শিঙাল

শিঙাল

একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে এক পশলা। এখনও গাছ-পাতা থেকে টুপটাপ করে জল ঝরছে। মানুষদের আওয়াজটা পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে একসময় মিলিয়ে যেতেই একলা শম্বরটা আস্তে আস্তে ঘন জঙ্গলের ভেতর কোয়েল নদীতে নেমে এল।

এখানে জঙ্গলের রাস্তাটা নদীর ওপর দিয়ে চলে গেছে। নদীতে জল বেশি নেই। মানুষদের গাড়িগুলো এলে নদীতে চিরচির করে জল ছিটে ওঠে দু-পাশে। আর তার সঙ্গে গোঁ-গোঁ করে একটা আওয়াজ। আওয়াজটা এখন একেবারে মিলিয়ে গেছে।

শম্বরটা ওর বিরাট ডালপালা সংবলিত শিং পিঠের ওপর শুইয়ে দিয়ে মুখ ওপরে তুলে হাওয়া শুঁকল একবার। মিষ্টি গন্ধ মহুয়ার। কাছাকাছি অবশ্য মহুয়া বেশি নেই। অসময়ের বৃষ্টিভেজা হাওয়ায় হাওয়ায় বাস আসছে। যে ক-টা মহুয়া ধারেপাশে আছে, সেসব গাছের একশো গজের মধ্যেও যাওয়ার উপায় নেই। মানুষগুলো কালো কালো লম্বা লাঠির মতো কী একরকম জিনিস হাতে প্রায়ই গাছের ওপর বসে থাকে। কাছাকাছি পৌঁছোলেই গুড়ুম করে একটা আওয়াজ হয়। আর এক ঝলক আগুন।

ব্যাস, আর সেখান থেকে ফিরতে হয় না।

ভোররাতে যে এক দৌড়ে গিয়ে ভরপেট মহুয়া খেয়ে আসবে তারও উপায় নেই। সেই অন্ধকার থাকতে কোথা থেকে মানুষদের মেয়েরা এবং বাচ্চারা ঝুড়ি হাতে এসে পৌঁছোয়। মহুয়া কুড়িয়ে নিয়ে যায়। সে মহুয়া থেকে মদ তৈরি করে খায় ওরা। তারপর নাচ হয়, গান হয়, মাদল বাজে।

সন্ধ্যারাতের মাদলের গুমগুমানি পাহাড় ছাপিয়ে কাঁপতে কাঁপতে জঙ্গলের প্রত্যেক শম্বরের বুকে এসে পৌঁছোয়। ওদের বুকের মধ্যে গুড়গুড় করে।

এইরকম রাতে যখন সমস্ত বনে, পাহাড়ে, কোয়েলের কাঁচা করমচারঙা বালিতে এক চমৎকার শান্তি বিছানো থাকে, যখন শুকনো পাতা উড়িয়ে বনের বুক মুচড়িয়ে মচমচিয়ে হাওয়া বয়, দূরের পাহাড়ে ডুবে-যাওয়া চাঁদকে ধাওয়া করে কোনো টিটি পাখি ডাকতে ডাকতে উড়তে উড়তে জঙ্গলের গভীরে হারিয়ে যেতে থাকে, যখন জিরহুল আর ফুল দাওয়াইর গন্ধ ভাসে হাওয়ায়, তখন এই শিঙাল শম্বরটা একা একা বিস্তীর্ণ পাহাড়ি নির্জনে দাঁড়িয়ে অনেক কথা ভাবে।

মানুষেরা জিপগাড়ি চড়ে রাতের সহলে আসে। জানোয়ারদের রাহন-সাহানের খোঁজ নিয়ে এসে এদিকে-ওদিকে আলো ফেলে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে যায়। তীব্র আলো ছুরির ফলার মতো বনের বুক চিরে এফোঁড়-ওফোঁড় করে। মানুষদের গাড়ির ধুঁয়োর বিচ্ছিরি গন্ধে শম্বরদের নাক জ্বালা করে।

শম্বরটা গাছের আড়ালে বোবা-মুখে শান্তির সবুজ আলোয় চোখ ভরে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর হয়তো দূরের দলের কারও গায়ে গুলি লাগে। সে পুরুষ শম্বরও হতে পারে, মেয়েও হতে পারে। যার গায়ে লাগে, সে আচমকা পড়ে যায়। তারপর হয়তো উঠে পড়ার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে, পায়ের নীচে শুকনো পাতা খচমচ করে। পাথরে একটা আছাড় পড়ার শব্দ হয়। জিভটা দাঁতে কামড় খায়। তারপর হয় মানুষেরা জয়োল্লাসে তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়, নইলে ওইখানেই তাকে কেটে তার শরীরের সুস্বাদু অংশগুলো বয়ে নিয়ে যায়। পরের দিন ভোরে শকুনের ঝাঁক সেই মৃত শম্বরের অবশিষ্টাংশ নিয়ে খাবলাখাবলি করে। তার জলভেজা অর্ধগলিত চোখ দুটিকে বড়ো বড়ো ঠোঁটে ঠা-ঠা রোদে ঠক ঠক করে ঠোকরায়।

