছিল না।
পকেট থেকে ‘ফাইভ ফাইভ ফাইভ’-এর প্যাকেট বের করে স্নিগ্ধ গৌতমকে অফার করল।
ছেড়ে দিয়েছি। গৌতম বলল।
—কবে থেকে?
—তা বছর পাঁচেক হল।
—পাঁচ বছর? তার মানে পাঁচ বছর তোর সঙ্গে দেখা হয়নি আমার?
—দেখা হয়েছে নিশ্চয়ই। এই তো মাস ছয়েক আগেও হল পুরোনো পাড়ার ঘন্টুদার মেয়ের বিয়েতে।
তাইই? তা হবে।
সারাদিনই মিটিং করেছে। কথা বলাই গৌতমের কাজ। যে কথার কোনো মানে নেই, যেসব কথা শুধুই সময় নষ্ট করবার জন্যেই বলা হয় তাতে ওর কোনোই ইন্টারেস্ট নেই। বড়ো বাজে এবং বেশি কথা বলা হয় এই পৃথিবীতে, যার একটা বড়ো অংশ বলা এবং শোনা না হলে সকলেরই হয়তো উপকার হত।
—কোথায় উঠেছিলি?
স্নিগ্ধ আবার বলল।
—‘তাজ’-এ। নীচুগলায় বলল গৌতম।
—তাজমহল হোটেলে? ‘নিউ উইং’ না ‘ওল্ড উইং’-এ?
চেঁচিয়ে বলল স্নিগ্ধ।
গৌতম কোনোরকমে বলল, ‘নিউ উইং’-এ।
আমি যদি তাজ-এ উঠিই, তাহলে সবসময়ই ওল্ড উইং-এই উঠি। ওল্ড উইং ইজ ওল্ড উইং। আজকাল অবশ্য আমি ওবেরয় টাওয়ার্সেই রেগুলারলি উঠছি। আমার কার্ড আছে তো! বলেই, হিপ-পকেট থেকে পার্স বের করে কার্ডটা দেখাল।
গৌতম দেখল। দেখতে হল বলে।
গৌতমের অফিসের অনেকেরই ওবেরয়ের কার্ড আছে এবং তারা বোম্বেতে এলে ওখানেই ওঠে, কার্ড-হোল্ডারদের পক্ষে একটু সস্তা হয় বলে। ও তাজ-এ ওঠে কারণ ওর ডিভিশনের অফিসটা ফ্লোরা-ফাউনটেইনেই । ট্যাক্সিখরচটা বেঁচে যায়। তা ছাড়া, নিজের জন্যে কলম-টলম, পিয়ার জন্যে হ্যাণ্ডব্যাগ, মিস্টির জন্যে কোলাপুরি চটি, এইসব টুকটাক কেনাকাটা করতেও সুবিধা হয় ‘কোলাবা’ এবং ‘ফ্লোরা ফাউনটেইন’-এ। কিন্তু এগুলো নিতান্ত ব্যক্তিগত কারণ। স্নিগ্ধকে বিনা কারণে অত এক্সপ্লানেশন দিতে বাধ্য নয় ও। বলবেও না।
—কবে এসেছিলি? বোম্বেতে? আবারও বলল স্নিগ্ধ।
—পরশু।
—সকালের ফ্লাইটে না বিকেলের ফ্লাইটে?
সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন। তবুও উত্তর দিতেই হল গৌতমকে। বলল, সকালে।
—আমি এসেছি কাল রাতের ফ্লাইটে। অবশ্য কলকাতা হয়ে নয়। কলকাতা থেকে বেরিয়েছিলাম সোমবার। হায়দরাবাদ গেছিলাম। তারপর সেখান থেকে ব্যাঙ্গালোরে। ব্যাঙ্গালোর থেকে দিল্লি। দিল্লি থেকে ওই বোম্বে। এবং আজ আবার বোম্বে থেকে কলকাতা। সত্যিই আর পারি না! টায়ার্ড অফ হপিং-ইন অ্যাণ্ড হপিং-আউট।
স্নিগ্ধ বলল।
ওর মুখ দেখে কিন্তু মনে হল যে, ও মোটেই ক্লান্ত নয়। শারীরিকভাবে ক্লান্ত হলেও হতে পারে হয়তো, কিন্তু মানসিকভাবে ও যে প্রচন্ড গর্বিত তা ওর দীপ্ত মুখই বলছিল।
এক-এক জন মানুষের গর্ববোধ আলাদা আলাদা। তাদের ফিলিং অফ ইম্পর্ট্যান্স-এর ক্ষেত্রও আলাদা আলাদা। প্রত্যেকের চাওয়াই এই জীবনে আলাদা আলাদা। কে যে কীসে গর্বিত হয় বোঝা মুশকিল।
চাকরি করতে হয় বলেই গৌতম চাকরি করে। চাকরি করলে ট্র্যাভেল করতে হয় বলেই ট্র্যাভেল করে। প্রতিটি ফ্লাইটেই উড়ন্ত প্লেনের মধ্যে এই ব্যস্ততা, এই হোটেল সংক্রান্ত কথাবার্তা চেনা ও অচেনা মানুষের মুখে শুনে শুনে ও সত্যিই ক্লান্ত। মালিকের পয়সায় ঘোরে বলেই প্লেনে যাওয়া-আসা করে ও। তাজমহল হোটেলে থাকে। নিজের খরচে এসি চেয়ার-কার বা রিজার্ভড সেকেণ্ড ক্লাসেই আসত। কোনো আত্মীয়র বা বন্ধুর বাড়িতে, নয় তো খুঁজেপেতে কোনো সস্তার হোটেলেই উঠতে হত। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই আসাটা হত অনেকই আনন্দর। ট্রেনের জানলার পাশে বসে মিস্টি তার অফুরন্ত প্রশ্নে তার বাবাকে ভরিয়ে তুলত। বলত, ‘এটা কী বাবা? ওটা কী বাবা?’ আর পিয়া বুদ্ধিমতী হাসি হাসি মুখ নিয়ে অপলকে তাকিয়ে বাবা আর মেয়ের কথোপকথন শুনত।
প্রশ্ন যখন অকৃত্রিম কৌতূহলে ভরা এবং টাটকা থাকে, তার জবাব দেওয়া তখন গভীর আনন্দেরই ব্যাপার। যেমন গৌতমের মেয়ে মিষ্টির সব প্রশ্ন। কিন্তু স্নিগ্ধর প্রশ্নগুলো ঠিক প্রশ্ন নয়, এক ধরনের উত্তর। এক ধরনের বোকা বোকা আত্মপ্রচার সুপ্ত থাকে এই অহেতুক চিৎকৃত সব প্রশ্নে।
তোর গাড়ি আসবে তো রে? স্নিগ্ধ বলল।
—হুঁ।
—তোর সেই ফিয়াটই আছে। না বদলেছিস?
—হুঁ।
—হুঁ মানে?
—ওই!
আসলে গৌতম ফিয়াটটা বিক্রি করে দিয়ে মারুতি নিয়েছে একটা। মিষ্টিরই ইচ্ছেতে। অফিস থেকে দেওয়া একটি কন্টেসা আছে অবশ্য। সেটা অফিসের ড্রাইভারই চালায়। কিন্তু এতকথা স্নিগ্ধকে বলার ইচ্ছে বা প্রয়োজন আদৌ বোধ করল না ও। এড়িয়ে গিয়ে, মুখে ওইটুকুই বলল—ওই।
দশ বছরের মেয়ে মিষ্টি মারুতির পেছনের কাচের দরজাটা তুলে দিয়ে মোড়া পেতে বসে সেখানে। অনেকেই বলে যে, ‘খুব ডেঞ্জারাস। পেছন থেকে ধাক্কা মারলে…’
গৌতম তবুও মেয়েকে বারণ করে না। এখন মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকাটাই ডেঞ্জারাস। জন্ম থেকে মৃত্যু। গৌতমদের জীবনগুলো তাও কাটিয়ে দিল একরকম করে। মিষ্টিদের যা জীবন, যা পড়াশুনা, এই বয়সেই ওদের যা কর্তব্য-দায়িত্ব, চব্বিশ ঘণ্টার দিনে ষোলো ঘণ্টা কাজ, যে গভীর প্রতিযোগিতা; তাতে নানারকম ‘ডেঞ্জার’ নিয়েই ওদের ঘর করতে হবে। ওদের জীবন হবে সত্যি সত্যিই হাইলি ডেঞ্জারাস। প্রতিক্ষণই হাইপারটেনশানের। পিয়া বা গৌতমের সাধ্য কী যে, তাদের ভালোবাসার সন্তানকে এই বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখে। মাঝে মাঝেই মিষ্টিকে এই পৃথিবীতে এনেছে বলে আফশোস করে। মেয়েটার শৈশব বলে কিছুমাত্র নেই। এখন হয়তো কোনো শিশুরই নেই। একথা ঠিক যে, মিষ্টিরা যা এবং যতরকম শিক্ষা পাচ্ছে, তার ছিটেফোঁটাও ওরা পায়নি। গৌতমরা সাদামাটা বাঙালি স্কুলেই পড়েছিল। বলতে গেলে অশিক্ষিতই ছিল ওরা একরকম মিষ্টিদের বয়সে, মিষ্টিদের তুলনায়। কিন্তু এও ঠিক যে, দলবেঁধে ওরা তুমুল বৃষ্টির মধ্যে খালিপায়ে ফুটবল খেলেছে কাক-ভেজা হয়ে, ঘুড়ি উড়িয়েছে। রথের মেলায় গেছে রাসবিহারী অ্যাভেনিউর মোড়ে আর পদ্মপুকুরে পাঁপড়ভাজা খেতে আর তালপাতার ভেঁপু কিনতে। ফাঁকা নির্জন ট্রাম রাস্তায় ট্রাম লাইনের পাশের ইলেকট্রিক পোস্টের সঙ্গে কান লাগিয়ে ট্রাম যাতায়াতের আশ্চর্য আওয়াজ শুনেছে প্রাণ ভরে। বড়ো সহজেই গভীর সুখে আশ্চর্য হতে পেরেছে ওরা। তখন বিনি পয়সাতে অনেকই আনন্দ পাওয়া যেত। অনেক সহজ সুন্দর অবসরের ছিল জীবন। মিষ্টিদের এই এত বিষয়ের জ্ঞান, এই দ্রুতগতি জেটপ্লেন, এইসব ফাইভ স্টার তাজমহল বা ওবেরয় শেরাটন না থাকলেও জীবন তখন পরিপূর্ণ ছিল কানায় কানায়। আনন্দর; অনাভাবের জীবন। আজ এতকিছু হয়েও লাভ বোধ হয় হয়নি কিছুই। মানুষের আসলে কী যে চাইবার ছিল মানুষ হয়ে বেঁচে থাকবার জন্যে, তাই তো ভুলে গেছে আজকের মানুষ।
আমি তো বুক করে ফেললাম একটা। স্নিগ্ধ হঠাৎ বলল।
ওর ভাবনার জাল ছিঁড়ে যাওয়াতে চমকে উঠল গৌতম!
মানুষের ভাবনার মতো দ্রুতগতি কোনো জেট প্লেন কোনোদিনও বানাতে পারবে না মানুষ। মানুষের নিজস্বতার কাছেই, যা কিছুই সে জন্মসূত্রে মানুষ হওয়ার সুবাদে পেয়েছিল সেই সবকিছুর কাছেই তার সবচেয়ে বড়ো হার। জেট প্লেন আর ফাইভ স্টার হোটেল কোনোদিনও একজন মানুষকে, তার নিজস্বতা তাকে যা দিতে পারত, তা দিতে পারবে না।
—বুঝলি, বুক করেই ফেললাম।
এবারে কথা বলতেই হল গৌতমের।
বলল, কী?
স্ট্যাণ্ডার্ড টু-থাউজ্যাণ্ড। প্রায় আড়াই লাখ মতো পড়বে অন রোড। বলেছি সাদা অথবা কালো দিতে। কালোতে পালিশ বেশি ভালো ওঠে। কালো কিন্তু দেখিনি! তুই কি দেখেছিস?
—না।
গৌতম বলল। সংক্ষেপে। একটা হাই তুলে।
—একটা মারুতি, একটা অ্যাম্বাসাডর আর একটা কন্টেসা আছে অবশ্য। কিন্তু আমার মেয়ের খুবই শখ স্ট্যাণ্ডার্ড ট্রু-থাউজ্যাণ্ডের। ওর ক্লাসের তিন-জন মেয়ের আছে। আজকাল বুঝলি না, এই সবই হচ্ছে স্ট্যাটাস সিম্বল।
হুঁ। গৌতম বলল।
—ভি. সি. আর. কিনেছিস?
স্নিগ্ধ শুধোল আবার।
—না।
কথাটা মিথ্যে বলেনি। আবার পুরোপুরি সত্যিও নয়। পিয়ার দাদা সিঙ্গাপুরে গেছিলেন কাজে। পিয়ার জন্যে একটি ভি.সি.আর. নিয়ে এসেছেন। ছোটোবোনকে দান করেছেন। কিন্তু ছবিটবি দেখা হয় খুবই কম। সেদিন মোৎজার্ট-এর জীবনীটা দেখেছিল। খুবই ভালো ছবি। কিন্তু উদবৃত্ত সময় পেলেই পিয়া এবং ও বই পড়ে, গান শুনেই কাটায়। রবিবার বিকেলে ময়দানে এখনও রিলিজিয়াসলি ফুচকা খেতে যায় সকলে মিলে। নয়তো ভেলপুরি।
গৌতমের চাকরিটা সত্যিই মস্তবড়ো। কিন্তু মস্ত মালটিন্যাশনাল কোম্পানির মস্ত চাকর ছাড়াও যে, ওর অনেকই এবং নিজস্ব পরিচয় আছে তা কোনোক্রমেই ও ভুলে যেতে চায় না। ছোট্ট ছোট্ট সুখ নিয়েই জীবন। যেসব সুখ, যেসব আনন্দ, চাকরিটা কালকে ও ছেড়ে দিলে অথবা রিটায়ার করলেও রাখতে বা করতে পারবে শুধু সেই সমস্ত সুখ এবং আনন্দতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে চায় ও। চারপাশে চাকচিক্যময় চাকরদের ঝকমকানিতে ওর চোখ এমনিতেই ধেঁধে থাকে।
অন্যদের মতো হতে চায় না ও।
—আমি তো বাহাত্তর ইঞ্চি সোনি রিমোর্ট কন্ট্রোল কালার টিভি আর একটা রিমোর্ট কন্ট্রোল ভি. সি. আর. নিয়ে এলাম এইবার হংকং থেকে। বাড়িতে অবশ্য ছিল একটা। টেলেরামার আই. টি. টি.।
স্নিগ্ধ বলল, আশপাশের অনেককেই শুনিয়ে।
—বা:।
গৌতম বলল।
গৌতমের ‘বা:’ বলার অপেক্ষা না করেই স্নিগ্ধ বলল, রবিবারে কী করিস?
বাড়িতেই থাকি।
গৌতমের মনে হচ্ছিল স্নিগ্ধর লাগাতার কথা শুনে যে, এই কথোপকথন আসলে দু-জনের জন্যে আদৌ নয়। স্নিগ্ধ নিজের সঙ্গেই নিজে কথা বলে যাচ্ছিল আসলে। নিজেকে অ্যামপ্লিফাই করছিল। গৌতম উপলক্ষ্য মাত্র। গৌতমের সঙ্গে দেখা না হলে ও অন্য কাউকে ধরেই এ কথাগুলো বলত।
আসলে স্নিগ্ধর কোনো প্রশ্নরই পুরো উত্তর দিচ্ছিল না গৌতম। স্নিগ্ধ ওর ছেলেবেলার প্রতিবেশী। খেলার সঙ্গীও ছিল। তারপর নিজের নিজের জীবনের অয়নপথ আলাদা হয়ে গেছিল ওদের।
প্রত্যেক মানুষের জীবনের মধ্যেই তার স্বাতন্ত্র্যর বীজ সুপ্ত থাকে। কেউ কেউ সেই বীজ থেকে গাছ জন্মাতে পারে, কেউ আবার সেই বীজ যে ছিল, আদৌ তা বুঝতে পর্যন্ত পারে না। যাদের গাছ বাড়ে, তাদের কারও-বা বাড়ে বাইরের দিকে আর কারও ভেতরে। জীবনই ওদের দু-জনকে অনেক বদলে দিয়েছে। বাইরে থেকে মনে হয় অনেকই মিল দু-জনের। আসলে তা আদৌ নয়।
—আমি তো এভরি সানডেতে সকাল বেলা ওয়াইফ আর ডটারদের নিয়ে টলিতে চলে যাই। আই মিন টালিগঞ্জ ক্লাবে। ডটার ঘোড়া চড়ে। ওয়াইফ সাঁতার কাটে। আর আমি গলফ খেলি। তারপর ক্লাবেই ব্রেকফাস্ট খেয়ে আসি। কোনো কোনোদিন লাঞ্চও করি। কখনো-বা হোল-ডে স্পেণ্ড করি। দেয়ারস নো গেম লাইক গলফ।
—তুই ডাংগুলিটা কিন্তু খুবই ভালো খেলতিস। আর খেন্তিদিদের বাড়ির সামনের ভাঙা ফুটপাথে মার্বেল। পিট্টু খেলাও। মনে আছে? ডাংগুলি খেলা নিয়ে গাডলুর সঙ্গে তোর মারামারি হয়েছিল একবার?
অনেকক্ষণ পর একসঙ্গে এতকথা বলে ফেলে হাঁপিয়ে গেল গৌতম।
স্নিগ্ধ লজ্জিত হয়ে এদিক-ওদিক তাকাল। কলকাতার ফ্লাইট। কাছাকাছি দু-জন বাঙালিও ছিলেন। তাঁরা গৌতমের কথা শুনতে পেলেন কি না তা চকিতে মুখ ঘুরিয়ে স্নিগ্ধ একবার দেখে নিল।
তারপর নীচুগলায় বলল, অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স করলি তুই গৌতম।
স্নিগ্ধ ভয় পেয়ে গেছিল। চেনা লোকেরা তো তাকে চেনেই। অচেনা লোকেদের কাছেও একটা ইমেজ গড়ে তুলতে বেশ নেশা নেশা লাগে। তাদের কাছে ছোটো হতে সেই কারণেই খারাপও লাগে।
কেন? গৌতম বলল।
—কোথায় গলফ আর কোথায় ডাংগুলি?
—দুটোই তো খেলা। সব খেলাতেই কমবেশি আনন্দ তো থাকেই। আর আমাদের সেই ছেলেবেলাকার আনন্দর সঙ্গে তো আজকের আনন্দর তুলনা হয় না।
উত্তরে কী বলবে ভেবে না পেয়ে স্নিগ্ধ বলল, তা হলেও।
বলেই চুপ করে গেল।
কলকাতার ফ্লাইট অ্যানাউন্সড হল এবারে।
গৌতম ভাবল, বাঁচা গেল এতক্ষণে স্নিগ্ধর হাত থেকে।
স্নিগ্ধও ভাবল, বাঁচা গেল গৌতমের হাত থেকে। কোথায় যে কী বলতে হয় তা জানে না। গৌতমটা আসলে ওদের ছেলেবেলার হরিশ মুখার্জি রোড থেকে বেরোনো ছাপোষা মানুষদের বাস ছিল যে গলিতে, সেই গলিতেই রয়ে গেছে মনে মনে। ওর লাইফ, এই জেট-সেট-এজ, ওর সায়েবদের, থুরি মাড়োয়ারিদের বিরাট কোম্পানির চাকরিও একে বদলায়নি বিশেষ। সে ওই হরেন রায়ের ছেলে গৌতম রায়ই রয়ে গেছে। ছ্যা। টিপিক্যাল মিডল ক্লাস মেন্টালিটির ঘরকুনো বাঙালি। কিসসু হবে না ওদের। ওরা বদলে যাওয়াকে বড়োই ভয় করে।
গৌতম ভাবছিল, প্লেনে উঠেই চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়বে চেয়ারটা রিক্লাইন করে। আজকাল ভাববার বড়ো-একটা অবকাশই পায় না। যখনই এরকম ট্রাভেল করে তখনইও একটু ভাববার সময় বের করে নেয়। তবে প্রতি ফ্লাইটেই চেনা-জানা লোক অনেকেই বেরিয়ে যায়। তাঁদের অনেকেই কথা বলতে স্নিগ্ধর মতোই ভালোবাসেন। তবে স্নিগ্ধ স্নিগ্ধরই মতো।
চান্স-টিকেটে ভালো লেগরুমঅলা সিটও অনেকসময় পাওয়া যায়। খারাপের ভালো দিকও থাকে। শেষমুহূর্ত অবধি ভি.আই.পি.-দের জন্যে রেখে তখন ভালো সিটগুলো ওঁরা রিলিজ করেন বোধ হয়। এদেশে ভি.আই.পি. বলতে চোর-জোচ্চোর-রাজনৈতিক নেতা বা আমলাদেরই শুধু বোঝায়। লেখক, গায়ক, বাজিয়েরা এদেশে নন-এনটিটি। আজ তেমনই ঘটেছে গৌতমের ভাগ্যে। সামনের গেট দিয়ে উঠেই একেবারে প্রথম রোতে সিট। বা:!
বাঁ-দিকে ‘জো’ ক্লাসের কম্পার্টমেন্টের দিকে ঘুরে গিয়েই স্নিগ্ধ বলল, সি ইউ।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল গৌতম।
প্লেনটা সময়েই ছাড়বে। মনে মনে হিসেব করল। গাড়ি নিয়ে আসবে ছত্রবাহাদুর। বাড়ি পৌঁছোতে পৌঁছোতে, বাইপাস দিয়ে গেলেও সাড়ে আটটা বেজে যাবেই। মিষ্টির স্কুলের বন্ধুরা ততক্ষণে সবাই চলে যাবে। পিয়া রাগ করবে। কিন্তু করার কিছুই নেই। সকালের ফ্লাইটে যদি আসতে পারত! কিন্তু ওই নেরুলকারই তো ডোবাল মিটিংটা আজ লাঞ্চ অবধি গড়িয়ে দিয়ে।
ভাবনার মধ্যে ডুবে গেছিল গৌতম। প্লেন টেক-অফ করেছে। সিটবেল্ট লাগাবার এবং নো স্মোকিং-এর সাইন সুইচড-অফ হয়ে গেছে। ক্লান্ত লাগছিল, সারাদিনই ঘোরাঘুরি এবং মিটিং করেছে। তা ছাড়া, কাল হোটেলের ঘরে রাত দুটো অবধি ভিডিয়োতে ছবিও দেখেছিল। ঘুম ঘুম পাচ্ছিল।
—ঘুমোলি নাকি?
চোখ মেলে দেখল অ্যাইলে দাঁড়িয়ে তার সিটের মাথায় হাত রেখে স্নিগ্ধ। বুকের পকেটে সেই লাল-সাদা বোর্ডিং কার্ডটা উঁচু হয়ে আছে।
স্নিগ্ধ বলল, দাঁড়া আসছি।
বলেই, ‘জে’ ক্লাসের ল্যাভেটরিতে না গিয়ে ইকনমি ক্লাসের ল্যাভেটরিতে গেল প্লেনের পুরো দৈর্ঘ্য পেরিয়ে। কে জানে কেন! ও যে ‘জে’ ক্লাসের প্যাসেঞ্জার তাই দেখাবার জন্যে?
ফিরে এসে গৌতমের পাশে ফাঁকা সিটটাতে বসে পড়ে অরেঞ্জ বাটন প্রেস করে এয়ার হোস্টেসকে ডেকে বলল, দুটো গ্লাস আর বরফ দিতে। তারপর গৌতমকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়েই আবার বলল, ‘আসছি এখুনি।’
সামনে ‘জে’ ক্লাসের এনক্লোজারে গিয়েই ফিরে এল ‘সিভাসরিগাল’-এর একটি পাঁইট নিয়ে। বলল, তোর কপালে ছিল। বাংলাদেশ থেকে নিয়ে এসেছিলাম গত মাসেই।
গৌতম কিছু বলল না। গ্লাসে যখন হুইস্কি ঢালছিল স্নিগ্ধ, তখন ও বলল, অল্প দিস কিন্তু। আমি কালেভদ্রে খাই।
—চিয়ার্স!
—চিয়ার্স। তোর ফেভারিট ব্র্যাণ্ড কী? জাস্ট নেম ইট। তোকে পাঠিয়ে দেব।
স্নিগ্ধ বলল।
কিছুই না। নান ইন পার্টিকুলার। গৌতম বলল।
সান্টাক্রুজ এয়ারপোর্টে দেখা হওয়ার পর থেকে এতক্ষণেও গৌতমকে একটুও ইমপ্রেস করতে না পেরে স্নিগ্ধ ফ্রাস্টেটেড ফিল করছিল।
গৌতমও ফ্রাস্টেটেড ফিল করছিল স্নিগ্ধকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে না পেরে। সেই তখন থেকে সিন্দবাদ নাবিকের মতো চেপে বসে আছে ঘাড়ে।
ওরা দু-জনে বন্ধু কখনোই ছিল না। বন্ধু অবশ্য একজীবনে ক-জনই বা হয়। একসময়ের অভিন্নহৃদয় বন্ধুরাও দূরে যাওয়ার পর, বিয়ে করার পর, কত সহজেই ভিন্ন হৃদয় হয়ে যায়। এ সবই ও নিজের জীবনে দেখেছে। নানা কারণেই তাই নতুন সম্পর্ক কারও সঙ্গেই পাতাতে চায় না গৌতম। যেসব সম্পর্ক মাত্রা পেয়েছিল, তাদেরই নিজ নিজ মাত্রাতে ধরে রাখা গেল না যখন, তখন নতুন কোনো সম্পর্কতেই আর বিশ্বাস করে না ও।
ছেলেবেলাতে ওরা দু-জন নিম্নমধ্যবিত্ত সাধারণ পরিবেশের একই পাড়ায় বসবাসকারী দুটি পরিবারভুক্ত ছিল। একই শ্রেণির। জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ প্রায় পেরিয়ে এসে আবারও ওরা একই শ্রেণিভুক্ত হয়েছে। যদিও এ এক অন্য শ্রেণি। সম্পূর্ণই অন্য। তবুও, স্বার্থগত সমতার কারণে একশ্রেণির মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব খুবই তাড়াতাড়ি এবং সহজেই হয় বলেই হয়তো স্নিগ্ধ চাইছিল ছেলেবেলার সম্পর্ককে পুনরুজ্জীবিত করতে। কিন্তু গৌতম চাইছিল না। গৌতম জানে যে, স্নিগ্ধর সঙ্গে বন্ধুত্ব বড়ো বয়সে হবে না আর। ডাংগুলি মার্বেল আর পিট্টু খেলার দিনে সবকিছুই অন্যরকম ছিল। তখন অসাধ্যও সাধন করা যেত। তা ছাড়া গৌতম এও শুনেছে যে, স্নিগ্ধ কী করে বিরাট বড়োলোক হয়েছে। অথচ সমাজ ওকে মেনে নিয়েছে। মাথায় করে রেখেছে। ব্যাবসাটা স্নিগ্ধর অনেকগুলো মুখোশের একটা মুখোশ। পড়াশুনোতে স্নিগ্ধ বাজে ছিল। ক্লাস এইটে না নাইনে একবার ফেলও করেছিল। অঙ্কের স্যার নাকে বড়ো এক টিপ নস্যি নিয়ে ওকে ডাকতেন, ‘এই যে স্নিগ্ধ গর্দভ’ এদিকে এসো। শুনেছে, স্নিগ্ধদের সেকশনের ছেলেদের কাছে। গৌতম ছিল স্কুলের গর্ব এবং স্নিগ্ধ অন্যতম কলঙ্ক। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষাতে শেষের দিক থেকে থার্ড হয়েছিল স্নিগ্ধ, যারা পাশ করেছিল তাদের মধ্যে। থার্ড ডিভিশনই পেয়েছিল। তারপর ও কোন কলেজে পড়েছিল জানে না। দেখা হয়ে গেছিল বছর কয়েক আগে। এমনি করেই বোম্বে এয়ারপোর্টে। তারপর প্রায়ই দেখা হয়েছে এখানে-ওখানে। গতবছর রোটারির মিটিং-এ। চেম্বার অফ কমার্সের একটি সাবকমিটির মেম্বার হিসেবেও দেখা হয়েছিল। স্নিগ্ধ হয়তো কোনোদিন চেম্বারের প্রেসিডেন্টও হয়ে যাবে। তাতে গৌতমের যাবে আসবে না কিছুমাত্র। ও চিরদিনই নিজেকে এই স্নিগ্ধদের থেকে অন্য ক্লাসের বলে জেনে এসেছে। স্নিগ্ধ আজ যত বড়ো ব্যাবসাই করুক, ‘সিভাসরিগাল’ই খাক রোজ অথবা ‘স্ট্যাণ্ডার্ড টু-থাউজ্যাণ্ড’ বুকই করুক অথবা এগজিকিউটিভ ক্লাসে ট্র্যাভেলই করুক, গৌতমের ক্লাসে ও কোনোদিনই উঠতে পারবে না।
একটা ড্রিঙ্ক শেষ করেই স্নিগ্ধ বলল, আর একটা নে।
—না।
—কেন? কী হল?
এবার সামান্য প্রচ্ছন্ন বিরক্তি ফুটে উঠল স্নিগ্ধর গলায়।
—এমনিই। আমার লিমিট একটা।
—তুই চিরদিনই বড়ো হিসেবি।
—জানি।
—যারা হুইস্কি খাবার সময়েও হিসেব করে খায়, তারা মানুষ সুবিধের নয়।
—জানি।
আবারও বলল গৌতম।
স্ন্যাকস সার্ভ করবে বলে অ্যানাউন্স করল। ‘জে’ ক্লাসের খাওয়াটা সামান্য ভালো ইকনমি ক্লাস থেকে। তা ছাড়া, টেক-অফ-এর পরে ওডিকোলন মাখানো ঠাণ্ডা ফেস-টাওয়ালও দেয় ওই ক্লাসে, ক্লান্ত ঘর্মাক্ত প্যাসেঞ্জারদের টাটকা হয়ে নেওয়ার জন্য।
আরও একটা হুইস্কি ঢেলে, বোতলটা সাফারি সুটের পকেটে ভরে স্নিগ্ধ বলল, এই রাখ। আমার একটা কার্ড। উই মাস্ট মিট মোর অফটেন।
কার্ডটা নিয়ে, ওর সুটের পকেটে রাখল গৌতম।
—তোর কার্ড নেই?
স্নিগ্ধ শুধোল।
বাক্স-ভরতি কার্ড ছিল ব্রিফকেসে। গোটা চার এক ছিল পার্স-এও। কিন্তু গৌতম বলল, আনতে ভুলে গেছিলাম এবারে।
—তোর অফিসের নাম আর নাম্বার কত? মানে, ফোনের?
গৌতম ইচ্ছে করেই অন্য একটা কোম্পানির নাম বলল। তারপর ভুল এক্সচেঞ্জ। ভুল ফোন নাম্বার।
স্নিগ্ধ সেই লাল-সাদা বোর্ডিং পাস-এর পেছনে লিখে নিল।
তারপর বলল, চলি।
গৌতম ঠাণ্ডা গলায় বলল, আয়।
ছেলেবেলার সহপাঠী, খেলার সাথি, একপাড়ার ছেলের আশ্চর্য শীতল ব্যবহারে আন্তরিকভাবে দুঃখিত, অনেক খেটে বড়োলোক হওয়া, একটু বোকা কিন্তু খুব সরল হতভম্ব স্নিগ্ধ ‘জে’ ক্লাসে গিয়ে ওর সিটে বসল।
স্নিগ্ধ ভাবছিল, জীবনের পথে কে কোথা থেকে রওনা হয়েছিল সেটা কোনো ব্যাপারই নয়, কে কোথায় পৌঁছোল সেটাই আসল। পৌঁছোতে পারাটাই….। জীবনে সচ্ছল হওয়ার স্বপ্ন দেখে সব মানুষই। কিন্তু সচ্ছল হতে পারার মধ্যে যেমন আনন্দ আছে এক ধরনের, তেমন দুঃখও আছে গভীর। বড়ো একা লাগে, পরিত্যক্ত সচ্ছল মানুষমাত্রই তা জানে। সকলকে জড়িয়ে ধরে থাকতে চাইলেও হাত ছাড়িয়ে চলে যায় সকলেই। যাদের জড়াতে চায়, তারা কাছে থাকে না; যারা থাকে, তাদের চায় না ও। তারা সব ধান্দাবাজ, নিজেদের স্বার্থেই ভিড় করে শুধু।
গৌতমটা খুবই ভালো খেলত। লেফট উইংগার ছিল। ওর স্বভাব-ব্যবহার-চেহারা সবকিছু দেখেই ওকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করত। স্নিগ্ধর মা বলতেন, ‘গৌতমের মতো হতে পারিস না? সোনার টুকরো ছেলে।’
জীবনে সচ্ছল হওয়া, গাড়ি করা, বাড়ি করা, কেউকেটা হওয়া, নামি ক্লাবের মেম্বার হওয়া ওইসবই তো ‘হওয়া’। অথবা, এই-ই সব নাকি? মা তো এই ‘হওয়ার’ কথাই বলেছিলেন। হয়েওছে আজ স্নিগ্ধ। কাউকে ঠকায়নি, চুরি করেনি, অনেক খেটে এই ব্যাবসা একহাতে দাঁড় করিয়েছে। চল্লিশ বছর অবধি কোনো সুখের মুখই দেখেনি। তাই অতৃপ্ত বাসনাগুলোকে যে একটু হুড়োহুড়ি করে পূর্ণ করেছে তাও জানে। মা অনেক দিন আগেই চলে গেছেন। তখনও স্নিগ্ধ এরকম বড়ো করেনি ব্যাবসা। মা থাকলে খুবই খুশি হতেন। মা নেই বলেই আজ গৌতমকে কাছে পেয়ে মায়ের কথা মনে পড়ছে খুবই।
স্নিগ্ধ অবশ্য নিজের কথা একটু বলে। একটু বেশিই বলে যে, তাও জানে। কিন্তু এই বাজে পৃথিবীতে অন্য মানুষের প্রশংসাও তো মুখ ফুটে এক-জনও করে না। সে কারণেই ও নিজের প্রশংসা নিজেই করে। অন্যর গর্ব চুরি তো ও করেনি। ভিক্ষাও চায়নি কারও কাছে। নিজের কথা বলে একটু আনন্দ পায়, ভালো লাগে। ও যে চালিয়াতি করার জন্যে করে, তা নয়। অনেকে যদিও ভুল বোঝে ওকে। স্কুলের পরীক্ষায় কবে ফেল করেছিল, কোন সময় ফুটপাথে পিট্টু বা মার্বেল খেলত সেইজন্য চিরদিনই গৌতম তাকে হেয় করে যাবে এটাই-বা কেমন কথা?
স্নিগ্ধ বড়ো করে আরও একটা হুইস্কি ঢালল। খুবই দুঃখ হল ওর। নিজের জন্য। গৌতমেরও জন্যে। কিছু মানুষ নিজেদের গড়ে-তোলা একটা শক্ত খোলার মধ্যেই জীবনটা কাটিয়ে যায়। নিজেদের মতো আর ‘কেউই’ নয় এই ভেবে। খোলাটা ভেঙে বাইরে বেরোতে পারলে তারা জানতে পেত জীবনে সত্যিই অনেক আনন্দ আছে। এত কষ্টের মধ্যেও। নিজের জন্যও কষ্ট হল স্নিগ্ধর। ভাবল, কিছু পেলে, কিছু ছাড়তে হয়ই। জীবনের খেলাতে এরকমই নিয়ম। ফুল ফুটলে, কাঁটার ঘের থাকেই। কিছু করার নেই।
স্নিগ্ধ ভাবছিল, এগজিকিউটিভ ক্লাসকে ‘জে’ ক্লাস বলে কেন কে জানে?
‘জে’ ফর জেলাসি। তাইজন্যেই কি?