ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

পূর্বরাত্রি পূর্বদিন – ৮

আট

গভর্নিং বডির মিটিং পরের দিন। আগের দিন রাখী দুপুরবেলা লাইব্রেরি থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছে— ঠিক এই সময় ক’টি মেয়ে এসে সামনে দাঁড়াল। কী ব্যাপার তোমাদের? রাখীকেও দাঁড়াতে হল।

আপা আমাদের মাফ করে দিন।

রাখী লক্ষ করল মেয়ে ক’টির মুখ অনুশোচনা আর সঙ্কোচনে ভয়ানক মলিন। সে পাল্টা শুধাল, কিসের মাফ? কী হয়েছে?

আপা, মাফ করতে হবে, না হলে আমরা ছাড়ব না, আপনি বলুন, মাফ করেছেন-

রাখী সামনের দিকে তাকাল। সামনে মাঠ তারপর রাস্তা। তার ওপারে হলুদে সবুজে মেশানো ফসলের ক্ষেত, তারপরে একেবারে দিগন্ত আর আকাশ। না, খুশি নয়, রাখীর মনের ভেতরে কষ্ট হতে লাগল। সে এক এক করে মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল- এর নাম বীনু, ভীষণ কথা বলে মেয়েটা— আর এ হল সেই দুষ্টু মেয়ে যে রাখীর গলা নকল করে বন্ধুদের হাসায়। ওদিকে বোধহয় সোনিয়া দাঁড়িয়ে- ডাক্তারের মেয়ে, সাজতে খুব ভালোবাসে। আর সাকিনা কোথায়? সাকিনাকে দেখল সবার পেছনে দাঁড়িয়ে— তার পাশে রোকেয়া।

অনুমান হল, কোথাও কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কৌতূহল নেই তার, সে কিছুই জিজ্ঞেস করল না। বরং গলায় কৌতুক আনল- এই মেয়েরা, কী হয়েছে তোমাদের এ্যা? কাঁদবে নাকি তোমরা? দ্যাখো কেঁদো-টেদো না বাপু- কাউকে কাঁদতে দেখলেই আমার আবার ভীষণ কান্না পায়।

রাখীর ঐ কথায় কী যে হল। মেয়েরা বোজা মুখে এ ওর গলা জড়িয়ে ধরে একসঙ্গে ফুঁপিয়ে উঠল।

রাখী হাসতে চেয়েছিল। চেয়েছিল হালকা মেজাজ তৈরি করে মেয়েদের মনের ভারটা কাটিয়ে দেবে। কিন্তু ঐ হালকা মেজাজের কথাই উল্টো ব্যাপার ঘটিয়ে দিল। মেয়েদের কাঁদতে দেখে রাখীর নিজের বুকের ভেতরেও কোথায় ছটফট করে উঠল কেউ। এ কোন্ কান্না? এরই নাম কি তাহলে ভালোবাসা? অনেকদিন আগে যে আব্বার কোলে মুখ গুঁজে রাখী নিঃশেষে কেঁদেছিল— এ কি সেই কান্না? রাখীর মন কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। সে কোনো কথা বলতে পারে না। মেয়েদের পাশ কাটিয়ে তখনকার মতো সে বাসায় চলে এল।

এসব অভিজ্ঞতা রাখীর ছিল না। মনের খুব ভেতর থেকে উঠে আসা এরকম সম্মিলিত কান্না আগে সে কখনো দেখেনি। গত ক’দিনের জ্বালা, অপমান, হতাশা, ক্ষোভ সব একসঙ্গে মেশামেশি হয়ে গেল মেয়েদের ঐ কান্নার সঙ্গে। সে নিজেও কি কেঁদেছিল। রাখী বলতে পারবে না। কিন্তু ভারি গভীর, শান্ত অথচ আভাময় এক বিচিত্র অনুভূতিতে তার বুকের ভেতরটা ভরে যেতে লাগল।

গভর্নিং বডির মিটিঙে রাখীর ব্যাপারটা উঠতেই প্রিন্সিপ্যাল সাহেব একশো- জন অভিভাবকের স্বাক্ষর-করা একখানা দরখাস্ত পেশ করলেন আর অন্যদিকে জাহানারা শহরের মহিলাদের স্বাক্ষর-করা আরেকখানা দরখাস্ত সবার চোখের সামনে মেলে ধরল। হুমায়ুন জানাল, ছাত্রীরাও আমার কাছে একখানা আবেদনপত্র পাঠিয়েছে- দরকার হলে সেটাও দেখতে পারেন আপনারা, এরপর যদি গভর্নিং বডি বাইরের ষড়যন্ত্র প্রশ্রয় দেয়, তাহলে ব্যাপারটা অনেকদূর গড়াবে- আর তাতে শেষপর্যন্ত কী দাঁড়াবে বলা মুশকিল। নিজামউদ্দিন হুমায়ুনের দিকে তাকায়, ইজিট এ থ্রেট?

হুমায়ুন শান্তমুখে বলে, ইচ্ছে হলে বলতে পারেন, ভবিষ্যতের কথা কিছু কি বলা যায়? ঢাকা শস্ত্র নিয়ে সরকার ব্যতিব্যস্ত হয়ে রয়েছে, এখন মফস্বলগুলোতেও যদি ডিসটার্বেন্স শুরু হয়ে যায়— সেও শুধুমাত্র দুএকজন লোকের ফুলিশনেস-এর জন্যে-সেটা সম্ভবত সরকার সহ্য করতে চাইবে না।

নিজামউদ্দিন আনোয়ার সাহেবের দিকে তাকায়, আনোয়ার সাহেব গম্ভীর হয়ে থাকে। মীর জাহান চৌধুরী হাসি-হাসি মুখে সবার মুখের দিকে ঘনঘন তাকায়। কলিমউদ্দিন শেষ মন্তব্য করে, আপনারা কিন্তু রাখতে পারবেন না মহিলাকে। আই ক্যান অ্যাশিওর য়ু- শি মে বি সট্ বাই দ্য পোলিস ফর আদার রিজনস্।

হুমায়ুন হাসে। বলে, সরকার যদি মেয়েমানুষকে অহেতুক হয়রানি করে বীরত্ব বোধ করতে চায় তো কার কী করার আছে বলুন।

নিজামউদ্দিন দাঁতে দাঁত চাপে হুমায়ুনের কথা শুনে। বলে, হুমায়ুন সাহেব কি সরকারের বীরত্বটা দেখতে চান? চাইলে দেখাতে পারব আমরা।

তাতো অবশ্যই পারবেন- হুমায়ুন হাসে, কিন্তু চোখের নজরটা সরায় না। বলে, আপনিই তো সরকারি কর্তা এ জায়গায়-সেই সুবাদে সরকারের বীরত্ব বলুন, কাপুরুষতা বলুন- সবকিছু দেখানোর দায়িত্বটা তো আপনারই— তা দেখান একটু-আধটু, আমরা কিছুটা ভয় পেতে চেষ্টা করি। ফয়সালা হল না কিছু— ব্যাপারটা ঝুলিয়ে রাখল নিজামউদ্দিন। জানাল, এ ব্যাপারে একটা তদন্ত কমিটি বসুক, কমিটির রিপোর্ট পাওয়া গেলে তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। ইতিহাসের অধ্যাপিকা নিয়মিত কাজ করতে থাকুন।

.

খুশির খবরটা জাহানারা বাড়ি বয়ে দিতে গেল। তো গিয়ে দেখে, রাখী বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। কী ব্যাপার, তুই যে অবেলায় শুয়ে? জাহানারার গলায় ঈষৎ উদ্বেগ প্রকাশ পায়।

রাখী উঠে বসল শিথিল শরীর গুটিয়ে নিয়ে। বলল, কী ব্যাপার, তুমি হঠাৎ?

প্রাণের দায় যে— না এসে পারি? শোন, তোর ফাঁড়াটি আপাতত কাটানো গেছে।

রাখী শুনল। কিন্তু ওতে যেন তার আগ্রহ নেই। বলল, তার মানে ক্লাসে যাব কাল থেকে, এই তো?

শুধু কি তাই? জাহানারা রেগে ওঠে। ভালো একটা খবর দিলাম, তা মন উঠল না বিবির। শোন্, তুই আর রাতবিরেতে এখানে-ওখানে যাস না। পুলিশ লেগেছে তোর পেছনে। রাজনীতি করিস এই দায়ে জেলে পর্যন্ত পুরতে পারে ওরা। নিজামউদ্দিন সাংঘাতিক খেপে রয়েছে তোর ওপর। এখন তোর সম্পর্কে খোলাখুলিই কথা বলে।

জাহানারার পরের কথাগুলোও রাখী শুধু শুনলই, কানে নিতে পারল না। সুমিতার চিঠি কম আসে আজকাল। কিন্তু তবু আসে। বরং রাখীর দিক থেকেই জবাব যায় না। তো রাখী একদিন লিখল- সুমি, ভেবেছিলাম, আমি বোধহয় এ জায়গায় থেকে যাব— তুইও সেই কথা লিখেছিলি, আব্বাও লিখেছিলেন, কিন্তু মজা দ্যাখ্, সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না। আসলে আমার কপালটাই খারাপ, দ্যাখ, নইলে আমার কেন থাকবার মতো জায়গা হবে না কোথাও, বল্? তুই অনেকের ভালোবাসা পেয়ে শুয়ে বসে দিন কাটিয়েছিস কখনো? আমার ঐরকম দিন কাটছে। কলেজের মেয়েরা আমাকে এত ভালোবাসে যে তুই না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবি না। কিন্তু তবু বোধহয় আমাকে ফিরেই যেতে হবে। একটার পর একটা ক্লিক হচ্ছে। কলেজ যারা চায় না, বারবার তারাই আমাকে স্কেপগোট বানাচ্ছে। এভাবে আর কত পারা যায় বল্?

চিঠিতে লেখা থাকে না, কিন্তু নিঃসঙ্গতার ভাবটা বেশ বোঝা যায়। সুমি চিঠিতে সেকথা উল্লেখও করে। জানায়— তোর চিঠিতে আবার সেই পুরনো হতাশা- রাখী, এমন চিঠি তো আগে লিখিসনি কখনো। তবে কি তুই গোলমাল পাকিয়েছিস কোথাও? নইলে ক্লিকের জন্যে তুই হতাশ হয়ে সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে আসবি- এমন মেয়ে তুই, বল্? আমি তোকে চিনি না মনে করিস! হ্যাঁ রে, সেজানের কথা লিখিসনি কেন? এখন কেমন আছে? বলবি টেনশন অ্যাভয়েড করতে, ভালো করে ঘুমোতে আর দুধ খায় যেন, যথেষ্ট পরিমাণে। রাখী, সেজান হল সেই রকমের একজন লোক- যাকে সবাই ভুল বুঝবে। আর সেজন্যেই দেখবি, লোকটা একদিন নিঃশেষ হয়ে ফুরিয়ে যাবে। ওর জন্যে আমার একেক দিন বেশ চিন্তা হয়।

সুমির চিঠিতে কেন সেজানের কথা অত বেশি করে লেখা থাকে, রাখী বুঝে উঠতে পারে না। অনুমান হয়, কে জানে, হয়তো সুমি আবার রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছে-তাই তার চিঠিতে কোনো-কোনো জায়গায় রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই থাকে না। যেমন- এবার দেখিস, খুব জোর আন্দোলন হবে একটা— না হয়ে পারে না। এখানে এমন অত্যাচার শুরু হয়েছে না— থাকলে বুঝতিস, মোনেম খানের পেটোয়া গুণ্ডাদের দিয়ে তৈরি এনএসএফ কী জিনিস। গয়নাগাঁটি পরে সন্ধ্যার পর কোনো মেয়ের একলা পথ চলা দারুণ বিপজ্জনক। য়ুনিভার্সিটির একটি মেয়েকে ক’দিন আগে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে রেপ করল। একটি বউ গুম হয়ে গেল— এখানে ওখানে ছুরি মারছে। এত কাণ্ড কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। ভয়ে যেন সিঁটিয়ে আছে সবাই। কিন্তু দেখিস, দারুণ একটা কিছু ঘটবে, এভাবে চলতে পারে না।

সুমিতার চিঠির ঐসব খবর রাখীকে ভাবায় না। কারো সঙ্গে ঐসব খবর নিয়ে আলাপ-আলোচনাও হয় না। কিন্তু তবু রাখীর কেমন যেন মনে হয়, সুমির অনুমান সম্ভবত মিথ্যে নয়। বাইরে চাপা, শান্ত একটা ভাব থাকলেও ভেতরে ভেতরে কোথায় যেন একটা প্রস্তুতি আরম্ভ হয়েছে অনেক দিন আগে থেকে। শুধুই তলে তলে ক্ষয়ে যাবে, বাইরে আর কোনোই চিহ্ন দেখা যাবে না— এ কি হয় কখনো? রাখীর মন বলছে- আসবে সেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণটা। আব্বার সংসার ভেঙেচুরে ছত্রখান হয়ে গেল, তার নিজের দাঁড়াবার জায়গা থাকল না— শুধুই নিঃশেষ হওয়া, শুধুই ফুরিয়ে যাওয়া- বিরতিহীন, একটানা— এমন অবস্থা চলতে পারে না। লোভের, প্রতারণার, চক্রান্তের আর বিশ্বাসহীনতার চেহারা যত বড়ই হয়ে উঠুক- তারও একটা সীমা আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *