তিন
তবে ঐ পিকনিকের ঘটনা যেন ফাটিয়ে দিল সবকিছু। যা কিছু ভেতরে রাখা ছিল, গোপনে রাখা ছিল, সবকিছু একসঙ্গে ফেটে পড়ল।
পোস্টার পড়ল, এঞ্জিনিয়ার এবং ঢাকার অধ্যাপিকার প্রেমলীলা চলবে না। দুশ্চরিত্রা অধ্যাপিকার অপসারণ চাই। ছাত্রীদের চরিত্র নষ্টকারীদের শাস্তি দাও। কলেজের দেয়াল ছেয়ে গেল পোস্টারে। এবং মেয়েদের প্রায় অর্ধেক কলেজে এল না। এস.ডি.ও. প্রিন্সিপ্যাল আর রাখীকে ডেকে পাঠাল। গেলে লম্বা একখানা অভিযোগপত্র মেলে ধরল সামনে। তাতে অনাচারের নানান বানানো কাহিনী বর্ণনা করে ঢাকার অধ্যাপিকা এবং প্রিন্সিপ্যালের অপসারণ চাওয়া হয়েছে।
নিজামউদ্দিন শেষে জানাল, বুঝতেই পারছেন, অবস্থা কতদূর গড়িয়েছে। এরপর তো আমাকে অ্যাকশন নিতেই হবে।
প্রিন্সিপ্যাল গম্ভীর হলেন। বললেন, ঠিক আছে, আপনি অ্যাকশন নিন। আপনি কিছু বলবেন? নিজামউদ্দিন রাখীর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল। রাখী মাথা নাড়াল, না, কিছু বলার নেই আমার।
আমি অবশ্যি আপনার ব্যাপারে ট্যাল করতে পারি, নিজামউদ্দিন চেয়ারে হেলান দেয়। তারপর থেমে থেমে বলেন, যদি আপনি আমার কথামতো চলেন।
রাখী এই কথার পর আর লোকটার সামনে বসে থাকতে পারল না, সে উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে প্রিন্সিপ্যালও উঠে পড়লেন। রাখীকে বললেন, চলো, একসঙ্গেই যাচ্ছি। তারপর এস.ডি.ও.’র দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি জানেন এইসব গোলমাল পাকানোর পেছনে কারা আছে, কিন্তু আপনি তাদের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশনই নিচ্ছেন না- কেন নিচ্ছেন না, সেটা আমরা জানি। কিন্তু জেনে রাখুন, ব্যাপারটা অত সোজা নয়।
ঐদিনই রাখী বুঝে নিল, এ শহর থেকে বাস উঠতে তার আর দেরি নেই। সে ঢাকায় চিঠি লেখে— সুমিরে, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও অন্য কাজ করে না, আমার দশা হয়েছে তা-ই। শিগিরই বোধহয় ঢাকা ফিরছি। এখানে আমার বিরুদ্ধে মেলা অভিযোগ। যাওয়ার আগে টেলিগ্রামে খবর দেব।
মেয়েরা এসে দেখা করে যায়, সঙ্গে থাকে মায়েরা ভাইয়েরাও। কেউ কেউ বলে, খবরদার যাবেন না। এস.ডি.ও.’র বাপের কলেজ যে তাড়িয়ে দেবে? ইতিমধ্যে কৈফিয়ত তলব করা হয়েছে, রাখী সে চিঠির জবাব দেয়নি। জানানো হয়েছে, দুসপ্তাহের মধ্যে জবাব না দিলে শাস্তি দেয়া হবে। প্রিন্সিপ্যাল বলেছেন, দিক শাস্তি, যদি ক্ষমতা থাকে।
মাঝখানে অভিভাবকদের একটা সভাও হয়ে গেল, অল্পবয়সী কিছু ছেলে একদিন দুপুরবেলা একটা মিছিলও বার করল।
আর ঠিক একসময় একখানা চিঠি পেল রাখী। চিঠিটা হাতে নিয়ে রাখীর কথা সরে না মুখে। সেজানের লেখা চিঠি। ছোট্ট, কিন্তু রাখীকে আমূল কাঁপিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট— তুমি মেয়েদের কলেজে এসেছ জানি, গোলমালের খবরটাও পেলাম। তুমি চলে যেও না, কিংবা রিজাইন কোরো না- কোনোক্রমেই না। প্রিন্সিপ্যালকে বলো কেেজর ডোনার্স কমিটির একটা মিটিং ডাকেন যেন তাড়াতাড়ি। আমি যদি ইতিমধ্যে ওদিকে যাই, তাহলে দেখা হবে। একটু সাবধানে থেকো।
রাখী চিঠিটা পড়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইল। বাইরের গাছপালায় তখন ঝিলিমিলি শীতের রোদ। বহুদূরে একটা চিল ঘুরে-ঘুরে উড়ছে। তার মনের ভেতরে
অসংখ্য পুরনো কথা একসঙ্গে তোলপাড় করে উঠল। আর কান্নায় ছাপিয়ে উঠতে লাগল— জীবন এত নিষ্ঠুর কেন? স্মৃতি কেন মানুষকে ছাড়ে না। বুবুর শেষ কথাগুলো মনে পড়ে গেল, রাখীরে আমাকে বাঁচা, আমাকে মরে যেতে দিস না। আব্বা কেমন আছেন? আব্বা কি রাখীর কথা মন থেকে মুছে ফেলেছেন একেবারে? নইলে দুমাস হয়ে গেল চিঠির উত্তর আসে না কেন? প্রথম দুমাসের দুখানা চিঠি পেয়েছিল— কিন্তু তারপর চুপ কেন আব্বা?
রাখী সেদিন চুপচাপ ঘরের ভেতরে কাটিয়ে দিল।
প্রিন্সিপ্যালকে চিঠিটা দেখালে রাখীর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর জানতে চাইলেন, তুমি হাসানকে চেনো?
হাসান? রাখীর অনুমান হল সম্ভবত সেজানের কথাই বলছেন। বলল, সেজান সাহেব বোধহয় এ এলাকায় হাসান নামে পরিচিত?
