বুলির ‘পা’
রাসবিহারী অ্যাভিন্যু আর ল্যান্সডাউন রোডের মোড়ে আলোতে গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল। জানালার পাশে বসে উদ্দেশ্যহীন ভাবে চেয়েছিলাম মোড়ের দিকে। হঠাৎই মনে হল, যেন পারুলকে দেখলাম।
সোডিয়ামে ভেপার ল্যাম্পের আলোয় জানুয়ারির মাঝামাঝির ধোঁয়াশা আর ডিজেলের ধোঁয়াকেও সুন্দর দেখাচ্ছিল। দেখলাম, শেয়ালরঙা ছেঁড়া র্যাপারখানি গায়ে জড়িয়ে পারুল হেঁটে যাচ্ছে প্রিয়া সিনেমার দিকে। ক্লান্তিতে ন্যুব্জ। রোগাও হয়ে গেছে অনেক। হাতে একটি লাঠি।
বুকটার মধ্যে এমন করে উঠল যে, কী বলব! লোকলাজ ভুলে চিৎকার করে ডাকতে ইচ্ছে করল পারুলের নাম ধরে। উত্তেজনায় সিট থেকে প্রায় উঠেই দাঁড়িয়েছিলাম। পরক্ষণেই আস্তে আস্তে বসে পড়লাম।
পারুলই তো…..।
অনেক কিছুই বলার ছিল ওকে। কিন্তু যেসব কথা তামাদি হয়ে গেছে সে-কথা আর বলা যায় না কাউকেই। ওকে আমার দেওয়ারও ছিল অনেক কিছু। কিন্তু দেওয়ার সময়েরও একটি সময়সীমা থাকেই, পাওয়ার সময়েরই মতো। সেই সময়ের মধ্যে দেওয়া বা পাওয়া না হলে এই এক জীবনে তা দেওয়া বা পাওয়া বোধ হয় হয়ে ওঠে না।
আলো সবুজ হতেই গাড়ি এগোল ড্রাইভার। যাকে পারুল বলে ভেবেছিলাম, তার কাছে চলে গিয়ে পাশ কাটিয়ে গাড়ি এগিয়ে গেল। বুকের গভীর থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস উঠে এসে বাইরের ধোঁয়াশায় মিশে গেল।
মনে মনে বললাম, পারুলের জন্যে আর কিছুমাত্রই করতে এ জীবনে পারব না। তার অভিশাপ বাকি জীবন আমাকে বয়ে বেড়াতেই হবে। আমার চেয়েও বেশি হয়তো রিমাকে। পারুল কিন্তু কোনোদিনও মুখে কিছুই বলেনি আমাকে। তবু, মনে হয়।
বাড়ি ফিরে চান-টান করে খাওয়ার টেবিলে যখন খেতে বসলাম তখন খেতে খেতে আমি বললাম, আজ ঠিক পারুলের মতোই একজনকে দেখলাম, জানিস বুলি।
পারুলদি?
আমার কিশোরী মেয়ে বুলি খাওয়া থামিয়ে চমকে উঠল।
বুলি, আমার একমাত্র মেয়ে, এখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। একমাত্র ছেলে চুপুও খাওয়া থামাল। মুখে কেউই কিছুই বলল না।
রিমা বলল, খাওয়ার সময় পারুলের কথা না বললেই হত নাকি? আজ জগু কড়াইশুঁটির চপটা কেমন করেছে তা তো খেয়ে বলবে? সারাটা দুপুরই ও এই নিয়ে মকশো করেছে। পুর নিয়ে অনেকই এক্সপেরিমেন্ট। পুরটা বানানো আর ভাজাটাই আসল। পুরে গোলমরিচের গুঁড়ো দিয়েছে। জানো?
বুলি বলল, যেমনই করুক জগুদা, আর যাই-ই দিক পারুলদির মতো কড়াইশুঁটির চপ কেউ করতে পারেনি আজ অবধি। আর পারবেও না।
সকলেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। খাওয়া বন্ধ করে। হাত থামিয়ে। একেই বোধ হয় সভা-সমিতিতে বলে ‘মৃতের আত্মার প্রতি সম্মান জ্ঞাপনার্থে দুই মিনিট নীরবতা পালন।’
কোনো মৃতকেই মানুষ চিরদিন মনে রাখে না। মহান মানুষেরা হয়তো তাঁদের কীর্তির মধ্যে বেঁচে থাকেন অনেক দিন। আর পারুল অথবা আমার মতো সাধারণ বেঁচে থাকে কড়াইশুঁটির চপ অথবা প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকাটার পুরোটাই ধার হয়ে যাওয়ার পারিবারিক শোকের মধ্যে।
খাওয়া-দাওয়ার পর রিমা বলল, টিভি দেখবে?
বুলি বলল, ওর অনেক পড়া। পড়বে।
বুলি চলে গেল। চুপুও উঠল। আমাদের বাড়ির চারটে বাড়ি পরেই মাল্টিস্টোরিড বাড়িতে স্নিগ্ধাদের ফ্ল্যাটের ভি. সি. আর-এ মোৎর্জাট-এর জীবনীর ওপর যে-ছবিটি সাড়া জাগিয়েছে তাই দেখতে যাবে ও। ‘অ্যামিডিয়াস’ নাকি যেন!
খাওয়ার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে শোয়ার ঘরে এসে আমি জানালার পাশে চেয়ার টেনে বসলাম।
একসময় আমি ভাবতাম যে, এক-জন আধুনিক নগরভিত্তিক মানুষের জীবনের সব চেয়ে বড়ো লজ্জা হচ্ছে তার একঘেয়েমি। এই প্রাত্যহিক, মানডেন মিনিংলেস দিনগুলি রাতগুলির গতানুগতিকতা তাদের প্রত্যেককেই সব সময় ক্লিষ্ট করে রাখে। কিন্তু পারুলের মতো কারওর কথা যেই মনে হয়, তখন মনে হয় যে, তারা সকলেই আমারই মতো নিশ্চয়ই বোঝে যে, মানুষের লজ্জাকরতম লজ্জাটি হচ্ছে তার অহংবোধ।
পারুল আজ থেকে পনেরো বছর আগে আমাদের বাড়িতে এসেছিল। তখন চুপু ছোটো। বুলি হয়ইনি। চাকরিতে আমার এত পদোন্নতিও হয়নি। পারুল এসেছিল রাঁধুনি হিসেবে। তারপর নিজের গুণে ও আন্তরিকতায় কী করে যে সে হাউসকিপার, বেবি সিটার, কেয়ারটেকার, আয়া, দারোয়ান একইসঙ্গে সবকিছুই আস্তে আস্তে উঠেছিল তা আমরা লক্ষ পর্যন্ত করিনি।
পারুলের ওপরে বাড়ি ছেড়ে আমরা কত জায়গায় বেড়াতে গেছি। বুলি যখন ছ-মাসের তখন তাকে পারুলের জিম্মাতেই রেখে মধ্যপ্রদেশে বেড়াতে গেছিলাম একবার। বন্ধুবান্ধব সকলেই শুনে অবাক হয়ে গেছিল। কিন্তু কী করব! যৌথ পরিবার থেকে বেরিয়ে এলে আর সেখানে ফেরা যায় না। কেউ ফিরিয়েও নেয় না। পারুলরাই অবলম্বন আমাদের। রিমারও তখন খুবই বেড়াবার শখ ছিল। পারুল আমাদের পরিবারেরই এক-জন হয়ে গেছিল।
বুলি কথা বলতে শেখার পর পারুলকে প্রথমে ‘পা’ বলে।
পারুল হেসে কথা বলত, কোন ‘পা’-রে বুলি? ডান, না বাঁ?
আরও একটু কথা শেখার পর বুলি বলত ‘পারু’। পারুল হাসত। বলত, আমাকে দেবদাসের পারু করে দিলে গো! বুড়ি বড়ো হয়ে যাওয়ার পর অবশ্য পারুদি বলেই ডাকত। পারুলদির সঙ্গে বুলির যে-ধরনের সখ্য, মমত্ব ও স্নেহের সম্পর্ক ছিল তা হয়তো তার মায়ের সঙ্গেও ছিল না। পরবর্তী জীবনের তার কোনো প্রিয় সখীর সঙ্গেও বোধ হয় হয়নি। ভূতের ভয় থেকে বয়ঃসন্ধির ভয়ের কথার সব কিছুই বোধ হয় বুলি পারুর কাছেই শুনেছিল। রিমার সময় ছিল না।
পারুলের নিজের ছেলে ছিল একটি। সে দশ বছর বয়সে নাকি কলেরাতে মারা যায়। অনেকই বছর আগে। পারুলদের বাড়ি ছিল লঞ্জীকান্তপুর না ক্যানিং কোথায় যেন! দোকনো ভাষায় কথা বলত। পান খেত, বাড়িতে বানিয়ে। দোক্তা দিয়ে। প্রতিমাসেরই এক তারিখে দু-টি ষণ্ডা-গুণ্ডা ছেলে আসত পারুলের কাছে মাইনের টাকা নিতে। তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে থাকত যতক্ষণ না টাকাটা হস্তগত করে। পারুলকে আমরা পুজোর সময়ে এবং পয়সা বৈশাখে নতুন শাড়ি-জামা ইত্যাদি ছাড়াও দু-মাসের মাইনে বোনাস হিসেবে দিতাম এবং দিয়ে শ্লাঘা বোধ করতাম। টাকা ও যাই-ই পেত, ওই ছেলে দুটিই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই নিয়ে যেত। পারু দশ-বিশ টাকা রাখত নিজের কাছে। হয়তো হাতখরচা হিসেবেই। মাস পয়লা ছাড়াও নানা দরকারে মাসের মধ্যে একাধিকবার ছেলে দুটি এসে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে ডাকত পিসি! অপিসসি।
রিমা বলত, পারু তোমার বুড়ো বয়সে কী হবে? সব টাকাই ওদের দিয়ে দাও কেন? একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করে দিই, তাতে রাখো।
পারুল হাসত। বলত, কী যে বলো দিদি। ওরাই তো আমার সব। আপন ভাইপো। ওরাই দেখবে। আমার আর আছেটা কে? তারপর বুলি আর চুপুর দিকে চেয়ে বলত, ওরাও দেখবে। কী? দেখবে না? ওরাই তো সব চেয়ে আপন আমার। আমার ভাইপোদের চেয়েও অনেক বেশি।
বুলি আর চুপু কিছু না বুঝেই বলত, নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই।!
পারুলের দু-পায়ের আর্থরাইটিস ছিল। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্লাডপ্রেসার অস্বাভাবিক রকম বেশি হয়ে গেল। হাঁটতে লাগল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ভাইপোরা এসে প্রায়ই এটা করতে হবে, সেটা করতে হবে, ওটা করতে হবে বলে উপরি টাকা নিয়ে যেতে লাগল। টাকা অবশ্য রিমাই দিত। স্কুলের এবং কলেজের সময়ের মধ্যে রান্না করে উঠতে পারত না পারুল প্রায়ই। অফিসেও আমাকে প্রায়ই না খেয়েই যেতে হত। রিমা এবং আমি ক্রমশই বিরক্ত হয়ে উঠতে লাগলাম মানুষটার ওপরে মাত্র দুটি মাসেই। অবলীলায় ভুলে গেলাম যে দীর্ঘ পনেরো বছর সে আমাদের জন্যে কী করেছে আর করেনি।
একদিন রিমা রাতে আমাকে ডেকে বলল, বুঝলে, একটি অল্পবয়সি মেয়ে পেয়েছি। লাজুক প্রকৃতির, স্বভাবও ভালো। চুপু এখন বড়ো হচ্ছে তো। তাই কুৎসিত দেখতে বলেই ওকে রাখব ঠিক করেছি। খালি বাড়িতে থাকবে। আগুন নিয়ে খেলা আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না।
আমি বললাম, কী যে বলো! কিন্তু পারুলকে কী করবে?
ওকে তিন মাসের মাইনে দিয়ে ছুটি দিয়ে দেব। এ বাজারে তো আর কাউকে বসিয়ে খাওয়ানো যায় না। মানুষ নিজের মা বাবাকেই আজকাল বসিয়ে খাওয়াতে পারে না, তার কাজের লোককে।
ওকে কে দেখবে?
কেন? ওর ভাইপোরা। তারাই তো ওর সব। তা ছাড়া এত বছর পারুলকে আমরা কম টাকা তো দিইনি। শুনেছি ওর গ্রামে না কোথায় পাকাবাড়িও করে নিয়েছে পারুল। তা ছাড়া সারাজীবন দেখবার দায়িত্ব গভর্নমেন্টই নেয় না তো আমরা নেব কোত্থেকে।
আমি বললাম, একদিন আমরা গিয়ে দেখে এলেই তো পারি পারুলের বাড়ি সত্যি আছে কি না। ওর খোকা আর খোকনরা তো ওকে ঠকাতেও পারে।
তোমার মতো অত প্রেম আমার নেই। কালকে আমার অবস্থা যদি পারুলের মতো হয় আমার প্রিন্সিপালও কি আমাকে বিদেয় করে দেবেন না? তিন মাসের মাইনেও দেবেন কি না সন্দেহ। সবাই তো আর তোমার মতো ভালো কোম্পানির চাকরি করে না। অত ভাবলে চলে না। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে সকলকে যেতেই হয়ই। তা ছাড়া নতুন কাজের লোকটি কোথায় থাকবে? কোয়ার্টার তো একটিই! এ কী তোমাদের বাড়ি, যে প্রচুর ঘর? একতলার একটা ঘর পারুকে দিয়ে দেওয়া যেত। আমাদের এই টু বেডরুম মাল্টিস্টোরিড ফ্ল্যাটে এক্সট্রা একজন মানুষেরও তো জায়গা নেই।
পারুলও খুব কেঁদেছিল। ওর কান্নার শব্দ কোনোদিনই কেউ শুনতে পেত না। কিছু কিছু নারীর কান্না ওইরকমই হয়, সমুদ্রপারের বৃষ্টির মতো।
তারপর একদিন—লাল গোপাল আঁকা ওর ছোট্ট টিনের তোরঙ্গটি নিয়ে বুলির থুতনি ছুঁয়ে চুমু খেয়ে আশীর্বাদ করে হেলতে দুলতে পারুল সত্যিই চলে গেছিল।
আর্থরাইটিসের জন্যেই ও অমনি হেলেদুলে চলত, নইলে চলতে পারত না। মোটাও হয়ে গেছিল প্রচন্ড।
বুলি কিন্তু ফিসফিস করে কাঁদেনি। ডাক ছেড়েই কেঁদেছিল সে-দিন। শিশুর কাছে ঘোড়েল এবং বিষয় ও স্বার্থবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্কদের যুক্তি আদৌ গ্রহণীয় হয়নি। যখন তখন পথেঘাটে পড়ে পারুল মারা যেতে পারে, একথা জেনেও তাকে কেন যে এমন করে ছাড়িয়ে দিলাম এ নিয়ে ছোট্ট বুলি তার মায়ের সঙ্গে ঝগড়াও করেছিল খুবই।
খাবার টেবিলে বসে বুলির দিকে চেয়ে আমি ভাবছিলাম যে, একদিন বুলিও অবলীলায় রিমা হয়ে উঠবে। আমাদের সমাজব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, আমাদের বিবেককে, শুভবুদ্ধিকে নিজস্বার্থের কাছে নীরবে এবং নেপথ্যে বলি দেওয়াবে। পাতি বুর্জোয়াদের ভিড়ের মধ্যে শামিল হয়ে যাবে বুলিও।
সে রাতে পথে পারুলকে দেখার মাস দুয়েক পরে আমার বন্ধু সীতেশ ফোন করে বলল যে, পারুল নাকি লাঠি ঠকঠকিয়ে ওর বাড়ি গেছিল কিছু সাহায্যের জন্যে। পাশের বাড়ির কাজের লোক মতি, পারুলের গ্রাম চিনত। তাকে দিয়ে এক রবিবার খবর নিতে পাঠালাম। সে এসে বলল, পারুলকে তার ভাইপোরা তাড়িয়ে দিয়েছে। পারুলের পনেরো বছরের রোজগারের প্রতিটি টাকাতে তারা ধান-জমি, বাড়ি, গোরু সবই করে নিয়েছে। তাদের বউদের সঙ্গে পারুলের বনেনি বলে তারা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে পিসিকে। পারুল এখন নাকি লেক-এর কাছে সার্দান অ্যাভিন্যুর ফুটপাথের এক গাড়ি বারান্দার নীচে রাত কাটায় এবং সারাদিন নাকি পথে পথে ভিক্ষা চেয়ে বেড়ায়।
কথাটা শুনে বড়ো ভয় হল। না, পারুলের জন্য নয়, বন্ধু ও পরিচিতেরা আমাদের সম্বন্ধে কী আলোচনা করবে তা ভেবে।
পরদিনই অফিস থেকে ফেরার পথে ড্রাইভারকে বললাম, সার্দান অ্যাভিন্যুতে যেতে। তখন সন্ধে হয়ে গেছে। দেখি, দুটি ইটের ওপরে বসানো একটি পোড়া কালো মাটির হাঁড়িতে শুধু ভাত সেদ্ধ করছে পারুল। দেখলে ওকে চেনা যায় না। মনে হয়, যেন জন্মানোর পর থেকেই ও ভিক্ষা করছে। ভিখিরিদের বুঝি অতীত থাকে না কোনো!
পারুলকে বাড়িতে দেখা করতে বলে এলাম পরদিন সকালে। গাড়ি থেকে নেমে ভিখিরির সঙ্গে কথা বলা যায় না। কে কোথা থেকে দেখে ফেলবে। কী মনে করবে আমাকে। পারুল বলল, অতদূর যে যেতে পারবোনি দাদাবাবু। লাঠি নিয়েও চলতে পায়ে বড়োই লাগে। তা শুনে ওকে দশটা টাকা দিয়ে বললাম, রিকশা করেই এসো।
পরদিন রিকশা করে কিন্তু এল না পারুল। হেঁটেই এল। টাকাটা বাঁচিয়েছে। ভিখিরি হয়ে গেলে মানুষ মিথ্যেবাদীও হয়ে যায় বোধ হয়। দশটা টাকা অনেকের কাছে অনেকই টাকা। ছেঁড়া দুর্গন্ধ, নোংরা শাড়ি। পা-ময় গা-ময় ধুলো। রিমা তো ওকে ঝকঝকে বসার ঘরে ঢুকতে পর্যন্ত দিল না। বাইরে বারান্দাতেই বসিয়ে রাখল। বলল, কত রোগের জার্মস যে ওর পায়ে থিক থিক করছে কে জানে।
আমি পারুলকে বললাম, তোমার কী ক্ষতি করেছি আমরা যে, তুমি আমার বন্ধুর বাড়ি গিয়ে ভিক্ষা চাও? এতে কি অসম্মান করা হয় না আমাদের?
পারুল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল আমার মুখের দিক চেয়ে।
তারপর বলল, সম্মান-অসম্মানের কথা তো ভাবিনি দাদাবাবু। খিদে তো বড়ো ভীষণ জিনিস। কী করে বোঝাব আপনাদের।
রিমা বলল, ছি: ছি: তুমি এত নীচ।
পারুল চুপ করে রইল। ওর দু-চোখ বেয়ে জলের ধারা নামল। আবারও ফিসফিসে বৃষ্টি নামল সমুদ্রপারে।
রিমার অলক্ষ্যে গাড়িতেই ওকে তুলে নিয়ে আমাদের ফ্যামিলি ফিজিসিয়ানের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করিয়ে প্রেসক্রিপশন লেখালাম। উনি ওর হিসট্রি জানতেন। নানা রোগ এসে বাসা বেঁধেছে পারুলের মধ্যে। বয়সও হয়েছে ষাটের বেশি। দু-মাসের মতো ওষুধ কিনে দিলাম ওকে। তারপর একশো টাকা দিয়ে বললাম, পারুল, তোমাকে প্রতিমাসে আমি পঞ্চাশ টাকা করে দেব। প্রতিমাসের তিন তারিখে এসে নিয়ে যেয়ো। অথবা তুমি রাতে যে গাড়ি বারান্দার নীচে থাকো সেখানেই কাউকে দিয়ে পৌঁছে দেব।
দাদাবাবু, আপনি বড়ো দয়ালু।
সেই বাক্যটি এবং পারুলের রোগপান্ডুর জলভরা চোখ দুটি প্রায়ই কানে এবং চোখে ফিরে ফিরে আসে আমার।
এই বন্দোবস্ত চলল দু-মাস। তারপরই একদিন রিমা বাড়ি ফিরেই তুলকালাম কান্ড বাধাল। ওর খুড়তুতো দাদা প্রদীপের বাড়িতে গিয়েও নাকি পারুল ভিক্ষে চেয়েছে কাল সকালে। প্রদীপের স্ত্রীকে রিমা একেবারেই দেখতে পারে না। রিমার ধারণা, বড়োলোকের মেয়ে বলে দেমাকে পা পড়ে না মাটিতে। আপস্টর্ট। অশিক্ষিত। সে কলকাতার সকলকে বলে বেড়াচ্ছে যে, অ্যাই তো! দ্যাখো! কী শিক্ষিত বড়োলোকই না রিমারা! যে-মানুষটা এত কিছু করল এতদিন ধরে তার আজ এই দশা! সম্মানেও কি লাগে না? কেমন ছোটোমানুষ বলো তো?
আমার মাসতুতো দাদার বাড়ি সার্দান অ্যাভিন্যুতে। সেও বলল একদিন যে, পারুল লাঠি ঠকঠকিয়ে ভিক্ষা চাইতে গেছিল তার কাছেও। পারুল নাকি বলেছিল, দাদাবাবু দিদি খুবই দয়ালু। আমাকে মাসে পঞ্চাশ টাকা করে দেন। বলেছেন, দেবেন। যতদিন বাঁচি। কে দেয় বলুন? কিন্তু পঞ্চাশ টাকাতে তো খাওয়া এবং ওষুধ চলে না। এমনকী ফুটপাথে থেকেও চলে না। তারপর জাতে মেয়ে তো। শরীর ঢাকতেও তো এক বিরাট খরচ!
মাসতুতো দাদার কাছে শুনে আমারও বড়োই রাগ হল। আমার পরিচিত কারও কাছে না যেতে বলা সত্ত্বেও পারুল তবু গেছে ভিক্ষা করতে আবারও!
পরের মাসে টাকা নিতে এল না কিন্তু পারুল। আমিও ড্রাইভারকে দিয়ে সার্দান অ্যাভিন্যুতে টাকা পাঠালাম না। রাগ করেই। সত্যিই বড়ো অপমানিত বোধ করেছিলাম।
চুপুর এক বন্ধু চুপুকে স্কুলে বলল, কেওয়াতলার কাছে নাকি দেখেছে পারুলকে আগের দিন ফুটপাথে ভিক্ষা চাইতে।
রিমা রেগে গিয়ে বলল, ভালোই তো। লাস্ট ডেস্টিনেশনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
চুপু আর বুলি বলল, ওরা গিয়ে পারুলদিকে নিয়ে আসবে।
ছেলে-মেয়েকে রিমা বলল, নিজেরা রোজগার করো। পায়ে দাঁড়াও, তারপর আদিখ্যাতা কোরো।
ওরা চুপ করে যে যার ঘরে চলে গেল।
তার দিন দশেক বাদে পারুলের ভাইপো দু-জন সন্ধেবেলা এসে বলল, পিসি মরে গেছে বাবু। খবর পেয়েই আমরা এয়েচি। সৎকারের খরচ দিন।
কখন?
আমি অপরাধীর গলায় বললাম।
আজ ভোররাতে। শীতটা খুব জোরে পড়েছে তো! বহু বড়ো-বুড়িই টেঁসেছে আজ।
কোথায় ঘটল ঘটনাটা?
সে খুব ভেবেচিন্তেই মরেছে আমাদের পিসি। এক্কেবাড়ে কেওড়াতলার শ্মশানের সামনেই। ফুটপাতে।
ওদের থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছিল আমার। অনেক দিন পর মারামারি করতে ইচ্ছে করছিল। সত্যিই।
টাকা দিয়ে ওদের বিদেয় দিলাম। তখন বুলি ও চুপুও বাড়ি ছিল না, থাকলে, হয়তো শেষ দেখা দেখতে চাইত।
আমি যেতে পারতাম শ্মশানে। কিন্তু আমার মতো এক-জন মানুষের এক ভিখারিনির দেহ সৎকারের জন্যে কেওড়াতলায় যাওয়াটা এই সমাজের মনঃপূত নয়। তা ছাড়া গেলেই নানা চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হত, এপার্টিতে সেপার্টিতে দেখা হওয়া মানুষ। নানা কৈফিয়ত দিতে হত নানা-জনকে। না না, তা হয় না।
বলি চুপুরা এখনও ছেলেমানুষ। এখনও ওরা জানে না যে, শেষদেখা কখনোই দেখতে নেই, যদি তেমন শেষ দেখা না হয়। সবাইকেই সুন্দরতম দিনে, সুন্দরতম সাজে দেখে রাখতে হয়। সেইটুকু শুধু থাকে স্মৃতিতে।
পরদিন রবিবার ছিল। ব্রেকফাস্ট টেবিলে ছেলে-মেয়েকে রিমা হঠাৎই বলল, অ্যাই। জানিস তো পারুল মরে গেছে।
পারুলদি? কবে?
বলেই বুলি ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল।
বুলিটা আমার এখনও ঈশ্বরী।
চুপুও খাওয়া থামিয়ে চুপ করে বসে রইল।
রিমা আমাকে বলল, তোমাকে আর একটা আলু-পরোটা দিই?
উত্তর দিলাম না কোনো। শুধু ঘাড় নাড়িয়ে জানালাম, না।
আজকালকার সব মেয়েরাই কি রিমারই মতো? অবুঝ, নিজসুখমগ্ন, হৃদয়হীন? ভাবছিলাম, কেনই যে পারুল এমনভাবে ফুটপাথে না খেয়ে মারা গেল, এই মহৎ জনগণতান্ত্রিক সেনার সংবিধানের দেশে কে বা কারা যে তাকে অলক্ষ্যে খুন করে গেল। সেই রহস্য অথবা আমার এবং রিমার অসহায়তা বা অপারগতা যে ঠিক কতখানি তা আমার শোকস্তব্ধ অপাপবদ্ধ অনাবিল ছেলে-মেয়েকে বুঝিয়ে বলা যাবে না। এখন বলা গেলেও ওরা বুঝতে পারবে না। বলা যাবে না কোনোদিনও, যদি না তারা নিজেরাই বড়ো হয়ে ওঠার পর আমাদের দু-জনকে আমাদের পারিপার্শ্বিককে এবং আমাদের সমাজ ও দেশের প্রকৃত স্বরূপকে সত্যিই আবিষ্কার করতে চায়। কিন্তু তেমন ভালো কি আমার ও রিমার মতো নষ্ট-ভ্রষ্ট দম্পতির ছেলে-মেয়ের কখনোই হবে? ওরা কি আমাদের চেয়েও বেশি অসন্তুষ্ট, আত্মমগ্ন, নিজসুখ পরায়ণ হবে না?
আমাদের সাততলায় ছোট্ট, স্বয়ংসম্পূর্ণ সুখ ভরপুর ফ্ল্যাটের ড্রয়িং কাম ডাইনিং রুমে তখন উত্তরের জানলা দিয়ে হাওয়া আসছিল। সে-হাওয়ায় কোনো ফুলের গন্ধ ছিল না।
বারুদের গন্ধ তো নয়ই।
অথচ, থাকা উচিত ছিল।।