ফেরার সময়
সল্টলেকের নতুন বাড়িতে আজ ওদের বিয়ের দশ বছর পালন করেছে সিম্পি-নির্মাল্য। খুবই সেজেছে সিম্পি। বাড়ির ল্যাণ্ডিং-এ দাঁড়িয়ে অভ্যাগতদের আপ্যায়ন করছে। চৈতালি গাড়ি থেকে নামতেই ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, কী খুশি যে হয়েছি তুই এলি বলে! ফোনে সেদিন যা গাঁইগুঁই করছিলি!
কাল ছেলে-মেয়ের স্কুল নেই বুঝি! তা ছাড়া তোদের সল্টলেকে রাত্তিরে বাড়ি খোঁজার চেয়ে আফ্রিকাতে গিয়ে ‘চাঁদের পাহাড়’ খোঁজা অনেকই সোজা। তা ছাড়া তোদের মতো আমার নিজের তো গাড়ি নেই। ভাশুরের গাড়ি কি হুটহাট করে চাওয়া যায়, তবু ভাশুর আমার নিজের দাদার চেয়েও ভালো বলে…। এখন ফিরে যাবে গাড়ি দাদার কাছে আবার।
বুজুদা আর সীমাদি আসবেন তো রে?
আসবেন আসবেন। কুজুও আসবে ওঁদেরই সঙ্গে। আমি তো মায়ের কাছে হয়ে এলাম। সেইজন্যেই সেদিন বলেছিলাম তোকে। মায়ের শরীরটা এক্কেবারেই ভালো যাচ্ছে না। বাবা যাবার পর থেকে ভীষণ একাও হয়ে গেছেন তো! তাও টি ভি-টা ছিল ভাগ্যিস।
সত্যি! একদিন যাব মাসিমাকে দেখতে। তুই এসেছিস যে শেষপর্যন্ত এতেই আমি খুশি।
তারপর হেসে বলল, কখন থেকে তো নির্মাল্য তোর পথ চেয়েই বসে আছে।
চৈতালি হেসে বলল, ইয়ার্কি মারিস না।
চল, চল ভেতরে। তুই আজ না-এলে না…
এসে তো পড়লামই! আসাটা তো সোজাই! ফেরার সময়ই যত্ত সমস্যা!
দুই
গানুবাবু বিছানায় তাকিয়ায় উপুড় হয়ে শুয়ে, টিভি-র দিকে তাকিয়েছিলেন। দু-হাতের তেলোর ওপরে থুতনি রেখে। কালার টিভি। দুই ছেলে মিলে কিনে দিয়েছে।
মণিদীপা চলে যাওয়ার পর এই টিভি-ই তাঁর সব। টিভিময় জীবন। টিভি-টা না থাকলে যে কী হত তা ভাবতে পর্যন্ত বুক কাঁপে। টিভি-ই হচ্ছে বিপত্নীকের স্ত্রী। বিধবার স্বামী।
টিভি ছাড়াও আছে দু-বউমা, তিন নাতি আর তিন নাতনি। শিশুরাই বৃদ্ধদের প্রকৃত বন্ধু। এখন মনে হয় ওঁর যে, প্রত্যেক বৃদ্ধর মধ্যেই একজন শিশু এবং প্রত্যেক শিশুর মধ্যেই একজন বৃদ্ধ বাস করে বোধ হয়। এই দুই সত্তার মেরুমিলন যে, ঠিক কোথায় হয় তা মনস্তাত্ত্বিকরাই বলতে পারবেন। তা নিয়ে আজ আর কোনো মাথাব্যথাও নেই গানুবাবুর। আজ প্রায় কোনো কিছু নিয়েই মাথাব্যথা নেই তাঁর। সব ঔৎসুক্য, উচ্চাশা, লোভ, কাম এবং মাৎসর্যর শক্ত হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়েছেন অবলীলায়। কিছুটা হয়তো নিজের অজানিতেও। তবে এখনও রয়ে গেছে একটি জিনিস। ক্রোধ। মানুষ হয়ে জন্মাবার পর রিপুগুলির মধ্যে ক্রোধেরই উন্মেষ হয়েছিল সব থেকে আগে। কিন্তু তার বিলুপ্তি হয়তো ঘটবে চিতাতে শরীর যখন ছাই হয়ে যাবে শুধু তখনই। সব থেকে পরে। স্তিমিত হয়ে এসেছে যদিও ক্রোধ তবুও ছাইচাপা আগুনেরই মতো হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠেই প্রমাণ করে দিয়ে যায় যে, সে ছেড়ে যায়নি আদৌ।
ভয় ব্যাপারটা গানুবাবুর চরিত্রানুগ নয় যে, একথা তাঁর আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতরা সকলেই জানতেন। শৈশবে দারিদ্র্য, বর্ষা-সন্ধ্যার দিঘির পারের অন্ধকার বাঁশবন, গ্রীষ্ম-রাতের সাপ এবং পাঠশালার অত্যাচারী পন্ডিতমশায়ের নির্মম কানমলাকেও ভয় পাননি উনি। চাকরিজীবনেও ভয় পাননি লালমুখো মনিবদের, খাটনিকে, নিয়মানুবর্তিতার কঠোরতাকে, সাহেবদের চোখ রাঙানিকে। পরবর্তী জীবনে ভয় পাননি ঐশ্বর্যকেও। ঐশ্বর্য, ছোটোমাপের মানুষের কাছে বড়োই বিপদ হয়ে আসে। অমানুষ হয়ে যাওয়ার ভয় তাঁকে কখনো আচ্ছন্ন করতে পারেনি। তাঁর সমস্ত বৈভব ও জাগতিক প্রাপ্তির মধ্যে বাস করেও মানুষ গানু রায়কে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন গানুবাবু। গরিবের কষ্ট বুঝেছেন, নিজের দুঃখের দিনের কথাগুলি ভুলে যাননি, কারও প্রতি জ্ঞানত কোনো অন্যায় করেননি। কোনোরকম ভয়েই ভীত হননি একমুহূর্তের জন্যেও।
কিন্তু ইদানীং….।
বড়োনাতনি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ওপরের দিকের কোনো ক্লাসে পড়ে। কোন ক্লাস, রোজই শুধোন তা; কিন্তু পরমুহূর্তেই ভুলে যান। আজকাল পরীক্ষার নাম-টামও তো বদলে গেছে! তাঁদের সময় বলত এনট্রান্স। ম্যাট্রিকুলেশন তো সেদিনই হল।
সুন্দরী, ফর্সা নাতনি, মেজোছেলের বড়োমেয়ে, কালো, একটু নাদুস, বড়োছেলের কলেজে পড়া খেলাপাগল বড়োছেলেকে বলল; তোর পাঞ্জাবিটা ভুঁড়ির ওপর এমন করে লেপটে আছে-না যে, মনে হচ্ছে বেশ ‘আলতোবেলি’ ‘আলতোবেলি’ ব্যাপার।
নাতি হেসে উঠল। যেন অ্যাপ্রিসিয়েট করল যে, ওর বোন দীপার রসবোধ আছে। ওয়ার্ল্ড কাপের ফুটবলারকে আলতো করে ভুঁড়ির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়াটা যার-তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
দীপা বলল, পার্থকাকা সেদিন বলেছিলেন বড়োমামাকে।
কোন পার্থকাকা?
আরে বইপাগলা পার্থকাকা রে।
ছোটোনাতি নিপা বলল, চুপ করো দিদি, দাদু যেন কী বলছেন। কী বলছ দাদু?
গানুবাবু আঙুল দিয়ে দেখালেন।
নাতি বলল, আরও জোর করে দে টি-ভি-টা।
আরও জোর? স্বগতোক্তি করল দীপা। তারপর তার দাদা গগকে বলল, দাদুর কানটা এক্কেবারেই গ্যাসে। কানে একেবারেই শোনেন না আজকাল।
গগ বলল, ছোটোপিসিকে বলে দিয়েছে বাবা, ‘মেমফিস’ থেকে হিয়ারিং-এইড পাঠাবে গিফট-পার্সেল করে।
কেন? এখানেই তো পাওয়া যায়।
এখানে?
হ্যাঁ। কেন-না? শমিতের বড়োমামা তো ফিলিপস থেকে এনেছেন। ওঁদের নিজেদের ডাক্তারও আছেন, ডা. আর.এন.মুখার্জি।
তাই? দীপা বলল। বলেই, ওরা সদলবলে চলে গেল একতলাতে।
গানুবাবুর চোখ টিভি-র দিকেই। ওরা গেল যে তা বুঝলেন, কিন্তু চোখ সরাননি। একটি হিন্দি ছবি দেখাচ্ছে। হিন্দি সিনেমা তিনি জীবনে দেখেননি। হিন্দি বলতেও পারেন না। ইচ্ছে করেও বলেননি। তবে আজ গানুবাবুর যায়-আসে না কিছুতেই। একটা-কিছু নিয়ে থাকা তো চাই। সময় যে আর কাটে না। একদিন ছিল যখন মরার সময়ই ছিল না। আর আজকে সময়ের ভারী পাথরে চাপা পড়ে গেছে স্থবির জীবন; বিবর্ণ, ইটচাপা ঘাসেরই মতো। তাই টিভি-র প্রোগ্রাম ভালো লাগালাগির কোনো ব্যাপারই নেই। নাতি-নাতনিরা ঘরে গোলমাল করুক। তিনি যে আছেন, একসময়ের দোর্দন্ডপ্রতাপ গানু রায় যে সশরীরে এই ঘরে উপস্থিত, তো জেনেই ভালো লাগে তাঁর। যাঁর মুখের দিকে চেয়ে তাঁর কোনো ভাই বা ছেলেও কথা বলতে সাহস করেনি কোনোদিনও সেই তাঁকেই এই নাতি-নাতনিরা আজ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলেও এক ধরনের আনন্দ বোধ করেন তিনি।
বন্ধুভাবে না পেলে এই জীবনে কোনো কিছু পাওয়ার দাম নেই। আজ বোঝেন কথাটা কতখানি সত্যি। মণি বলত কথাটা। নাতি-নাতনিরা কোনো আড়াল রাখেনি ওদের আর গানুবাবুর মধ্যে। বৃদ্ধকে তিন বছরের নাতনি এবং কুড়ি বছরের নাতি সকলেই বন্ধু ভাবে। বন্ধু ভাবে বলেই উপেক্ষা করে কখনো কখনো। ওদের অনেক কথাই গানুবাবু বোঝেন না, কানে না শোনার জন্যেই; তবু কলরোলই যথেষ্ট। অশীতিপর গানুবাবু জেনে আশ্বস্ত বোধ করেন যে, ক্ষয়িষ্ণু, প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে আসা তাঁর নিজের চারপাশে এখনও জীবনের চিহ্নগুলি বড়োই স্পষ্ট। জীবন্ত সব ফুটফুটে টানটান চামড়ার মুখের টাটকা ছেলে-মেয়েদের ছড়াছড়ি। একদিন উনি নিজেও যে ওদের মতো ছিলেন একথা ভেবেই খুশি হন খুব।
টিভি-র পর্দাতে অনেকই মানুষের ভিড়। অনেকই রকমেরও। হাসি, গান, নাচ, মারামারি। অনেক রঙের সহাবস্থান সেখানে। উজ্জ্বল সব রং, হয়তো রুচিতে লাগত, চোখে ঠেকত কিছুদিন আগেও; আজকে যেকোনো রংই যথেষ্ট। এমনকী সাদাও। যদিও সাদা মানেই রক্তশূন্যতা। রং দেখলেই উনি খুশি। বিবর্ণ জীবন যাঁদের তাঁরাই জানেন রঙের মূল্য কতখানি।
কিছুক্ষণ পরই দুখিয়া তাঁকে ডাকতে এল। বলল, বাবু খাবার দিয়েছি। সিনেমাও তো শেষ হল। বন্ধ করেই দিই টিভি এবারে? খাওয়ার পরে আবার চালিয়ে দেব খন। ন্যাশনাল প্রোগ্রাম থাকবে। দেখবেন তো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। নিশ্চয়ই।
টিভিটা না চললে বড়োই ভয় করে গানুবাবুর আজকাল।
দু-পা গেলেই খাবার ঘর। তা-ই মনে হয় বহুদূরের পথ। একটুও জোর নেই পায়ে, রোশনি নেই চোখে। বউমাদের মধ্যে একজন-না-একজন খাওয়ার সময় প্রায় রোজই সামনে থাকে, আজ ছেলে-বউদের নেমন্তন্ন আছে কোথায় যেন। কার যেন ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি না জন্মদিন না ওইরকম কিছু। মনেও থাকে না নামটাম আর। প্রয়োজনও নেই।
টিভি-র গাঁক-গাঁক আওয়াজ কান-চোখ এবং মস্তিষ্ককে ভরে রাখে। যখন টিভি দেখেন না তখন মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা ঠেকে। এবং মাথাটা ফাঁকা থাকলেই, মাথার মধ্যে চিন্তাগুলো এমন এলোমেলো হয়ে ঘুরপাক খেতে থাকে যে, তা বলার নয়। কখনো মনে হয়, মাকড়সার জালে জড়িয়ে যাচ্ছে মস্তিষ্ক। কখনো-বা মনে হয়, প্রচন্ড কালবোশেখি ঝড়ের মধ্যে পড়ে কুটোর মতো উড়ে যাচ্ছে তা। কখনো আবার মনে হয় নৌকাডুবি হওয়া সাঁতার না-জানা মানুষের মতোই তাঁর মস্তিষ্কটি ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে অথই কোনো নদীর জলের গভীরে। যেখানে চাপ চাপ বোতল সবুজ নরম শ্যাওলা, প্রথম যৌবনের দাড়ির মতো নরম; যেখানে জলজ অন্ধকারের মধ্যে প্রতিসারিত হালকা হলুদ আর সবুজ মেশা নরম আলো; প্রথম প্রেমিকার চিঠির মতো অস্পষ্ট।
হলুদ আর নীল মেলালে সবুজ হয়। যাঁরাই ছবি আঁকেন তাঁরাই জানেন। কিন্তু সেটা তৈরি করা সবুজ। ওই অবস্থার পরই মস্তিষ্ক যে গভীর সবুজ অন্ধকার নদীতলে হারিয়ে যায়, চারিয়ে যায়; সেই সবুজই আদিম সবুজ। মৌল তার অস্তিত্ব। কোনো শিল্পীরই তুলিতে সে জন্মায়নি। মস্তিষ্কের মধ্যের সেই জলজ সবুজের বোবা অন্ধকারকে বড়োই ভয় পান গানুবাবু।
জানলার ধারে দাঁড়াতেও উনি ভয় পান আজকাল। ভয় পান, আকাশের দিকে চাইতেও। ভয় পান একা একা বাথরুমে নিজের অশক্ত, বার্ধক্যপীড়িত থরথরিয়ে কাঁপা পা-দুটির ওপর দ্বিধাভরে ভরদিয়ে দাঁড়ানো শরীরটার করুণ ছায়া আয়নাতে হঠাৎ দেখে। কারা যেন আয়নায় প্রতিফলিত তাঁর হাস্যকর কুদৃশ্য নগ্নতার চারপাশে রথীন মৈত্রর ‘দা ড্রামার’ ছবির মানুষগুলিরই মতো বেসামাল হাত-পা ছুড়ে নি:শব্দে নাচে। প্রচন্ড প্রমত্ততায় শব্দহীন কিন্তু চিৎকৃত গান গায় সেই ছবির মানুষেরা।
ভয় করে।
বড়ো ভয়। বড়ো একা লাগে।
মণি! তুমি কোথায় আছ গো এখন? ভয় কি কেটেছে তোমার? যেখানে গেছ, সে জায়গাটি কেমন? ভালো? লোডশেডিং আছে কি? ইনফ্লেশন? এই মারাত্মক ইনফ্লেশন? যা অবসরপ্রাপ্ত, অশক্ত, অসহায় মানুষদের গেঁটেবাতের চেয়েও অনেক বেশি কষ্ট দেয়? তাও কি আছে?
নাতি-নাতনিরা দল বেঁধে এল দাদুর খাওয়া দেখতে। মা-বাবারা বলে গেছে নিশ্চয়ই পার্টিতে যাওয়ার সময়! এই এক ধারা হয়েছে আজকাল। গানুবাবুদের সময় ‘নেমন্তন্ন’ শব্দটার মানে ছিল বাড়ি সুদ্ধ সকলেরই নেমন্তন্ন। আজকাল কেউই আর নেমন্তন্ন বলে না। বলে, ‘পার্টি’। ছেলে-মেয়েরা সকলেই বাদ। ইংরেজ সাহেবদের সঙ্গেই সাহেবি কোম্পানিতে কর্মজীবনের পুরোটাই কাটিয়েছিলেন তিনি। তাই জানেন যে, ইংরেজদের দোষ যেমন ছিল, গুণও ছিল অনেক। সেগুলোর কিছুমাত্রও না-নিয়ে খালি এই বাহ্য ব্যাপার আর ওর উপরচালাকিগুলোই নিল ওরা। বোঝেন না। এখন আর বোঝার ইচ্ছেও নেই। লাভ কী?
নাতি-নাতনিরা টেবিলে বসে গল্প করছিল নিজেদের মধ্যে। বোধ হয় কর্তব্যর কথা মনে পড়ে যাওয়াতে হঠাৎ বলল দীপা, ভালো করে খেয়ো দাদু। পাতে নুন খেয়ো না একটুও। রুটিও ঠিক দুটোই। বুঝেছ? বলে গেছে মা।
গগ বলল, দীপাকে থামিয়ে দিয়ে অন্য কথার সূত্রে বলল, তুই যা-ই বলিস দীপা, ‘ওয়েট আনটিল ডার্ক’-এর চেয়ে ‘ভার্টিগো’ অনেকই ভালো ছবি। মানে অনেক বেশি ভয়ের!
‘ভয়’ কথাটা অস্পষ্ট শুনলেন গানুবাবু। খেতে খেতে মুখ তুলে তাকালেন নাতি-নাতনিদের দিকে।
দীপা বলল, হিচকক-এর ‘বার্ডস’ দেখেছিস দাদা? ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবি।
যা! যা! অজ্ঞান হওয়া অত সহজ ব্যাপার নয়। গগ বলল।
‘আলতোবেলি’ বলে ব্যাপার! ঠাট্টার গলায় দীপা বলল। তারপর বলল, তুই ‘টু চেইজ আ ক্রুয়েড শ্যাডো’ দেখেছিস? অনেক পুরোনো ফিলম। কাল নমুদের বাড়িতে ভি.সি.আর.-এ দেখলাম। ফ্যানটাস্টিক!
গানুবাবু হাই-পাওয়ারের চশমার মধ্য দিয়ে নাতি-নাতনিদের সুন্দর উজ্জ্বল ফুলের মতো আলো-ঝলমল মুখগুলির দিকে চেয়েছিলেন। ভাবছিলেন, ভয়ের প্রকৃত স্বরূপ সম্বন্ধে ওদের আসলে কোনো ধারণাই নেই বলে ভয় নিয়ে ওদের এত বিলাস। প্রেমেরই মতো, ভয়ও অল্পবয়সি ওদের কাছে রহস্যময় ভালো লাগা এবং খারাপ লাগাতেও মাখামাখি গা-শিরশির করা এক অনুভূতি। ‘ভয়’ যে কাকে বলে, তা জানলে ওরা সিনেমাতে দেখা ভয় নিয়ে এত উচ্ছ্বসিত হত না।
গানুবাবু জেনেছেন ভয় কাকে বলে। ভয়ের সঙ্গেই তাঁর ওঠা-বসা এখন।
গানুবাবুর খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই অনিচ্ছুক কর্তব্য করতে আসা নাতি-নাতনিরা কলকল করতে করতে ওপরে চলে গেল।
তেতলাতে ছোটোছেলে থাকে। চার-তলাতে বড়োছেলে। মেজো আজ আটাশ বছর নিউইয়র্কে। আমেরিকান-চাইনিজ একটি মেয়ে বিয়ে করেছে পাঁচ বছর হল। একবার মাত্র এসেছিল। ভালো আমেরিকান চপস্যুই রাঁধে সুসান। রোমান ক্যাথলিক ওরা।
মুখ ধুয়ে এসে খাটে বসে ছোটো তোয়ালে দিয়ে ভালো করে হাত মুছছিলেন গানুবাবু। ঠিক সেই সময়েই লোডশেডিং হয়ে গেল। অন্ধকার— গভীর অন্ধকার। বাড়ির সামনের মস্ত, প্রায় তাঁরই সমসাময়িক বকুল গাছটার বিস্তারিত ডালপালা ভ্যাপসা গরমের রাতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যেন গানুবাবুর মুখের দিকেই চেয়ে আছে তার অগণ্য পাতাদের বুকের মধ্যিখানে বসানো অলক্ষ্যে লুকিয়ে-রাখা অসংখ্য চোখগুলি মেলে। বলছে যেন, ‘আজ কেমন?’
কে যেন হঠাৎই খোলা জানলার পাশ থেকে সরে গেল। কে? কে তুমি?
বিমুর মতো গলায় কে যেন হঠাৎ পাশ থেকে বলে উঠল, ‘কী রে শালা গানু! কনটেমপ্লেশন করছিস?’
চমকে উঠলেন গানুবাবু। বাঁধানো দু-পাটি দাঁতই খুলে অন্ধকার হাতড়ে কাচের বাটিটা বের করে বাটির জলে ডুবোলেন।
হুবহু বিমুরই মতো গলা। তাঁর কলেজের বন্ধু। খুবই মজার ছেলে ছিল। সব কথার আগে একটা করে ‘শালা’ বলত ও। অথচ ওরকম ভদ্র ছেলে হয় না। দারুণ খেলত ফুটবল। ওই খেলার জোরেই চাকরিও পেয়েছিল রেলে। তারপর নিজ-যোগ্যতাতে উন্নতিও করেছিল খুবই। সিগারেট খেত প্রচন্ড। যাকে বলে চেইন স্মোকার। জিভে ক্যান্সার হয়েছিল। ধরাও পড়ল গানুবাবুরই সঙ্গে বাইরে গিয়ে। পরিষ্কার মনে আছে। মনে হয়, সেদিনের কথা। দু-জনে গয়ায় পিন্ডি দিতে গেছিলেন নিজের নিজের বাবার মৃত্যুর পঁচিশ বছর পর। ওঁদের দু-জনের বাবাই একই বছরে মারা যান। গয়াতেই জিভের জ্বালা প্রথম ফিল করেন বিমু। গানুবাবুই জোর করে ধরে নিয়ে যান ডাক্তারের কাছে। গানুবাবুদের কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভের দাদা ডাক্তার পান্ডে ভালো করে বিমুকে দেখে বলেছিলেন কলকাতায় গিয়েই ক্যান্সার স্পেশালিস্টকে দেখাতে। গানুবাবু আর জুনিয়র পান্ডেকে আলাদা করে পাশের ঘরে ডেকে ডাক্তারবাবু বলেছিলেন যা বলার ফিসফিসে গলায়। তখন বিমুর কতই-বা বয়স। পঁয়তাল্লিশ-টয়তাল্লিশ হবে।
কলকাতায় ফিরেই চিকিৎসা শুরু হল। যতখানি ভালো করে সম্ভব। ভাই-বোনেরা সেবাযত্নর কোনোরকম ত্রুটি করেনি। দেখতে দেখতে অতবড়ো সুন্দর সুগঠিত হাসিখুশি মানুষটা চোখের সামনেই ছোট্ট কালো একটি চামচিকের মতো হয়ে গেল। মাথাভরতি কোঁকড়া চুল ছিল। উঠে গেল তাও সবই। কী বীভৎস চেহারাই যে হয়েছিল বিমুর, এখনও মনে করলে ভয় করে গানুবাবুর। ভয়ে-দুঃখে গানুবাবু শেষকালে ওকে দেখতে যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিলেন। বন্ধুদের মুখে খবর নিতেন। তবে এমনই ঘটেছিল যে, ঠিক মৃত্যুর দিনটিতেই গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন উনি। বিমুর চোখ-মুখে কী যে অস্বাভাবিক এক ভয় ফুটে উঠেছিল সেদিন। কী অবিশ্বাস্য এক অসহায়তা! সন্ধে হয় হয়, সেই সময় হঠাৎই একবার হাত তুলে খোলা জানলার দিকে দেখাল ও। বসন্তর দিন, তখনও অনেক আলো ছিল একতলায়। ওর ঘরেই শুয়েছিল ব্যাচেলর বিমু। ওর রামের মতো দাদা, বউদি এবং দিদিরা সব ঘিরে ছিল ওকে। বিমু ফিসফিস করে জানালার দিকে চেয়ে অদৃশ্য কাদের যেন বলছিল, আঃ, একটু দাঁড়াও-না। প্লিজ! একটু দাঁড়াও। যাচ্ছি, যাচ্ছি আমি।
বিমুর বালবিধবা বড়দি অবাক হয়ে শুধিয়েছিলেন, কার সঙ্গে কথা বলছিস রে বিমু?
ওই যে। ওরা। ওরা নিতে এসেছে আমাকে। ওই যে! দেখতে পাচ্ছ না তোমরা?
কারা? কী যে বলিস পাগলের মতো।
ওই যে! ওরা। যারা সকলকেই নিয়ে যায়। নিতে আসে। তর সইছে না ওদের। আঃ। দাঁড়াও, দাঁড়াও একটু…আমি তো যাবই…
এমন করে বলেছিল বিমু যে, গানুবাবুর মনে হয়েছিল যেন বরই নিতে এসেছে কনের বাড়ির কেউ।
তারপর হঠাৎ—‘যাই! যাই রে দাদা। বউদি। দিদি। ঘুনটু রে যাই। চলি রে গানু। চললাম, চললাম সবাই। এই কথা ক-টি বলা শেষ করেই মাথাটা বালিশে লুটিয়ে দিয়েছিল বিমু।’ মুখটি বিকৃত হয়ে গেছিল।
বিমুর দাদা সঙ্গে সঙ্গেই গিয়ে যে জানলার দিকে চেয়ে বিমু এসব বলছিল সেই জানলাটি সশব্দে বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
যে ওই দেশে একবার চলে যায়, সে ফিরে আসুক তা কারওই অভিপ্রেত নয়। তার প্রিয়তম জনেরও না।
বিমু বলত গানুবাবুকে, ‘চলল শালা! আজ শিশির ভাদুড়ির থ্যাটার দেখে আসি।’ একই মেস-এ থাকত দু-জনে। কোনোদিন বলত ও—চল আজ ফুটবল খেলা দেখে আসি। ইংলণ্ডের হাইল্যাণ্ডার্স টিম এসেছে। মোহনবাগানের সঙ্গে খেলা। ব্যাকে গোষ্ঠ পাল, গোলে মনা গুহ। খেলা তো দেখতে হবে ব্যাক আর গোলকিপারেরই। ওরা তো বুট পরে মেরে ছারখার করে দেবে খালিপায়ে আমাদের দিশি প্লেয়ারদের।
খুবই প্রাণ ছিল বিমুটার। চিরদিনই। রসিকতাতে ওর জুড়ি ছিল না। যারা ওকে ডেকে নিয়ে গেল অত কষ্ট দেওয়ার পর; যারা এসেছিল, তারা কারা? আজও জানা যায়নি।
পরজন্মে-ফন্মে কোনোদিনও বিশ্বাস করেননি গানুবাবু। বিজ্ঞানের ছাত্র তিনি। ধর্ম মানেন না। পুজো করেন না। গুরু-ফুরুতেও বিশ্বাস করেন না। ওইসব দুর্বলতা বরং তাঁর চলে-যাওয়া স্ত্রী মণির ছিল। মণিদের পারিবারিক গুরুর কাছেও দীক্ষা নিতে দেননি গানুবাবু মণিদীপাকে। খুবই দুঃখ ছিল এই কারণে মণির। মানুষের যে একটামাত্রই জীবন, একথা তিনি চিরদিনই বিশ্বাস করে এসেছেন। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই জীবনের শেষ। রেশ থাকে না কিছুমাত্রই। এই-ই জানেন এবং মানেনও তিনি।
কিন্তু…
মণির মৃত্যুর সময়ও উনি নার্সিং হোমে মণির একেবারে পায়ের কাছেই বসেছিলেন। চারপাশে দাঁড়িয়েছিল ছেলে-বউ-মেয়ে-জামাইরা। শেষসময়ে বিমুরই মতো মণিও হঠাৎ এক ঝটকাতে খোলা জানলার দিকে তাকিয়েছিল। পরমুহূর্তেই ওর মুখ-চোখ ভয়ে একেবারে কুঁকড়ে গিয়ে নীল হয়ে গেছিল। জিভটা বেরিয়ে এসেছিল হঠাৎ করে। যেন কালী মায়ের জিভ। মণির সেই প্রচন্ড ভয়ার্ত দৃষ্টিটি গানুবাবুর দু-চোখে চিরদিনের মতোই আঁকা হয়ে আছে। কী দেখেছিল মণি মৃত্যুর মুহূর্তে? জানলার দিকে তাকিয়েছিলই-বা কেন সে? হঠাৎই অমন ভয় পেয়েছিল কেন?
‘কী রে শালা? কনটেমপ্লেশন করছিস?’ আবার বলল বিমু।
এবার যেন একেবারে গানুবাবুর ঘাড়ের পেছনে দাঁড়িয়েই।
গানুবাবুকে চুপ করে কিছু ভাবতে দেখলেই বিমু ওই বাক্যটি বলত ঠাট্টা করে। ‘কী রে শালা! কনটেমপ্লেশন করছিস?’
বকুল গাছের ঘন সন্নিবিষ্ট পাতার ভিড়ের গভীর থেকে কোনো শব্দসমষ্টি বা ঝড় বা অজস্র ফুলের গন্ধ যেন এক দমকে ভেসে আসতে চাইছে গানুবাবুর দিকে। কিন্তু হাওয়া নেই বলেই যেন তারা থমকে আছে।
হাওয়া ছিল। লোডশেডিং হলেই হাওয়া দিতে শুরু করে। আলো যখন জ্বলে তখন বোঝা পর্যন্ত যায় না, এত কোটি কোটি ওয়াটের আলো আর লক্ষ লক্ষ ফ্যানের আওয়াজ কলকাতার সব মিষ্টি হাওয়াকে আর নিথর নিস্তব্ধতাকে কীভাবে খুন করে যায় প্রতিমুহূর্তে। লোডশেডিং হলেই তখন বোঝা যায় পৃথিবীতে কত শান্তি, কত হাওয়া।
বেশ গানের গলা ছিল মণির। বিমু বলত, এ জন্মে তুমি তো গানুর মতো বেরসিককে বিয়ে করে জীবনটা মাটিই করে গেলে। পরজন্মে তোমাকে আমিই বিয়ে করব দেখো। তখন দেখবে জীবন কাকে বলে! আমি তো স্বর্গে পৌঁছেই রিসেপশনিস্টের কাছে তোমার ঘরের নাম্বার খোঁজ করব।
মণি হাসি হাসি মুখ করে বলত, আমি রাজি নই।
কেন? বিমু বলত, কপট রাগের স্বরে।
মণি বলত, যেকোনো হোটেলেরই ঘরের দরজাতে চাবি লাগিয়ে চাবি ঘোরাবার সময়ই মন বড়ো প্রত্যাশায় ভরে ওঠে, মন ভাবে এবারে কী-না-কী যেন দেখবে ভিতরে! কিন্তু ঘর খুললেই দেখা যায় যে, সব ঘরই একইরকম। একই ধরনের ফার্নিচার, কার্পেট, সোফা, বিছানা, বালিশ। নতুনত্ব নেই কিছুই। শুধুই হতাশা, একঘেয়েমি। সব হোটেল, সবই ঘরই এক।
আহা! স্বর্গের হোটেলের কথা তুমি জানছই-বা কী করে! তা ছাড়া হোটেলে ভালো না-লাগে তো মন্দাকিনী নদীর পাশের ঘাসেই বসব তোমাকে নিয়ে। বিমু না-দমে বলত।
এত ফাজিল না! বলেই মণি উঠে যেত চা বা খাবার আনতে।
দেখা কি হয়েছে মণির সঙ্গে বিমুর? এতদিনে? কে জানে! আগে গেছে বিমুই। স্বর্গের রিসেপশনে কি অপেক্ষা করেছিল ও মণির জন্যে নিজের ঘরের চাবি হাতে নিয়ে? কে জানে? কেন এমন মনে হয়? এসব কথা কেন মনে আসে বার বার? বিজ্ঞানে, আধুনিক প্রযুক্তিতে, যন্ত্রসভ্যতায় মানুষের অসীম জ্ঞানে এবং সর্বজ্ঞতায় প্রচন্ড বিশ্বাসী গানু রায়ের মনে যে কেন এসব আজগুবি ভাবনা আসে?
ডাডু ও ডাডু। টুমি বয় পেয়ো না কিন্তু অণ্ডকারে। আমরা আলো এনেচি।
দুখিয়ার কোলে চড়ে ঘরে এসে, হাতে একটি ছোট্ট জ্বালানো-টর্চ ধরে তিন বছরের নাতনিটি বলল, গানু রায়কে।
ওকে গানুবাবুর পাশে খাটে বসিয়েই দুখিয়া হ্যারিকেনটা জ্বালাল।
ইতিমধ্যে সামনের মাড়োয়ারির বাড়ির জেনারেটরও চালানো হয়েছে। ওদের বাড়ির আলোতেই এই বাড়ির এ দিককার ঘরগুলোর অন্ধকার ঘোচে। তবে বড়ো আওয়াজ। বাড়িটি ছিল প্রফেসর সেনগুপ্তর। হঠাৎ সেরিব্রাল অ্যাটাকে মারা যান। ছেলেরা কেউই নিজের পায়ে দাঁড়াল না। মাড়োয়ারি মি. আগরওয়াল কিনে নিয়েছেন। এ পাড়ার অর্ধেক বাড়ি ওঁরাই কিনে নিয়েছেন, ওঁর সাড়ুভাই, শালা, ভাই-ভাতিজা, বেচারাম বাঙালিদের কাছ থেকে, একটি একটি করে।
দুখিয়া হ্যারিকেন জ্বেলে চলে গেল। কিন্তু আলো এসে গেল একটু পরই। এবং আলো আসার সঙ্গে সঙ্গে ছোটোবউমাও এল। ঘরে ঢুকেই বলল, বাবা এক্ষুনি শুনে এলাম উকিলকাকা মারা গেছেন।
অ্যাঁ? তুমি এত তাড়াতাড়ি এলে? গানুবাবু শুনতে না পেয়ে বললেন।
এলাম, আমার শরীরটা ভালো লাগছে না তাই। উকিলকাকা মারা গেছেন।
অ্যাঁ? কী বলো?
হ্যাঁ বাবা।
রণেন?
হ্যাঁ বাবা।
কখন?
একটু আগে। আপনি কি যাবেন? তাই ও গাড়ি পাঠিয়ে দিল আমাকে দিয়ে।
আমি? না না। না! আমি যাব না। কী দেখতে যাব?
ভয়ার্ত, বিরক্ত এবং অসহায়তা মাখা গলায় বললেন উনি।
একটু চুপ করে থেকেই বললেন, কোথায় শুনলে।
সিম্পিদের বিয়ের দশ বছরের পার্টিতে গেছিলাম। দুবুদা ফোন করে জানাল।
তোমরা কাল সকালেই যেয়ো। সিধে নিয়ে যেয়ো। ফুল। টাকা নিয়ে যেয়ো আমার কাছ থেকে। গানুবাবু স্বগতোক্তির মতোই বললেন। ওঁর যতটুকু সঞ্চয় আছে তা প্রিয়জনের মৃতদেহের ফুল কিনতেই লাগবে। দীর্ঘজীবন বড়োই কষ্টের।
কবে যেন এসেছিল রণেন! অনেকক্ষণ গল্প করে গেল? গানুবাবু জিজ্ঞেস করলেন ছোটোবউমাকে।
এই তো পরশুদিন।
পরশু?
হ্যাঁ বাবা।
অ।
ছোটোবউমা চলে গেল হ্যারিকেনটা নিবিয়ে দিয়ে।
রণেন! রণেন ঘোষও। অনুজের মতো যদিও, কিন্তু ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছিল ও গানুবাবুর। নামি উকিল ছিল। সিভিলই করত, শেষের দিকে ট্যাক্সও করছিল কিছু কিছু। গত সপ্তাহেও কোর্টে গেছে। রোভার, মানে স্ট্যাণ্ডার্ড টু থাউজ্যাণ্ড গাড়ি কিনেছিল একটা অল্প ক-দিন হল। টেনিস খেলত এই সেদিনও। রণেনও যে, কোনো দিন মরবে বা মরতে পারে তা ভাবতেও পারেননি গানুবাবু। বয়সে ছোটো ছিল রণেন গানুবাবুর চেয়ে বছর দশেকের। মণির সঙ্গে রণেনের একটা প্লেটোনিক প্রেমের সম্পর্কও ছিল। বউমারাও জানে। রণেনের স্বভাবের জন্যেই বউমারা সকলেই ওকে খুব পছন্দ করত। ভাবতেই পারছেন না। পরশুদিনও ওই চেয়ারটাতে বসে কত্ত হাসি-ঠাট্টা করে গেল। ইয়ার্কি মেরে বলেছিল, গানুদা, আমি একজন রক্ষিতা রাখছি। তোমাকেও নিয়ে যাব, দেখবে তুমি গেঁটেবাত, হার্টের ব্যামো সব হাপিস করে যৌবন ফিরে এসেছে তোমার।
এবারে আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়লেন গানুবাবু। দুখিয়ার কথা ছিল মশারিটা গুঁজে দিয়ে যাওয়ার। এল না। এখন আর কেউই মানে না তাঁকে। শরীরের জোর নেই, টাকার জোর নেই, কাউকেই আর কিছু দেওয়ার ক্ষমতা নেই। বাড়িটাও দেশে-থাকা দু-ছেলেকে লিখে দিয়েছেন। তবু টিভিটা ছিল, নাতি-নাতনিরা, তাই….
কিন্তু কোথায় গেল রণেন? গেলটা কোথায়? মণি? বিমু? মরে-যাওয়া মানুষেরা সব কোথায় যায়? সেদিন পাশের বাড়ির ঘোষ সাহেবের তিরিশ বছরের বউমাটি এমনিই হঠাৎ চলে গেল। হার্ট-অ্যাটাক। গভীর রাতে অর্গান বাজিয়ে গান গাইত মেয়েটি। ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতদূরে আমি ধাই, কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই…’। রমা না ক্ষমা কী যেন নাম ছিল, মনে থাকে না। ভারি মিষ্টি মেয়ে। তিরিশ বছরে কেউ কি যায় না যাওয়া উচিত কারও? এই ছিল; এই নেই। শরীরটা থেমে গেল, চোখ বুজে গেল, কিন্তু মস্তিষ্ক? মন? তারাও কি অমনিই চিরদিনের জন্যে সত্যিই থেমে যায়। আত্মা বলে কিছু নেই তা তিনি জানেন। ঈশ্বরফিশ্বরও মানেন না, ব্রহ্মও নয়। কিন্তু তবে কঠোপনিষদ-এ এতসব কথা লেখা হল কেন? কেন লেখা হল ‘গীতা’য়। হিন্দুদের সব প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে? সাহেবদের বাইবেল কেন বলল মৃতকে কবর দেওয়ার সময় এই মন্ত্রোচ্চারণ করবে—
‘উই দেয়ারফোর কমিট হিজ বডি টু দা গ্রাউণ্ড, আর্থ টু আর্থ, অ্যাশেস টু অ্যাশেস ডাস্ট টু ডাস্ট ইন শিয়োর অ্যাণ্ড ইটার্নাল হোপ অব রেজারেক্সান টু ইটার্নাল লাইফ।’
‘ইটার্নাল লাইফ’ বলে কি আছে কিছু?
‘কঠোপনিষদ’ বলছে:
‘ন জায়তে ম্রিয়তে বা বিপশ্চিন—
নায়ং কুতশ্চিন্ন বভুব কশ্চিৎ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।’
কেন বলল এই কথা?
পুনর্জন্ম কি আছে? সত্যিই কি আত্মা অন্য শরীরে প্রবেশ করে থেকে যায় পৃথিবীতে?
ধ্যাত! এইসব আজেবাজে বুজরুকিতে বিশ্বাস করেন না গানুবাবু। আধুনিক তিনি।
কিন্তু আজকাল ভয়ও করে খুব। কোথায় যাবেন তিনি এই চিন্তাটা সবসময় জোঁকের মতোই আঁকড়ে থাকে। সব শান্তি শুষে খায়। অনুক্ষণ। রণেন কোথায় গেল? যাবে কি কোথাও? নাকি থেমেই যাবে? জাস্ট থেমে যাবে? শরীরটা থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এতদিনের মনটা, এত অভিজ্ঞতাময় তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক, সবই কি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে? থাকবে না একটুও?
মরা মানুষেরও মুখে যখনই চেয়েছেন গানুবাবু, মনে হয়েছে মানুষটি ঘুমিয়েই পড়েছে শুধু। জীবনের পথে এতদিনের পথ চলা শুধু কি এইভাবে হঠাৎ একদিন থেমে যাওয়ারই জন্যে? বিজ্ঞান তো নিজেকে নিজে বাতিলও করে মাঝে মাঝে। বিজ্ঞানীরাও বলেন, ‘যা ধ্রুব বলে জানতেন, তা ধ্রুব নয়। ‘স্থবির জ্ঞান’ বলে কোনো কথা নেই।’ না! বিজ্ঞানের জগতেও নেই। জীবনের সঙ্গে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান বদলে যায়, বদলে যায় তার পরিধি, রকম। থেমে থাকে না এক জায়গাতে। বিজ্ঞান যা জেনেছে এই ব্যাপারে, তাই কি চরম জানা? শেষ জানা?
গানুবাবু ভাবেন। নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলেন মুখ গোঁজ করে।
হাওয়া বইছে এলোমেলো। বউমা ঘরে আসার পর দু-ঘণ্টা সময় চলে গেছে। আগরওয়ালাদের বাড়ির গ্র্যাণ্ডফাদার ক্লক বলল।
ঝড় উঠতে পারে। রাত গভীর। ঘুম নেই। রণেনের খবর শোনার পর ঘুম আসেনি। ভাবনা উঠলে সময় উড়েও যায় মেঘের মতো, বোঝা পর্যন্ত যায় না কী করে সে গেল। ঝড় উঠলেই রাস্তার আলোটা দোলে আর বকুল গাছের ডালপালার ছায়াগুলো গানুবাবুর সাদা দেওয়ালে নানারকম নাচ নাচে নি:শব্দে। কালো কালো ছায়ামূর্তির মতো। ভয় করে তখন খুবই।
সাহসী গানুবাবুর সত্যিই বড়ো ভয় করে আজকাল।
বিমু কাদের দেখেছিল জানলাতে? গানুবাবু তো ওর সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন। একথা তো শোনাকথা নয়। চুলহীন, শিশুর মতো ছোট্ট হয়ে-যাওয়া শরীরের বিমু ফিসফস করে বলেছিল ‘একটু দাঁড়াও। আসছি, আসছি আমি।’
মণিই-বা মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে কাদের দিকে তাকিয়েছিল জানলাতে? কোন ভয়ে তার মুখ অমন আতঙ্কিত হয়ে গেছিল? জিভ বেরিয়ে পড়েছিল বীভৎসভাবে অমন হঠাৎ করে? কেউ কি সত্যিই নিতে আসে যাওয়ার সময়?
টলস্টয়ের কথাটা গল্পে পড়েছিলেন গানুবাবু অনেক দিন আগে। ‘হোয়াট মেন লিভ বাই’। তখন ভালো লেগেছিল খুবই। এই মুহূর্তে গল্পটার কথা মনে পড়ে গা-ছমছম করতে লাগল। ওর জীবন শেষ হয়ে এসেছে। এখন ‘হোয়াট মেন লিভ বাই’ তা নিয়ে কোনো ঔৎসুক্যই নেই ওঁর আর।
কাল থেকে দুখিয়াটাকে এই ঘরেই শোওয়াবেন। অথবা, কোনো নাতিকে। শিশুর মতো হয়ে গেছেন তিরাশি বছরের গানু রায়। একা শুতে বড়োই ভয় করে।
খোলা জানলার পাশ থেকে কে যেন হঠাৎ হাতছানি দিল। কে? কথা বলছে কি কেউ ফিসফিস করে? টিভি-তে কেন যে সারারাতই প্রোগ্রাম থাকে না! থাকলে, এই ভয়ের মুহূর্তে টিভি-টা খুলে দিয়ে বসে থাকতেন সামনে। ঘরে কেউই না-থাকুক রঙিন পর্দায় তো অনেকেই থাকত। ভলিউমটাকে খুব বাড়িয়ে দিতেন। ঘুমোবার অসুবিধা হত হয়তো বাড়ির অন্য বাসিন্দাদের। হলে হত। তাঁর জীবনটা তাঁর কাছে যে খুবই দামি। তাঁর বয়স যতই হোক। জীবনের চেয়ে দামি আর কী আছে! পৃথিবীর সব সম্পর্ক, সব মহার্ঘ জিনিসের থেকেও এই পুরোনো জীবনটা অনেকই দামি।
রণেন! কাল দাহ করবে নিশ্চয়ই ওকে নিমতলায়। সকালে।
রণেন!
হঠাৎই এক বীভৎস চিৎকারে চমকে উঠলেন গানুবাবু। বড়োরাস্তা থেকে একদল জন্তু আওয়াজ দিল—‘বল্লো হররি বোল…’
কী সাংঘাতিক। কী প্রচন্ড অশালীন। এই জন্তুগুলোকে পুলিশের উচিত গুলি করে মারা। পৃথিবীর কোনো সভ্য, এমনকী অসভ্য দেশেও মৃতের প্রতি এমন অসম্মান কখনোই দেখানো হয় না। ছি ছি। এ কি কোনো সভ্য দেশের শিক্ষিত মানুষদের শহর! বাঙালি ছেলেরাই তো শব বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। মৃতকেও কি ন্যূনতম সম্মান…?
একথা ভাবতে ভাবতেই আবারও ওই চিৎকার হল। আর সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করতে লাগল গানুবাবুর। ভাবলেন, বিছানা ছেড়ে উঠে একটু জল খান। কিন্তু হাত-পা সব অবশ হয়ে এল। ঘামতে লাগলেন খুব। তারপরে উঠেই পড়লেন এক ঝটকা দিয়ে। হয় এসপার নয় উসপার। এই জীবন বইবার কোনো মানে নেই। নিজের কাছে এবং অন্যদের কাছেও কোনো প্রয়োজন নেই তাঁর। তবু এই খোলসটাকে ছাড়তে বড়ো ভয় করে। জীবন ছেড়ে যাওয়ার দুঃখ নয়; অজানা গন্তব্যের ভয়। বড়ো ভয়। রুখু প্রান্তরের সাপেরই মতো যদি সহজেই খোলসটা ছেড়ে যেতে পারতেন! কিন্তু খোলসটাতেই তো আটকে পড়ে থাকার কথা। বিজ্ঞান তো আত্মাকে অস্বীকারই করে। তবে?
টেবিল-লাইটের সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে উঠে পড়লেন উনি মশারির ব্যূহ পেরিয়ে। সরবিট্রেট খেলেন একটা। জল খেলেন ঢকঢকিয়ে। তারপর পা টেনে টেনে জানলার পাশে এসে দাঁড়ালেন।
গভীর রাতের পথটা আলোতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ট্রামলাইন চকচক করছে। বন্ধ দোকানগুলোর নানারঙা সাইনবোর্ডের ওপরে চকচক করছে আলো। একটি কালো পাগল এবং একটি কালো কুকুর ল্যাম্প-পোস্টের নীচের আবর্জনা থেকে খাবার খুঁটে খাচ্ছে।
ওরাও একদিন মরবে। ওদেরও ডাক দিয়ে যাবে কেউ হাতছানি দিয়ে। বিমু আর মণিরই মতো। রণেনকেও কি ডেকেছিল কেউ? নিঝুম রাতের উথালপাতাল হাওয়াতে গা-শিরশির করছে গানুবাবুর। হঠাৎই মোড়ের মাথায় দেখা গেল আসছে ছোঁড়ারা। অথবা জানোয়ারেরা। বাঙালির কুলাঙ্গার, কলকাতার বেজন্মারা। বৃদ্ধর শব। গানুবাবুরই বয়সি হবেন। ওদের দেশি মদে বা ড্রাগে মত্ত অবস্থায় চিৎকারে আর প্রমত্ততার দুলুনিতে মৃতর মাথাটা জোরে জোরে আন্দোলিত হচ্ছে এপাশে-ওপাশে। মৃতদেহটি পড়েই-না যায় খাটিয়া থেকে। ‘বল্লো হররি বোল, বল রে শালা জোরসে বল। বল্লো হররি—হররি বোল।’
গানুবাবুর ছোটোবউমা, তিরিশ বছরের চৈতালি আচমকা গাঢ়ঘুমের মধ্যে হরিধ্বনি শুনে জেগে উঠল। হরিধ্বনি তো এ নয়, হার্টফেল করিয়ে মারার মতো জানোয়ারসুলভ হুংকার। পুলিশদের সত্যি সত্যিই উচিত এই ছেলেগুলোকে গুলি করে মারা।
বাইরে গভীর রাত।
চিৎকারটা হতেই লাগল। হতে হতে একসময় মিলিয়েও গেল কিন্তু ঘুম আর এল না চৈতালির। বারে বারেই উকিলকাকার মুখটা ভেসে উঠছিল বন্ধ চোখের সামনে, দাহ কাল সকালে। ভোরে উঠেই ওরা সবাই যাবে। আসলে রাতেই যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ওরা দু-ভাই বেশ ভালো হুইস্কি খেয়ে ফেলেছিল খবর পাওয়ার আগেই। এই অবস্থাতে মৃতর বাড়িতে যাওয়া যায় না। ওদের সম্পর্কও এমন নয় যে, নাম প্রেজেন্ট করেই চলে আসবে। উকিলকাকা এই বাড়ির একজনের মতো ছিলেন।
ভোর চারটেতেই উঠে যাবে ওরা। নিউ মার্কেটে ফুলের কথাও, খবরটা শোনামাত্রই ফোন করে বলে দিয়েছে। ফুল পৌঁছে গেছে রাতেই।
পরশুদিনও মানুষটি এসে কত মজা করে গেলেন। কে বলবে যে, বাহাত্তর বছর বয়স হয়েছে। ভীষণ প্রাণবন্ত ছিলেন মানুষটি। যেখানে থাকতেন, সেই জায়গাই হাসিতে, গল্পে, মুখর হয়ে উঠত।
চৈতালির ভয় করতে লাগল এমন চিৎকারে ঘুম ভেঙে যাওয়াতে। পাশ ফিরে শুয়ে শক্ত হাতে তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা। হঠাৎই মনে হল যে, একদিন-না-একদিন প্রত্যেক মানুষকেই মরতে হবে। এমনকী তাকেও। জন্মালেই, প্রত্যেক জীবেরই শেষ গন্তব্য মৃত্যু।
কিন্তু মৃত্যুর পর? মরে কোথায় যায় মানুষ? ঝড়ে-জলে-রোদে? পাহাড়ে, সমুদ্রে, একা একা অন্ধকারে? ভয় করে ভাবলেই! পথ চেনা নেই। কোথায় যেতে হবে? কোথাও কি যেতে হয়ই? না, সবই ফুরিয়ে যায় শরীরটা ছাই হলেই?
বড়ো ভয় করতে লাগল চৈতালির। স্বামীকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ও। জীবু হুইস্কির নেশাতে বেহুঁশ হয়ে ঘুমোচ্ছিল। তার ঘুম ভাঙল না। ভয় তাতে বেড়ে গেল আরও। চৈতালি নিজেকে বলল, আর যে মরে মরুক, ও নিজে কোনোদিনও মরবে না। চিরদিনই বাঁচবে। পারবেই না যেতে এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে; খোকনকে ছেড়ে।
অসম্ভব।
একটা বেড়াল কেঁদে উঠল দত্ত সাহেবের বাড়ির গ্যারাজের ছাদ থেকে। তারপর সেটা কাঁদতেই থাকল। আজ নিশ্চয়ই অঘটন ঘটবে কিছু। কী? কী?
জীবুর পিঠের মধ্যে মুখ গুঁজে ঘন নিথর হয়ে শুয়ে রইল চৈতালি। ওর চোখের জলে পিঠ ভিজে গেল জীবুর। তবু তার ঘুম ভাঙল না। হুইস্কি তাকে জীবন এবং মৃত্যুর হিসেবের অন্য পারে পৌঁছে দিয়েছে কয়েক ঘণ্টার জন্যে।
সাহেব কোম্পানিতে চাকরির ইন্টারভিউ যেদিন দিতে যান সেদিন তাঁর ঠিক আগে ডাক পড়েছিল যাঁর, তাঁর নামটি আজও স্পষ্ট মনে আছে গানুবাবুর। হিতেন গুহঠাকুরতা। খুবই ভয় করছিল সব ক্যাণ্ডিডেটেরই। ঝকঝকে বাদামি বার্নিশের পালিশ-করা মস্ত বার্মা সেগুনের ভারী দরজা। ব্রাসো দিয়ে চকচকে করা পেতলের নব। করকরে করে মাড় দিয়ে ইস্ত্রি-করা ধবধবে সাদা আর লাল উর্দিপরা চাপরাশি নাম ডাকছিল এক এক-জনের। সাঁতরাগাছির ওলের মতো গায়ের চামড়ার লালমুখো সাহেবরা বড়ো বড়ো বাদামি গোঁফ নিয়ে জুতো মসমসিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। ওই বন্ধ দরজার আড়ালের ঘরটার ভেতরে কী আছে? কী হচ্ছে সেখানে? তা বিন্দুমাত্রও জানা ছিল না বলেই অত ভয়। সামনের দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে নিয়ে প্রত্যেককে ঘরের ভেতরের অন্য দরজা দিয়ে বের করে দেওয়া হচ্ছিল। যাদের ডাক পড়েনি তাদের জানার উপায় ছিল না কোনোই, কী হচ্ছে ওই ঘরে? হিতেন গুহঠাকুরতা যখন ইন্টারভিউ দিতে ঘরে ঢুকেছিলেন তখন হাত নেড়েছিলেন গানুবাবু। কাঁপা কাঁপা নার্ভাস হাতটি নাড়িয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘বেস্ট অফ লাক’।
চাকরিটা বোধ হয় হয়নি হিতেন গুহঠাকুরতার। হলে, এই দীর্ঘ চাকরিজীবনে তাঁর সঙ্গে একবার অন্তত দেখা হত, যে ডিপার্টমেন্টেই চাকরি হোক-না কেন। বাকি জীবনেও কখনো দেখা হয়নি আর তাঁর সঙ্গে। না, পথে-ঘাটেও নয়।
জানলা দিয়ে মুখ ঝুঁকিয়ে দেখলেন গানুবাবু। মৃত মানুষটির মুখটি কেমন তা বোঝা গেল না। একে চোখে ভালো দেখেন না, তায় অনেকই দূর। মৃতদের মুখ অবশ্য মৃতদের মতোই দেখতে হয়। ‘মুখের আমি মুখের তুমি’র ব্যাপার নয়। জীবিত মানুষদের মুখের সঙ্গে মৃত মানুষের মুখের তুলনা চলে না কোনোমতেই।
শবের মাথাটা এখনও নড়ছে। নড়েই চলেছে। হাত তুললেন গানুবাবু। জানালার গরাদের মধ্যে দিয়ে কাঁপা কাঁপা হাত। আজ থেকে ষাট বছর আগে লালমুখো সাহেবদের অফিসের মধ্যে একজন নার্ভাস যুবক যেমন করে হাত তুলেছিলেন, অন্য একজন নার্ভাস যুবককে শুভেচ্ছা জানাতে; ঠিক তেমনই করে। হাত নাড়লেন আস্তে আস্তে, অচেনা অজানা মানুষটিকে, যাঁর মন বা আত্মা চলেছে কোনো অনির্দিষ্ট অজানা গন্তব্যের দিকে, আর ঠাণ্ডা শক্ত হয়ে-যাওয়া শরীরটি চলেছে নিমতলা ঘাটে। এবার অস্ফুটে বলল গানুবাবু; ‘বেস্ট অফ লাক।’ যেন মাইক্রোফোনেই বললেন। নিজের দু-কানে গমগম করতে লাগল ওই তিনটি শব্দ।
আবারও বেজন্মারা চেঁচিয়ে উঠল, ‘বল্লো হররি হররি বোল…বল্লো…’
জানলা থেকে তাড়াতাড়ি সরে এলেন। বকুল গাছের গভীর অন্ধকার থেকে ছায়ামূর্তিগুলি কখন যে ফিরে আসবে কে জানে? ভয় করে। জল খেয়ে খাটে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে মশারির মধ্যে ঢুকে গিয়েই একটু নিরাপদ বোধ করলেন। শিশুকালে যেমন করতেন। অশরীরীরা যেন মশারই মতো মশার অরির কাছে পর্যুদস্ত হবেই।
শুয়ে পড়ার আগে একবার জানলার দিকে তাকাতেই চমকে দেখলেন যে, সাদা দেওয়ালে সার সার কালো কম্পমান ছায়ামূর্তিরা এসে ভিড় করেছে। হেলে-দুলে আজ যেন হাত নাড়ছে তাঁকে। হাত নাড়ছে?
হ্যাঁ। তা-ই তো! হাত নাড়ছে।
যেন, না-বলেই বলছে: ‘বেস্ট অফ লাক’ মিস্টার গানু রায়। ফেয়ারওয়েল। অ্যাড্যু: ফ্রেণ্ড।
ভয়ে গলা শুকিয়ে এল গানুবাবুর। ফ্যাকাশে হয়ে গেল শীর্ণ জরাগ্রস্ত মুখটি। বাঁধানো দাঁতের পাটি দুটি খুলে-রাখা, তোবড়ানো, বলিরেখাময় মুখটির ভেতরে মরুভূমির ঊষর জ্বালা নেমে এল। দূর থেকে আবারও ভেসে এল সেই বেজন্মাদের গলার স্বর—‘বল্লো হররি, হররি বোল।’
ভয় করতে লাগল। মশারির মধ্যে জুজুবুড়ির ভয়ে ভীত শিশুর মতোই জড়সড়ো হয়ে বসে রইলেন উনি। ঠিক এই মুহূর্তটিতে মণি, মণিদীপার অভাব বড়ো বেশি করে বোধ করতে লাগলেন। উনি বুঝতে পারছিলেন যে, কিছু ঘটবে আজ রাতে। অথচ সবাইকে যে ডাকবেন তেমন ইচ্ছেও করছিল না।
যেতে যখন একাই হবে, তখন…
মণি চলে যাওয়ার পরদিন থেকেই ভাবতেন, কবে তিনিও মণির সঙ্গে মিলিত হবেন গিয়ে। কিন্তু যাওয়ার সময়ে, যেতে একটুও ইচ্ছে করছে না। এমনকী মণির সঙ্গে মিলিত হলেও নয়। ভয়ে একেবারেই সিঁটিয়ে গেলেন আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, ইনটেলেকচুয়াল, অবিশ্বাসী মানুষটি। বুকের কষ্টটা ক্রমশই বাড়তে লাগল।
এলে তো ফিরতে হবেই। বৃত্ত সম্পূর্ণ তো করতে হবেই। এও তো অয়নপথই একরকমের! গানুবাবুর বাবা ঠাকুরের নাম করতে করতে চলে গেছিলেন। মনে পড়ল সেকথাও। ওঁর মাথায় হাত রেখে হেসে বলেছিলেন, গানু বাবা, চলি রে। ভালো থাকিস! যেন ভারি আনন্দই হয়েছে; মহানন্দের ঘটনাই ঘটল যেন কোনো।
কিন্তু উনি যে অবিশ্বাসী! অবিশ্বাসীদের ফেরার পথে বড়োই ভয়।
সংশয়-দেওয়ালের বকুলগন্ধী ছায়ামূর্তিগুলি হেলে-দুলে তখনও হাত নেড়ে যাচ্ছিল তাঁকে।
ফেরার সময় হল। এবারে যেতে হবে।
এবারে….