নয়
৬৭/৬৮-র মাঝামাঝি সময়ের ঘটনাগুলো কী? শেখ মুজিবের ছয়-দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, রাজবন্দি শক্তি আন্দোলন, প্রগতিশীল ছাত্র-আন্দোলনের ঐক্য প্রয়াস আর নানান ধরনের রাজনৈতিক নেতাদের ঘরের ভেতরে নানান ধরনের টেবিল-বৈঠক। খবরের কাগজে হেডলাইনের ঐসব খবরের নিচে ছোটখাটো খবরও আসছিল। গ্রামের কোথায়ও কৃষকদের সংগঠন হচ্ছে, কোথায়ও চলেছে সম্মেলনের আয়োজন, কোথায়ও গ্রামের লোকদের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় হচ্ছে না— এইসব খবর আসছিল বড় বড় খবরের নিচে। খুব জোরালো নয়, কিন্তু তবু দুটি একটি করে অনবরত আসছিল। সেইসঙ্গে এ ধরনের খবরও ছিল- যেমন, হামলা হয়ে তহসিল অফিস লুঠ হয়ে গেছে। গ্রামবাসীদের হাতে ডাকাত মারা পড়েছে, লাশ পাওয়া গেছে য়ুনিয়ন কাউন্সিল মেম্বারের।
খবরগুলো আসছিল, কিন্তু এসব খবরের তাৎপর্য কী সে খোঁজ কেউ করেনি। ঐসব খবরের সংখ্যা কী হারে বাড়ছে, সে হিশেবটাও কেউ রাখেনি। যাদের চোখে পড়েছিল খবরগুলো— তারাও ভেবেছিল ওসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ইতস্তত যেমন ঘটে থাকে মাঝে মাঝে। কেউ ধরতে পারেনি তখন, যে অন্যরকম দিন আসছে, টান ধরেছে সময়ের শিরায় শিরায়।
ফেব্রুয়ারির বাতাস টাল খেয়ে দিক বদল করছে তখন। মাঝখানে ২১শে ফেব্রুয়ারি চলে গেল। মার্চের প্রথমেই প্রখর আর ধারালো হয়ে উঠল পশ্চিমের হাওয়া। আমের মুকুলের গন্ধ ভাসে এখন বাতাসে। রাস্তার ধুলো উড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষের ওপর। একেকদিন সাকিনা ছুটতে ছুটতে মাঠ পার হয়ে বারান্দার ওপর এসে দাঁড়ায় আর আড়চোখে তাকিয়ে দেখে, মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা তখনও তার দিকে তাকিয়ে দেখছে কি না। কমনরুমে উমার সঙ্গে একেকদিন মেয়েরা গলা মিলিয়ে গেয়ে ওঠে- ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে। নদীর ধার থেকে পলাশের ডাল ভেঙে এনে কারা যেন রাশ রাশ পলাশ ছড়িয়ে রেখে যায় সারাটা রাস্তা ভরে।
একদিন জাহানারার বাড়িতে গিয়ে দেখে, দেবতোষ বসে আছে। রাখী বলল, এখানেও আপনি?
কী আর করা যাবে, দেবতোষ জানায়। বলে, জায়গাটাই আসলে ছোট, দেখা না হয়ে উপায় নেই।
তবু, এখানে? হঠাৎ রাখীর কেমন যেন রোখ চেপে যায়।
না, রাতের অতিথি হতে আসিনি, ঘাবড়াবেন না- বলেই হো হো করে হেসে ওঠে দেবতোষ।
হুমায়ুন একবার এর, একবার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। দেবতোষকে ঐরকম হাসতে দেখে বলল, আপনাদের চেনাজানা অনেক দিনের মনে হচ্ছে।
রাখীর মনে হল, সে বোধহয় দেবতোষকেই খুঁজছিল। সোজাসুজি জিজ্ঞেস করল, আপনি যে লোকজন খেপিয়ে তুলছেন, যদি সাপ্রেশান আসে, ঠেকাতে পারবেন?
দেবতোষ হাসছে তখনও। যেন নিপাট ভালোমানুষটি একেবারে। বলল, ওসব কথা থাক এখন- পরে আপনার সঙ্গে আলাপ করব।
না, পরে নয়, রাখী মুখোমুখি এগিয়ে বলল, আপনি নিজেকে লুকোতে চাইলে কী হবে— আমার কানে সব খবর এসেছে। আপনি পেজেন্টদের খেপিয়ে তুলছেন। আপনার উদ্দেশ্য, তারা কনফ্রন্টেশনে যাক, একটা কিছু ঘটুক। কিন্তু পারবেন সামাল দিতে? বলুন?
দেবতোষ রাখীকে পাশ কাটাতে চাইছিল। কিন্তু যখন বুঝল যে সেটা সম্ভব নয়, তখন যেন গা-ঝাড়া দিয়ে উঠল। বলল, আপনি কি রাজনীতিগতভাবে বলছেন কথাগুলো?
হ্যাঁ, রাখী স্পষ্ট স্বরে বলল- রাজনীতিগতভাবেই বলছি।
তাহলে আমার কথা শুনুন, দেবতোষ সোজা হয়ে বসল। বলতে শুরু করল : শ্রেণীসংগ্রাম না হলে শ্রেণীচেতনা জাগে না। কিষাণদেরই আন্দোলন করতে হবে— কনফ্রন্টেশনে যেতে হবে- আবার আঘাত এলে সে আঘাত তাদেরই রুখতে হবে। তাদের লড়াই অন্যে এসে করে দিয়ে যাবে না।
তাদের শক্তি আছে কি না বিবেচনা করবেন না?
না, সেটাও তাদেরই বিবেচনা করতে হবে।
বাহ্, তাহলে আপনি এসেছেন কেন? রাখীর গলার স্বর তীব্র হয়ে ওঠে। বলে, সংগঠন গড়লেন না, বলে দিলেন, যাও আঘাত করো- এ কেমন যুক্তি?
দেবতোষ গম্ভীর হলে দারুণ কঠোর দেখতে লাগে। বলল, আপনি খামোকা চটেছেন, সংগঠন হাওয়ার ওপর দাঁড়ানো না। আন্দোলন দরকার। আন্দোলন না হলে সংগঠন হওয়া সম্ভব নয়। আমরা বিপ্লব শেখাতে আসিনি, আমরা চাই কিষাণদের সমস্যা কিষাণরাই সমাধান করুক এবং শ্রেণীগতভাবে করুক। হ্যাঁ, দরকার হলে কনফ্রন্টেশনও হবে।
রাখী চোখে চোখে তাকিয়ে শেষ মন্তব্য করে, আপনারা হয় পাগল, নইলে শয়তান।
সংশোধনবাদীরা অমনই বলবে, আমরা জানি।
দেবতোষ যেন রাখীকে বোঝাতে চাইল। বলল, সংশোধনবাদের নানান চেহারা। যেমন দেখুন গিয়ে হাসান ভাইয়ের এখনকার কাজ— তাঁরা রিভিশনিস্টদের থেকে আলাদা হয়েছেন, কিন্তু আবার তাঁরাই পেজেন্টদের ন্যায্য লড়াই ঠেকিয়ে রাখতে চাইছেন। কিন্তু পারবেন না— পারবেন না জানেন বলেই জোর করতে বলছেন। কিন্তু দেখবেন, হবে না শেষপর্যন্ত, সময় এখন আমাদের দিকে।
দেবতোষ একটু পরই চলে গেল। কিন্তু রাখীকে প্রায় অভিভূত করে রেখে গেল। রাখীর মনে হচ্ছিল, যা বলছে, দেবতোষ তার মতো সত্যিকথা আর কিছু হয় না। কিন্তু রাখীর মনে সবচাইতে বেশি যে খবরটা ধাক্কা লাগল, সেটা সেজানের ঐ গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোর খবর। রাখীর খারাপ লাগল, কষ্ট হল, কিন্তু তবু চুপচাপ থাকতে হল তাকে।
জাহানারার বাড়িতে সেদিন অনেকক্ষণ ছিল। জাহানারা অনেক কথা বলছিল। রাখীর কানে সব ঢুকছিল না। মনের ভেতরে থেকে-থেকেই সেজানের শীর্ণ মুখখানা দেখতে পাচ্ছিল সে। থেকে-থেকেই মনে হচ্ছিল- এবার আর রক্ষা নেই। এবার রক্তবমি হতে শুরু করবে— তারপর আর সেই রক্তবমি থামানো যাবে না। সেজান মরবে।
জাহানারা বারবারই বলছিল, তোর হলটা কী? এত শক্ত মেয়ে তুই আর সামান্য একটুখানি তর্ক করেই মুষড়ে পড়লি।
রাখী জবাবে কিছু না বলে চলে এল সেদিন। আসবার সময় হুমায়ুনকে বলল, দেখবেন, দেবতোষ আপনাদের ঝামেলায় ফেলবে।
এই কি তাহলে রাজনীতি? একদিন কথাটা সুমিকে জিজ্ঞেস করেছিল। সুমি তাকে বোঝাতে পারেনি। সে নিজে এখনো বুঝতে পারে না। দিনের পর দিন শুধু ক্ষয়ে যাওয়া? প্রকাণ্ড আর অসম্ভব একটা দেয়ালে শুধুই মাথা কুটে মরা? কারো কিছু করার নেই— অনিবার্য পরিণতির মতো সবার চোখের সামনে মৃত্যু এসে তার শিকার ছিনিয়ে নিয়ে যাবে একদিন। সে বুঝতে পারে না, এ কি একধরনের জেদ, নাকি নির্বুদ্ধিতা? কেমন করে পারে মানুষ জেনেশুনে এইভাবে নিঃশেষে ক্ষয়ে যেতে?
জাহানারাকে সেদিন সে কিছু বলেনি। সুমিকেও চিঠিতে কিছু লেখেনি। সেকথা কি কাউকে বলা কিংবা লেখা যায়? জানাতে পারে কি, যে একজনের মৃত্যুসংবাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে সে? কখন খবরটা পাবে, সেই আশঙ্কায় তাকে দিন গুনতে হচ্ছে।
অবশেষে খবরটা এল।
রাখীর রাগ হচ্ছিল সেই মুহূর্তে। মিন্টু সাইকেল ধরে তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। রাখী ফুঁসে উঠল যেন। বলল, আমি গিয়ে কী করব? ডাক্তার ডেকে নিয়ে যান।
মিন্টুকে বেশ উদ্বিগ্ন আর অসহায় দেখাচ্ছিল। সে বলল, এখন রাগারাগির সময় নয়— ডাক্তার সাহেবই আপনাকে যেতে বলেছেন, অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করুন। অসুস্থ হবার পর থেকেই হাসান ভাই আপনার কথা বলছেন। আপনার যাওয়া উচিত।
রাখী বুকের ভেতরে তখন কান্না আর চোখে-মুখে রাগ। সে থেকে-থেকেই বলে উঠছিল— না, আমি যাব না। আমার সামনে কেউ মরে যাবে- আমি তাই দেখব? আপনি চলে যান, আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।
মিন্টু তারপর আর দাঁড়ায়নি।
মিন্টু চলে যাবার পর রাখীও আর দাঁড়ায়নি। তাকেও বার হয়ে আসতে হয়েছে তখনই।
গিয়ে দেখে সেই আগের বিছানায় একইভাবে শুয়ে আছে লোকটা। এখন আর চেহারার আদলটুকুও ধরা যায় না। ডাক্তার বসে রয়েছেন মাথার কাছে। রাখী জানল, ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়েছে। কিন্তু দেখল সেজান ঘুমোয়নি। থেকে-থেকে তার বুকের অনেক ভেতর থেকে আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে। মাথাটা কখনো ডাইনে’ হেলাচ্ছে, কখনো বাঁয়ে। রাখী শিবনাথবাবুকে দেখল। আরো যেন কে-একজনের সঙ্গে শফিউদ্দিন ঘরের ভেতরে এসে শিবনাথবাবুকে কিছু বললেন এবং তারপরই তিনজন একসঙ্গে বেরিয়ে গেলেন। ডাক্তার নিজেই বরফ জোগাড় করে আনিয়েছেন। রাখীকে বরফ, দুধ, ওষুধ, ঘুম এইসবের কথা বলে বিদায় নিলেন। যাওয়ার আগে শেষ মন্তব্য করলেন- এখানে এ রোগী বাঁচানো যাবে না। জেলা শহরের হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন।
কথা ক’টি বলে ডাক্তার চলে গেলেন।
তারপর রাখী একা। লণ্ঠনের ম্লান লালচে আলো প্রাচীন স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে এসে পড়ে আরো ম্লান, আরো লালচে দেখাচ্ছে।
রাখী সেজানের মুখের দিকে তাকাতে পারে না। নজর রাখলেই বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যাচ্ছে— মনে হচ্ছে, এ কে তার সামনে? একবার মনে হয় মনি ভাই, একবার মনে হয় আব্বা, একবার মনে হয় চেনাজানা কেউ নয়- একেবারেই অন্য কোনো লোক। বাইরে পশ্চিমের প্রখর বাতাসের ঝাপটা বাড়িটার দরজা জানালায় থেকে-থেকে ঘা মারছে। রাখী দরজার দিকে নজর ফেরায়। দরজার একটা পাট কখনো খুলছে কখনো বন্ধ হচ্ছে। রাখী সেদিনও এমনিভাবে বসেছিল। সেদিনও কাঁদেনি রাখী সেদিন কেমন একটা জোর ছিল মনে। আজ আর সেই জোরটা পাচ্ছে না সে। কেবলি মনে হচ্ছে— এইই শেষ, ওদিকে ফেরানো মুখটা বোধহয় আর এদিকে কোনোদিন ফিরবে না।
একসময় সে আস্তে করে সেজানের ঠাণ্ডা হাতটা ধরে। দুহাতের মধ্যে নেয়। তারপর নাড়ির স্পন্দন অনুভব করতে চায়। একবার মনে হয় সাড়া পেল আবার মনে হয়, না— নেই। বুকের ভেতরে তখন কোথায় যেন প্রকাণ্ড একটা ধস নামে। তখন একটা তীব্র চিৎকার গলার কাছে এসে আটকে যায়। কিন্তু পরক্ষণে আবার দেখে সেজান মাথাটা এপাশে ফেরাচ্ছে। তখন ফের রাখী আশ্বস্ত হয়। তবু বুকের ভেতরকার কান্না দমকে উঠে আসতে থাকে। কাঁদতে পারে না, কিন্তু তবু আসে কান্নাটা। নিজের দুহাতের মধ্যে ধরে রাখা সেজানের ঠাণ্ডা হাতের ওপর গাল ছোঁয়ায়। আর মনে-মনে বলে, এইজন্যেই কি আমি অপেক্ষা করেছিলাম এতদিন, বলো? আগে ডাকতে পারলে না আমাকে?
অনেক রাতে সেজান একবার চোখ মেলেছিল- কিন্তু রাখীকে চিনতে পেরেছিল কি না বলা মুশকিল। রাখী তার মুখে চামচে করে বরফ-দুধ তুলে দিয়েছে। আর ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করেছে, কষ্ট হচ্ছে তোমার? আমাকে চিনতে পারছ- আমি রাখী।
সেজান ঢোক গিলে আবার চোখ বুজেছে।
প্রায় শেষরাতের দিকে স্যালাইন নিয়ে এল মিন্টু। ডাক্তার এসে ধমনিতে নিড্ল ঢুকিয়ে নল বোতল ঠিকমতো ঝুলিয়ে দিয়ে বিদায় হলেন আবার। এবারও বলে গেলেন— স্যালাইনই সব নয়, যে-কোনো মুহূর্তে রক্তের দরকার হতে পারে। এখানে রক্ত কোথায় পাবেন? আপনাদের এখনও বলছি, এক্ষুনি রোগীকে জেলা সদরের হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন।
সকাল হয়ে যাবার পরও রাখী নড়ল না। টুলের ওপর ঐ একইভাবে বসে রইল। ভোররাতের দিকে সে রোগীর বিছানায় কিছুক্ষণ মাথা পেতে দিয়েছিল। মিন্টু একবার জানতে চেয়েছিল, আপনি কি বাসায় যাবেন?
কলেজের কথা মনে পড়েছিল একবার- সেইসঙ্গে গোটা অতীতটাই ছায়া ফেলে গিয়েছিল মনের ভেতরে। তবু রাখীর তখন ঐ একটাই জবাব— না। কোথাও যাবে না সে।
বিকেলবেলার দিকে সেজানের ওষুধের ঘোরটা কাটল। যখন জ্ঞান ফিরল তখন রাখী কাছে নেই। তাকে বাইরে যেতে হয়েছিল। আনোয়ার ছিল কাছে। রাখী এসে দেখে, সেজান কথা বলছে। কষ্ট হচ্ছে, যন্ত্রণায় মুখ কুঁকড়ে যাচ্ছে- তবু কথা বলছে। রাখী আনোয়ারকে সরিয়ে দিয়ে ঝুঁকে পড়ল। বলল, কথা বোলো না, চুপ করে থাকো।
আর ঐসময় সেজান হাত তুলে রাখীর হাতটা ধরল। তারপর হাতটা ধরে রেখেই আবার চোখ বুজল। রাখীকে কিছু বলল না।
রাখী ঐ বিকেলবেলাতেই লক্ষ করল, কিছু একটা ঘটেছে বাইরে। লোকজনের আনাগোনা হচ্ছে-শিবনাথ শফিউদ্দিনকে চিন্তিতমুখে ঘোরাফেরা করতে দেখল। হায়দার আর মিন্টুকে খুব ব্যস্ত মনে হল। রাখী আনোয়ারকে জিজ্ঞেস করেও কোনো জবাব পেল না। আনোয়ার জানাল, আমিও কিছু জানি না। তবে কোথাও কিছু একটা নিশ্চয়ই ঘটেছে।
ইতিমধ্যে ডাক্তার এসে দেখে গেলেন দুবার। দুবারই রাখী ডাক্তারের মুখে স্বস্তির ভাব লক্ষ করল। দুবারই যাবার সময় মন্তব্য করলেন— না, এখনো বড় বিপদ কিছু হয়নি।
সন্ধ্যার দিকে মিন্টু রাখীকে বাইরে ডাকল। ঐসময় হুমায়ুনকেও দেখল রাখী। হুমায়ুন শিবনাথের সঙ্গে আলাপ করছে। মিন্টু বেশ উত্তেজিত। একটু একটু হাঁফাচ্ছে। বলল, আপা, আপনার কাছ থেকে আমাদের এখন সবচাইতে বড় সাহায্যটা প্রয়োজন। বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গিয়েছে— তিনটে হাটে একসঙ্গে গোলমাল হয়েছে। আমাদের ওপর হামলা আসছে— আজ হোক কাল হোক, আমাদের সবার নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়ে যাবে। এদিকে হাসান ভাইয়ের কী অবস্থা, দেখতেই পাচ্ছেন। আমরা কোনোভাবেই ওঁর অ্যারেস্ট চাই না। হাসান ভাই ধরা পড়ে গেলে- সব আমাদের যাবে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম হাসান ভাইকে ঢাকায় পাঠাব। এবং সঙ্গে আপনি যাবেন। ডাক্তার সাহেবও অবশ্যি যাবেন। কিন্তু আপনাকে যেতেই হবে। কিন্তু আমি কি-
না আপত্তি নয়, রাখী আপত্তি করতে যায়নি। বলতে গিয়েছিল সে সম্ভবত পারবে না। কিন্তু মিন্টু শুনতে চাইল না। বলল, সময় খুব কম। খবর পেয়েছি, সকালের দিকেই পুলিশের লোক এসে যাবে। এখন আপনি ছাড়া আর কেউ নেই, অন্য কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। দোহাই আপনার, না বলবেন না।
উত্তেজনা, অস্থিরতা, ব্যস্ততা— যেন টলমল করছে সবাই। রাখী মিন্টুর মুখের দিকে তাকিয়েছিল। এবং ঐরকম তাকিয়ে থাকতে থাকতেই নিজেকে বলতে শুনল, আমি যাব।
সুতরাং আবার ঢাকা। রাখীর জিনিসপত্র গুছিয়ে স্যুটকেসে ভরে এনে দিয়েছে আনোয়ার আর হায়দার। প্রিন্সিপ্যালকেও জানিয়ে এসেছে ঐসঙ্গে। গাড়ি জোগাড়ের কৃতিত্বটা হুমায়ুনের, একেবারে ড্রাইভারসুদ্ধ। সেজানকে ধরাধরি করে গাড়িতে হেলান দিয়ে বসানো হল। শিবনাথবাবু জানালেন, আমরা সাদেক সাহেবকে টেলিগ্রাম করে দিচ্ছি। আপনারা পৌঁছতে পৌঁছতে ওদিকে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনারা সোজা গিয়ে হাসপাতালের গেটের কাছে অপেক্ষা করবেন। সাদেক সাহেবের হাতে পৌঁছে দিলেই আপনাদের দায়িত্ব শেষ।
আরো কী কী সব বলেছিল শিবনাথবাবু, রাখীর কানে যায়নি। সে বুঝতে পারছিল না, অত সব কথা কাকে বলা হচ্ছে, ডাক্তার সাহেবকে না তাকে। ডাক্তার সাহেব থেকে-থেকে তখনও বিরক্তি প্রকাশ করছেন। বলছেন, এ কীরকম অত্যাচার বলুন তো- আমি বুড়োমানুষ, আমি কি পারব এই রোগী নিয়ে ঢাকা পর্যন্ত যেতে। এদিকে আমার দুটো রোগী আনকেয়ার্ড থাকবে। আপনাদের সবকিছুতেই অব্যবস্থা। এভাবে আপনারা রাজনীতি করবেন, হুঁ!
রাখী ভদ্রলোকের কথা কিছু শুনছিল, কিছু শুনছিল না। অস্পষ্ট চিন্তা হচ্ছিল, সেজানকে পৌঁছে দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ— কিন্তু পৌঁছেই যদি দিতে না পারে? সেজানের মুখের দিকে তাকালে সমস্ত সাহস উবে যায়। ভয় জেঁকে বসে মনের ওপর। বিশ্বাস হয় না ঢাকা পর্যন্ত সে যেতে পারবে।
হুমায়ুন তখন ড্রাইভারকে উপদেশ দিচ্ছে। উর্দুভাষী ড্রাইভারের ভারী গলা কানে এল, জি হ্যাঁ, হ্যাঁ, জরুর, কভি নেহি। ওদিকে শেষরাতের ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে, কাঁঠালগাছের ফাঁকে কৃষ্ণপক্ষের ভাঙা চাঁদ। মাঝ আকাশে অন্ধকার ফিকে হয়ে এসেছে।
কোথায় যাস রাখী?
তার মনের ভেতরে কেউ বোধহয় শুধায়। রাখী শোনেও, কিন্তু মনোযোগ দিতে পারে না। কেননা সে-ভাবনা এখন সে আর ভাবছে না। পেছনে তাকাবার মতো অবস্থা নয় এখন তার। হিশেব করারও নয়। সে একেকবারে সেজানের ঠাণ্ডা হাত ধরছে নিজের দুহাতের মধ্যে, একেকবার কপালের ওপর থেকে চুল সরিয়ে দিচ্ছে, কখনো আবার তাকিয়ে দেখছে বোজা চোখের দিকে। তারপর আবার সামনের দিকে তাকাচ্ছে। জানালার কাছে কুযাশা, তবু অনুমান হয়— বাইরে এখন আলো ফুটবার সময়। সৈয়দপুর পার হয়ে এলে রোদ দেখা গেল। ঐসময় সেজান নড়াচড়া করে উঠল। চোখ মেলে মাথা ঘুরিয়ে ডাইনে বাঁয়ে তাকাল। রাখীর হাত ধরে জানতে চাইল, আমরা কোথায় যাচ্ছি? রাখী সেকথার জবাব না দিয়ে শুধাল, কষ্ট হচ্ছে তোমার?
সেজান মাথা নাড়ায়, না।
কিন্তু রাখী বুঝতে পারে, তার কষ্ট হচ্ছে। সে হাতের ওপর হাত বুলিয়ে দেয়। আপাতত কিছু করার নেই। ডাক্তার সাহেব বললেন, ওঁকে কথা বলাবেন না, ঘুমোতে দিন।
বড় দীর্ঘ পথ। রাখীর মনে হচ্ছিল, পথটা বোধহয় আর ফুরোবে না। বগুড়া ছাড়ল যখন, তখন বেশ বেলা হয়েছে। সকালের দিকে আকাশে মেঘ ছিল— এখন বেশ রোদ। রোদের তাপও বাড়ছে। ডাক্তার সাহেব ঘন ঘন পেছনে তাকাচ্ছিলেন। সেজান ঐসময় থেকে-থেকেই মাথা এপাশ ওপাশ করছিল, চেপে রাখতে চাইলেও দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে ক্ষীণ আর্তনাদও বার হয়ে আসছিল। ডাক্তার পানি দিতে বললেন মুখে। রাখী পানি মুখের কাছে ধরলে সেজান হাত দিয়ে সরিয়ে দিল। এবং তখনই শরীরটা মুচড়ে জানালার কাছে মুখ নিয়ে বমি করল। ড্রাইভার অবস্থা দেখে ততক্ষণে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে। ডাক্তারের কপালে দুশ্চিন্তার রেখা। রাখীকে বললেন, গাড়ি ফিরিয়ে বগুড়া গেলে হয় না?
আপনি কী বলেন? রাখী পাল্টা জিজ্ঞেস করে। বলে, যাবেন ফিরে?
অবস্থাটা কিন্তু বেশ রিস্কি, রাখীর কথার জবাব না দিয়ে চিন্তিত হয়ে ডাক্তার অস্ফুট মন্তব্য করে।
একেকবার মনে হচ্ছিল ফিরে যায়। কিন্তু পরক্ষণে মনে হচ্ছিল, রিস্কি অবস্থা কোন্টা নয়? তাছাড়াও তার মনে হচ্ছিল, ফিরে যাওয়া মানেই হাল ছেড়ে দেওয়া— আবার পিছিয়ে থাকা। নিজেকে সে ঐ মুহূর্তে ভয়ানক শান্ত অনুভব করল। সামনে দীর্ঘ পথটাকে দেখল। লোকজন মাঠে কাজ করছে, রাস্তার ধারে গরু চরছে, দূরে দূরে ফসলের ক্ষেত। সেজানের মুখের দিকে তাকিয়ে সে যেন গোটা সংসারটাকে মেলাল। তারপরই বলল, না, ফিরে যাওয়ার মানে হয় না, অর্ধেক পথ তো পার হয়ে এসেছি।
হ্যাঁ, যুক্তিহীন, কোনো মানে হয় না ঝুঁকি নেয়ার। আর ফিরে যাওয়া মানে পিছিয়ে যাওয়াও ছিল না। তবু ঐ মুহূর্তে রাখী যেন নতুন করে জেগে উঠেছিল। অসুস্থ সেজানের প্রথমবার শুশ্রূষা করার সময় যেমন হয়েছিল। ঐদিনের মতোই, সেজানের মুখের দিকে তাকিয়ে সে যেন মৃত্যুকে মুখোমুখি দেখতে চাইছিল। মৃত্যুকে দেখতে চাইছিল বটে, কিন্তু সেজানকে সে আবার নিজের বুকের ওপর ধরেও রেখেছিল।
হাসপাতালের গেটের কাছে সাদেক সাহেব ছিলেন না। রাখী এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল বারবার করে- না, ভদ্রলোক নেই। অন্য কোনো লোকও তাদের গাড়ির কাছে এগিয়ে এল না যে মনে হবে ভদ্রলোক খবরটা পেয়েছেন। ডাক্তার সাহেব হাসপাতালে যেতে চাইছিলেন। রাখী বলল, একটু বসুন, দেখি কী করা যায়।
ডাক্তার সাহেব বিড়বিড় করে গালাগাল আরম্ভ করেছেন তখন। বলছেন, যত সব ইরেসপনসিবল কাণ্ড, দেখে নেবেন, কোনোদিন এরা কিছু করতে পারবে না। দায়িত্বহীনতারও একটা সীমা থাকা দরকার।
রাখী এনকোয়ারিতে গিয়ে সুমিতাকে ফোন করল। একটু পরই সুমিতা বেরিয়ে এল ছুটতে ছুটতে। এসে একেবারে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলল, এসেছিস মুখপুড়ি- বল্ কেমন ছিলি? রাখী সুমিতার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারছিল না। কান্না ঠেলে আসছিল বুকের ভেতর থেকে। শেষে খুলে বলল সব কথা। সুমিতা শুনে রাখীর চোখের ভেতরে তাকাল, তাহলে বল্ তুই একেবারে জোড়েই ফিরেছিস?
রাখী হাসল না। শুধু বলল, সুমি আমার বড় বিপদ।
সুমি তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে রেখে ছুটোছুটি করে কোথায় কোথায় গেল। কার কার সঙ্গে যেন কথা বলল, তারপর এসে জানাল। চল্ নিয়ে আসি- আপাতত হাসপাতালে থাক ক’দিন। পরে দেখা যাবে।
রাখী সেজানকে হাসপাতালের বেডে শুইয়ে যখন বেরুল তখন প্ৰায় সন্ধ্যা। ডাক্তার সাহেবকে প্রথম হাসতে এবং নিশ্চিত হতে দেখল সে। বললেন, খুব কাজের মেয়ে তুমি বাপু— আমার তো ভয় হচ্ছিল, গাড়ির মধ্যে না রাত কাটাতে হয়।