শম্বরটা, মানুষদের ঘৃণা করে।

যেদিন মানুষরা আসে না, সেদিন বাঘটা আসে। বড়ো বড়ো কালো পাথরের আর ঝুপড়ি গাছের ছায়ায় শুকনো পাতা এড়িয়ে পা ফেলে ফেলে গুঁড়ি মেরে বাঘটা একলা শম্বরটার পিছু নেয়। বাঘটা যেমনভাবে প্রায়ই ওর পিছু নেয়, বেশিদিন ও পালিয়ে বাঁচবে বলে শম্বরটার মনে হয় না।

সবসময় ভয়, কখন কী হয়, কখন কী হয়। তার ওপর এখন সে একা, একেবারে একা। ওর পুরোনো দলটা দক্ষিণের পাহাড়ের নীচের গভীর নালায় শাকুয়া আর আসন গাছের ছায়ার নীচে থাকে দিনের বেলায়। ওখানে একদল শুয়োরও থাকে। শুয়োরগুলোর প্রত্যেকের মুখ চেনে শম্বরটা। দোষের মধ্যে শম্বরটা একদিন একটা আমলকী গাছের তলায় দাঁড়িয়ে সেই ফিকে পাটকিলেরঙা মেয়ে শম্বরটার গলায় একটু মুখ ঘষেছিল। মেয়ে শম্বরটা আরামে আনন্দে একটা বড়ো নিশ্বাস ফেলেছিল। ওরও খুব ভালো লেগেছিল। ঠিক অমনিসময় দলের সর্দার শম্বর প্রকান্ড শিং নিয়ে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর শিঙে শিঙে কী খটখটি। সেই প্রচন্ড লড়াইয়ের আওয়াজ শুনে টিয়ার দল ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে গেছিল। সবুজ টুঁই পাখিগুলো ঘাস ফড়িঙের মতো উত্তেজনায় ‘টি-টুঁই টি-টুঁই’ করে চারপাশে লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল, এখনও মনে আছে। শম্বরটা তারপর একসময় লড়তে-লড়তে-লড়তে-লড়তে ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। শিঙাল সর্দারের সঙ্গে কিছুতেই ও পেরে ওঠেনি। রক্ত চুঁইয়ে পড়েছিল ওর বড়ো বড়ো লোমভরা গায়ে। পায়ের নীচের লালমাটির সঙ্গে রক্ত মিশে কাদা কাদা হয়ে গেছিল খুরের ঘায়ে ঘায়ে।

তারপর একসময় শীতের বিকেলের পড়ন্ত রোদ্দুরে টলতে টলতে তার সুন্দরী সঙ্গিনীর গায়ের গন্ধ থেকে, তার দুঃখ-সুখের দল থেকে, শম্বরের সমাজ থেকে সে চিরদিনের মতো নির্বাসিত হয়েছিল। পুরুষশাসিত শম্বরসমাজে অন্য সমর্থ পুরুষের জায়গা হয়নি এক দলে।

তারপর থেকে শম্বরটা একা একাই ঘুরে বেড়িয়েছে। ‘একরা’ হয়ে গেছে। সমস্ত রাত নদীর চড়ে দৌড়ে বেড়িয়েছে। শক্ত শাল গাছের সঙ্গে প্রহরের পর প্রহর শিং ঠুকে পরীক্ষা করেছে তার শিং শক্ত হয়েছে কি না। ও দাঁতে দাঁত চেপে বার বার বলেছে, একদিন-না-একদিন তাকে দলে ফিরে যেতেই হবে। তাকে লড়তেই হবে সর্দারের সঙ্গে। লড়ে, তাঁর শিঙের আঘাতে সর্দারকে ক্ষতবিক্ষত ভূলন্ঠিত করে সর্দার একদিন যেমন করে ওকে তাড়িয়ে দিয়েছিল দল থেকে, ওই ক্ষমতাপিপাসু সর্দারকে ও নিজে তেমনি করেই তাড়িয়ে নিজের শিঙেও ক্ষমতালিপ্সার মহার্ঘ মুকুট পরবে। ওর দলের ওপর তখন কেবল ওর একারই অধিকার থাকবে। ওর সেই পাটকিলেরঙা বান্ধবীকে তখন ও পাটরানি করবে।

এই রোজকারের ব্যায়াম, একা একা, সশব্দ মানুষকে এবং শব্দহীন বাঘকে বাঁচিয়ে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করে করে শম্বরটা আগের থেকে অনেকটা সবল হয়ে উঠেছে। আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। যেদিন দল থেকে নির্বাসিত হয়েছিল, সে-রাত জঙ্গলে-পাহাড়ে একেবারে একা একা কী দারুণ ভয়ে আর আশঙ্কায় যে কেটেছিল তা আজও শম্বরটার মনে আছে।

কোয়েল নদীর বালিময় বুকে চাঁদনিরাতে একা একা হাঁটতে হাঁটতে শম্বরটা প্রথম প্রথম দাঁতে দাঁত ঘষত। সর্দারের ওপর ওর প্রথম প্রথম ঘৃণা হত। কিন্তু ইদানীং ও কেমন যেন বুঝতেও পারে সর্দারকে। একটু যেন শ্রদ্ধাও হয় সর্দারের ওপর। শ্রদ্ধা হয়তো হত না, যদি ও এতদিন তিল তিল করে সর্দারের প্রায় সমকক্ষ না হয়ে উঠত। নিজে একা একা বাঁচার চেষ্টা করে আজ শম্বরটা বুঝেছে যে, নিজে বাঁচাই যদি এত কঠিন হয় তো অতবড়ো দল, মেয়ে ও বাচ্চা শম্বরে ভরা দলকে বাঁচাবার দায়িত্ব কতখানি!

গরমের সময় সর্দারকে হাতির দলের পথের চিহ্ন দেখে কুটরা, বাইসন, চিতা সকলের সঙ্গে মরুভূমির মতো লু-বওয়া বনে বনে যখন জলের সন্ধানে ঘুরতে হয়, জলের কাছাকাছি থাকতে হয়, তখন জলের কাছাকাছি বাঘও থাকে। বাঘের হাত থেকে দলের সকলকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় প্রতিদিন, প্রতিরাত, প্রতিমুহূর্ত। আবার বর্ষার দিনে পাহাড়ি নদীর ঢল বাঁচিয়ে কোথায় কী খাবার আছে তার খোঁজে ফিরতে হয় সকলকে নিয়ে। বুনো কুকুরের দল যখন আসে, তখন দলের ছোটো-বড়ো সকলকে বাঁচাবার দায়িত্ব সর্দারের ওপরই পড়ে। তারপরে একদিন যখন শীত আসে, পাহাড়ের উপত্যকার খেতে খেতে যখন গেঁহু-বাজরা লাগে, কুলথি লাগে, সুরগুজা লাগে, যখন অড়হরের খেতের গন্ধ শীতের শেষরাতের কুয়াশায় ভাসতে থাকে, তখন পাহারাদার গাঁ-ওয়ালাদের পাহারা এড়িয়ে, শিকারি মানুষের চোখ বাঁচিয়ে এতবড়ো দলকে সামলে নিয়ে ভালো-মন্দ খাবার খুঁজে বেড়াতে হয়। যখন গরম অসহ্য হয়, যখন পাহাড়ে পাহাড়ে দাবানল জ্বলে, জঙ্গল-কে-জঙ্গল হু-হু আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়, সেই সময় পোড়া গাছ ধোঁয়া আর আগুনের তাপ ছাড়িয়ে দূরে— অনেক দূরে, কোনো ঠাণ্ডা ছায়ার উপত্যকায় সারাদলকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বও তখন সর্দারের ওপরই পড়ে।

শম্বরটা ভাবে, তবু সর্দার হলে নিজের দায়িত্বে দলকে নিয়ে যা খুশিও করা যায়। কোনো সুন্দর ছবির মতো শীতের দুপুরে পালামৌর জঙ্গলের আমলকী গাছের ছায়াভরা কোনো পাহাড়ি মালভূমিতে সমস্ত দলকে নিয়ে ছুটোছুটি করে খেলে বেড়ানো যায়, আরও কত কী, কত কীই করা যায়।

একদিন-না-একদিন শিঙাল শম্বরটা তার দলে ফিরে যাবেই। তার দলের সর্দার সে হবেই। প্রায়ই রাতে তাই শম্বরটা স্বপ্ন দেখে যে, ও টিলার ওপর শিং উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর সর্দার ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত শরীর নিয়ে অপমানের বোঝায় মাথা নামিয়ে ধীরে ধীরে টিলা বেয়ে তার দল ছেড়ে কোনো অজানা বনের দিকে চলে যাচ্ছে।

অনেকক্ষণ ধরে এসব কথা ভাবছিল শম্বরটা। ভাবতে ভাবতে ও খুব রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। নিজের মনে একেবারে হেসে উঠল ‘ঘ্যাক ঘ্যাক’ করে। নিস্তব্ধ রাতে নদীর কোলের সে আওয়াজ দু-ধারের উঁচু পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পুবের পাহাড়ের নীচে ঝোপেঝাড়ে একটা টিটি পাখি ডাকতে ডাকতে উড়তে লাগল। একটা কুটরাহরিণের ভয় পাওয়া ডাক কানে এল, ‘ব্বাক ব্বাক’। শম্বরটা একদৌড়ে নদীর এপাড়ে এসে গাছের আড়ালে গিয়ে, ওই দিকে সাবধানে চেয়ে রইল বাঘের মতলব বোঝার আশায়।

দুই

সকাল থেকেই আজ আকাশ মেঘলা। সন্ধ্যার পর মাঝে মাঝে একফালি চাঁদ উঁকি মারছে জঙ্গলের মাথায়, তারপরই আবার কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। বিকেলের দিকে খুব এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। পাথুরে মাটিতে জল পড়ার পর থেকে সেই মিষ্টি গন্ধটা মাটি ছেড়ে উঠে জঙ্গলময় ছড়িয়ে গেছে। একটা এলোমেলো ভিজে হাওয়া বনের শাখাপ্রশাখা ঘাস-পাতা উথালপাতাল করছে।

শম্বরটা ওদের পুরোনো আস্তানার দিকে এগিয়ে চলেছে। দু-দুটো পাহাড় পেরিয়ে যেতে হবে।

কতক্ষণ চলেছে মনে নেই শম্বরটার, তবে এখন চেনা পটভূমিতে এসে গেছে। সেই বড়ো শাকুয়া গাছটা। আসন আর পিয়াশালের জঙ্গল। পশ্চিমের পিটিসঝোপে ভরা টিলা। সব, সবই খুব চেনা মনে হচ্ছে।

শম্বরটার বাবার ঠিক নেই। ও কানীন।

যে শিঙালসর্দারকে পরাজিত করবে বলে ও আজ দলের কাছে ফিরে এসেছে, সে ওর বাবাও হতে পারে। যে মেয়ে শম্বরটাকে ওর ভালো লেগেছিল। দলের সেই পাটকিলে শম্বরিটা, সে তার বোন অথবা মা-ও হতে পারে। শম্বরদের সমাজে মা-বাবা, স্ত্রী-পুত্র, ভাই-বোন কিছু নেই। শুধু বাচ্চা আছে আর ধাড়ি আছে। মরদ আছে আর মাদি আছে। যেখানে মেয়ে শম্বরেরা থাকে, সেখানেই ক্ষমতার প্রশ্ন থাকে, সেখানে একসঙ্গে দু-জন মস্তান থাকতে পারে না। যার শিঙে জোর বেশি, শুধু সেই পুরুষই থাকে। মাত্র এক-জন।

এবার বেশ কাছাকাছি পৌঁছে গেছে শম্বরটা। আর একটু গেলেই সেই টিলাটায় পৌঁছে যাবে। তারপরই নালাটা। হঠাৎ শিঙালটার নাকে জিপগাড়ির পেট্রোলের এবং অন্য কিছু-একটা বিচ্ছিরি পোড়া পোড়া গন্ধ এল। শম্বরটার নাক জ্বালা করতে লাগল। ও সাবধানে আর একটু এগোতেই দেখল টিলার নীচে নালার পাশে, জঙ্গলের দিকে ওর পুরোনো দলের প্রায় সব শম্বর-শম্বরি অন্ধকারে গোল হয়ে কী যেন ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ ওইখানে দাঁড়িয়ে সে সর্দারকে খুঁজতে চেষ্টা করল ভিড়ের মধ্যে। কিন্তু দেখতে পেল না। তখন তার শিং দুটোকে তার চওড়া কাঁধের ওপর শুইয়ে, আত্মবিশ্বাসের ধীর পায়ে শম্বরটা ওর দলের কাছে গিয়ে পৌঁছোল।

ওকে দেখতে পেয়েই সকলে ওকে জায়গা করে দিল। শম্বরটা দেখল যে, শিঙাল সর্দার হাঁটু মুড়ে কাত হয়ে আধশোয়া ভঙ্গিতে মাটিতে পড়ে আছে। সর্দারকে মানুষরা গুলি করেছিল। কিন্তু গুলিটা পেটে লেগেছিল বলে বড়ো রাস্তা থেকে এত দূরে সে পালিয়ে আসতে পেরেছে। সর্দারের নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে গেছে। শাল গাছের চারায় আটকে আছে। শিঙাল সর্দারের দু-চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে।

শম্বরটা আস্তে আস্তে সর্দারের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। শম্বরটার মনে হল, সর্দার যেন তার জন্যেই অপেক্ষা করছিল, সর্দারের চোখে ‘তোমারই সব রইল, এদের মালিক তুমি’ গোছের একটা ভাব ফুটে উঠল। পরক্ষণেই সর্দারের লম্বা গ্রীবা ও প্রকান্ড মাথা মাটিতে আছড়ে পড়ল। দলের সব পুরুষ ও মাদি শম্বর নি:শব্দে মৃত শিঙালটার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল।

শম্বরটা ওর চারদিকে চেয়ে দেখল। তার পুরোনো দল, তার পাটকিলেরঙা বান্ধবী। ওরা সকলেই তার আদেশের প্রতীক্ষায় মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে যেন!

যে দলের সর্দারি করার স্বপ্ন দেখেছে ও দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, যে সুন্দরী শম্বরির গায়ের গন্ধ সে পেয়েছে কল্পনায়, তারা সকলে প্রত্যেকে, তাদের নতুন সর্দারের কাছে বাধ্যতা, আনুগত্য ও শ্রদ্ধার শপথ নিয়ে তার দিকেই চেয়ে আছে।

শম্বরটা মেঘলা আকাশে নীচের এলোমেলো বৃষ্টিভেজা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর ধীরে ধীরে টিলা ছেড়ে নেমে যেতে লাগল।

সেই সুন্দরী শম্বরি চোখ তুলে নরম করে চাইল। বোধ হয় বলতে চাইল, কোথায় চললে?

শম্বরটা কান নাড়াল। বলল, জানি না।

ওরা সমস্বরে বলল, তার মানে? তুমি কি আমাদের সর্দার হবে না?

শম্বরটা হাসল। তারপর বলল, না।

তবে আমাদের সর্দারি কে নেবে?

শিঙালটা নামতে নামতে মুখ ঘুরিয়ে বলল, হয়তো নতুন কেউ আসবে অন্য কোনো দল থেকে বিতাড়িত হয়ে, হয়তো তোমাদের দলেই কেউ সর্দার হয়ে উঠবে। আমি জানি না।

ওরা সকলে বলল, না! আমরা তোমাকে চাই।

শম্বরটা হাসল, ‘ঘবাক ঘবাক’ করে। বলল, চললাম। তোমরা সব ভালো থেকো। বাঘটা কাছাকাছিই আছে। মানুষরাও আবার আসতে পারে।

সেই পাটকিলে শম্বরি ওর পিছু পিছু অনেকখানি এল। ওকে বার বার শুধোল, তুমি কেন যাচ্ছ বলে যাও, কোথায় যাচ্ছ বলে যাও।

শম্বরটা দাঁড়িয়ে পড়ে শম্বরির গলায় জিভ দিয়ে একটু আদর করে দিল। তারপর বলল, নতুন দলের খোঁজে যাচ্ছি। যে দলের শিঙাল সর্দার এখনও জীবিত আছে। যে আমাকে দেখেই রুখে দাঁড়াবে। যার রক্তে আমাকে রক্তাক্ত হয়ে তারপর সর্দারি পেতে হবে।

শম্বরি অবাক হয়ে বলল, কেন? সর্দারি তো তুমি এমনিতেই পাচ্ছ। তার জন্যে মিছিমিছি রক্তারক্তি করবে কেন?

শম্বরটা টিলার প্রায় নীচে নেমে এসে বলল, তুমি বুঝবে না। বিশ্বাস করো, বললেও তুমি বুঝবে না।

ততক্ষণে আকাশে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে একফালি চাঁদ আবার উঁকি দিয়েছে। ঝোড়োবাতাসে শিঙাল শম্বরের তাজা রক্ত ও নাড়িভুঁড়ির গন্ধ ভাসছে।

শম্বরটা টিলা থেকে নেমে এসে যে পথে এসেছিল সে পথে আবার ফিরে চলল। কোথায়, তা ও জানে না।

বাঘটা পথের পাশের একটা বড়ো পাথরের আড়ালে এতক্ষণ সামনে দু-থাবার ওপরে মুখ রেখে শুয়েছিল। আড়মোড়া ভেঙে উঠে, এবার লাফিয়ে পথে নামল। তারপর গাছের ছায়ায়, সাবধানি পা ফেলে ফেলে শিঙাল শম্বরটার পিছু নিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *