ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

দক্ষিণায়নের দিন – ১২

বারো

কিন্তু রাত্রি তখনও জেগে। বুলু অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। রিকশর শব্দ, রেলগাড়ির গুমগুম আওয়াজ- আর একটা পাগলের ডাঙা- তাকে সে চেনে না। যাকে চিনত, পরম নির্ভরতায় একদা যার হাত ধরেছিল, সে-মানুষ কোথায় হারাল ভেবে পায় না সে।

সেইসব দিন আর রাত এখন শুধুই স্মৃতি। অথচ তারই চোখের সামনে দিয়েই সেইসব দিন-রাতের মুহূর্তগুলো একটি একটি করে নিঃশব্দে হারিয়েছে। তখন দেখেনি, আজ যখন দেখছে, তখন সে সবকিছু হারিয়ে বসে আছে। জীবনের সব সুখ সে হাতের মুঠোয় ধরে রাখতে চেয়েছিল। হায় রে, মানুষ কত কী যে ভাবে।

ভেবেছিল, কর্মী সুপুরুষ স্বামী, আমার সমস্ত কিছু সে নিজের বলে গ্রহণ করেছে— আমার সব সুখ-দুখ-আনন্দ-বেদনা তার হাতে- আমি কিছু জানি না, কিছু বুঝতে চাই না। সে-ই আমার সব। যা বলবে, তাই আমি সত্যি বলে বিশ্বাস করব। বহু দেখেছে সে, বহু মেয়ের দাম্পত্যজীবনের কথা জানে সে। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া চিরকাল তার কাছে অশ্লীল বলে মনে হয়েছে। সন্তান এসেও এল না, তবু সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেনি। মানিয়ে চলতে চেয়েছে সর্বক্ষণ। শুধু এইটুকু সাধ-শান্তি থাক জীবনে। স্বামীকে নিয়ে শান্তি, স্বামীকে সত্য বলে জেনে শান্তি, স্বামীর ভালোবাসা পেয়ে শান্তি। কিন্তু এ কোন্ শান্তি আসছে তার জীবনে?

সে দিনের পর দিন একাকী আজকাল। এই নিঃসঙ্গতার ক্লান্তিতে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। এইরকম অন্ধকার রাত্রি আর তারাদের ঝিকিমিকি আরো কতকাল তাকে দেখতে হবে? দিন-রাতের শত কাজ, শত কোলাহল থেকে নিজেকে যখন সে ছাড়িয়ে আনে, তখন তার মুখোমুখি আর কেউ নেই। বুলু কাঁদতে গিয়েও কাঁদতে পারে না। মুখ নেই তার। কার কাছে গিয়ে কাঁদবে সে? জীবনকে তো নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল সে। নিজের হাতে তিল তিল করে সুখের প্রাসাদ গড়তে চেয়েছিল। কিন্তু এখন? এখন এ কোন্ সুখের প্রাসাদ গড়ে উঠেছে তার?

পায়ে পায়ে বারান্দায় এধার থেকে ওধার নিঃশব্দে সে হাঁটে। একবার নিজের ঘরের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, একবার আব্বার ঘরের দরজার কাছে। আব্বা সম্ভবত আজ জেনেছেন, নিজের কানে শুনেছেন সব কথা। কিছুদিন থেকেই আব্বা তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছেন, মাঝে মাঝেই মনে হয়, কিছু বোধহয় জিজ্ঞেস করবেন। বুলু আব্বার সেই দৃষ্টিকে ভয় পেয়েছে। বারবার সে আব্বাকে এড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু এবার, এবার সে নিজেকে কোথায় লুকোবে?

অন্ধকার রাতের মুখোমুখি হয়ে বুলু সেদিন শুধু দিশেহারা হল। রাখী ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মুখে পাউডারের পাফ বুলোচ্ছিল, হঠাৎ চোখ পড়ল আয়নাতে। দেখে, পারভিন তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখ ফিরিয়ে হাসল রাখী, কি রে কী দেখছিস?

পারভিন পালটা হাসে। বলে, তোমাকে।

বাহ্ কেন, আমার কি শিং গজিয়েছে, নাকি ল্যাজ দেখা যাচ্ছে?

পারভিন চোখ নামায় না। বলে, রাখী আপা, যা সুন্দর হয়েছ না তুমি! আমারই মুণ্ডু ঘুরে যাচ্ছে।

রাখী রাগে, যাহ্ ফাজিল মেয়ে, এই তোর পড়াশোনা হচ্ছে ঢাকায় এসে? পারভিন আবার বইয়ের পাতায় নজর ফেরায়।

আচ্ছা রাখী আপা, মুখ না তুলেই পারভিন জিজ্ঞেস করে, তুমি নাকি দারুণ গম্ভীর মেয়ে?

কেন, হঠাৎ এ প্রশ্ন?

অনার্সের একটি মেয়ে বলেছিল, তুমি নাকি কাউকে কখনো পাত্তা দাওনি। ইয়ং টিচাররা পর্যন্ত তোমার কাছে ঘেঁষতে সাহস করত না?

রাখী পারভিনের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ধমকায়, য়ুনিভার্সিটিতে গিয়ে এইসব নিয়ে থাকো তুমি?

বাহ্, আমি কী করব? তোমার সম্বন্ধে ওই কথাই তো বলল ওরা। সত্যি নাকি রাখী আপা?

কে জানে, আমি তো কিছু জানি না।

একটু থেমে পারভিন আবার বলে, আজ কি কোথাও যাবে-টাবে?

মানে?

য়ু লুক সো গর্জিয়াস।

তুই ভারি ফাজিল হয়েছিস পারভিন।

আচ্ছা বাপু, আর কিছু বলব না। আমি এখন ফেরারি কুইনের পাল্লায় পড়েছি।

রাখী অলক্ষ্যে আরেকবার আয়নার দিকে তাকায়। পারভিন কেন বলল ওকথা? দ্যাখে সে নিজেকেই। কপাল, ভ্রূ, চোখ, ঠোঁটদুটি, চিবুক, গ্রীবা, বাহু, বুক, তারপর শাড়ির লীলাবিস্তার। হঠাৎ, হ্যাঁ নিজেরই অলক্ষ্যে যেন তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। এ কে? এই কি আমি?

চোখ নামায় রাখী। গোপন লজ্জা আর কাঁপা কাঁপা অদ্ভুত অনুভূতিতে সারা মন আচ্ছন্ন হয়ে যায়। সরে আসে আয়নার সামনে থেকে। সে এমন করে সেজেছে কেন আজ? গতকাল সেজান ফোন করে জানিয়ে রেখেছে আজ দেখা করতে আসবে, সেইজন্যে?

সেজানের কথা মনে পড়তেই নিজের ওপর রাগ হয়। ছি ছি, কেন ভাবলাম ওর কথা, ছি ছি। নিজেকে শাসন করে রাখী। তাহলে?

ও, এতক্ষণে মনে পড়ে।

জামানের সঙ্গে দেখা করবার কথা আজ। কথাটা ভেবে স্বস্তি পায় সে। বরং পরক্ষণেই ফের ব্রিতবোধ করে। কখন নিজের অজ্ঞাতে সে সেজে বসে আছে জামানের জন্যে- নিজেকে ছোট মনে হয় তার। একজন পুরুষমানুষকে মুগ্ধ করার জন্য নিজেকে সাজিয়েছে বলে লজ্জা লাগে তার। পুরুষমানুষকে কি লোভ দেখাতে চায় সে? ছি ছি!

ঘরে আর দাঁড়ায় না রাখী, ব্যাগটা হাতে নিয়েই বেরিয়ে পড়ে।

মাজহার সাহেবের কামরায় বসে আরো বেশি অস্বস্তি লাগতে আরম্ভ করে তার। একটা চিঠির উত্তর দেয়ার ব্যাপারে পরামর্শ চাইতে গিয়েছিল। মাজহার খান কথা বলছিলেন আর বারেবারেই কথার খেই হারিয়ে ফেলছিলেন। আর রাখী যতবার চোখ তুলে তাকাচ্ছিল, ততবার দেখছিল মাজহার খানের দুচোখে অন্যরকমের দৃষ্টি। স্থিরচোখে তাকিয়ে আছেন। তার দৃষ্টির ভেতরে কীরকম একটা অস্থিরতা। রাখীর খারাপ লাগল। সে জানে না মাজহার সাহেব আগে কখনো এমনি চোখে তার দিকে তাকিয়ে দেখেছেন কি না। আজই প্রথম? নাকি বরাবরই এমনি চোখে মাজহার সাহেব তার দিকে তাকিয়ে দেখেন? রাখী নিশ্চিত হতে পারে না। রাখী উঠতে চায়, এখন উঠি তাহলে!

এখুনি উঠবেন কী, বসুন, আরো কাজ আছে।

রাখীকে বসতে হয়। তখন লাঞ্চ আওয়ার, সারা অফিস নিঃশব্দ। টাইপমেশিনগুলো সম্ভবত ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। পাখার শব্দ ফরফর করছে ঘরময়। মাজহার একটা ফাইল খুললেন। ক’টা পৃষ্ঠা খুলে ফাইলটা এগিয়ে দিলেন রাখীর দিকে। রাখী কতগুলো পুরনো চিঠি দেখল। প্যান- অ্যাম রিওএসির ছাপ মারা চিঠিগুলোতে।

রাখী নেড়েচেড়ে কিছু বুঝে উঠতে পারে না।

কী ব্যাপার? রাখী চোখ তোলে।

যে জবাব খুঁজছেন, তা ঐ করেসপন্ডেন্স-এ পাবেন। রাখী এবারও পৃষ্ঠা উল্টে কিছু বুঝে উঠতে পারে না।

মাজহার খান উঠে আসেন, এসে তার চেয়ারের পাশে ঝুঁকে পড়েন। চেয়ারের পিঠ থেকে একটা হাত রাখীর ঘাড় ছোঁয়। রাখী অনুভব করে, সারাটা শরীর তার শিরশির করে উঠছে। মাজহার খানের মাথা তখন হয়ে এসেছে আরো নিচু। কোন্‌টা বুঝছেন না, কোন্‌টা? সবই তো লেখা আছে এখানে, এই যে—

রাখীর কানের কাছে উত্তপ্ত নিশ্বাস এসে লাগছে। সে মুখ ফিরিয়ে তাকাতে পারে না। মাথাটা একপাশে হেলিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। আর দাঁড়িয়েই মুখোমুখি তাকাল। মাজহার তখন আবার নিজের চেয়ারে গিয়ে বসতে যাচ্ছেন মুখ নিচু করে।

আচ্ছা, চলি-রাখী কথাটা উচ্চারণ শেষ করার জন্যে আর ঘরের মধ্যে দাঁড়ায়নি। নিজের ঘরে এসে বসে। ফ্যানটা জোর করে দিয়ে নিজের ঘরে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে সে। কোনোকিছু ভাবতে পারছে না। সব চিন্তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তখন নাকি ওসব কিছুই নয়? একসময় তার মনে হয় মাজহার সাহেব স্বাভাবিকভাবেই কথা বলেছেন, তার নিজেরই ভুল। নিজের সম্বন্ধে আজ বেশি সচেতন হয়ে রয়েছে বলেই কি অমন মনে হল? রাখীর মনে কেবলি সন্দেহ দোল খেতে থাকে।

মাঝখানে একবার বেয়ারা এসে খবর জানায়, সেজান সাহেব ফোন করেছিলেন, আজ আসতে পারবেন না।

রাখী খবর শোনে শুধু। বেয়ারাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না। সবকিছু বিশ্রীরকম গোলমাল হয়ে যাচ্ছে তার। সারাটা দুপুর কাজে মন বসাতে চাইল, আগাগোড়া ব্যাপারটা সে ভুলে যেতে চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। একবার ভাবল মাজহার সাহেবের ঘরে আরেকবার যায়। কিন্তু গিয়ে কোন্ কথা বলবে, সেটাই সে ভেবে পায় না।

এমন সময় ফোন কানে তুলতেই মাজহার সাহেবের গলা শোনে রাখী। দুপা এগিয়ে ঘর, তবু ফোন করছেন, অদ্ভুত কাণ্ড। নাকি ইতিমধ্যে বাইরে গিয়েছেন কোথাও, সেখানে থেকে ফোন করার দরকার হয়েছে।

যাবেন না, আপনার কামরায় আমি একটু পরই আসছি, একটা সমস্যা হয়েছে— সাহায্য করবেন আশা করি, মাজহার বলে।

রাখী ছোট্ট জবাব দিল, আসুন, আমি আছি।

তারপর রাখী অস্থির হয়ে অপেক্ষা করল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে- তিনটা। অফিসের কলিংবেলগুলো আবার সাড়া তুলছে। টাইপ মেশিনগুলোর সরব ব্যস্ততা শোনা যায়।

হাতের কাছের ফাইলগুলো নাড়াচাড়া করল রাখী, কয়টা বিজ্ঞাপন দেখল, সাউথ সি আইল্যান্ডে কুসুমসজ্জিতা রমণীদের সঙ্গে বিদেশি ট্যুরিস্টদের অন্তরঙ্গ আলাপের ছবি।

ঠিক তখনই দরজা খোলার শব্দ হল।

মাজহার সাহেব ধীরপায়ে এগিয়ে এলেন। তারপর একখানা খাম এগিয়ে দিলেন। বললেন, এটা পড়ে দেখবেন। রাখী খামখানা হাত বাড়িয়ে নিল। মাজহার সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমি দুদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি, অফিসের চার্জ আপনার ওপর রইল। সবাইকে আমি জানিয়ে দিয়েছি।

রাখী মাজহারের মুখের দিকে তাকায় তখন। কী বলবে, ভেবে পায় না। আপনার কোনো অসুবিধে হবে?

না, তেমন কী— রাখী মৃদুস্বরে অসম্পূর্ণ জবাব দেয়।

তাহলে চলি আমি। মাজহার সাহেব দোরের দিকে পা বাড়ালেন। তারপর বেরুবার মুখে বললেন, মিস রাশেদ, আই ডিডন্ট মিন টু হার্ট য়ু, প্লিজ কিপ ইট ইন মাইন্ড।

রাখী শুনল এবং তারপরও বসে রইল। চিঠিটা হাতে নিয়ে এখন সে বিপন্ন বোধ করছে। অনুমান করতে অসুবিধে হয় না, কী আছে চিঠিতে। খুলবে কি খুলবে না, ইতস্তত বোধ করল কিছুক্ষণ। তারপর একসময় চিঠিখানা খুলল। ইংরেজিতে লেখা দীর্ঘ চিঠি। মাজহার সাহেব অল্পক্ষণ আগে এ চিঠি লিখেছেন, চিঠি দেখে তা মনে হয় না।

মিস রাশেদ,

জীবনে এমন কতগুলো সময় আসে যখন মানুষকে দৃঢ় হতে হয়, একরোখা হতে হয়— তা না হলে জীবন ফাঁকি দিয়ে চলে যায়। আমি অপেক্ষা করেছি বহুকাল, কিন্তু যেদিন তোমাকে প্রথম দেখলাম, সেইদিন মনে হল, আমার জীবনের সেই মুহূর্তটি এসেছে। সেইদিনই আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। আমি পোড়-খাওয়া মানুষ। ছেলেবেলায় আমার বিয়ে হয়েছিল এক অভিজাত বংশের মেয়ের সঙ্গে— সেই পঞ্চাশের এলাহাবাদে। কিছুদিন পর দেশত্যাগ করে আলীগড় থেকে সোজা ঢাকায় চলে আসি। আর আমার বালিকাবধূ মানুষ হবার জন্যে করাচি চলে যায়। বছর কয়েক পর আমার তরুণী বধূ তার এক অধ্যাপককে ভালোবেসে ফেলে। আমি খুশি হয়েছি মেয়েটির সাহস দেখে এবং অভিনন্দনসহ তালাকনামা পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার অনেক টাকা আছে— কত টাকা- তুমি কেন, অনেকেই ধারণা করতে পারবে না। ওভারসিজ-এ আমার শখের চাকরি। আমি উঁচু সোসাইটি বলে যাকে, সেখানে মেলামেশা করি। এজন্য বহু মেয়ে আমার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু লাভ হয়নি কারো। কেননা মেয়েদের আমি শ্রদ্ধার চোখে দেখতে চাই। আমার বিশ্বাস মেয়েরা শুধু বিলাসিতা আর ভোগের জিনিস নয়- মেয়েরাও কিছু ভাবতে পারে, কিছু করতে পারে। কিন্তু কোনো মেয়ের মধ্যেই আমি ঐ ধরনের ব্যক্তিত্ব দেখতে পাইনি। তাদের সান্নিধ্য বিরক্তিকর মনে হয়েছে সবসময়। সেদিন আমার অবাক লেগেছিল তোমাকে দেখে। এমন মেয়েও তাহলে এদেশে আছে? তারপর তোমার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর আমার সর্বনাশ হয়ে গেল। আমার এতদিনের অহঙ্কার ধুলায় লুটল। দেখলাম, এমনও মেয়ে আছে যে আমার আকর্ষণ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে থাকতে পারে। একদিন দুদিন নয়, গত পাঁচ ছয়টা মাস আশায় আশায় ছিলাম, তুমি সাড়া দেবে। কিন্তু তুমি ভারি নিষ্ঠুর। কিছুই বললে না। খোঁজ নিলাম, হাসান জানাল, কোনো ছেলের সঙ্গে কখনো তোমার ঘনিষ্ঠ জানাশোনা হয়নি— এখনো তেমন কেউ নেই আর সেজন্যেই আজ আমি তোমার কাছে স্পষ্ট হতে চেষ্টা করছি। জানি না তুমি কী মনে করছ। জানো, আমার একেক সময় কী ইচ্ছে করে? তোমার ঐ সুগঠিত নরোম পুষ্ট শরীরটা দু’হাতে বুকের কাছে টেনে নিই আর বিপুল তৃষ্ণায় হা হা করতে করতে বুকের মধ্যে তোমাকে একবার পিষে ফেলি। কিছু মনে কোরো না, আমি নিজের মনের সত্যিকারের চেহারা তোমার কাছে তুলে ধরতে চাই বলেই এমন কথা লিখছি।

কী নামে তোমাকে ডাকব জানি না। তোমার মাতৃভাষা যদি জানতাম! জানলে নিশ্চয়ই টেগোর থেকে কোট করতে পারতাম। উর্দু ফার্সি কাব্য থেকে অজস্র কোট করতে পারি কিন্তু সে তো কঠিন পাষাণে মাথা কুটে মরা শুধু।

শোনো, আমি বড় জেদি, ভীষণ অহঙ্কারী—জীবনপণ করে আমি তোমাকে চাইব। সবকিছুর বিনিময়ে আমি তোমাকে পেতে চাই। আজ হোক, কাল হোক—আমি তোমার কাছে যাবই, ছায়ার মতো তোমার পেছনে আমি ঘুরে ফিরব, তোমার বিবেকে আমি কাঁটার মতো অহরহ ফুটব— তোমাকে কোনোভাবেই নিষ্কৃতি দেব না।

রোকেয়া, আমার কেউ নেই। আমার যা-কিছু আছে সব আমি তোমার জন্যে বিলিয়ে দিতে পারি। তুমি এসো রোকেয়া, আমার অন্ধকার ঘরে আলোর মতো এসো।

আমি এক্ষুনি তোমার মতামত চাইছি না। তুমি সবকিছু ভেবে দ্যাখো। যখন তুমি রাজি হবে, আমি তখনই তোমার আব্বাকে জানাব। হাসানকে আমি ইতিমধ্যে বলে রেখেছি।

ইতি মাজহার।

রাখী চিঠি পড়ে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর কী মনে করে উঠে দাঁড়াল। আর এখানে থাকতে ভালো লাগছে না। এখানে থাকলেই যত রাজ্যের ঝামেলা।

আর এ মুহূর্তে দরজায় বেয়ারার মুখ দেখা গেল, স্টেনো মেমসাব কথা বলতে চান।

রাখীকে আবার বসতে হল। বলল, আসতে বলো।

ইভা মরিস হল সেই ধরনের মেয়ে যে রাখীর ইংরেজি শোধরাতে এসেছিল। ইভাকে এখন ম্লান দেখাচ্ছে, ক’দিন আগেও ওকে ভারি উজ্জ্বল দেখেছিল রাখী।

ইভা সোজাসুজি কথা পাড়ল, আমার একটা বিপদ হয়েছে, সাহায্য করবেন?

রাখী হাসল, আন্তরিক হতে চেষ্টা করল। বলল, বলে দেখুন কতদূর পারি। আমার কিছু টাকা দরকার। টাকাটা আমি অফিস থেকে ধার চাই।

বেশ তো, অনেকেই তো ধার নেয়।

অনেকেই নেয়, কিন্তু আমরা পারি না, টেম্পরারি স্টাফ, তা ছাড়া মাজহার সাহেব বোধহয় রাজি হবেন না।

হোয়াই? রাখীর ভ্রূ কুঁচকাল।

সে অনেক কথা, সেসব বলা সম্ভব নয়। ইভা মাথা নিচু করে জানায়, শুধু টাকাটা ধার পেতে যদি সাহায্য করেন, তাহলেই কৃতজ্ঞ থাকব। রাখী শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, কত টাকা?

বেশি নয়, হাজার দুয়েকের মতো।

অত টাকা! রাখীর অবাক লাগে। দুহাজার টাকা বেশি নয়? আশ্চর্য!

ইভা তখন বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করে, টাকাটা আমার বোনের জন্যে চাইছি আমি। তার স্বামী বহুকাল নিখোঁজ থাকার পর এসেছে একটা জখম ফুসফুস নিয়ে। তার চিকিৎসার জন্যেই টাকাটা ধার করতে হচ্ছে।

আচ্ছা আমি দেখব, মাজহার সাহেবকে কালই বলব— রাখী আশ্বাস দিয়ে উঠল, আর এখানে নয়, এবার বেরুবে সে।

প্লিজ, ও কাজ করবেন না, মাজহারকে কিছু বলবেন না। ইভা কেমন আর্তনাদ করে উঠল।

বাহ্ কেন? রাখী বুঝতে পারে না। বলে, মাজহার সাহেব ঢাকা অফিসের বড়কর্তা, তাঁকে না জানিয়ে এ ব্যাপারে কিছু করা কোনোমতেই সম্ভব নয়। ইভা মাথা নিচু করে বলল, আগে হলে আমি ওর কাছেই সোজাসুজি যেতাম। ওই আমাকে এ ফার্মে নিয়ে আসে। অ্যান্ড নাউ হি ইজ ট্রাইয়িং টু অ্যাভয়েড মি। ইভেন হি ডাজন্ট রেসপন্ড টু মাই কার্টসিজ।

ঠিক আছে, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব, রাখী উঠল। এখানে বেশিক্ষণ থাকলে তার মাথা সত্যি সত্যি খারাপ হয়ে যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *