আয়নার সামনে

আয়নার সামনে

মনে পড়ে, সেদিন লক্ষ্মীপূর্ণিমা ছিল। উত্তরপ্রদেশের বন ও পাহাড়-ঘেরা অখ্যাত জায়গা তিতিরঝুমায় বেশ ঠাণ্ডা পড়ে গেছিল। আমি কলকাতায় আসছিলাম ছুটিতে। গোরুর গাড়ি করে বারো মাইল পথ আসতে হত তখন, লাঠিয়ালিয়া স্টেশনে ট্রেন ধরতে।

রাতের গাড়ি ধরব বলে বিকেল বিকেল বেরিয়ে পড়েছি। সঙ্গে চৌহান সাব। খড়ের ওপর কম্বল বিছিয়ে তার ওপরে বসে ছইয়ে হেলান দিয়ে আমরা গল্প করতে করতে আসছি।

বাইরে ফুটফুট করছে জ্যোৎস্না। কাঁচা রাস্তা, তাই বয়েলগুলোর পায়ে পায়ে ও গাড়ির চাকায় ধুলো ছিটোচ্ছে, কিন্তু উড়ছে না। কারণ শিশিরে ভিজে ধুলো ভারী হয়ে আছে। দু-পাশে কিতারি ও বজরার খেত। দূরে বিন্ধ্যাচলের পাহাড়ের রেখা দেখা যাচ্ছে। আদিগন্ত সমান উচ্চতায় একটা দেওয়ালের মতো।

ধুলোর গন্ধ, শিশিরের গন্ধ, জ্যোৎস্নার গন্ধ, গোরুর গায়ের গন্ধ, খড়ের গন্ধ, শিশিরভেজা বজরা ও কিতারির গন্ধ মিলে একটা অদ্ভুত মিশ্র গন্ধ বেরুচ্ছে।

দেখতে দেখতে আমরা টুণ্ডুর মোড়ে পৌঁছোলাম। গাড়োয়ান গাড়িটার মুখ ডানদিকে ঘোরাল, এবার আমরা পাহাড়ের সীমানায় তিতিরঝুমার মাঠে এসে পড়লাম। ধু-ধু মাঠের একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে বুটবুটিয়ার খাস জঙ্গল।

রাজিন্দার সিং গোরুর গাড়ির পেছনের দিকে বসেছিল। গায়ের ওপর আলতো করে ফেলে রেখেছিল একটা দেহাতি কম্বল। রংটা এখনও মনে আছে। সাদার ওপরে কালো বড়ো বড়ো চেক। কম্বলের ওপর, রাজিন্দারের কাটা কাটা অথচ ভাবুকমুখে চাঁদের নরম ভিজে আলো এসে পড়েছে। রাজিন্দার পথের পেছনের গাছগাছালি, চন্দ্রালোকিত ধু-ধু প্রান্তর ও দূরের পাহাড়ের দিকে চেয়ে যেন কী ভাবতে ভাবতে চলেছে।

একটা সাদা লঞ্জীপেঁচা পথের পাশের একটা ঝাঁকড়া বাবলা গাছ থেকে উড়ে এসে নি:শব্দে আমাদের চলমান গোরুর গাড়ির ওপরে চক্রাকারে উড়তে উড়তে অনেকখানি এল, তারপর আবার ফিরে গিয়ে সেই গাছে বসল।

হঠাৎ রাজিন্দার বলল নিজের মনেই, আমার দিকে মুখ না ফিরিয়ে বলল, কী সুন্দর আমাদের দেশটা, না বেণিবাবু? বড়ো সুন্দর এই দেশটা। এদেশের মানুষগুলো, মানে আমরা সকলে যদি এই দেশের মতো হতাম?

আমি একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, দেশের মতো সুন্দর মানে?

ও বলল, শারীরিক সৌন্দর্যের কথা নয়। সুন্দর হত যদি সব মিলিয়ে, যদি মানুষের মতো মানুষ হত!

মানুষের মতো মানুষ মানে তুমি কী বলতে চাইছ? মানুষ তো আমরা সকলেই। কী? আমরা মানুষ নই?

রাজিন্দার আমার দিকে মুখ ফেরাল এবার, বলল, কই? দেশে মানুষ কই? মানুষের মতো মানুষ কই?—আমরা সকলেই বেশিরভাগই তো মানুষের ছাঁচমাত্র। কিছু বদ রক্ত, কিছু জল, কিছু মেদ, কিছু অস্থি-চর্মের সমষ্টি। কতগুলো ছাঁদে-ফেলা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জঞ্জাল। এই কোটি কোটি লোকের মধ্যে মানুষ ক-জন আছে বলো?

গোরুর গাড়িটা একটা কালভার্টের দিকে এগোচ্ছিল।

হঠাৎ গাড়োয়ান চাপা ভয়ার্ত গলায় বলল, কালভার্টের ওপরে মাথা-মুখ চাদরে ঢেকে কয়েক-জন লোক বসে আছে। মনে হচ্ছে ডাকাত।

এই তিতিরঝুমার মাঠ ডাকাতির জন্যে কুখ্যাত। ডাকাত অবশ্য আমার কাছে নেবেই-বা কী? তবে জামাকাপড় ও গত একবছরে সামান্য মাইনে থেকে যা সঞ্চয় করেছি সবই সঙ্গের সুটকেসে আছে, নিয়ে গেলেই গেল।

গাড়োয়ান গাড়িটাকে ভয়ে দাঁড় করিয়েই ফেলল।

রাজিন্দার ধমক দেওয়ার গলায় ওকে শুধোল, রোকা কিউঁ?

গাড়োয়ান উত্তরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘হুজৌর।’

রাজিন্দার ধমকে একটা গাল দিয়ে বলল, ‘তোর ভয়টা কী? তোর না-আছে বুকের ভিতরে কিছু, না বাইরে কিছু—তোর আবার ডাকাতের ভয় কী রে শালা?’ তারপরই বলল, ‘গাড়ি হাঁকা। সোজা হাঁকিয়ে ওদের সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করা। তারপর ওদের দেখাচ্ছি। ওরা জানে না, গাড়িতে আমি আছি।’

দেখতে দেখতে গাড়িটা প্রায় কালভার্টের কাছাকাছি পৌঁছে গেল। ভয় যে আমার একেবারে করছিল না, তা নয়, ভয় লাগলেও রাজিন্দার সঙ্গে থাকলে ভয় আবার লাগেও না।

গাড়িটা থমকে দাঁড়াল। গাড়িটা দাঁড়াতে দেখেই লোকগুলো উঠে দাঁড়াল।

প্রত্যেকে ছ-ফুটের ওপর লম্বা। এ অঞ্চলের কোনো লোকই বোধ হয় ছ-ফুটের কম নেই। পরনে সব মালকোঁচা-মারা ধুতি, দেহাতি খদ্দরের জামা, গায়ে ভারী দেহাতি চাদর। পায়ে নাল বসানো নাগরা জুতো। হাতে সাত ফুট লম্বা কোঁতকা কোঁতকা লাঠি।

রাজিন্দার তার গম্ভীর কিন্তু চিলের মতো তীক্ষ্ণগলায় একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিল ওদের দিকে। বলল, ‘তু লোগ কওন হো, হো?’

ওরা সমস্বরে হেসে উঠল।

সেই চাঁদের আলোয় তিতিরঝুমার মাঠে দাঁড়ানো আপাদমস্তক ঢাকা লোকগুলোকে ভৌতিক বলে মনে হল।

ওরা হেসে বলল, তেরা বাপ হো।

রাজিন্দার নিরুদবেগ ঘৃণা-ভরা গলায় বলল, ‘তু লোগ সব কুত্তে হো কুত্তে।’ তারপরেই ওদের সকলের সহোদরাদের প্রতি অশ্লীল একটা উত্তরপ্রদেশীয় উত্তপ্ত উক্তি করে বলল, ‘জানসে বাঁচনে চাহতে তো আভভি রাস্তে ছোড়ো, নেহি তো সব শালে লোঁগোকো গেলিসে ভুঞ্জ দিয়া যায় গা।’

লোকগুলো নড়ল না। যেমন দাঁড়িয়েছিল, তেমনি দাঁড়িয়ে রইল।

বলদ দুটো নিরুদবেগ চোখে লোকগুলোর দিকে চেয়ে জাবর কাটতে লাগল।

রাজিন্দার তেমনি বসে বসেই একটুও উত্তেজিত না হয়ে, একটুও না নড়ে বলল, ‘ম্যায় কোই বাঁতে দোবারা নেহি কহতা হুঁ। রাস্তে ছোড়ো কুত্তেকো বাচ্চে।’

হঠাৎ লোকগুলোর মধ্যে একটা চমক খেলে গেল। জলের তলায় চমকে ওঠা একঝাঁক মাছের মতো ওরা দলবদ্ধ হয়েই নড়ে উঠল। তারপর সেই জ্যোৎস্নার মধ্যে ওরা পথ ছেড়ে বুটবুটিয়ার জঙ্গলের দিকে নি:শব্দে চলে যেতে লাগল।

ওদের মধ্যে কে যেন চাপা শ্রদ্ধামিশ্রিত গলায় বলে উঠল, ‘চৌহান সাব!’

আর একজন বলল, ‘জলদি ভাগ। আজ জানসে বাঁচ গ্যয়ে।’

স্টেশন পৌঁছে আলো-ঝলমল ওভারব্রিজ পেরোবার সময় আমি ভালো করে তাকালাম রাজিন্দারের দিকে। পায়জামা আর সবুজ খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা সুপুরুষ ভালো মানুষ দীর্ঘদেহী রাজিন্দারকে দেখে কে বিশ্বাস করবে যে, একটু আগে ডাকসাইটে ডাকাতের দল তার নাম শুনেই পালিয়ে গেছে।

একটু পরে রাজিন্দার চলে গেল।

ট্রেন এলে উঠে পড়লাম। প্রথমে বসার জায়গাও ছিল না। এক স্টেশন পরে জানলার পাশে একটার চেয়ার খালি হল। বসে পড়লাম।

জানলায় বসে বসে ভাবতে লাগলাম। ভাবনার পাখি নানা জায়গা ঘুরে এসে আবার রাজিন্দারের দাঁড়ে বসল।

আমার পরিচয় দেওয়ার মতো কিছুই নেই। নানারকম কসরত করে টিউশনি করে কোনোরকমে বি. এসসি. টা পাশ করেছিলাম। এই নয় যে আমার অবস্থা সচ্ছল হলেই আমি মেধাবী হতাম। মেধাবী আমি কোনোকালেও ছিলাম না। কোনোরকমে না-টুকে সাধারণভাবে বি. এসসি.-টা পাশ করেছিলাম। তারপর এই বিশ্বাটাঁড় জায়গায় একটা লাইমস্টোন কোয়ারিতে চাকরি নিয়ে আসি। বিয়ে-টিয়ে করা হয়নি প্রধানত সচ্ছলতার অভাবে, দ্বিতীয়ত, সাহসের অভাবে। বিধবা মা-র খরচ ও আমার খরচ চলে যায় কোনোরকমে, যা পাই তাতে। রোজকার দিনের কথা ভেবেই দিন চলে যায়। কখনো নিজের চাকরি, নিজের মালিক, নিজের মা, নিজের বন্ধুবান্ধব এসবের বাইরের কোনো ভাবনা মাথায় স্থান দিইনি। বরাবর জেনেছি যে, এসবের বাইরে যেকোনো ভাবনাই ‘বড়ো ভাবনা’। যা আমাকে মানায় না।

গত এক বছর হল রাজিন্দারের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকে আমার মাথায় যেন ভাবনার ভূত চেপেছে। আমাদের দেশের কথা, আমার দেশের লোকের কথা, ঘুরে-ফিরেই মনে পড়ে যায়। হয়তো রাজিন্দারের সঙ্গদোষেই এমন হয়েছে, ও সবসময় বলে, ‘কোনো ভাবনাই বড়ো ভাবনা নয়। আমরা সকলেই এ ভাবনাগুলোকে পরের ভাবনা বলে এড়িয়ে যাই বলেই তো আমাদের দেশের এই দশা।’

ও বলে, ‘এ পোড়া দেশ আমার-তোমার প্রত্যেকের কাছে কিছু-না-কিছু আশা করে।’

অথচ ভাবলে আশ্চর্য লাগে যে, রাজিন্দার যে পরিবেশে থাকে, যেভাবে থাকে, ওর যা সঙ্গীসাথি, তাতে ও এতসব কথা ভাবে কী করে?

ও কোনো পার্টি করে না, ওর নেতা হওয়ার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই, এম. এল. এ. বা এম. পি.ও হতে চায় না। অথচ ও সবসময় এমন ভাবনা ভাবে, এমন সব কাজ করে, তা সাধারণ বুদ্ধিতে ওর এক্তিয়ারের বাইরে থাকা উচিত।

রাজিন্দারের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকে আমার জীবনের মানে যেন বদলে গেল। জীবন মানে যে শুধুই চাকরি করা নয়, শুধুই নিজের পোস্ট অফিস, সেভিংস অ্যাকাউন্টের দিকে চোখ চেয়ে থাকা নয়, নয় নিজের স্ত্রী নিজের ছেলে-মেয়ের গন্ডির মধ্যে দিন কাটানো, তা যেন ওকে দেখে আমি আস্তে আস্তে শিখছি, ততই ওর প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে আসছে। কেবলই আমার মনে হয়, রাজিন্দারের মতো গোটা কয়েক লোক এদেশে থাকলে এদেশের চেহারাটা বুঝি অন্যরকম হত।

রাজিন্দারের সঙ্গে আমার আলাপটা একটা দুর্ঘটনা বই আর কিছুই নয়। কারণ, এই জঙ্গল পাহাড়-ঘেরা নির্জন প্রবাসে আমার ডেরা থেকে তিন মাইল দূরে গভীর জঙ্গলাকীর্ণ উপত্যকার মধ্যে এককালীন এক অত্যাচারী জমিদারের বিনয়ী ও সাহসী পুত্রের সঙ্গে আমা হেন একজন বাঙালি খনি-বাবুর পরিচয়কে দুর্ঘটনা ছাড়া আর কী বলতে পারি?

বাবা মারা যাওয়ার পর বাবার বন্দুকটা আমার নামে ট্রান্সফার করিয়ে নিয়েছিলাম!

মাছের রক্ত দেখেই আমার মন খারাপ করে, তাই বন্দুকে রক্ত লাগাবার অভিপ্রায়ে আমি ওটাকে সঙ্গে নিয়ে এখানে আসিনি। কিন্তু এখানে আসার পরই আমার বেয়ারা ধক্কনলাল কেবলই আমাকে উসকানি দিতে লাগল, সাহাব একঠো বরহা মারকে দিজিয়ে।

শ্রীমান ধক্কন আমাকে নিয়ে এক রবিবার খাওয়াদাওয়ার পর আমাদের ডেরা থেকে মাইল দুয়েক হাঁটিয়ে নিয়ে পাহাড়ের মালভূমির একেবারে এক কোনায় এনে দাঁড় করাল।

সেই মুহূর্তে সে জায়গায় দাঁড়িয়ে নীচের দিকে চোখ পড়ায় আমি আমার অতীত ভবিষ্যৎ সবকিছু কথা বিস্মৃত হয়ে চুপ করে তাকিয়ে রইলাম।

আমি কলকাতার গলিতে ক্যাম্বিসের বল দিয়ে ক্রিকেট খেলেছি, ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের খেলা দেখতে গিয়ে জামা ছিঁড়ে, জলে ভিজে, মাউন্টেড পুলিশের তাড়া খেয়ে বাড়িতে ফিরেছি, পাশের বাড়ির ফার্স্টইয়ারে পড়া মেয়ে রুমাকে নিষ্ফল প্রেমপত্র লিখে ইট বেঁধে ছুড়ে দিয়েছি। এইসবই আমার অভিজ্ঞতার অভিধানে ছিল অ্যাডভেঞ্চারের পরাকাষ্ঠা। এই নিসর্গ দৃশ্যের সৌন্দর্য এবং ভয়াবহতার সম্মুখীন হওয়ার মতো কিছু যে, এদেশে থাকতে পারে, এমন ধারণাও আমার ছিল না।

আমি বহুক্ষণ বন্দুক কাঁধে স্তব্ধ হয়ে সেখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

জায়গাটা বেহড় মতো। মালভূমি এখানেই শেষ হয়ে গেছে—তার নীচে এক বিস্তীর্ণ সবুজ উপত্যকা। উপত্যকার তিনদিক পাহাড় ঘেরা, একদিকের শেষ দেখা যায় না। ছোটো ছোটো টিলা আর ঝোপ-ঝাড়-ঝাঁটি জঙ্গলে উপত্যকাটি ভরে আছে। পাহাড়ের কোলে কোলে নেমে এসেছে গভীর জঙ্গলের সবুজ রোমশ হাত। সময়টা বর্ষাকাল ছিল। পাহাড় থেকে নেমে আসা তিন-চারটি নালা উপত্যকাটিকে কাটাকুটি করেছে।

একটু আগে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। কিন্তু এখন বর্ষার উজ্জ্বল রোদ, পাহাড়, নদী এবং উপত্যকার নরম সবুজ মখমলের মতো ঘাসে বেঁকা হয়ে এসে পড়েছে। এখানে-সেখানে একদল নীলগাই ইতস্তত ঘুরে ঘুরে খুঁটে খুঁটে ঘাস খাচ্ছে। রোদের লাল, উপত্যকার নীলগাইয়ের মেঘ মেঘ রং এবং আকাশের নীল সব মিলেমিশে কী যে এক অপূর্ব ছবির সৃষ্টি হয়েছে কী বলব।

একঝাঁক টিয়া যৌবনের দ্যুতির মতো পুলকভরা ডাক দিতে দিতে, সে ডাক আমার মাথার মধ্যের সমস্ত কোষময় ছড়িয়ে দিয়ে এতবছরের সমস্ত শ্যাওলাধরা জমে-থাকা অসাড় ভাবনাকে ছিটিয়ে দিয়ে, কী যেন এক নতুন অনাস্বাদিত অনাঘ্রাত সবুজের রাজ্যে আমাকে হাতছানি দিয়ে নিমন্ত্রণ জানিয়ে গেল।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম।

ধক্কনলাল বলল, ‘ই সব চৌহান সাহাবকা এলাকা হ্যায় হুজৌর। চলিয়ে, হামলোগ হুঁইয়ে পর চলেঙ্গে।’

পাকদন্ডী পথ দিয়ে উপত্যকার মধ্যে নেমে পড়ার পর বুঝলাম জায়গাটা কতখানি সুন্দর, আর কত ভয়াবহ।

ওপরে দাঁড়িয়ে শুধু চোখে যতটুকু দেখা যায়, ততটুকু দেখেছিলাম। নীচে নেমে এসে আমার চোখের সঙ্গে ঘ্রাণেন্দ্রিয়ও ঝুমঝুমির মতো আনন্দে বাজতে থাকল। পৃথিবীতে যে এত ভালোলাগা আছে, এমন সুন্দর জায়গা আছে, চৌহান সাহেবের এলাকার মধ্যে ঢুকে না পড়লে বুঝি জানতে পেতাম না।

প্রায় মাইল খানেক হেঁটে গিয়ে আমরা একটা বড়ো বজরা খেতের কাছে এলাম। তখন রোদের তেজ যে শুধু পড়েছে তাই-ই নয়, আকাশে আবার মেঘের ঘনঘটা শুরু হয়েছে।

খেতের পাশে একটা টিলা। ছোটোটিলা, তার মাথায় একচালা খাপরার একটি ঘর। টিলায় উঠতে উঠতে ধক্কন ডাকল, ‘এ বাজিরাও, বাজিরাও ভাইয়া।’

বাজিরাও নামধারী লোকটি বেরিয়ে এল, এসেই পরনাম জানিয়ে একটা চারপাই বের করে বসতে দিল। তারপর একটু দেহাতি গুড় আর জল খেতে দিল।

বলল, ‘সন্ধে হবার সঙ্গে সঙ্গেই শুয়োর আসবে বজরা খেতে।’

বাজিরাওই বলল, ‘শুয়োর তো একটা-দুটো আসে না বাবু, দল বেঁধে আসে। এখনও সময় আছে, রাজিন্দারবাবুর ওখানে গিয়ে চা-টা খেয়ে আসুন, আর রাজিন্দারবাবুকেও নিয়ে আসুন, যাঁর জন্যে আমরা এখানে আছি এবং বেঁচে আছি।’

বাজিরাও-এর বাড়ি থেকে আধ মাইল আসতেই দূর থেকে চোখে পড়ল একটা প্রাচীন গড়ের মতো বাড়ি। দেখলে রাজবাড়ি বলে মনে হয়, এখন ভেঙে গেছে, রং উঠে গেছে কবে যেন, বৃষ্টিতে রোদে এককালীন প্রাসাদে এখন আবার পাহাড়ের নিজের রং ফিরে এসেছে।

বাড়িতে ঢুকে মনে হল না কোনো লোক থাকে বলে, তারপর বাইরের চত্বর পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতে দেখা গেল অন্য চেহারা। অনেক লোক কাজ করছে। নানারকম কাজ। কেউ গোরুকে খাবার দিচ্ছে। কেউ শুকাতে দেওয়া বীজ ঘরে তুলছে, কেউ সারের বস্তা সাজিয়ে রাখছে।

আমাদের দেখে ভিতর থেকে একজন দীর্ঘদেহী সুপুরুষ বেরিয়ে এলেন। পরনে মালকোঁচা-মারা ধুতি, তার ওপর খদ্দরের পাঞ্জাবি। আপ্যায়ন করে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসালেন চারপায়ার ওপর। চারপায়াটা বাজিরাও-এর চারপায়ার চেয়ে কিছুমাত্র ভালো নয়। তবে তাতে ছারপোকা ছিল, এতে নেই, তফাত এই।

সব শুনে উনি হাসলেন। বললেন, আপনাকে এখন ছাড়া হচ্ছে না। শুয়োর অন্য লোক মেরে দেবে। আমি তাদের পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনার আজ এখান থেকে যাওয়া চলবে না। এখানে অতিথি এলে তাকে ছাড়া হয় না।

সেই একরাত ছিলাম চৌহান সাহেবের সঙ্গে। তাঁর ব্যবহার, অন্যদের সঙ্গে তাঁর আচরণ, তাঁর অতিথিপরায়ণতা এসব কিছু ছাপিয়ে যে কথাটা আমার মনে সে রাতে চিরদিনের জন্যে দাগ কেটে বসেছিল তা হচ্ছে যে, চৌহান সাহেব একজন আদি ও অকৃত্রিম মাটির লোক, এই দেশের লোক, একজন খাঁটি লোক।

এমন লোক আমাদের দেশে সচরাচর দেখা যায় না।

সেই এক রাতের আলাপেই চৌহান সাহেব আমার কাছে রাজিন্দার হয়ে গেলেন।

সেই দিনের পর প্রায় প্রতি সপ্তাহের শেষেই ওখানে গিয়ে থেকেছি, খেয়েছি- দেয়েছি আর দিনে দিনে শ্রদ্ধা বেড়েছে আমার লোকটার ওপর। মনে হয়েছে, লোকটা ছদ্মবেশী সাধু। একটা খেয়ালি প্রতিভা যে, তার সারাজীবন তার আশপাশের লোকের জন্যে, তার সুন্দর দেশের জন্যে উৎসর্গ করবে বলে মনস্থ করেছে। পায়রা ওড়ানো বাইজি নাচানো পিতা-পিতামহর বংশধর হয়ে লোকটা এমন অদ্ভুত হল কী করে ভাবলেও অবাক লেগেছে। কিন্তু দিনে দিনে তার আকর্ষণ আমার কাছে শুধু দুর্নিবারই হয়ে উঠেছে।

এবারে কলকাতা যেন অসহ্য লাগছিল, অথচ কখনো ভাবিনি যে, কলকাতা খারাপ লাগতে পারে আমার। বাসের জন্যে ধর্মতলায় অপেক্ষা করতে করতে, থলে হাতে বাজারে গুঁতোগুঁতি করতে করতে ভিড়ের চাপে, ডিজেলের ধোঁয়ায়, লক্ষ লোকের ঘামের গন্ধে অতিষ্ঠ হতে হতে কেবলই ভেবেছি কবে আবার ফিরে যাব—তিতিরঝুমার মাঠে বুটবুটিয়ার জঙ্গলে এবং রাজিন্দারের সেই স্বপ্নময় উপত্যকায়।

ফিরে এসেই সে সপ্তাহেই রাজিন্দারের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলাম। ওরও যেন অনেক কথা জমে ছিল। কত কথা যে দু-জনে বললাম, তার ঠিক নেই।

রাজিন্দার বলল, খুব একটা ভালো খবর আছে। পিয়াসা নদীর ওপর ড্যাম বানানো হচ্ছে। এখানের জননেতাদের, মুরুব্বিদের ধরাধরি করে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি। আর মাসখানেকের মধ্যেই কাজ আরম্ভ হয়ে যাবে। এই ড্যামটা হয়ে গেলে আমার এই পুরো এলাকার আর দুঃখ থাকবে না।

মুশকিল কী জানো বেণিবাবু, লোকগুলোর আত্মসম্মানজ্ঞান নেই। বেশিরভাগ লোকেরই নেই। না বড়োলোকের, না গরিবের, না শিক্ষিতের, না অশিক্ষিতের। আত্মসম্মান না থাকলে কী নিয়ে বাঁচব আমরা বলো?

পিয়াসা নদীর ওপর দশ লাখ টাকা খরচ করে যে ড্যাম তৈরি হবে তার কনট্রাক্ট পেয়েছেন পান্ডে বাবু। রনধীর পান্ডে। পান্ডেবাবুর বয়স বেশি নয়। চল্লিশের নীচে, কিন্তু এ বয়সেই তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। স্টেশনের কাছে তাঁর প্রকান্ড তিনতলা বাড়ির ন্যাংটা ও রঙিন ফ্লুরোসেন্ট বাতিগুলো পথে যেতে-আসতে চোখে পড়ে। একটা ইটের ভাঁটাও করেছেন। উত্তরপ্রদেশ সরকারের ইণ্ডাস্ট্রিজ ডিপার্টমেন্টে ঘোরাফেরা করছেন কিছুদিন হল একটা সুগার মিলের লাইসেন্স জোগাড় করার জন্যে। এ অঞ্চলে আখ (কিতারি) প্রচুর পরিমাণে হয়। পিয়াসা নদীর ড্যাম হয়ে গেলে বিদ্যুৎ সম্বন্ধে কোনো চিন্তা নেই। এখানেই একটা ছোটো জেনারেটিং স্টেশন হবে। তারপর সেচের জল এবং বন্যা নিবারিত হলে চাষের পরিমাণও অনেক বেড়ে যাবে।

এ ক-দিন হল পান্ডেবাবুর কাছে প্রায় রোজ যাতায়াত করছে রাজিন্দার। ওর খুব আনন্দ। এখানে ড্যাম হবে, সুগার মিল হবে, মিলের চিমনি দেখা যাবে দূর থেকে। সকাল-বিকেলে বুকের মধ্যে আনন্দের বাঁশি বাজিয়ে মিলের সাইরেন বাজবে। দলে দলে লোকে কাজ করতে যাবে। অসংখ্য বেকার লোক, অর্ধ-নিয়োজিত লোক, বসে বসে হাড়ে মরচে-পড়ে-যাওয়া লোক চাকরি পাবে। মিল ছুটির পর সাইকেলের ঘণ্টি বাজবে ‘ক্রিং ক্রিং’ করে। ওরা সব ওদের সম্মানের রুজি-রোজগার করে, মেহনত করে টাকা আনবে ঘরে। সন্ধের পর আগুনের পাশে গোল হয়ে বসে বাজরার কেন, তখন গমেরই রুটি খাবে। সপ্তাহে এক-দুদিন ভাতও খেতে পারে। ওদের কোয়ার্টার গড়ে উঠবে, খেলার মাঠ, হাসপাতাল, স্কুল সবকিছু হবে। রাজিন্দার বলে, ‘সব হবে, হবে না কেন? সব হবে। বিশ্বাস থাকলে, আত্মসম্মান থাকলে সব হয়, অপেক্ষা করতে হয়, তারজন্যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, এবং এসব করলে যা হবার তা হয়ও।’

রাজিন্দার আজকাল প্রায়ই শহরে যায়। যাতায়াতের পথে আমার এখানে কখনো-সখনো থামে। মাঝে মাঝে আমার বাঙালি-রান্না খেয়ে যায়।

সত্যি কথা বলতে কী, রাজিন্দারের সঙ্গে মেশার পর আমি অনেক বেশি কর্তব্যনিষ্ঠ হয়েছি। আসলে দোষটা আমার রক্তের। বাবাকে ছোটোবেলা থেকে শুনেছি বাড়ি ফিরে মাকে রসিয়ে গল্প করতে, সেদিন কী করে বড়ো সাহেবকে ধোঁকা দিলেন, কী করে অফিসের চেয়ারে কোট ঝুলিয়ে রেখে দুপুরে ম্যাটিনি শো দেখে এসে আবার বিকেলে ওভারটাইম করতেন। বাবা মাইনেও তেমন পেতেন না অথচ রুপো বাঁধানো হুঁকোয় হুঁকো খেতেন, সিল্কের জামার ওপর গরমে তসর ও শীতে আলপাকার কোট পরতেন, দু-বেলা মাছ ছাড়া আমরা কখনো খাইনি, এবং বাবা রিটায়ার করার আগেই উত্তর কলকাতার এক অজ্ঞাত পল্লিতে একটা ছোটোখাটো বাড়িও করে ফেলেন। বাবা প্রায় রোজই বলতেন ওঁর অফিসের সাহেবদের সম্পর্কে, শালারা আমার দাম বুঝল না। তাই নিজেই দাম করে নিতে হল।’

স্কুল-কলেজে ক্লাস কাটাকে বরাবরই বাহাদুরি বলেই জেনেছিলাম। পরীক্ষার প্রশ্ন বেছে বেছে পড়ে ও পরীক্ষার পনেরোদিন আগে তা মুখস্থ করে কোনোরকমে পাশ করে যাওয়াটাই বুদ্ধিমত্তার পরমউৎকর্ষ বলে বিশ্বাস করেছিলাম। এখানে চাকরি পাওয়ার পর মোটাসোটা ভালোমানুষ মালিক যখন বললেন, ‘দেখিয়ে বেণিবাবু, বাঙালিদের আমি বহত পসন্দ করি। আপনাদের মাথা সাফ আছে। আপনারা ইমানদারও আছেন। এই লাইমস্টোনের কারবার আপনার ওপরে থাকল। আমি দেখতে পারব না। আমার সময় নেই। ভালো করে দেখলে আপনারই থাকল, ভালো করে না দেখলে, লোকসান হয়ে উঠে গেলে আপনার চাকরিটাও কোম্পানির সঙ্গে সঙ্গে যাবে।

তখন মাথা নেড়েছিলাম, মনে মনে বলেছিলাম, হ্যাঁ রে শালা, সব জানা আছে। মুনাফা ভালো হলে কত দিবি আমাকে? তোর জন্যে আমি এত করতে যাব কেন? কী দরকার আমার? চাকরি করি, চাকরি রক্ষা করতে যতটুকু মিনিমাম এফর্টের দরকার তাই-ই করব। তার বেশি একটুও না।

কিন্তু তখন আমার একবারও মনে হয়নি যে, চাকরিটা তো শুধু চাকরিই নয়, সেটা আমার ক্ষমতা, আমার কৃতিত্ব প্রদর্শনের একটা ক্ষেত্রও তো বটে। আমি যে পারি, আমি যে ভালো করে পারি, এটা তো আমার নিজেরই জানা উচিত। তা ছাড়া, পরের জিনিস যত্ন করে, নিজের ভেবে যদি না বাড়াই, না বড়ো করি, তবে যদি কখনো নিজের কোনো জিনিস হয় তাই-বা রাখব কী করে? তখন আমার একবারও মনে হয়নি যে, ফেল করতে করতে বেঁচে-যাওয়া আমি বড়োপিসেমশাইয়ের দৌলতে এই চাকরিটা পেয়ে কী দারুণ হতাশার হাত থেকে মুক্ত হয়েছিলাম।

এবারেও ছুটিতে গিয়ে কলকাতায় দেখলাম আমার সঙ্গে পাশ করা আমার কত মেধাবী সহপাঠীরা এখনও ‘সাঙ্গুভ্যালি’ রেস্টুরেন্টে ডাবল-হাফ চায়ের অর্ডার দিয়ে সিগারেট হাতে একগাল খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে বসে আছে। পরীক্ষা পাশের চার বছরের মধ্যেও বেচারিদের কোনো চাকরি জোটেনি। অথচ ওদের পিসেমশাই ছিল না এবং আমার ছিল। তাই ওরা পড়াশুনায় আমার চেয়ে অনেক ভালো হয়েও আজও ওরা বেকার।

আসলে রাজিন্দার ঠিকই বলে, বলে যে এদেশে যার চাকরি আছে, ব্যাবসা আছে, কিছু-একটা করার আছে, তাদের তা ভালো করে না-করাটা একটা ক্রিমিনাল অফেন্স।

এবার ছুটিতে গিয়ে যে রুমাকে একদিন ইটের টুকরো মুড়ে প্রেমপত্র ছুড়ে দিয়েছিলাম, সেই রুমাকে দেখলাম। আমার সুন্দরি প্রেয়সী কেমন বুড়ি হয়ে গেছে।

বি. এ. পাশ করে, পাড়ার কর্পোরেশন প্রাইমারি স্কুলে একটা চাকরি পেয়েছে। আমি যখন ওকে প্রেমপত্র দিয়েছিলাম ও তখন সাধন সরকার বলে আমাদেরই বন্ধু, পাড়ার একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম করছিল। সাধন আমার সঙ্গে পড়ত। বরাবর পড়াশুনায় ও আমার চেয়ে অনেক ভালো ছিল, চেহারাও অনেক সুন্দর ছিল। পড়াশুনায় ভালো ছিল, কিন্তু এমন ভালো ছিল না যে, ন্যাশনাল স্কলারশিপ পায়। কোনো টেকনিক্যাল লাইনেও যেতে পারেনি পয়সার অভাবে। তাই সাধনও ‘সাঙ্গুভ্যালি’র অন্যদের একজন হয়ে গেছিল। পুজোর সময় সাধন প্যাণ্ডেলের পাশে প্রতিবছর তেলেভাজার দোকান দেয়, এই অপরাধে নাকি রুমা তারসঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করেছিল।

শুনে আমার এত ভালো লাগল সাধনের জন্যে এবং এত খারাপ লাগল রুমার কথা ভেবে যে কী বলব।

আমাদের বাঙালি মেয়েরা কবে যে সাধনের মতো ছেলেদের বুঝবে, ভালোবাসতে শিখবে, তা জানি না।

আমার সাধনের জন্যে খুব গর্ব হল। সেই সমস্ত ছেলেদের জন্যেই হয়, যারা পড়াশুনা শিখেও ইঞ্জিনিয়ার হয়েও এই হ-য-ব-র-ল দেশে চাকরি না পেয়ে অন্য কিছু-একটা করে; করার চেষ্টা করে। ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে এদের দেখে যেমন গর্ব হয়, তেমন নিজের জন্যে লজ্জায় মাথা নুয়ে আসে।

আমি এই বেণিমাধব সেনগুপ্ত, আমার চেয়ে অনেকানেক গুণ ভালো ছেলেদের বঞ্চিত করে শুধু পিসেমশায়ের জন্য আজ যথেষ্ট ভালো আছি। এ লজ্জার কথা নয়? নিশ্চয়ই লজ্জার কথা। তাই, চাকরিটা যখন পেয়েইছি, তখন চাকরি পাওয়ার প্রক্রিয়ার লজ্জাটাকে আমি আমার কাজের গর্ব দিয়ে অন্তত ঢেকে রাখতে চেষ্টা করি।

জানি না, হয়তো প্রত্যেকের জীবনের ট্রায়াল-ব্যালান্সেই কিছু গরমিল থাকে। গরমিলওয়ালা ট্রায়াল-ব্যালান্স নিয়ে সকলকেই শুরু করতে হয়। তারপর চেষ্টা করতে হয় তা মেলাতে। যে সেই গরমিল মিলিয়ে তার জীবনের ব্যালান্স শিটকে শেষপর্যন্ত মেলাতে পারে সেই সার্থক, সেই একমাত্র বেঁচে থাকার অধিকারের অধিকারী।

কেন জানি না, রাজিন্দারের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকে আমার কেবলই মনে হয়, সারাজীবন গোঁজামিল দিয়ে চালানো যায় না। প্রত্যেকের জীবনেই প্রত্যেককে কতগুলো সরল সত্যকে ভন্ডামিহীন ঋজু মেরুদন্ডের সঙ্গে একসময় গ্রহণ করতে হয়। বাইরের কোনো লোক বা কোনো শক্তির সঙ্গে লড়তে না হলেও প্রত্যেক মানুষকেই জীবনের কোনো-না-কোনো সময়ে নিজের সঙ্গে দারুণভাবে লড়তে হয়। সে লড়াই বাইরে থেকে দেখা যায় না, অথচ ভেতরে তার ঢেউ উথালপাতাল করে।

রুমা পরপর তিনদিন এসেছিল আমাদের বাড়িতে। রুমার চোখে একটা আকুতি দেখেছিলাম। যেন ও বলতে চায় সেই ইটের টুকরো মোড়া আমার চিঠিটিই ওর জীবনে সত্যি। আর সাধন! সাধন সরকার মিথ্যা, মিথ্যা। কারণ সে ফুটপাথে তেলেভাজার দোকান দেওয়ার মতো সৎসাহস রাখে।

অথচ আমি এমন কুকুর যেন, একটু হলে বলেই ফেলতাম রুমাকে কিছু। একবার বললেই রুমা এক্ষুনি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়। ওকে সেকথা বলার লোভ আমি অনেক কষ্ট করে সামলেছিলাম।

আমি কি মানুষ? যে চাকরিতে আমার যোগ্যতানুসারে অধিকার নেই, যে-মেয়েকে আমি সুস্থ প্রতিযোগিতায় জয় করতে পারিনি, তাকে কিনা আজ সেই চাকরির জোরেই আমি পেতে চাই?

ওখানে সাধনকে কিছু বলতে পারিনি। ওকে যদি বলতাম, বাইরে চাকরি করবি? আমি যেখানে করি? হয়তো হাসত, ভাবত আমি চালিয়াতি করছি। তাই কিছু বলিনি।

কিন্তু ফিরে এসেই আমি ওর আর রুমার কথা খুব ভাবছি। আমার খুব ইচ্ছা করে, আমি সাধনের জন্যে একটা মোটামুটি চাকরি জোগাড় করে দিয়ে ওকে এবং রুমাকে লিখি এখানে চলে আসতে বিয়ে করে। জীবনে করার মতো কীই-বা করলাম এ পর্যন্ত? এমন কিছুই কারও জন্যে করিনি, স্বার্থ ছাড়া, পারিশ্রমিক ছাড়া। এই একটা সৎকর্ম যদি করতে পারি তাহলেও কিছু-একটা করা হয়।

যদি সত্যিই যা ভাবছি তা করতে পারি তবে পরের পুজোয় কলকাতা যেতে আমার দারুণ লাগবে।

পুজোর দিন রুমার সঙ্গে দেখা হবে। বড়ো করে সিঁদুরের টিপ পরবে রুমা। নতুন তাঁতের শাড়ি পরবে। সাজবে-গুজবে। ওর নতুন তাঁতের শাড়ির গন্ধের সঙ্গে আমার মনের স্বার্থহীন, কলুষহীন আনন্দের গন্ধ একাত্ম হয়ে যাবে। ভাবতেই ভালো লাগে।

আমার কোম্পানির মালিক এইখানে একটা শিল-নোড়া বানাবার ফ্যাক্টরি করবেন বলে ভাবছেন। যদি হয় তো বেশ বড়ো ফ্যাক্টরিই হবে। সাধনকে যদি ম্যানেজার করে আনতে পারি তবে বেশ হয়। মাইনে হয়তো আড়াইশো-তিনশোর বেশি হবে না প্রথমে—নাই-বা হল, নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। শরীরের মরচে তো ছাড়বে। রুমার মুখে হাসি তো ফুটবে। তারপর একবার কাজে লেগে গেলে কার কী ভবিষ্যৎ কেউ বলতে পারে?

সেদিন রবিবার ছিল। ভেবেছিলাম বেলা অবধি ঘুমোব। শীতটা এখানে বেশ বেশি, তবুও সপ্তাহের অন্য ছ-দিন ভোর পাঁচটায় উঠি অন্ধকার থাকতে থাকতে, তারপর পুবে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই খনিতে বেরিয়ে পড়ি। খুঁটিনাটি ছোটো-বড়ো সব কাজ দেখাশোনা করি। দুপুরে একবার সাইকেল নিয়ে ডেরায় ফিরে খেয়ে যাই। আবার সন্ধে অবধি কাজ করি।

সন্ধের পর বই পড়ি। রাজিন্দার অনেকগুলো বই পড়াল আমাকে পর পর।

প্রতি সকালে উঠে, সকালের রোদের সঙ্গে, উড়ে-যাওয়া পাখির চিকন ডাকের সঙ্গে, শিশিরের গন্ধের সঙ্গে আমার রোজ মনে হয়, জীবনটা কী দারুণ একটা পাওয়া। আমি আমি, বেণিমাধব সেনগুপ্ত, তিনশো টাকার কেরানি কাম ম্যানেজার, আমার মতো সুখী লোক যেন দুনিয়াতে নেই। জীবনে সকলেই আমরা বড়োকিছু হই না, বড়ো ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট নাই-বা হলাম, বড়োলোক নাই-বা হলাম, বিবেকসম্পন্ন একজন সুস্থ সৎ লোক হতে আমার বাধা কোথায়? সে আনন্দ, সে-অধিকার আমার তো আজ আর কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে না।

এক কাপ চা খাওয়া হয়ে গেছে, এমন সময় রাজিন্দার এসে হাজির। রাজিন্দারকে কেমন অন্যমনস্ক দেখাল।

উঠে এসে বললাম, কী হল? চৌহান সাহেবের মুখ ভার কেন?

রাজিন্দার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। বলল, উঠে পড়ো বাঙালিবাবু, চলো একটু বেড়িয়ে আসি।

—কোথায়

—আহা, চলোই-না।

চা ও লুচি তরকারি খেয়ে আমরা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

শীতের ভোরের বাতাস শিরশির করছিল গায়ে। প্রায় মাইল পাঁচেক সাইকেল চালিয়ে আমরা পিয়াসা নদীর ধারে এলাম। পথের ধারে সাইকেল রেখে, নদীর পাশের টিলাটায় উঠে গেলাম দু-জনে, তারপর দুটো বড়ো পাথরের ওপর বসে পড়লাম।

বসে বললাম, এবার বলো তো রাজিন্দার, কী হয়েছে?

রাজিন্দার প্রথমে চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, কী বলব বেণিবাবু, বাজিরাওটা কাল আমার গুদাম থেকে একবস্তা সার চুরি করে বেচে দিয়েছে বাজারে। তুমি জানো, সে গুদামটা আমার হলেও, আমার নয়। আমি তার জিম্মাদার মাত্র। ওরাই চাষ করে, ওরাই ফসল তোলে, ওরাই তা সাজিয়ে রাখে, আবার ওরাই তা সারাবছর ওদের প্রয়োজনমতো তা থেকে নিয়ে যায়। আমি আমার এই প্রচারহীন সুন্দর সমবায় গুদামের জন্যে খুব গর্বিত ছিলাম।

বাজিরাও-এর কোনো দুঃখ ছিল না। আমি যা খাই, ও-ও তাই-ই খায়। ওর স্ত্রী-পুত্রের দেখাশোনা অনেকের স্ত্রী-পুত্রের দেখাশোনার মতোই আমি করি। চাবি, সব ওদের কাছেই থাকে, ভাগে ভাগে। ওরা যে কারওরই দয়ানির্ভর হয়ে জীবনে বাঁচে না, কোনো মানুষই কারও দয়ানির্ভর হয়ে বাঁচতে পারে না, এই বোধটা আমি ওদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে চেয়েছিলাম। অথচ, বাজিরাও চুরি করল।

—কেন চুরি করল, জানতে পেলে?

—জানলাম।

—কেন?

—ওর বউ একটা ট্রানজিস্টার রেডিয়ো চেয়েছিল, তাই।

—ট্রানজিস্টার রেডিয়ো নিয়ে কী করত রাজিরাও-এর বউ?

—ফিলমের গান শুনত।

আমার বাজিরাও-এর কথা শুনে মনে হল, যাকে বেঁচে থাকতে হয় নীলগাই আর শুয়োরের সঙ্গে বর্ষা আর খরার সঙ্গে যুদ্ধ করে, যে একদিন বেঁচেই থাকত না হয়তো যদি-না রাজিন্দার সবসময় ওর পাশে থাকত। অথচ ওর এক্ষুনি একটা ট্রানজিস্টার রেডিয়োর হঠাৎ ভীষণ দরকার হল!

রাজিন্দার নিজের মনেই বলে উঠল, মুশকিল, মুশকিল। এই মানুষগুলোকে নিয়ে তুমি কী করবে বেণিবাবু, বলতে পারো? এদের নিয়ে তুমি দেশ গড়বে?

তারপর অনেকক্ষণ আমরা চুপচাপ বসে রইলাম। রাজিন্দার কোনো কথা বলল না।

নীচে সুন্দরী পিয়াসা নদী বয়ে গেছে। নরম গেরুয়া বালি, স্বচ্ছ জলে শীতের রোদে এসে পড়েছে। একঝাঁক পিন টেইল হাঁস উড়ে এসে বসেছে জলে। ঘুরে ঘুরে খুঁটে খুঁটে কী যেন খাচ্ছে। তারা যখন জলে মুখ ডোবাচ্ছে তাদের ছুঁচোলো ল্যাজগুলো জলের ওপরে সোজা উঁচু হয়ে থাকছে।

আমি শুধোলাম, ড্যামের কাজ কবে শুরু হবে?

কথাটা বলতেই রাজিন্দারের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, এই সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই। পান্ডেবাবু লোকটা এফিসিয়েন্ট। এরকম লোকেরই দরকার এখন। বেশিরভাগ লোকই ইনএফিসিয়েন্ট।

আমি বললাম, বাজারে যে গুজব, পান্ডেবাবু পুকুর চুরি করে? কথাটা সত্যি?

রাজিন্দার চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল। বলল, তাই নাকি? রাজিন্দারের মুখটা বিমর্ষ দেখাল। তারপর বলল, করে দেখুকই-না শালা, আমিও ওকে দেখাব। কিন্তু আমার মনে হয় না চুরি করে বলে। দেখা যাক। মানুষের ওপর মানুষ হিসেবে বিশ্বাস রাখতে হয়। তারপরও যদি সে অমানুষ হয় তখন দেখা যাবে।

আমি হঠাৎ বললাম, আমার অনেক দিন ধরে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে—তুমি দেশের জন্যে এত ভাবো, এত করো, তোমার কোনো-না-কোনো রাজনৈতিক মতবাদ একটা নিশ্চয়ই আছে অথচ কখনো তা স্পষ্ট করে জানিনি, তাই জানতে ইচ্ছে করে।

রাজিন্দার পিয়াসা নদীর দিকে চেয়ে অনেক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, বেণিবাবু, আমি কমিউনিস্টও না ক্যাপিটালিস্টও নই, আমি হিউম্যানিস্ট, ন্যাশনালিস্ট। তা ছাড়া যে দেশে মানুষ নেই, নেতা নেই, সে-দেশে এসব ইজম-ফিজম ফাঁকাবুলি ছাড়া কী? তা ছাড়া এ দেশ তো কোনো দলের বা কোনো নেতার একার নয়। কোনো শালার বাবার একার নয় তো এদেশ। এ দেশ আমাদের সকলের, আমার, তোমার, বাজিরাও-এর পান্ডেবাবুর সকলেরই। প্রত্যেকেরই বিশেষ ভূমিকা আছে এখানে। আমরা প্রত্যেকে যদি প্রত্যেকের ভূমিকামতো কাজ করি, তাহলেই কোনো ঝামেলা থাকে না।

কিন্তু আমরা তা করি কোথায়?

তাহলে তুমি বলছ, সোশ্যালিজম-এ বিশ্বাস করো না রাজিন্দার, অথচ তোমাকে দেখে…..।

রাজিন্দার আবার হাসল, বলল ‘সোশ্যালিজম’ বলতে তুমি কী বোঝো জানি না বেণিবাবু, তবে তোমাকে একটা সোজা উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে পারি। এই যে মাঠটা দেখছ নদীর পাশে, চেয়ে দ্যাখো মাঠটায় পাঁচ-ছটা বড়ো গাছ আছে আর অসংখ্য ছোটো গাছ। তুমি আমাকে একটা কুড়ুল এনে দাও, আমি রাতারাতি এ মাঠে তোমার সোশ্যালিজম এনে দেব। সস্তা সোশ্যালিজম।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কীরকম?

ও বলল, কেন? এ তো সোজা? কুড়ুল দিয়ে ক-টা বড়ো গাছ আছে সেগুলোকে ছোটো গাছগুলোর সমান করে দেব ছেঁটে। ব্যাস সবাই সেই মুহূর্তে বরাবর হয়ে গেল। এও তো সোশ্যালিজম।

তবে তোমার কীসে বিশ্বাস? সবাই সমান হয় একি তুমি চাও না?

রাজিন্দার আবার হাসল, বলল, নিশ্চয়ই চাই। হয়তো অনেক জনদরদি নেতার চেয়ে অনেক বেশি করেই চাই। চাই যে, তা তুমি জানো, ভালো করেই জানো।

—তা জানি। কিন্তু তুমি কী করতে চাও?

—আমি করতে চাই ছোটো গাছগুলোকে বড়ো করতে এবং বড়ো গাছগুলো যাতে আর বড়ো না হয় তা দেখতে। ছোটো গাছগুলোকে জল দিয়ে সার দিয়ে ওদের প্রত্যেকের মধ্যে বড়ো হবার, আলোর দিকে, বাতাসের দিকে হাত বাড়াবার, মেরুদন্ড সোজা করে উঠে দাঁড়াবার জোর সঞ্চারিত করতে চাই। এ যদি করা যায় তো দেখবে, দেখতে দেখতে আমাদের চোখের সামনে ছোটো গাছগুলো, প্রত্যেকটি ছোটো গাছ বড়ো গাছগুলোর কাঁধ ছুঁই-ছুঁই করছে। তারপর একদিন দেখবে যে, সব গাছগুলোই সমান হয়ে গেছে। সেই হল সত্যিকারের সমান হওয়া।

বুঝলে বেণিবাবু, আমার মতে, পার্টি বা ইজম গৌণ। মুখ্য যা, তা হচ্ছে মানুষ। জানি না বেণিবাবু, আমার ধারণা হয়তো ভুল, কিন্তু আমার মনে হয় এই মনুষ্যত্বের বাবদেই আমরা সব এগিয়ে যাওয়া দেশের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছি। রাস্তাঘাট বাড়িঘর বানানোটা কিছুই নয়। বাইরের অনেক কিছু হয়তো আমরা বানিয়েছি, বানাচ্ছি। কিন্তু বুকের ভিতরে যা-কিছু গড়ে তোলার ছিল, তার কিছুই আমরা গড়িনি।

আমি অনেকক্ষণ চুপ করে রইলাম। রাজিন্দারের কথাগুলো বোঝবার চেষ্টা করছিলাম। আমার মতের সঙ্গে ওর মতের কোথায় অমিল তা অনুধাবন করার চেষ্টা করছিলাম।

আমার ভাবনার জাল ছিঁড়ে রাজিন্দার বলল, চেয়ে দ্যাখো ওই যে পুবে গ্রামটা দেখছ, ওই গ্রামের জায়গায় রিজার্ভার হবে আর ওই যে বড়ো আমলকী গাছটা—তার কাছে হবে জেনারেটিং স্টেশন। তুমি যদি এখানে থাকো আরও পাঁচ-দশ বছর, তো দেখবে এ জায়গার চেহারা বদলে গেছে। তখন আমাকে দেখে তুমি চিনতে পারবে না। আমার মতো সুখী লোক তুমি এ তল্লাটে খুঁজে পাবে না তখন।

তারপর বাতাসে নাক উঁচু করে নিশ্বাস নিয়ে রাজিন্দার বলল, ইস! কবে আসবে? সেদিন কবে আসবে?

আরও কিছুক্ষণ ওখানে বসে থাকার পর রোদের তেজ বাড়ল।

আমি বললাম, এবার নামা যাক।

রাজিন্দার বলল, চলো।

তারপর টিলা থেকে নামতে নামতে বলল, আজ সন্ধে বেলায় কী করছ?

আমি বললাম, কী আর করব? কার্পেট কারখানার ছেলেরা যদি ব্যাডমিন্টন খেলে তো খেলব, নইলে বই পড়ব বাড়ি বসে।

রাজিন্দার বলল আজ কিছুই করতে হবে না, আজ আমার সঙ্গে এক জায়গায় চলো।

কোথায়?

চলোই-না ইয়ার। গেলে তোমার ভালো লাগবে। আমিও ব্যাচেলার, তুমিও তাই। মাঝেমধ্যে একটু নাচনা-গানা দেখা ভালো, নইলে জীবনটা বড়ো ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মাঝে মাঝে মেয়েদের সঙ্গ বেশ লাগে, কী বলো?

আমি বললাম, মাঝে মাঝে কেন? সবসময় লাগে না?

দুর। দুর বলে হাসল রাজিন্দার। বলল, মেয়েরা কিছুক্ষণের জন্যে ভালো। কোনো বুদ্ধিমান পুরুষমানুষ কোনো মেয়ের সঙ্গে সারাজীবন থাকতে পারে না। থাকলে তাদের বুদ্ধি উবে যায় বলেই আমার বিশ্বাস।

—এটা তুমি কী কথা বললে? এত হাজার হাজার বিদগ্ধ বুদ্ধিমান লোক তাহলে বিয়ে করে বুড়ো বয়স অবধি সুখে ঘরসংসার করছে কেন? কী করে?

—তুমিই বেণিবাবু, এবার একটা বোকার মতো কথা বললে।

—মানে? অবাক হয়ে আমি বললাম। তারা তবে কি বোকা?

—মানে, তারা বুদ্ধিমান ঠিকই, আমার-তোমার চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান, কারণ সেসব লোক জানেন একজন মেয়ের সঙ্গে সারাজীবন থেকেও কী করে তার সঙ্গে না থাকা যায়। এমন বুদ্ধি আমার নেই। তাই ঠিক করেছি, আমার পক্ষে ওদিকে পা না বাড়ানোই ভালো। বলেই, হো-হো করে হাসতে লাগল রাজিন্দার।

সাইকেলের প্যাডেলে পা রেখে রাজিন্দার বলল, চলি ইয়ার। আমি তিতিরঝুমার মাঠের মধ্য দিয়ে শর্টকাট মারব। বিকেল পাঁচটায় ঠিক তোমার ডেরায় পৌঁছোব—ভালো করে সেজেগুজে থেকো। তোমাকে নিয়ে যাওয়ায় বিপদ আছে আমার। আমার এতদিনের বান্ধবী না হাতছাড়া হয়ে যায়।

আমি হাসলাম। বললাম, ইয়ার্কি কোরো না।

সেদিন বিকেলে তখনও বেলা ছিল, এমন সময় আমার ডেরার সামনে একটা ফিটনগাড়ি এসে দাঁড়াল। দুটো সাদা তেজি ঘোড়ায়-টানা কালো কুচকুচে ফিটন। ফিটন থেকে যে লোকটি নামল, তাকে আমি কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না।

ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি, চিকনের কাজ করা, সঙ্গে চুড়িদার পায়জামা পরে চৌহান সাহেব আমার সামনে যখন এসে দাঁড়াল, তখন সত্যিই সেই দেবদর্শন লোকটিকে চেনবার কথা ছিল না আমার। মোটা দেহাতি খদ্দরের পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা অবস্থাতেই তাকে বরাবর দেখে এসেছি। তাই মনে হল, ও যেন খোলস বদলে এসেছে কোনো নতুন পিছল সাপের মতো। গায়ে খয়েরি কাশ্মীরি শাল পায়ে সাদা নাগরা জুতো।

আমি বললাম, তুমনে কা কিয়া ইয়ার?

রাজিন্দার হাসল, ও দারুণ মুডে ছিল, ওকে সিনেমার হিরোর চেয়েও অনেক ভালো দেখাচ্ছিল, সারা শরীর থেকে আতরের গন্ধ বেরুচ্ছিল। রাজিন্দার বলল, কা কিয়া? গজাব কিয়া, কিসিকি ওয়াদেপে।

আমি বললাম, উর্দু বুঝি না, বুঝিয়ে বলো।

রাজিন্দার বলল, বিশ্বাস করেছি, কারও কথায়, সকলের কথায়, আমার প্রেয়সীর কথায় বিশ্বাস করেছি।

রাজিন্দারের সঙ্গে ফিটনে বসে পড়লাম। বললাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

রাজিন্দার হাসল, বলল মির্জাপুর।

সে তো বহুদূরে।

ও বলল, যাকে ভালোবাসি তার সঙ্গে দেখা করতে অন্য পৃথিবীতেও যেতে পারি, আর এ তো সামান্য দূর।

শীতের বিকেলের রোদ মাঠে-ঘাসে-গাছে-পাহাড়ে ছড়িয়ে গেছে। সব কেমন সুন্দর স্বপ্নময় মনে হচ্ছে।

আমরা দু-জনে চুপ করে দু-দিকে চেয়ে বসে আছি মুখোমুখি।

ফিটন চলেছে। ঝুমঝুম করে ঘোড়ার গলার ঘণ্টা বাজছে, মছিন্দার ছায়াঘেরা পথ দিয়ে ফিটন চলেছে।

বিরহী নদীর বুকে রোদের আঁচ লেগেছে। একটা মাছরাঙা পাখি তার বিচিত্রবর্ণ শরীর নিয়ে জলে ছোঁ মেরে মেরে মাছ ধরছে, ছিটকে-ওঠা জলের রং, মাছরাঙার রং সব মিলেমিশে সেই মুহূর্তে একীভূত হয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আমার মনের আড়ালে লুকিয়ে রাখা সমস্ত মিষ্টি-দুষ্টু ইচ্ছেগুলোও ছিটকে-ওঠা ক্যারাম বোর্ডের গুটির মতো মাছরাঙাটার সঙ্গে লাফিয়ে উঠছে।

অনেকক্ষণ পর রাজিন্দার বলল, তুমি কখনো কাউকে ভালোবেসেছ বেণিবাবু?

আমি হাসলাম, তারপর ওর চোখের দিকে চেয়ে বললাম, কখনো কাউকে ভালোবাসেনি এমন পুরুষমানুষ কি কেউ আছে?

বোধ হয় নেই। বলে রাজিন্দার চুপ করে রইল।

তারপর আবার বলল, ভালোবাসা বলতে তুমি কী বোঝো জানি না বেণিবাবু, তবে আমার ভালোবাসা একটু অদ্ভুত। হয়তো আমি নিজেই অত্যন্ত অদ্ভুত তাই।

একথার পিঠে কোনো কথা হয় না। তাই চুপ করে রইলাম।

ধীরে ধীরে বিকেলের স্নিগ্ধ রোদ রাতের অন্ধকারে গড়িয়ে গেল। সন্ধ্যাতারাটা দিগন্তরেখার ওপরে পৃথিবীর সব প্রেমিকের ভালোবাসার চোখ হয়ে জ্বলজ্বল করতে লাগল। একটি একটি করে তারা ফুটতে লাগল আকাশে। পথের পাশের শিশিরের গন্ধ, খেতের গন্ধ, সবকিছু রাজিন্দারের গায়ের আতরের গন্ধে মিশে গেল।

অনেকক্ষণ পর আমরা আলো ঝলমল মির্জাপুরে এসে পৌঁছোলাম।

ফিটন থেকে আমরা যেখানে নামলাম, সেটা একটা চক। হয়তো চাঁদনি চক কী মিনাবাজার হবে। আতরের দোকান, ফুলের দোকান, দেওয়াল-জোড়া আয়না বসানো পানের দোকান।

রাজিন্দার একটা পানের দোকানে দাঁড়িয়ে খুশবু-ভরা জর্দা দিয়ে বানারসি মঘাই পান খেল। আমাকেও খাওয়াল। তারপর আয়নায় নিজেকে একটু ঠিকঠাক করে নিল।

ওর দিকে চেয়ে আমি হাসলাম।

ও ভর্ৎসনার চোখে আমার দিকে চাইল। বলল, তোমরা পুরুষমানুষরা বড়ো স্বার্থপর। তোমরা আশা করো তোমাদের প্রেমিকারা সবসময় সুন্দর করে সেজে তোমাদের কাছে আসবে অথচ তোমাদের যেন তাদের প্রতি কোনো কর্তব্য নেই? বুঝলে বেণিবাবু, যখন তোমার প্রেমিকার কাছে যাবে, সেজে যেয়ো। তোমার সবচেয়ে সুন্দর চেহারা ও মনের মধ্যে যে সবচেয়ে সুন্দর মন আছে সেই মন নিয়ে তার কাছে যেয়ো, নইলে তাকে ঠকানো হয়।

একগোছা লাল গোলাপ কিনল রাজিন্দার, তারপর আমাকে নিয়ে পাশের গলিতে ঢুকে পড়ল।

ঢুকে পড়েই মনে হল কোথায় যেন এলাম।

ঝাড়লণ্ঠনের নরম আলো, সারেঙ্গির বিধুর কান্না, তবলার আলতো ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ আর তারসঙ্গে মিষ্টি সুরে ভরপুর গলার পুরবি। মনে হল যেন কোনো স্বপ্নরাজ্যে এসে পড়লাম।

ফুলের গন্ধ, আতরের গন্ধ, সুন্দরী মেয়েদের গায়ের গন্ধ মাড়িয়ে এসে আমরা পাথরের সিঁড়ি বেয়ে দোতলার একটা ঘরের চৌকাঠে এসে পৌঁছোলাম।

রাজিন্দার সিং চৌহান, জরির ঝালর দেওয়া পর্দা সরিয়ে দরজায় দাঁড়াতেই—ভেতরের গান থেমে গেল, সারেঙ্গি স্তব্ধ হয়ে গেল, সমস্ত ঘর নি:শব্দ হয়ে গেল, ভয়ে নয়, আনন্দে।

সামনে যাকে দেখলাম, তার মতো কোনো মেয়ে আমার জীবনে দেখেছি বলে মনে পড়ল না।

রাজিন্দার বলল, ‘ও সালেমা, মেরি সালেমা! তুম কৈসি হো? মেরি পেয়ারি, তুম কৈসি হো?’

সালেমা কুর্নিশ জানাতে জানাতে উঠে দাঁড়াল। নীচুস্বরে বিশুদ্ধ উর্দুতে কী যেন সব আবেগময় আনন্দের কথা বলল। বুঝতে পারলাম না।

রাজিন্দার আমার দিকে ফিরে আমাকে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলল, মেরা দোস্ত, কলকাত্তাকা বেণিবাবু। তারপর সারেঙ্গি নিয়ে যে অল্পবয়সি ছেলেটি বসেছিল তারদিকে ফিরে বলল, ‘নৌসের তু কৈসে হো?’

এরপর সালেমা এবং নৌসের আমাকে অবাক করে রাজিন্দারকে ধরে বলল যে, অনেক দিন পরে এসেছ, তোমায় গান শোনাতে হবে রাজিন্দার।

রাজিন্দার যে গান গায়, একথা জানার অবকাশ আমার কখনো হয়নি। ওর চরিত্রের দৃঢ়তা ও দেশের জন্যে ওর অনুক্ষণ পাগলামি দেখে কখনো মনে হয়নি ওর জীবনের একটা অন্যরকম দিকও আছে। মনে হয়নি যে, সমস্ত সুস্থ মানুষের জীবনেই প্রেম থাকে। কোথাও-না-কোথাও থাকেই। প্রেমিক না হলে, জীবনে কেউই সার্থক হয় না। প্রত্যেক ব্যক্তিরই, সে কর্মজীবনে যেই হোক, যা-ই হোক, ব্যক্তিগত জীবন না থাকাটাই অস্বাভাবিক।

রাজিন্দার ফরাশে বসে পড়ে হাসল, আমাকে টেনে বসাল পাশে, তারপর সালেমাকে বলল, ‘তুমি আগে গাও। কতদিন তোমার গান শুনিনি।’

আবার সারেঙ্গি কাঁদতে লাগল, তবলা ছলাৎ ছলাৎ করতে লাগল, সালেমার গলায় কোনো শিশিরভেজা নরম সুরের পাখি উড়ে এসে বসল।

সালেমা শুরু করল, ‘এওঁহি অগর হামারি তরফ দিখতে রহোগি তো একরোজ জরুর পেয়ার বন যায়েগি।’

মানে তুমি যদি এমনি করে আমার দিকে চাও, চেয়ে থাকো—চাইতে থাকো—তবে একদিন, তবে নিশ্চয়ই একদিন তোমার সঙ্গে আমার প্রেম হয়ে যাবে।

সালেমা গান গাইছিল, আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর দিকে চেয়েছিলাম।

একটা আকাশি-নীল ভেঙ্কটাগিরি শাড়ি পরেছে সালেমা, চোখে সুরমা, নরম প্রশস্ত কপাল, মাজা-রঙে উজ্জ্বল মুখটি যেন প্রদীপের মতো নীল পিলসুজের ওপর জ্বলছে। সাইবেরিয়ান রাজহংসীর মতো গ্রীবা, উদ্ধত চিকন চিবুক। ভেলভেটের কাঁচুলি ঘেরা বুক। আর সালেমার চোখ। কী চোখ, কী চোখ! চোখের সাদা অংশটা সাদা নয়, কেমন নীলাভ আর কনীনিকা কোমল উজ্জ্বল কালো। মুখ দিয়ে যা না বলছে, চোখ দিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি বলছিল সালেমা, আমার রাজিন্দারের প্রেমিকা। বলছিল বারে বারে, বিভিন্ন পর্দার আলাপে এবং তানে ও বিস্তারে বলছিল, এমনি করে যদি চেয়ে থাকো; যদি চাও যদি চাইতে থাকো আমার দিকে, তবে একদিন তোমাকে কিন্তু সত্যি সত্যিই ভালোবেসে ফেলব।

সালেমার গান শেষ হয়ে গেলে রাজিন্দার অনেকক্ষণ মুখ নীচু করে বসে রইল, কথা বলল না, তারপর সারেঙ্গিওয়ালা নৌসেরের হাত থেকে সারেঙ্গিটা নিয়ে, বাঁ-পায়ের পাতা এবং ডান পায়ের ঊরুর মধ্যে বসিয়ে গান গাইবে বলে তৈরি হল।

সালেমা এতক্ষণ আসন করে বসেছিল গান গাওয়ার সময়, এবারে পা ভেঙে পাশ ফিরে বসে পাঁচ বছরের মেয়ের মতো আনন্দে ও কৌতূহলে সুপুরুষ রাজিন্দারের মুখের দিকে বড়ো বড়ো উজ্জ্বল চোখ মেলে চেয়ে রইল।

রাজিন্দার গজল ধরল, ‘পুছোঁ না মুঝকে দিল কা ফাসানে, ইস্কহি বাঁতে, ইস্কহি জানে।’

অর্থাৎ আমাকে আমার মনের কথা কিছু শুধিয়ো না, কিছু বলতে পারব না আমি। ভালোবাসার কথা শুধু ভালোবাসাই জানে।

মেঘগর্জনের মতো গম্ভীর অথচ শীতের রোদের মতো শান্ত রাজিন্দারের গলায় যে এত দরদ ছিল কখনো জানিনি। দরদ যার থাকে তার বোধ হয় সব ব্যাপারেই এমন দরদ থাকে। ও যেমন দরদ দিয়ে ওর দেশকে ভালোবাসে তেমন দরদ দিয়ে ওর প্রেমিকাকেও ভালোবাসে।

জাফরানিরঙা বিরিয়ানি পোলাও এবং রেজালা খেয়ে, পান মুখে দিয়ে যখন আমরা সালেমার ঘর থেকে বেরোলাম তখন রাত অনেক হয়ে গেছে।

রাজিন্দার কোনো কথা বলছিল না। চুপ করে চেয়েছিল বাইরে।

বাইরে যদিও খুব ঠাণ্ডা ছিল, তবুও আমরা গাড়ির জানলা খুলে রেখেছিলাম। ভিজে জ্যোৎস্নায় ফসলের ভারী গন্ধ উঠছিল, একটা টিটি পাখি ফাঁকা মাঠে কাকে যেন কী শুধিয়ে বেড়াচ্ছিল।

ঝুমঝুমি বাজিয়ে ফিটন চলছিল।

রাজিন্দার হঠাৎ বলল, ভাবলে কেমন আশ্চর্য লাগে, তাই না বেণিবাবু? কোনো একজনের, কোনো বিশেষ একজনের কাছে গেলে, তার চোখের দিকে চাইলে, তার মুখোমুখি একটু বসলে কী যেন এক ভালোলাগায় সমস্ত মন ভরে যায়। খুব বেশি চাইলে তার হাতে একটু হাত রাখতে চাওয়া যায়, তার চোখের পাতায় কী কানের লতিতে অথবা তার গ্রীবায় আলতো করে একটা চুমু খাওয়া যায়, এর চাইতে বেশি কিছু কিন্তু মেয়েদের কাছে কখনো চাইতে নেই। জানো বেণিবাবু, প্রত্যেক মেয়েই আমার মনে হয় তাজমহলের মতো। তাদের বেশি কাছে যেতে নেই। তাদের দূর থেকে দেখে মনে মনে নিজের বাসনা ও আবেগ ও ইচ্ছা দিয়ে বাকিটা ভরিয়ে নিতে হয়। যারা তাজমহলের ভিতরে ঢুকে দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ‘কু’ দিয়ে তাজমহল দেখে আমি তাদের দলে নেই। সে মালিকানায় আমি বিশ্বাস করি না।

তারপর বলল, কী? তোমার কী মত?

আমি বললাম, তাজমহল আমি এখনও দেখিনি, দূর থেকেও দেখিনি। আশা করি আমিও কোনোদিন শাজাহান হব। যদি হই, তবে সেদিনই তোমার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনায় বসা যাবে।

পরের শনিবার বিকেলে রাজিন্দারের বাড়িতে পৌঁছোতেই ও বলল, একটা নতুন এক্সপেরিমেন্ট করছি বেণিবাবু। চলো তোমাকে দেখাই।

আমি শুধোলাম, কীসের এক্সপেরিমেন্ট?

—ও বলল, চলোই-না। একটা খুব সিরিয়াস ব্যাপার। এক্সপেরিমেন্ট ইন লিডারশিপ।

—সে আবার কী?

—আহা, চলোই-না!

ওদের মূলবাড়ি থেকে এক ফার্লং দূরে ওর ঠাকুরদার বানানো শিসমহল ছিল। এখন অশ্বত্থ ও নানারকম জংলি গাছে ছেয়ে ফেলেছে দালানটা। আমি এর আগে কোনোদিনও ঢুকিনি এতে। দূর থেকে দেখেছি। ধক্কনলাল আর বাজিরাও-এর মুখে শুনেছি যে, এখন এতে সাপ ও ভূত পেতনির বাসা।

তখন সন্ধে হব হব। বাইরের বড়ো ফটক দিয়ে ঢুকতেই গা ছমছম করতে লাগল। কতগুলো বাদুড় আর চামচিকে ওড়াওড়ি করতে লাগল। একটা বিচ্ছিরি পচা গন্ধ।

ভেতরে ঢুকলেই অন্ধকার। ভালো দেখাই যায় না।

রাজিন্দার কার উদ্দেশ্যে যেন ডাকল, ইজ্জৎ….ইজ্জৎ….ইজ্জৎ।

কেউ সাড়া দিল না।

তারপর রাজিন্দার হাততালি দিল।

হাততালি দিতেই, কোথা থেকে এক রুপোলি চুলের নুয়ে-পড়া গলিত-নখদন্ত বৃদ্ধ একটা পেতলের মোমবাতিদানে বসানো জ্বলন্ত মোমবাতি নিয়ে এসে হাজির হল। বৃদ্ধকে দেখে মনে হল না বৃদ্ধ এখানকার লোক। এখানকার লোকের চেহারার সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে পেলাম না তার চেহারায়।

উর্দু মেশানো চোস্ত হিন্দিতে সেই পলিত-কেশ বৃদ্ধ ‘ইজ্জৎ’ আমাদের স্বাগত জানাল।

বৃদ্ধ মোমবাতি নিয়ে আগে আগে যেতে লাগল। আমরা পেছনে চললাম।

একটু গিয়ে বৃদ্ধ দাঁড়াল, মোমবাতিদানটা রাজিন্দারের হাতে দিল। দিয়ে মরচে ধরা বড়ো একটা তালা খুলতে লাগল। নানারকম আওয়াজ হতে লাগল কিন্তু তালাটা খুলল না।

বৃদ্ধ আবার চেষ্টা করতে লাগল।

এমন সময়ে সেই বন্ধ ঘর থেকে কতগুলো ক্রুদ্ধ জানোয়ারের হুংকার ভেসে এল।

আমি চমকে উঠলাম, শুধোলাম এঘরে কী আছে রাজিন্দার? বাঘ?

হা-হা-হা করে হেসে উঠল রাজিন্দার।

ছাদের ফাটল থেকে ভয় পেয়ে ক-টা কবুতর ডানা ঝটপট করে উড়ে গেল। অন্ধকারের মধ্যে অন্ধকারতরো বাদুড়গুলো নড়ে উঠল।

রাজিন্দার বলল, বাঘ থাকলে তো খুশিই হতাম বেণিবাবু। একদিন যেন এতে বাঘই থাকে। অথবা সিংহ। সেই চেষ্টাই তো করছি। তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক বেণিবাবু।

আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, কী আছে এতে? বলো-না?

রাজিন্দার আবার হেসে উঠল, বলল ভয় পাচ্ছ কেন? দেখতেই পাবে।

প্রচন্ড শব্দ করে তালাটা খুলে গেল।

ইজ্জৎ আগে ঢুকল।

তারপর মোমবাতি হাতে রাজিন্দার। পেছনে আমি।

ভেতরে ঢুকতেই চমকে উঠলাম। দেখি একটা বিরাট হলঘর। দেওয়ালের চতুর্দিক ছাদ এবং আয়নায় ঘেরা। অনেকগুলো আয়না দাগ হয়ে খারাপ হয়ে গেছে। তবে এখনও অনেকগুলো ভালোও আছে। রাজিন্দারের হাতের মোমবাতিটা হাজার মোমবাতি হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেল। ঘরটা নরম সোনালি আলোয় ভরে যেতেই আমি সভয়ে ও বিস্ময়ে দেখলাম, মেঝের ফরাশের ওপর ও তাকিয়ার পাশে বসে আছে চারটে বিরাট বিরাট কালো কুচকুচে অ্যালসেশিয়ান কুকুর। তাদের চারজোড়া চোখ দেওয়ালের চতুর্দিকের আয়নায় চার হাজার চোখ হয়ে আমাদের দিকে চেয়ে আছে।

তালা খোলার আগে কুকুরগুলোই তাহলে ঝাঁপাঝাঁপি করছিল, এখন সাদা পোশাকের ইজ্জৎকে দেখে সব থমকে গেছে।

রাজিন্দার হঠাৎ ওর পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা রুটি বের করে ছুড়ে দিল ওদের দিকে। একটি কুকুর সেটাকে সঙ্গে সঙ্গেই লাফিয়ে উঠে লুফে নিল মুখে, তারপর ঘরের অন্য কোনায় দৌড়ে গেল একা একা খাবে বলে।

রাজিন্দার রেগে উঠে চেঁচিয়ে বলল, ‘ইজ্জৎ, চাবকাও শালাকে।’

ইজ্জৎ অমনি দেওয়ালে ঝোলানো চাবুক নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে যেতেই কুকুরটা রুটিটা মুখে করে নিয়ে ফরাশে রাখল।

রাজিন্দার নিজে হাতে রুটিটাকে চারটে ভাগে ভাগ করে চার-জনকে ছুড়ে দিল।

ওই চারটে কুকুর কুকুরের স্বভাববশেই অন্য হস্ত প্রদত্ত রুটি খেতে লাগল একমনে।

দেখে মনে হল ওরা অনেক-দিন কিছু খায়নি।

রাজিন্দার ওদের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে বলল, যে দৌড়ে গেল একা রুটিটাকে নিয়ে, ওর নাম কী ইজ্জৎ?

ইজ্জৎ উত্তর দিল না। বোবার মতো মুখে রাজিন্দারের দিকে তাকাল।

পরমুহূর্তেই রাজিন্দার লজ্জা পেয়ে হাসল। বলল, ওহো আমি ভুলেই গেছিলাম।

আমি শুধোলাম, কী ভুলে গেছিলে রাজিন্দার?

ভুলে গেছিলাম, যে ওদের নাম ইজ্জৎ জানে না। ওদের নাম দিয়েছি আমি।

আমি শুধোলাম, একে জোগাড় করলে কোথা থেকে? মানে ইজ্জৎকে?

রাজিন্দার গলায় বিরক্তি ফুটিয়ে বলল, অত কথায় তোমার দরকার কী; তারপরই লজ্জা পেয়ে বলল, ওকে অনেক কষ্টে জোগাড় করেছি। ও কত কুকুর পিটিয়ে বাঘ করেছে তার ইয়ত্তা নেই। তাই তো ওকে নিয়ে এসেছি এখানে।

আমি এসব হেঁয়ালির কথা কিছুই বুঝলাম না। রাগ রাগ গলায় বললাম, তোমার এই চার-চারটে কালো কুকুর আর সাদা পোশাকের বৃদ্ধর মানে আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। তুমি কি কুকুরের বাচ্চার ব্যাবসা করবে?

রাজিন্দার আবার একচোট হাসল, বলল, না হে বেণিবাবু, না। এই যে চারটে কুকুর দেখছ এদের আমি এলাহাবাদ থেকে আনিয়েছি। একজনের নাম ‘আমির’, অন্যজনের নাম ‘গরিব’, আর একজনের নাম ‘নোকর’, আর চতুর্থ-জনের নাম রেখেছি ‘মালিক’। এই কুকুরগুলোর মধ্যে থেকে আমি একজন বাঘের মতো নেতা তৈরি করতে চাই। হয় কি না দেখতে চাই। তাই আমি সবরকম ভাবে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখছি যে, কুকুরদের মধ্যে একজন কুকুরেরও বাঘ হওয়ার ক্ষমতা আছে কি না। ওদের সকলকে না খাইয়ে রেখে দেখছি, ক্ষুধার্ত অবস্থায় ওদের মধ্যে কে, কীরকম ব্যবহার করে। তারপর ওদের আবার একজনকে ভরপেট খাইয়ে রেখে দেখব অন্য তিন-জন ক্ষুধার্তর প্রতি সে কীরকম ব্যবহার করে। প্রত্যেককে এমন করে দেখব। তারপর সবাইকে পেট ভরে খাইয়ে দেখব তখনও ওরা ভদ্রতা, ন্যায়, আত্মসম্মান জ্ঞান, সততা শেখে কি না, অন্যকে ও নিজেকে সম্মান করে কি না। এমনি করে দেখতে অনেক সময় লাগবে।

আমার জন্যে প্রার্থনা কোরো বেণিবাবু, ওদের জন্যে প্রার্থনা কোরো, ওদের মধ্যে একজনও যেন নেতৃত্বর আসনে বসবার যোগ্যতা অর্জন করে, ওদের মধ্যে একজনও যেন কুকুর হয়ে জন্মেও বাঘের মতো স্বভাব পায়।

অনেকদিন রাজিন্দারের ওখানে যাওয়া হয়নি। তার ওপর মাঝে আমাকে প্রায় দু-সপ্তাহের জন্যে লখনউ যেতে হয়েছিল। এখানে ছিলাম না। দেখতে দেখতে শীতের দিন গিয়ে বসন্তের দিন এসে গেল। কী করে যে দিনগুলো, মাসগুলো কেটে গেল বুঝতে পর্যন্ত পেলাম না।

ফিরে এসেই একটা খুব ভালো খবর পেলাম। আমার মালিক কারখানার করার সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলেছেন। সাধনের কথা বলতেই উনি একবাক্যে মেনে নিলেন। তবে বললেন, কলকাতার পড়ে-লিখে আদমি এই জঙ্গলে কি থাকতে পারবেন এসে?

আমি বললাম, কেন? আমি বুঝি থাকছি না?

আপনার কথা আলাদা, আপনি ব্যাচেলার মানুষ, বাড়িতে বিধবা মা ছাড়া আর কেউ নেই, আপনার কথা অন্য। আপনার বন্ধু কি বিয়েশাদি করেছেন?

আমি অকপটে মিথ্যে কথা বললাম, হ্যাঁ করেছেন।

তবে?

আমি বললাম, ওরা স্বামী-স্ত্রী দু-জনেই খুব নির্জনতা ভালোবাসে। তা ছাড়া নতুন বিয়ে করেছে তো। ওদের খারাপ লাগবে না।

অতএব মালিক রাজি হয়ে গেলেন। তিনশো পঁচিশ টাকা মাইনে, কোয়ার্টার এবং একজন রান্নাবান্না ও খিদমদগারি করার লোক।

খারাপ কী এই বাজারে?

সেদিনই সন্ধের সময় রুমাকে চিঠি লিখতে বসে গেলাম।

অনেক প্যাডের কাগজ নষ্ট করে, অনেক কলম কামড়ে, অনেক কাপ চা ও সিগারেট ধ্বংস করে শেষপর্যন্ত একটা দাঁড় করালাম খসড়া। তাতে অনেক কাটাকুটি হল। সেই অবস্থাতেই পাঠাব বলে মনস্থির করে ফেললাম—নইলে আর পাঠানোই হবে না বলে আমার মনে হল।

লিখলাম,

তোমাকে এর আগেও একটি চিঠি লিখেছিলাম। তখন আমিও ছোটো, তুমিও ছোটো। ঢিল মুড়ে সে চিঠি তোমাদের ছাতে ফেলে দিয়েছিলাম। মনে আছে?

তুমি তার কোনো উত্তর দাওনি।

জবাব পাইনি প্রথম চিঠির। আশা করি এ চিঠির জবাব দেবে।

ছোটোবেলায়, মানে ছোটোবেলা থেকেই তোমাকে আমার ভালো লাগে। যখন তুমি ফ্রক পরে, বেণি দুলিয়ে, পাড়ার গলিতে এক্কা-দোক্কা খেলতে তখন থেকে তোমায় আমি এক বিশেষ চোখে দেখি। সেই ছেলেমানুষি ভালোলাগা কখন যে ভালোবাসায় গড়িয়ে গেছিল আমি নিজেও কখনো জানিনি।

আজও আমি তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু সে এক অন্য ধরনের ভালোবাসা।

যখন আমি তোমাকে প্রথম চিঠিটি দিই, সে প্রায় আট বছর আগের কথা, তখন জানতাম না যে, সাধনকে তুমি ভালোবাসো। জানলে হয়তো ও চিঠি আমি দিতাম না। তখনকার সেই অল্পবয়সের আবেগে যা হঠাৎ করে বলা যায়, লেখা যায়, সেসব বলা বা লেখা এখন আর সম্ভব নয়।

সত্যি কথা বলতে কী, গত পুজোর পরে যখন কলকাতা গেছিলাম তখন তোমার সঙ্গে কথা বলে ও সাধনকে দেখে আমার খুব মনখারাপ হয়ে গেছিল। সেদিন থেকে আমি ভেবেছি, কী করে তোমাদের দু-জনের ওই দুঃখ ঘোচানো যায়।

তুমি জানো যে, আমি একজন সামান্য মানুষ। আমার ক্ষমতা বলতে কিছুই নেই, তবু তুমি শুনে বোধ হয় খুশি হবে যে, সাধনের জন্যে আমি একটা চাকরি জোগাড় করেছি। তোমাদের কোয়ার্টার আমি দেখে রেখেছি। তিনটে ঘর এবং দুটি বারান্দাঅলা একতলা খাপরার চালের বাংলো। একটি বারান্দা ঢাকা; অন্যটি খোলা। রান্নাঘর ও চানঘর আলাদা।

কম্পাউণ্ডের মধ্যে কতগুলো আম ও পেয়ারা গাছ আছে। একটি হাসনুহানার ঝোপ আছে এবং সামনের দরজার দু-পাশে দু-টি বোগোনভেলিয়া লতা আছে। মাঝে মাঝে টিয়াপাখি এসে পেয়ারা গাছে বসে; কাঠবিড়ালি দৌড়াদৌড়ি করে পেয়ারার ডালে।

ভাবতে ভালো লাগছে যে, আমার সাইকেলটা তোমাদের বাড়ির দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রেখে, তোমাদের বাড়ির কড়া নাড়ব আমি, আর তুমি এসে হাসিমুখে দরজা খুলবে, আমাকে নিজে হাতে চা করে খাওয়াবে। সে যে আমার কতবড়ো প্রাপ্তি হবে তা তুমি হয়তো বুঝবে না।

তুমি ও সাধন যদি সুখে থাকো, সুখী হও এবং তাও আবার আমার চোখের সামনেই হও, তাহলে যে আমার কী আনন্দ হবে, তা তুমি ভাবতেও পারো না।

আগামী পয়লা মার্চ সাধনকে এখানে জয়েন করতে হবে।

সাধনের বাড়ির ঠিকানা আমি ভুলে গেছি, তাই তোমাদের বাড়ির ঠিকানায় ওকেও একটি চিঠি ও ওর অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠাচ্ছি। আমার ইচ্ছা, তুমি নিজে হাতে গিয়ে সাধনকে আমার চিঠি ও অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটি দিয়ো।

আশা করি তোমরা দু-জনেই এ চিঠি পেয়ে খুব খুশি হবে।

তোমরা কবে আসছ জানিয়ো।

লাঠিয়ালিয়া স্টেশন এখান থেকে অনেক দূর। আমি গোরুর গাড়ি নিয়ে স্টেশনে থাকব। যেদিন তোমাদের নতুন বাড়িতে এসে উঠবে সেদিন তোমরা কী খাবে তা আগে থেকে জানালে আমি রাঁধিয়ে রাখব।

তোমাদের জন্যে একজন লোকও ঠিক করে রাখব, সে রান্নাবান্না এবং অন্যান্য কাজ করতে পারে। আশা করি, তোমাদের এখানে এসে কোনো অসুবিধা হবে না, এক নির্জনতা ছাড়া। নতুন বিয়ের পর নির্জনতা খারাপ লাগার কথা নয়। তাই না?

তোমাদের বিয়েটা, আমি যতদূর জানি, শুধু সাধনের চাকরির কারণেই আটকে ছিল। তাই যত তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে ফেলতে পারো, ততই ভালো। না হলেও ক্ষতি নেই। এখানে মৈথিলি ব্রাহ্মণ দিয়ে বিয়ে দিয়ে দেব। বুঝেছ?

কবে আসছ, কোন ট্রেনে আসছ, পত্রপাঠ জানিয়ো।

চিঠিটা শেষ করে ফেলতে পেরে খুশি খুশি লাগতে লাগল।

মনে হল বেশ একটা বড়োরকমের পুণ্যকর্ম করলাম।

তারপর চিঠিটা পেয়ে রুমা কী ভাববে, কী করবে, এসব ভাবতে লাগলাম।

পরের রবিবার ভোর ভোর রাজিন্দারের ডেরার দিকে রওনা হয়েছিলাম।

পথের সেই সুন্দর উপত্যকায় তখন শীত সরে গিয়ে বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে একটু একটু।

কত যে ফুল, কত যে পাখি, কত যে সবুজের বাহার! চোখ জুড়িয়ে যায় দেখে। ঘাস-পাতা গাছের রং ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। মাটির গন্ধ বদলে গেছে। শীতের ভোরের ভারী কুয়াশার গন্ধের বদলে এখন বসন্তের আমেজ-ভরা ফুলঝরানো ভোরে মিষ্টি হাওয়ায় কোনো মিশ্র আতরের গন্ধ আলতো হয়ে ভাসছে।

উপত্যকাটির মাঝামাঝি এলে একটা বড়ো টিলা পড়ে। টিলার নীচ দিয়ে দুটি পাহাড়ি নদী একে অন্যের বুকের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। এইখানে, এই নদীর নুড়ি-ভরা বুকে দাঁড়িয়ে রাজিন্দার একদিন এক সুরেলা নিস্তব্ধ দুপুরে ওর উদাত্ত গলায় ইকবালের গান শুনিয়েছিল আমায়, ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা, হিন্দুস্তাঁ হামারা হামারা। ম্যায় বুলবুলে হ্যায় উঁসকি, ইয়ে গুলসিতাঁ হামারা হামারা।’

গানটা যেন কানে লেগে আছে। রাজিন্দার সত্যিই এই ফুলবাগানের বুলবুলি। ওর মতো করে এই উপত্যকা, এই পাহাড়, এই নদী ভালোবাসে, এমন কেউই নেই।

রাজিন্দারের ডেরায় পৌঁছে শুনলাম যে সে নেই। সে পিয়াসার ড্যামে গেছে।

ওর অনুচর গিরধারী বলল, দিনরাত চৌহান সাব ওই ড্যামের কাজেই ছোটাছুটি করছে। পান্ডেবাবুর কুলিসর্দার স্ট্রাইক করল তো রাজিন্দারবাবু হাতে-পায়ে ধরে তাকে কাজ করাতে রাজি করাল। যেখানে যতটুকু অসুবিধা তা দূর করতে সে সবসময় সেখানে দাঁড়িয়ে। চান নেই, খাওয়া নেই, কোনো কোনোদিন রাতেও বাড়ি ফিরতে পারে না নাকি রাজিন্দার। তবে ও বলল, ড্যামের কাজও নাকি এক সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।

গিরধারী গরম দুধ আর রুটি-তরকারি খাওয়াল।

খেয়েদেয়ে শুধোলাম, রাজিন্দারের কুত্তাগুলো সব কেমন আছে? ইজ্জৎ? কোথায় থাকে?

গিরধারী বলল, ইজ্জৎ তো চলে গেছে।

—চলে গেছে? কেন?

—তা জানি না। একদিন সে রাতের বেলায় এসে হুজৌরকে বলল, কোথাও কারও কাছে পয়সার বদলে কাজ করিনি। আমার এখানে ভালো লাগছে না। যেখানে আসার আমি এমনিতেই আসি, এমনিতেই থাকি।

আমি শুধোলাম, রাতের বেলা, এই জঙ্গলের আনজান পথে কোথায় চলে গেল সে পরদেশি লোক?

গিরধারী বলল, সামনের টিলায় তাকে উঠে যেতে দেখেছিলাম। তারপর তার সাদা পোশাক চাঁদের আলোয় মিশে গেল। আর তাকে দেখা গেল না। যাওয়ার আগে সে বলল, কোনোদিন আসার হলে এমনিতেই আসব। ডাকতে মাইনের লোভ দেখাতে হবে না আমায়।

—তোমার হুজৌর কিছু বললেন না?

—হুজৌর বললেন, ঠিকই বলেছ ইজ্জৎ! এ জায়গা তোমার থাকার জায়গা নয়।

আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে আমি আবার সেই বুলবুলির গুলিস্তাঁ পেরিয়ে বাড়ি ফিরলাম। কিছুদিন হল তিতিরঝুমায় একটি গুজব সোচ্চার হয়ে উঠেছে। প্রথমে সেটা মৃদু ফিসফিসানির মতো ছিল, কিন্তু এখন সেটা প্রায় চিৎকারে পৌঁছেছে। মাঠে, হাটে, পথের মোড়ে, বড়ো গাছতলায়, পানের দোকানে, টাঙাওয়ালা এক্কাওয়ালাদের মুখে মুখে সবসময়ই এই কথাটা ঘুরছে। পিয়াসা নদীর প্রায় সমাপ্ত ড্যামে নাকি ফাটল দেখা দিয়েছে। এদিকে ড্যাম প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।

এই গুজব কার কাছে কতখানি অর্থবাহী তা বলতে পারব না, তবে এ গুজবে যদি বিন্দুমাত্র সত্যও থেকে থাকে তাহলে এ সত্য রাজিন্দারকে কতখানি বিদ্ধ ও ব্যথিত করবে, তা আমার মতো অন্য কেউই বোধ হয় জানবে না।

সবসময় আমি ভয়ে ভয়ে আছি।

রাজিন্দারের সঙ্গে দেখা হয় না অনেক দিন। গত এক মাস ও প্রায় সবসময় ওই ড্যামের কাছেই রয়েছে। ও কনট্রাক্টর নয়, ইঞ্জিনিয়ার নয়, সরকারের কোনো মুখপাত্রও নয় ও , তাই ওর কোনো ভূমিকা থাকার কথা নয় এই বাঁধের নির্মাণকার্যে। অথচ প্রথম থেকে শেষ অবধি ও-ই সব। তা এখানকার লোকেরা সকলে খুব ভালোই জানে। যা কিছু ভালো হয় এখানকার, সেসব কিছুর অনুপ্রেরণা রাজিন্দারেরই।

এদিকে আমিও খুবই ব্যস্ত ছিলাম। নিজের কাজ, তার ওপরে নতুন ফ্যাক্টরির প্রাথমিক কাজের তদারকিও ছিল। যতদিন-না সাধন কাজ বুঝে নিচ্ছে ততদিন আমাকেই একটু দেখাশোনা করতে হবে। কারণ সাধন আমারই মনোনীত প্রার্থী।

সেদিন দুপুর বেলা খেতে এসেছি ডেরায়। ধক্কনলাল খাবার দিয়েছে। খেতে বসব, এমন সময় টেলিগ্রাম-পিয়োন সাইকেল ‘ক্রিং ক্রিং’ করে একটা টেলিগ্রাম দিয়ে গেল।

খাওয়া ছেড়ে উঠে তাড়াতাড়ি টেলিগ্রামটা খুলে দেখি রুমার টেলিগ্রাম। ‘রিচিং টুয়েন্টি সেকেণ্ড মর্নিং। অ্যাটেণ্ড স্টেশন।’

খাওয়া শেষ করে উঠতে-না-উঠতেই ধক্কনলাল বলল, একেবারে ভুলে গেছিলাম বাবু সকালে পোস্টাফিসে যখন গেছিলাম, তখন তোমার একটা চিঠি নিয়ে এসেছি।

একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দার চেয়ারে বসে চিঠিটা খুললাম। সাধনের চিঠি! দেখি, সাধন কী লিখেছে?

কলিকাতা

২৬ ফেব্রুয়ারি

বেণি,

রুমার মারফত তোর চিঠি পেলাম।

তুই বোধ হয় সবাইকে তোর নিজের মতোই ভাবিস। রুমা আমাকে বিয়ে করবে কী আমি তাকে বিয়ে করব, এটা আমার এবং রুমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

যে উদারতা তোকে মানায় না, সে-উদারতা তুই না দেখালেও পারতিস। তোর নিজের চাকরিও তো পিসেমশাইয়ের দেওয়া। তোকে তো আমি আমার উপকার করার জন্যে বলিনি। তা ছাড়া আমার উপকার করার জন্যে তুই এ চাকরি জোগাড়ও করিসনি। করেছিস তোর মিথ্যা মহত্ত্ব দেখাবার জন্যে এবং রুমার কাছে নিজেকে বড়ো করার জন্যে।

রুমার সম্বন্ধে আমার কোনো দুর্বলতা নেই। আজ অন্তত নেই। থাকলেও একজনের দয়ায় নির্ভর করে তাকে পেতে চাওয়ার মতো হীন আমি নই।

আমি যদিও এখনও বেকার, তবুও আমি বিশ্বাস করি যে, কারও দয়ার ওপর নির্ভর করে কেউ কোনোদিন বাঁচে না। কখনো বাঁচেনি। আমার সমস্যাটা আমার একার নয়। আমার মতো এবং আমার চেয়ে অনেক ভালো ভালো ছেলেরাও আমারই মতো অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। তাদের সকলেরই ভবিষ্যৎ সমান অন্ধকার।

তোর পিসেমশাই বা তুই, তোর কিংবা আমার একটা হিল্লে হয়তো করতে পারেন কিন্তু তাতে অন্যান্য পিসেমশায়হীন লক্ষ লক্ষ ছেলেদের কোনো উপকার নেই।

তুই হয়তো আমাকে ভালোবাসিস, হয়তো রুমাকে যতখানি ভালোবাসিস তার চেয়ে কম বাসলেও বাসিস, তাই তোকে দুঃখিত করতে চাই না রূঢ় কথা বলে। কিন্তু তোর জানা উচিত যে, আমার সমস্যাটা আমার ব্যক্তিগত সমস্যা নয়। এর সমাধান আমার একার চাকরি পাওয়াতে হবে না। কীসে যে হবে তা আমি জানি না। এরকমভাবে বাঁচার কোনো মানে নেই। আমাদের বাপ-ঠাকুরদারা সবাই এরকমভাবেই দয়ানির্ভর হয়ে বেঁচে এসেছেন। আমরা অন্যরকমভাবে বাঁচতে চাই। আমাদের নিজেদের অধিকারেই আমরা বাঁচতে চাই।

জানি না, তোকে সব কথা বুঝিয়ে বলতে পারলাম কি না। বোঝালেও তুই বুঝবি কি না জানি না। তাই সে চেষ্টা না-করাই ভালো।

আমাদের পাড়ার নবীন নিয়োগীকে তুই চিনিস। ও বি. এসসি. পাশ। এবং একটা চাকরি ওর আমার চেয়েও বেশি দরকার। কেন দরকার তা ও নিজেই জানাবে।

নবীনকে আমি পাঠাচ্ছি। সাধন সরকার সেজে ও এ চাকরিটা করবে। পয়লা মার্চের আগেই ও ওখানে পৌঁছোবে।

সারাদেশে সক্কলে, ছোটো-বড়ো প্রত্যেকে, আজ অনেকরকম জাল-জুয়াচুরিই করছে। সে তুলনায় আমার এই জালিয়াতি এমন কিছুই নয়। আশা করি, সাধন সরকার হিসেবে ওকে প্রতিষ্ঠিত করতে তোর অসুবিধে হবে না কোনো।

তোর রুমা তোর কাছে যাবে। রুমা মাসিমাকে সব কথা বলেছে। মাসিমা সব জানেন। এবং পুত্রবধূ বলে ওকে পাবেন জেনে খুশি হয়েছেন। রুমাকে পেয়ে তুইও নিশ্চয়ই খুশি হবি। রুমা এই মুহূর্তে তোকে যতখানি চায়, আমাকে ততখানি চায় না। যদি-বা চাইতও তাহলেও আমার পক্ষে তাকে গ্রহণ করা সম্ভব হত না নানা কারণে।

রুমা একা যাচ্ছে পরশু তোর কাছে। ওকে স্টেশনে নিতে আসিস।

এটুকু বলি শেষে যে, নিজের মূর্খামিতে ভর করে জীবনে আর যাই করিস, কারও পরমগর্বের জায়গায় হাত দিস না ভুলেও। আমার চাকরি নেই বলে তুই মনে করিস আমার আত্মসম্মানও নেই? আমার কোনো দায়িত্বও যে নেই তাও তুই জানিস। তবে?

তোর মতো ফুলগাছ ঘেরা কোয়ার্টার, ঠাণ্ডা শরীরের পরাভূত স্ত্রী, পোষা পায়রার চাকরি, আমার জন্যে নয়। এ জীবন অন্য জীবন। আমার জীবনে শুধু আগুনের হলকা। তার মধ্যে আছি, এবং তারমধ্যেই থাকব। এও আর একরকমের জীবন। এ জীবনের মানে তুই বুঝবি না।

ভাবতে আশ্চর্য লাগছে এই ভেবে; যে রুমা যাকে প্রত্যাখান করেছিল সেই তোরই দেওয়া ‘তু-তু’ চাকরি আমি গ্রহণ করে সুখে রুমাকে জড়িয়ে সংসার করব, এমন কথা আমার সম্বন্ধে তুই ভাবলি কী করে? তুই কি পুরুষমানুষ?

আর কিছু লেখার দরকার নেই। তোর রুমা যাচ্ছে। তাকে গ্রহণ করিস। আমার সমস্ত শুভেচ্ছা রইল তোদের প্রতি। সত্যিরে, সত্যি সত্যিই সব আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল!

ইতি তোদের তেলেভাজাওয়ালা

সাধন সরকার

চিঠিটা পড়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। মনে হল, কোনো অদৃশ্য ঘাতক যেন আমাকে খুব কয়েক ঘা চাবুক মেরে গেল। হঠাৎ আমার রাজিন্দারের শিশমহলের সেই সাদা পোশাকের বৃদ্ধর কথা মনে হল, সে-ই যেন আমাকে চাবকে গেল এক্ষুনি।

বেরোবার সময় ধক্কনলালকে গোরুর গাড়ি ঠিক করার কথা বলে গেলাম।

ভোরের ট্রেনে যখন রুমা আসছেই তাকে আনতে স্টেশনে যেতেই হবে। রুমা এলেই সব বিস্তারিত শোনা যাবে।

সাধনের চিঠির চাবুকের জ্বালা তখন মোছেনি মন থেকে, কিন্তু তবুও মনে হল, মনে হয়ে খুব ভালো লাগল যে, রুমা সত্যিই আসছে। আমার ঘরে, আমার কাছে থাকছে। মুহূর্তের জন্যে একথা মনে হয়েও খুব ভালো লাগল।

সাইকেলে চড়ে খনির কাছাকাছি প্রায় এসেছি, এমন সময় পুব দিকের আকাশে একটা প্রলয়ংকরী আওয়াজ হল। চমকে তাকিয়ে দেখলাম আকাশ নির্মেঘ, অথচ আওয়াজটা মিথ্যে নয়। পাহাড়ে পাহাড়ে আওয়াজটা অনেকক্ষণ কাঁপল।

খনির কাজ সেরে এসে অফিসে বসে বিলিং রিপোর্ট তৈরি করছি, এটা পাঠাব মালিকের কাছে। এমন সময় আমাদের একজন কনট্রাক্টর সাইকেলে চেপে এসেই খবর দিল, দু-ঘণ্টা আগে পিয়াসার পুরো ড্যামটি ভেঙে পড়েছে; অনেক কুলিকামিন মারা গেছে।

ছোটো জায়গা হলে যা হয়, কারখানার মজুররা বলল, আমরা দেখতে যাব এক্ষুনি, সকলেই খুব উত্তেজিত হয়ে উঠল। তাদের মধ্যে অনেকেই আবার প্রায় দৌড়োতে দৌড়োতে ঊর্ধ্বশ্বাসে গেল, কারণ তাদের অনেকের আত্মীয়স্বজনরা সেখানে কুলিকামিনের কাজ করছিল।

অফিস বন্ধ করে আমার ডেরার দিকে ফিরছি, এমন সময় পথেই রাজিন্দারের সঙ্গে দেখা।

তাকে চেনা যাচ্ছে না। দেখে মনে হচ্ছে এ রাজিন্দার নয়, যেন তার প্রেতাত্মা। রাজিন্দারের চোখের দিকে তাকাতে পারলাম না আমি। আমার মনে হল, ড্যামটা যেন আমিই ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছি নিজের হাতে।

কোনো কথা না বলে পাশাপাশি সাইকেল চালিয়ে আমরা আমার ডেরায় এলাম।

রাজিন্দার বারান্দায় বসল।

ওর চুল উশকোখুশকো, মুখ শুকনো। চা পর্যন্ত খেল না। ও পাগলের মতো বলতে লাগল, সব ঘুণ ধরে গেছে বেণিবাবু। ঘুণপোকায় আমাদের মেরুদন্ড খেয়ে গেছে কিছু করা যাবে না এখানে, কিছুই করা যাবে না।

আমি বললাম, রণধীর পান্ডেকে জিজ্ঞেস করলে না? কেন এমন হল?

—জিজ্ঞেস করলাম না মানে, শালার গলা টিপে আমি ওখানেই শালাকে মেরে ফেলেছিলাম আর একটু হলে। কিন্তু ও যা বলল, তাতে দেখলাম, অসংখ্য বড়োলোক এবং গরিব লোকের গলা টিপে তক্ষুনি মারতে হয়। তেমন জোর তো আমার হাতে নেই বেণিবাবু। তা ছাড়া, তা করে লাভই-বা কী?

আমি শুধোলাম, কী শুনলে পান্ডেবাবুর কাছে?

রাজিন্দার একটু চুপ করে থেকে বলল, শুনলাম কলঙ্কের ইতিহাস, কুকুরের রোজনামচার কথা। জনদরদি নেতা থেকে আরম্ভ করে সরকারি বড়ো-ছোটো অফিসার, কেরানি, ব্যাবসাদার এবং আরও অনেক বেসরকারি লোককে তার নানাভাবে পেট ভরাতে হয়েছে। এবং সে নিজেও সিমেন্টের সঙ্গে কাদা মিশিয়ে চালিয়েছে। আশ্চর্য! সবসময় সঙ্গে থাকলাম, অথচ বুঝতে পর্যন্ত পারলাম না কিছু।

ওকে যখন বললাম, শালা! তোমাকে এক্ষুনি গলা টিপে মারব। ও বলল, আমি ব্যাবসাদার মানুষ। দু-পয়সা কামাব বলেই এতদিন ধরে এত ঝামেলা করেছি। আমি কী ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াব? এ ড্যাম তো আমার একার সম্পত্তি নয়, দেশের সম্পত্তি । একথাটা যদি দেশের অন্য কেউই না বোঝে, নেতা এবং বড়ো বড়ো আমলারাও না বোঝে তবে আমার একার বোঝার দরকার কী?

বলল, অন্য সকলে যদি বিনা মেহনতে, বিনা লগ্নিতে বসে বসে পুকুর চুরি করে তাহলে আমি দিনরাত মেহনত করে কি ঘরের টাকা দেশের কাজের জন্যে গচ্চা দেব? তা ছাড়া, এমনি করেই তো এপর্যন্ত কত কাজ করলাম। সবই উতরে গেল। এ আমার বদনসিব, তাই এত তাড়াতাড়ি ভেঙে গেল।

এই অবধি বলে, রাজিন্দার অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলল, শুনলে বেণিবাবু, আমার এত স্বপ্নের, এত কল্পনার পিয়াসা ড্যাম আজ ভেঙে গেল। কত লোকের ট্যাক্সের টাকা, কত লোকের পরিশ্রম, কত লোকের স্বপ্ন সব গুঁড়িয়ে গেল। না: বেণিবাবু, কিছু করা যাবে না, এখানে কিছু করা যাবে না। আমি আজই অন্য কোথাও চলে যাব।

আর কোনো কথা না বলে রাজিন্দার সাইকেলে উঠে চলে গেল।

আমার দিকে ফিরে পর্যন্ত তাকাল না।

অথচ আমার ওকে আজ কত কথা বলার ছিল। আমার রুমা আসছে কাল ভোরে। আমার জীবনে কতবড়ো একটা পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। ঠিক এমন সময় পিয়াসা ড্যাম ভেঙে পড়ল। ভাঙার সময়টা কী অন্য কোনো সময় হলে হত না?

ড্যাম ভেঙেছে তা আমি এখন কী করব? কাল আমার রুমা আসছে, এসময়ে আমার এসব দেশের ও দশের ভাবনা ভাবার সময় নেই।

রাজিন্দার চলে যেতেই আমার দেশ, আমার সমাজ, পিয়াসা ড্যাম, এসব কিছু বড়ো বড়ো চিন্তা আমার মন থেকে উবে গেল।

আমি ঘর গোছাতে লাগলাম, চতুর চড়ুই পাখির মতো।

তক্ষুনি নোংরা হয়ে-যাওয়া বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, তোয়ালে, এসব কাচতে দিলাম। বইয়ের তাক গুছিয়ে রাখলাম। রুমা যে ঘরে শোবে সে ঘরে চারপায়া, আলনা, এসব ঠিকঠাক করে রাখলাম। ও-ঘরের বাথরুমের জানলার একটা কাচ ভাঙা ছিল, সেখানে ময়দার আটা করে কাগজ সাঁটালাম। এখন না করলে আর সময় পাব না, আমার ভোর চারটেয় বেরোতে হবে স্টেশনে যাওয়ার জন্যে।

সব কাজ শেষ করে, কাল ধক্কনলাল রুমার জন্যে বিশেষ কী রান্না করবে না করবে বলে দিয়ে, চান করতে যাব, তখন রাত প্রায় আটটা, এমন সময় বাজিরাও দৌড়োতে দৌড়োতে এসে খবর দিল, সত্যানাশ হো গিয়া বাবু, চৌহান সাব জিন্দা নেহি হ্যায়।

তারপর কী করে, কীভাবে পাহাড় পেরিয়ে উপত্যকার পাকদন্ডী পথে সাইকেল চালিয়ে রাজিন্দারের ডেরায় পৌঁছোলাম, আমি নিজেই জানি না।

তখন কৃষ্ণপক্ষ। আকাশে আলো নেই; তারাদের আলো ছাড়া। দূর থেকে রাজিন্দারের বাড়িটাকে ভূতের বাড়ি মনে হচ্ছিল।

আমি পৌঁছোবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উলটোদিকের পথ দিয়ে কোতোয়ালির বড়ো দারোগাও এসে পৌঁছোল।

শিশমহলের কাঠের চওড়া দরজাটা হাঁ করে খোলা ছিল। মধ্যে একটা হ্যাজাক জ্বলছিল। আয়নায় আয়নায় সেই উজ্জ্বল আলো চতুর্দিকে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল।

রাজিন্দার ফরাশের ওপর তাকিয়ে হেলান দিয়ে, আধশোয়া ভঙ্গিতে পড়েছিল। মাথাটা ডানদিকে কাত করা।

দারোগার সঙ্গেই ঢুকলাম আমি।

ঢুকেই দেখলাম, রাজিন্দারের চারপাশে সেই কালো কুচকুচে চারটে কুকুরও মরে পড়ে আছে। প্রত্যেকের ফুসফুসের মধ্যে দিয়ে গুলি গেছে। আমির এবং মালিক, গরিব এবং নোকর চার-জনেই পাশাপাশি শুয়ে আছে। চার-জনেই রাজিন্দারের শব পাহারা দিচ্ছে।

আয়নাগুলোর দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম আমি। কুঁকড়ে গেলাম আমি নিজের চেহারা দেখে।

তারপর ভালো করে তাকাতেই দেখি, আলো-চমকানো আয়নার ওপরে আলকাতরা দিয়ে আঙুল বুলিয়ে কী যেন লিখেছে রাজিন্দার। হিন্দিতে বড়ো বড়ো করে লিখেছে।

বিরাট ভুঁড়িঅলা বড়ো দারোগা পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে, জোরে জোরে প্রায় অশিক্ষিতর মতো বানান করে পড়ছিল। ‘বাঘের বাচ্চা কোনোদিনও কুকুরের বাচ্চাদের নেতা হয় না। কুকুরের নেতা কুকুররাই হয়। সবসময়।’

দারোগা একটু চুপ করে থাকল, তারপর স্বগতোক্তি করল, ‘দিমাগ খারাব হো গায়া থা।’

রাজিন্দার কপালে নল ঠেকিয়ে ট্রিগারটা টেনে দিয়েছিল। সুন্দর মুখময় খয়েরি খয়েরি কীসব থকথকে জিনিস মাখামাখি হয়েছিল। এই আশ্চর্য উপত্যকার, এই গুলিস্তাঁর বুলবুলির ঠোঁট দিয়ে রক্ত গড়িয়ে গেছিল; যে ঠোঁট আর কখনো গান গাইবে না।

কিছুক্ষণ পর শিশমহল থেকে ধীরে ধীরে বাইরে এসে দাঁড়ালাম।

দেখি, সেই থমথমে রাতে অনেক লোক জড়ো হয়েছে, জড়ো হচ্ছে শিশমহলের কাছে। এখানে-ওখানে, আশপাশের টিলায়, জঙ্গলে, খেতে, কাছে-দূরে, অন্ধকারে বিন্দু বিন্দু আলো কাঁপছে। কুপি বা মশাল বা হ্যারিকেনের আলো।

ওরা চতুর্দিক থেকে চৌহান সাহেবের বাড়ির দিকে ধীরে ধীরে আসছে।

ওইখানে দাঁড়িয়ে, আমার হঠাৎ মনে হল, আমার চারদিকে, কাছে-দূরে অনেকগুলো বাঘের চোখ অন্ধকারে যেন জ্বলজ্বল করছে।

তারা-ভরা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একেবারে হঠাৎই, কী যেন এক শ্বাসরোধকারী যন্ত্রণায় আমার বুক ভেঙে যেতে লাগল। এই আমি, এই পাত-কুড়োনো, পিসেমশাইসর্বস্ব, চড়ুই পাখি আমি; সেই অন্ধকারে হু-হু করে কেঁদে উঠলাম।

কবে? রাজিন্দার? কবে? তোমার স্বপ্ন সত্যি হবে?

কবে আমরা, এই আসমুদ্র হিমাচলের কোটি কোটি মানুষ বাঘের মতো মাথা উঁচু করে, আত্মসম্মানের গর্দান ফুলিয়ে তোমার এই শিশমহলের আয়নার সামনে দাঁড়াব!

কবে, রাজিন্দার; কবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *