ব্রন্টি

ব্রন্টি

দিনের কাজ প্রায় শেষ, এবার উঠব অফিস থেকে। ঘড়িতেও সাড়ে পাঁচটা বাজে। গজেন আর ঘোষ ছাড়া আর কেউই নেই এখন। আমি উঠলেই জমাদার ঘর পরিষ্কার করবে। দারোয়ান আজকের মতো তালা-টালা লাগিয়ে দিয়ে যাবে বাইরে।

এমন সময় ইন্টারকামে ঘোষ বলল, একজন ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, স্যার। বলছেন, আপনার বন্ধু। নাম বরুণ চ্যাটার্জি। অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই।

—বরুণ চ্যাটার্জি? আমার বন্ধু!

মনে পড়ছে না ওই নামের কোনো বন্ধুকেই। রাত সাড়ে সাতটাতে বলা নেই কওয়া নেই অফিসে এসে হাজির হল কেন? কী দরকার? আমি চিনিই না। বলে দাও, এমন অসময়ে দেখা হবে না। আমি এক্ষুনি বেরিয়ে যাব। পরে একদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে যেন আসেন।

পরমুহূর্তেই আবার ইন্টারকাম চ্যাঁ চ্যাঁ করে উঠল।

—উনি যেতেই চাইছেন না স্যার। বলছেন, কোনো কাজে আসেননি, এমনিই এসেছেন। আপনার সঙ্গে কলেজে পড়তেন নাকি, ওঁর ডাকনাম ব্রন্টি!

—ব্রন্টি? ও হো—ব্রন্টি! তাই বলো।

আচ্ছা, দু-মিনিট লাগবে আমার। আমি ডিকটেটেড ম্যাটারগুলো দেখে, সই করে দিয়েই ডাকছি। একটু বসতে বলো।

এমিলি ব্রন্টির ‘উইদারিং হাইটস’ পড়া আর ব্রন্টির সঙ্গে পরিচয় আমার প্রায় একই সময়। তাই-ই ওর নামটি এ জীবনে ভোলার নয়। টাইপ করা চিঠিগুলোতে চোখ বোলাতে বোলাতে ভাবছিলাম। ব্রন্টি। ব্রন্টির ভালো নাম যে বরুণ চ্যাটার্জি, তা ভুলেই গেছিলাম। মনে থাকার কথাও ছিল না। আমরা সকলেই ওকে ব্রন্টি বলেই ডাকতাম।

বন্ধু বলতে ঠিক যা বোঝায়, ও তা ছিল না। শুধু আমারই নয়। ও কারওই বন্ধু ছিল না। কারও বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা বা মানসিক সমতা ওর ছিল না। ক্ষমতাও বোধ হয় ছিল না। কলেজে প্রথম দু-বছর শুধু একসঙ্গে কতকগুলো কমন ক্লাস করেছি। ব্রন্টি চিরদিনই ভুলোভালা। ট্রাউজারের মধ্যে এমনভাবে শার্টটাকে গুঁজত যে, পেছন দিকে অথবা সামনের দিকেও অনেকখানি শার্ট বেরিয়ে থাকত। যতদূর মনে আছে, খুব বড়ো পরিবারের অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে ছিল ও। ওদের প্রাসাদের মতো পৈতৃক বাড়িতেও গেছিলাম একদিন। চমৎকার অ্যাকসেন্টে ডান হাতের তর্জনী নাড়িয়ে কথা বলত। বেশিই ইংরেজিতে। কিন্তু ওর বেশিরভাগ কথারই কোনো মানে ছিল না। মনে হত, ও কাল্পনিক কোনো সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলছে।

আমার আর এক সহপাঠী রুদ্র, গত সপ্তাহে একদিন ফোন করেছিল বোম্বে থেকে। নানাকথার পর বলেছিল, ব্রন্টির নাকি মাথাখারাপ হয়ে গেছে। অবশ্য জানি না, কবেই-বা ওর মাথার ঠিক ছিল।

—তোর সঙ্গে দেখা হয়েছে কি রিসেন্টলি?

