মেজদাদা আসছেন
এই যে পটা। এটা কে করেছে?
কোনটা বাবু?
বাজার থেকে সাইকেলের দু-হ্যাণ্ডেলে বাজারের থলে ঝুলিয়ে ফিরে এসে নামতেই অবনী বাঁড়ুজ্যের মুখোমুখি পড়ে গেল পটা। তারপর সাইকেল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই আবার বলল, কোনটা বাবু?
তোমার চোখ নেই? ঠিক সিঁড়ির সামনে উঠোনের মধ্যে ঠাকুরঘরের শুকনো বেলপাতা এমন করে কেউ ছড়িয়ে রাখে?
ও আমার কাজ নয় বাবু।
তবে কার কাজ?
নিশ্চয়ই খেঁদির কাজ। ও-ই তো বড়োমা-র ঠাকুরঘর দেখাশোনা করে।
গুণেনদা এইসব পুজো-ফুজোকে বিশ্বাস করেন না। তিনি আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক লোক। দেশ-বিদেশে গোরু-শুয়োর খেয়ে বেড়ান। কত বড়ো নামকরা লেখক তিনি, কত প্রাইজ পেয়েছেন জানিস কিছু তুই তার?
পটা অপরাধ স্বীকার করে বলল, না বাবু।
পটা জানবেই বা কোত্থেকে? পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি অবধি পড়েই কাজে নেমে পড়েছে। কাজে লেগেছিল কলকাতাতেই অবনীবাবুর বাড়িতে। অবনীবাবুর ব্যাংকের চাকরি। বদলি হয়ে বেনারসের কাছে রবার্টগঞ্জে আসার সময় পটাকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। এমনিতে দেশ ছেড়ে দূরে বড়ো কেউ একটা যেতে চায় না, কিন্তু এখন টগবগে যৌবনের বাইশ-তেইশ বছরের ছেলে পটা স্বভাবে একটু অন্যরকম। মানে, একটু অ্যাডভেঞ্চারাস টাইপের। আজকের বাজার থেকে এক পয়সাও সরায়নি পটা কারণ বাবুর বড়ো সম্বন্ধী গুণেন মিত্র নামি মস্ত বড়োকবি। সিংগ্রাউলির নর্দান কোলফিল্ডের বর্তমানে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের নেমন্তন্নে তিনি কবি সন্মেলনে যাচ্ছেন সিংগ্রাউলি। তিনি বেনারসে পৌঁছে সেখান থেকে নর্দান কোলফিল্ডের ঢাউস গাড়িতে আসবেন এখানে। দুপুরের খাওয়াটা খেয়ে তারপর বাবুর অফিস এবং এখানের বাঙালি সমাজের অনেককে দেখা দিয়ে তাদের সঙ্গে দু-একটি কথা বলে তারপর রওয়ানা হয়ে যাবেন সিংগ্রাউলির দিকে। খাওয়ার পরে একঘণ্টা বিশ্রাম নেবেন। মা আর বাবু মিলে গত পনেরো দিন ধরে গুণেনবাবুকে কী কী খাওয়ানো যায়, তাকে কী করে আপ্যায়ন করা যায়, এই নিয়েই আলোচনা করেছেন। বসবার ঘর এবং যে ঘরে মামাবাবু বিশ্রাম করবেন তার রং ফেরানো হয়েছে। সোফার কভার, জানলা দরজার পর্দা, বিছানার বেডশিট এবং বেডকভার সব বদলানো হয়েছে। ধোপাকে দিয়ে নয়, মর্ডান ডাইংক্লিনিং থেকে সব কাচিয়ে, ইস্ত্রি করা হয়েছে। জয়সোওয়াল বাবুর বাড়ির বাগান থেকে নানা ফুল এসেছে বসার ঘর, শোওয়ার ঘর এবং যে ঘরে মামাবাবু বিশ্রাম নেবেন সেই ঘর সাজানোর জন্যে। জয়সোওয়ালবাবুর অ্যাকাউন্ট আছে বাবুদের ব্যাংকে। ব্যাংকের ম্যানেজার। অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজার এবং রবার্টগঞ্জের আরও নানা বিশিষ্ট-জনকে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। বঙ্কুবাবু, ব্যাংকের ক্যাশিয়ার কলকাতায় প্রকাশককে লিখে গুণেন মিত্রর একটি বই আনিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী কবিতার খুব ভক্ত। তিনি নিজেও কবি। তাঁর নবতম বই, ‘গুণী, শুধু তোমারই জন্যে’ কপি তিনি নিজের হাতে গুণী গুণেন মিত্রকে দিতে চান। অবনীবাবু আজ এক অ্যাকাউন্ট- হোল্ডারের মারুতি ভ্যানটি সকাল পাঁচটা থেকে চেয়ে নিয়েছেন। তাতে করে সকালে তিনি নিজেই পানি টাঙ্কির নীচ থেকে এখানে যতরকমের মাছ পাওয়া যায় সবই কিনে এনেছেন। তাঁর সম্বন্ধী ইনটেলকচুয়াল মানুষ, তা ছাড়া মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করাদের মধ্যে প্রধান এক-জন। দুপুরে কুচোমাছ ভাজার সঙ্গে তিনি পান করবেন কিছু। তিনি কী পান করেন তা অবনীবাবুর জানা নেই। তিনি টিটোটালার। তা ছাড়া, এসব পছন্দও করেন না। কিন্তু বড়ো মানুষদের সবই মানিয়ে যায়। এখানে যাঁরা রসিক আছেন তাঁরা বলেছেন, অবনী, ও ব্যাপারটা দায়িত্ব আমাদের ওপরে ছেড়ে দাও। এমন গুণীজনের সাধুসঙ্গে আমরাও তো দু-পাত্তর করে খাব। ভদকা, জিন, এমনকী কাম্পারির পর্যন্ত বন্দোবস্ত করে রাখব। তিনি তো একাই আসবেন বোন-ভগ্নীপতির কাছে। বিরাট কবি-সন্মেলন হবে নাকি সেখানে। এখান থেকে অনেক কবি এবং কবি-কবি ভাবের মানুষেরা যাবেন। অবনীবাবু ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’-র বেশি এগোতে পারেননি কবিতাতে। কমার্সের ছাত্র ছিলেন, ডেবিট-ক্রেডিট বোঝেন, ভালো অ্যাকাউন্ট্যান্ট বলে তাঁর খ্যাতি আছে। অন্য কোনো জগতের খোঁজ রাখেন না।
এতসব কথা পটা এবং অবনীবাবুর মাথায় মধ্যে আলোর গতির চেয়েও দ্রুত গতিতে চমক তুলে বেরিয়ে গেল। যেন সংবিত ফিরে পেয়ে অবনীবাবু পটাকে বললেন, সবজিগুলো সব মা আর বউদিকে দিয়ে আয় আর ঠাকুমাকে বলিস আজ দুপুরে যেন ঘণ্টা বাজিয়ে পুজো না করেন। আমি যাই এবার বেঙ্গল সুইটস থেকে দই, শোনপাঁপড়ি আর সন্দেশটা নিয়ে আসি গাড়িটা নিয়ে।
সবসুদ্ধ কত-জন লোক হবে বাবু?
অবনীবাবু বললেন, বাড়ির লোক নিয়ে তা প্রায় সতেরো আঠারো জন।
তারপর বললেন, পাঁচুঠাকুর কী এসে গেছে পটা? এত-জন লোকের রান্না করতে হবে, তাড়াতাড়ি আরম্ভ না করলে চলবে কী রে। চাটনিটা যেন আগে করে।
সেসব পাঁচুঠাকুর ভালোই জানে। কিন্তু এসেছে কী না তাই তো জানি না।
আমি তো পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাজারে ছিলাম। দেখছি গিয়ে।
অবনীবাবু বললেন, শোন পটা, তোর মাকে বলবি একদম টেনশন না করতে। গত তিন দিন হল যা টেনশন করছে তা বলার নয়। অবশ্য, এমন বিখ্যাত দাদা, এই ছোটো রবার্টসগঞ্জে এসে আমাদের ধন্য করবেন আর একটু উত্তেজনা হবে না তা কী হয়? রবার্টসগঞ্জের বাঙালি সমাজেই হই চই পড়ে গেছে খবরটা শুনে। আমাদের প্রেস্টিজই বেড়ে গেছে। টেনশন হবার তো কথাই। পটা সাইকেলটা বাগানের টিনের শেডের নীচে তুলতে তুলতে বলল, সে তো ঠিক কথাই।
অবনীবাবু মারুতি ওমনিতে উঠে পড়লেন। মারুতির সামনের সিটে বসলেন বাঁ হাতটা জানালার ওপর রেখে। পাঞ্জাবির বাঁ-হাতটা গুটিয়ে তুলে রেখেছেন যাতে নতুন কেনা টাইটান ঘড়িটা দেখা যায়। যাঁরা গাড়ির মালিক তাঁদের বসা দেখে বোঝা যায় আর যাঁরা ভাড়াগাড়ি বা অন্যের গাড়ি চড়েন তাঁদের বসা দেখেও বোঝা যায়।
গাড়ির ড্রাইভার সরযুপ্রসাদ ভাবছিলেন সে কথা।
দুই
বাড়ির ভেতর ঢুকতেই শুনতে পেলেন অবনীবাবু যে ফোনটা বাজছে। পটা রান্নাঘরে গেছিল তরকারিগুলো সব রেখে আসতে। খেঁদি নিশ্চয়ই পটারই নির্দেশে ঠাকুমার পুজোর ঘরে গিয়ে দেখছিল আরও কিছু পচা ফুল পাতা পোড়া ধূপকাঠি ইত্যাদি পড়ে আছে কী নেই। ললিতা নিশ্চয়ই চানে গেছে। ওর ভীষণ গরম। খাবার দেওয়ার আগে ও আবার একবার চান করবে নিশ্চয়ই। পাটভাঙা শাড়ি পরবে। অবনীবাবুর ব্যাংকের এক অ্যাকাউন্ট-হোল্ডার সিঙ্গাপুর থেকে রেডডোর পারফ্যুম নিয়ে এসেছিলেন, সেই পারফ্যুম মাখবে।
কেউই না থাকতে অবনীবাবু নিজেই গিয়ে রিসিভারটা তুললেন। আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে এস. টি. ডি. কল। অবনীবাবু বললেন, বলছি।
কে? বাবা?
হ্যাঁ। তুই কখন আসবি খোকা? তোর মেজোমামার তো আসার সময় হয়ে গেল। ওখান থেকে গলা শুনে বললেন, কী বললি? আসতে পারবি না? তোর ইলাহাবাদের দাবা কম্পিটিশন এতই ইমপর্ট্যান্ট হল? এ-দিকে পুরো রবার্টগঞ্জের মানুষ ভেঙে পড়তে চলেছে তোর মেজোমামাকে দেখতে। পুটুনির মোড়ে ফুল দিয়ে ‘স্বাগতম’ লিখে তোরণ করেছে। আর তুই এতবড়ো ভি. আই. পি যে, একটা দিনের জন্যেও ছুটি নিয়ে আসতে পারছিস না! তুই-ই তো গুণেনদার একমাত্র ভাগনে, তোর মামিদের কারওরই তো ছেলে নেই।
খোকন ওরফে অগ্নিভ ও প্রান্ত থেকে বলল, আমাদের অফিসের প্রতিনিধি আমি। নতুন চাকরি। ছোটো চাকরি। এই দাবা খেলার সুবাদেই তো চাকরিটা হয়েছে বাবা, তুমি তো জানো এই ইলাহাবাদ, লক্ষ্ণৌ, শতরঞ্জ কি খিলাড়িদেরই জায়গা। আমি পারলে কি আর আসতাম না? কোনো না কোনো ট্রেইন ধরে ঠিকই পৌঁছে যেতাম এতক্ষণে।
অবনীবাবু প্রচন্ড বিরক্তি ঝরিয়ে বললেন, ঠিক আছে।
মাকে বলে দিয়ো বাবা। যেন ভুল না বোঝে।
বলব।
বলে, ঠকাস করে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। ললিতা ভেজা চুলের ওপরে তোয়ালে জড়িয়ে কাফতান জড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে বললেন, কে?
অবনীবাবু বললেন, তোমার আদরের খোকা, আবার কে?
কী বলল, আসছে না? ওকে বিন্ধ্যাচলের পেঁড়া নিয়ে আসতে বলেছিলাম।
না, আসবে না। ওদের অফিসের টিমের হয়ে দাবা কম্পিটিশনে ওকে আজ থাকতেই হবে। তারপরেই স্বগতোক্তি করলেন। নারানাং মাতুলক্রমঃ।
ললিতা বললেন, ভালো হবে না কিন্তু। আমার মেজাজ আজ খারাপ করে দিয়ো না।
আজ আর কাল কী? তোমার মেজাজ আর কবে ভালো থাকে?
অবনীবাবু তাঁর মেজোশালাকে একেবারেই পছন্দ করেননি কারণ শ্বশুরবাড়ি ভাগ্য বড়োই খারাপ। তারমধ্যে মেজোশালা গুণেন মিত্র নিকৃষ্টতম। কী ছাতার কবিতা লেখেন উনিই জানেন। তবে রোজই খবরের বিভিন্ন কাগজে তাঁর নাম ও ছবি ছাপা হয় রবার্টসগঞ্জে বাংলা চ্যানেল খুব কমই পাওয়া যায়, শুধু ই-টিভি বাংলা আর দূরদর্শনের বাংলা চ্যানেলটাই আসে। নইলে তাঁকে রোজই কোনো না কোনো টিভি চ্যানেলে বাধ্যতামূলকভাবে দেখতে হত। বছরের মধ্যে ন-মাস তিনি পৃথিবীর নানা দেশে ঘোরেন। লোকমুখে অবনীবাবু শুনেছেন তিনি নাকি নোবেল প্রাইজ পাওয়ার জন্যে তদবির করতে যান প্রতিবছর। তাঁর অনেক সাহেব সুবো বন্ধু আছেন বিদেশে। তা হতে পারে কিন্তু ললিতার মা-ভাই-বোন কারও সঙ্গে তিনি বিশেষ সম্পর্ক রাখেননি। তিনি আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে গেছেন। দেশে যে সময়টুকু থাকেন তা-ও কলকাতাতে থাকা হয় না। গালুডিতে ফার্ম হাউস করেছেন। সময় করতে পারলে লেখালেখির জন্যে সেখানেই যান। মানুষ হিসেবে তাঁকে একেবারেই পছন্দ করেননি অবনীবাবু কোনোদিনও। গত পঁচিশ বছরে তাকে একদিন জামাইষষ্ঠীর নেমন্তন্নও খাওয়াননি কিন্তু এখন মেজসম্বন্ধী এক জন সেলিব্রিটি। তাঁর সঙ্গে আত্মীয়তা আছে এ-কথা কেউ জানতে পারলেই অবনীবাবু আর ললিতার সামাজিক স্ট্যাটাস উঁচু হয়ে যায়। কিন্তু খোকন, মানে তাঁদের একমাত্র পুত্র অর্ণব তার মেজোমামাকে কোনোদিনও পছন্দ করেনি। ও গোপনে বলে, এক-জন ফলস ইনটেলেকচুয়াল। মিডিয়ার কাঁধে চড়ে অনেক বছর থাকতে পারে কিন্তু মাল একেবারে ভুসি। ফুটে যাওয়ার তিন দিনের মধ্যে মানুষ তাঁকে ভুলে যাবে। তেমন দৃষ্টান্ত আরও আছে।
এ-সব কথা অর্ণব বাবা-মায়ের কাছেই বলে, কারণ তার বলার কেউ নেই। জন্মের পর থেকেই সে বাংলার বাইরে বাইরেই মানুষ হয়েছে। বাংলা লিখতে পড়তে পারে কিন্তু সাহিত্য পড়ে না, তবে ওর অনেক বন্ধুবান্ধব আছে তারা বাংলা সাহিত্যের চর্চা করে। রবার্টগঞ্জ থেকেও একটি লিটল ম্যাগে বেরোয়, ইলাহাবাদ শহরে এসেও দেখছে এখানেও প্রবাসী বাঙালির বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বাংলা গান এ-সব বাঁচিয়ে রাখার কী প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছেন।
ফোনটা আবারও বাজল। আজ কাগজগুলো পড়ারও সময় পাননি। তিনি টি.ভি. বিশেষ দেখেন না। দেখলে কাজের জন্যে এমন হা-পিত্যেশ করতে হত না প্রতিদিন। তবে রবিবারে একটু সময় নিয়ে দু-তিন কাপ চা খেতে খেতে ইজিচেয়ারে বসে খুঁটিয়ে কাগজগুলো পড়া তাঁর অভ্যেস। তবে রবিবারের পাতার যা চেহারা হয়েছে এবং বাংলা ভাষা নিয়ে যা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, বাংলা বানান নিয়েও, তাতে অবনীবাবুর মনে হয়, কয়েক-জন পন্ডিত মিলে বাংলা ভাষাকে গলা টিপে মারার চক্রান্ত করেছে। ম্যাগাজিনগুলো বাঙালি সংস্কৃতি ও রুচির সর্বনাশ করেই দিয়েছে অথচ অবাক হয়ে যান তাঁর মেজোশালার মতো প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবীরা কেউ একটি কথাও বলেন না এর প্রতিবাদ হিসেবে। তারপর ভাবেন, যাকগে যাক, উনি তো আর কলকাতাতেই ফিরবেন না, এ-দিকেই রিটায়ারমেন্ট-এর পরে সেটল করবেন। বেনারস আর ইলাহাবাদের মাঝামাঝি বিন্ধ্যাচলের কাছে শিউপুরাতে বিঘা চার এক জমি নিয়ে রেখেছেন সস্তাতে, সেখানেই ছোট্ট বাড়ি করে থিতু হবেন। ছেলের, শুধু তাঁর নিজের ছেলেরই নয়, সব ছেলেরই যা মতিগতি, তাতে তারা যে কোথায় থাকবে তাদের সুখী সংসার গড়ে তা তারাই জানে। ছেলের ওপর তিনি ডিপেণ্ডেন্ট নন।
ততক্ষণে লতিতার জামাকাপড় পরা হয়ে গেছে। ললিতাই এসে ফোনটা ধরল, হ্যালো, ও বলো, ছুটকি দিদি। পায়েস রেঁধে আনবে? কেন ঝামেলা করতে গেলে? তোমার নতুন কবিতার বই দেবে মেজদাকে? তা বেশ! তবে একটু তাড়াতাড়ি এসো। আমাকে একটু হেল্প কোরো। আমার নার্ভাসনেস লাগছে। সবসুদ্ধ প্রায় জন কুড়ি লোক হবে। আমি কর্তাকে বলেছিলাম যে-কোনো ক্যাটারারকে ভার দিয়ে দাও। তা উনি বললেন, নামি মানুষ, আমাদের আত্নীয়ই হন আর যাই-ই হন নিজের রান্না করে খাওয়ানোই শোভন। রান্না অবশ্য করছে পটা ঠাকুর। সে বাড়ির লোকই হয়ে গেছে। অবনীবাবুকে পটা চা আর দুটো টোস্ট আর ডিমের একটা ওমলেট এনে দিয়েছিল। চা খেতে খেতে উনি কাগজ পড়ছিলেন।
ললিতা কাল ওদের বিয়ের পঁচিশ বছরে পাওয়া বোন-চায়নার ডিনার সেটটা বের করেছে। অনুরাধা ঘোষালকে বলেছে এবং মিসেস সেনকেও, কিছু বাসনপত্র আনতে। বুফেই খাওয়াবে। ওদের ছোট্ট ডাইনিং টেবিলেতে মোট ছ-জন বসতে পারে। নানা ব্যাপারে বড়োই টেনশনে আছেন ললিতা।
আচ্ছা পুজন পানওয়ালাকে বলে রেখেছ পানের জন্যে? মিষ্টি পান তো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলে রেখেছি, ওমনি গাড়ির ড্রাইভার সময় মতো গিয়ে নিয়ে আসবে। মেজদার সঙ্গে দেখা করতে সবসুদ্ধু পঞ্চাশ-জন মতো মানুষ হয়তো আসবেন। তাঁদের জন্যে শুধু চা আর শরবতের বন্দোবস্ত করে রাখো। তাঁদের অধিকাংশই আমার অপরিচিত। একবার মেজদার দেখা পাওয়ার জন্যেই আসবে। তবে আমার দৃঢ় ধারণা ওঁদের মধ্যে অর্ধেক মানুষই মেজদার একটি লেখাও পড়েননি, আমারই মতো, শুধু মেজদা সেলিব্রিটি বলেই আসছেন। নিজেদের শালিদের লিখবেন অথবা বলবেন, হি ইজ আ ফ্রেণ্ড অফ মাইন।
ফোনটা আবারও বাজল। নবারুণ ঘোষ। জাতে মাতাল তাতে ঠিক। বলল, অবনীদা আমি আমার পশরা নিয়ে এগারোটার সময়ে পৌঁছে যাব। চার-পাঁচ বাড়ি থেকে বরফ জোগাড় করেছি। তুমি কেবল কিছু কাঁচা লংকা চিরে বিচিগুলো বের করে প্লেটে সাজিয়ে রেখো। গন্ধরাজ লেবু আমি নিয়ে যাব। একটু কেটে দিতে হবে দু-ভাগ করে। তোমার মেজদা ক-টা নাগাদ আসবেন?
বেনারসে মেইল থেকে নেমে কোথাও চান করে ব্রেকফাস্ট করে তারপরে ধীরেসুস্থে আসবেন। মনে হয় এগারোটা নাগাদ পৌঁছে যাবেন। ওঁকে নিতে সিংগ্রাউলি থেকে গাড়ি আসবে ছ-টা নাগাদ। সঙ্গে কলকাতার কোনো কবিও আসতে পারেন। কবি সন্মেলনও আজও রাতে, তবে মেজদার আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ পৌঁছোলেই চলবে।
তবে কি রাতের বন্দোবস্ত রাখব কিছু? এখানে তো স্কচ-টচ পাওয়া যাবে না। লোকমুখে শুনেছি যে উনি মহাদেব, বাংলা কী মহুয়া কিছুতেই তাঁর আপত্তি নেই।
আমি বলতে পারব না, লজ্জিত গলাতে বললেন অবনীবাবু।
তাহলে এই কথাই রইল। আমি, সত্যেন, বড়োখোকা, ন্যাকাহাঁদু আমরা সবাই এগারোটার সময়েই স্টার্ট করে দেব। আমাদের জন্যে তোমার একটা ঘর, বারান্দার লাগোয়া হলেই ভালো হয়, ঠিক করে রেখো। গ্লাসটাও আমরাই নিয়ে যাব। বেশি টেনশন কোরো না।
অবনীবাবু দেওয়ালের বড়োঘড়িটার দিকে তাকালেন একবার। সাড়ে আটটা বাজে। এবার তাঁরও টেনশন হচ্ছে।
তিন
মাসের শেষ। অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল। প্রায় জনা কুড়ি লোকের জন্যে এতগুলো পদ। তা-ও ওঁরা পানীয় খরচ নিজেরাই দেবেন বলেছেন, বলেছেন, এতবড়ো এক-জন মানুষ রবার্টগঞ্জে আসছেন, আমাদেরও তো কিছু করা উচিত। এতে অবু তুমি ‘না’ কোরো না।
হাতঘড়িতে তাকিয়ে অনুমান করার চেষ্টা করলেন ক-টা নাগাদ এখানে এসে পৌঁছোতে পারেন মেজদা। অবশ্য সবকিছুই নির্ভর করবে কখন ওখান থেকে রওয়ানা হচ্ছেন তার ওপরে। যদি দেড়টা দুটোতে এসে খেয়েই চলে যান সিংগ্রাউলিতে তবে বড়োই লজ্জার কারণ হবে। এত লোকে আশা করে রয়েছেন, তা ছাড়া এটা অবনীবাবুর প্রেস্টিজেরও ব্যাপার বটে। লোকে বলবে, বোধ হয় আপন শালা নন, পাড়াতুতো-টুতো হবেন। আর বেচারি ললিতা, তারই তো সবচেয়ে বেশি টেনশন। কাল রাতে স্বামী-স্ত্রীতে এই নিয়ে কথা হচ্ছিল। মেজদা এসে অবনীবাবুর মাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবেন তো? ললিতা বলছিলেন, মেজদা আমার যে কাউকেই প্রণাম-ট্রণাম করে না, বাবার শ্রাদ্ধও তো করেনি, চুলদাড়ি কাটেনি। মেজদা কি কম্যুনিস্ট? অবনীবাবু বলেছিলেন।
না, কম্যুনিস্ট তো নন। ওঠা-বসা তো সব ক্যাপিটালিস্টদের সঙ্গেই। ছোড়দা বলত, মেজদা আসলে অপরচুনিস্ট। যার কাছ থেকে যেটুকু বাগিয়ে নেওয়া যায়। তলারটাও কুড়োব, গাছেরটাও খাব।
পটা বাইরে বারান্দাটা ঝড় দিয়ে দিয়েছিল অনেকক্ষণ, এখন ফিনাইল দিয়ে ভালো করে মুছছে। পটা ভাবছিল, বউদির দাদাকে কোনো সুযোগে কথা বলবে। শুনেছে বউদির দাদাকে নর্দার্ন কোলফিল্ডসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ফাইনান্স ডিরেক্টর সকলেই খুব সম্মান করেন। তিনি বলে দিলে পটার একটা চাকরি হয়ে যেতেই পারে। যেকোনো চাকরি হলেই চলবে, তবে খাদানের কুলির কাজ করতে পারবে না। তারা তো নিরক্ষর কিন্তু পটা তো ইংরাজি বাংলা অক্ষর জানে, পড়তে পারে, লিখতে পারে, মোটামুটি হিসেবও করতে পারে, নইলে বাজার থেকে পয়সা মারে কী করে রোজ? হিসেব তো মাকে বুঝিয়ে দিতে হয়। বাবু ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট্যান্ট হতে পারেন, তাঁদের চুরি-টুরি লাখ লাখ টাকার, যদি চুরি করা মনস্থ করেন, কিন্তু পটার দিনে দশটাকা হলেই যথেষ্ট। আফিং আর বিড়ির খরচটা এই চুরির পয়সাতেই হয়। এককাপ করে দুধও খায়, সেটা অবশ্য ফ্রিজ থেকেই চুরি করে, আফিং খেলে একটু দুধ খেতে হয়ই।
চার
মোগলসরাই স্টেশনেই নামার কথা ছিল। সময় বাঁচাবার জন্যে অনেকেই আর গঙ্গার ব্রিজ পেরিয়ে ট্রেনে বেনারস অবধি যান না। তা ছাড়া, যাঁরা অন্য দিকে যাবেন তাঁরাও মোগলসরাই জাংশনেই নেমে পড়েন।
নর্দান কোলফিল্ডসের বোর্ড নিয়ে এক-জন উর্দিপরা ড্রাইভার এবং ইউনিয়নের একটি ছেলে স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন, কারণ ইউনিয়নের কবিতা-ভালোবাসা কর্মীরাই এই কবিদের মহাসন্মেলনের উদ্যোক্তা। ইউনিয়নকে ভয় সব কর্তাই পান, সব কোম্পানিরই। তাদের গুড হিউমারে রাখাটা প্রত্যেকেরই অবশ্য কর্তব্য, তাই তারা যখন যা আবদার করে তা প্রসন্নচিত্তে মেনে নেয় ম্যানেজমেন্ট, সব কোম্পানিই।
স্টেশনে আরও ছিলেন ব্রতীন বাগচী, এক সময়ের নকশাল এবং শক্তিশালী আধুনিক কবি। তাঁকে দেখে অবাক হলেন গুণেন। বললেন, তুমি! কী করে জানলে যে আমি আসছি?
আমি, যে ব্যাংকে তোমার ভগ্নীপতি রবার্টগঞ্জ ব্রাঞ্চে কাজ করে সেই ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার। পুরো উত্তরপ্রদেশের কোনো বাঙালি কবির সাধ্যই নেই যে, এ বুড়ি না ছুঁয়ে কোথাও যায়। আমার হেডকোয়ার্টাস লক্ষ্ণৌতে। তুমি আসছ শুনে আর শনি-রবি পড়েছে বলে চলে এলাম। আমাদের চমৎকার এয়ার কণ্ডিশাণ্ড গেস্ট হাউস আছে। তোমার জন্যে কাম্পারি আনিয়েছি কলকাতা থেকে। গেস্ট হাউসের কুক চমৎকার বিরিয়ানি ও মোগলাই খানা বানায়। এরশাদ মিয়া। এখানে দু-চার-জন বাঙালি কবিও আছে, তাঁদের খরব দিয়ে রেখেছি। এতক্ষণে তাঁরা গেস্ট হাউসে পৌঁছেও গেছেন। এখন চলো, চান করে ব্রেকফাস্ট করো। তারপর বিয়ার, কাম্পারি সেশান বসবে। আমার একটি নতুন বই বেরিয়েছে দে’জ থেকে, তোমাকে দেব।
গুণেন বলল, কিন্তু আমাকে রবার্টগঞ্জে দুপুরে যেতেই হবে। আমার ছোটো বোনেরই তো স্বামী অবনী।
আরে তোমার মতো এক-জন সেলিব্রিটি কী সময় নষ্ট করবে এ-রকম নন ডেসক্রিপট একটা জায়গাতে? না না, তা হবে না।
ওরা খুবই দুঃখ পাবে। তা ছাড়া কষ্ট করে খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করেছে, অনেককে বলেও রেখেছে হয়তো, রান্নাবান্নাও শুরু করে দিয়েছে। আমার মা-ও খুব রাগ করবেন জানতে পেলে। ওদের বাড়ির ওপর দিয়ে যাব অথচ ওদের সঙ্গে দেখা না করে!
দেখা করবে না কেন? ফেরার সময় তাড়াতাড়ি বেরিয়ে দুপুরে খেয়ে, গল্প করে, বিশ্রাম করে তারপর মোগলসরাই থেকে এ. সি. ফাস্ট ক্লাসে এ চড়ে চলে যেয়ো। তুমি ফিরবে কবে?
পরশু দিন।
পরশুই সব বন্দোবস্ত করে রাখব আমি। ট্রেনে চড়ার আগে কয়েকপাত্র হুইস্কি খেয়ে ডিনার আর জল নিয়ে ট্রেনে চাপবে। সব বন্দোবস্ত করে দেব আমি, যদিও সোমবার বলে আমার থাকা হবে না।
সোমবার হলে ওদের, মানে গুণেনাদেরও অসুবিধে হবে। যাঁদের আসার কথা তাঁরা হয়তো আসতে পারবেন না।
আরে ওরা তো সব পেটিক্লার্ক এখানে ওখানে। কাজ তো করে উলটে দিচ্ছে। সকালে অ্যাটেণ্ডেন্স রেজিস্টারে সই করেই সব অন্য কাজে যায়, কেউ তোমার মতো কবিতা লেখে। তোমার খবরের কাগজের অফিসে তুমিই-বা সপ্তাহে ক’দিন যাও আর গেলেই বা কতক্ষণ থাক? এ-সব আমাকে বোলো না। আমি নিজে রবার্টগঞ্জে ফোন করে দিচ্ছি। তোমার ভগ্নীপতি ট্যা-ফোঁ করতে পারবে না। তা ছাড়া, বলে গলাটা নামিয়ে ব্রতীন বলল লক্ষ্ণৌতে আমাদের যে সাহিত্য-কাব্য গোষ্ঠী আছে তারা এ-বছর থেকেই একটা পুরস্কার চালু করেছে। আগামী ডিসেম্বরে দেওয়া হবে সেটা। পুরস্কার কমিটির আমিই চেয়ারম্যান—আমি তোমার নাম প্রোপোজ করেছি এবং ব্যাংকের সঙ্গে অনেকেরই টিকি বাঁধা বলে আমার প্রোপোজাল অ্যাকসেপ্টেডও হয়েছে। তোমাকে আমাদের অফিসিয়াল ডিসিশান অ্যাণ্ড ইনভিটেশান আজই বিকেলে দিয়ে দেব। শুভ্রাকে নিয়ে এসো। লক্ষ্ণৌ অতিপরিচিত শহর তুমি তো জানোই, খুবই সম্মান দেবে তোমাকে ওখানকার মানুষেরা।
কী পুরস্কার? নারকোল আর গামছার সংবর্ধনা? যেমন সাহিত্যিকদের দেওয়া হয়। যেসব গায়কের গলাতে সুর লাগে না তারাও তো আজকাল তিরিশ-চল্লিশ হাঁকে, শুধু সাহিত্যিকদের বেলাতেই এমন অপমানজনক পরিস্থিতি।
আমি নিজে একজন কবি। তুমি কী করে ভাবলে যে অন্য একজন কবিকে আমি অপমান করব? পুরস্কার মূল্য ৫০,০০০—মানে পঞ্চাশ হাজার টাকা-ইন ওয়ার্ডস।
গুণেন বললেন, তা তো হল। তুমি না হয় ফোনও করে দেবে কিন্তু তাদের শহরের ওপর দিয়ে যাব, তারা দেখতে পাবে না?
কেউ দেখতে পাবে না। আমি সিংগ্রাউলিতে ফোন করে দাস সাহেবের কাছ থেকে ভেনুটা জেনে নিচ্ছি। সময়টাও। তুমি অন্ধকার নামলে এখান থেকে বেরোলে সময়মতো পৌঁছে যাবে। নর্দার্ন কোলফিল্ডস ইন্নোভা গাড়ি পাঠিয়েছে টোয়োটো কোম্পানির, প্লেনের স্পিডে চলে যাবে।
বলেই বলল, চলো এখন আমার গাড়িতে। বলেই নর্দার্ন কোলফিল্ডসের ড্রাইভারকে বলল, তোমার মোবাইল ফোন আছে তো?
জি হুজুর।
তবে সিংগ্রাউলিতে বলে দাও এই প্রোগ্রামের কথা। তারপর বলল, গুণেন আর আমি গেস্ট হাউস থেকে রবার্টগঞ্জ ব্রাঞ্চের মানেজারকে বলে দিচ্ছি তোমার ভগ্নীপতি অবনীবাবুকে খবর দিয়ে দেবে।
ম্যানেজারকে দিয়ে বলে পাঠালে কি ঠিক হবে? আমি নিজে বললে ভালো হত নাকি?
ও-সব ঝামেলাতে যেয়ো না। দুপুর একটার মধ্যে প্রাইজ কমিটির অন্য দু-জন মেম্বার চিঠি টিঠি নিয়ে এসে পৌঁছোবেন গেস্ট হাউসে বিদায় সেশনে জয়েন করতে তুমি আমার দিকটা একটু ভাবো। ওদের মধ্যে বেঁটে চট্টোপাধ্যায়ের ভক্ত আছেন দু-জন। তারা তাকেই প্রাইজটা দিতে চেয়েছিল। তোমাকে দিলে আমার লাভ? তোমার কাগজে তুমিই তো কবিতার ইনচার্জ। আমার কবিতা মাঝে মাঝে ছাপবে।
গুণেন বলতে গিয়ে চেপে গেল যে সে আর ক্ষমতাতে নেই, সেই ক্ষমতা এখন অন্য এক কবিকে দেওয়া হয়েছে, গুণেনের চেয়ে কমবয়সি। বলে ফেললেই তো সর্বনাশ।
গুণেন মিত্র চুপ করে রইলেন।
ব্রতীন বাগচী বললেন, চলো।
অবনী বাড়িতে ন্যাকা হাঁদু ফোন করে কনফার্ম করল যে ওরা সব স্টক নিয়ে এগারোটার আগেই পৌঁছে যাচ্ছে। ওর এক ভাগনি আছে গুণেন মিত্রকে একটি কবিতা শোনাতে চায়, বেনারসে পড়ে কলেজে। গুণেন মিত্র রবার্টগঞ্জে আসছেন শুনে গতরাতেই এসে হাজির হয়েছে।
অবনী বললেন, দেখো এত স্বল্প সময় উনি থাকবেন তারমধ্যে পান করা, খাওয়া, বিশ্রাম। কবিতা শোনার সময় কি হবে ওর?
না না, সে-কথা বোলো না। কবিতা না শোনাতে পারলে মেয়েটা গলায় দড়ি দেবে।
অবনী একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তাহলে নিয়েই এসো।
শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ-গলার ঘাম মুছতে মুছতে ললিতা বসার ঘরে, যেখানে অবনী বসেছিল, এসে বলল, ক-টা বাজে গো? বলে, নিজেই দেওয়ালের বড়ো ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, বাবা সাড়ে দশটা বেজে গেল। এতগুলো পদ তা-ও এতজন লোকের জন্যে, ক্যাটারারকে বললেই বোধ হয় ভালো হত।
তোমার সেলিব্রিটি দাদাকে ক্যাটারারের খাবার খাওয়াবে?
তা-ও ঠিক। তারপরই ললিতা বলল, ওমা! তোমার ব্যাংকের ম্যানেজারের গাড়ি যে গো। যাও যাও তুমি বাইরে যাও, আমি ভেতরে যাচ্ছি। তোমরাই তো বলো লোকটার মেয়ে-দোষ আছে। তবে আজ যদি জরুরি কাজের দোহাই দিয়ে অফিসে যেতে বলে আর তুমি যদি যাও তাহলে তোমাকে এ-কাজ ছেড়ে দিতে হবে। তোমাকে আমি এ-কাজ করতেই দেব না।
অবনীবাবুও কম অবাক হননি। ম্যানেজার উপাধ্যায় কখনো তাঁর বাড়িতে আসেননি। তবে ললিতা যাই বলুক চাকরি ছাড়লে খাবেন কী? অবনী বারান্দায় দাঁড়িয়ে ম্যানেজারকে আপ্যায়ন করে ভেতরে আসতে বললেন। ম্যানেজার বলল, আপকি কোই রিস্তোদার বাগচি দোস্ত হ্যায়?
কওন বাগচি সাহাব?
আরে ঔর কওন? লক্ষ্ণৌকি। হামলোগোঁকি ভগয়ান।
নেহি তো। হামে তো পাতা নেহি থা।
উপাধ্যায় একবার কেশে বলল, মগর…..।
ললিতা বসবার ঘরের পর্দার আড়ালে থেকে বোঝবার চেষ্টা করছিল, কী কথা হতে পারে দু-জনের মধ্যে…..।