আপাত শুভ্র
আমার সঙ্গে পতুবাবুর, মানে পতুমেসোর আলাপ, বলতে গেলে, আকস্মিক ভাবেই। আমাদের এক বন্ধু সুমিতের মামার বাগানবাড়ি ছিলো বারাসত উজিয়ে গিয়ে বাদুর কাছে। পতুমেসোর বাড়িটি ছিল, বাড়ি না বলে বাসস্থানই বলা ভালো, ওই বাগানবাড়িরই প্রায় লাগোয়া। মাঝে মাঝেই আমরা বন্ধুরা দল বেঁধে যেতাম ওই বাগানে পিকনিক করতে। কখনো রাতে থেকেও যেতাম। তাস খেলা হত, গান-বাজনা, কখনো বা অভিনয়ের মহড়াও।
সবে সাতদিন হল চাকরি পেয়েছি স্টেটব্যাঙ্কে। তারই সেলিব্রেশান করতে বন্ধুদের জোরাজুরিতে যাওয়া হয়েছে সেবারে। শনিবার রাতে পৌঁছে খুব হৈ হৈ হয়েছে। সকালে দেরি করে উঠে আমরা শুয়ে-বসে আড্ডা মারছি। ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছে। সুমিত গেছে মালিকে সঙ্গে করে মাংস আনতে। এমন সময়ে চমৎকৃত হয়ে দেখি তিনটি মেয়ে আম কুড়োচ্ছে আম-বাগানে। তাদের সুন্দরী বলতে যা বোঝায় তা বলা চলে না তবে প্রত্যেকের মুখে একটা আলগা শ্রী ছিল। যেন তিনটি হরিণী।
বাগানে অনেকই আমগাছ ছিল। আম কুড়োবে কী তারা, আমার বন্ধুরা এবং আমিও আমাদের সবকটি তরুণ হৃদয় কল্পনার আমেরই সঙ্গে ছড়িয়ে ছড়িয়ে মিশিয়ে দিলাম তাদের পায়ের কাছে। দেখি, কার-কারটা নেয়। জানালার ধারে আমাদের হুড়োগুড়ি এবং মুগ্ধতা, যা আদৌ অশোভন ছিলো না, কুরুচিকরও নয় ; তাদের চোখে পড়েছিল। তারা হেসে, একটি করে আম হাতে নিয়ে ফিরে গেল। হৃদয় নিল না আম, তা বুঝতে না দিয়ে।
ভালোলাগার মতো মেয়ে তো কতই দেখা যায়! কিন্তু এই তিনবোনের মধ্যে এমন কোনো ব্যাপার ছিল, তাদের তেল-মাখানো খোঁপা, কোমর-ছাপানো চুল, মা-মাসিমাদের মতো করে শাড়ি পরার ধরন এবং তাদের মুখের গভীর সৌম্য এবং সম্ভ্রান্ত গ্রাম্যতা আমাদের সকলকেই একসঙ্গে মুগ্ধ করে ফেলল।
কলকাতার সুন্দরীদের মধ্যে আজকাল কোনো রকমফেরই চোখে পড়ে না। সকলেই একরকম করে শাড়ি পরে। সকলেই চুলে তেল দেয় না। এবং চুল ছাঁটে। ভুরু প্লাক করে। ভ্রু আঁকে। শাড়ির চেয়ে সালোয়ার-কামিজ বেশি পরে। কেউ কেউ বা আমাদেরই মতো ট্রাউজারস বা জিনস। ওপরে পাঞ্জাবি।
যাই হোক, আমরা এইরকম আন-সফিস্টিকেটেড, পিওর গ্রাম্য সুন্দরী, তার আগে দেখিনি কখনো তাই সত্যিই শোকাহত হয়ে পড়েছিলাম ওরা চলে যাওয়ায়।
সুমিত বাজার করে ফিরল। সব শুনে বলল, তোদের তো অবস্থা রীতিমতো খারাপ দেখছি! ইডিয়টস। এখনও কেউ প্রেমে পড়ে? এই অলমোস্ট টোয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরিতেও!
প্রদীপ বলল বুকে হাত দিয়ে, শুধু প্রেম নয়, মাসস প্রেম। একটা হিল্লে কর ভাই আমাদের। নইলে তোদের পুকুরেই আমরা তিনজনে মিলে— একসঙ্গে গলায় কলসি বেঁধে ডুবব আর সুইসাইড নোটে লিখে যাব যে তুই-ই এই জন্যে দায়ী। ইয়েস, সুমিত সেন।
আমাদের মধ্যে চতুর্থজন, সুহৃদের বিয়ে হয়েছিল গত শীতে, ওর পিসতুতো বোনের সঙ্গে, রেজিস্ট্রি করে।
সুমিত বলল, ভাবনা কী? আমি মাসিমাকে বলছি। যা ভালো রান্না করেন না মাসিমা। শুঁটকিমাছ, কাউঠটা, ভেটকিমাছের কাঁটা চচ্চড়ি। তারপরে হিজ হুজ হুজ-হুজ এলেম।
প্রদীপ বলল, গড়গড় করে বলে গেলি ওগুলো কী জিনিস রে? চাইনিজ ডিশ নাকি?
ধ্যাৎ। এগুলো বাঙাল-রান্না। পদ্মাপারের নয়, একেবারে চাঁটগার। বিজাতীয় রান্নাই যদি খেতে হয় তাহলে কিন্তু বাঙালদেরই! বুঝেছিস! কোথায় লাগে থাইল্যাণ্ডের বা চাইনিজ ডিশ।
সুমিত গিয়ে উজ্জ্বলকে ডেকে নিয়ে এলো। মেয়ে তিনটির দাদা। চমৎকার ছেলে। আমাদেরই সমবয়েসি। লম্বা-চওড়া-সপ্রতিভ। কথায় একটু চাঁটগাঁইয়া টান আছে শুধু।
বলল, আগামী সোমবার ভিলাইতে যাচ্ছে। ট্রেনিং-এ।
একটু পরেই উজ্জ্বলের বাবা এলেন, সুমিতের পতুমেসো। সেই থেকে আমাদেরও পতুমেসো। ভারি ভোলে-ভালা মানুষ। হাতে মস্ত একটা পেতলের জামবাটি। কুচকুচে কালো টাক নাড়িয়ে পতুমেসো সুমিতকে বললেন এই যে বাবা! তোমার মাসিমা পাঠিয়ে দিলেন।
কী মেসোমশায়?
সিঙ্গিমাছের চচ্চড়ি, কালোজিরে কাঁচালঙ্কা দিয়ে জম্পেশ করে রেঁধেছেন তোমারই জন্যে। শুঁটকিমাছও পাঠিয়ে দিচ্ছি। বম্বে ডাক। মনে হবে মাংস। এখনও একটু বাকি আছে।
উনি চলে গেলে সুমিত বলেছিল, ভারি ভালোমানুষ রে। যখনই আসি কত কী করেন। অথচ সম্পূর্ণ বিনাস্বার্থে। এমন মানুষ আজকাল বেশি চোখে পড়ে না।
দুই
মনে আছে উজ্জ্বলের ছোটো তিনবোনের নাম ছিলো দীপিতা, ঈশিতা আর ইপ্সিতা।
বলাই বাহুল্য, বছর চারেক কেটে গেছে তার পরে। ওদের একজনকেও আমাদের মধ্যে কেউই বিয়ে করিনি। কারণ কোনো অবকাশের মেঘলা দুপুরে ঝিরিঝিরি হাওয়া-বওয়া যৌবনের সুখময় রোমান্টিকতায় পৃথিবীর সব যুবতীকেই বিয়ে করতে ইচ্ছে যায় সব যুবকেরই। কিন্তু সেসব ঘটনা পঞ্চাশ বছর আগে ঘটত। এখন মানুষের মন ঘণ্টায় ঘণ্টায় পালটায়। এখনকার দিনের যুবকেরা মেয়ের বাবার অবস্থা, মেয়ের চাকরি, কী পাবে না পাবে, এসব না দেখে আদৌ এগোয় না। খবরের কাগজের সম্পাদকের দপ্তরে ‘‘জহর ব্রত’’ আর ‘‘সতী’’র বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষায় চিঠি লিখেই পাত্র-পাত্রী কলাম নিয়ে হামলে পড়ে সব শিক্ষিত ছেলে এবং তাঁদের শিক্ষিত বাবা-মায়েরা।
না। আমি অথবা প্রদীপ অথবা সুমিত আমরা কেউই বিয়ে করিনি দীপিতা বা ঈশিতা বা ইপ্সিতাকে। যদিও প্রদীপ এবং সুমিত বিয়ে করেছে বড়োলোকের মেয়েদের। দেখতেও মন্দ নয় দুজনেই। দুজনেই এম. এ পাস। প্রদীপ মারুতি গাড়ি পেয়েছে। সুমিত ব্যবসা।
সুমিত এবং পতুমেসোর বারংবার অনুরোধে উজ্জ্বলের জন্যে আমাকে একটি মেয়ে দেখে দিতে হয়েছিল। দেখেছিল অনেকেই, আমারটাই বিঁধে গেল।
আমাদের পাড়ার ফুচকুদা ভারি কেউকেটা লোক। প্রতিশুক্রবারই তাঁর বাড়িতে পার্টি লেগে থাকে। পুলিশের কর্তা থেকে শহরের কেউকেটা লোকেদের মোচ্ছব লেগে যায়। বছরের মধ্যে ফুচকুদা তিনবার সপরিবারে বাইরে বেড়াতে যান। ব্যবসাটা ওঁর যে ঠিক কীসের তা কেউই জানে না। উনি বলেন, অর্ডার সাপ্লাইয়ের। তবে ভালো অর্গানাইজেশান আছে বলে মনে হয়। কারণ নিজেকে খাটতে হয় না একটুও। বিনা-পরিশ্রমে এমন রবরবা এক স্মাগলিং ছাড়া অন্য কিছুতে হতে পারে বলে মনে হয় না। পাড়ার লোকেরা তাই বলে।
এমনিতে পাড়ার লোকদের সঙ্গে ব্যবহার ভালো। তাঁর স্ত্রী নমিতাদি খুবই মিশুকে। কথায় কথায় বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে এমন হাসেন যে, ভয় হয় যে-কোনো সময়ে সে দাঁত খুলে পড়ে যাবে। কেউ হয়তো কখনো বলেছিল তাঁকে যে, দাঁত বার করে হাসলে, সুন্দরী দেখায়। তারপর থেকেই তাঁর এই দেখন-হাসির রোগ। রোগটি বছর চার-পাঁচের। এই বয়সেও সুইমিং জগিং যোগ ব্যায়াম করে নিজের মেয়ে শাশার মতোই তরুণী রেখেছেন নিজেকে। কিন্তু কোন বয়সে যে কোন সৌন্দর্য মানানসই এবং এদেশটা যে এখনও অ্যামেরিকা হয়ে যায়নি এই কথাটি বোধহয় তাঁর ‘স্পোকেন-ইংলিশ’ শেখা মাথায় ঢোকে না।
উজ্জ্বলের বিয়েতে ঘটকালি করাটাই কাল হয়েছিল আমার। ভাবলেই এত খারাপ লাগে।
না, না। ডিভোর্স-টিভোর্স নয়।
পতুমেসো মানুষটি এত কষ্ট করেছেন সারাটা জীবন। মেয়েরাও প্রত্যেকেই যদিও শ্রীময়ী এবং শিক্ষিতা তবুও টাকা ছাড়া যে আজকাল বিয়ে হওয়া ভারি মুশকিল। তাই উজ্জ্বলই ছিল পতুমেসোর একমাত্র ভরসা। উজ্জ্বল যদি পায়ে ভালো করে দাঁড়ায়, এবং তার স্ত্রী যদি মন্দবুদ্ধির না হয় তবে উজ্জ্বল একএক করে নিশ্চয়ই তিনবোনকেই বিয়ে দিতে পারবে ভালো করে। উজ্জ্বল যদি বউ নিয়ে আলাদাও থাকতে চায়, থাকুক না। সেখানেও যদি দীপিতাকে রাখে তাহলেও উজোর কোনো ভালো বন্ধু-বান্ধবই ওকে বিয়ে করবে। টাকটাই তো সব নয়। এখনও তো ব্যতিক্রম কিছু আছে। তাই সকলেই বলতেন ছেলের জন্যে ভালো মেয়ে খুঁজতে।
ফুচকুদা আর নমিতা বৌদির বাড়ি ছেলেবেলায় সরস্বতী আর দুর্গাপুজোর চাঁদা আনতে যেতাম। তখন ওঁদের মেয়ে শাশা আর ছেলে চকোর খুবই ছোটো ছিল। এই হঠাৎ রবরবাও তখন হয়নি। এখন দেখি শাশা বারান্দাতে ম্যাক্সি বা জিনস পরে দাঁড়িয়ে থাকে, হাত নাড়িয়ে ইংরেজিতে কথা বলে। ইংরেজিই যেন মাতৃভাষা। বাংলা একটা গণ্য করার মতো ভাষাই নয়। ও ভাষা? শুধু কেরানি আর মাছওয়ালারাই কথা বলে এমনই একটা ভাব। এও আরেক রোগ হয়েছে বত্রিশ পাটি বের করে হাসার মতো। কী কেলো! কথায় কথায় ‘‘ওহ মাই। মাই!’’ ‘‘গুড গ্রেশাস,’’ ‘‘আউচ’’ ইত্যাদি ছিটকে বেরোয়।
ইংরেজদের পদানত যখন ছিলাম আমরা তখন কিছু স্ব-ধর্ম, স্ব-সংস্কৃতি, স্ব-সংগীত, স্ব-ভাষা সম্বন্ধে অজ্ঞ কু-জাত একধরনের বাঙালিদের মধ্যে ‘‘ড্যাডি! ড্যাডি! ছাপ্পর-পর পিজন বৈঠে বৈঠে’’ সংস্কৃতি গজিয়ে উঠেছিল ইংরেজদের জুতোর তলা চাটার জন্যে। তখন তারও মানে বোঝা যেত। কারণ, তাতে লাভ ছিল কিছু। ‘‘ডাউটফুল পেরেন্টেজের’’ মানুষেরা চিরদিনই বিশেষ বিশেষ ফায়দা উঠিয়েছে। তাদের সুন্দর ফিগারের স্ত্রীদের ভাঙিয়ে খেতেও তাদের বিবেকে বাধেনি। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার চল্লিশ বছর কেটে যাওয়ার পর এই ‘বিলেটেড’ মেমসাহেবদের ভাঁড়ামো যে-কোনো সুস্থরুচির শিক্ষিত, ইংরেজি-জানা মানুষের চোখেও অত্যন্তই বিরক্তিকর ঠেকে। শিক্ষা ও সপ্রতিভতা এক জিনিস, আর সপ্রতিভতার র্যাপিং-পেপারের নির্মোক অন্য।
তবু, ফুচকুদার টাকা আছে এবং শাশা একই মেয়ে এবং উজ্জ্বলের বাবারও ইচ্ছে যে উজ্জ্বল যেন একটি শক্ত খুঁটি পায় তার শ্বশুরের মধ্যে।
পতুমেসো সদ্বংশজাত মানুষ। ছেলের বিয়েতে একপয়সাও নেবেন না এবং মেয়েদের বিয়েতেও দেবেন না একপয়সাও। এই ধনুক-ভাঙা পণ। যারা ‘‘গোরু-ছাগলের’’ মতো ছেলে-মেয়ে বেচাকেনা করে সে লোকগুলোকে পতুমেসো মানুষ বলেই গণ্য করেন না।
কী করে কী হলো জানি না। ফুচকুদাকে উজ্জ্বলের কথাটা বলতে উনি বিশেষ গা না করে বললেন, দেখি আগে ছেলে কেমন? পরিবার কেমন? ঝপ করে কি মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায়? আমার কাছে পতুমেসোর ঠিকানাটি নেবার পর একেবারেই চুপ মেরে গেলেন।
খবর পেলাম আবার যখন, তখন বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বিয়ের দিন কুড়ি বাকি। ফুচকুদা তাঁর চাপরাশিকে দিয়ে বিয়ের চিঠি পাঠালেন। একলাইন খামে লিখে : ‘‘বুঝতেই পাচ্চো, কী ঝামেলাতে আচি। আসা চাই-ই।’’
শাশা এবং উজ্জ্বলের বিয়ের সময়ই ফুচকুদার বাড়িতেই পতুমেসো, দীপিকা, ঈশিতা এবং ইপ্সিতার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সুমিতের সঙ্গেও।
পতুমেসো ফুচকুদার দু-হাত জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন : আমার ছেলেকে আপনার হাতে সঁপে দিলাম। দেখবেন, আমি বড়ো অভাগা, দুর্বল এবং গরিব তো বটেই। আমার ছেলেকে যেন না হারাতে হয়। ও-ই আমার এবং আমার মেয়ে তিনটির আশা-ভরসা। ফুচকুদা তাচ্ছিল্যের গলায় বললেন, ন্যাকামি ছাড়ুন তো। আপনার ছেলে কি শিশু নাকি যে, তাকে আমি জাদু করে রেখে দেব? তা ছাড়া তা করবই বা কেন? আমার কি নিজের ছেলে নেই? চকোর?
পতুমেসো কীরকম যেন আহত চোখে আস্তে আস্তে ফচকুদার হাতটা ছেড়ে দিলেন।
আমার খুব খারাপ লেগেছিল। আমার মা বলতেন কক্ষনো বিয়ের ঘটকালিতে আর দাম্পত্য-কলহে থাকবি না। পরে দেখবি মিছিমিছি দু-পক্ষেরই কাছে শত্রু হয়ে উঠেছিস।
বউভাতে ফুচকুদা তো বটেই পতুমেসোও আমাকে নেমতন্ন করেননি। একটু অবাকই হয়েছিলাম। বলতে গেলে, ঘটক হলাম আমি! আর…..
পরে পতুমেসো একটি চিঠি লিখেছিলেন ইনল্যাণ্ড-লেটারে।
পরম কল্যাণীয়েষু, বাবা শুভ্র,
অত্যন্ত লজ্জার সঙ্গে জানাইতেছি যে তোমাকে উজ্জ্বলের বউভাতে নিমন্ত্রণ জানাইতে পারিলাম না। অথচ তুমিই এই বিবাহের ঘটক!
কেন পারিলাম না তাহা পরে কখনো সাক্ষাতে জানাইব। এক্ষণে লিখিবার অসুবিধা আছে।
ভালো থাকিও। একদিন আসিও। তোমার মাসিমা তোমার কথা বলিতেছিলেন। প্রায়ই বলেন। নির্ভয়েই আসিও। আমার কোনো কন্যাকেই তোমার স্কন্ধারুঢ় করিব না। আমার কোনো কন্যাই অরক্ষণীয়া হইয়াছেন এমনও নহে। তা ছাড়া তাহারা নিজেরাই নিজেদের দায় লইতে সক্ষম।
ইতি আং পতুমেসো।
তিন
তারপর বহুদিন পতুমেসোর বা সুমিতেরও আর কোনো খবর রাখি না। ওদের মামাবাড়ির বাগানেও যাওয়া হয়নি। আমাকে মাঝে ডালটনগঞ্জে বদলি করে দিয়েছিল। সেখানে একটি অ্যাকাউন্ট নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। চাকরি যাওয়ারই উপক্রম হয়েছিল প্রায়। তারপরে বম্বেতে ট্রেনিং-এ গেলাম। ফিরে ব্যাঙ্গালোরে।
কলকাতায় যখন থাকতাম তখন দু-একবার দেখেছিলাম উজ্জ্বল ফুচকুদাদের বাড়িতে আছে। বারান্দাতে দেখতে পেতাম। বেড়াতে এসেছে সম্ভবত। একবার মায়ের কাছে শুনলাম যে উজ্জ্বল পারাদীপ না হলদিয়া না ডিগবয় কোথায় যেন ট্রান্সফার হয়ে গেছে।
আমার এখনও বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। আমার পরের বোন সোমা গোঁ ধরেছে যে ‘‘পায়ে না দাঁড়িয়ে’’ বিয়ে করবে না। বিয়ে ওর অবশ্য ঠিকই হয়ে রয়েছে। সৌরীন ডাক্তার। প্রায়ই আসে আমাদের বাড়ি। সোমার পায়ে দাঁড়াতে এখনও বছরখানেক। মায়ের ইচ্ছা নয় যে, আমি সোমার বিয়ে না দিয়ে আগে বিয়ে করি। অবশ্য আমার কাউকে পছন্দও নেই। পছন্দ করার সময়ও নেই। মেয়েরাও বোধহয় সাধারণভাবে আমাকে অপছন্দ করে।
এক রবিবার সুমিতদের বাড়িতে গেছি। সুহৃদ, প্রদীপ সকলেই এসেছিল। সুমিত লেট-লতিফ। ছুটির দিন দশটা অবধি ঘুমোয়। সকলে ওর ঘরে বিছানার ওপর বসে গুলতানি মারছি। এমন সময় সুমিত বলল, যা: চলে! ভুলেই গেছিলাম শুভ্র। তোর নামে একটি চিঠি এসেছে আমার কেয়ারে। পতুমেসোর কাছ থেকে।
সুহৃদ সুমিতের বিছানাতে শুয়ে পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে আনন্দবাজারের পাতা ফরফরিয়ে পড়ছিল। একথা শুনে হঠাৎ বলল, আমাকে লক্ষ করে, দ্যাখ। এবার তোর ঘাড়টি মটকাল বলে। ঘাড় খালি যে রাখে তারই মরণ। যে ভদ্রলোকের নিজের ঘাড়ে তিন-তিনটি অনূঢ়া কন্যা তিনি তোমার মতো ব্যাচেলারের ঘাড় ভাঙবেন না তো কে ভাঙবেন? বেচারি! আর না ভেঙে করবেনই বা কী?
সকলেই ঝুঁকে পড়ে দেখতে গেলাম চিঠিটি একসঙ্গে। মধ্যে দিয়ে কাগজটাই ছিঁড়ে গেল।
আমি ওদের দেখালাম, চিঠির ওপরে Personal লেখা।
ওরা বলল, সরি!
বাদু
১৫.৮.৮৮
উত্তর চব্বিশ পরগনা
পরমকল্যাণীয় শ্রীমান শুভ্র বসু
C/O পরমকল্যাণীয় শ্রীমান সুমিত চট্টোপাধ্যায়
১০০, দেশপ্রিয় পার্ক ওয়েস্ট,
কলকাতা – ৭০০ ০১৯
বাবা শুভ্র,
‘উজোর’ বউভাতে তোমাকে নিমন্ত্রণ করি নাই এবং সে কারণে বৌভাতের পরে পরেই তোমাকে একটি পত্র লিখিয়াছিলাম। সেই পত্রে এমৎ কহিয়াছিলাম যে না-করার কারণ তোমাকে পরে জানাইব।
এক্ষণে জানাই যে উজোর শ্বশ্রুমহাশয় আমাকে বারণ করিয়াছিলেন। কহিয়াছিলেন যে পাড়ায় তাঁহার বিশেষ সম্মান আছে। পাড়ার লোককে বলিতে হইলে একহাজার মানুষকে বলিতে হইবে। তেমন সামর্থ্য কি আপনার আছে?
আমি কহিয়াছিলাম কিন্তু শুভ্রই যে এই বিবাহের মূলে! কিন্তু তিনি কর্ণপাত করেন নাই।
যে-কারণে আজ তোমাকে পত্র লিখিতেছি তাহা অতিকরুণ। এমনকী তাহা তোমার নিকট বিশ্বাসযোগ্যও না হইতে পারে। কিন্তু আমি তোমা বই আর কাহাকেই একথা বলিতে পারিতেছি না। বাবা, এ যে বড়োই লজ্জার কথা, বাবা হইয়া নিজপুত্র সম্বন্ধে এইরূপ কথা বলিবই বা কেমনে?
আমার ও আমার স্ত্রীর প্রাণাধিক ‘উজো’, তাহার তিনভগিনীর নয়নের মণি উজো হারাইয়া গিয়াছে। না, না, অন্যরূপ ভাবিও না। হারাইয়া গিয়াছে অর্থাৎ চুরি হইয়া গিয়াছে। সে প্রথমে দুর্গাপুরে জয়েন করিয়াছিল। বিবাহের পরে ছয়মাস পর্যন্ত অনিয়মিত ভাবে একা আসিত। তাহার পর রাউরকেল্লাতে বদলি হইয়া চলিয়া যাইবার পর মাঝে মাঝে চিঠিপত্র লিখিত এবং টাকাও পাঠাইত। তাহার পর হইতে তাহার আর কোনো সংবাদ জানি না। সে যে কোথায় রহিয়াছে, কেমন রহিয়াছে গত দীর্ঘ দুই বৎসরে তাহার কিছুই জানি না।
তাহার দুর্গাপুরস্থ এক বন্ধু চিঠি লিখিয়া জানাইয়াছিল যে সে সস্ত্রীক বিদেশে বেড়াইতে গিয়াছে। এবং ফিরিয়াই রাউরকেল্লা হইতে ভিলাই চলিয়া যাইবে। তাহাকে ট্রান্সফার করা হইয়াছে। পদমর্যাদাও বৃদ্ধি হইয়াছে। আমার পুত্রবধূ শাশাও গত আড়াই বৎসর হয় আমাকে, তাহার শশ্রুমাতাকে অথবা তাহার ননদিনীদিগকে একটিও পত্র লেখে নাই। প্রি-পেইড টেলিগ্রাম পর্যন্ত করিয়াছি। উত্তর পাই নাই।
অদ্য হইতে প্রায় দেড় বৎসর পূর্বে আমার বেয়াই মশাইয়ের নিকট নিরূপায় হইয়া একদিন গিয়া তাঁহার পায়ে পড়িয়া আমার পুত্রের বিশদ সংবাদ প্রার্থনা করি। এমন সময় আমি উজোর কন্ঠস্বরও শুনিতে পাই দোতলাতে। কিন্তু ফুচকুবাবু বলেন, পতুবাবু আপনার ছেলে, মনে করুন, চুরি হইয়া গিয়াছে। শিশুকালেও চুরি যাইতে পারিত। সে শিশুকালে অপহৃত না হইয়া ভরাযৌবনে হইয়াছে। আপনি গাত্রোত্থান করুন। আপনার পুত্রের সঙ্গে দেখা হওয়া সম্ভব নহে। উজ্জ্বল এখন আর আপনার পুত্র নহে, সে আমার জামাতা হইয়াছে। এবং তাহাই থাকিবে। ভবিষ্যতে আর কখনোই তাহার খোঁজ করিবার চেষ্টা করিবেন না এবং যত শীঘ্র সম্ভব আপনি এই স্থান ত্যাগ করিয়া যান।
আমি সংযম হারাইয়াছিলাম। বলিয়াছিলাম, জানোয়ার! তোমাকে আমি গলা টিপিয়া হত্যা করিব।
ফুচকুবাবুর দারোয়ান আর কুকুরে আমাকে প্রায় ছিঁড়িয়া ফেলিয়াছিল। পেছনের গ্যারাজে আমাকে বলপুর্বক লইয়া গিয়া বন্ধ ভ্যানে চাপাইয়া সাদার্ন অ্যাভিন্যুর নির্জন স্থানে ধাক্কা মারিয়া ফেলিয়া দেওয়া হয়। আমার চশমাটি ভাঙিয়া বাম চোখের নীচে অনেকখানি কাটিয়া যায়।
তুমি ভাবিতে পারো যে, এই সব কষ্টকল্পিত ঘটনা। বিশ্বাস করিও যে ইহার একবর্ণও মিথ্যা নহে। ধাক্কা মারিয়া পথে ফেলিবার পূর্বে আমাকে এই বলিয়া শাসানো হইয়াছিল যে, ভবিষ্যতে আবারও আসিলে মিথ্যা পুলিশ-কেস দিয়া আমাকে চোর প্রতিপন্ন করিয়া তিনবছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হইবে।
আমিও আর যাই নাই। আমার বেয়াই প্রতাপশালী ব্যক্তি এবং দুষ্ট ব্যক্তি,—তাঁহার পক্ষে সব কিছুই করা সম্ভব। ক্ষমতা যদি দুষ্টজনের কুক্ষিগত হয় তখন তাহার রূপ হয় প্রলয়ংকরী।
আমি এক্ষণে অসুস্থ। এমনই অসুস্থ যে শয্যা হইতে উঠিতে পর্যন্ত পারি না। মেয়েদের কাহারও বিবাহ হয় নাই। এমন যোগ্য পুত্র থাকিতেও সে নাই। এমতাবস্থায় আমার কী করণীয় তাহা তুমি ও তোমার বন্ধুরা মিলিয়া যাহা স্থির করিবে তাহাই মানিয়া লইব।
তুমি শুঁটকিমাছ খাইতে ভালোবাসো। যেদিন আসিবে তাহার পূর্বদিন একটি পোস্টকার্ড ফেলিয়া দিও। তোমার মাসিমা তোমার নিমিত্ত শুঁটকিমাছ রাঁধিয়া রাখিবেন।
অপেক্ষা করিবার সময় আর বেশি নাই। যথাসম্ভব শীঘ্র আসিও।
এই অসহায় সম্বলহীন বৃদ্ধর অপরাধ নিজগুণে মার্জনা করিও।
—ইতি আশীর্বাদক পতঞ্জলি রায়
স্তব্ধ হয়ে আমি চিঠিটি ওদের দিকে এগিয়ে দিলাম। সুমিত জোরে জোরে পড়ল, যাতে সকলে শুনতে পারে।
চিঠি পড়া হলে পর প্রদীপ বলল, কী কেলো বল তো!
সুহৃদ বলল, এ তো আজকাল হরদমই হচ্ছে। জানিস না? ছেলে বা মেয়ের বাবার মধ্যে যে বেশি ইনফ্লুয়েনশিয়াল সে-ই পাবলিক বা প্রাইভেট সেক্টরের বড়োসাহেবদের বলে নিজের জামাইকে বা ছেলেকে বা পুত্রবধূকে যেখানে-সেখানে ট্রান্সফার করিয়ে দিচ্ছেন। এমন জায়গায় করছেন যাতে জামাইয়ের বা পুত্রবধূর ‘‘চুরি হয়ে যাওয়া’’ ছাড়া উপায়ই নেই।
মেয়ের হয়তো বনছে না শাশুড়ির সঙ্গে তো সে জামাইকে এর্নাকুলাম-এ ট্রান্সফার করে। যা এবারে সেখানে গাঁটের কড়ি খরচা করে বউ-এর সঙ্গে ঝগড়া করতে! বছরে কতবার পারবে যেতে? আর গেলেও কোমরের ব্যথার চিকিৎসা করাবে আগে? না ঝগড়া করবে? আবার ধর বাড়িতে প্রবলেম। পুত্রবধূ বড়ো ত্যাণ্ডাই-ম্যাণ্ডাই করছে। এদিকে পঙ্গু শ্বশুর। খিটখিটে শাশুড়ি। যেই জানা গেল পুত্রবধুর বাবা জামাইকে ট্রান্সপার করাবার তালে আছেন, তখনই দে আরও বড়ো মুরুব্বি ধরে ট্রান্সফারের পথে কাঁটা বসিয়ে। কত লোক টাকাও বানিয়ে নিচ্ছে আজকাল এই করে।
বলিস কী রে!
হ্যাঁ রে। যার এলেম আছে সে সমুদ্রের ঢেউ দিলেও টাকা বানায়। এলেম কি আর চাট্টিখানি কথা!
প্রদীপ বলল, তা ট্রান্সফার করলেও জানা যাবে না কোথায় ট্রান্সফার করল?
ওপর-মহলে জানা থাকলে তবেই না এমন ট্রান্সফার করানো সম্ভব? আর পতুমেসো অতিসাধারণ মানুষ। জনবল অর্থবল কিছুই নেই। তাঁর পক্ষে ছেলের বা জামাই-এর কোনো কলিগ-টলিগকেও জানা না থাকলে কোথায় ট্রান্সফার হল তা জানবেনই বা কী করে? তা ছাড়া বড়োসাহেব অপারেটর, রিসেপশনিস্ট বা এরিয়া-ম্যানেজারকে টিপেও তো রাখতে পারেন! ঠেকাচ্ছেটা কে?
তা ঠিক। আমি বললাম।
প্রতিষ্ঠিত, শিক্ষিত বন্ধুরা পতুমেসোর এই এস-ও-এসকে বিশেষ গ্রাহ্যর মধ্যেই আনল না দেখে একটু ব্যথিত হলাম আমি। ওরা ‘‘অ্যাকাডেমিক ডিসকাশন’’ করেই নিজের নিজের কর্তব্য শেষ করল।
সুমিতই একমাত্র বলল, তোকে লিখেছে ‘‘পার্সোনাল’’ চিঠি, তুই দেখে আয়। টাকাপয়সা কিছু দিতে হলে চাঁদা তুলে দেওয়া যাবেখন।
সুমিত চান করে তৈরি হলে ওরা সকলে গেল টিটুর বাড়ি ভিডিও দেখতে। মোৎজার্টের জীবন নিয়ে ভিডিও ‘অ্যামেডিয়াস’। ওখানেই খাওয়া-দাওয়া করবে সকলে। টিটুর বৌদি নেমন্তন্ন করেছেন।
চা খেয়ে বললাম, আমি কিন্তু উঠছি। ‘অ্যামেডিয়াস’ আমি দেখেছি। বৌদিকে বলিস কিছু মনে না করতে। চমৎকার ছবি। দেখে আনন্দ পাবি।
সুমিতদের বাড়ির বাইরে বেরিয়ে মোটরসাইকেলটা স্টার্ট করতেই তার এঞ্জিনের ভটভট শব্দ যেন অ্যামপ্লিফায়ারের শতগুণ বেড়ে উঠে আমার কানের মধ্যে ভটভট করে উঠল। আমি সোজা চললাম বাদুর দিকে।
পতুমেসো প্রায়ান্ধকার ঘরে শুয়ে শুয়ে অনেক কথা ভাবছিলেন। এখন বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। কিছু করতেও পারেন না করার মতো। শুধু ভাবতে পারেন।
যে-যুগে ভালোমানুষি ও সারল্যের মতো মূর্খামি আর দুটি হয় না সেই যুগে পতুবাবুর মতো সরল ভালোমানুষ যে কী করে জন্মান তা ভাবাই যায় না।
বাড়ি ছিলো চিটাগঙ্গ-এ। পাহাড়, সমুদ্র, সামুদ্রিক পাখি আর শুঁটকিমাছের দেশ। শিশুকালে একবার কক্সবাজারেও গেছিলেন। সেসব এখন স্মৃতি। পার্টিশানের সময় ওঁর বয়স ছিল বারো। আজ পনেরো আগস্টে ছাপ্পান্ন হল।
নেহরুসাহেব আর জিন্নাসাহেব দুই দেশের প্রধানমন্ত্রিত্বের গদিতে আসীন হবার মুহূর্তেই বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো দেশভাগের খড়্গ পড়েছিল তাঁদের মাথায়।
প্রথমে উদবাস্তু হয়ে গেছিলেন আসামে। সেখান থেকেও তল্পি গুটিয়ে আসতে হল বাঙালি জাতির শেষ অবলম্বন এবং ক্ষয়িষ্ণু কলকাতাতে। তখন তাঁর বয়স পঁয়তাল্লিশ।
বাঙালির চরিত্র যে কী প্রকার খারাপ তা নিয়ে পতুবাবুর কোনোরকম উত্তাপ ছিল না কোনোদিনই। উনি নিজস্ব সমস্যাসমূহ নিয়ে এতই ন্যুব্জ ছিলেন যে সমাজ, যুগ, দেশ,কাল, কংগ্রেস, সি. পি. এম. জনমোর্চা, রাজীব গান্ধি অথবা কিমি কাটকার কোনো কিছু সম্বন্ধেই দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষেরই মতো ওঁর বিন্দুমাত্রও আগ্রহ ছিল না। আপাতত কোনোক্রমে ওঁর ‘‘উজো’’-কে ফিরে পেলেই তিনি হাতে চাঁদ পেতে পারেন। না। শিশু নয়। বেদেরা বা আন্তঃরাষ্ট্রীয় কোনো ছেলেপাচারকারী দলও তাকে ধরেনি। পরমদুর্বিপাকের মধ্যেও খেতে পান আর নাই-ই পান ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনো তিনি ঠিকই চালিয়ে গেছিলেন। মেয়েরাও ভালোই ছিল পড়াশুনোয় কিন্তু ব্রিলিয়ান্ট ছিল উজ্জ্বল। ব্যবহারেও। আসামে থাকার সময়ই আসাম সরকারের বৃত্তি পেয়ে পড়েছিল। কলকাতাতে এসে পতুবাবুর বাদুর কাছাকাছি প্রায় বস্তির মতো আস্তানাতে থেকে ‘উজো’ এঞ্জিনিয়ারিং পড়ে এবং ফার্স্ট হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায়। টাটা কোম্পানি থেকে ডেকে চাকরি দেয় তাকে। এই বাজারে ক-জনের ছেলেকে ডেকে চাকরি দেয় কে?
ছোটো তিনবোনের বড়ো আদরের একমাত্র ‘‘দাদা’’, দুখিনী মায়ের বড়ো গর্বের ধন এই উজ্জ্বল। পতুবাবুর ‘‘উজো’’।
সুমিতের বড়োমামার বাগানবাড়ির পাশ দিয়েই এলাম।
অনেক দিন আসিনি এদিকে। বড়ো শ্রীহীন হয়ে গেছে পুরো এলাকাটি, গাছপালা তো নেই, নতুন নতুন নানা ঢঙের নানা ধাঁচের বাড়ি উঠেছে। আর বেড়েছে মানুষ এবং যানবাহন। পাখির ডাক শোনা যায় না। কর্কশ চিৎকার। রুক্ষ। আমগাছেরও বেশির ভাগই নেই।
সুমিতের কাছে শুনেছিলাম যে, পতুমেসোর ব্যবসা ফেল করেছে। কোনোদিনও পতুমেসো যোগ্য ছিলেন না। তা ছাড়া ওই লাইনে বাঙালি খুব কমই ছিলেন। ওঁর ব্যবসা বড়োরকম ধাক্কা খাওয়াতে বাঙালি প্রায় নিশ্চিহ্নই হয়ে গেল ওই লাইন থেকে।
এখন কোনো ব্যবসাই হয়তো বাঙালির জন্যে নয়। অথচ ব্যবসা না করলে এই জাতটা ভিখিরি আর দালাল আর বেশ্যার জাতই হয়ে যাবে। অন্য কোনো পথ খোলা নেই। একমাত্র ব্যবসাই একে বাঁচাতে পারে। এ বড়ো সঙ্কটময় মুহূর্ত। বাঙালি সমাজের প্রতিভূ, মাথা, দন্ডমুন্ডের কর্তা এখন ফুচকুদার আর নমিতা বৌদির মতো মানুষেরাই!
পতুমেসোর বাড়িটাও চেনা যায় না। টিনের চালের পাকা দেওয়ালের বাড়ির একদিকের ছাদের টিন ঝড়ে উড়ে গেছে। পেঁপে গাছে দাঁড়কাক ডাকছে খা-খা করে। মনে হচ্ছে সব বুঝি সত্যিই খেয়ে নেবে।
দীপিতা পুকুর থেকে নেয়ে উঠে পুকুরপাড়ের টিউবওয়েল থেকে জল তুলে স্বচ্ছ ভেজা শাড়িতে ভেজা চুলে কোমরে জলের ঘড়া তুলে নিয়ে আসছিল। প্রথমে আমি ওকে চিনতে পারিনি। ও-ও পারেনি আমাকে। কোথায় গেছে সেই ঢলঢলে রূপ।
হতবাক হয়ে আমি ভাবছিলাম, দারিদ্র্য যেখান দিয়ে হাঁটে তার দু-পাশ বড়ো নোংরা করে যায়। শুয়োরেরা যেমন কচুবন উপড়োয়, দারিদ্র্যও তেমন শ্রী, সুখ; শান্তি। বোগেনভেলিয়া ফুলগুলিকে পর্যন্ত খেয়ে নিয়েছে দারিদ্র্য। আশ্চর্য!
আমি মুখ নামিয়ে বললাম, পতুমেসো।
দীপিতা বলল, আসছি আমি।
বলেই, ভেতরে গিয়ে জামা পরে, শাড়ি বদলে এলো। জামাটাও ছেঁড়া। শাড়িরও তথৈবচ অবস্থা। বলল, বাবা অসুস্থ। আপনার কথা বলেছি। ভিতরে আসুন।
ভিতরে না গেলেই পারতাম!
পাঁচ ইঞ্চি সিমেন্টের দেওয়ালের প্রায় জানালাহীন ঘর। ওপরে টিনের ছাদ। তেতে আগুন হয়ে আছে। পতুমেসো একটি তক্তপোষের ওপর অতিমলিন বিছানায় শুয়ে আছেন একটি নোংরা তেলচিটে বালিশের ওপর মাথা রেখে। চেনাই যাচ্ছে না। দড়ির মতো হয়ে গেছে শরীর।
মাসিমা একটি ভাঙা টিনের চেয়ার পেতে দিলেন বিছানার পাশে।
বললেন, কেমন আছ শুভ্র?
আমার নাম যে শুভ্র এ কথাটি মনে হয়ে বড়ো লজ্জা হল আমার। এই ঘরে, এই বিছানাতে, এই মানুষের সামনে ‘শুভ্রতা’র চেয়ে বড়ো ভ্রষ্টতা আর কিছুই হয় না।
আমি বললাম, পতুমেসো! তারপর বললাম, কী হয়েছে মাসিমা?
পতুমেসো চোখ খুললেন হঠাৎই ভীষণ উত্তেজিতভাবে। এদিক ওদিক কাকে যেন খুঁজলেন। যেন কেউ এসে দাঁড়িয়েছে, তাঁর মাথার কাছে। তারপর আমাকে দেখেই হাত চেপে ধরলেন। বুকের ওপরে ধরে রইলেন হাতটা।
ওঃ তুমি!
নিরাশ গলায় বললেন উনি। তারপরই চোখ বুজে ফেললেন।
বললাম, পতুমেসো, এসেছি। আমাকে সব খুলে বলুন।
কী আর বলব? তোমার ফুচকুদা মানে, উজ্জ্বলের শ্বশুর একটা বাজে, ইতর মানুষ। উনি চক্রান্ত করে, পদে পদে চক্রান্ত করে আমার ছেলেকে কেড়ে নিয়েছেন। আর ও ফিরে আসবে না। কোথায় যে রয়েছে এখন তাও জানি না। টাটার চাকরি ছাড়িয়ে দুর্গাপুরে ঢুকিয়েছিলেন। তারপর দেখতে দেখতে ছেলে আমার দূরে সরে যেতে লাগল। শেষে চুরিই হয়ে গেল শুভ্র। ছেলে চুরি হল।
দোষ শুধু আমাদের পাড়ার ফুচকুদাকে দিয়ে কী হবে? আপনার এত ভালো ছেলে উজ্জ্বল কি ইচ্ছে করলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারত না? পারত না যে, একথা আমি বিশ্বাস করি না।
না। ও পারে না। সত্যি। বিশ্বাস করো। ওর হাত-পা বাঁধা। ফুচকুর লোক পোস্ট-অফিসে পর্যন্ত আছে। উজ্জ্বলের তার মা ও বোনদের কাছে লেখা চিঠিগুলি পর্যন্ত সেই দৈত্যর হাতে চলে যায়।
পতুমেসো বললেন, জানো শুভ্র, মাঝে মাঝে কী মনে হয় এখন জানো? টেররিজম ইজ দ্যা ওনলি ওয়ে আউট। খবরের কাগজ পড়ো না? এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
আপনার কী হয়েছে পতুমেসো?
জিজ্ঞেস কোরো না। আমার পেটে ও গলায় ক্যানসার। বড়ো যন্ত্রণা শুভ্র। কিন্তু যখনি দীপিতা, ঈশিতা আর ইপ্সিতার মুখে চোখ রাখি তখুনি তাদের মনের যন্ত্রণা অন্য সব যন্ত্রণাকে ডুবিয়ে দেয়। বড়ো যন্ত্রণা শুভ্র।
ফুচকুদাকে গিয়ে কি কিছু বলব?
মাথা খারাপ। ভগবানের কাছে তো বটেই, মানুষের কাছেও মাথা নোয়ানো যায়। কিন্তু উনি তো মনুষ্যেতর জীব। তার কাছে যেন মৃত্যুর ক্ষণেও মাথা না নোয়াতে হয়।
তো কী করব?
তোমার তো অনেক জানাশোনা। যদি ভিলাই স্টিল প্লান্টে খোঁজ নিতে পারো।
আমি বললাম। উজ্জ্বল কি ওখানে আছে?
জানি না। চেষ্টা করে দেখো। জানতে পারো কি না।
উজ্জ্বলের চিঠি না হয় আসছে না। উজ্জ্বল নিজেও কি একদিনের জন্যে আসতে পারে না?
আমার মনে হয় পারে না। তোমার ফুচকুদাকে তুমি চেনো না।
কী জানি!
এমন সময় দীপিতা এলো। হাতে এককাপ চা নিয়ে।
বলল, চা খান।
ওর সঙ্গে চোখাচোখি হল। আমার মনে হল, আমি শিক্ষিত উপার্জনক্ষম যুবক। আমার শিক্ষা আমাকে কিছু কর্তব্য-দায়িত্ব দিয়েছে। দেওয়াটা উচিত অন্তত। যে কারণে আমার শিক্ষা নিয়ে আমি গর্বিত।
দীপিতা তখনও দাঁড়িয়েছিল।
আমি বললাম পতুমেসো, আমি দীপিতাকে চাইতে এসেছি।
কথাটা বলে ফেলেই ন্যায্য কারণে নিজের সম্বন্ধে আমি গর্বিত হলাম।
পতুমসোর চোখ দুটো ঘোলাটে দেখাল।
বললেন, ভাড়া নেবে? ক-রাতের জন্যে?
আমি মুখ নামিয়ে নিলাম।
কী হল বলো?
আমি বললাম, পতুমেসো, আমি দীপিতাকে বিয়ে করতে চাই।
বিয়ে?
দীপিতা?
আমি দীপিতার মুখে তাকালাম।
তার মুখে না-হাসি, না-কান্না, না-রাগ, না-লজ্জা, না-বিস্ময় ফুটে রইল বে-মওকা কেটে-যাওয়া চাঁদিয়াল ঘুড়ির মুখের ভাবের মতো।
দীপিতা চলে গেল ঘর ছেড়ে।
আমি বললাম ঈশিতা আর ইপ্সিতা কোথায়?
ওরা অফিস করে। অফিসে গেছে।
কী অফিস?
জিজ্ঞেস করি না শুভ্র। শুভ্র, আমি ভয়ে জিজ্ঞেস করি না। রোজ সকালে ডাল-ভাত আর আলুসেদ্ধ আর কচু সেদ্ধ খেয়ে চলে যায় হাতে দুখানি একসারসাইজ বুক আর বই নিয়ে। ফিরতে ফিরতে সাতটা-আটটা। কত টাকা পায় জানি না। দৈনিক তাদের মাকে দুজনে মিলে পঞ্চাশ টাকা দেয়।
ওদের সঙ্গে দেখা হবে না তাহলে?
হতে পারে, যেখানে ওরা দেখা দেয়। সে কোথায়। আমি তো জানি না শুভ্র।
আমি দীপিতাকে চাই।
সম্মানের সঙ্গে চাও? সদ্বংশজাতা নারীর মতো যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারবে তো শুভ্র? বিশ্বাস কোরো, দোষ ঈপ্সিতা ইপিসতারও নয়, দোষ আমার। দোষ সেই নেতাদের যারা আমাকে আমার সম্পূর্ণ বিনাদোষেই রাতারাতি উদবাস্তু করেছিল। দু-দুবার।
আমি বললাম পারব। পারব মেসোমশাই।
আমার গলা ধরে এসেছিল।
উঠে পড়ে, হেড গিয়ারটা হাতে নিয়ে বললাম, আমি আবার আসব। আমি কিন্তু দীপিতাকে চাই।
আবার যেদিন আসব সেদিন, যেন ঈশিতা আর ঈপ্সিতা বাড়ি থাকে। পোস্টকার্ড ফেলে আসব।
পতুমেসো চুপ করে থাকলেন। হাতটা তুললেন। কার উদ্দেশে জানি না।
চার
পরদিন ভোরে চায়ের সঙ্গে খবরের কাগজ খুলেই দেখি গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা-করা দুই যুবতীর ছবি। ঈশিতা আর ইপ্সিতা। দুইবোন।
চা পড়ে গেল খবরের কাগজে। আমি সোজা ফুচকুদার বাড়ি গেলাম। তিনি তখন প্রাতঃকালীন ভ্রমণ সেরে এসে যোগব্যায়াম করছিলেন।
একতলার বসার ঘরে ঘণ্টাখানেক বসে থাকার পর চটি ফটফটিয়ে নীচে নামলেন তিনি।
বললেন, পুলিশের কোনো বড়োসাহেবকে বলতে বলছ তো?
না। আমি আপনার কাছে এর জবাবদিহি চাইতে এসছি।
জাবাবদিহি! আমার কাছে? মুখ সামলে কথা বলো হে বাবুমশায়।
বাবুমশায় কথাটা বোধহয় অবাঙালি ব্যবসাদারদের কাছ থেকে শেখা।
আপনিও মুখ সামলে কথা বলবেন। আপনি একটি ইতর, জানোয়ার। উজ্জ্বলকে এরকম করে ওর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন কেন? আপনার মনে নেই পতুমেসো অনুনয় করে আপনাকে কী বলেছিলেন?
হা:। তুমি বিয়ে করলে তুমিও বুঝবে। যে পুরুষ যখন যে নারীর স্তনে মুখ রাখে সে পুরুষ তখন তার।
মানে?
মানে মাতৃস্তনে রাখলে মায়ের, স্ত্রীর স্তনে রাখলে স্ত্রীর, রক্ষিতার স্তনে রাখলে তার। উজ্জ্বল এখন শাশার। ব্যাটা ম্যাড়া যদি বাপ-মায়ের খোঁজ না রাখে সেই দোষ কি আমার?
ফুচকুদা।
দেখো ছোকরা। আমাকে ভয় দেখিও না। তেলাপোকা ছাড়া আর কোনো কিছুকেই আমি ভয় পাই না।
এই দুটি নিষ্পাপ মেয়েকে হত্যার জন্যে আপনিই দায়ী।
নিষ্পাপ? ফু:। তুমি যদি শুতে চাইতে কালই শুইয়ে দিতাম। অবশ্য এখন আর…
এই ইতরের সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। চলে এলাম ওখান থেকে। ভাবলাম, মোটর সাইকেল নিয়ে আমি তখুনি যাই। কিন্তু কী করব গিয়ে? আমি এমন ঘনিষ্ঠ নই যে আমি গেলে ওঁরা শোকে সান্ত্বনা পাবেন। এই শোক এতই গভীর, এতই তীব্র যে, আমি গেলে বিব্রতই হবেন শুধু ওঁরা। তাই আমাদের পাশের বাড়ির ভন্টেকে ডেকে মোটর সাইকেলটা দিলাম। দীপিতার নামে একটা চিঠি দিয়ে চিঠির মধ্যে একহাজার টাকা পাঠালাম। ভন্টেকে বললাম যে, পোস্টমর্টেমের পর কোথায় দাহ হবে তা জেনে, যেখান থেকেই হোক আমাকে একটা ফোন করে দিতে। আর দাহর বন্দোবস্ত সব করতে। উজ্জ্বল এসেছে কি না তাও জানাতে বললাম।
ভন্টে ফোন করল দুটোর সময়ে। বলল, আজ যে রবিবার। দাহ আজ হবে না। পোস্টমর্টেম হবে কাল। দাহ হতে হতে কাল রাত। কী করব?।
চলে আয়। দীপিতা কী বলল?
চিঠিটা পড়ল। টাকাটা ফেরত দিয়েছে। বলল পরে চিঠি লিখবে তোমাকে শুভ্রদা।
পতুমেসো কী করছেন রে? কেমন আছেন?
শুয়ে শুয়ে গীতাপাঠ করছেন।
মাসিমা?
কাঁদছেন না। দু-চোখে আগুন। ছোটো দু-বোনকে নাকি প্রতিশনি-রবিবারে দলের পর দল লোক দেখতে এসেছিল। গত দেড় বছরে। রসগোল্লা সিঙারা খেয়ে গেছে। গান শুনেছে, চুল দেখেছে, পায়ের নখ দেখেছে। পছন্দও করেছিল সব দলই। শুধু দাবির জন্যেই বিয়ে হয়নি কোথাওই। প্রত্যেকেরই ভালো দাবি ছিল।
বলিস কী রে? পশ্চিমবঙ্গেও এরকম হয়? এই সব তো উত্তরপ্রদেশ, বিহার, তামিলনাড়ুতে…।
সব জায়গাতেই হয় শুভ্রদা। সব জায়গাতেই নোংরা। ওপরে শুধু একটি সাদা চাদর পাতা। ডেডবডির ওপরে যেমন পাতা থাকে। তোমার নামটা এবার পালটে ফেলো। হাই-টাইম। তোমার নামটার মধ্যে কেমন একটা ভন্ডামি-ভন্ডামি গন্ধ আছে। এই দেশে ও নাম অচল। ‘‘শুভ্র’’ নাম এখানে চলে না।
হুঁ!
বলে, লাইন রেখে দিলাম আমি।
পাঁচ
পরদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ভণ্টেকে সঙ্গে নিয়ে বাদুতে গেলাম। ভণ্টে জার্নালিজম-এ এম এ করে বসে আছে। চাকরি নেই। কোনো বাঙালি ছেলেরই চাকরি নেই।
বাদুতে পৌঁছেই দেখি উজ্জ্বল। মাসিমা-মেসোমশাইয়ের পায়ের কাছে বসে হাউ-হাউ করে কাঁদছে। বলল, অসুস্থ ছিলাম দু-দিন। গতকাল খবরের কাগজটা পর্যন্ত আমার কাছ থেকে সরিয়ে রেখেছিল। দু-চারদিন কোনো ফোনও ধরতে দেয়নি। কলিগেরা এলে মিথ্যা কথা বলে ফিরিয়ে দিয়েছে। দুপুরে এক বন্ধুর বাড়ি নেমন্তন্ন ছিল। শাশা যেতে না করেছিল। নিজের শরীর খারাপ এই অছিলাতে যায়নি। গিয়ে দেখি, সকলেই আলোচনা করছে ঈশিতা-ইপ্সিতাকে নিয়ে। কাগজটা চেয়ে একবার দেখেই সোজা নীচে নেমে ট্যাক্সি নিয়ে একবার বাড়ি পৌঁছে টাকা-পয়সা চেকবুক নিয়ে এই আসছি। ফুচকু চৌধুরীর মেয়ে, তার নাতি, তার দেওয়া চাকরি কোনো কিছুর সঙ্গেই আর সম্পর্ক রাখব না। আগে আমার বোনেদের সৎকার করে নিই। ওই রাসকেলটার কী করি তোমরা দেখো।
চাকরি ছাড়বি কেন দাদা?
দীপিতা বলল। আতঙ্কিত গলায়।
চাকরির অভাব কী আমার? বাইরের কত জায়গা থেকে অফার পেয়েছি। শুধু ওই একটার জন্যে। শ্বশুর! আমার শ্বশুর। কী বলব তোকে শুভ্র! এখানেই চাকরি পাব এক মাসের মধ্যে। ও জন্যে ভাবিস না। বিদেশ যাবার কথা ভাবছিলাম এখানের নোংরামির জন্যে। বড়ো নোংরা, বড়ো লোভ চারদিকে।
আমার আবারও মনে হল আমার নামটা বড়োই লজ্জার।
পোস্টমর্টেম শেষ হবে বিকেলে। তারপর দাহ।
আমি বললাম, আমরা ঘুরে আসছি। সময়মতোই ফিরব।
মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে ভন্টে বলল, শালাকে কী করা যায় বলো তো! শালার বড্ড বড় বেড়েছে।
আমি বললাম, ফুচকুদা কিন্তু ফট করে কাঠমান্ডু বা অন্য কোথাও চলে যেতে পারে। কাঠমান্ডু ওর ফেভারিটি-স্পট। হয়তো স্মাগলিং-এর কানেকশানস আছে।
ভন্টে বলল, প্রাণে মারলে হবে না। সারাজীবন পঙ্গু করে রাখতে হবে। শালার কত্ত টাকার গরম আর ধূর্তামি বেড়েছে দেখাই যাক। বস্তার মধ্যে ভরে রাবারের রড দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে তুলো ধুনব ওকে। হাড়গোড় ভেঙে দেব। শারীরিক কষ্ট কাকে বলে, খিদে কাকে বলে, তা ওকে জানাতে হবে। মৃত্যুর কাছাকাছি যেতে কেমন লাগে, তাও। ওর চোখ দুটো খুবলে তুলে নেব। ওকে পনেরোদিন গুম করে রাখতে হবে। কত পুলিশ আর বড়োলোক ওর জানা আছে দেখি!
কোর্ট-কাছারি করলে হত না?
আমি বললাম।
হত। কিন্তু কাঁচকলা দেখাত ও। আইন তো তামাশামাত্র। যার পয়সা আছে সে-ই সে তামাশা দেখতে পারে।
আমি ভাবছিলাম, পতুমেসো বোধ হয় ঠিকই বলছিলেন।
টেররিজম। টেররিজম ইজ দ্যা ওনলি ওয়ে আউট।
ফুচকুদার বাড়ি যখন পৌঁছোলাম তখন বেয়ারা বলল, সাহেব এখনি বেরোবেন।
ঠিক আছে। আমরা তো শুতে আসিনি। একটা কথা বলেই চলে যাবে।
ভন্টে বলল।
অত্যন্ত উত্তেজিত ভাবে মুখ-ভরতি পান-জর্দা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে ফুচকুদা বললেন, কী ব্যাপার। আবার কী?
আপনার মেয়ে শাশা আর নাতির প্রোটেকশনের বন্দোবস্ত করুন, আমরা বাদু থেকে আসছি। সেখানের লোক প্রচন্ড খেপে গেছে আপনার ওপরে। আপনার এখানের বাড়িও জ্বালিয়ে দিতে পারে। ঠিকানা চাইছিল। আমরা দিইনি।
কী ইয়ার্কি হচ্ছে? আমার মেয়ে কোথায় বলো তো?
কেন? ভিলাইতে।
ভন্টে বলল। আপনি কি ভাবছেন নিজেদের সময় নষ্ট করে আমরা আপনার সঙ্গে আমড়াগাছি করতে এসেছি? আমরা সত্যি বলছি না মিথ্যে টেলিফোন করেই জানতে পারেন।
ওঃ আই সী!
নাম্বারটা দেব? ভিলাই-এর?
ভন্টে বলল।
না। ঠিক আছে ফুচকুদা একটু চমকে উঠে বললেন।
আমি বললাম ফুচকুদা, আপনার কিন্তু একবার বাদুতে যাওয়া দরকার। উজ্জ্বল এসেছে।
উজ্জ্বল? কোথায়?
বাদুতে। আসবে না? দু-দুটো বোন একসঙ্গে।
উজ্জ্বল? আর উ্য ম্যাড?
হ্যাঁ। উজ্জ্বল।
ভন্টে বলল, শুভ্রদা যাই বলুক, খবরদার। আপনি কখনো যাবেন না। ওখানকার লোক জ্যান্ত আপনার চামড়া ছাড়িয়ে বেগুনের মতো ঝলসে দেবে। দেখুন ওরা এখানেও আসে কি না। ডেসপারেট ছেলে আছে সব ওখানে। কিছুকে কেয়ার করে না।
ওরা? কেন…আমি তো লাইফে কারোরই ক্ষতি করিনি…।
আমার ভীষণ হাসি পেল। একথা শুনে।
বললাম, জীবনে একজনেরও কি ভালো করেছেন ফুচকুদা? একজনেরও ভালো হলে আপনি একটুও খুশি হয়েছেন আজ অবধি? কোনোদিনও কি একমুহূর্তের জন্যে হলেও কারও মঙ্গলকামনা করেছেন?
ফুচকুদা চোখ মিচকে, যেন কিছুই বুঝতে পারেননি এমনভাবে বললেন মানে?
এটা ওঁর আরেক কায়দা। গোলমালে পড়লে, উত্তর দেবার জন্যে সময়ের প্রয়োজন হলেই সমানে মানে? মানে? করে যান। ছেলেবেলা থেকেই তা দেখছি।
আমি মনে মনে বললাম, আপনার মুখে আপনার চরিত্রের আর মানসিকতার ছাপ বড়ো গভীরভাবেই পড়ে গেছে। আপনার মুখোশের দাগগুলো প্রকট হয়ে উঠেছে। আপনার মুখের দিকে চাইলেই পরিষ্কার বোঝা যায় আপনি কী প্রকৃতির মানুষ।
আমি বললাম, আমরা চলি।
যাওয়া নেই, এসো।
ভন্টে মোটরসাইকেল চালাচ্ছিল। আমাকে বাড়িতে নামিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বললাম ওখানেই ফিরে চলো।
হু হু করে গরম হাওয়া লাগছিল চোখে মুখে। পিচ গলছিল। রাস্তার।
ভন্টের পেছনে বসে ঝাঁকতে ঝাঁকতে যেতে যেতে আমার মনে হচ্ছিল ফুচকুদার লোমহীন বুকটা কেটে যদি দেখা যায় তা হলে দেখা যাবে হৃদয় যেখানে থাকার সেখানে হৃদয় নেই। একটা ঘিনঘিনে ব্যাঙ বসে আছে। আর চোখ দুটির গর্তে করপোরেশনের ম্যানহোলের থিকথিকে নোংরা।
জোরে মোটরসাইকেল ছুটছিল। আমি ভাবছিলাম ফুচকুদার ওপরে না হয় প্রতিশোধ নেওয়া গেল। যে মেয়ে-মদ্দরা দলে দলে সিঙাড়া-রসগোল্লা খেয়ে গত দেড় বছর ধরে প্রতিশনি-রবিবার ঈশিতা আর ইপ্সিতাকে অপমান করে গেল তাদের শাস্তি দেব কী করে? খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে তার মধ্যে আমার, সুমিতের, সুহৃদের, প্রদীপের এমনকী ভন্টের আত্মীয়-বন্ধুরাও আছে।
ভন্টে বোধহয় ঠিকই বলেছে। যে সাদা চাদরটা দিয়ে ঢাকা আছে সব কিছু, সমস্ত দেশ, সেই চাদরটাকেই সরাতে হবে। সেটাই হবে আসলে উৎসে গিয়ে প্রতিকার।