রক্ত
ওয়ার্ড বয়টি বলল, খেয়ে ফেলুন।
আমার সামনে দু-হাতে দু-গ্লাস গ্লুকোজ-গোলানো জল ধরে সে দাঁড়িয়ে ছিল। ঢক ঢক করে গ্লাস দুটি নি:শেষ করে আবার তার হাতে ফিরিয়ে দিলাম।
যিনি ক্লিনিকের চার্জে ছিলেন, সেই প্যাথোলজিস্ট বললেন, ঘড়ি দেখুন। ঠিক দু-ঘণ্টা পরে রক্ত নেওয়া হবে।
দু-ঘণ্টা?
বিরক্তির গলায় শুধোলাম ওঁকে।
উনি নৈর্ব্যক্তিক গলায় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, হ্যাঁ! ঠিক তাই।
দু-টি ঘণ্টা সময় ওইখানে বসে নষ্ট করতে হবে ভেবেই অস্বস্তি লাগতে লাগল।
আজ অনেক দিন হয়ে গেছে সেই দু-ঘণ্টা। অনেক ঘণ্টা, দিন, মাস বছর পেরিয়ে এসেছি। কিন্তু পেছন ফিরে তাকালে মনে হয়, ভাগ্যিস সেদিন দু-ঘণ্টা ওখানে বসে ছিলাম, নইলে সাকচুদের সঙ্গে পরিচিত হতাম না কখনো। ওদের সম্বন্ধে কিছু জানতেও পেতাম না।
ওখানে বসে থাকতে থাকতেই একটু পরেই চার-জন গুণ্ডা প্রকৃতির লোক একই সঙ্গে সেই এয়ার কণ্ডিশানড ক্লিনিকে দরজা ঠেলে ঢুকল। কাউন্টারে এক জন ক্যাশিয়ার টাকাপয়সা জমা নিচ্ছিলেন। অন্য-জন রক্তের রিপোর্ট টাইপ করছিলেন। তাঁদের দু-জনেরই এই লোকগুলোকে দেখে চমকে ওঠার কথা ছিল, কারণ ওই পরিবেশে, ওই সময়ে, ওই লোকগুলোকে একেবারেই মানাচ্ছিল না।
কিন্তু ওঁরা একবার চোখ তুলেই, সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিলেন।
বুঝলাম, ওরা ওদের চেনা লোক।
পার্টিশানের ভেতর থেকে একটি ভারী গলা ওই লোকগুলোকে উদ্দেশ করে বললেন, এক এক-জন করে ভিতরে এসো তোমরা।
সেই গলার স্বর শুনে মনে হল, এই লোকগুলোর কোনো নাম নেই, পরিচয় নেই। ওরা এক ভিন্ন জগতের প্রাণী যেন। এমনকী গায়ে কোনো নম্বর বা দাগও নেই।
কয়েক মিনিটের মধ্যে ওরা এক এক করে ভেতরে গেল এবং এক এক করে ফিরে এল কনুইয়ের উলটোদিকে হাতের শিরায় এক টুকরো করে তুলো গুঁজে।
বুঝলাম, রক্ত দিয়ে এল ওরা।
চার-জন একসঙ্গে হতেই আবার যেমন দলবদ্ধ হয়ে এসেছিল তেমনি দলবদ্ধ হয়ে দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে গেল একটিও কথা না বলে।
ওদের মধ্যে এক-জন লুঙ্গি পরে ছিল। কাঁধের কাছে অনেকখানি ছেঁড়া একটা নীল টুইলের শার্ট ছিল তার ঊর্ধ্বাঙ্গে। কিন্তু তার চোখ-জোড়ায় চোখ পড়লে চোখ ফেরানো সম্ভব ছিল না। লাল টকটকে বাঘের চোখের মতো চোখ।
তারা অদৃশ্য হলে, আমি ফিস ফিস করে ওয়ার্ড বয়কে শুধোলাম, এরা কারা?
ওয়ার্ড বয় বলল, ডোনার।
মানে?
মানে, রক্ত দেয়, দিয়ে পয়সা রোজগার করে।
পয়সার জন্যে রক্ত দেয়?
হ্যাঁ। আজ তো শনিবার, রেসের মাঠে যাবে ওরা আজ।
ওই লুঙ্গি পরা লোকটার নাম কী? নিয়মিত রক্ত দিয়েও ওইরকম গুণ্ডার মতো চেহারা ও রাখে কী করে? চোখের দিকে তাকালে মনে হয় গিলে খাবে।
ওয়ার্ড বয় হাসল।
বলল, ওরা ও-রকমই। ও গুরুদেব। ওর নাম সাকচু সিং। ও গুণ্ডা সর্দার।
কত পায় রক্ত দিয়ে?
যতবার দেয় ততবার ছাব্বিশ টাকা। সাকচু অনেক বেশি। কারণ ওর নেগেটিভ।
নেগেটিভ মানে?
আমি বললাম।
ওয়ার্ড-বয়টি বলল, মানে নেগেটিভ গ্রূপের রক্ত।
ও। কিন্তু এতেই চলে যায়? রোজ তো আর রক্ত দিতে পারে না!
রোজ দেয়ও না। মাঝে মাঝে দেয়, বাদবাকি সময় পকেট মারে, ছিনতাই করে, মদ খায়, লোকের পেটে চাকু চালায়। কী করে না?
তারপরই বলল, আপনার পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিন একবার। সব ঠিকঠাক আছে তো?
তাড়াতাড়ি বুক-পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম। প্রেসক্রিপশন, টাকা সব বুক পকেটেই রেখেছিলাম।
না:, ঠিকঠাকই আছে।
বসে থাকতে থাকতে দু-ঘণ্টা হয়ে গেল। রক্ত দিলাম আমিও। পরীক্ষার জন্যে। পয়সা নিয়ে নয়। দিয়ে, তারপর বেরিয়ে এলাম।
ওই লোকগুলোর কথা, সাকচুর কথা তারপর ভুলেই গেছিলাম। কাজেকর্মে, নিজেদের নানা ধান্দায়।
আমার ছোটোবেলার বন্ধু পরিতোষের স্ত্রী রমার হার্টের সাংঘাতিক অসুখ। রমার মতো এমন সুন্দরী মেয়ে বড়ো একটা দেখা যায় না। যেমন চেহারা, তেমনি নম্র শান্ত মিষ্টি স্বভাব। অথচ এমন মেয়েকে ভগবান এমন কঠিন অসুখ দিয়ে পাঠালেন কেন ভেবে পেতাম না। তিন বছর হল বিয়ে হয়েছিল। ছেলে-মেয়ে হয়নি। হবার সম্ভাবনাও ছিল না হার্টের ওই অবস্থায়। স্বামী-স্ত্রী দু-জনেই ওরা আড্ডা মারতে খুব ভালোবাসত। প্রতি রবিবার সকালে আমার আড্ডাখানা ছিল ওদের বসার ঘর। প্রথম সকালে বসবার ঘরে কাপের পর কাপ চায়ের সঙ্গে আড্ডা জমত। তারপর খাওয়া-দাওয়ার পর শোবার ঘরে। আমরা তিন-জন পাশাপাশি শুয়ে গল্প করতে করতে শেষ বিকেলে ঘুমিয়ে পড়তাম। ছাড়াছাড়ি হত সেই সন্ধের মুখে চা খাওয়ার পর।
রমা বলত, আপনার একটা বিয়ে না দিলে আমাদের দাম্পত্য জীবনে প্রাইভেসি বলতে কিছুই থাকবে না দেখতে পাচ্ছি। স্বামীকে যে রবিবারেও একটু একলা পাব, তারও কী উপায় আছে?
আমি হাসতাম।
বলতাম, আমার বন্ধুর মতো কৃতী ছেলেকে বিয়ে করেই আপনার হার্ট অকেজো। আমাকে যে বিয়ে করবে, সে তো হার্টফেল করেই মারা যাবে তিন দিনের মধ্যে।
রমা হাসত উত্তরে। রমার হাসিটা ছিল ভারি বুদ্ধিদীপ্ত ও মিষ্টি।
পরিতোষ বর্তমানে আই-বি-ডিপার্টমেন্টের অফিসার। ওর কাজের কোনো সময় অসময় ছিল না, ছিল না ছিরিছাঁদো, যখন তখন যার তার বাড়ি হানা দিতে হত। হানা দিয়ে অনেক সময় নিজেদের এবং কিছু সময় যাদের বাড়ি হানা দিত, তাদেরও অহেতুক বিব্রত করত।
রমা এই নিয়ে হাসাহাসি করত। পরিতোষ বলত, আই-পি-এসদের সকলেই এই আনপ্লেজেন্ট কাজের মধ্য দিয়ে যেতে হয় জীবনের কোনো-না-কোনো সময়ে। ওপর তলায় ওঠার সিঁড়ি কি সবসময়েই মোজাইক টাইলসের হয়?
এক বৃহস্পতিবারেই ফোন পেলাম পরিতোষের কাছ থেকে যে, রমার অবস্থা হঠাৎই বিপজ্জনক ভাবে খারাপ হয়ে গেছে। নার্সিংহোমে রিমুভ করেছে কাল। ক্রিটিকাল কণ্ডিশন। শনিবার সকালে ওর অপারেশন হবে। এ ছাড়া নাকি কোনো উপায়ই ছিল না। কলকাতার খুব নামজাদা নার্সিংহোমইে ভরতি করেছে রমাকে। বাঁচা-মরা একেবারে ভগবানের হাতে।
কলকাতাতেও এ-রকম অপারেশন নাকি বড়ো একটা হয় না। হচ্ছে, তাই হই হই পড়ে গেছে পুরো নার্সিংহোমে এমনকী ডাক্তার মহলেও।
রমাকে দেখতে গেলাম সেদিনই অফিস ফেরতা। ওকে নার্সিংহোমের দুধ-সাধা বিছানার উঁচু বালিশে হেলান দেওয়া অবস্থা আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল; ও চাঁপাফুল খুব ভালোবাসে। ওর জন্যে চাঁপাফুলের তোড়া নিয়ে গেছিলাম।
রমা ফুলগুলো নিয়ে বলল, রবিদা, এবার আপনাকে বিয়ে করতেই হবে। আপনার জন্যে নয়, বলেই পরিতোষের দিকে চেয়ে বলল, ওর জন্যে। আপনার বউ যেন আপনাদের দু-জনেরই হয়। আমার অনুরোধ পান্ডব হবেন আপনারা।
পরিতোষ চাপা ধমক দিল।
ঘর ভরতি রমা ও পরিতোষের আত্মীয়স্বজনরা ছিলেন। তাঁরাও বিব্রত হলেন।
আমি বললাম, আমি বাইরে আছি কেমন? যাওয়ার আগে দেখা করে যাব।
নার্সিংহোমের করিডরে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম প্রত্যেক মানুষেরই হৃদয় থাকে। কিন্তু রমার মতো নরম, সহানুভূতিশীল সংবেদনশীল মেয়ের হৃদয় নিয়েই কাটাছেঁড়া কেন? ভগবান লোকটার সেন্স বলে কোনো পদার্থ নেই।
শনিবার ছিল। অফিস ছুটি নিলাম। সকাল সাতটার মধ্যেই নার্সিংহোমে এসে হাজির হলাম। পরিতোষ স্বাভাবিক কারণে খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। আমিও হয়েছিলাম। কিন্তু ওকে বল দেওয়ার জন্যে হইনি যে তার প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলাম।
অপারেশন আরম্ভ হবে সকাল আটটায়। শেষ কখন হবে ঠিক নেই। এ অপারেশনে নাকি দশ-বারো ঘণ্টা লাগে।
নার্সিংহোমে পৌঁছোনোর সঙ্গে সঙ্গেই পরিতোষ বলল, একটা খুব গোলমাল হয়েছে বুঝলি?
ওর গলার স্বরে চিন্তা ঝরে পড়ল।
আমি বললাম, কী?
রমার ব্লাড নেগেটিভ গ্রূপের। যদিও এখানে ওদের যথেষ্ট স্টক আছে, তবুও যদি কম পড়ে! আমার রক্ত পরীক্ষা করলাম, পজিটিভ। রমার সঙ্গে মিলবে না।
আমি বললাম, আমারটা পরীক্ষা করে নিতে বলো।
পরিতোষ মনে মনে খুশি হলেও একুট সংকোচের সঙ্গে বলল, তুই রমার জন্য রক্ত দিবি? যদি অনেক রক্ত লাগে?
পরিতোষ জানে না, রমা পরিতোষের স্ত্রী বলে আমার যেমন আনন্দের শেষ নেই, দুঃখেরও না। আজ রমার জীবন সংশয় না হলে আমি কখনো বুঝতে পারতাম না হাসি-ঠাট্টা-আড্ডার মধ্য দিয়ে কোন মুহূর্তে, কেমন করে রমাকে আমি ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি। আজ সকালে রমার জন্যে কিছুমাত্র করতে পারার সম্ভাবনাও আমাকে মনে মনে দারুণ খুশি করে তুলেছে।
আমি দেখতে ভালো না। সাধারণ চাকরি করি, চাল-চুলো নেই, কিন্তু আমি তো বদলে কিছু চাইনি রমার কাছ থেকে, শুধু ভালোবাসতেই চেয়েছি। ভালোবাসা বোধটা যে এত গভীর, এত গাঢ়, নিজের রক্তের চেয়েও গাঢ়—এই মুহূর্তের আগে কখনো যেন বুঝতে পারিনি।
আমার রক্ত পরীক্ষা করল যখন ওরা, আমার কেবল-ই মনে হচ্ছিল, আমার গ্রূপ যেন নেগেটিভ হয়। যেন রমার জন্যে, রমার কারণে আমি রক্তশূন্য হয়ে নীল হয়ে যেতে পারি। হঠাৎ এমন ভাবনাতে নিজেই আশ্চর্য হলাম।
আজকের পৃথিবীতে উঁচু ঘোড়ায় চড়ে, খোলা তলোয়ার হাতে নিয়ে শিভালরি, দেখাবার কোনো উপায় নেই। পুরুষের পুরাকালীন, সহজে দৃশ্যমান সমস্ত শিভালরি আজ এমনই ছোটো ছোটো টুকরো টুকরো সূঞ্জাতিসূঞ্জ ক্ষণস্থায়ী ও ক্ষণজন্ম অনুভূতিতে ছড়িয়ে গেছে। যখন সেই অনুভূতির শরিক হই নিজেরা তখনও যেন বুঝতে পারি না যে, এই অনুভূতিকেই ব্লো-আপ করলে আমি এই কেরানি রবি সেনই টগবগানে ঘোড়াছুটোনো প্রবল প্রতাপান্বিত বর্মাকৃত মহাবল যোদ্ধাতে রূপান্তরিত হয়ে যাব।
আমার রক্ত পজিটিভ।
রমার কোনো উপকারেই আমি আসব না।
পুরাকালটাই ভালো ছিল।
অপারেশন আরম্ভ হল। রমার হৃদয়, আমাদের সকলের হৃদয়, সার্জেনের হৃদয়, প্রত্যেকের হৃদয় ঘড়ির সেকেণ্ডের কাঁটার সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে লাগল। চলতেই লাগল।
রক্ত। রক্ত চাই রক্ত।
বেলা বারোটা বাজল দেখতে দেখতে। অপারেশন শেষ হবে কি না এবং হলেও কখন শেষ হবে তা এখনও জানার উপায় নেই। সার্জেন টাকা নেননি। নেবেন না। এ অপারেশনটা তার পৌরুষের পরীক্ষা। এ-ও এক রকমের শিভালরি।
ভেতরে কী হচ্ছে আমরা জানি না। শুধু জানি যে, জীবন ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী আঙিনায়, ওর শোবার ঘরের আর বসার ঘরের মধ্যের চওড়া বারান্দারই মতো শান্তিনিকেতন মোড়া পেতে রমা বসে আছে। ওর নিয়তির নির্দেশের অপেক্ষায়।
ঘড়ি দেখলাম। আড়াইটে। অন্য শনিবারে হলে রমা বলত, এবার চলুন তো মশায়, খেয়ে নেবেন। আপনার জন্যে কি আমার বরের গ্যাসট্রিক আলসার হবে?
পরিতোষ মিনিটে মিনিটে সিগারেট খাচ্ছে। এটাও কি একরকমের শিভালরি? না শিভালরি দেখাবার কিছুমাত্র না করতে পারার গ্লানি থেকে মুক্ত হবার পথ?
ওর আঙুলগুলো হলুদ হয়ে গেছে পুড়ে।
বললাম, কী করছিস কী?
ও বিড়বিড় করে বলল, কিছু তো করতে হয় একটা।
মাঝে মাঝে অপারেশন থিয়েটারের দরজা খুলছে। শাদা অ্যাপ্রন পরা অ্যাসিট্যান্ট একটাই শব্দ ছুড়ে মারছেন আমাদের দিকে।
রক্ত।
বারেবার।
আমরা দৌড়ে যাচ্ছি।
এক-এক বোতল কিনে আনছি।
নার্সিংহোমে আট বোতল নেগেটিভ রক্ত ছিল সবসুদ্ধু।
ওরা বললেন, আরও রক্তের দরকার হলে কিন্তু এখন থেকেই বন্দোবস্ত করুন। পুরো কলকাতা শহর ঢুঁড়েও চট করে নেগেটিভ রক্ত পাওয়া মুশকিল।
পরিতোষ ব্যাংক থেকে অনেক টাকা তুলেছে। বুকপকেট ভারী টাকায়, বেদনায়, চিন্তায়। আমার দু-হাতের পেশি ও ঘাড়ের পেশি ফুলে উঠেছে। উত্তেজনায়।
রক্ত চাই। নেগেটিভ।
এখন আমি মানুষ খুন করতেও পারি। রমাকে বাঁচানোর জন্যে রক্ত চাই।
পরিতোষ বলল, একটা ট্যাক্সি নিয়ে ব্লাড ব্যাংকে যাবি? গাড়িটা রেখে যা। কখন কী হঠাৎ দরকার হয়!
আমি হঠাৎ বলে উঠলাম, সাকচু সিং।
পরিতোষ অবাক ও বিরক্ত গলায় বলল, সে কে?
আমি উত্তর না দিয়ে বললাম, দাঁড়া।
বলেই দৌড়োলাম।
পরিতোষ বলল, টাকা নিয়ে যা।
আমি বললাম টাকা আছে।
আমিও কাল টাকা তুলেছিলাম।
দৌড়োতে দৌড়োতে মনে মনে বললাম, তুই না হয় বড়োলোক। আমি না হয় গরিবই। কিন্তু রমা কি আমার কেউ-ই নয়? তোর বউ বলেই কি ও তোরই একার? সমস্তটুকু রমাই কি তোর? আমার কি ও একটুও নয়? আমাকেও কিছু করতে দে পরিতোষ। প্লিজ, পরিতোষ। এটা আমার আনন্দ। তোর বা রমার কাছ থেকে যা পেয়েছি, পাই, তাতেই আমি সুখি। এটা পাওয়ার ব্যাপার নয়। দেওয়ার ব্যাপার। আমাকে ভুল বুঝিস না ভাই। রমার জন্যে কিছুমাত্রও করতে পারলে বড়ো ভালো লাগবে আমার।
নিজেই বললাম, নিজেই শুনলাম। পরিতোষ জানতেও পেল না। ভাগ্যিস পেল না। পেলে লজ্জিত হতাম।
ট্যাক্সিওয়ালা বলল কাঁহা?
আমি চমকে উঠলাম।
বললাম, সাকচু সিং!
কেয়া?
ট্যাক্সিওয়ালা ধমকাল আমাকে।
আমি বললাম, পার্ক স্ট্রিট।
সেদিনও ক্লিনিকে ক্যাশিয়ারবাবু, টাইপিস্টবাবু কাজ করছিলেন। আমি ঝড়ের মতো দরজা ঠেলে ঢুকে বললাম, ওদের ঠিকানা জানেন?
ক্যাশিয়ারবাবু পেনসিল হাতে শামুকের মতো ধীরে ধীরে একটা বিলের টোটাল দেখছিলেন।
আমি ধমকে বললাম, ক্যালকুলেটর কেনেন না কেন আপনারা?
ক্যাশিয়ারবাবু চমকে চোখ তুলে তাকাতেই বললাম, ওদের ঠিকানা?
কাদের ? উনি বিরক্ত ও রাগি গলায় বললেন।
বললাম, সাকচু সিং-এর। ভীষণ দরকার।
আমার বে-এক্তিয়ারের ধমকে উনি চটে গেলেন। বোধ হয় দিতেন না।
টাইপিস্টবাবু আমার চোখে তাকিয়ে ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝলেন।
ঠিকানাটা পেলাম।
বেকবাগান।
ট্যাক্সি, বেকবাগান।
সাকচু সিং বস্তির উঠোনের মধ্যে খাটিয়াতে হাঁটুর ওপর লুঙ্গি তুলে বসে একটা নেড়ি কুকুরকে কোলে নিয়ে আঠালি বাছছিল।
দড়াম করে দরজা পড়তেই বলল, কওন বে?
আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, ভাই, এক আওরাতকি জান বাঁচানো হ্যায়।
সাকচু সিং অনেক্ষণ পূর্ণদৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থাকল।
তারপর হাসল। অদ্ভুত হাসি।
বলল, তুম গলদ গল্লিমে আয়া ইয়ার। হিঁয়া জান লেনেকা মামলা লেকে আয়া, কারও জান বাঁচানেকা নেহি।
আমি বললাম, আপকা খুন নেগেটিভ। এক জওয়ান খুবসুরত আওরতকি জান বাঁচানা হ্যায়। বড়ো ভারী অপারেশান চল রহ হ্যায়।
সাকচু সিং একটা বড়ো আঠালি কুকুরটার ঘাড় থেকে ক্যাজুয়ালি তুলে খাটিয়ার পায়ায় আরও ক্যাজুয়ালি টিপে মারল।
ঘন, কালো রক্ত বেরোল আঠালিটার শরীর থেকে। ওর আঙুলেও রক্ত লাগল।
সাকচু সিং আঙুলটা আমার দিকে তুলে বলল, খুন সিরিফ খুনই হোতা হ্যায়। উসমে খাবসুরতিকা সওয়াল ক্যা? সব হি খুন লাল হোতা হ্যায়—মরদ কি, আওরত কি, কুত্তে কি,……খাটমল কি…..।
বললাম, চালিয়ে, মেহেরবানি করকে চালিয়ে। ট্যাক্সি খাড়া হ্যায়।
সাকচু সিং আমার-হেতুক আত্মবিশ্বাস ও হয়তো ধৃষ্টতাও দেখে আমার দিকে কিছুক্ষণ অবাক চোখে চেয়ে থাকল।
তারপর বলল, সাচমুচ। জানকা সওয়াল?
বললাম, সাচমুচ।
সাকচু মুখ নীচু করে কী ভাবল একটু, তারপর বলল, তব চলিয়ে।
আমি বললাম, কিতনা রুপেয়া?
সাকচু সিং একরাশ কালো আবিরের মতো আমার মুখময় ঘৃণা ছুড়ে দিয়ে বলল, ম্যায় আদমি হুঁ। জানোয়ার নেহি।
নার্সিংহোমে সাকচু সিংকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসতে আসতে ভাবছিলাম দিনের মধ্যে কত রক্তই চোখের সামনে নষ্ট হয়। মাছের রক্ত, খাসির রক্ত, ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া ন্যাপকিনে লেগে থাকা রক্ত। পৃথিবীতে এত রক্তারক্তি কিন্তু রমাকে বাঁচাবার জন্যে রক্ত পাওয়ার এত অসুবিধে?
ভাবলাম, রমার মতো যারা অসামান্য তাদের বোধ হয় আনকমন নেগেটিভ রক্ত দিয়েই পাঠান ভগবান।
নার্সিংহোমে পৌঁছেই প্যাথোলজি ডিপার্টমেন্টে বললাম, ডোনার এনেছি।
ওঁরা মুখ চুন করে বসেছিলেন। সব রক্ত শেষ হয়ে গেছে। পরিতোষ পাগলের মতো ছুটে গেছে রক্তের খোঁজে।
প্যাথোলজি ডিপার্টমেন্টের অ্যাসিস্টান্ট সাকচু সিংকে দেখে সামনেই বললেন, ভেনারের ডিজিস-টিজিস নেই তো?
সাকচু সিং বলল, নেহি নেহি, মেরা খুন সাচ্চা হ্যায়। ম্যায় সাচ্চা হুঁ।
রক্ত পরীক্ষা হল নেগেটিভ।
কিন্তু তারপরেই উনি বললেন, এখনও কত বোতল রক্ত লাগবে কে বলতে পারে? ও একা দেবে কী করে? মরে যাবে তো?
সাকচু সিং হাসল। বলল, মেরি মওত?
তারপর একটু চুপ করে থেকে স্বগতোক্তির মতো বলল, মেরি মওত ইতনি আসামিসে নেহি।
তারপরই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, লিজিয়ে খুন। কিতনা চাহিয়ে।
সাকচু সিঙের রক্তে দেখতে দেখতে বোতলটা ভরে উঠতে লাগল। ঘন কালচে—লাল রক্ত।
গুণ্ডা বদমাশদের রক্তের রং কি আলাদা? ভাবছিলাম আমি।
এমন সময় পরিতোষ দৌড়ে এসে ঢুকল। দু-বগলে দু-বোতল রক্ত নিয়ে।
হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আর পাওয়া গেল না, যাবে না।
পরক্ষণেই, সাকচু সিংকে দেখে আমার দিকে চেয়ে নাক সিঁটকে বলল, এ কী, এর রক্ত? রমার শরীরে যাবে?
এমন ভাবে বলল কথাটা, যেন সাকচু সিং রমার শ্লীলতাহানিই করেছে।
সাকচু সিং শুয়ে শুয়ে রক্ত দিতে দিতেই বলল, খুন সব বরাব্বর হোতা হ্যায় সাহাব। গরিবোঁ, আমিরোঁ, বদসুরত, খাবসুরত; সবহিকা বরাব্বর।
পরিতোষ শকড হল কথাটা শুনে। বোতল দুটো পৌঁছোতে গেল অপারেশন থিয়েটারে।
সেখান থেকে খবর নিয়ে ফিরল আরও রক্ত হলে ভালো হয়।
এক বোতল রক্ত দিয়ে উঠে বসল সাকচু সিং।
বলল, জরুরত হোগি তো ফির লিজিয়ে গা। ম্যায় তৈয়ার হুঁ। জান কবুল।
তারপর আমার দিকে ফিরেই ফিস ফিস করে বলল, আপসে ঔর ই খাবসুরত মারিজসে মুহব্বত হ্যায়? না? কিঁউ জি? দুসরা কোই রিস্তা?
আমি তাড়াতাড়ি এদিক ওদিক চেয়ে নেতিবাচক ভাবে মাথা নাড়ালাম।
ও বলল, বি-ফিক্কর রহিয়ে, ম্যায় ভাগেগা নেহি। আজতক খুন তো কিতনা বরবাদ কিয়া, মগর আজ মেরা খুনকা বড়ি ইজ্জত মিলা।
এমন সময় পরিতোষের এক বন্ধু ক্লিনিকে ঢুকে সাকচু সিঙের দিকে তাকিয়েই পরিতোষকে ইশারায় ডাকল বাইরে।
আমার সন্দেহ হতে আমিও বাইরে এলাম।
পরিতোষের বন্ধুও পুলিশ অফিসার। স্থানীয় থানার লোক।
আমাকে বললেন, একে পেলেন কোথায়? গত তিন মাস গোরু খোঁজা খুঁজে বেড়াচ্ছি। একে আমি অ্যারেস্ট করব।
পরিতোষ বলল, ডোন্ট বি সিলি। রমার জন্যে আর কত রক্ত লাগবে কে জানে? রমার কারণ যতক্ষণ ওকে দরকার ততক্ষণ ওর রক্ত চুষে নেওয়া যাক। তারপর বেরোলেই অ্যারেস্ট করিস। রমা বেঁচে উঠলে প্রমোশনের খাওয়ার নেমন্তন্ন করতে ভুলিস না।
আমি ভেতরে গিয়ে সাকচু সিঙের পাশে বসলাম।
বসলাম, কিন্তু কী করব, আমার কী করা উচিত বুঝতে পারছিলাম না।
সাকচুকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল।
বললাম, কেয়া? থক গ্যয়া?
নহি। ঠিক্কে হ্যায়। ও বলল।
পরিতোষের বন্ধুর মুখটা দরজার কাচে একবার ফুটে উঠেই সরে গেল।
আমি জানি, ও বাইরে থাকবে। ওর প্রমোশন আটকে আছে এই কাচে।
আমার সেই মুহূর্তে মনে হল, হঠাৎই মনে হল, যেন এই রুক্ষ পুরুষ অশিক্ষিত সাকচু সিংকে আমি নরম মিষ্টি সুশ্রী শিক্ষিতা রমার চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসি। চিরদিনই যেন বেশি ভালোবেসে এসেছি।
ক্লিনিকের দরজা, দেওয়াল সব যেন মিলিয়ে গেল। আমার মনে হল আমি যেন সেই পুরাকালেই ফিরে গেছি, যে যুগে মঙ্গল গ্রহের মাটি খুঁড়ত না মানুষ, হার্ট-ট্রান্সপ্ল্যানটেশান করতে জানত না, সেই যুগে আমি আর সাকচু সিং দুটো পাশাপাশি সাদা ঘোড়ায় খোলা তলোয়ার হাতে ধুলো উড়িয়ে জোড়ে ছুটে গিয়ে পরিতোষকে তলোয়ারের এক কোপে কেটে ফেলে, রমাকে মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে ঘোড়ায় তুলে নিয়ে টগবগিয়ে বুক ফুলিয়ে ফিরে আসছি। ফিরে আসছি তো আসছিই!
পরিতোষের বড়োশালা দরজা খুলে এসে আমাকে উত্তেজিত হয়ে বললেন, অপারেশন সাকসেসফুল। খুব সম্ভব রমা বেঁচে যাবে এ যাত্রা।
বলেই, সাকচু সিঙের রক্তের বোতলটা উনি নিয়ে গেলেন রমার জন্যে।
আমি জানতাম যে, রমা বেঁচে যাবে। আগে থেকেই জানতাম।
ভাবলাম আমি।
ভেবে, একটা শুঁয়োপোকার মতো নিজের ওপরই নিজে ঘৃণায় বেঁকে গিয়ে, সাকচু সিঙের দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিলাম। বড়ো ভালোবাসার সঙ্গে, গভীর কৃতজ্ঞতার আঙুলে।
সাকচু সিং যখন সিগারেটটা ধরাল, যখন আগুনটা এক এক লাফে নীচে নামতে লাগল, তখন আমার মনে হল যে সিগারেটটার সঙ্গে আমি আমার হৃদয়ের মধ্যে যা কিছু শুদ্ধ, পবিত্র, সৎ উৎপাদন ছিল তার সবকিছুর সঙ্গে কোনো কটুগন্ধ তামাকেরই মতো অতিদ্রুত পুড়ে যাচ্ছি।
ভাবছিলাম, সাকচু সিং ভুল বলেছিল, একেবারেই ভুল।
রক্তে রক্তে অনেকই তফাত!!