আট
ভুলে কি যায় মানুষ? ভুলতে চাইলেও কে পারে সব সময়? অন্যকিছু নয়- জামান নয়, আমাদের সঙ্গে প্রথম ঘনিষ্ঠ হবার শিহরিত মুহূর্তগুলো নয়, মাজহার নয়, ইভা মরিস্ত্রে তীব্র গালাগাল নয়- তার বিয়ে নয়, বিছানার মুহূর্ত নয়— সেসব কিছু নয়। সেসব তার জীবনে ঘটেছে কি না, রাখী হিশেব করার প্রয়োজন বোধ করে না কখনো।
কিন্তু ঘুরেফিরে, বারবার করে, বিষণ্ন, চাপা, রক্তের ভেতরকার বুজে-থাকা একটা বেদনা ফুটে উঠে যেন তার মনের ভেতরে ছেয়ে যায়। একেক সময়
মনে হয়, তার সমস্ত জীবনের সাধ, ইচ্ছে, ভালোবাসা সব যেন একসঙ্গে মিশে গেছে ঐসঙ্গে। ঐরকম বিষাদময়তার মধ্যেই সে মনের ভেতরে বারবার করে দেখতে পায় মনি ভাইকে। মনি ভাই অস্থির হয়ে উঠত একেক দিন। বন্ধ ঘরে চাপা আর্তনাদের মতো ওর গলা শোনা যেত, বিশ্বাস কাকে বলে? কেন বিশ্বাস করব আমি, বলতে পারো? প্রতারণাকে সত্য বলে চালাবে শুধু বিশ্বাসের জোরে?
ওর বন্ধুরা আশ্বস্ত করতে না পেরে মাথা নিচু করে বসে থাকত। মনি ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত ওদের জানা ছিল না।
না-কামানো গাল, লম্বা রুক্ষ চুল, আর বেদনাক্লান্ত দুটি চোখ— বারবার করে তার মনের ভেতরে ভেসে ওঠে।
মনি ভাই তার কিশোরকালের বিক্ষুব্ধ কান্নার মতো, আজকাল একেক সময় রাখীর মনে হয়।
মানুষের মন বড় অদ্ভুত। আগে কখনো এমন করে মনে পড়ত না। কিন্তু কে জানে কেন, এখন বারবার করে মনে পড়ে। রাজনীতি জানে না সে, বোঝে না, বুঝতে চায়নি কখনো। কিন্তু এখন অনুমান করতে পারে, মনি ভাইকে কিছু বিশ্বাস করতে বলা হয়েছিল। কোনো মানুষকে, কিংবা কোনো পদ্ধতিকে, কিংবা হয়তো কোনো আদর্শকে। কিন্তু মনি ভাই সেই বিশ্বাস মনের ভেতরে আনতে পারেনি। আর সেইজন্যেই তাকে মানুষের একদম ভেতরে চলে যেতে হয়েছিল। বিশ্বাস নামক ঐ বস্তুটিকে না-পাওয়ার জন্যেই বোধহয় শেষপর্যন্ত তাকে মরে যেতে হল।
এখন বোঝে, বিশ্বাস করা ব্যাপারটা কীরকম ভয়ানক। কাকে বিশ্বাস করব? মানুষকে? নিজেকে? সংসারকে? সে জানে না।
সেজানকে জিজ্ঞেস করলে সে হাসে। বলে, এসব আলোচনা পরে হবে। এখন নয়, আগে সুস্থ হয়ে ওঠো।
রাখী পীড়াপীড়ি করে না। জানে, তাতে কোনো লাভ নেই। সেজান সেসব কথা তার সঙ্গে আলোচনা করতে চায় না।
ঐসব পুরনো প্রসঙ্গ আলাপে আসে না। কিন্তু সেজান একেক দিন অনেক রাত পর্যন্ত রাখীর কাছে বসে থাকে। রাখী এমনিতে উঠতে বসতে পারে, কিন্তু তবু তাকে উঠতে বসতে দেয়া হয় না। ওকে উঠতে বসতে দেখলেই বুবু ছুটে আসে, আব্বা ছুটে আসেন। সেজান ঐরকম অবস্থার মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়। নানান কথা বলে যায়। কখনো ওর নিজের কথা, কখনো ওর বন্ধুদের কথা- কখনো স্রেফ গল্প। মজার মজার ঘটনা বর্ণনা করে কোনো-কোনোদিন রাখীকে হাসাতে চেষ্টা করে।
রাখী শোনে, কোথায় কোন্ মফস্বল এলাকার ইস্কুলে পণ্ডিতমশাই কীরকম শাস্তি দিতেন সেই গল্প।
তুমি কল্পনাও করতে পারবে না, পণ্ডিতমশাইয়ের কীরকম প্রতিভা। ব্যাপারটা কীরকম বোঝো-ঝাঁ ঝাঁ চৈত্রের দুপুর, ইস্কুলের মাঠে সব ক্লাসের ছেলেদের মুরগি-হাঁটুনি হাঁটাচ্ছে। মুরগি-হাঁটুনি কী জানো? সে এক অদ্ভুত জিমনাস্টিক— উবু হয়ে দুই হাঁটুর ভেতর দিয়ে গলিয়ে দুই হাতে কান ধরে হেঁটে বেড়ানো। ভয়ানক কষ্টের ব্যাপার। সারা মাঠময় ছেলেরা মুরগির মতো হেঁটে বেড়াচ্ছে আর পণ্ডিতমশাই ছড়ি হাতে একবার এদিকে ছুটছেন, একবার ওদিকে। ব্লাকবোর্ডে কে যেন একটা কুমড়ো এঁকে তার বাঁকানো বোটার জায়গায় একটুখানি ঝুঁটির মতো এঁকে রেখেছে।
মাস্টার মশাইরা ছেলেদের মধ্যে কে কী খেয়ে ইস্কুলে এসেছে সেকথা জিজ্ঞেস করতেন। কিন্তু পণ্ডিতমশাই কোনোদিন কাউকে ঐ প্রশ্ন করতেন না। জামাই একবার খেতের কুমড়ো শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়েছিল বলে জামাই বাবাজিকে খড়মপেটা করবেন বলে শাসিয়েছিলেন।
ভারি যত্ন করতেন টিকির। মাথায় চুল উঠে টাক পড়ে গিয়েছিল বলে সবসময় মাথাটা ক্লিন শেভড্ রাখতেন এবং সেইসঙ্গে বেশ মোটা একটা পুরুষ্টু টিকির গোছা ছিল তাঁর। তেল দিয়ে আঁচড়ে গিঁট বেঁধে রাখতেন। তো একদিন ঐ টিকি নিয়ে গোলমাল বেধে গেল। আমাদের এক মাড়োয়ারি বন্ধু ছিল তুলসীরাম আগরওয়ালা নামে। তার ঠাকুর্দা মারা যাওয়াতে সে বেচারাকে ন্যাড়া হতে হয়। মাথা ন্যাড়া করলেও কিন্তু ফুল ন্যাড়া তারা হতে পারে না, একটুখানি টিকি তাদের রাখতে হয়। তা তুলসী তো দাদাজি মরে গেছে বলে কয়েকদিন কাঁদাকাটা করে ইস্কুলে এসেছে। তখনও মলিন মুখ। কিন্তু পণ্ডিতমশাই টিকিসুদ্ধ ন্যাড়া মাথা দেখে একেবারে লাফিয়ে উঠলেন, কোনো কথা শুনলেন না। তক্ষুনি সেলুন থেকে কাঁচি আনিয়ে তুলসীর টিকি সাফ করে দিলেন।
কিন্তু ঐ ঘটনার ঠিক পরের দিনই পণ্ডিতমশাইয়ের টিকিটা ইস্কুল থেকে হারিয়ে গেল। সে এক হৈ-হৈ রৈ-রৈ কাণ্ড! তুলসীরামকে ধরে আনা হয়েছে তখন। তুলসী খালি বলছে, না আমি ও-কাজ করিনি। শেষে বেচারা ‘ও মেরে দাদাজি’ বলে অ্যায়সা এক চিৎকার জুড়ে দিল যে হেডমাস্টার পর্যন্ত ছুটে আসতে দিশা পেলেন না। তুলসী পরে পণ্ডিতমশাইয়ের কাটা টিকিটা আমাদের দেখিয়েছিল, সে অনেক পরের ঘটনা-
সেজানের গল্প শুনতে শুনতে রাখী সত্যি সত্যি হাসে। নিজের শৈশবে ফিরে যায়। একদিন আবার সেজান নিজের গল্প বলে। রাখী সে-গল্পও মনোযোগ দিয়ে শোনে। শোনে আর সেজানের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে।
জানো, আমার এই নামটার জন্যে আমি ভয়ানক বিব্রত থাকতাম।
কেন? রাখী অবাক হয়।
এ একটা নাম হল? গেঁয়ো লোক শহরে গিয়ে যেমন গলায় টাই বাঁধে- আমার এই নামটাও ঐরকম। কিন্তু মুশকিল এই যে, নিজে নিজে নিজের নাম বদলানো যায় না। আমি একসময় নিজের নাম নিয়েছিলাম কুতুবউদ্দিন আইবক, বিশ্বাস করবে?
কী?
রাখী হাসতে হাসতে বালিশে মুখ ডোবায়।
কিন্তু নামটা চলল না। আর চলবার কথাও নয়। ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে পড়ছি— বন্ধুবান্ধব হয়েছে— তখন কি আর নাম পাল্টানো চলে? আমার ওপর নামের এই বোঝাটি কে চাপিয়েছেন, জানো? জানো না আমি ভদ্রলোকের নামে ঠিক মানহানির মামলা করব, যদি কোনোদিন তিনি দেশে ফেরেন।
রাখী কৌতূহলী হয়।
আমার চাচা এই কাণ্ডটি করেন। ছবিটবি আঁকছেন, এখন বিদেশে স্থায়ী হয়েছেন। আর স্থায়ী হয়ে আমার স্থায়ী সর্বনাশটি করেছেন। আমার জন্ম হবার পর নাম কী হবে, এই নিয়ে লোকজন যখন মাথা ঘামাচ্ছে, তখন চাচা আমার জানালেন, ছেলের নাম সেজান হোক। দাদি বেঁচে ছিলেন তখনও। তিনি বুঝে নিলেন, মীজান, দিলজান যদি নাম হতে পারে, তাহলে সেজান হতেই বা আপত্তি কোথা? ব্যস্, ঐ নাম আমার ঘাড়ে চেপে বসল। আর আমার জননীটিও ছিলেন চৌকশ—যেমন জেদি তেমনি একরোখা। নামটা তাঁরও পছন্দ হয়েছিল বলে কারো ওজর-আপত্তি টিকল না।
নিজের গল্প বলার সময় সেজানের কথাবলার ভঙ্গি বদলে যায়। যেন হাসির ঘটনা বর্ণনা করছে, এমন মনে হয়। কিন্তু মায়ের কথা উঠে আসতে রাখী সেজানকে ধরে ফেলল। বলল, আপনার নামের মাহাত্ম্য পরে শুনব, মায়ের কথা বলুন।
সেজান চুপ করে যায় কয়েক মুহূর্তের জন্যে। কিছু হয়তো ভাবে। শেষে বলে, আমার মায়ের কথা বোলো না। একটু খ্যাপা গোছের ছিলেন আর কী। রবীন্দ্রনাথ, ছবি, গান এইসব বিষয়ে কিছু কিছু বাতিক ছিল তাঁর। তবু চাচা রক্ষা করেছেন। নইলে মা হয়তো আমার নাম রাখতেন ভীমগলশ্রী, নয়তো হিন্দোল- কানাড়া দরবারী হয়ে যাওয়াটাও আশ্চর্যের ছিল না। মায়ের এইরকম খ্যাপামির মানে ছিল না। স্বামী যদি মদ খায়, কি অন্য মেয়ের প্রেমে পড়ে— তাহলে জমিদারবাড়ির বউয়ের কী করার থাকে? বড়জোর গলায় কলসি বেঁধে পুকুরে ডুবতে পারে, নয়তো পরনের শাড়ি গলায় পেঁচিয়ে কড়িকাষ্ঠ থেকে ঝুলে পড়তে পারে। না, মা সেসবের ধার দিয়ে গেলেন না। দুই ছেলেকে নিয়ে চাকরি করাতে বেরুলেন।
রাখী বিছানার ওপর উঠে বসে। সেজানকে এত কাছ থেকে যেন আর কোনোদিন দেখেনি সে। সেজান হাসছে, কিন্তু এ যেন অন্য সেজান। একটু তাচ্ছিল্য, একটু বিদ্রূপ গলায়— কিন্তু তবু যেন অসম্ভব অন্তরঙ্গ। সেজানের গলার ভেতরকার দীর্ঘশ্বাসটুকু শোনবার জন্যে সে কান পাতে।
কিন্তু সেই দীর্ঘশ্বাস শব্দ হয়ে বেরুলে তো? সেজানের গলায় ঠাণ্ডা থাকে না, কিন্তু আবেগও আসে না। বলে, আমার মা বাবা চাচারা— ফিউডল ভ্যালুজ-এর শিকার। ধসে পড়ার আগে ভেঙে দেয়ার সাহস ছিল না বলে তারা দালান-চাপা পড়লেন।
রাখীর গলায় আব্দার ফোটে, না ওভাবে নয়, পুরোটা বলতে হবে। ডিটেল বলুন।
ডিটেল বলার মতো তো কিছু নেই তার। এ ধরনের ঘটনা তো বাংলা গল্পের বইয়ে মেলা আছে, সেজান পাশ কাটাতে চায়।
কিন্তু রাখী ছাড়ে না। বলে, বলতে দোষ কী, গল্পই তো বলছেন।
সেজানকে তখন বাকিটুকুও বলতে হয়। কিছুটা বিরক্তি লাগে বলতে, কিন্তু বলতে হয়।
স্বামী মিথ্যেবাদী জানবার পরও কি অভিমান সাজে, বলো? যদি তারপরও কোনো স্ত্রী অভিমান করে, তাহলে সে বোকা না? আমার মা ছিলেন ঐরকম বোকা মহিলা। চার বছর পর স্বামী স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে এলেন বলে কী খুশি আমার মায়ের, খুশিতে আমাদের দুভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। পরনে রঙিন শাড়ি উঠল, গায়ে গয়না দেখা গেল। আমরা সব মহাসমারোহে বাড়ি যাবার জন্যে স্টেশনে এলাম আর ঠিক ঐ স্টেশনেই দেখা হয়ে গেল দুই সতীনে— একেবারে মুখোমুখি। সে মহিলাও তাঁর স্বামীর পিছু পিছু এসেছিলেন। ঐসময় ট্রেনটা স্টেশনে ইন করছিল। আমার মায়ের বালাসুদ্ধ একখানা হাত শুধু আমি তারপর রেললাইনের মাঝখানে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম।
খুব সোজাসুজি গল্পটা শেষ করে সেজান।
আপনার আব্বা, আপনার ভাই? রাখীর কৌতূহল মিটতে চায় না। সে আরো জানতে চায়। বলে, আপনি এমন কেন? যদি নাই বলবেন তো আরম্ভ করেছিলেন কেন?
সেজানকে হাসতে হয় রাখীর আগ্রহ দেখে। বলে, আর কিছু তো নেই বলবার। বলো, এরকম গল্পের শেষে আর কী থাকবে?
আপনার আব্বা কোথায়, আপনার ভাই?
এ তো সহজেই অনুমান করতে পারো। একে মাতাল, তারপর এইরকম সব ঝড়ঝাপটা, জমিদারি চলে যাব চলে-যাব করছে। এ অবস্থায় মানুষ বাঁচে কী করে? মফস্বল শহরে ওয়ান ফাইন মর্নিং-এ দেখা গেল ভদ্রলোক আর নেই। তবে ভাইটি আছে, টাউট হয়েছে সম্ভবত- ব্যবসা-ট্যবসা করে বোধহয়।
রাখী থেকে-থেকে সেজানের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। এই লোককে কি সে চেনে? লোকটার মনে কি কোনো দুঃখ আছে? কোনো কষ্ট? কোনো বেদনাবোধ নিজের জন্যে কিংবা মা-বাবার জন্যে? রাখী ধরতে পারে না। বাইরে ওদিকে রাত বেড়ে যায়, সেজান একসময় বাইরের দিকে তাকায় জানালা দিয়ে। শিউলিফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। কাছাকাছি বোধহয় কোথাও শিউলির গাছ আছে।
রাখী ঐসময় আচমকা তাড়া দিল, যান এবার বাসায় যান। অনেক রাত হয়েছে।
তারপর থেকে রাখী আগের সেজানকে যেন খুঁজেই পায় না। একেক দিন দেখে সেজানের দুচোখের দৃষ্টিতে আশ্চর্য কোমলতা ছেয়ে আছে। একেক দিন আবার ভারি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত তাকে দেখায়। তখন কাছে ডেকে শুধায়, কী হয়েছে আপনার?
না, কিছু হয়নি তো, সেজান অবাক হবার ভান করে।
রাখী ঐ ভানটুকুও লক্ষ করে। এমনিতে ধীর-গম্ভীর শান্ত মানুষ, কিন্তু- রাখী জানে, ভেতরে সে ভয়ানক কঠিন। নিজেকে অসম্ভব শক্ত আবরণের নিচে সে লুকিয়ে রাখতে পারে।
একদিন সেজানই জানাল, রাখী এবার আমাকে বাইরে যেতে হবে। বাইরে? কোথায়?
গ্রামের দিকে।
কেন, গ্রামের দিকে কেন? রাখী বুঝেও যেন বুঝতে চায় না।
গ্রামের দিকে কাজ রয়েছে আমার।
তখন অনেক রাত। হেমন্ত-শীতের রাত। জানালার কাচ দিয়ে বাইরের কিছুই দেখা যায় না। সেজানের চোখের দিকে তাকিয়ে রাখী স্থির হয়ে যায়। বলে, আপনার কোনো কষ্ট হয় না?
মাথা নাড়ায় সেজান। না, কষ্ট কিসের জন্যে হব?
কোনো কষ্ট নেই? কোনো দুঃখ, একেবারে নিজের কোনো দুঃখ নেই আপনার?
সেজান তখনো হাসে। বলে, চারদিকে মানুষের এত কষ্ট— তার মাঝখানে আমার একার কষ্ট আর কতটুকু? ওসব চিন্তাভাবনা থাকলেও তো ঝামেলা। মিছিমিছি ঝামেলা রেখে লাভ কী বলো?
অন্য সময় হলে রাখীর মনে হত, লোকটার সবই ভণ্ডামি। তুখোড় চালাক লোক, তাই এমনি প্যাচানো কথা বলছে। কিন্তু এখন সেরকম কিছুই মনে হল না। যাবার সময় শুধু বলে গেল, রাখী এবার আমি যাই, ভালো থেকো।
বাইরে তখন নিশ্চয়ই দারুণ হিম পড়ছে। রাখীর ইচ্ছে হল জিজ্ঞেস করে- কেমন করে যাবেন, বাইরে যে ভীষণ ঠাণ্ডা। কিন্তু কিছু বলতে পারল না। তার আগেই সেজান ঘরের বাইরে চলে গেছে।
তারপর রাখীর আবার শূন্য সময়। এলানো, শিথিল, লম্বা সময়। আব্বা এসে বসেন কিছুক্ষণ, কিছুক্ষণ বুবু এসে অহেতুক মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। বুবুকে আজকাল কেমন যেন লাগে। মনে হয়, বুবু যেন নিজের মধ্যে নেই। বুবুর কিছু একটা হয়েছে বলে তার আশঙ্কা হয়।
পারভিন কিন্তু নতুন-নতুন খবর বলে। হাসান ভাই নাকি আরো বড় কাজে হাত দিচ্ছে। এখন নাকি একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স-এর প্ল্যান হচ্ছে। সেখানে মাজহার সাহেব, নাদভী সাহেব তো আছেই, কায়সার আহমদকে তো তুমি দ্যাখোনি, ভয়ানক নাক-উঁচু লোক- সেই লোক আর হাসান ভাই মিলে গোটা জিনিসটা সাজাচ্ছে। জার্মান, ব্রিটিশ নানান কোম্পানি ভেড়াবার চেষ্টা হচ্ছে এখন। যদি দেখতে, কীরকম ব্যস্ত একেক জন আর একেক জনের মুখে কীসব কথা। ইটালিয়ানরা কী অসভ্য যদি জানতে। খারাপ খারাপ কথা মেয়েদের মুখের ওপর এমনভাবে বলে যে, শুনলে পায়ের জুতো খুলে মারতে ইচ্ছে করে। চন্দনা আর বন্দনাকে এক সাহেব একদিন কী বলল জানো? বলল, তোমাদের জামার গলাগুলো আরেকটু বড় করতে পারো না? ওরা কীরকম জামা পরে তা তো জানো। ওদেরকে ঐ কথা বলা। আমি তো ভাবলাম বোধহয় ঠাট্টা করছে। ওমা, গিয়ে দেখি পর্নো ম্যাগাজিনের ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে ভদ্রলোক চন্দনদের অনেকক্ষণ ধরে কী কী সব বোঝাচ্ছে। আর নার্গিসের কাণ্ড শুনেছ তো, শোনোনি? ওমা, জামান ভাই কথাটা এখনো চেপে রেখেছে! মাজহার সাহেবের সঙ্গে নাকি কোণায় গিয়েছিল সাভার না নয়ারহাট। রাস্তার ধারে গাড়ি থামিয়ে নেকিং আরম্ভ করে দিয়েছিল। গাঁয়ের মানুষ মাঠে কাজ করছিল কাছাকাছি— তারা সব হৈ হৈ করে ঘিরে ধরল। গাড়িসুদ্ধ জ্বালিয়ে দেবে এমন অবস্থা। শেষে থানার লোকজন এসে যাওয়াতে মারধোরটা আর হয়নি। কিন্তু কেস হয়েছে।
পারভিনের এসব গল্প শুনে রাখীর কোনোরকম কৌতূহল জাগে না। সে একসময় মুখ ফিরিয়ে শোয়, জানালার বাইরে তাকায়। দেখে, চৌধুরীদের যুক্যালিপটাসের বিনত শাখায় একটা টুনটুনি পাখি দোল খাচ্ছে। ওদিকে একটা পুরনো দেয়ালের শ্যাওলা ক্রমেই ফ্যাকাশে হয়ে আসছে, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা লোক পায়ের কাছ থেকে কী একটা কুড়িয়ে নিল। রাখী দেখে এইসব আর পারভিনের কথা শোনে। মন দিতে পারে না, তবু শোনে।
পারভিনের গল্প আর ফুরোতে চায় না। ক্লাবে কী মজার ঘটনা ঘটেছিল একদিন, সে নিজেই এখন গাড়ি চালাতে পারে, এক অবাঙালি ভদ্রলোক তাকে বিয়ে করতে চাইছে কিন্তু হাসান ভাই ভদ্রলোককে দুচোখে দেখতে পারে না, ইভার চাকরি খেয়ে নিয়েছে নার্গিস, সে বেচারা এখন ডেল্টাতে আসবার জন্যে খুব চেষ্টা করছে—
একের পর এক এত খবর যে, রাখী একসময় আর খেই ধরে রাখতে পারে না। বাইরের দিকে মন চলে যায় তার। আকাশ মেদুর হয়ে আসছে তখন। একটা চিল অনেক দূর দিয়ে চক্কর দিচ্ছে, শীতের সন্ধ্যা এই নামল বলে। রাখীর হঠাৎ ইচ্ছে হল বাইরে যায়। বাইরের রাস্তায় রাস্তায় নিশ্চয়ই অজস্র আলো জ্বলে উঠবে এক্ষুনি- য়ুনিভার্সিটি পাড়ায় বাচ্চাদের কোলাহল এখন শান্ত হয়ে গিয়েছে। রাস্তার দুপাশের ঝাঁকড়া গাছগুলোতে ঠিক এখন কাঠবিড়ালিরা এক ডাল থেকে আরেক ডালে ঝুপ ঝুপ করে লাফিয়ে নামছে। রাখী নিজের মনের ভেতরে দেখে সবগুলো দৃশ্য। শেষে উঠে বসতে চাইল।
কিন্তু পারভিন চলে যাবার আগেই জামান এল। পারভিনকে দেখে অল্প হাসল। বলল, কী ব্যাপার, তোমাকে আজকাল দেখাই যায় না।
খুব ব্যস্ত, আমাদের অফিস বড় হয়েছে শুনেছেন নিশ্চয়ই- পারভিন মুখ টিপে হাসে। তারপর হঠাৎ বিদায় নেয়।
পারভিন চলে গেলে জামান স্ত্রীর মুখোমুখি তাকায়। তাতে রাখী চোখ ফিরিয়ে নেয় না। বরং জামানকে দেখতে চায়। জামান তেমনি নিখুঁত মসৃণ, উজ্জ্বল—তেমনি ঝকঝকে, তেমনি পরিপাটি। রাখীকে ঐভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সম্ভবত খুশি হয়। বলে, কী দেখছ?
রাখী কিছু বলে না, চোখ ফিরিয়ে নেয়।
একসময় জামান ডাকে, চলো বাসায় যাবে, আর কতদিন থাকবে এখানে?
রাখী হাসে, তোমার কষ্ট হচ্ছে?
কষ্ট? না, কষ্ট কী আর।
রাখী, একটু পর আবার ডাকে জামান।
কী?
আবার চুপ। রাখী জানে, জামান অহেতুক তার সঙ্গে কথা বলছে। এভাবে কথা না-বললেও পারত। সে দেয়ালের দিকে মুখ ফেরায়।
রাখী, আবার ডাকে জামান। বলে, আমি জানি তোমার খারাপ লেগেছে, বড় কষ্ট পেয়েছ তুমি।
রাখী শুনতে চেষ্টা করল এবার। জামান বোধহয় অন্য কথা বলবে।
আমি জানি আমার ওপর তোমার ক্ষোভ হয় কিন্তু বাচ্চা হওয়ার ব্যাপারে যা বলেছিলাম, তা কিন্তু আমি সত্যিই মিন করিনি। আমাকে ভুল বুঝো না- প্লিজ।
জামান কাছে এসে রাখীর হাত ধরে। রাখী নড়ে না, সাড়া দেয় না- শুধু জামানের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে নেয় আর একবার। জামান তেমনি স্থির, দেখছে রাখীর মুখের দিকে। কী যেন খুঁজছে সেখানে। শেষে বলে, যা হবার হয়ে গিয়েছে— ওসব আর মনে রেখো না, চলো আমরা আবার আগেই মতো হয়ে যাই— তেমনি স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করি। মানুষের জীবনে এমনি অনেক কিছু ঘটে যায়— ওসবের বেশি গুরুত্ব দিতে নেই, তাতে অহেতুক কষ্ট পেতে হয়।
রাখী জামানের কথা শুনে হাসে একটুখানি। হ্যাঁ, তার হাসি পাচ্ছিল তখন। সে কী করবে। জামানকে দেখে কেবলি মনে হচ্ছিল, সে যেন মিথ্যে কৈফিয়ত দিতে এসেছে বাচ্চাছেলের মতো। বলল, এসব কথা কেন বলছ? রাখীর কথায় জামান উৎসাহ বোধ করে। বলে, তাহলে তুমি বাড়ি আসছ, বলো, কবে? কখন, কাল?
রাখী জামানের চোখের দিকে তাকায়, তোমার কাজের কতদূর?
কাজ, জামান ঠিক বুঝতে পারে না প্রথমে। তারপর বলে, ও রিসার্চের কথা বলছ? ও হয়ে যাবে— এখন তো ভাবছি— কাজটা আমি বিদেশেই শেষ করব। দুজনে মিলে বিদেশে থাকব, বাইরের ঝামেলা থাকবে না, তখন নিশ্চিন্ত মনে কাজটা শেষ করা যাবে।
বেশ ভালো হল— রাখী আস্তে আস্তে উচ্চারণ করে একটু পর।
কী? এবার জামানের শুধাবার পালা।
বাচ্চাটা মরে গিয়ে ভালো হল।
মানে? জামান বুঝে উঠতে পারে না।
রাখী হাসে তখন জামানের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। বলে বাচ্চাটা হলে তোমার কাজের কত অসুবিধা হত, কত ঝামেলা বাড়ত—
জামান রাখীর কথা শুনে চুপসে যায়। গম্ভীর হয়ে দাঁড়ায় জানালার দিকে মুখ করে। কী যেন ভাবে। তারপর আবার কাছে আসে। বলে, রাখী আবার সেসব পুরনো কথা খুঁচিয়ে তুলছ তুমি। প্লিজ, ওসব ভুলে যাও, আমরা আবার স্বাভাবিক হই আগের মতো।
রাখী কী বলবে! কিন্তু কী বলা উচিত তার? সে বুঝে উঠতে পারে না। কিন্তু তবু মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় কথাটা। বলে, তোমার চিঠিতে ঐ কথাই তো ছিল, আগের মতো হওয়ার কথাই তো তুমি আমাকে জানাতে চেয়েছিলে, তাই না?
জামান রাখীর মাথায় হাত রাখে এবার। বলে, সত্যি রাখী, আমি সিরিয়াসলি লিখেছিলাম কথাটা।
হ্যাঁ আমি জানি, রাখী মৃদু হাসে, তুমি সত্যিই মিন করেছিলে কথাটা— কারো ওপর আমার ক্ষোভ নেই। কিন্তু আমার কী মনে হয় জানো?
কী রাখী, কী মনে হয় তোমার? জামান রাখীর মুখের ওপর একেবারে ঝুঁকে পড়ে।
জামানের চোখে-মুখে কী দেখতে পায় কে জানে। সে হঠাৎ হেসে ওঠে জোরে। বলে, আমার কিছুই মনে হয় না। বাদ দাও ওসব।
না, বাদ দেব কেন, বলো তুমি- জামানকে দারুণ আগ্রহী দেখে রাখী।
শেষে একসময় রাখী বলে, আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে না হলেই ভালো ছিল।
কেন বলছ, কেন বলছ রাখী, একথা? জামান অস্থির হয়ে ওঠে।
সিরিয়াসলি কিছু বলছি না, রাখী অস্পষ্ট হাসে। তারপর বলে, হঠাৎ মনে হল তাই বললাম।
জামান স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে হাসে। বলে, যাক, তবু ভালো- আমি তো ভাবলাম কী না কী। যাক সেসব এখন ভুলে যাও, পুরনো সমস্ত কিছু- লেটাস ট্রাই এগেন। শুধু এবারের মতো মাফ করে দাও আমাকে। বলো, কবে যাবে?
যেতে কতক্ষণ, রাখী সহজ হতে চেষ্টা করে। বলে, এ-পাড়া ও-পাড়ার তো ব্যাপার, এই নিয়ে এত ভাবনার কী হয়েছে— যাব একদিন।
এই কথার পর জামানকে কিছুটা আশ্বস্ত এবং সুস্থির দেখা যায়। কিন্তু তবু রাখীর মনে হচ্ছিল, এতক্ষণের গোটা ব্যাপারটাই জামানের বানানো। কারণ রাখীর ফিরে যাবার কথা শুনেই স্বচ্ছন্দ হয়ে গেল সে। স্ত্রীর কপালে চুমু খেল দুবার। তারপর বলল, রাখী একটা কথা বলব?
রাখী চোখ তোলে।
জানো, আমি তোমার ওপর একটা অন্যায় করেছি।
রাখীর কৌতূহল নেই। সে কিছু শুধায় না। শুধু বলে, অন্যায় কে না করে। না, সত্যি রাখী, জামান বলে, ব্যাপারটা অমন হালকাভাবে নিও না। ব্যাপারটার জন্যে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। বলো, ক্ষমা করেছ? মিথ্যে একটা সন্দেহ হয়েছিল, সন্দেহটা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। আমি সেই সন্দেহের জন্যে মিছিমিছি তোমার ওপর অভিযোগ এনেছি—অনর্থক সেদিন মাজহারের কথা বলতে গিয়েছিলাম। বলো, আমাকে মাফ করেছ, বলো রাখী?
রাখী কী বলবে জানে না। কেমন বাজে আর সেন্টিমেন্টাল করে ফেলল জামান গোটা ব্যাপারটাকে। সে বাইরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দুচোখ বুজিয়ে রাখল—যেন ঘুমোচ্ছে। সে বিরক্ত হতে পারত, রেগে যেতে পারত— কিন্তু কী লাভ? মনে হল, মিছিমিছি সে আরেক ঝামেলা। তার চাইতে এইই ভালো, চুপ করে থাকা। জামান বসে থাকতে থাকতেই লক্ষ করল, রাখীর চোখ বোজা। ঝুঁকে পড়ে সে শুধাল, রাখী, শরীর খারাপ লাগছে? সাড়া না-পেয়ে আবার ডাকল, রাখী!
উম্, অস্ফুট সাড়া দেয় রাখী। চোখ মেলে আবার বোজে। বলে, আমার ঘুম পাচ্ছে।
শেষে জামান উঠল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে বাইরে- এবার ওঠা দরকার। ক্লাবে নয়, আজ সে প্রফেসর চৌধুরীর বাসায় যাবে। না, আজ আর ইভার ওখানে নয়, কাজগুলো গোছাতে হবে তাকে।
কিন্তু চোখ বুজে থাকলেই কি চোখ বুজে থাকা যায়? জামানকে পাশ কাটাতে পারে সে, আব্বাকে, বুবুকে—সবাইকে পাশ কাটানো যায়। কিন্তু নিজেকে? সারারাত সে অস্থির হয়ে এপাশ-ওপাশ করল। নিজের অস্তিত্ব একেক সময় উদ্দেশ্যহীন হয়ে যাচ্ছে তার কাছে। অনেক রাতে একসময় হঠাৎ বুবুর গলার স্বর শুনতে পেল সে। চাপা নয়- মনে হয় তীব্র চিৎকার করছে কেউ যেন। কী কী কথা হচ্ছে, বোঝা গেল না। ভারি খারাপ লাগল। নিজের জন্যে, আব্বার জন্যে, বুবুর জন্যে। হায় রে, মানুষের জীবন কত সহজেই না দুর্ভার হয়ে উঠতে পারে।
সকালবেলাটাও কাটল তেমনি চাপা বিষণ্নতার মধ্যে। বুবুকে একবারের জন্যে মাত্র দেখল। দুপুরবেলা রাখী বিছানা থেকে নেমে পড়ল। পায়চারি করল ঘরের মেঝেতে, বাইরের দিকে নজর ফেরাল অনেক দূর পর্যন্ত। শীতের রোদ ম্লান, দূরে বাড়ির ছাদগুলোতে ধূসর দেখায়। জানালার ধারে উদ্দেশ্যহীন দাঁড়াল— দূরে পানির ট্যাঙ্ক, তার ওপরে একঝাঁক পায়রা উড়ছে। রাখীর মনে হল, অনেক দিন পর সে যেন দাঁড়িয়েছে জানালার কাছে। কবে যেন এইরকম দাঁড়িয়েছিল সে। হ্যাঁ, ঠিক এইরকমই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পানির ট্যাঙ্কের ওপর পায়রাদের ওড়াউড়ি দেখেছিল। কবে যেন ঠিক মনে পড়ে না। সেদিনও এইরকম নির্জন, নিঃশব্দ ছিল চারদিকে। সে কান পাতল। এখন নিঃশব্দ নয়, কিন্তু তবু যেন নিঃশব্দ- অজস্র শব্দের মাঝখানেও সে যেন বিপুল নিঃশব্দতার মধ্যে ডুবে রয়েছে, শূন্য আর একাকী।
মনে পড়ল, সে মা হতে যাচ্ছিল- আর একটা অস্তিত্ব জেগে উঠছিল তার রক্তের ভেতরে। অহোরাত্র একটা স্পন্দন কাঁপছিল অনেক গভীর নিচে কোথায় যেন। এখন আর সেটা নেই। আর সেটা না-থাকায় এখন কী শূন্যতা। অথচ নিজেরই অজ্ঞাত মমতার একেবারে নিগূঢ়ে ঐ স্পন্দনটা ভারি ধীরে জেগে উঠেছিল, আর জেগে উঠতে উঠতে স্পষ্ট হচ্ছিল- বাঁধা ছিল হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে। এখন হৃৎপিণ্ড ভয়ানক শূন্যতার মধ্যে একাকী বেজে চলেছে নিঃসঙ্গ যন্ত্রের মতো। রাখী জানে না, তার ইচ্ছে হয়েছিল কি না- জানে না, সে মা হতে চেয়েছিল কি না। কে জানে, হয়তো সমস্ত জীবন ধরে শুধু মা-ই হতে চেয়েছিল সে। জন্ম জন্ম ধরে মা হবার বাসনা ছিল তার। কী নিদারুণ শূন্য লাগে এখন নিজেকে। রাখীর সেই মুহূর্তে হঠাৎ মনে হল, জন্ম জন্ম ধরে সে একাকী। কখনো কেউ ছিল না তার।
আর সেইদিনই সে বেরুল।
আব্বা ছুটে এলেন, সে কী, কোথায় যাবি?
উদ্বিগ্ন আব্বাকে আশ্বস্ত করে বলল, ঘরে বসে থাকতে খারাপ লাগছে আব্বা, একটু বেরুব।
বেরুবি? কী যেন ভাবলেন রাশেদ সাহেব। পরে বললেন, বেশ যা, কিন্তু একা যাবি কেন, আমি সঙ্গে যাই, কিংবা বুলু যাক।
রাখী হাসল, সেই আগের মতো নয়, কিন্তু তবু হাসল। বলল, থাক না আব্বা, আমি এক্ষুনি তো চলে আসব।
শীতের বিকেল তখন। রাখীর সাজতে ইচ্ছে করল না। হাতে বালাজোড়া ঢোকাল, চিরুনি ছোঁয়াল চুলে, পাউডারের পাফটা দ্রুত বুলিয়ে নিল গালে, কপালে এবং গলায়, তারপরই স্যান্ডেলে পা গলিয়ে সে বাড়ির বাইরে চলে এল। রিকশয় চেপে কিন্তু ভারি মুশকিলে পড়তে হল। কোথায় যাবে, বলতে পারে না। রিকশঅলাকে সামনের দিকে যেতে বলে সে ভাবতে লাগল কোথায় যাওয়া যায়। কার কাছে যাওয়া যায় এখন। নাসিমা কি ঢাকায়? কে জানে নার্গিসের কথা মনে হল একবার, একবার সুমির কথা- সুমি বড্ড কাছাকাছি এসেছিল ক’দিন। সুমি কি চাটগাঁ থেকে ফিরেছে? সে জানে না। শেষে ভাবল, বাসায় যায়। তার নিজের বাসায়।
তখন সন্ধ্যা, য়ুনিভার্সিটির স্টাফ কোয়ার্টারগুলোয় জানালায় জানালায় আলোকিত পর্দা। রাস্তায় মার্কারি বালবের বাতি জ্বলছে। প্রফেসর ইয়াজদানির লনে বোগেনভিলিয়ার ঝাড়ভর্তি বেগুনি রঙের ফুল— মার্কারি বালবের আলোয় আরো সুন্দর দেখাচ্ছে। রাখীর হঠাৎ একটা গান মনে পড়ল। একদিন সন্ধ্যায় এইরকম বোগেনভিলিয়ার ঝাড়ের পাশে বসে গান গেয়েছিল টুটু, ‘জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে।’ রাখীর মনের ভিতরে কলিটা গুনগুনিয়ে উঠল, আপনা থেকে।
ফ্ল্যাটের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দুবার ধাক্কা দিল, ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেয় না। বুঝল, আবদুল নিশ্চয়ই কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। নাম ধরে ডাকল। তখন অবাক কাণ্ড, আবদুল ছুটে এল পাশের বাগানের সিঁড়ির তলা থেকে। রাখীকে দেখেই খুশি হয়ে উঠল, আপনি আইয়া পড়ছেন, কখন আইলেন, সাবে জানে? র’ন সাবেরে ডাক দি।
দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে আবদুল জানাল যে এক বিবি সায়েব মেহমান এসেছেন—সাহেবের সঙ্গে গল্প করছেন। আবদুলকে বাইরে থাকতে বলেছেন-কে একজন নাকি আসবার কথা।
রাখী ছোকরার কথা কিছু শুনল, কিছু শুনল না। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল। দরজায় ইতিমধ্যে নতুন রঙ দেয়া হয়েছে, চুনকামও বোধহয় হয়ে থাকবে।
একটু পর দরজা খুলল, এবং দরজার ওপারে জামান।
রাখীকে দেখে জামান ভয়ানক বিমূঢ়। রাখী যেন নিদারুণ অপ্রত্যাশিত কিছু। কী বলবে, বুঝে উঠতে পারছে না।
রাখী হাসল, কী দেখছ, আমাকে চেনো না?
জামান থেকে-থেকে বলে, তুমি— কখন- মানে হঠাৎ এভাবে-
রাখী জামানকে থামায়। বলে, থাক, খুব হয়েছে, এবার আমাকে ভেতরে যেতে দাও।
জামান কেন যে অমন করছে, সে ভেবে পায় না। স্বামীকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকল আর তখনই দেখল, বাথরুম থেকে বেরিয়ে বসবার ঘরে আসছে নার্গিস।
সে কী তুই? নার্গিসকে দেখে যেন আকাশ থেকে পড়ল রাখী। নার্গিস গম্ভীর হতে চেয়েও পারছিল না। ভীষণ করুণ আর অসহায় দেখাচ্ছিল তাকে। রাখী বলল, কিরে, চমকে গিয়েছিস মনে হচ্ছে?
নার্গিসের চূড়ান্ত অপ্রস্তুত অবস্থা তখন। খালি আমতা আমতা করে- না, ঠিক তুই আজই- জামান সাহেব অবশ্যি বলছিলেন- তা তুই দেরি করলি যে এত?
বাহ্ দেরি কোথায়?
তা ভালো, নার্গিস সহজ হতে পারছে এখন। বলল, যাক তবু এলি।
আরে না, রাখী হেসে ফেলল। আমি কি এসেছি নাকি? দেখতে এলাম, কী হাল হয়েছে সংসারের। তা তুই এদিকে, হঠাৎ?
না মানে, তোর কাছেই এসেছিলাম-কিন্তু তুই যে এদিকে আসিসনি, তা তো জানি না— গল্প হচ্ছিল জামান সাহেবের সঙ্গে—
রাখী তখন নার্গিসকে দেখছিল। নার্গিস কী কী সব বলে যাচ্ছে তার কানে কিছুই ঢুকছিল না। পানি-ভেজা চোখের পাতা, কসমেটিকস ধুয়ে যাওয়া গাল, বিস্রস্ত চুল, অপরাধীর মতো অপ্রস্তুত চেহারা— সবই রাখী দেখছিল। একেকবার ইচ্ছে হচ্ছিল জিজ্ঞেস করে, তুই এভাবে মুখ ধুয়েছিস কেন, তোর কসমেটিকস যে সব ধুয়ে-মুছে গেছে। বলতে ইচ্ছে করছিল, চুলটা আঁচড়ে নে, এভাবে এখন থেকে বেরোস নে, তাহলে লোকে আমাদের খারাপ বলবে। এইসব বলতে ইচ্ছে করছিল রাখীর। কিন্তু বলল না, কী লাভ বলে? মিছিমিছি লজ্জা দেওয়া শুধু। জামান নিশ্চয়ই ভীষণ একাকী বোধ করছিল। জামানের জন্যে তার করুণা হল- আহা বেচারা!
জামান ততক্ষণে ঘরে এসে ঢুকেছে। বোধহয় বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল পরিস্থিতিটা সহজ করার চেষ্টায়। ফিরে এসে রাখীকে শোনাল, কই নার্গিস কী যেন হয়েছে তোমার ভাইয়ের, ইংরেজিতে পড়ে না?
রাখী তাড়া দিল, রাখো তোমার কথা। ওর সঙ্গে বলে আমার কত কথা আছে— ইশ, কতদিন পরে দেখা তোর সঙ্গে, তাই না?
নার্গিস ছটফট করে উঠল রাখীর কাণ্ড দেখে। বলল, আজ তাহলে উঠি। সে কী রে, উঠবি মানে? রাখী হাত চেপে ধরল। তোকে কে যেতে দিচ্ছে, বোস্ চুপ করে। তোর সঙ্গে আমার কথাই হল না। তোর বিয়ের খবরটা বলবি তো।
নার্গিস হাত ছাড়িয়ে মিনতি করে, আজ থাক ভাই, রাত হয়ে গেছে— বাসায় ফিরতে দেরি হলে সবাই ভাববে।
রাখী জামানকে ফের দেখল, দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। নার্গিস বিদায় নিচ্ছে তখন। বলছে, যাই রাখী, তুই যাস একবার-
রাখী জামানকে দেখল একবার, কিন্তু সেও আধো দেখার মতো। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গেল নার্গিসের পেছনে পেছনে। না ঈর্ষা নয়, ঈর্ষা হওয়া উচিত, কিন্তু ঈর্ষা হচ্ছে না তার। নার্গিসের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে দেখল। দরজার কাছে সে তখন দাঁড়িয়েছে, ঐ অবস্থায় পেছনে তাকিয়ে সংসারটা দেখে নিল। মনের ভেতরে কেউ যেন বলছে, রাখী যাস নে- রাখী চলে যাস নে, জীবন এরকমই, জীবনে এসব মেনে নিতে হয়।
রাখী শুনল বুকের ভেতরকার সেই ডাক। বুকের ভেতরে সে শিউরাল, বুকের ভেতরে মাথা কুটে কাঁদল, আর ঐ মুহূর্তটি, দরজার বাইরে পা দেয়ার মুহূর্তটিই যেন তাকে আলগা করে দিল। কেউ যেন কেটে দিল তার জন্ম-জন্মান্তরের বাঁধন। যে বাঁধেনে সে আমূল বাঁধা আব্বা, বুবুর, মনি ভাই, তার স্মৃতি, শৈশব- সবকিছুর সঙ্গে সেখানে সে বাঁধা, যা তাকে ঘিরে রেখেছে— দুঃসাহস বলো, শপথ বলো, প্রেম বলো, সাধ বলো, স্বপ্ন বলো, সব যেখানে ধরা— সেই বাঁধনটা কেমন যেন তীব্র টানটান হয়ে উঠল, আর অতি সহজেই কেটে গেল।
কেটে গেল, কিন্তু তার জন্যে তারপর রাখীর মনে কোনো সাড়া জাগল না, ক্ষোভ নয়, অভিমান নয়, ঈর্ষা নয়, কান্না নয়, অপমান নয়- কিছুই জাগল না। রাখীর সময় লাগল শুধু ঐ মুহূর্তটুকু। ঐ একটি মুহূর্তের ইতস্তত সময়েই সে বেরিয়ে এল যেন নিজেরই ভেতর থেকে। কে জানে, নিজের ভেতর থেকে নাকি জীবনের ভেতর থেকে, সে বলতে পারবে না। পদক্ষেপের ইতস্তত মুহূর্তটিতে যে কিসের বাঁধন ছিঁড়ল, সে নিজেই জানে না।
বাইরে পা রাখছে, তখনই ডাকল জামান, রাখী!
রাখী শুনল, কিন্তু সাড়া দিল না। বাইরের রাস্তায় নেমে হাঁটছে তখন সে, শোনবার সময় কোথায় তার?
পেছন থেকে ছুটে এল জামান, শোনো রাখী, শুনে যাও।
রাখীকে দাঁড়াতে হল। শান্ত গলায় শুধাল, কী হয়েছে?
ফিরে চলো রাখী, আমার কথাটা শোনো অন্তত।
এরই মধ্যে আবার নতুন কী হল, রাখী যেন বুঝতে পারে না। জামান কিছু বলার আগেই সে পা বাড়াল, আমি এখন যাই।
রাখী, প্লিজ, মিনতি করতে আরম্ভ করে জামান, আমাকে ক্ষমা করে দাও রাখী- আমার দিকটা দেখবে না, আমিও তো রক্ত-মাংসের মানুষ।
রাখী এবার হাসে। মনে হয়, ভয়ানক অস্থির হয়ে উঠেছে জামান। বলল, কেন এত অস্থির হচ্ছ বলো তো? নার্গিসের সঙ্গে শুয়েছ বলে আমি রাগ করিনি, বিশ্বাস করো।
জামান ভয়ানক নির্বোধের মতো রাখীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাখী বলে, সত্যি বলছি, বিশ্বাস করো, আমার একদম রাগ হয়নি।
তাহলে, কেন ফিরে যাচ্ছ, বলো, এসেও কেন আবার ফিরছ? ঘরে চলো। রাখী চুপ করে শোনে জামানের ঐরকম আকুলিবিকুলি। শেষে জানায়, তুমি মিছিমিছি ভাবছ, আজ যাচ্ছি, কিন্তু যেদিন ভালো লাগবে, সেদিন হয়তো চলে আসব- হ্যাঁ, একেবারেই চলে আসব।
কথাটা জানিয়ে রাখী আবার হাঁটতে লাগল। আর পেছনে বিমূঢ় বিস্মিত জামান ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থাকল— আদালতের ডেকে দণ্ডিত আসামির মতো।