আমি ঠিক জানি না, হতে পারে। ঠিক এই ধরনের চিঠি আমার কাছেও এসেছে। চিন্তা কোরো না, দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে। ডোনারদের মিটিং সামনের সপ্তাহেই হচ্ছে। এস.ডি.ও. সাহেবকে আমি দেখে নেব। আর এইসব ভণ্ড ধার্মিকদের কতদূর মুরোদ, সেটাও দেখা যাবে।
রাখীর অবাক লাগে আজকাল। আজকাল মানে এইতো ক’টা দিন। কিন্তু ঘটনাগুলো ভয়ানক দ্রুত ঘটে যাচ্ছে বলে মনে হয়। কোত্থেকে সব ছেলেরা এসে যাচ্ছে- প্রিন্সিপ্যালের চিঠি নিয়ে দশ মাইল বারো মাইল রাস্তা একদিনে পাড়ি দিয়ে আসছে। হুমায়ুন তার জিপখানা ড্রাইভারসুদ্ধ প্রিন্সিপ্যালের কাছে দিয়ে রেখেছেন। আর আশরাফও সুযোগ বুঝে ট্যুর করে বেড়াচ্ছে সারা মহকুমা। প্রিন্সিপ্যাল জানেন ষড়যন্ত্রটার চেহারা কীরকম। আসলে রাখী একটা ছুতো, তাঁকে সরানোটাই আসল উদ্দেশ্য। তিনি এককালে তেভাগা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, হুমায়ুন ন্যাপের সমর্থক। কলেজ করে একটা ভুল তো হয়েছেই— এখন মেয়েদের কলেজটাও দাঁড়িয়ে গেলে ঘর বাহির দুইই করিম মাস্টার আর হুমায়ুনদের হাতে চলে যাবে। প্রাইমারি ইস্কুল মাস্টারের মেয়ে মুখোমুখি ঝগড়া করবে উকিল সাহেবের বউয়ের সঙ্গে, এরকম হওয়া কি ঠিক?
প্রিন্সিপ্যাল সাহেব প্রতিপক্ষের মনোভাবটা অনুমান করার চেষ্টা করেন।
রাখীর এমনিতে কিছুই করার নেই— যা করবার হুমায়ুন আর প্রিন্সিপ্যাল সাহেবই করছেন। রাখী জানে, তাঁরা যা করছেন তা কিন্তু তার নামের কুৎসা প্রচারের বিরুদ্ধে নয়। তাদের চেষ্টাটা গভর্নিং বডি যে প্রিন্সিপ্যালকে টাকা দেয়া বন্ধ করেছেন তার বিরুদ্ধে, প্রিন্সিপ্যালকে যে অপসারণের নোটিশ দেওয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে। রাখীকে হয়তো চলেই যেতে হবে। কিন্তু তবু রাখী কলেজের ঘটনাগুলোর সঙ্গে নিজেকে না-জড়িয়ে পারছে না। জাহানারা একেক দিন রাখীকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। সে মহকুমার মেয়েদের স্বাক্ষর সংগ্রহের কাজ আরম্ভ করেছে। তার ইচ্ছে, স্বাক্ষর সংগ্রহ হয়ে গেলে আবেদনসুদ্ধ শিক্ষামন্ত্রীর কাছে পাঠাবে।
সেদিন একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল ফিরতে। দেরি এমনকিছু নয়, আটটা আর কী এমন রাত। রিকশটা ব্রিজের কাছে গিয়েছে, ঠিক ঐসময় কয়েকজন লোক তাকে থামাল। একজন বলল, শুনুন আপনি বাড়াবাড়ি করছেন, এখানে কেউ আপনাকে চায় না- ভালোয় ভালোয় এখান থেকে চলে যান, না হলে ফল খুব খারাপ হবে।
রাখীর তখন বোঝা হয়ে গিয়েছে, কারা তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। কায়দাটা এতই পুরনো যে রাখীর না-বোঝার কারণ ছিল না। সে ডাইনে বাঁয়ে নজর ফিরিয়ে দেখল, চারদিকে অন্ধকার এবং ভয়ানক নির্জন। বেশ ভয়ই করে উঠল বুকের ভেতরে। পেছনে একজন অশ্লীল ভাষায় টানা কথা বলে যাচ্ছিল- অত ভদ্রতা কিসের, নামিয়ে আন্ না মাগীকে, শুধু এঞ্জিনিয়ার কেন, ওর ছেনালি আমরাও একটু দেখে নিই। শালী দেমাক দেখায়, জানে না কোন্ জায়গায় এসেছে— দে শালীকে টের পাইয়ে।
আরো কী কী সব বলে যাচ্ছিল, রাখীর মাথায় কিছু ঢুকছিল না। গলা শুকিয়ে কাঠ। ঐসময় বোধহয় রিকশঅলাকে ঘুসি মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল। রাস্তার ঢাল থেকে তার চিৎকার কানে আসছিল।
ঠিক ঐসময় একখানা ট্রাক আসে ঐ পথে। আর তাতেই লোকগুলো ব্রিজের নিচ দিয়ে দৌড়ে পালায়।
সেদিন ফিরে আসার পরও অনেকক্ষণ পর্যন্ত আতঙ্কিত বিমূঢ় ভাবটা ছিল। কী করবে, ভেবে পাচ্ছিল না। নির্জন অন্ধকারে হিংস্র জ্বলজ্বলে চোখগুলোকে সে কোনোভাবেই মন থেকে সরাতে পারে না। একেকবার মনে হচ্ছিল, এ জায়গা ছেড়ে তার চলে যাওয়াই বোধহয় উচিত।
কিন্তু ঐ আতঙ্কের ভাবটা দিনের বেলায় থাকল না। দিনের আলোয় চিন্তা করে গোটা ব্যাপারটা সহজভাবে বুঝতে চেষ্টা করল। মনে পড়ল, এইজন্যেই সম্ভবত, সেজান তাকে সাবধানে থাকবার কথাটা লিখেছিল। বুঝল, ভয় পাওয়াটা তার উচিত হয়নি। আসলেই ভয় পাওয়ার কোনো মানে হয় না। নিজের অস্তিত্বকে আগলে রাখবার তো তার কোনো দায় নেই। তাহলে মিছিমিছি বোকার মতো ভয় পাওয়া কেন?
সে তখনও কিছু বলেনি কাউকে। কিন্তু রিকশঅলাটাই সম্ভবত ব্যাপারটা হুমায়ুনের কানে তুলেছিল। ফলে রাখীকে থানা পর্যন্ত যেতে হল। সেখানে শুধু এটুকু বলল যে লোকগুলো স্থানীয় নয়, কথার ধরন তাদের অন্যরকম।
থানার ওসি বয়স্ক মানুষ। তিনি রাখীর বাসায় এসে পরামর্শ দিয়ে গেলেন, আপনি খামোকা কেন এইসব বাজে গোলমেলে ব্যাপারের মধ্যে রয়েছেন- চলে যান এখান থেকে।
রাখী জানে না, কী নাম দেবে তার এই মানসিক অবস্থার। এর নাম বোধহয় জেদ নয়, তার চাইতেও কিছু বেশি। ওসি সাহেবকে সে কিছু বলেনি। কিন্তু জাহানারা তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য এলে সে বলে দিল— না, কোথাও যাব না আমি, নিজের বাসাতেই থাকব। যদি যেতে হয়, তাহলে একেবারে চলে যাব।
কথাটা যে কেমন করে তার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল সে নিজেই বলতে পারবে না। কিন্তু ঐ মুহূর্তে সে খুব সহজভাবেই কথাটা বলে ফেলতে পারল। শুধু বলাই নয়— অদ্ভুত একটা ভাব অনুভবও করল তার নিজের ভেতরে।
জাহানারা রাগ করে ফিরে গেলে রাখী একাকী অনেকক্ষণ বসে রইল ঘরের ভেতরে। সে ঘুরেফিরেই অবাক হয়— ভয় হচ্ছে না কেন তার।
ঐ লোকগুলো আবারও হয়তো চড়াও হতে পারে তার ওপর। তাকে চূড়ান্ত অপমান পর্যন্ত করতে পারে- শরীরের ওপর অত্যাচার করতে হয়তো ওদের বাধবে না। হয়তো মাঝরাতে দরজা ভেঙে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল— তখন? নিজের মনকে সে ভয় দেখায়। কিন্তু মনের ভিতরে কোনো সায় পায় না সে। আসলে তো সে জানে, কারা এসেছিল তাকে ভয় দেখাতে- উদ্দেশ্যটা কী ছিল তাদের, তাহলে? ভয় করার কী আছে। রাখী সারাটা সন্ধ্যা অন্ধকার, অন্ধকারের মধ্যে সেই জ্বলজ্বলে চোখ, রুক্ষ গলার স্বর, অশ্লীল গালাগালি, সব মিলিয়ে গোটা দৃশ্যটা কল্পনা করল। কিন্তু কিছুই হল না। নিজেকে ভয় পাওয়াতে পারল না। সে সন্ধ্যার পর রিকশ চেপে জাহানারাদের বাড়ি গেল, ফিরল রাতের বেলায়, ব্রিজের ঐ জায়গাটায় কিছুক্ষণ রিকশঅলাকে দাঁড়াতে বলল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না।
ভারি অদ্ভুত তো। রাখীর তখন অবাক হওয়ার পালা। নিজের কাছে হাস্যকর হয়ে উঠল ব্যাপারটা। যদি কাউকে বলে, ভাড়াটে গুণ্ডার ধমক খেয়ে সে সাহসী হয়ে উঠছে, তাহলে কি কেউ বিশ্বাস করবে? রাখী নিজের মনে হেসে কূল পায় না।
আসলে কী ঘটেছে তার ভেতরে রাখী তা-ই খুঁজে হয়রান। যুক্তি নেই, ব্যাখ্যা নেই, কারণ পর্যন্ত পাওয়া যায় না- অথচ এরকম একটা ঘটনা ঘটল রাখীর ভেতরে। ভয় দেখবার মতো ভয়ানক আর কিছু নেই। নাকি সে নিজেকে নিয়ে ভাবে না বলে ভয়ের ভাবনাটাও কাটিয়ে উঠল। নাকি সে ভয়টাকে ভালো করে দেখতে চায় বলে ভয়টা পালিয়ে গেল?
রাখী, ধর্ তোকে বিশ্রী রকম অপমান করল। মনে কর্, তোর নামে এমন কুৎসার কথা রটাল, যে কানে শোনা যায় না। ভেবে দ্যাখ্, কেউ তোকে খুন করতে এগিয়ে আসছে। তুই পালাবি না? রাখী নিজের মনেই উত্তর পায়— মান অপমানে আমার কী হবে? সংসারের কাছে তো আমার চাওয়ার কিছু নেই। কুৎসার কথা— কুৎসা কি ইতিমধ্যে কম হয়েছে? আর মরণ? মনি ভাই মরে যায়নি? বুবু কি বেঁচে আছে? আব্বার অবস্থাটাই কি বেঁচে থাকার অবস্থা?
এইসব একাকী চিন্তার পর রাখী নিজের মনের দিকে তাকায় আর অবাক হয়। নিজেকে বলে, রাখী এই কি তুই? আগে কেন তুই এরকম হোসনি। যেদিন তোকে ইভা মরিস অপমান করেছিল, যেদিন তুই জামান আর নার্গিসকে একসঙ্গে দেখে নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলি, যেদিন দেখলি বুবু পাগল হয়ে যাচ্ছে- সেইসব দিনে তো তুই এরকম হতে পারতিস। রাখী আজকাল চিঠি লেখে কম, কিন্তু তবু লেখে। কেননা প্রত্যেক চিঠিতে সুমি জানতে চায়— কবে আসছিস? প্রস্তাব করে ও, ঐ ঘোড়ার ডিম চাকরি না করলে কী হয়— চলে আয় তুই— ও জায়গায় তোর পোষাবে না। রাখী সুমিতার চিঠি পড়ে আর মনে-মনে হাসে। সুমি না বলেছিল, রাখী তুই একটা কিছু কর্। সেই একটা কিছু করার জন্যে পাঠিয়ে এখন নিজেই ফিরে যাবার জন্যে বারবার করে লিখছে। রাখী এখন ফিরে যাবার কথা লেখে না। বরং জানায় তার নানান ঘটনার কথা। লেখে, কখনো তো নিজের পায়ে দাঁড়াইনি-এখানে এসে দাঁড়াতে চেষ্টা করছি। জানিস, ব্যাপারটা কিন্তু বেশ লাগছে। তুই যে কিছু-একটা করার কথা বলতিস- আমার এখন মনে হয়— এটাকেই বোধহয় কিছু-একটা করা বোঝায়। এ এমন একটা ব্যাপার যে তুই নিজেই জড়িয়ে পড়ছিস— আরো মজা কী জানিস- তুই জড়াচ্ছিস নিজের অনিচ্ছায় নয়- একেবারে জেনেশুনে, ভেবে নিজেরই ইচ্ছায়।
সকালবেলার কাজগুলো গুছিয়ে কলেজ থেকে বার হবে, এমন সময় শুনল- ভালো আছেন?
রাখী অবাক, দেবতোষ। সহজ ভঙ্গিতে বলে ফেলল, আপনি? এখানে?
হ্যাঁ, এসে গেলাম, দেবতোষ চেয়ার টেনে বসে। বলে, তাড়িয়ে দেবেন না তো?
পুরনো কথা মনে পড়ে রাখীর। ঈষৎ বিব্রতবোধ করে। কিন্তু জানতে দেয় না। বলে, তেমন কাজ করলে নিশ্চয়ই তাড়াব।
দেবতোষ ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখে। বলে, আপনি যে এখানে এসে ঘাপটি মেরে থাকবেন, কল্পনাও করা যায় না। আপনি তো ডেঞ্জারাস মহিলা মশাই।
তাই বুঝি! রাখী হাসে।
বাহ্ ডেঞ্জারাস নন? কোথায় ঢাকা শহরের ভদ্রলোকের আধুনিকা বউ নয়তো মেয়ে হয়ে থাকবার কথা- আর কোথায় এই অজ পাড়াগাঁয়ে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন— কেউ বিশ্বাস করবে? আপনিই বলুন?
তা আপনি এখানে, এই অজ পাড়াগাঁয়ে? আপনারও তো ঢাকায় গিয়ে থাকবার কথা।
আমি থাকব ঢাকায়? দেবতোষ যেন অবাক হয়।
কেন, ঢাকায় ছিলেন না আপনি? সুমিতাকে চেনেন? সুমিতা বোস? দেবতোষ যেন ধাক্কা খায়। বলে, বোস মশাইকে আপনিও চেনেন? কী কাণ্ড— দুনিয়াটা আসলেই খুব ছোট জায়গা দেখছি।
দেবতোষ প্রসঙ্গ ফেরায়। বলে, ব্যাপারটা কীরকম জানেন? আমি পরশুদিন এক চায়ের দোকানে চা খাবার সময় আপনার নামটা শুনলাম, শুধু নামটা নয়— মেয়েদের কলেজ নিয়ে যে গোলমালটা পাকিয়ে উঠেছে সেটাও কানে এসে গেল। শুনে কেমন সন্দেহ হল, নিশ্চয়ই আপনি। ঢাকায় শুনেছিলাম আপনি নাকি মফস্বলে কোথায় চাকরি করতে গিয়েছেন। তা দেখছেন তো, আমার অনুমান কীরকম ঠিক— এখন কিছু খাওয়ান।
রাখীর বেশ লাগছিল দেবতোষকে। বলল, এখন কি এখানেই থাকবেন? এখানে মানে এই কলেজে?
না, এই শহরের কথা বলছিলাম।
না-না পাগল নাকি, আমার বাড়ি নর্থবেঙ্গল বলেছিলাম বলে ভেবে রেখেছেন এখানেই আমার বাড়ি? ভালো বিবেচনা আপনার। হ্যাঁ- কিন্তু তার আগে দুপুরে ভাত খাব আপনার বাসায়, বিকেলে চা খাব— তারপর।
দেবতোষ সহজভাবে নানা কথা বলতে লাগল। রাখীর ভালোই লাগছিল শুনতে। কিন্তু একসময় মনে হল, দেবতোষের কথায় কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। আরো যেন কী বলবার ছিল, জানবার ছিল। দেবতোষের দিক থেকেও, রাখীর দিক থেকেও। দেবতোষ মজার মজার কথা বলছে, কিন্তু থেকে-থেকেই যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে, সহজ হতে পারছে না। শেষে একসময় দেখল, দেবতোষ কেমন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।
কী হল? রাখী জিজ্ঞেস করতেই সে জানাল, কিছু হয়নি। ভাবছি চলেই যাই— আরেকদিন এসে খেয়ে যাব আপনার বাসায়।
না-না সে কি— রাখী দেবতোষের মুখের দিকে তাকায়। সেখানে চিন্তার রেখা। দেবতোষ বলে, পরশু এসে সোজা চলে গিয়েছিলাম হাসান ভাইয়ের কাছে, সেখান থেকেই ফিরছি।
হাসান ভাই, রাখী সচকিত হল, মানে সেজান সাহেব?
হ্যাঁ, আর বলবেন না, ভদ্রলোক যাচ্ছেতাই কাণ্ড আরম্ভ করে দিয়েছেন, উল্টোপাল্টা কথা বলছেন। আমরা কী করব? ভদ্রলোকের কপালে দুঃখ আছে।
রাখী রাজনীতির ব্যাপারে নাক গলাতে পারে না। কেননা ও-ব্যাপারে তার প্রায় কিছুই জানা নেই। শুধু বলে, আমার কাছে একখানা চিঠি পাঠিয়েছেন-শুনেছি এ এলাকাতেই কোনো এক জায়গায় থাকেন, জানিয়েছিলেন দেখা করবেন, কিন্তু এখনো আসেননি।
দেবতোষ হাসে মুখ নিচু করে। বলে, শরীর খারাপ যাচ্ছে তাঁর, খুব কাহিল দেখলাম।
কী অসুখ? রাখীর গলা বোধহয় কাঁপল একটু।
দেবতোষ পকেট থেকে বার করে সিগ্রেট ধরাল। তারপর বলল, অসুখ সেই পুরনোই-আলসার-এখন বাড়াবাড়ি আরম্ভ হয়েছে। শুনলাম, দুএকদিনের মধ্যেই শহরের কাছাকাছি কোথাও এসে থাকবেন।
মুখোমুখি বসে, কিন্তু রাখীর দৃষ্টি তখন জানলা দিয়ে বাইরে আকাশে গিয়ে পৌঁছেছে। সে নজর না-ফিরিয়েই জানতে চাইল, অসুখটা কি খুবই বাড়াবাড়ি বলে মনে হল?
দেবতোষ মাথা নাড়ায়, বোধহয়। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে। তারপর বলে, বলা মুশকিল, ওঁর সঙ্গে যারা ছিল তারা মুখই খুলল না। তবে চেহারায় যা দেখলাম, তাতে মনে হল, শরীরের অবস্থা বেশ খারাপ। রাখী ভেবে পায় না, কীরকম সম্পর্ক এদের। এত জানাশোনা অথচ ব্যক্তিগত খবরটা পর্যন্ত ঠিকমতো রাখতে পারে না। বলে, আপনি জিজ্ঞেস করলেন না?
দেবতোষ হাসে, কী যে বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলেই কি বলবেন? জিজ্ঞেস তো করলাম, বললেনও এখন ভালো আছি। কিন্তু সেটা যে সত্যিকথা নয়, তা তো নিজের চোখেই দেখলাম।
বাসায় এল দেবতোষ। বসবার ঘরে মাদুর বিছিয়ে শরীর টান করে শুয়ে পড়ল। বলল, আমি একটু গড়াই, খাওয়ার সময় হলে ডেকে দেবেন। রাখীর তখন থেকেই পুরনো কথা মনে পড়ছে। তার হাসপাতালে থাকবার সময়ে সেজান আসত, এসে বসে থাকত মুখোমুখি, গল্প হত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ওর ওপর একেক দিন ভয়ানক রাগ হত। যাচ্ছেতাইভাবে একদিন সে গালাগাল পর্যন্ত করেছিল। কিন্তু তবু লোকটা কেমন যেন ফিরে ফিরে আসে তার জীবনে, নইলে কে ভেবেছিল যে এতদূরে এসেও আবার ঐ লোকের কথাই তাকে ভাবতে হবে।
দেবতোষ ঘুমাল না। রাখী গোসল সেরে বারান্দায় রোদে এসে বসলে আবার নিজের থেকেই কথা বলতে আরম্ভ করল। বলল, হাসান ভাইকে নিয়ে আমাদের অনেক আশা ছিল, জানেন, ওর মতো অনেস্ট লোক খুব কম দেখা যায়। আমরা তরুণরা ওঁর দিকে তাকিয়ে থেকেছি বারবার। কিন্তু কী যেন হল, ঢাকা থেকে চলে এলেন, কিছু বললেন না। এদিকে আমরা নানান গুজব শুনছি। পার্টির মধ্যে দুটো ভাগ ভেতরে ভেতরে ছিলই— যারা ইলেকশান চাইছিল, পার্লামেন্ট চাইছিল, গণতান্ত্রিক ঐক্যের নামে আওয়ামী লীগের মতো দলের সঙ্গে কাজ করতে হবে এইসব কথা সামনে আনছিল, স্ট্র্যাটেজির তত্ত্ব বোঝাচ্ছিল- তাদের আমরা হিশেবের বাইরে ধরে নিয়েছিলাম। বুঝে নিয়েছিলাম- আমাদের আলাদাভাবে কাজ করতে হবে— আগাপাশতলা সংশোধনবাদীদের সঙ্গে আর নয়। কিন্তু হাসান ভাই নতুন গোলমালের মধ্যে ফেলে দিলেন। বললেন, সব নাকি ভুল হচ্ছে। কখনো বলছেন মাসপার্টি থাকবে, মাস আন্দোলন হবে- আবার বিপ্লবী সংগঠনও রাখতে হবে। গণতন্ত্রের কথা বলতে হবে আবার সামন্তবাদের শিকড় ওপড়ানোর কাজ, সাম্যবাদী আগ্রাসনের বিরোধিতার কাজ, দুটো একসঙ্গে করতে হবে। ভাবুন তো, কী বিশ্রী গোলমালের ব্যাপার।
রাখী এইসব কথার অর্থ পুরো বুঝতে পারে না— আগেও কখনো পারেনি। কিন্তু তবু সে কিছুটা মনোযোগী হল। খাবার সময় বলল, আচ্ছা আপনারা খোলাখুলি আলাপ করতে পারেন না?
দেবতোষ মাথা নাড়ায় রাখীর কথা শুনে। বলে, ব্যাপারটা যত সহজ ভাবছেন, আসলে অত সহজ নয়। নিজের যুক্তি সহজে কে ছাড়তে চায় বলুন?
যাবার সময় দেবতোষ বলল, আমি হয়তো আবার আসব, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে ইতিমধ্যে আপনার সঙ্গে হাসান ভাইয়ের দেখা হবে। দেখা হলে একটা কথা শুধু বলবেন- যেন আপাতত নিজের শরীরের দিকে খেয়াল করেন। বলবেন, তাঁর জীবনের অনেক দাম। আমাকে অনেক কথা বলতে বলা হয়েছিল— আমি সেসব কথা তাঁকে বলিনি। তাঁর শরীরের ঐ অবস্থা দেখে আমার সাহস হয়নি।
সন্ধ্যার মুখে দেবতোষ বিদায় নিল।
দেবতোষ চলে গেলে রাখীর নিঃসঙ্গ লাগে নিজেকে। নিজের অতীতের একটুখানি যেন দেবতোষ নিয়ে এসেছিল। তার কাজকর্মের নয়, চিন্তাভাবনার নয়, এমনকি স্মৃতিরও নয়। তবু কোথায় যেন একটা যোগাযোগ ঘটিয়ে দিল দেবতোষ। করুণ বিষাদ নিয়ে পুরনো দিনগুলো বারকয়েক যেন তাকাল তার দিকে। রাখী ভেবে রাখে একদিন সেজানকে সে দেখতে যাবে।
কিন্তু তারপর দুতিনটা দিন রাখী বিশ্রী উত্তেজনার মধ্যে পড়ে গেল।
বিকেলবেলা জাহানারার আসবার কথা ছিল বলে সে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু জাহানারা না এসে এসে গেলেন গভর্নিং বডির দুই মেম্বার। রাখী তো অবাক, এঁরা তার কাছে কেন? প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের কাছে খবর পাঠাল 1 কিন্তু জানা গেল প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বাড়ি নেই। আনোয়ার সাহেব বললেন, ওঁকে আবার কেন, আমরা আপনার কাছেই এসেছি- দু-একটি কথা বলে চলে যাব। খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, এদিকে এসেছিলাম, ভাবলাম দেখা করে যাই।
রাখী চেয়ারের পিঠ ধরে দাঁড়াল, বলুন।
দেখুন, মীর জাহান চৌধুরী আরম্ভ করলেন, লোকে যা-ই বলুক, আমরা কিন্তু আপনাকে ভালো জানি। আপনার কাজকর্ম খুব এনকারেজিং। আপনার মতো লোক যে-কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য অ্যাসেট। কিন্তু আমাদের এ জায়গাটা তো বুঝতেই পারছেন কীরকম। বিশ্রী দলাদলি এখানে। এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে ভালো কাজের স্বীকৃতি পর্যন্ত কেউ দেয় না। আমরা ভাবছি, আপনাকে প্রিন্সিপ্যালের দায়িত্ব দিলে কেমন হয়?
রাখী ঐ পর্যন্ত শুনেই মনে-মনে হুঁশিয়ার হয়ে উঠল। দুজনারই-যে কোনো বদমতলব রয়েছে তা আঁচ করল।
ব্যাপারটা কী জানেন, কলেজটা তো মেয়েদের- মহিলা প্রিন্সিপ্যাল আজ হোক কাল হোক, আমাদের দরকার হবেই— সেজন্যেই আমরা আপনার সম্বন্ধে নতুন করে চিন্তা করছি। করিম সাহেব, মানে আমাদের প্রিন্সিপ্যাল, খুবই ভালো মানুষ— কিন্তু শরীর ভালো যাচ্ছে না তাঁর— এইতো ঢাকা থেকে চিকিৎসা করিয়ে এলেন- কিন্তু এখনো তো পুরোপুরি কর্মক্ষম হতে পারছেন না। আমরা জানি, কীরকম কাজের লোক তিনি— আপনি তাঁকে আর কতটুকু দেখেছেন? এদিকে বয়সও হয়েছে তাঁর। এই অবস্থায় ভবিষ্যতের কথা আমাদের ভাবা উচিত নয়, বলুন?
রাখী ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। ছিপছিপে চেহারা- মাথায় পাট করে আঁচড়ানো চুল। বাদামি রঙের সোয়েটার গায়ে- চোখের ভেতরে ধূর্ত একটা ভাব। থেকে থেকে দরজার দিকে তাকাচ্ছিলেন। রাখীর একবার মনে হল, কেউ এসে না পড়ে সেজন্যেই বোধহয় ঐরকম দরজার দিকে ঘনঘন তাকানো। কিন্তু পরে বুঝল, ওটা অভ্যাস— ওরকম অভ্যাস অনেকের থাকে।
শেষ কথা দুজনে একসঙ্গেই প্রায় বললেন, আপনি রাজি হোন।
রাখী গম্ভীরমুখে ওদের কথা শুনলেও— ভেতরে ভেতরে খুব মজা পাচ্ছিল। দুজনের প্রস্তাব শুনে বলল, আপনারা এ শহরের গণ্যমান্য লোক আর আমি এসেছি চাকরি করতে— এখন আপনারা যদি চান, তাহলে নিশ্চয়ই আমার অমত থাকা উচিত নয়।
এই পর্যন্ত বলে রাখীকে মুখে আঁচল চেপে কেশে উঠতে হল। তারপর কাশি সামলে আবার বলল, কিন্তু আমি রাজি হলেই তো হচ্ছে না ব্যাপারটা। আমার কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছে, তার কী হবে, এস.ডি.ও. সাহেব কী ভাবছেন, সেটাও জানা দরকার।
ও নিয়ে ভাববেন না- ওসবের ব্যবস্থা আমরা করব। এস.ডি.ও. সাহেব কে? কলেজ আমাদের, আমরা যা ভালো বুঝব, তাঁকে তাতেই রাজি হতে হবে।
মীর জাহান বললেন, ওসব টেকনিক্যাল ব্যাপার আমরা ভেবে রেখেছি। যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, সেসব যদি অস্বীকার করেন, তাহলে কিন্তু সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে— লোকের কাছে তাহলে গভর্নিং বডির মুখ থাকছে না। সেক্ষেত্রে একটা উপায় হচ্ছে, আপনার দোষ স্বীকার করে মাফ চাওয়া। কিন্তু সেটা আমরা আপনাকে বলব না। আপনার পার্সোনালিটির একটা ব্যাপার আছে। আর মিছিমিছি দোষ স্বীকার করতেই বা যাবেন কেন? ভদ্রঘরের মেয়ে না আপনি? চাকরিটাই কি সব? আমরা সেকথা বলি না। একটা খুব সহজ উপায় বার করেছি আমরা। খুব ভালো হয় যদি আপনি রিজাইন করেন। আপনি রিজাইন করলেন, তারপর আমরা আপনাকে আরো কিছুদিন কাজ করার জন্য অনুরোধ করলাম। আপনি থেকে গেলেন-
ব্যস্, থাকলেন তো- এবার আনোয়ার সাহেব বোঝাতে আরম্ভ করেন, বলেন, ইতিমধ্যে, ধরুন মাস দুয়েক, করিম সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অসুস্থ তো হবেনই উনি— সেই সময় আপনার চার্জে থাকবার কথা— আর ঐসময়ই একদিন-
ভদ্রলোক দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে রাখী হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায় না। এঁরা কি তাকে ছেলেমানুষ ভেবেছেন? সে রাগল না, বরং খুব বিগলিত ভাব দেখাল। বলল, হ্যাঁ ঠিক আছে, ব্যাপারটা ভেবে দেখার জন্য সময় দিন- আমার তো মনেই হচ্ছে আপনাদের পরামর্শটাই ঠিক— এইসব বলে দুজনকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল।
মেম্বার দুজনের আসবার খবর সে প্রিন্সিপ্যালকে জানাল। কিন্তু কোনোরকম উত্তেজনা প্রকাশ করল না। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব অবশ্যি খুশি হলেন। রাখীর মতো তিনিও বুঝলেন, ডোনার্স মিটিঙের ফলাফলটা কী হবে, আঁচ করেই ঐ দুই চামচা মেম্বার রাখীকে ভোলাতে এসেছিল।
মিটিঙের আগের দিন, রাখী তখন কলেজে, ঐসময় একটি মেয়ে কাছে এল, আপা একটা কথা।
রাখী তার দিকে মনোযোগী হলে জানাল, আপনি শফিউদ্দিন মোল্লা আর শিবনাথবাবুর সঙ্গে আলাপ করবেন, হাসান ভাই বলে দিয়েছেন।
রাখী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখল। শান্ত, অল্পবয়সী মেয়ে— একটু দূর থেকে হেঁটে কলেজে আসে। ক্লাসে ভারি চুপচাপ। রাখীর খুব অবাক লাগছিল, ঐ মেয়ে সেজানের খবর বয়ে নিয়ে এসেছে বলে। মেয়েটি চলে যাচ্ছিল। রাখী ডাকল, এই শোনো, কী নাম যেন তোমার?
মেয়েটি হাসে। বলে, রোকেয়া- রোকেয়া খাতুন।
ওমা, আমার নামটা যে দেখছি তোমারও। রাখী খুব আন্তরিক হয়ে উঠতে চাইল, বলল, তোমাদের বাড়ি কি অনেক দূর?
না তো, রোকেয়া অপ্রতিভ হয় না। বলে, এই তো স্টেশনের ওপারে।
রাখীকে বিস্ময় মানতে হয়। স্টেশন এখান থেকে তিন মাইলের ওপরে। এই রোগা পাতলা মেয়ে এতখানি রাস্তা রোজ যাওয়া-আসা করে। সে বলে, আমাকে একদিন নিয়ে যাবে?
আপনি যাবেন? রোকেয়ার যেন বিশ্বাস হতে চায় না।
বাহ্, কেন যাব না, তুমি বলে দ্যাখো, বলেছ কখনো?
রোকেয়া লজ্জা পায়। রাখী প্রসঙ্গ ফেরায়। জানতে চায়, হাসান সাহেব তোমাদের বাড়ির কাছেই থাকেন তাহলে?
হ্যাঁ, একেবারে কাছে, জমিদারের পুরনো একটা কাছারি বাড়ি আছে-
সেই বাড়িতে থাকেন?
রাখীর প্রশ্ন শুনে রোকেয়া নিজের ভুল শুধরায়। বলে, না সবসময় থাকেন না- আমাদের এদিকে যখন আসেন, তখন থাকেন।
তাঁর নাকি অসুখ?
রোকেয়ার মুখের হাসিটুকু এ প্রশ্নে আর থাকে না, বলে হ্যাঁ, এবার অসুখ নিয়ে এসেছেন। পরশুদিন ডাক্তার এসেছিল।
রাখী আর কিছু জিজ্ঞেস করে না। হেসে বলে, তাহলে কবে যাব আমি বলো?
রোকেয়া কী যেন হিশেব করে। তারপর বলে, পরশু।
কেন, পরশু কেন? আজ নয় কেন?
রোকেয়া অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বলে, হাসান ভাই তো আজ নেই, শিবগঞ্জ গেছেন, পরশু ফিরবেন, তাই-
তার মানে তোমাদের বাড়িতে নয়- হাসান ভাইয়ের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাও-
রোকেয়া তাড়াতাড়ি জিভ কেটে বলে ওঠে, না না, তা নয়— ও কথা আমি বলিনি।
ঐসময় প্রিন্সিপ্যালের ঘর থেকে ডাক আসাতে রোকেয়ার সঙ্গে আলাপটা আর এগুল না। রাখী গিয়ে দেখে প্রিন্সিপ্যালের সামনে বসে আছেন বয়স্ক এক ভদ্রলোক। পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর রাখীকে বললেন, জেলা শহর থেকে এসেছেন তোমার সেই ঘটনাটার ব্যাপারে।
রাখী প্রথমটা বুঝতে পারেনি। পরে বুঝল, সেই গুণ্ডাদের তার রিকশ থামানোর ব্যাপারটা এখনো গড়াচ্ছে। ভদ্রলোক বললেন, আমাকে কিছু খবর দিতে হবে।
রাখীকে তারপর ঐ ঘটনাটার বর্ণনা দিতে হল। তারপর কী কী হয়েছে, সেসবও যতটা জানে বলতে হল। এমনকি আনোয়ার সাহেবরা যে রিজাইন করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল তার কাছে সেকথাও সে বলল। এস.ডি.ও. সাহেবের সঙ্গে কী কথা হয়েছিল সেটাও সে লুকাল না। ভদ্রলোক শুনলেন। নোট নিলেন। তারপর উঠে যাবার সময় বললেন, আমরা কিছু লোককে ধরেছি— চিনতে পারবেন?
রাখীর সন্দেহ হয় নিজের ওপর। বলে, না অসম্ভব, কারো চেহারাই ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না।
ভদ্রলোক জানিয়ে গেলেন যে ব্যাপারটা তাঁর হাতে যখন পড়েছে, তখন একটা কিছু হেস্তনেস্ত করে তবে ছাড়বেন।
রাখীর মগজে ঢোকে না-কী যে হবে। ভীষণ গোলমেলে ব্যাপার।
ডোনার্স কমিটির মিটিঙের দিন একে একে ডোনার্স কমিটির মেম্বররা সবাই এলেন। নিজামউদ্দিনকে দেখা গেল খুব ব্যস্ত। আনোয়ার সাহেব একবার এদিক যাচ্ছেন, একবার ওদিকে যাচ্ছেন। মীর জাহান চৌধুরী সিগ্রেট বিলি করে যাচ্ছেন প্যাকেটের পর প্যাকেট। এদিকে প্রিন্সিপ্যালও নেই, হুমায়ুনও নেই। রাখী কী করবে ভেবে পায় না। বেয়ারাকে দিয়ে শিবনাথবাবুর খোঁজ করতে পাঠাল। শিবনাথবাবু তখনও আসেননি, কিন্তু নিজে থেকেই এলেন শফিউদ্দিন মোল্লা। বললেন, শিবনাথ আমাকে আপনার কথা বলেছে— আপনি কিছু ভাববেন না। শহরের পলিটিক্সের ঢোল এবার আমরা ফুটো করে দিয়ে যাব দেখবেন। প্রিন্সিপ্যাল সাহেবকে শুধু শক্ত থাকতে বলবেন- এস.ডি.ও.’র ধমকে যেন এদিক-ওদিক না করে ফেলেন।
একটু পরই আবার রাখীর নাম ধরে খুঁজতে খুঁজতে এলেন শিবনাথ। বয়স্ক ভারিক্কি লোক। ভয়ানক পান চিবুচ্ছেন। এসেই বললেন, কী খবর কমরেড- ভয় পাননি তো।
রাখী অবাক। চেনা নেই জানা নেই হঠাৎ ঐরকম সম্বোধন। সে কিছুটা অপ্রস্তুত হল। বলল, না, না, ভয় কেন পাব।
হ্যাঁ, ভয় পাবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে, শফিউদ্দিনের সঙ্গে তো দেখা হয়েছে শুনলাম। কলিমউদ্দিন চৌধুরী আসেনি।
রাখী চেনে না কে এই কলিমউদ্দিন চৌধুরী। বলল, আমি তো ঠিক চিনি না-
ও চেনেন না, ঠিক আছে— বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। রাখী ডাকল, শুনুন, আপনার সঙ্গে আমার কিছু আলাপ ছিল।
শিবনাথবাবু তাঁর গমগমে গলার স্বর ঘরময় কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন। বললেন, আরে হবে, আলাপ পরে— সব জানি আমি। আপনার কাছে টিংটিঙে আনোয়ার আর মীর জান গিয়েছিল, তাই না? তাহলেই বুঝুন আমার কাছে সব খবর আছে— আলাপের কোনো দরকার নেই।
মিটিঙে বড়জোর শ’খানেক লোক আসবার কথা। কিন্তু দেখা গেল, কলেজের মাঠে, রাস্তায় মানুষ ভিড় জমিয়ে ফেলেছে। হুমায়ুন জিপ চালিয়ে এল একসময়। রাখীকে বারান্দায় দেখে বলল, জাহানারার কাণ্ড দেখবেন এখন।
কী কাণ্ড, রাখী বুঝতে পারে না।
দেখবেন এক্ষুনি, বলে হাসতে হাসতে হুমায়ুন মিটিঙের ঘরে চলে গেল। তো দেখল রাখী। কাণ্ডই বটে— একেবারেই অকল্পনীয়- একখানা লজ্ঝড় বাস— যে বাসখানা তিন মাইল স্টেশনের পথ পাড়ি দিতে তিনবার বিকল হয়ে পড়ে— সেই বাসভর্তি মেয়েরা স্লোগান দিচ্ছে : কলেজ বন্ধ চলবে না, ষড়যন্ত্র বন্ধ করো। শিক্ষার অধিকার দিতে হবে।
একেবারে অভিভূত হয়ে পড়বার মতো ব্যাপার।
রাখী আর জাহানারা যখন দরজায় গিয়ে দাঁড়াল, তখন আনোয়ার সাহেবের বক্তৃতা শেষ হয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে কী বলেছেন তা ধরা গেল না। শেষের কথায় শুধু জানা গেল যে, কলেজ ঠিকমতো চলছে না। প্রিন্সিপ্যাল চালাতে পারছেন না— এ অবস্থায় এত টাকাপয়সা খরচ করে কলেজ চালানোর পেছনে কোনো যুক্তি নেই।
শফিউদ্দিন উঠলেন তারপর। উঠেই জানতে চাইলেন, প্রিন্সিপ্যাল সাহেব জবাব দিন, কলেজের ফান্ডে কত টাকা ছিল।
পঞ্চাশ হাজার।
শহর থেকে কত টাকা চাঁদা উঠেছিল?
কুড়ি হাজার।
বেশ ভালো কথা, তাহলে শুনলেন, ফান্ডের অবস্থা, কার কত দান তাও জানলেন। এখন বলুন, কলেজ চলবে কি চলবে না, এ ব্যাপারে শহরের লোকেরাই কি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন?
শফিউদ্দিন সাহেবের বলবার ধরন খুব নাটকীয়, তিনি আবার আরম্ভ করলেন, প্রিন্সিপ্যাল সাহেব জবাব দিন, আপনার ছাত্রী কতজন?
একশোর মতো।
প্রথম ব্যাচে কতজন পরীক্ষা দেবে?
তিরিশ জন।
কলেজের বিল্ডিং আছে।
আছে।
লাইব্রেরি?
আছে।
টিচার?
আছে।
অ্যাফিলিয়েশন আছে?
আছে।
তাহলে আপনার কলেজ বন্ধ হওয়ার প্রশ্ন উঠছে কেন?
টাকা পাই না, গভর্নিং বডি টাকা দিচ্ছেন না।
টাকা কেন দেবেন না, টাকা কি গভর্নিং বডির বাপের?
নিজামউদ্দিন ভয়ানক রেগে উঠল এই কথায়। বলল, গালাগালি করবেন না, করলে মিটিং বন্ধ করে দেওয়া হবে।
আচ্ছা গালাগালি করব না, শফিউদ্দিন সভাপতির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তারপর বললেন, কিন্তু গালাগাল দেওয়ার মতো একটা পরিস্থিতি এখানে তৈরি করা হয়েছে। আমরা আমাদের মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্যে বহু কষ্টের টাকা এখানে দিয়েছি— কারো ফোঁপর দালালি দেখানোর জন্যে নয়। যদি দেখি, যে একশো জন মেয়ে দুবছর পড়াশোনার পর পরীক্ষা না দিতে পারে, বছরের মাঝখানে একশো মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়— তাহলে কী করা উচিত বলুন? গালাগালি তো তুচ্ছ কথা। বলুন আপনারা, কী ইচ্ছে হয় আপনাদের?
মেম্বারদের মধ্যে তখন বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। শিবনাথবাবুর গলা শোনা যাচ্ছে। চিৎকার করে বলছেন, কলেজের টিচারের ওপর গুণ্ডার হামলার বিচার হয় না কেন?
শফিউদ্দিন কিছুক্ষণ গোলমালটা চালাতে দিলেন, তারপর দুহাত তুলে আবার নিজেই থামালেন। বললেন, আপনারা শান্ত হোন। আমরা গভর্নিং বডির কাছ থেকে শুনি, কী কারণে তাঁরা কলেজের টাকা বন্ধ করেছেন। বলুন গভর্নিং বডির মেম্বাররা, কেন টাকা দেওয়া বন্ধ করেছেন?
গভর্নিং বডির পক্ষ থেকে নিজামউদ্দিন জানাল, প্রিন্সিপ্যাল ডিসিপ্লিন রাখতে পারে না, টিচাররা বেহায়াপনা করে। আপনারা কি চান, আপনাদের মেয়েরা বেহায়াপনা শিখুক?
ঠিক আছে, শফিউদ্দিন চিৎকার করলেন আবার, জানি মিথ্যেকথা এসব। তবু মানলাম। কিন্তু টিচারদের বেহায়াপনার জন্য কলেজ কেন বন্ধ হবে? কলেজের কাজ কেন বন্ধ থাকবে? আপনারা টিচার বদলান, নতুন টিচার আনুন, কিন্তু কলেজ কেন বন্ধ করে দেবেন? এ আপনাদের ষড়যন্ত্র। আপনারা বলুন, এই ষড়যন্ত্র বন্ধ করবেন কি না। যদি বন্ধ না করেন, তাহলে আমরা এই প্রকাশ্য সভায় স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্ৰস্তাব গ্রহণ করব। দেখব ষড়যন্ত্র বড় না সত্য বড়।
শফিউদ্দিনের জোরালো বক্তৃতাটা শেষের দিকে আর শোনা গেল না। ঐসময় রাস্তার দিক থেকে— ধর্ ধর্, পালাচ্ছে, শালারা পালাচ্ছে- এইরকম রব শোনা গেল। জাহানারা রাখী দুজনেই দেখল এবং চিনল। আনোয়ার সাহেব রাস্তা দিয়ে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে পালাচ্ছেন।
হুমায়ুনও বারান্দায় বেরিয়ে এসেছিলেন মজা দেখতে। রাখীতে দেখতে পেয়ে বলল, কেমন লাগছে ম্যাডাম?
রাখী হাসল, এত কাণ্ড করেছেন আপনারা!
এ আর কী দেখছেন, এক্ষুনি আরো দেখবেন, মজা কাকে বলে। তো রাখী ঐ মজাটা চাক্ষুষ দেখতে পেল না। কেননা নিজামউদ্দিন কীরকম চাপা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চেক সই করল, সই করার সময় শিবনাথবাবু কী কী মন্তব্য করলেন, শফিউদ্দিন মোল্লা ওদিকে মীর জাহান চৌধুরীর ভুঁড়িতে কীরকম লোক দেখিয়ে দেখিয়ে হাত বোলালেন— এসব ঘটনা ঘটল রাখীর চোখের আড়ালে। তবে সম্মিলিত হাসির আওয়াজটা ঠিকই কানে এসেছিল। যাবার সময় নিজামউদ্দিন দাঁতে দাঁত চেপে বলে গেল— আই’ল সী য়ু অল।
হুমায়ুনও শুনিয়ে চিৎকার করে বলল, হ্যাঁ আমরাও দেখব। জিনিস তো কম দেখলাম না।
মিটিং শেষ হয়েও শেষ হতে চাইছিল না। সবাই এখানে-ওখানে জটলা করছে। থেকে-থেকে হা হা শব্দে হেসে বারান্দা কাঁপিয়ে দিচ্ছেন শিবনাথবাবু। জাহানারা মেয়েদের বলছে, এই মেয়েরা কাল থেকে সবাই কলেজে আসছ তো? সবাই আসবে কিন্তু। হুমায়ুন বলছে, আশরাফটা এল না, এমন মজার ব্যাপারটা মিস করল।
রাখীর কানে সব কথা আসছিল। আর মনে হচ্ছিল, এইসব এলোমেলো কথার মধ্যে সেও আছে। তার খুশির সঙ্গে, ইচ্ছের সঙ্গে, তার প্রতিটি নিশ্বাস পতনের সঙ্গে যেন কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কেমন যেন মনে হচ্ছে— কোথায় কী একটা জেগে উঠে ক্রমেই বিশাল থেকে বিশালতর হচ্ছে। ঐ মুহূর্তে বুকের ভেতরে কোথায় যেন তার কষ্ট হতে লাগল। রাখীর অবাক লাগে— এই কি জীবন তাহলে? সংসারের স্রোতে আর স্পন্দনে একাকার হয়ে থাকা, ঘটনার সঙ্গে মিশে যাওয়া, ইচ্ছের ওপর সওয়ার হয়ে সম্মুখের দিকে এগিয়ে চলা— এরই নাম কি জীবন? পালানো নয়, পাশ কাটানো নয়, ভয় পাওয়া নয়— শুধুই শক্তপায়ে দাঁড়ানো, একেই তাহলে জীবন বলে? তার জন্য প্রিন্সিপ্যাল আছেন, শফিউদ্দিন আছেন, শিবনাথ আছেন, জাহানারা আছে, এমনকি ছোট্ট শান্ত মেয়ে রোকেয়া, সেও আছে। রাখী আকাশটাকেও এখন মুখোমুখি দেখতে পায়, বাতাসের শব্দও শুনতে পায়, মনে হয় বিশাল অন্ধকার প্রান্তরটা একেবারেই তার নিজের।