—না তো। কলেজ ছাড়ার পর আর দেখাই হয়নি। কী করে রে ব্রন্টি এখন? রুদ্রকে শুধিয়েছিলাম।

—করার মতো কিছুই তো করত না। বি.এ. পরীক্ষাটাও তো দিল না শেষপর্যন্ত! কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিল হঠাৎ, মনে নেই তোর?

টাইপ করা চিঠিগুলো সব সই করে, গজেনকে ডেকে বললাম, কাল সব যাবে ডাকে। আর যিনি ঘোষবাবুর কাছে বসে আছেন, তাঁকে এবারে ডাক। ঘোষবাবুকেও চলে যেতে বল। তুইও ব্রিফকেসটা ড্রাইভারকে নামিয়ে দিয়েই বাড়ি চলে যা। আমি একটু পরই উঠব। দারোয়ানকে বলে যাস।

চেয়ার থেকে উঠে দরজা খুলে দেওয়ার আগেই ব্রন্টি ঢুকল। চেহারাটা অবিকল সেইরকমই আছে, তবে রোদে-জলে-ময়লায় তেলচিটে তেলচিটে এই যা। চুলে ও জুলপিতে পাক ধরেছে যদিও, কিন্তু বয়সের ছাপ পড়েনি এখনও তেমন। নোংরা শার্ট আর ট্রাউজার। শার্টটা ঠিক সেইরকমভাবে গোঁজা। সামনে-পেছনে খাবলা খাবলা বেরিয়ে আছে।

ব্রন্টি বলল, হাল্লো নাটু, হাউ নাইস টু হ্যাভ মেট ইউ আফটার এইজেস।

বললাম, বোসো, বোসো।

ও বসে বলল, থ্যাঙ্কস। হাউ ইজ লাইফ?

—চলে যাচ্ছে। নাথিং টু গ্রাম্বল অ্যাবাউট।

—খুব সুখী তাহলে। ইস সুখী হওয়া কী কঠিন! আমি যদি হতে পারতাম!

—তুমি কী করছ এখন ব্রন্টি?

—আমি? সেইমথিং—। সেইম ওল্ড থিং।

— কোথায় আছ তুমি? আই মিন, কোন কোম্পানিতে? নাকি ব্যাবসা-ট্যাবসা? বাণিজ্যে বসত লঞ্জী?

ব্রন্টি সেই ছেলেবেলারই মতো আমার দু-চোখে ওর দু-চোখ রেখে নির্ভেজাল গলায় বলল, আছি মানে—আছি ঠাকুরদারই বাড়ির দোতলার বারান্দারই এক কোণে। এখন সবই ভাগাভাগি হয়ে গেছে। থাকার ঘর, ভালোবাসা, মন, রান্নাঘর, হৃদয়ের তাপ—সব। ছোটোকাকার শখের কুকুরের নাতির নাতি আর আমার জায়গা হয়েছে একই কোণে। ফার্স্ট ক্লাস আছি নাটু। কুকুরের ক্যারেকটার স্টাডি করছি, এক্কেবারে খুবই কাছ থেকে। কুকুরটা একেবারে ডোসাইল। লেজ মাড়ালেও কাউকে কামড়ায় না, অনেকটাই মিডল ক্লাস ডোসাইল মানুষদেরই মতো। একটা থিসিস তৈরি করব ঠিক করেছি। আ কমপারেটিভ স্টাডি।

একমুহূর্ত চুপ করে থেকেই ও বলল, এক গ্লাস জল হতে পারে?

বিব্রত হয়ে বললাম, ইস, সকলেই চলে গেল যে! আচ্ছা, আমিই দিচ্ছি।

একটু দাঁড়াও—

ঘরের কোণের ছোট্ট ফ্রিজ খুলে ওকে জল ঢেলে দিলাম।

ফ্রিজটা যখন খুললাম, তখন ব্রন্টি বলল, কিছু খাবার হতে পারে? যা হোক কিছু? আমি জেনারেলি লাঞ্চটা ফিরপোতেই করি। আজ করা হয়নি। সময়ই হয়নি।

ফিরপো! অবাক হলাম আমি। মনটাও খারাপ হয়ে গেল ফিরপোর কথাতে। এখন একটা বাজার বসেছে সেখানে। কলকাতা যদিও ফিরপো ছাড়া কানা হয়ে গেছে। কিন্তু কবে বন্ধ হয়েছে ফিরপো! বছর কয়েক হতে চলল। ব্রন্টির মাথা সত্যিই খারাপ।

লজ্জিত গলায় বললাম, খাবার? না, খাবার তো রাখি না ফ্রিজে। শুধু চিজ আছে একটু, খাবে?

—চিজ খাই না। আরে! মাখন আছে দেখছি এক প্যাকেট! হতে পারে?

—আমাদের ক্যান্টিনের মাখন। শুধুই মাখন।

এগিয়ে দিতে দিতে, অ্যাপোলজিটিক্যালি বললাম আমি।

—খাব, খাব। রোজই মাখন খাওয়া উচিত আমার।

জানো নাট, শরীরে খুবই লাবণ্যর অভাব ঘটেছে। লাবণ্য তো বিয়েও করল না আমাকে। সেসব ছোটোবেলার কথা। তোমাকে কি কখনো বলেছিলাম লাবণ্যের কথা? জানি না। লাবণ্যের কোনো সাবস্টিটিউট হয় না; হল না। দাও, মাখন দাও। লাবণ্য—হা: হা! আমাদের ছিল কাফ-লাভ। আজকাল তো ডগ আর বিচদের যুগ। কী বলো? হি-হি। ডোন্ট টু থিংক সো?

একমুহূর্ত চুপ করে থেকেই বলল, একটু প্রেম-ভালোবাসা হতে পারে?

একথার উত্তর হয় না। চুপ করে রইলাম।

ব্রন্টি মাখনের প্যাকেটটা খুলে, চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠেই, বলতে গেলে প্রায় চুষেই পুরো প্যাকেটটা একেবারে সড়াৎ করে খেয়ে ফেলল, আমি ডিশ চামচ বের করার আগেই। তারপর যেটুকু মাখন হাতে গেলে ছিল, সেটুকুও দু-গালে মেখে নিয়ে বলল, ন্যাপকিন দেবে নাকি একটা?

ড্রয়ার খুলে ন্যাপকিন দেওয়ার আগেই ও জামাতে এবং ট্রাউজারে হাত-মুখ সব মুছে ফেলল। চোখ কুঁচকে বলল, শার্ট আর ট্রাউজারটাও একটু লাবণ্যময় হোক। কী বলো। হোক। লাবণ্য-নির্মূল জীবন অন্তত ‘আমুল’ লাবণ্যে ভরে থাকুক। আ-মুল। মাই ফুট। হোয়াট আ সাবস্টিটিউট। দ্যাট লাবণ্য; অ্যাণ্ড দিস।

মনে পড়ে গেল, কলেজে থাকাকালীন ব্রন্টি আধুনিক কবিতা লিখত। ও একবার লিখেছিল; ‘প্রিয়তমা, দেখা হবে আমাদের নিশ্চয়ই গতকাল।’

গ্রেট পোয়েট আমাদের ব্রন্টি! প্রমিস ছিল; কারণ ওরমধ্যে দুর্বোধ্যতার গ্রেটনেস ছিল।

মনে পড়ে গেল, একদিন লাইটহাউস সিনেমার উলটোদিকের বইয়ের দোকান থেকে ‘দি ফ্লাইট অফ দি পাইড হর্নবিলস’ বলে একটা পেপারব্যাক বই হঠাৎ কিনে তাতে ও নিজেহাতে লিখে দিয়েছিল : ‘টু ডিয়ার নাটু। আই ক্যুড ডু নো বেটার অ্যাণ্ড দিস আই বিলিভ’!’

ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, pied hornbills সম্বন্ধে তোমার বুঝি খুব ইন্টারেস্ট?

ও বলেছিল, দুস। কে জানে? কোনো পাখিটাখি হবে হয়তো। শিংঅলা কোনো জানোয়ারও হতে পারে। হু কেয়ারস?

—সে কী? তাহলে, হঠাৎ আমাকে এই বইটি কিনে প্রেজেন্ট করলে?

—জানো না? আজ বোদলেয়ারের জন্মদিন যে। প্রত্যেক কবিকেই আজ উদার হতে হয়। দিস ইজ মাই ওয়ে অফ রিমেম্বারিং দি পোয়েট।

আড়াইশো গ্রাম মাখন খেয়ে লাবণ্যময় হয়ে উঠে ব্রন্টি বলল, তোমার ছেলে-মেয়ে কী?

—মেয়ে বড়ো। ছোটো ছেলে।

—মেয়ে কতবড়ো? বিয়ে দিয়েছ?

—বয়স হয়নি মেয়ের। মাত্র এগারো বছর। তা ছাড়া, বিয়ে তো আস্তে আস্তে উঠেই যাচ্ছে। এখন তো লিভ টুগেদারের দিন।

—জানি। তবু, আমি পুরোনো দিনের লোক। আমি বিয়েতে আজও বিশ্বাস করি। আমি কিন্তু বিয়েই করব। এবং করলে, তোমায় নেমন্তন্ন করব। তোমার মেয়েকেও।

—কবে হবে তোমার বিয়ে?

—হা:! দ্যাটস আ মিলিয়ান ডলার কোয়েশ্চেন। লাবণ্য নেই। নো হোয়্যার ইন দি ওয়ার্ল্ড। আই হোপ, ইউ নো হোয়াট আই মিন। লাবণ্য ইজ আ মাচ ওয়াইডার, ডিপার; ওয়ার্ড। লাবণ্য, বুঝলে নাটু; শি ইজ আ সিম্বল। শি ইজ নট জাস্ট মাই গার্ল। অর, ফর দ্যাট ম্যাটার; এনিবডিজ এলসএস গার্ল ইদার; শি ইজ আ সুপারলেটিভ এলিমেন্ট, আ কনসেপ্ট, হু মুভস আওয়ারসেলভস ফ্রম উইদিন। মুভস হেভেন অ্যাণ্ড আর্থ।

একটু চুপ করে থেকে আর এক ঢোক জল খেয়ে বলল, বাই দি ওয়ে, নাটু, আমার একবোন বলছিল; তুমি নাকি আজকাল গল্প লেখো বাংলায়? ফিকশান? বই লেখো? তুমি? নাটু সেন? অফ অল পার্সনস?

হেসে বললাম, বাংলা সাহিত্য কোন পর্যায়ে নেমে এসেছে তাহলে বুঝতেই পারছ! নইলে, নাটু সেনও গল্প লেখে?

—হা:। আই লাইক ইট। তোমার সেন্স অফ হিউমার এখনও ঠিক সেইরকমই আছে। ভেরি ফিউ উইল পুল সাচ আ ফাস্টওয়ান অন হিমসেলফ। গ্রেট। বাই দি ওয়ে, হোয়াটস ইয়োর নেক্সট প্রোজেক্ট? অ্যান অটোবায়োগ্রাফি অফ অ্যান ইডিয়ট? অর ফর আ চেঞ্জ, দ্যাট অফ আ মেগালোগ্যানিয়াক?

এরও উত্তর হয় না। প্রোজেক্ট দুটিই ভেবে দেখার মতো। চুপ করে রইলাম।

—গাড়ি কিনেছ?

—কোম্পানি দিয়েছে। বহুদিন।

—ফ্ল্যাট কিনেছ?

—না। বাড়িই তৈরি করছি, সল্টলেকে।

—নিজের বাড়ি? বা:।

—ফরেনে গেছ?

—গেছি একবার।

—কোথায়?

—ব্যাংকক।

—বা:! তবে তো গেছই।

—ক্লাবের মেম্বার হয়েছ?

—হ্যাঁ অনেক দিন।

—কোন ক্লাব?

—ক্যালকাটা ক্লাব।

—তোমার বিয়ের তারিখে ইংরেজি কাগজের পার্সোনাল কলামে তোমার শালির শুভেচ্ছা ছাপা হয়?

—হ্যাঁ। হয় বই কী! শালি ছাড়া আরও অনেকেরই হয়।

এবার মনে মনে আমি বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম।

—বা:! তবে তো তুমি একজন সম্পূর্ণ মানুষ। টোটাল। সাকসেস তো একেই বলে। কনগ্রাচুলেশনস। জীবনে তোমার আর কীই-বা চাইবার থাকতে পারে? বাঙালির বাচ্চাদের পক্ষে ঢের করেছ। যুগ যুগ জিয়ো। তোমাকে দেখে ছোটোকাকার পেডিগ্রি গ্রেট-ডেন কুকুরের নাতির নাতি পর্যন্ত লজ্জা পাবে। সাব্বাশ।

কথা ঘুরিয়ে বললাম, তুমি কী করো ব্রন্টি, এখনও খুলে বললে না তো?

—সেইমথিং! বললাম তো! ও, খুলে বলিনি বুঝি এখনও? আউচ। দ্যাট বাটার অফ ইয়োরস, রিয়্যাল গুড।

ব্রন্টি আর একটা ঢেকুর তুলল।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, একটা জেলুসেল হতে পারে?

—না। নেই। সরি।

—ডোন্ট বদার। তোমরা যাকে ‘করা’ বলো তেমন কিছুই করি না আমি। আই অ্যাম সিম্পলি স্যাম্পলিং লাইফ। গত পঁচিশ বছর ধরে এই-ই করছি। গ্রেট ফান। নিজের জীবন কুরে কুরে খেয়ে দেখছি ভুট্টার দানার মতো। স্বাদ চাখছি। দেখছি, নোনতা না মিষ্টি। এক্সপেরিমেন্ট করে দেখছি, জীবন সলিড না লিকুইড না গ্যাসি? আই রিয়ালি ডু স্যাম্পল মাই ওন লাইফ। ঠিক কীভাবে বলব জানি না; ধরো যদি বলি, অ্যাজ আ টি-টেস্টার স্যাম্পলস টি। সামথিং ভেরি মাচ অ্যাকিন টু দ্যাট। বুঝলে নাটু। আই এনজয় মাইসেলফ, থরোলি এনজয়; এভরি মিনিট অফ মাই লাইফ। একটা শামুকের মতো; দার্জিলিং-এর রেলগাড়ির মতো। আর তোমরা?

তোমরা সবাই জেট প্লেন। টাকা-নাম-যশ-সিকিউরিটি এসবেরই পেছনে দৌড়ে বেড়াচ্ছ। তাই না? তোমাদের করুণা করি আমি। তোমরা সকলেই—তুমি, রুদ্র, শ্যামল—আ প্যাক অফ স্টুপিড উল্ফস।

—আর তুমি নিজে? তুমি নিজে কী করছ? কী কী করলে জীবনে?

—নাটু। আমি রেললাইনের পাশের টেলিগ্রাফের তারে বসে থাকা ছোট্ট, ননডেসক্রিপ্ট ফিঙে। করার মতো কিছুই করি না আমি। তোমাদের দেখে মজা পাই। তোমরা কেউই জানো না, জানবার সময়ই পেলে না যে, লাইফ ইজ ফর লিভিং। তোমাদের জীবন, জীবনই নয় হে, সে একটা অভ্যেস। ইয়েস। ইয়োরস ইজ ওনলি অ্যান অ্যাপোলজি ফর আ লাইফ। হোয়াট আ সেম।

বলেই ব্রন্টি বলল, কুড়িটা টাকা হতে পারে? খুবই খিদে পেয়েছে। লাবণ্য তার অস্তিত্বে এবং অনস্তিত্বে মাঝে মাঝেই আমার মধ্যে বড়ো খিদের উদ্রেক করে। কী দারুণ বাংলা বললাম, দেখলে। তোমার সঙ্গগুণেই কি? গ্রেট!

কুড়ির জায়গায় ওকে একশোটা টাকা দিলাম। বললাম, তোমাকে বেশিই দিলাম, যাতে তোমার বার বার না আসতে হয়। সত্যিই আমি খুবই ব্যস্ত থাকি। উইদাউট অ্যাপয়েন্টমেন্টে কারও সঙ্গেই দেখা করতে পারি না। কিছু মনে কোরো না ব্রন্টি।

—ফেয়ার এনাফ। বলল, ব্রন্টি। ফেয়ার এনাফ। তুমি কী বলতে চাইছ বুঝেছি। আর হয়তো আসব না। কিংবা কী জানি, আসতেও পারি। তোমার মাখন বড়ো ভালো। লোকে মাখন দেয়, আমি নেব।

তারপরই বলল, পঁচিশ বছর পর কলেজের বন্ধুর সঙ্গে দেখা হল। আরও জাস্ট দেড়শোটা টাকা কি হতে পারে? পার ইয়ারে তা হলে দশ টাকা করে হবে। হিসেবে গোলমাল কোরো না। আমার অ্যাডিশনাল ম্যাথস ছিল। অঙ্কে ভুল হয় না।

—আজ ব্যাংক থেকে হাজার টাকা তুলেছিলাম। তাই-ই দিতে পারছি তোমাকে।

ব্রন্টি হাসল। বলল, বড়োলোকেরা এমন বলেই থাকে। দু-নম্বর কী একনম্বর টাকা, তাতে ভিখিরির কী এসে যায়? দু-নম্বর টাকা হাত বদলালেই তিন নম্বর হয়ে যায়, তাও জানো না? নাও, দাও দাও, আরও দেড়শোটা টাকা দাও, ফর ওল্ড টাইমস সেক। হতে পারে?

—টাকা তুলেছিলাম প্রয়োজন ছিল বলেই। তবু, নাও।

টাকাটা যেই দিলাম, অমনি তা পকেটে পুরে হঠাৎই উঠে পড়ল ব্রন্টি। ডান হাতের তর্জনী নেড়ে বলল, নেভার এক্সপ্লেইন ইয়োর কনডাক্ট। নো। নট ইভেন টু ইয়োরসেলফ।

পরমুহূর্তেই, যেমনই আচমকা এসেছিল তেমনই আচমকা উধাও হয়ে গেল ও।

অনেকক্ষণ হতভম্বর মতো চেয়ারে বসে রইলাম। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছিল না। সত্যিই কি ব্রন্টি? আমাদের কলেজের বন্ধু ব্রন্টিই?

নীচে নেমে যখন আমি গাড়িতে উঠলাম, তখন দেখি; ব্রন্টি আমারই অফিসের নীচের জিলিপি-শিঙাড়ার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে শুকনো শালপাতার দোনায় দু-হাতে রস আর আলু প্রায় মাখামাখি করে শিঙাড়া-জিলিপি খাচ্ছে। পাশে দাঁড়িয়ে একটা ষাঁড় ওকে নিবিষ্ট মনে লক্ষ করছে।

ষাঁড়টা হঠাৎ চলি-কী-চলি-না করে চলতে আরম্ভ করল, রাস্তা থেকে আবর্জনা কুড়িয়ে খেতে খেতে। জনস্রোত তাকে ধাক্কা দিতে লাগল। ধাক্কা দিতে লাগল ব্রন্টিকেও। ব্রন্টি তখন তার টুকরো করে ভেঙে খাওয়া নিজের জীবনেরই একটি টুকরোর মতো শিঙাড়া-জিলিপি স্যাম্পলিং করছিল। আমি যেন শুনতে পেলাম বাঁ-হাতের চেটোয় শালপাতার দোনা ধরে ডান হাত দিয়ে খেতে খেতে ও বলছে, ‘লিভিং ইজ গ্রেট ফান। ইউ ওনলি হ্যাভ টু ফ্লোট উইথ ইট। নেভার ট্রাই টু স্যুইম এগেইনস্ট লাইফ।’

ষাঁড়টা চলেছে সোজা। এবার সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে গিয়ে পড়বে। তার মুখ বড়োবাজারের দিকে।

—বি আ ফ্লোটসাম।

কে যেন বলল, কানের পাশে।

তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। টাকাটা কোনো ব্যাপারই নয়। ও আবারও টাকা চাইবে, শুধুমাত্র এই ভেবেই ব্রন্টিকে আমি আসতে বারণ করিনি। ও আসলে ভীষণ ভীষণ খারাপ লোক।

দারোয়ানকে বলে দিতে হবে যাতে ওকে আর কোনোদিনও ঢুকতে না দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *