ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

কুলায় কালস্রোত – ৩

তিন

ঐসময় একেক দিন একাকী শুয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন মনে হয়, ঘরের ভেতরে বোধহয় আরো কেউ নিশ্বাস ফেলেছে। আরো যেন কেউ আছে কাছাকাছি। নির্জন দুপুরে, নিঃসঙ্গ বিকেলে, কিংবা একাকী বিছানায় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে ঐরকম মনে হয়। একেক সময় মনে হয়, তার শরীরের অনেক ভেতরে কোথায় যেন কে একজন অন্ধকারে ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটছে। কাকে যেন কোথায় কে ডেকে উঠল। ঘুম আর জাগরণের মাঝখানে, ধূসর নিবিড় অনুভূতির মধ্যে, একেক দিন মনে হয়, কে যেন খুব ধীরে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে।

বলে না সে এসব। বলার কোনো মানে হয় না বলেই সে এসব কখনো বলেনি জামানকে। বিছানায় শোয়ার সময়কার ঘেন্নার কথা যেমন বলা যায় না— এও যেন তেমনি। কোনোমতেই বলা যায় না।

একদিন জামান পুরনো পিলের কৌটো ছুড়ে ফেলে দিতে গিয়ে অবাক। দেখে কৌটোর তলায় তিন-চারটে পিল তখনো রয়েছে। এর মানে? সে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকায়।

শান্ত হাসে রাখী। না লজ্জা নয়, লজ্জা পায়নি তার। বলে, আর দরকার হবে না ওসবের।

কী বলছ তুমি পাগলের মতো! জামানকে তখন বেশ উদ্বিগ্ন দেখায়। রাখী দেখে, কিন্তু কিছু বলে না।

দ্যাখো তো কী বিশ্রী ব্যাপার হয়ে গেল, আমার সব প্ল্যান গেল উল্টেপাল্টে। ভয়ানক ক্ষুব্ধ দেখায় তখন জামানের চেহারা।

কীরকম? তখন হাসতে চেষ্টা করে রাখী।

বাহ্, এই সময় কী দরকার ছিল বলো তো। মাত্র তো ক’টি মাস হল বিয়ে হয়েছে। কিছুদিন পরে যদি হত তাহলে-

রাখীর দিকে তাকিয়ে জামানের ক্ষোভ থমকে যায়। কোনোরকমে বলে, তাছাড়া ও যখন হবেই, তখন ও যত দেরিতে হয় ততই ভালো, তাই না, বলো?

রাখী তখন জামানকে ভালো করে দেখে। দেখে, জামান কীরকম হিশেবি। জামান একটু পর আরো হিশেবের কথা শোনায়। বলে, স্কলারশিপের ব্যবস্থা প্রায় হয়ে এসেছে, কোথায় বিদেশে গিয়ে ডিগ্রি আনব, মাঝখান থেকে এই ফ্যাসাদ বেধে গেল।

রাখী নিজে আহত হয় না। বরং জামানের জন্যে দুঃখ হয় তার। আহা বেচারা, সত্যি তো কী মুশকিলেই না পড়বে জামান। শেষে সে জামানকে বুঝিয়ে বলল, দ্যাখো, দোষ আমারই। পিল খাওয়ার নিয়মটা অভ্যেস না হওয়াতেই এমন হয়েছে। তুমি ভেবো না, আমি সব ঠিক করে নেব। রাখীর কৈফিয়ত অপরাধীর কৈফিয়তের মতোই শুনিয়েছে। আর স্ত্রীর মুখে ঐ কথা শুনে হুঁশ হয়েছে জামানের। নিজের রূঢ় ব্যবহারের জন্যে মাপ চাইতে অধীর হয়ে উঠে এসেছে কাছে। আর সেই ব্যাকুল হয়ে উঠে আসবার মুহূর্তটিতেই রাখীর ভীষণ ঘেন্না লেগেছে জামানকে।

আর সেই হল রাখীর নিজেকে লুকানোর শুরু। রাখীর আর নিজেকে মেলবার জায়গা নেই যেন।

একদিন দুপুরবেলা সুমিতাকে গিয়ে ধরল। বলল, একটা অ্যাবরশনের ব্যবস্থা করে দে।

সে কী রে, সুমি চোখ কপালে তোলে, তুই কি পাগল হয়েছিস? এখন বাচ্চা না হলে আর কখন হবে। এ বয়সে দুটি-একটি বাচ্চা না থাকলে কি মানায়?

রাখী হাসে। বলে, তুই কী বুঝবি-বিয়ে তো করিসনি -বিয়ের এন্‌জয়মেন্টাই—

রাখী আরো কিছু বলবার আগেই সুমিতা চিৎকার করে ধমকে ওঠে, রাখী! রাখী দেখে, সুমিতা তার মুখের দিকে বিচিত্র চোখে তাকিয়ে আছে। বলে, রাখী তুইও শেষপর্যন্ত ঐসব আজেবাজে কথা বলতে শুরু করলি। মুখপুড়ি, কথাটা বলতে লজ্জা করল না তোর। বেহায়া কোথাকার!

সুমিতার রাগ দেখে রাখীর আরো হাসি পায়। বলে, প্রেম করে বিয়ে কর্, তখন বুঝবি, বেহায়া হওয়াটাও কীরকম মজার জিনিস।

রাখী অনেক অনুরোধ করেছিল, সুমিতা কান দেয়নি তার কথায়। শেষে বলেছে, দ্যাখ্ রাখী, মাথায় এসব কে ঢুকিয়েছে জানি না, তবে শুনে রাখ, আমি ডাক্তার হিসেবে বলছি, বাচ্চা হলে সেক্স কমে না। সেক্স আরো বেশি উপভোগ্য হয়।

রাখী এসব কথা শোনার সময়ও মনের ভেতরে হেসেছে। সুমিতা কাকে যে কী বলছে। রাখীর মনের ভেতরে কেউ যেন বলতে থাকে, আচ্ছা সুমি তুই প্রেম করলি না কেন বল্- তোর বর যদি আরেকটা বিয়ে করতে পারে, তাহলে তোর প্রেম করতে বাধাটা কোথায়? তুই কি কানের টবটা নতুন কিনেছিস? চুনী পেলি না? লাল বড় বড় চুনী হলে বেশ লাগত তোকে।

সুমিতা তখন বলেই চলেছে, দ্যাখ্ আমাদের দেশে মেয়েদের জীবন এরকমই— ইরেস্পনসিবল আমরা হতে পারি না- যতই পাস করি, যতই টাকাপয়সা হোক, স্বামী-সন্তান নিয়ে আমাদের থাকতেই হয়— নিজেদের বাঁচাবার জন্যেই আমাদের হিউম্যান রিলেশান দরকার, বিচ্ছিন্ন হলে মেয়েদের কিছুই থাকে না-

রাখী বেশিক্ষণ থাকলে আরো বোধহয় বকবক করত সুমিতা। রাখী সে সুযোগ দিল না। বলল, চলি এবার- তোর মতো ডাক্তারের পাল্লায় যে রোগী পড়েছে তার অবস্থা শেষপর্যন্ত কী হয়েছে, বেশ বুঝতে পারছি। এই বলে সে চলে এসেছে। আর বাচ্চা নষ্ট করার চিন্তাটা বাদ দিয়েছে। জামানকে জানিয়ে দিয়েছে, বাচ্চাটা তার হওয়া দরকার।

জামান ডাক্তার দেখিয়েছে। একসময় বলেছে, তোমার আব্বাকে খবর দিই। রাখী বাধা দিয়েছে তখন। বলেছে, থাক না, এসবের মধ্যে আব্বাকে আবার কেন। আর এত তাড়াই বা কিসের? পরে হবে সব।

রাখীকে যেন কিছুই স্পর্শ করে না। বাইরের পৃথিবী যেমন ইচ্ছে তেমন হোক সেখানে তার কিছুরই প্রয়োজন নেই যেন। সে নিজেরই ভেতর ডুবছে তখন।

সে কান পেতে অনুভব করে একেক দিন। একটুখানি কী যেন হঠাৎ কেঁপে ওঠে শরীরের অতি গোপনে কোথায়। তারপর সেই কাঁপনটুকু তরঙ্গের পর তরঙ্গ হয়ে কেবলি ছড়াতে থাকে সারা শরীরে। বুকের ভেতরে কাঁপুনিটা পাক খায়। শরীরের একেবারে ভেতরে কোথায় যেন দুমড়ে-মুচড়ে ওঠে আর কী যেন গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। ইচ্ছা-অনিচ্ছা সবকিছু ছাপিয়ে সর্বক্ষণ জেগে থাকে কাঁপুনিটা। একেক দিন মনে হয ভীষণ অসুখ করেছে তার। বেদম বমি করে কোনো-কোনোদিন। খেতে ইচ্ছে করে না কিছু।

জামান প্রায়ই কাছে এসে বসে, খোঁজ নেয়, যত্ন নিতে চেষ্টা করে। তারপর আবার বেরিয়ে যায়। তার বেশ তাড়া আজকাল, রিসার্চের কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করা দরকার। বিদেশ যাওয়ার সুযোগ এই এল বলে। সে এখন কর্তাব্যক্তিদের সুনজরে রয়েছে, গভর্নর হাউসের সঙ্গে তার পোক্ত যোগাযোগ, এ অবস্থায় সুযোগ-সুবিধাগুলো হেলায় হারানোর মতো বেকামি আর কিছু হতে পারে না।

রাখীকে অসুস্থ শরীরে শুয়ে থাকতে হয়। ওষুধ খেতে ইচ্ছে করে না। কীরকম একটা শিথিল ক্লান্তি সর্বাঙ্গে জড়ানো থাকে। ঘুমোতে চেষ্টা করে, কিন্তু ঘুম আসে না। থেকে থেকে একেক দিন সেই পুরনো ভাবনাটা জেগে ওঠে— রাখী, এই কি তুই হতে চেয়েছিলি? ছায়ার মতো মনি ভাইয়ের মুখ মনে পড়ে— আব্বার কথা ভাবে। আব্বা যদি জানতে পারেন, তাহলে খুব অস্থির হবেন। বুবুর কথা মনে পড়ে। পারভিনটা আসে না, যদি আসত। একেক সময় মনে হয়, হ্যাঁ একেক সময়, ক্ষণিকের জন্যে শুধু, তারপর আর মনে থাকে না। মাজহারকে মনে পড়ে। মনে পড়ে সেজানকে। সেজান যদি দেখে তাকে। যদি ও শুনতে পায় রাখী মা হতে যাচ্ছে, তাহলে কী বলবে সেজান?

সে জানে না, কেন সেজানের কথা মনে হলেই ভীষণ রাগ হয় তার। কোনো মানে হয় না, তবু। মনে হয়, সেজানই যেন সকল সর্বনাশের মূল। মনি ভাই থেকে শুরু- সেই যে কী এক সর্বনাশের বীজ পুঁতে দিয়েছিল তাদের সংসারে। সবকিছু ভেঙেচুরে ছত্রখান হয়ে গেল। মনি ভাই চলে গেল, বুবু সবকিছু হারাতে বসেছে। আব্বা যেন থেকেও নেই। আশা থেকে, উদ্যম থেকে, বিশ্বাস থেকে, সবাই কেমন যেন আলগা হয়ে যেতে থাকল। সে নিজেও কেমন একটা ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে গেল। পড়াশোনা শেষ হল, ওভারসিজ-এর চাকরি, জামান, বিয়ে- সবকিছু কেমন যেন তালগোল পাকানো। কেন এমন হল, সে বলতে পারবে না। কিন্তু কেবলই তার মনে হয়, শুরুতেই আছে কোনো একটা ভয়ানক সর্বনাশের বীজ। আর সেখানে সেজান ছাড়া আর কেউ নেই। সেজান তার শত্রু।

একেক দিন আবার তার চিন্তা উল্টো খাতে বয়। ভাবে, যদি সেজান অন্যরকম হত, যদি মাজহারের মতো, কি জামানের মতো, কিংবা হাসান ভাইয়ের মতো— যদি হত, তার মনে হয়, তাহলে যেন স্বস্তি পেত সে। কেন স্বস্তি পেত, কেন স্বাভাবিক লাগত, সেসব কারণ রাখী খুঁজে পায় না। কিন্তু মনে হয়, ঐরকম হলে তার ভালো লাগত।

এই উল্টো খাতে বওয়া চিন্তারও ঠিক নেই। একেকবার সন্দেহ হয় নিজেকে। তবে কি সেজানকেই ভালোবেসে এসেছে সে এতদিন? সে কি কিছু একটা বলবার জন্যেই সেজানের কাছে বারবার করে গিয়েছিল? যদি গিয়েছিল, তাহলে সেজান কেন সেটা বুঝতে পারেনি? কেন তার অস্পষ্ট ভাবনাটা স্পষ্ট করে তোলেনি? কেন এগিয়ে এসে হাত ধরল না। কেন শাসন করে বলল না, তুমি ঐ চাকরি করতে যেও না। কেন জানাল না, রাখী আমি তোমাকে ভালোবাসি।

ঠিক নেই, কিছুরই ঠিক নেই। ঘৃণা বলো, ভালোবাসা বলো, রাগ বলো, প্রেম বলো, কোনোকিছুরই ঠিক নেই। মানুষের মনের ভেতরে কোথায় যে লুকিয়ে থাকে সবচাইতে অচেনা ইচ্ছেটা, কেমন করে যে তা ফুলতে থাকে রাগে, কেমন করে সে আবার স্রোতের মতো ভালোবাসা হয়ে বয়ে যায়, কিছুই বলা যায় না। কে জানে, হয়তো সে মাজহারকেই ভালোবেসেছিল- কিংবা সেই ছেলেটিকে, কী যেন নাম তার, তাকেই সে নিজের অজ্ঞাতে ভালোবেসে এসেছে। জামান শুধু একটা অজুহাত মাত্র, একটা অবলম্বন শুধু। জামান তাকে লুঠ করে নিয়েছে। ঘনিষ্ঠ হয়ে তার শরীরকে জাগিয়ে দিয়ে রাখীকে নিজের জগৎ থেকে বাইরে বার করে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। যদি সেদিন বিকেলে জামানের বাড়ি না যেত, যদি তখন মনে বিষাদ আর শরীরের জাগরণ না ঘটত, তাহলে জামান তার কাছে কে? তাহলে জামান, মাজহার, সবাই তো তার কাছে একই রকম অস্তিত্ব। জামান যা করেছে, সেইরকম মাজহারও করতে পারত। সেও লুঠ করে নিত রাখীকে। আর মাজহারই যদি তার জীবনে আসত, তাহলে আজ যে পরিণতিতে এসে পৌঁছেছে, সেই পরিণতিতে কি সে পৌঁছত না? তাহলে? রাখীর চিন্তা একেক দিন আর সামনে এগোবার পথ পায় না।

এমনি এলোমেলো ভাবনা আসতে লাগল রাখীর মনে। দিনের পর দিন, নির্জন, একাকী ক্লান্ত, দীর্ঘ দিনের পর দিন।

শেষে একদিন পারভিন এল।

এসেই অবাক। এ কী চেহারা হয়েছে তোমার!

রাখী ওর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল, তুই, এ পথে?

রাখীর শরীরের দিকে তাকিয়ে কী যেন খুঁজে দেখে পারভিন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। রাখী বাধা দেয় না, শান্ত গলায় শুধায়, কবে থেকে রাখী আপা, ক’মাস?

সে খোঁজে তোর কী দরকার!

রাখীর হালকা ভঙ্গিতেও কিন্তু পারভিন সহজ হতে পারে না। বলে, রাখী আপা, তোমার শরীর খুব খারাপ হয়েছে।

রাখী আমল দেয় না। বলে, তোর যত বাড়াবাড়ি, এরকম হয়।

পারভিন অনেক খবর শোনাল। তার নতুন নতুন দিগ্বিজয়ের কাহিনী। য়ুনিভার্সিটির কামাল সাহেব এমন শুরু করেছেন যে, ঢাকা ছেড়ে পালাতে হবে তাকে, ইউনাইটেড ব্যাংকের চাকরিটা শুধু তার নেয়ার অপেক্ষা। রেডিওর বড়কর্তা চাকরিতে ঢোকাবার জন্যে ভয়ানক সাধাসাধি করছে। একেকটা মানুষের কী অবস্থা, যদি দেখতে রাখী আপা।

রাখীর হয়তো একসময় এসব কথায় বিরক্তি লাগত। আজ লাগল না। সে পারভিনকে দেখে ভালো করে। বেশ তো আছে পারভিন- আনন্দে আছে, খুশিতে আছে, মনের ভেতরে কোথায় যেন ওর আত্মবিশ্বাস আছে বলে মনে হয় তার।

পারভিন আরো খবর বলল। হাসান ভাইয়ের কোম্পানি কেমন সাঁ সাঁ করে ফেঁপে উঠছে, হায়দার অ্যান্ড সন্স-এর সঙ্গে যোগ দিয়ে হাসান ভাই এখন পশ্চিম পাকিস্তানের শহরগুলোতে পর্যন্ত হাত বাড়াতে চাইছেন। এইসব নানা কথা একের পর এক বলে যেতে লাগল পারভিন। শেষে হঠাৎ রাখীর চোখে চোখ রেখে শুধাল, তুমি জামান ভাইকে মাজহারের কথা বলেছ?

রাখী বুঝতে পারে না। অবাক হয়ে বলে, কেন ওকে বলবার কী হয়েছে- আর তুই বা কোত্থেকে জানলি?

বাহ্, তুমিও যেমন, পারভিন হেসে উঠে। বলে, হাসান ভাই সব জানত। তোমার কথা সব আমাকে বলেছে।

রাখীর রাগ হয় না হাসান ভাইয়ের ওপর। যেন জানত, হাসান ভাইয়ের জানবারই কথা সেসব। শুধু হাসান ভাই কেন, বিশ্বসুদ্ধ লোকের জানবার জন্যে যেন সেসব ঘটনা ঘটেছে।

পারভিন একটু থেমে আবার বলে, নার্গিসের সঙ্গে দেখা হয় তোমার? নিশ্চয়ই হয় না। ও এখন ওভারসিজ-এ তোমার জায়গায় বসছে। নার্গিসের এখন একপাল বয়ফ্রেন্ড। ওদের কেউ কেউ জামান ভাইকে ক্লাবে নিয়ে যায়। আজকাল তুমুল আড্ডা চলে সেখানে। সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার।

কেন, বিচ্ছিরি কেন? ক্লাবে আবার বিচ্ছিরি ব্যাপার কেমন করে হবে? রাখীর অবাক লাগে।

তুমি ভারি বোকা রাখী আপা! ঢাকায় মানুষ হয়েছ, কিন্তু কিচ্ছু দ্যাখোনি। এইসব প্রাইভেট ক্লাবগুলোতে কী হয় জানো? একদিন দেখে এসো গিয়ে। আমি তো সেদিন গিয়ে দেখি এলাহি কাণ্ড একেবারে। মদ, নাচ, জুয়ো কিছুরই বাদ নেই। দেখলাম জামান ভাইয়ের সঙ্গে মাজহারের ভয়ানক খাতির। ঐ দেখে আমার মুণ্ডু ঘুরে গেছে। আচ্ছা, পারভিন এবার থামে। বলে, তুমি জামান ভাইকে বকে দিতে পারো না? মাস্টার মানুষ, কী দরকার ঐসব মদ আর জুয়ার আড্ডায় গিয়ে? তুমি এবব একটু রাশ টানো রাখী আপা, কিছু বলা যায় না।

পারভিন চলে গেলে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবে রাখী। ভাবে, কিন্তু আমল দেয় না। যেন জামান কেউ নয় তার, অপরিচিত দূরের কোনো মানুষ। মনে হয়, পারভিন হয়তো আরো অনেক কিছু জানে। তার শরীর খারাপ দেখে সবকিছু খুলে বলতে পারেনি। রাখীর একটুখানি হাসিও পায়। পারভিনটা যে কী— সব কথা খুলে বললে রাখীর যেন খুব কিছু একটা এসে যেত।

জার্মানকে ঐসব কথা জিজ্ঞেস করার প্রবৃত্তি হল না রাখীর। তাছাড়া সময় ও পাওয়া যায়নি। ঐদিন বিকেলবেলাতেই আব্বা এলেন, সঙ্গে বুবু। বুবু রাখীকে দেখে কেঁদে ফেলল, রাখী এ তোর কী হয়েছে- আর নয়, চল্ তুই আমার সঙ্গে।

আব্বা পেছনে দাঁড়িয়ে শুধু দুচোখ মেলে তাকিয়ে দেখলেন ছোটমেয়েকে। কী দেখছিলেন রাশেদ সাহেব, তিনিই জানেন। সম্ভবত মৃত্যুশয্যায় শায়িতা স্ত্রীর চেহারা তাঁর মনের মধ্যে চকিতে জেগে উঠে থাকবে। রাখীর কাছে এসে বসেছিলেন তখন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ‘দিচ্ছিলেন। রাখীর মনে হচ্ছিল, আব্বা হয়তো পুরনো স্বরে ডেকে উঠবেন, কী হয়েছে রাখীবাঈ। কিন্তু আব্বা কিছুই বললেন না। চেয়ে চেয়ে চারপাশ দেখে গেলেন। জামানের কথা জিজ্ঞেস করলেন। রাখীর ভীষণ কষ্ট হল, কেন আব্বা বুবুর মতো কেঁদে উঠলেন না। যদি কেঁদে উঠতেন, তাহলে রাখী বাঁচত, আর স্বস্তি হত।

জামান এল একটু পরেই। বলা যায়, অসময়ে এল হঠাৎ। রাখী শুধাল, আজ যে এত শিগগির?

জামান সেকথার জবাব না দিয়ে রাশেদ সাহেবকে দেখল, বুলুকে দেখল। কাছে এগিয়ে শ্বশুরের পায়ের কাছে ঝুঁকে সালাম করল।

রাশেদ সাহেব জামানের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। দেখে আঁচ করতে চেষ্টা করলেন, কোথাও কিছু হয়েছে কি না। বড় ভয় তাঁর, একটুতেই আজকাল ভয় পেয়ে যান। জামানের চোখের ভিতরে কোনোকিছু গোপন অপরাধের ছায়া দেখতে পাওয়া যায় কি না, তাই খুঁজলেন, মনে-মনে যাচাই করলেন তার কথাবার্তা। শেষে বললেন, রাখীর এমনি অবস্থা, না-জানানোটা ঠিক হয়নি।

জামান মাথা তোলে না। বিব্রত বোধ করছে সেটা বোঝা যায়। বলল, আমি প্রথমদিনই খবর দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু রাখীর এত লজ্জা যে- রাশেদ সাহেব জামানের কথা অবিশ্বাস করতে পারেন না। সত্যিই তো, এসব ব্যাপারে মেয়েদের দারুণ লজ্জা হয়। স্ত্রীর কথা মনে পড়ে সেই মুহূর্তে। তাঁর নিজেরও তো সঙ্কোচ হয়েছিল অন্যের কাছে খবরটা জানাতে। শেষে বললেন, রাখী বরং এখন আমার ওখানে গিয়ে থাকুক কিছুদিন।

জামান কী বলবে। তার কিছুই বলা উচিত নয় সে জানে। স্ত্রীর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে আঁচ করতে চায়। তারপর মৃদুস্বরে বলতে চেষ্টা করল— এখনই কী দরকার, আরো কিছুদিন যাক, তারপর নাহয়–।

এরপর রাশেদ সাহেব জামানের স্কলারশিপের কথা, রিসার্চের কথা এইসব শুনতে লাগলেন।

আর এদিকে ঐসময় আব্বাকে আড়াল করে দুবোন পেছনের বারান্দায় গিয়ে বসেছে। বুলু একসময় বলল, রাখী তুই চল্, আর এখানে নয়। তোর শরীরের দিকে যে আর তাকানো যায় না।

রাখী কথা বলে না। শেষে বুলু জানাল, তোকে আমি নিয়ে যাবই।

কোথায়? রাখী যেন অবাক হয়।

কেন, আমার কাছে, বাড়িতে।

রাখী বলল, না।

বুলু আবার ডাকে, রাখী একা থাকা উচিত নয় তোর। এসময়ে অন্তত-

রাখী তবু বলে, না।

বুলুর চোখে তখন পানির উচ্ছ্বাস। কথা বুজে আসতে চায়। তবু শুধায়, কেন রাখী? কেন?

রাখী বলতে চায়নি। কোনোদিন বলতে চায়নি। কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে, কী যে হয়। কথাগুলো যেন তার মুখ দিয়ে আপনা থেকেই বেরিয়ে আসে। সে ইচ্ছে করেনি, তবু বেরিয়ে আসে। বলতে বড় কষ্ট হয়, তবু বলে, ও- বাড়িতে আর আমাকে যেতে বোলো না বুবু। ওখানে গেলে আমি মরে যাব। আব্বার দিকে দেখলে, তোমার দিকে দেখলে আমার ভয়ানক কষ্ট হয়। আমার ছেলে ও-বাড়িতে গেলে সত্যিই বাঁচবে না। তোমাদের মরণ দেখবার জন্যে আমাকে ও-বাড়িতে আর যেতে বোলো না। ঐ কথা শোনার পর বুলু আর দাঁড়াতে পারে না। রাখীর তখন মনে পড়ছিল মনি ভাই মারা যাবার পরের দিনগুলোর কথা। কান্না নেই, দীর্ঘশ্বাস নেই, কেবলি স্তব্ধতা— গভীর, বিপুল আর নিঃশব্দ স্তব্ধতা। আব্বা আর বুবু চলে যাবার পর রাখীর বুকের ভেতরে যেন সেই দিনের মতো স্তব্ধতা জুড়ে বসল।

রাখীর বুকের ভেতরকার সেই স্তব্ধতা যেন তার চারদিকেও ছড়াতে লাগল। রাখী যখন হাঁটে, তখন আজকাল আর সাড়া জাগে না। মনে হয়, ছায়া হাঁটছে। রাখীর কথা বলতে ইচ্ছে করে না- প্রয়োজনেও না, অপ্রয়োজনেও না। জানালার পাশে বসে সময় কেটে যায়। জামান ঘরে এলে যে কাছে এগিয়ে যাবে, এমন উদ্যম থাকে না। একেক দিন রাখী নিজেকেই শুধায়, রাখী এ-ই কি তুই হতে চেয়েছিলে? রাখী মনের ভেতরে খুঁজে খুঁজে দেখে। কোনো জবাব পায় না। হ্যাঁও না, নাও না। তখন আবার নিজেকে বলে, জীবন এরকমই তা কি তুই জানতিস না?

জামান দূর থেকে দেখে আর দূর থেকেই সরে যায়। রাখীকে একেকবার ভারি গম্ভীর দেখতে পায়। মনে হয়, ওর সঙ্গে কথা বলতে গেলেই যেন কী একটা ভয়ঙ্কর অন্যায় হয়ে যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *