ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

দক্ষিণায়নের দিন – ৬

ছয়

ফোন ধরতেই পরিচিত ভঙ্গিতে কে যেন ডাকে, হ্যালো, রোকেয়া রাশেদ কি আছেন?

রাখী চিনতে পারেনি। অফিসী মেজাজে বলল, বলুন, কথা বলছি।

কেমন আছ? আমি জামান।

রাখী চমকে উঠল। ভাবতেই পারেনি, কখনো জামান তাকে এভাবে ডাকবেন। সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়। বলে, টেলিফোনে আপনার গলা একদম চেনা যাচ্ছে না। জামান উত্তরে বলেন, গলার দোষ, না টেলিফোনের, বলা মুশকিল। জ়ামানের উত্তরে খোঁচা ছিল, কিন্তু রাখী হজম

করল চুপচাপ। তার মনে হচ্ছিল, কী যেন বলতে চাইছেন জামান সাহেব, কিন্তু বলতে পারছেন না।

শেষে বললেন, তোমার কাছে খানকয় বই আছে আমার, এখন তো ওগুলো তোমার কোনো কাজে লাগছে না।

জী, কালই পাঠিয়ে দেব, আগেই পাঠানো উচিত ছিল।

কিছু মনে কোরো না, বইগুলো দরকার হয়ে পড়েছে বলেই বিরক্ত করছি।

একটু থেমে আবার বললেন, তারপর আর কী খবর বলো।

কী বলব, বলুন?

তোমার কথা, চাকরি কেমন লাগছে?

ভালো, এখনো সব কাজ বুঝে উঠতে পারিনি, তবু ভালো লাগছে। তোমার কি সময় হবে? জামান সাহেব প্রসঙ্গ ফিরিয়ে নিলেন! বললেন, য়ুনিভার্সিটিতে এসো না একদিন।

জি আসব, হাতের কাজগুলো গুছিয়ে উঠলেই আসব একদিন।

ফোন ছেড়ে দেয়ার আগে জামানের স্বর হঠাৎ বিষণ্ন হয়ে উঠল। বললেন, রাখী, আমার আশ্চর্য লাগে, তুমি ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি করছ। ফোনে মিনিট দুয়েকের কথা। কিন্তু তারপরও অনেকক্ষণ রাখী হাতের কাজ ফেলে বসে রইল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। মনে হল, জামান তার চাকরি পছন্দ করেননি। একবার মনে হল, জামান হয়তো চাইছিলেন, সে কলেজে চাকরি করুক। খুব সম্ভবত জামান চাইছিলেন, তার সঙ্গে দেখাশোনার সুযোগ থাক এমন একটা চাকরি করুক রাখী। জামান ফোন ছেড়ে দিলেন। কিন্তু রাখী বুঝল, জামান কথাটা বললেন না। বলতে চাইছিলেন, কিন্তু বললেন না! একটা চাপা অভিযোগ সকল ভদ্ৰতা রক্ষার চেষ্টা ভেদ করে ফুটে বেরুচ্ছিল। কিন্তু রাখী কী করবে। রাখীর মনে পড়ে, সপ্তাহ দুয়েক আগে দেখা হয়েছিল! জামান রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। রিকশ থেকে নেমে রাখীর রিকশর কাছে এসেছিলেন। উৎসুক চোখে কুশল জিজ্ঞেস করেছিলেন। রাখী কথা দিয়েছিল পরের দিনই দুপুরবেলাতে সে য়ুনিভার্সিটিতে যাবে।

কিন্তু তারপর ক’টা দিন কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল সবকিছুতেই। সকাল ন’টার দিকে অফিসে আসতে হয়। মাজহার সাহেব এখন কাজ বোঝাচ্ছেন তাকে। তার চেম্বারে বসতে হয় কিছুক্ষণ, তারপর সেখান থেকে ফিরে নিজের কামরায়। বিল, ড্রাফট, ট্রাভেলার্স চেকের হিসেবে, এক এয়ারলাইনের টিকিটের সঙ্গে অন্য এয়ারলাইনের টিকিটের বদল, বিভিন্ন কাগজে বিজ্ঞাপন ঠিক ঠিক পাঠানো হল কি না-এইসব খোঁজ, নানান ধরনের চিঠিপত্রের জবাব—এইসব বুঝে উঠতে উঠতে দুটো বেজে যায়। এরই মাঝখানে আবার চিঠিপত্রগুলো টাইপ হয়ে আসে। সেগুলোর ওপর চোখ বোলাতে হয়। লাঞ্চের পর মাজহার সাহেব দেখতে আসেন কাজকর্ম ঠিক ঠিকমতো হচ্ছে কিনা। একেক দিন আবার দুএকজন ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে আসেন, পরিচয় করিয়ে দেন। বললেন, এঁরা হচ্ছেন আমাদের প্যাট্রন, এঁদের ব্যাপারগুলো কিন্তু আপনাকেই দেখতে হবে।

রাখী সামাল দিতে পারে না একেক দিন।

গত কয়েকটা দিন আর অন্যকিছু ভাবতে পারেনি সে। এখন, টেলিফোনে কথা হবার পর, জামান সাহেবের কথাগুলো তাকে নতুন করে ভাবাল। হাতের কাজ ফেলে রেখে সে ভাবতে বসল।

সে ভাবত না, আব্বা যদি তার কাছে আগের মতো সহজ হতেন। যদি ডেকে বলতেন, রাখীবাঈ, কেমন লাগছে নতুন চাকরি? তাহলে সে ভাবত না। মনে করত—সবাইকে যা করতে হয় তাইই সে করে যাচ্ছে। আগে যেমন পড়াশোনা করত এও তেমনই কিছু একটা ব্যাপার।

ভাবতে ভাবতে সময় পার হয়ে যায়। একসময় সে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে। মতিঝিলের অফিসপাড়ায় তখন শেষ বেলার তাড়া। রাস্তায় নেমে রিকশ নিল না। তাকে বেরুতে দেখে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মাজহার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কোথাও যাবেন বুঝি? রাখীকে গম্ভীর হতে হল প্রশ্ন শুনে। বলল, একটু ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আগেই বেরুচ্ছি।

মাজহার সাহেব অপ্রস্তুত হন রাখীর কথা শুনে। তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই— আগে বেরুবেন বৈকি। এরপর মাজহার সাহেব গাড়ির কথা বললেন। বললেন, ড্রাইভার আপনাকে দিয়ে আসুক বরং। রাখী পাশ কাটায় সেই গাড়ি দেওয়ার প্রস্তাবে। বলে, অনেক ধন্যবাদ। কাছেই যাচ্ছি। মিছিমিছি গাড়ি কী হবে।

কথাটা বলেই রাস্তায় নেমে এসেছে সে। মাজহার সাহেবকে কিছু বলবার সুযোগ দেয়নি। মতিঝিলের রাস্তাটুকু হাঁটে সে স্টেডিয়াম পর্যন্ত। অক্টোবরের রোদে এখনো দারুণ ঝাঁজ। তবু ভালো লাগে। হাঁটতে হাঁটতে দেখে, এক জায়গায় উঁচু দালানের আড়ালে তিনটি বাচ্চা মার্বেল খেলছে। এক বুড়ো রিকশঅলা ভাঙা রিকশ টেনে টেনে নিয়ে চলেছে। এক হোটেলের গেটের কাছে দুজন উর্দিপরা বেয়ারা সিগ্রেট ফুঁকতে ব্যস্ত। নতুন লাল দালানটার গায়ে কেমন মেটে-মেটে রঙ।

এখন কোথায় যাবে সে? ডাইনে বাঁয়ে তাকায় সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কোনদিকে যাবে সে, ডাইনে না বাঁয়ে? এই মুহূর্তে বাসায় ফেরার কথা তার মনে আসছে না। বরং জামান সাহেবের কথা মনে পড়ছে। ঘড়ির দিকে তাকায়, চারটে বাজতে কুড়ি মিনিট। আজ বৃহস্পতিবার, জামান সাহেবের য়ুনিভার্সিটিতেই থাকবার কথা। সে যখন রিকশর জন্য ডাইনে বাঁয়ে তাকাচ্ছে, ঠিক তখনই দেখে একটি লোক হেঁটে আসছে। দেখে সে থকায়, ডাইনে বাঁয়ে তাকায় আবার। যদি রিকশ পাওয়া যায়, যদি কোথাও আড়াল নেওয়া যায়। রাখী দুমুহূর্ত অপেক্ষা করে সোজা সামনের দিকে হাঁটতে আরম্ভ করে দেয়।

একটা ছেলেমানুষি সঙ্কোচ, সেইসঙ্গে আবার চাপা কৌতুক রাখীকে তখন তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে সামনের দিকে। রাখীর মনে হচ্ছে— সে যেন হাসতে হাসতে ছুটছে। কয়েক পা এগোবার পর হঠাৎ রাখীর হুঁশ হয়। এ কী পাগলামিতে পেয়েছে তাকে! এখনো কি সে নতুন কলেজে ওঠা মেয়ে নাকি? কী আশ্চর্য, সেজান কি তার অচেনা মানুষ! নিজেকে সে ধিক্কার দেয়- ছি ছি এসব কী আরম্ভ করেছে সে!

সে সম্ভবত লক্ষ করেনি, করলে নিশ্চয়ই পা চালিয়ে এগিয়ে আসত।

পেছন ফিরে তাকায় রাখী।

শাদা ট্রাউজার্স আর শাদা হাফশার্ট পরনে। কদিন আগে যেমন দেখেছিল আজ তার চাইতে অনেক বেশি শুকনো দেখাচ্ছে। মুখ নিচু করে কী যেন ভাবতে ভাবতে হাঁটছে। রাখী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, সেজান একেবারে কাছাকাছি এসে ডাইনের দালানটার দিকে তাকিয়ে কী যেন খুঁজল তারপর বাঁয়ে নজর ফেরাতেই দাঁড়িয়ে পড়ল।

রাখী লক্ষ করে, মুহূর্তে মানুষটার চোখদুটো যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

তারপর এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথায়, এদিকে?

রাখী হাসে। বলে, আগে বলুন আপনি কোথায়?

কোথায় গেল সঙ্কোচ, রাখী সেজানের সঙ্গে হেসে ওঠে অক্টোবরের রোদ মাথায় নিয়ে।

আমি এখন চাকরি করি, রাখী একটু পর জানায়।

ওহো, তাই তো, খালুজান সেদিন বললেন, অথচ-

খালুজান! রাখী ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।

হ্যাঁ, তোমার আব্বার অফিসে গিয়েছিলাম সেদিন।

রাখী চুপ করে যায়। আব্বা সেজানের কথা তাকে বলেননি।

কিন্তু তুমি এ পথে? সেজান রিকশর জন্যে দুপাশে তাকাতে তাকাতে বলে, এদিকে তো দেখছি, এ সময়ে রিকশ পাওয়া যায় না।

আপনি কোথায় যাবেন তাই বলুন? একটা রিকশ আসছিল সেদিকে নজর রেখে রাখী পাল্টা জিজ্ঞেস করে।

আমি আপাতত কিছু খাব, ভীষণ খিদে পেয়েছে— কোন্ রেস্তরাঁয় ঢুকব, তাই ভাবছি।

রিকশটা কাছে এসে দাঁড়াতেই রাখী বলে, নিন উঠে পড়ুন।

সেজান ইতস্তত করে। বলে, তুমি কোথায় যাচ্ছিলে যাও-ঐ তো সামনেই রেস্তরাঁ, এটুকু রাস্তা হেঁটে যাব।

রাখী চোখের দিকে তাকায়। সে জানে না, এই প্রথম সে সেজানের চোখের দিকে তাকাচ্ছে কি না। বলে, চলুন আমিও কিছু খাব আপনার সঙ্গে।

সেজান আর কিছু বলবার মতো খুঁজে পায় না। বলে, বেশ তাহলে চলো। এতক্ষণকার সহজ ভঙ্গি, সে যেন ঘোর-লাগা ব্যাপার একটা। রাখী ছেড়ে দিয়েছে নিজেকে, নিজের মনের দিকে তাকায়নি। সেজানকে আলাদা করে ভাবছে না সে। অতীতকে চোখ বুজে সরিয়ে রেখেছে। এ যেন গা-ঝাড়া দিয়ে সহজ হয়ে ওঠার মতো।

হ্যাঁ, এতক্ষণ তাই ছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সহজ হওয়া সহজ ছিল। কিন্তু এক রিকশয় পাশে বসে সে ঘামতে লাগল। এই প্রথম, হ্যাঁ, জীবনে আজকে এই প্রথম সেজানের পাশে বসে রিকশয় চেপে যাচ্ছে সে। কথা বলবার প্রশ্নই ওঠে না। সে সেজানের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল। ঠিক সেই কোমল আঙুল, একটু বেশি কালো হয়েছে শুধু। একবার ভাবলেন, মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলে কী হয়? এবং সেই কৌতূহলেই অতি সহজেই জয়ী হয়ে গেল। দেখল, সেজানের চোখের কোলে আবার কালি পড়েছে, চোখের মধ্যে কেমন লালচে রুক্ষ ভাব, চুলে দুটি একটি পাক ধরেছে। সেজান বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে, একেক সময় কী রকমের অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যায় দ্যাখো। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার কল্পনাও করতে পারি না যেখানে, সেখানেই দেখা হয়ে গেল।

রাখীর হাসি পেয়ে যায় ঐরকম উদ্ভট কথা শুনে। বলে, এ তো হতেই পারে, ঢাকা শহর কি খুব বড় জায়গা?

বাহ্, আশ্চর্য নয়? ভাবো তো, কোথায় তুমি অফিস থেকে খেটেখুটে ফিরছ, কোথাও হয়তো যেতে হবে, আর আমি এদিকে খিদের জ্বালায় প্রাণান্ত হয়ে হোটেলে। বলো দৌড়াচ্ছি-এমন অবস্থায় যোগাযোগ, আশ্চর্য নয়? মানুষটা এমনভাবে কথা বলে। রাখীর হাসি সামলানো দায় হয়ে ওঠে। কিন্তু হাসতে পারে না।

প্রায়ই ভেবেছি, একবার যাই তোমাদের ওখানে-কিন্তু যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি। একটু থেমে সেজান আবার বলে, সেদিন তোমাকে দেখে অবাক হয়েছিলাম, ভাবতেই পারিনি, তুমি এত বদলেছ।

আমি বদলেছি? রাখীর মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে যায়।

না, মানে— সেজান নিজের কথায় বিব্রত বোধ করে একটুখানি। তারপর বলে, তুমি যে সেই য়ুনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে পড়া মেয়ে নও—এটাই আমি ভাবতে পারিনি। চার বছর কিন্তু বেশ লম্বা সময়।

সেজানের প্রসঙ্গ পাল্টে গেল। কোন্ কথায় কোন্ কথা চলে এল। বলল, এবার সত্যিই মনে হচ্ছে চার বছর বেশ লম্বা সময়-বাইরের অনেক কিছু বদলেছে, নিজেকে কেমন বাইরের লোক মনে হচ্ছে সব জায়গায়-কারো সঙ্গেই নিজেকে মেলাতে পারি না-একেক সময় মনে হয়, আমিই বোধহয় বদলে গেছি।

রিকশঅলাকে রাখী একটা চিনে রেস্তরাঁর সামনে নিয়ে এল। সেজান রেস্তরাঁর সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে দেখছি? এদের জিনিসের যা দাম, অত পয়সা কোথায় আমার কাছে?

আপনার কাছে পয়সা থাকতেই হবে, এমন কোনো কথা ছিল? রাখীকে এখন সহজ হতেই হয়। বলে, নামুন এবার।

সেজান তারপর রেস্তরাঁর কামরায় চুপচাপ বসে থাকে। আর বারবার রাখীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে একবার শুধু বলে, ক্ষুধার্ত লোককে যে এরা অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখে—এইটেই এদের খুব খারাপ নিয়ম।

ব্যস্, ঐটুকু কথা। তারপর খাবার এলে রাখী প্লেটে তুলে দেয়, সেজান চুপচাপ খেতে আরম্ভ করে।

রাখী একসময় লক্ষ করে, সেজান বোধহয় কিছু ভাবছে। বারবার তার কপালে ভুরুর ভাঁজ পড়ছে, হাতের ফর্কটা নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে একটা চিংড়ি মাছের টুকরোকে খোঁচাচ্ছে। এতক্ষণ যে সহজ ভাবটা ছিল সেটা কখন যেন উবে গেছে। রাখীর খারাপ লাগল। শুধাল, আপনার ভালো লাগছে না, তাই না?

কী? সেজান চোখ তুলে তাকায়। তারপর রাখীর চোখের ওপর খ পড়তেই তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, না না, খুব ভালো লাগছে— এখানে কখনো আগে আসিনি, তাই দেখছিলাম—তুমি বুঝি প্রায়ই আসো?

না, এখানে এই বোধহয় দ্বিতীয় বার।

ও, তুমিও তাহলে আমারই মতো আনাড়ি।

হাসে সেজান, স্বচ্ছ সহজ হাসি। রাখী সহজ বোধ করে এবার।

তুমি কি ঐ চাকরিই করবে? বেশ অনেকক্ষণ পর সেজান জিজ্ঞেস করে।

দেখি, আপাতত করছি। রাখী স্বল্প জবাব দেয়। জবাব দেয় আর অপেক্ষা করে, সেজান চাকরি সম্বন্ধে কিছু বলে কি না।

সেজান মাথা না তুলে জিজ্ঞেস করে, কেমন লাগছে চাকরি?

ভালোই, চাকরি তো সব সময়ই চাকরি।

তাতো বটেই, সেজান আবার খাওয়ার দিকে মনোযোগ দেয়।

রাখীর মনে হচ্ছিল সেজান বোধহয় জামান সাহেবের মতোই ট্রাভেল এজেন্সির চাকরি সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করবে। কিন্তু সেজান তার ধার দিয়েও গেল না। রাখীর অবাক লাগে। ভাবে একবার সোজাসুজি জিজ্ঞেস করবে। এ-ধরনের চাকরি তার নেয়া, উচিত হয়েছে কি না। কিন্তু শেষপর্যন্ত কিছু বলতে পারল না। সেই মুহূর্তে সেজানকে দেখে মনে হচ্ছিল না যে তার চাকরির ব্যাপারটায় কোনো গুরুত্ব আছে।

খাওয়া শেষ হবার পরও বসে সেজান। বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে, জায়গাটা বেশ নিরিবিলি, মনেই হয় না ঢাকা শহরের মাঝখানে বসে আছি— এই নতুন হোটেলগুলো কিন্তু বেশ হয়েছে।

রাখী বলবার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছে না তখন। সেজান কেমন যেন নিস্পৃহ চোখে চারদিকে তাকিয়ে দেখছে। ব্যক্তিগত কোনো কথাই এখন আর বলা চলে না। সে শুধু শুনে যায়। একেক সময় মনে হয়, মানুষটা বোধহয় কাছে নেই—অনেক দূর থেকে কথা বলছে।

নিজেকে না-মেলাবার মতো বিড়ম্বনা বোধহয় আর কিছু নেই। আমার কিছুতেই মিলছে না কারো সঙ্গে। একেকবার মনে হয়, সময় বোধহয় আমাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গিয়েছে। চিন্তাভাবনাগুলো পর্যন্ত তাল রাখতে পারে না। আবার একেক সময় মনে হয়—সবকিছু বোধহয় পিছিয়ে গেছে। চাকা উল্টোদিকে ঘুরলে যেমন হয়। এ খুব খারাপ অবস্থা-কীরকম পাগলা একটা সময় নির্বোধের মতো সবাইকে টেনে নিয়ে চলছে। অথচ কারো কিছু করবার উপায় নেই। আমি যাকেই বলতে যাচ্ছি-দ্যাখো, এভাবে চলবে না। বাধা দাও, কিছু একটা করো-কিন্তু কেউ আমল দিচ্ছে না আমার কথায়।

সেজান ব্যক্তিগত কথা বলছে বলে মনে হয়। কিন্তু রাখী বোঝে, এ সবই ওর রাজনীতির কথা। একবার ভাবে, বলে, আপনার নিজের কথা বলুন। কিন্তু বলতে গিয়েও থেমে যায়। সেজানের দৃষ্টি বাইরের আকাশে। আর যা বলছে, তার মধ্যে কেমন যেন একটা কোমল আন্তরিকতার ছোঁয়া টের পাওয়া যাচ্ছে—এ যেন গভীর কোনো মনোলগ। রাখীর শুধু শোনার পালা। না-শুনে কী করবে। শুনছে না শুধু, দেখছেও। এই লোক সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াবে-একজনের কাছ থেকে যাবে আরেক জনের কাছে, সেখানে থেকে আবার আরেক জনের কাছে। ক্লান্তি নেই বিশ্রাম নেই। শুধু একটাই স্বপ্ন চোখের সামনে-সব মানুষ সুখী হোক, সবার জীবন পরিপূর্ণ

হোক। আর কিছু চায় না সে। এখন বিশ্রাম নিচ্ছে, দুটি অন্তরঙ্গ কথা বলছে-এক্ষুনি আবার হয়তো পথে নেমে যেতে হবে। কী দরকার তার কথায় বাধা দিয়ে?

রাখীর চোখে চোখ পড়তেই সেজান হঠাৎ থেমে গেল। একটু বিব্রত হল বোধহয়। শেষে বলল, যাক সেসব কথা, চলো ওঠা যাক, অনেক দেরি হয়ে গেল তোমার।

রাখী ওঠে না। বলে, বসুন না, আরেকবার কফি খাই।

অনেক টাকা মাইনে পাও মনে হচ্ছে? সেজানের গলায় কৌতুক।

হ্যাঁ, তা পাই, আমার যা দরকার, তার চাইতে অনেক বেশি।

বাহ্, তাহলে তো রীতিমতো বড়লোক তুমি, আমার মতো গরিব লোকের তোমার কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়া উচিত। হাসান ভাই শুনলাম চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন? হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে ফেলে সেজান।

ইতিমধ্যে কফি এল আরেকবার। পারিবারিক প্রসঙ্গ ওঠাতে রাখী এবার ব্যক্তিগত প্রশ্ন করার সুযোগ পায়। জিজ্ঞেস করে, এবার কী করবেন? রাজনীতি, না অন্যকিছু?

সেজান বেশ শব্দ করে হেসে ওঠে। বলে, আমি আর অন্যকিছু তো পারি না, অবশ্যি রাজনীতির কী হবে এখনো কিছু বোঝা যাচ্ছে না, কিছু একটা করব নিশ্চয়ই, তবে-সেজান এ-পর্যন্ত বলে রাখীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। শেষে বলে, তবে আর যা-ই হোক, চাকরি নয়।

কেন? রাখী ঠিক বুঝতে পারে না।

আমার মতো জেলখাটা দাগী আসামিকে কে নেবে চাকরিতে বলো?

রাখী একটু অপ্রস্তুত হয়, কথাটা তোলা বোধহয় উচিত হয়নি।

একটু পর সেজান নিজের থেকেই জানায়, না বেকার নই একেবারে, একটা সাপ্তাহিক কাগজে ছোটমতো একটা কাজ জুটেছে।

বাসা কোথায়? নাকি সেই পুরনো মেস?

সেজান এবার হো হো করে হেসে ওঠে। বলে, তুমি দেখছি ডিআইবি’র লোক একেবারে— পেটের সব কথা বার করে নিতে চাও।

সেজানের ঐরকম আচমকা হাসিতে রাখীর খারাপ লাগে। সেজান তার সঙ্গে ঠাট্টা করছে তাহলে। ভেবে বসে আছে, সে এখনো ফার্স্ট ইয়ারের ছোট্ট মেয়েটি। কিছুটা গম্ভীর হয়ে সে ফের বলে, বাসার ঠিকানা জানবার জন্য নয়, এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম।

যেখানে থাকি সেটা অবশ্যি বাসাও বলতে পারো, সেজান এবার হাসে না। ধীর গলায় বলে, তবে ঘর বলাই ঠিক-লক্ষ্মীবাজারের কাছে একটা কামরা পেয়েছি-আপাতত ওতেই চলে যাচ্ছে।

এবার তাহলে লেখা-টেখা আরম্ভ করবেন?

সেজান বাইরের দিক থেকে নজর না-ফিরিয়েই হাসে। বলে, দেখি, কী করা যায়।

বিকেলটা কী আশ্চর্য। রাখী বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবে, সে যখন নিঃসঙ্গ আর একাকী বোধ করছিল তখনই সেজানের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কতদিন পর দেখা ভাবতেই অবাক লাগে। আরো অবাক ব্যাপার, মানুষটাকে যেমন ভেবেছিল, তেমন নয়। আগে দূর থেকে দেখেছিল, কিছুটা সঙ্কোচ ছিল, মনে হত, লোকটা বোধহয় রাখীর মতো মেয়েকে পাত্তা দেবে না। অথচ আজ লোকটার সঙ্গে এতক্ষণ সময় কাটল তার। এত গম্ভীর আর ভরাট লোকটার গলার স্বর-ওর কথা বললে একেবারে বুকের ভেতর গিয়ে বাজতে থাকে।

ঐ ফেরার পথেই রাখী একবার হেসে উঠল আপনমনে। কোথায় সে অফিস থেকে বেরিয়েছিল জামান সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাবে বলে আর কোথায় সে সারাটা বিকেল কাটিয়ে দিল সেজানের সঙ্গে।

বাসায় যখন ফিরল তখন সন্ধ্যা হয় হয়। বুবু জিজ্ঞেস করে, কোথায় গিয়েছিলি? হাসান খুঁজছিল তোকে। অফিস থেকে নাকি তিনটের সময় বেরিয়ে গিয়েছিস?

রাখী বুবুর মুখের দিকে তাকিয়ে একটুখানি হাসে। সিঁড়ির মুখে দেখা হয় হাসান ভাইয়ের সঙ্গে।

কী খবর ম্যাডাম, আজ অফিস ফাঁকি দিয়েছ শুনলাম?

কে বলল, মাজহার সাহেব? রাখী গম্ভীর হয়।

আরে না, ঠাট্টা করলাম। মাজহারকে অন্য কাজে টেলিফোন করেছিলাম-কথায় কথায় তোমার কথা জিজ্ঞেস করতেই জানাল তুমি নাকি তিনটের সময় আজ ছুটি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছ।

জানো বুবু, সেজানের সঙ্গে দেখা হল আজ, একটু পর রাখী জানায়।

সেজান, মানে মনির বন্ধু?

হ্যাঁ, রাস্তায় হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।

রাখী লক্ষ করে, হাসান ভাই গম্ভীর হয়ে গেল হঠাৎ।

কিছু বলল? দেখা করে না কেন?

বুবুরও তাহলে কৌতূহল আছে সেজানের ব্যাপারে। রাখীর অবাক লাগে বুবুর কথায়। বলে, না, তেমন কিছু না, এমনি খবরাখবর জিজ্ঞেস করল।

হাসান কাছে এসে দাঁড়ায় কী মনে করে। বলে, ম্যাডাম কিছু মনে কোরো না, তোমাকে একটা কথা বলি—তুমি এখন একটা ফার্মের প্রতিনিধি-এখন ওসব মানুষকে তোমার এড়িয়ে চলা উচিত-কখন পুলিশ এসে দুটো কথা বলে যাবে তোমার বস-এর কাছে, তাতে মিছিমিছি ঝামেলা হবে।

বা রে, বুবু অবাক হয়। বলে, তাই বলে চেনা মানুষের সঙ্গে দুটি কথা বলবে না।

চাকরি ইজ চাকরি-কোনো এমপ্লয়ি পলিটিক্যাল লোকের সঙ্গে কথা বলবে আর তার ফলে পুলিশ আসবে ফার্মে, এটা কে পছন্দ করবে, বলো?

রাখী কিছু বলে না। শুধু হাসান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। হাসান ভাই আজকাল চেহারায় ভারিক্কি হয়ে যাচ্ছে। কথায় কথায় আজকাল উপদেশ দিতে আসে। রাখী বারান্দা থেকে সরে এল।

বিকেলটা বেশ লেগেছিল রাখীর। কেমন শান্ত আর পরিপূর্ণ। হাসান ভাইয়ের কথা শোনার পর তার বিশ্রী লাগতে আরম্ভ করল, ক্লান্তিতে মন ভরে উঠল। নিজের ঘরে গিয়ে রাখী উপুড় হয়ে বালিশ জড়িয়ে শুয়ে থাকল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *