ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

দক্ষিণায়নের দিন – ১৯

উনিশ

জামানের পক্ষ থেকে মুরুব্বি কেউ আসবেন না।

খবরটা দিয়ে গেল জামানের এক বন্ধু। খবরটা পেল প্রথমে বুলু। রাশেদ সাহেব পরে শুনলেন। শুনতে যেয়ে শুধালেন, কেন ওর বড়ভাইরা? চাচারা কেউ আসবেন না?

না। কেউ আসছেন না।

বাড়িভর্তি লোক। পারভিনের মা এসেছেন দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। জাহিদ আর জাহাঙ্গীর বাড়ি মাতিয়ে রেখেছে। রেকর্ডপ্লেয়ার বাজছে ফুল ভল্যুমে। বুলুর আঁচলে মস্ত চাবির গোছা। পারভিন নিমন্ত্রণের কার্ড নিয়ে একবার যাচ্ছে একবার আসছে। হাসানের গাড়ি ভীষণ ব্যস্ত। এই এল, মিনিট দুই পরে আবার হুউস করে বেরিয়ে গেল। হাসান জরুরি কাজে ঠাকুরগাঁও গিয়েছে, ফিরবে বিয়ের আগের দিন রাতে। রাশেদ সাহেবের মুখেই হাসান কথাটা শুনতে পায়। বলেছিল, এত শিগগির সিদ্ধান্ত নিলেন? রাশেদ সাহেব গম্ভীর মুখে জবাব দিয়েছিলেন, হ্যাঁ হাসান, ছেলে দেখে আমার পছন্দ হয়েছে, রাখীর আপত্তি নেই, সুতরাং আর দেরি করে লাভ কী?

বেশ তো, হাসান সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে বেরিয়ে গেছে।

পারভিন এক এক করে সবাইকে খবর দিয়েছে। সবার চাইতে তার উৎসাহ বেশি। সে একাই একশো। কখনো গাড়ি নিয়ে ছুটছে জামানের বাসায়, কখনো ছুটছে দর্জির কাছে। এই দ্যাখো কসমেটিক্সের মধ্যে

শ্যাম্পু দেয়নি-দোকানগুলোও হয়েছে এমন। দেখতে-না-দেখতে পারভিন হাওয়া, তার নাগাল পায় কার সাধ্যি।

ওরই ফাঁকে ফাঁকে য়ুনিভার্সিটির অধ্যাপকদের সঙ্গে চুটিয়ে ঠাট্টা করছে। আবার রাখীর বন্ধুদের সঙ্গেও সুযোগমতো জুতসই কথা বলে কুপোকাত করে দিচ্ছে একেকজনকে।

রাখীকে বলেছিল, হয়েছে হয়েছে রাখী আপা- এখন আর অত লজ্জা করে না। জামান সাহেবকে কী খেলাটাই খেলালে, সব তো দেখলাম।

ওসব কথা শুনে নার্গিস ইংরেজিতে মন্তব্য করে, য়ু সিম টু বি নো লেস এ টেরিবল প্লেয়ার।

নার্গিসের কথার জবাব যেন মুখের ওপর তৈরি ছিল। পারভিন মুখোমুখি তাকিয়ে বলল, কেন হব না, লাভ ইট সেল্ফ ইজ এ টেরিব্‌ল গেম। একসঙ্গে তিন-চারটি প্রেমে গো স্নো পলিসি চলে না, ওয়ান হ্যাজ টু বি এ টেরিব্ল প্লেয়ার।

তার মুখে অমন কথা শুনে নার্গিস আর কথা বাড়াতে সাহস পায়নি। কে জানে বাবা, এ মেয়ে কোথায় কোন্ কথা বলে বসে।

পারভিনের মা বসবার ঘরে বসে বসে ছটফট করছেন। বুলুকে ডেকে বলছেন, কী যে করো তোমরা বাপু, কতক্ষণ ধরে বসে আছি, গাড়িটা একবার পেলাম না। কতকাল পরে ঢাকা এসেছি, দুচারজন জানাশোনা মানুষ আছে— কী বলবে, দেখা না করলে? কথা নেই বার্তা নেই, পারভিন হুট করে চলে গেল। একটু শাসন করতে পারো না? তুমি না এ বাড়ির গার্জিয়ান।

বুলু কিছু বলবার আগেই আবার নিজের থেকে বললেন, আমি বাপু ডিসিপ্লিন বুঝি, ক্যারেকটারের ঐটে হল আসল কথা। বাউণ্ডুলেপনা একদম পছন্দ হয় না আমার। অতটুকু মেয়ে আর ওর ওপরে তোমরা যত সব সিরিয়াস কাজের ভার দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে আছ? ধন্যি বাপু তোমাদের কাণ্ডজ্ঞান!

বুলুর অত কথা শোনার সময় কোথায়? ডেকোরেটারের লোক এসেছে, ওদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে বুলুকে উঠে যেতে হল।

সরে আসতে পেরে বুলু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মামানি আজকাল দারুণ কথা বলছেন, আর যা খুঁতখুঁতে স্বভাব হয়েছে তার

জাহাঙ্গীর এসে খবর দিল একসময়, বুবু, জামান ভাইয়ের এক বন্ধু এসেছেন। নাম বললেন তৌহিদ সাহেব, ফুফাজানের সঙ্গে কথা বলতে চান। বুলু তখন কাপড়অলার সঙ্গে কথা বলছে। বলল, মামানিকে খবর দে। সাহানা বেগম গম্ভীর মুখে ঢুকলেন। বললেন, রাশেদ সাহেব তো বাইরে গেছেন, আমাকে বলুন কী খবর, আমি রাখীর মামি।

তৌহিদ জানাতে এসেছে গয়না পছন্দের জন্যে কখন লোক পাঠাবেন মেয়েপক্ষ। সাহানা বেগম ব্যস্ত হয়ে পড়লেন খবর জেনে। সে কী! এরা তো আমাকে কিছুই বলেনি- এতবড় কাজটা বাকি রেখে অমন হৈচৈ করছে মিছিমিছি। মোটা শরীর নিয়ে আবার উঠলেন। দোরের কাছে গিয়ে বুলুকে ডাকলেন দুবার। সাড়া না পেয়ে আবার চেয়ারে এসে বসলেন। আর বলে চললেন যত অব্যবস্থার কথা।

একসময় খেয়াল হল, বাইরের লোকের সামনে এসব অব্যবস্থার কথা বলাটা বোধহয় উচিত হচ্ছে না, তখন চুপ করলেন। শেষে একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন, তা কী কী জিনিস দিচ্ছেন আপনারা, আগে থেকে কিছু জানিয়েছেন?

জী না, দোকানেই সেসব হবে, তবে এমনি একটা আন্দাজ আছে, ভরি পঁচিশেকের মধ্যেই সবকিছু দেওয়ার কথা ভাবছি আমরা।

মাই গুডনেস, আকাশ থেকে পড়লেন যেন সাহানা বেগম। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, অ্যাবসার্ড— মাত্র পঁচিশ ভরি!

তৌহিদ ঘাবড়ে গেল কিছুটা। তবু বোঝাতে চেষ্টা করল, দেখুন পঁচিশ ভরি তো আজকালের দিনে নেহাত কম নয়, তাছাড়া জানেনই তো–

কী যে বলেন আপনি, পঁচিশ ভরি নিয়ে কেউ বিয়ে করতে যায়? আপনারা না পারেন দেবেন না, বাট য়ু কান্ট ডু দ্যাট। ডায়মন্ড দিচ্ছেন?

জী না, তেমন কথা তো শুনিনি।

সে কী, নট ইভেন দ্যা ওয়েডিং রিং?

তৌহিদ তখন রীতিমতো ভড়কে গেছে। কথা খুঁজে পাচ্ছে না। নিজেকে তার ভয়ানক দোষী মনে হচ্ছে। এই বিরক্তি-মেজাজি ক্ষুব্ধ মহিলার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে এখন কী বলে? সাজাহান আর অজয়টা এত রাস্কেল— বেছে বেছে কিনা তাকেই পাঠাল? আর সেও এমন বুদ্ধ, রাজি হয়ে গেল। নিজের ওপর দারুণ রাগ হতে লাগল তার। মিছিমিছি কেন যে সে আসতে গেল! ভেবেছিল, বিয়েবাড়ি, তার ওপর গয়নার ব্যাপার, সুন্দরী মেয়ে-টেয়ের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হবে, বলছে যখন, যাই না— এইরকম ভেবে সে এসেছে। এসে অবধি মন্দ লাগছিল না তার। সুন্দরী মেয়ে কয়েকজনকে এদিক-ওদিকে দেখেও ছিল। মাঝখানে এই ঝগড়া। এই বিপুলা মহিলাকে সে কেমন করে সামলায়। কোনোরকমে বলতে চেষ্টা করল, দেখুন আমি তো সবকিছু জানি না, যতদূর শুনেছি, দেয়া নেয়া সম্পর্কে কোনো কথা হয়নি। জামান আমাকে পাঠাল, যেন গয়নার সেট দুটো আপনারাই পছন্দ করে দেন, সেইজন্যে আসা।

এসেছেন বেশ করেছেন, সাহানা বেগম তখনো রাগে গনগন করছেন। বললেন, য়ু শ্যূড হ্যাভ এ লিট্ল বিট অফ কমনসেন্স। ফুল ফ্রেজেড ম্যারেজ উইদাউট ইভেন দ্য ওয়েডিং রিং। দুনিয়াতে এমন ঘটনা ঘটেছে কোথাও? আপনি বলুন?

কতক্ষণ চলত কে জানে। তৌহিদ কেটে পড়বার জন্য তখন পথ খুঁজছে। কোনোরকমে বলল, কথাটা তখন আমাদের মনে হয়নি। আমি বরং একটু জেনে আসি জামানের কাছ থেকে। তৌহিদ উঠে দাঁড়ায়।

ওকী, কোথায় চললেন? সাহানা বেগম চেয়ার ছেড়ে উঠে আসেন একেবারে। বললেন, এসেছেন যখন, তখন চলুন, এখনই যাওয়া যাক। কই গাড়ি এনেছেন?

এ প্রশ্নের পর তৌহিদ বোবা, কথা বেরুচ্ছে না মুখ দিয়ে। ভাবছে, এখান থেকে একটা দৌড় লাগালে কি খুব বেশি অশোভন দেখাবে।

আর ঠিক এমনি সময় বুলু এসে দাঁড়ায়।

বুলু এসেই শুধায়, কী খবর, কোনো খবর নিয়ে এসেছেন?

তৌহিদের ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে আসে। বলে, জী—আমি এসেছিলাম গয়না পছন্দের ব্যাপারটা নিয়ে।

বুলু হাসে, বেশ তো বলুন, কিছু মুখে দিন আগে।

বুলু তোমরা কী-ঈ, অ্যাঁ? সাহানা বেগম যেন বিস্ফোরিত হলেন। বললেন, একি ছোটলোকের মেয়ের বিয়ে নাকি অ্যাঁ? নট ইভেন এ ডায়মন্ড রিং? বিয়ের ব্যাপারে কে কথা বলেছিলে?

বুলু মামানির কাণ্ড দেখে হা। কিন্তু পরক্ষণই ব্যাপারটা আন্দাজ করে মামানির হাত ধরে বলল, কে বলছে দেবে না? কথা হয়েছে আমার সঙ্গে জামানের। আপনি মিছিমিছি ভাবছেন। তৌহিদের দিকে তাকিয়ে বলল, ওঁর কাছে শুনেছেন তো, উনি সব ব্যাপার জানেন না। আজকালের ছেলেমেয়ে— বোঝেনই তো, আঙটিটা জামান নিজেই পছন্দমতো কিনবে, আর ও নিজের হাতে শাহি নজর-এর সময় রাখীর আঙুলে পরাবে। ও, সাহানা বেগম আশ্বস্ত হলেন। শুধু আশ্বস্ত নয়, খুশিও হয়ে উঠলেন। বললেন, বড় ভালো ছেলে জামান, হি মাস্ট বি এ পোয়েট, কবি না হলে এমন সুন্দর করে কেউ ভাবতে পারে না- হি নো’জ থিংস। কথাটা বলবার সময় সম্ভবত নিজের অতীতের কথা মনে পড়ে থাকবে তার। মনে-মনে নিজের জীবনের নিবিড়তর উষ্ণতাভর্তি দিনগুলোর কথা ভাবলেন। তারপর সম্ভবত বিষাদে কান্নায় ভরে গেল তার মন। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। শেষে ধীরপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাবার মুখে বলে গেলেন, বুলু, শরীরটা ভালো লাগছে না, পারলে বরং তোমরাই কেউ যেও গয়নার দোকানে।

সময় কেমন দ্রুত যায়। দেখতে-না-দেখতে ঘণ্টা পেরিয়ে যাচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা যেন সবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘুরছে। মামানির দুলাভাই আছেন ঢাকায়, তাঁদের ঠিকানাটা জোগাড় হল না এখনো। হোটেলঅলারা রাজি হচ্ছে না। বলছে, দিন পাল্টান। এদিকে হাসানও নেই। কী কী যেন কিনতে হবে? কে বলল ওদিক থেকে? পারভিন নিশ্চয়ই। গলা বসে গিয়ে কী হাল হয়েছে মেয়েটার দ্যাখো। গলার স্বর একদম চেনা যায় না। হ্যাঁ হ্যাঁ, আলাদা আলাদা কিনতে হয় না ওসব আজকাল। নিউমার্কেটে যেও, ওখানেই এক দোকানে সবকিছু প্যাকেট করা পাবে। সিঁদুর লাগে নাকি? যাহ্, সিঁদুর তো হিন্দুদের বিয়েতে দরকার হয়। আরে সিঁদুর নয়, সিন্দরেপ, সোনালি রঙের জিনিস। কিন্তু সে তো বিয়ের দিনে। তিনদিন পরের ব্যাপার। শাড়ি পাঠিয়েছে বরপক্ষ? লগনের শাড়ি কোথায়? ক’খানা শাড়ি? যারা মেয়েকে গোসল করাবে তাদের শাড়ি কে দেবে? প্রতিবেশী দুজন মহিলা জানতে চাইছেন। নার্গিস আসবে না আজ? কে একজন হঠাৎ প্রশ্ন করল।

বুলু সামাল দিতে পারছে না। একেক সময় মনে হয়, কেউ যদি এখন কাছে থাকত, নির্ভরযোগ্য কেউ, তাহলে বড় ভালো হত। মামানি আছেন, কিন্তু তাঁকে ডাকা মানে আরো বেসামাল হওয়ার ব্যবস্থা তৈরি করা। জাহিদ আর জাহাঙ্গীর কোত্থেকে যে নতুন নতুন রেকর্ড জোটাচ্ছে আর- কী গান সব! শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। মাঝে মাঝে বুলু বিরক্ত হয়ে ধমকে উঠছে। কী রান্না হচ্ছে কে জানে। কেউ খেল কি না, তাও দেখতে পাচ্ছে না বুলু। বাড়িভর্তি লোক, সবাই আত্মীয়, কেউ কাছের, কেউ দূরের। কিন্তু বুলুর সঙ্গে কারো তেমন জানাশোনা নেই। ক্যাটক্যাট করে কথা বলে উঠছেন একেকজন মহিলা। বুলুকে তাঁদের এড়িয়ে এড়িয়ে চলতে হচ্ছে।

একসময় পারভিন কোত্থেকে এসে হাত ধরে টানল, এসো তুমি।

কোথায়? বুলু অবাক হয়।

খাবে এসো।

খাব মানে, এক্ষুনি?

তিনটে বাজে, কাল খাওনি, আর কখন খাবে? বুলু তবু ঘুরে দাঁড়ায়, একটু দাঁড়া, হোটেলঅলাদের খবরটা শুনে আসি।

সে হবে, খবর নেওয়ার অনেক লোক আছে, এখন চলো তুমি। পারভিন রীতিমতো জোর খাটায়।

আব্বা খেয়েছেন?

হ্যাঁ।

রাখী?

হ্যাঁ বাপু খেয়েছে সবাই, তুমি এখন চলো তো! বিয়ের এখনো কত দেরি, আজ মোটে গায়ে-হলুদ, তাতেই নাওয়া-খাওয়া ভুলে বসে আছ। বুলুকে টেবিলে বসিয়ে দরজা বন্ধ করল পারভিন।

পারভিনকে দেখছে তখন বুলু! চুলের গোছা লেপ্টে আছে ঘামে ভেজা গালের ওপর। সারামুখে ব্যস্ততার ছাপ, আঁটসাঁট কাপড়, আঁচল কোমরে জড়ানো— বেশ লাগছে পারভিনকে।

ও যে এতটা পারবে বুলু কখনো ভাবেনি। আব্বা, রাখী, মামানি, জাহিদ, জাহাঙ্গীর সবার খোঁজ রেখেছে মেয়েটা অথচ সে নিজে সবকিছু ভুলে বসেছিল। নিজের কাছেই কেমন লজ্জা পায় বুলু।

হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, রাখী কোথায় রে?

কেন, ঘরে। কখন বরের বাড়ি থেকে হলুদ আসবে তার জন্যে বসে আছে। রাখী আপাটা যা ব্রাশ করছে না বুবু, যদি দেখতে।

ভারি ফাজিল হয়েছিস পারভিন, বুলু রাগ দেখায় একটুখানি।

হলুদ এল একটু পরই। হলুদ এল তো বিবাহিত মহিলারা সব উধাও। দ্যাখো কাণ্ড, কোন্ ফাঁকে আবার সটকে পড়েছেন। ডাকো তাঁদের, ডাকো সবাইকে। পারভিন ছুটল আবার। একটু পরই ফিরে কানে কানে বলল, বুবু একটা কাণ্ড হয়েছে।

কী, কী কাণ্ড? বুলু উদ্বিগ্ন হয়।

উঠোনের পাশে পানিভর্তি কলসি রাখা ছিল, জাহাঙ্গীর আর জাহিদ বাঁদর দুটো ভেঙে ফেলেছে, কলসি ভাঙা নাকি খারাপ, দুই বুড়ি বলাবলি করছে, ওতে নাকি অমঙ্গল হবে?

যাহ্, বাজে কথা, কে বলল তোকে?

বুলু বলল বটে, কিন্তু তার অস্পষ্ট চিন্তাও হল। তার বিয়ে খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে হয়েছিল, এত হৈচৈ হয়নি, মানুষজনও এত আসেনি- এসব খুঁটিনাটি ব্যাপার সম্বন্ধে তার ধারণাই নেই। কার কাছে জিজ্ঞেস করে এখন? গায়ে হলুদ তাহলে কি আজ বন্ধ থাকবে?

বুলু আব্বাকে খুঁজল, আব্বা কোথায়, আব্বাকে ডাকো।

রাশেদ সাহেব তখন সদ্য বাইরে থেকে ফিরেছেন। ঘরের দরজা বন্ধ করে বুলু শোনাল ঘটনাটা! শুনে রাশেদ সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, যতসব কুসংস্কার–আচ্ছা পাগল তোরা—এ যুগেও ঐসব কুসংস্কার মানিস!

বুলু লজ্জা পেল। কিন্তু সেইসঙ্গে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ওদিকে কয়েকজন বুড়ো মহিলা গান জুড়ে দিয়েছেন। একটা ঢোলক জুটিয়েছেন কোত্থেকে। মিহি সুরে গীত ধরেছেন দুজন— এঁরাই বোধহয় মুর্শিদাবাদের আত্মীয়, রাখী অনুমান করে। তারপর গান শুনতে শুনতে দাঁড়িয়ে পড়ে। কেমন বিয়ে-বিয়ে লাগছে চারদিকে। খুশি উত্তেজনা, আনন্দ। কিন্তু তার নিচে?

বুলু অস্পষ্ট কেঁপে উঠল। কেন জানে না, মনে হল, এই হাসিখুশি উৎসবের নিচে কোথায় যেন একটা কান্না কাঁপছে। কোথায় যেন বুলু ধরতে পারে না। শুধু তার মনে হয়। মনে হয় এত যে হৈচৈ আনন্দ- সব আসলে ম্লান বিষণ্ণ আর সাজানো। এখন না হোক, আজকাল না হোক, কিন্তু একদিন অনিবার্যভাবে একটা কান্নার জোয়ার আসছে।

অস্পষ্ট ভাবনাটা কিন্তু ঐ ক্ষণিকের জন্যই শুধু। তারপর বুলুকে আবার কাজের প্রবল স্রোতের মধ্যে গা ভাসাতে হয়।

রাখীকে গোসল করানো হচ্ছে। জলচৌকির ওপর দাঁড়িয়েছে রাখী। মাথায় কাপড়— তেল আর হলুদে যেন সোনার মতন দেখাচ্ছে গায়ের রঙ। বালতি উপুড় করে কে একজন পানি ঢেলে দিল রাখীর মাথায়। হুটোপুটি লেগে গেছে তাকে ঘিরে। সবাই কেমন জটলার ভেতর হুমড়ি খেয়ে পড়তে চাইছে। একপাশে গা বাঁচিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখছিল নার্গিস, একটি কিশোরী মেয়ে কোত্থেকে ছুটতে ছুটতে এসে একমুঠো গুঁড়ো রঙ ছড়িয়ে দিল ওর মাথায়। তারপরই দে ছুট।

এহ্ হে, দ্যাখো তো কী করল স্টুপিড কোথাকার। নার্গিস গালাগাল করেও কোনো পাত্তা পায় না। ওদিকে পারভিনকে দ্যাখো রঙে পানিতে একাকার। মনে হচ্ছে গায়ে হলুদের গোসল ওকেই করানো হয়েছে— গা মাথা ভিজে জবজবে। ও মেয়ে নির্ঘাত অসুখ বাধাবে, কে যেন বলে।

শেষপর্যন্ত হোটেলের ব্যবস্থা করা গেল না। পরের দিনেই শামিয়ানা বাঁধার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। দেখতে দেখতে গেট হল, লাল নীল বাল্বের মালা ঝুলিয়ে দেওয়া হল চারদিকে। ঠেলাগাড়ি বোঝাই হয়ে এল বাসন-কোসন হাঁড়ি-ডেকচি। বাড়ির ভেতরে ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি শোনা যেতে লাগল। যতই কাজগুলো একসঙ্গে জড়ো হয়ে এল, ততই যেন রাশেদ সাহেব দূরে দূরে সরতে লাগলেন।

রাত যেন না হয়। বিকেল নাগাদ পৌঁছবার কথা, কিন্তু বরযাত্রী পৌঁছতে পৌছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বুলু দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। জাহিদ আর জাহাঙ্গীর একপাল ছেলেমেয়ে জুটিয়ে এনে গেট ধরেছে। দর হাঁকছে, দুহাজার টাকা— এক পয়সা কম নয়। পারভিন প্রাণ খুলে ঠাট্টা করে যাচ্ছে ওর অধ্যাপকদের সঙ্গে।

জামানকে দেখল বুলু, একেবারে খাঁটি বরের পোশাক। শার্কস্কিনের শেরওয়ানি, পায়ে শাদা নাগরাই, শেহরা ঝুলিয়েছে আবার মুখের ওপর। পুরো বরের পোশাক দেখে বুলু খুশি হল। এমনই চাইছিল সে, যেন এতটুকু অসম্পূর্ণতা না থাকে কোথাও। আব্বা কোথায়? হঠাৎ আব্বার কথা মনে হল রাখীর। ডাইনে বাঁয়ে তাকিয়ে দেখল। আব্বার কলিগ মনসুর চাচা তদারক করছেন ঘুরে ঘুরে, হাসান বরের সঙ্গী দুই বন্ধুর সঙ্গে কোন্ কথায় যেন হা হা করে হেসে উঠল। তারপর জাহাঙ্গীরকে ডেকে কী একটা কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে হৈ হৈ রবে বাচ্চারা সরে পড়ল, গেট ছেড়ে দিল ছেলেমেয়েরা।

ঘরের ভেতরে দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। চারদিকের দেয়াল, মাথার উপরকার সিলিং কী ভীষণ শাদা। রঙিন কাগজ কেটে ফুল বানিয়েছে জাহিদ আর জাহাঙ্গীর। ফ্যানের বাতাসে কাগজের ফুল পাখির মতো ডানা ঝাপটাচ্ছে। আর কত সব মানুষ। পাশের বাড়ির ময়নার মা দাঁড়িয়ে উত্তেজিত গলায় কী যেন বলছে, মাথার কাপড় খসে গেছে, হাত নাড়াচ্ছে ভীষণ। মীরপুর থেকে মায়ের দিকের অবাঙালি আত্মীয়রা এসেছেন। সবাই বারান্দা ঘিরে রেখেছে। সবকিছু কেমন অস্পষ্ট লাগছে_ থেকে- থেকে। স্মৃতি দোল খাচ্ছে কোথায় যেন। রাখী একেক সময় নিজেকে চিনতে পারে না। কেন এমন হয় কে জানে। একজন বয়স্ক মহিলা, তার মুখের ওপর ঝুঁকে ছিলেন। চোখাচোখি হতেই রাখী শুনল, কি গো নাতিন, দুলহার কথা ভেবে ডর করছে নাকি? করলে বলো, আমি বসে পড়ি তোমার জায়গায়। কে মহিলা, রাখী ঠিক ধরতে পারে না, মাালদা’র কোনো লোক কি আমাদের আত্মীয়? বুবুকে জিজ্ঞেস করলে জানা যেত। মহিলার ঠাট্টাটা অশ্লীল লাগে।

দোলার বিবিকে শরবত খাওয়ানো হয়নি এখনো, কী কাণ্ড, কী কাণ্ড— মামানির গলা না? রাখী আর শুনতে পেল না কার বাচ্চা চিৎকার করে কেঁদে উঠল মাঝখানে। উঠুন, এবার উঠুন সবাই, মেয়েকে আমরা এবার সাজাব। কে? ও পারভিন। মেয়ের ডাঁট দ্যাখো, প্রায় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিতে লাগল ঘরের ভেতরকার মেয়েদের। চিৎকার করে বলতে লাগল, না কেউ নয়, শুধু দুজন থাকব আমরা- আপনারা যান।

হ্যাঁ, কী সাজ যে সাজাবে তা জানা আছে? কে একজন নিচুগলায় কথা বলল, তোমরা ক’খান বিয়ে দেখেছ শুনি? কার গলা? ওদিকে কে চিৎকার করছে? রাখী জানে না। তাকে সাজানো হবে তাই নিয়ে এত কথা। কই কাপড় গয়না কোথায? আরেক জনের গলা শুনতে পায় রাখী।

আমরা গয়না দেখব আপা, শুধু গয়না।

পরে, পরে হবে সেসব। মেয়েকে সাজানো হবে, তখন দেখবেন। পাখাটা আরেকটু জোরে চলে না? ভীষণ ঘামছে সেই কখন থেকে। এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দিতে পারত কেউ। রাখী ডাইনে বাঁয়ে তাকায়। কাছাকাছি কাউকে দেখছে না। ঘরের দরজাটা বন্ধ হল। ও মা, আমরা যে আবার তিনজন হয়ে গেলাম। তিনজন হলে তো চলবে না, তিনজন তো বেজোড়া— আরেকজনকে ডাকতে গেল পারভিন। পারভিন এক গ্লাস পানি দিতে পারবি, এই পারভিন? নার্গিস এল কাছে, কি রে খুব নার্ভাস লাগছে? হাসতে ইচ্ছে করে না, তবু হাসল রাখী। নার্গিসকে ভীষণ গম্ভীর দেখাচ্ছে। রাখীর জানতে ইচ্ছে করল আর কে কে এসেছে। আর সব বন্ধুরা আসেনি কেউ? নাসিমা, টুটু, মোটামতো সেই যে রহিমা। কী আশ্চর্য, কেউ এল না?

কে জানে এসেছে কি না সবাই, যাদের যাদের বলেছিল। ঘরের ভেতরে বসে থেকে কেমন করে জানা যাবে?

রাখী ভাবতে পারছে না কিছু, মাত্র ক’দিনের ব্যাপার, ক’দিন কেন, এখন তো মাত্র একদিন, শুধু আজকের এই দিনটা— তারপর সব বদলে যাবে। মানুষজন, বাড়িঘর, কথাবার্তা সব বদলাবে। না, কান্না পায় না কথাটা ভাবলে। বিয়ে হলে তা-ই তো হয়ে যায়। এ বাড়িতে যখন প্রথম এল তারা, এখনো স্পষ্ট মনে আছে, হ্যাঁ, এই ঘরটাই— স্পষ্ট মনে আছে সব। মনি ভাই প্রথম খাট পেতেছিল। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে জেগে বই পড়ত। তখন মাঝরাতে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় ডাকত যেন কারা।

কে ডাকত, কে? মনের ভেতরে চমকে উঠল রাখী। সেজান ডাক দিত অমন করে। পাশের ঘরে শুয়ে শুয়ে রাখীর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল— সেই ছেলেবেলায়, কী ভয় তখন রাখীর। সেজান কি এসেছে? কে জানে। আসবে নিশ্চয়ই, আব্বা নিশ্চয়ই আসতে বলেছেন। এবার কী করবে রাখী? আই. এ. পাস তো হল! মনে পড়ে রাখীর।

এলোমেলো ভাবছে সে।

রাখী আপা দ্যাখো, শাড়ি দ্যাখো। কীরকম হাড়কেপ্পন মানুষকে বিয়ে করতে যাচ্ছ, দেখে রাখো। হ্যাঁ, গয়না দিয়েছেন বটে ফুফাজান – মানুষ দেখলে হাঁ হয়ে যাবে- আজকাল এত গয়না কোনো বিয়েতে দিতে দেখা যায় না। আচ্ছা হীরের নাকফুলটা পরাই কেমন করে। ও রাখী আপা, তোমার নাক ফোঁড়া হয়েছিল? ছ্যাঁদাটা আছে না বুজে গেছে। এটা কী, ওমা এরই নাম বুঝি হেয়ার-পিন! আজকাল কি পরে কেউ?

কেমন অস্পষ্ট অসংলগ্ন সব কথা!

জানালার পাটদুটো খুলে দেয় না কেউ! বাইরে কেমন সম্মিলিত টানা কোলাহল-একসঙ্গে সবাই কথা বলছে। বাইরে না ঘরের ভেতরে? রাখী কান পাতে। না, বাইরের কোনো শব্দ তার কানে আসে না।

তারপর? ক্রমশ কেমন তীব্র আর প্রখর স্রোতের মধ্যে পড়ে গেল রাখী। কোলাহল চিৎকার আর সিনেমার ছবির মতো দ্রুত ব্যস্ততা। কিছু অনুভব করতে পারে না আর কারা কারা যেন আসছে আবার দ্রুত চলে যাচ্ছে। কার নাম ধরে কে যেন বলছে অমুকের পুত্র অমুক পঞ্চাশ হাজার টাকা, নগদ আদায়, রাজি আছেন? রাখী, বলো হ্যাঁ- রাজি আছি। রাখী আপা বলো। রাখীর বুকের মধ্যে দম আটকে আসতে চাইছে যেন— এত লোক কেন এ ঘরে? আব্বা কোথায়? আব্বা নেই কেন? রাখী, ঈ-ঈ— অনেক দূরে কেউ যেন ডাকছে। কে যেন থুতনি ধরে মুখটা নেড়ে দিতে চাইল।

অনেকক্ষণ পর রাখীর মনে হল, তার পাশে আরেকজন কে বসে আছে। কে, কে এখানে এভাবে বসে?

প্রশ্নটা মনে এল আর চমকে দিয়ে গেল তাকে। মাথা তুলতে গেল রাখী- লাল ওড়নাটা বিচ্ছিরিভাবে চোখের সামনেটা ঢেকে রেখেছে। মাথা তোলা আর হল না। জামান পাশে স্থির বসে। শার্কস্কিনের শেরওয়ানির হাতটা দেখা যাচ্ছে। শাদা-শাদা বোতামগুলো নিশ্চয়ই খুব দামি।

বলুন দেখি স্যার, রাখী আপার জন্যে কতদিন এ বাড়ির রাস্তায় হেঁটেছেন? কার গলা? চিনতে পারে না রাখী।

রাখী আপাকে চেনেন তো? এখন চিনতে পারবেন? ছাত্রীকে মশাই এমন পড়াটাই পড়ালেন— ইঁঃ এমন না হলে আর মাস্টার।

রাখী আপা শরবত খাও, রাখী মুখের সামনে একটা গ্লাস দেখতে পেল। কুঁচো পেস্তা আর জাফরান ভাসছে শরবতে।’ একটা চুমুক দিতেই হাঁ হাঁ করে উঠল সবাই— আর না, আর খেও না, বরকে দিতে হবে তো!

এই, শরবতটা ছাঁকা হয়েছে তো— এই ছেঁকেছ তো শরবতটা। এই পারভিন, শিগগির রাখী আপার একটা ধোয়া পেটিকোট আনো। রাখী এসব গলার স্বর একদম চিনতে পারে না।

কই আয়নাটা কোথায়? শাহি নজর হোক এবার। কারা কারা যেন কখনো একসঙ্গে আবার একের পর এক কথা বলে চলল।

আরে ওভাবে নয়, ওপর দিয়ে একটা কাপড় ফেলে দাও।

কে একজন রেগে উঠল। কে বলেছে, ও তো হিন্দুদের নিয়ম। আয়না ধরো না কেউ?

দেখুন দুলাভাই, আয়নার দিকে তাকান। রাখী আপা, এদিকে চোখ মেলে দ্যাখো। রাখী চোখ মেলে তাকাল, কিছু দেখা যায় না। কেমন অস্পষ্ট সব গোল গোল মুখ রেখা আঁকা নাক চোখ থুতনি। কেমন যেন রেখার আঁচড়ে আঁকা ছবির মতো।

তারপর কতক্ষণ পর কে জানে, একসময় রাখী দেখল সে হেঁটে যাচ্ছে, দুপাশে দুজন তাকে ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে চলেছে। একপাশে পারভিন অন্যপাশে বুবু।

ফুফাজান এদিকে, ডাকল বোধহয় পারভিন। বুবু কেমন থেমে পড়ল। পা যেন চলতে চায় না। মনে হল, অস্থির সময়টা কেমন শান্ত হয়ে যাচ্ছে। এখুনি তার শৈশব, তার কৈশোর, ইস্কুলে যাওয়ার দিন, কলেজের সেই মুখরিত সময়, বাড়ির দরজায় মাধবীলতার ঝাড়, রাতের অন্ধকার, দুপুরের শান্ত ছায়া— সব যেন একাকার হয়ে যাবে। একাকার হয়ে একটি মূর্তিতে স্থির হয়ে দাঁড়াবে। রাখী মোজাইকের রঙ দেখতে চেষ্টা করল। বুকের ভেতরে কী যেন ভীষণভাবে তোলপাড় করে উঠেছে। দুচোখ হঠাৎ ঝাপসা হয়ে এল। ঐ ঝাপসা চোখেই দেখল তার চোখের সম্মুখে পরিচিত একজোড়া পা। আর তখনই দলাদলা কান্না আটকে গেল গলার ভেতরে। আব্বা কিছু বললেন কি বললেন না, রাখী কিছুই শুনল না। মাথার ওপর আব্বার আশীর্বাদের হাত এসে পড়ল কি না তাও সে জানতে পারল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *